ব্যক্তিগত সুখ পর্ব-০১

0
474

#ব্যক্তিগত_সুখ
লেখিকা সুরিয়া মিম
পর্ব- ১

– “আপনি কি সিঙ্গেল?” মেয়েটি হঠাৎ ক্রেতার এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– “কেন? বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন না কি বাড়িতে?” ভদ্রলোক তখন মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
– “আপনার ঠিকানা টা?”
– “মোহম্মদপুর, সেকেরটেক, আদাবর, ঢাকা।” ভদ্র লোক তারপর হাসতে হাসতে চলে গেলেন দোকান থেকে। আশেপাশে সবাই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো….
মেয়েটি তখন জিজ্ঞেস করলো,
– “কি ব্যাপার? তোমরা সকলে এভাবে কেন তাকিয়ে আছো আমার দিকে?” তখন লিরা মিটিমিটি হেসে বললো,
– “মনে হচ্ছে, মিম আপু। ওই লোক টা না ক্রাশ খেয়ে -ছে তোমাকে দেখে।”
– “মানে কি? কিছু একটা বলে দিলেই হলো?” তখন নিরা ও মিটিমিটি হেসে বললো,
– “মনে হচ্ছে,সমাজ সেবা করতে এসে এবার আমার প্রিয় বান্ধবীর বিয়ে টা হ’য়ে যাবে।” মিম তার কথা শুনে হাসতে লাগলো, বললো,
– “নিরা তোদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। যাগগে, সেসব কথা। আজকে যত টাকার সেল হয়েছে তা দিয়ে কিন্তু পথশিশুদের এক রাতের খাবার এ্যারেঞ্জ করা যাবে।”
– “আর বাকি টাকা?”
– “নিরা তুই বাবাকে তো চিনিস? তাকে বলেছিলাম, তিনি খুশি হ’য়ে এই ভালো কাজের জন্য আমাকে
পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে।”
– “সত্যি বলতে আঙ্কেলে’র মতোন মানুষ হয় না। তুই অনেক ভাগ্য করে এমন একটা বাবা পেয়েছিস। জানিস,
যে কিনা তার মেয়েকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে।”
মিম তার কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো,
– “হয়েছে তোর? দেখ, আমি বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি। দেরি হয়ে গেলে কিন্তু আবার আমার মহান মা জননী কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ফেলবেন বাড়িতে।”
– “হুমম, বুঝলাম৷ কিন্তু, তুই তোর ঠিকানা টা কেন দিতে গেলি ওই অপরিচিত লোকটাকে?” রনিত বলল,
– “হুমম, সেটাই। এখন যদি উনি সত্যি সত্যিই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায় তোদের বাড়িতে?”
– “আরে ধুরর,তোরাও পারিস বটে। ওনার কি খেয়ে কোনো কাজ নেই?
উনি কি একবারও বলেছে, যে উনি বিয়ে করতে চান আমাকে? তোদের যত বাজে কথা। এখন আমি আসছি। বাকি কাজগুলো সে’রে নিস, জানি তোদের খুব কষ্ট হবে।”
– “তবুও বোন, ওই লোকটা তোর দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিলো। ওনার ভাবভঙ্গি, চোখের চাওনি যেন অন্য কিছু বলছে?” মিম ভেংচি কেটে তাদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
– “তোদের সেই এক কথা। আমি আসি? কাল দেখা হচ্ছে।”
তখন দুপুর দু’টো, মিম চোরের মতো পা টিপে টিপে প্রবেশ করছে বাড়িতে। হঠাৎ আচমকা হালিমা এসে মেয়ের সামনে দাঁড়ালেন। তিনি মেয়েকে দেখে হাসি মুখে বললেন,
– “মা জননী আপনার সমাজসেবা কর্ম শেষ হয়েছে?
মিসেস হালিমা কে এতো শান্ত দেখে চমকে গেলো মিম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– “কি হলো মা?
তুমি নিজের ঠিক মতো যত্ন নিচ্ছ না। চোখের নিচ টা কেমন যেন কালো কালো হয়ে গেছে?” মায়ের এমন কথায় যেন আকাশ থেকে মিম। তিনি বললেন,
– “ফেইস প্যাক বানিয়ে রেখেছি, আজ সারাদিন শুধু রূপ চর্চা হবে।” মায়ের কথায় কিছু টা ভড়কে গেলো মিম, সে জিজ্ঞেস করলো,
– “আবারও কোনো পাএ পক্ষ দেখতে আসছে না কি আমাকে?”
মেয়ের কথায় হঠাৎ থতমত খেলেন মিসেস হালিমা। তিনি বললেন,
– “দেখতে এলেই বিয়ে হয়ে যায় না মা আর আমি সেটা কি করে বোঝাই তোমাকে?”
– “তুমি আর আমাকে বোঝাতে এসো না মা৷ আমি আমার লেখাপড়া শেষ না করে কিছুতেই বসছি না বিয়ের পিড়িতে।” মেয়ের কথায় কিছু টা রেগে গেলেন হালিমা, তিনি বললেন,
– “তুমি কি কখনো বাবা-মায়ের মনের অবস্থা বুঝবে না? হুমম?
সারা জীবন অন্ন ধ্বংস করে যাবে বাপের বাড়িতে বসে বসে?”তখন ফাইজান সাহেব সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে স্ত্রী কে ঝাড়ি মে’রে বলে উঠলেন,
– “মুখ সামলে কথা বলো, হালিমা। তোমার বাবার মতো আমি কখনো বোঝা বলে মনে করিনি আমার কন্যা কে….।
আর কি যেন বলেছিলে? অন্ন ধ্বংস করার কথা,তাই না? আমার মেয়ে কারো অন্ন ধ্বংস করেনি এটা তার হক, ঠিক আছে? আর তুমি আমার অনুমতি ছাড়া আমার মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কে? ওর অভিভাবক আমি আমার মেয়ের বাবা এখনো ম’রে যায়নি, তিনি এখনো জীবিত আছে।” মিম পরিস্থিতি সামাল দিতে দু’জন কেই চুপ করিয়ে দিলো। ফাইজান সাহেবকে বললো,
– “বাদদেও না বাবা, কোনো ব্যাপার না ইট’স ওকে। আর মা তুমি যেন কি বলেছিলে?
ফেইস প্যাক বানিয়েছ? চলো না,আজ সারাদিন শুধু রূপ চর্চা হবে।
তবে হ্যাঁ, পাএ যেই হোক না কেন পছন্দ না হলে কিন্তু আমি না করে দেব মা। তুমি অযথা রাগারাগি করতে পারবেনা আমার সাথে।” হালিমা মেয়ের কথায় স্বস্তি ফিরে পেলেন, এদিকে মিম ঘরে এসে ফেইস প্যাক মেখে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর দ্বীপ্ত গিয়ে বোনকে ডেকে তুললো।
হালিমা মেয়ের জন্য তার পছন্দের মাছ দিয়ে ভাত মাখিয়ে নিয়ে বসে আছে। আধ ঘন্টা পর, মিম ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসলো, হালিমা মেয়েকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন,
– “ছেলে টা দেশের নাম করা বিজনেসম্যান। সে তোমাকে হয়তো কোনো এক জায়গায় দেখে পছন্দ করেছে?” সাথে সাথে মিম চিন্তায় পরে গেলো। তবুও সে মনেমনে বলে উঠলো,
– “এ যেই হয়ে থাক না কেন আমার কাছ থেকে রিজেক্ট হয়ে ফিরে যাবে।” তিনি মেয়ের মাঝে কোনো ভাবান্তর না দেখতে পেয়ে মুচকি হেসে বললেন,
– “একটু পরেই তোমাকে পার্লার থেকে একটা মেয়ে সাজাতে আসবে মা। ওকে বলেছি তোমাকে পার্টি মেক-ওভার করিয়ে দিতে।”
– “কেন? কেন? এই না বললে আমাকে কোথাও এক টা দেখে পছন্দ করেছে। তাহলে কেন আমায় আটা ময়দা মেখে ওনাদের সামনে যেতে হবে?”
হালিমা একটু ইতস্তত বোধ করতে লাগলেন,বললেন,
– “আসলে তোমার গায়ের রং রেষা এবং নয়নের থেকে একটু চাপা তো?
তাই আমার একটু দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে।” রেষা তখন রেগে গিয়ে বলে উঠলো,
– “তুমি কি পাগল মা?” মিম হাসতে হাসতে বললো,
– “বাদদেও না আপু, তোমাদের মতো রূপবতী হতে পারিনি বলে মায়ের আমাকে নিয়ে এতো জ্বালা সেটা আমি কি করে বোঝাই তোমাদেরকে?” নয়ন ভেংচি কেটে বলে উঠলো,
– “মা ভুল কি বলেছে মেঝো আপু?
এর আগেও তোমাকে দেখতে এসে লোকে আমাকে পছন্দ করেছে।” ইসাত রেগে গিয়ে বলে উঠলো,
– “টেনে মারবো এক চড়,বড়দের কথার মাঝে তোকে নাক গলাতে কে বলেছ?
শোনো মা,আমার বোনের জন্য ভালো ছেলের অভাব হবে না। তোমাকে দয়া করে এতো নাটক করতে হবে না ঠিক আছে?” বড় ছেলের কথা শুনে হালিমা মাথা নিচু করে রাখলো, মিম বললো,
– “লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারলে আমি আর কখনো পরে থাকবোনা বাড়িতে।”
মেয়ের কথা শুনে হালিমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো তিনি বললেন,
– “তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না মা? তোমার বড় আপু দুলা ভাইয়ের সাথে কত টা সুখে আছে?” মিম তার মুখের ওপরেই বলে উঠলো,
– “সে সব লোক দেখানো মা। আর হ্যাঁ, আমি যেমন তেমনই নিজেকে প্রেজেন্ট করবো পাএ পক্ষের কাছে
তাদের আমাকে পছন্দ হওয়া না হওয়া নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
আশা করছি এতক্ষণে বুঝে গেছো আমার উওর কি হবে?” মেয়ের কথা শুনে, ঠায়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন হালিমা। সন্ধ্যায় ছেলের বাড়ি থেকে ছেলের বাবা-মা এবং ছোটো বোন দেখতে চলে এলো মিমকে। মিমের কথাবার্তা চাল-চলন তাদের ভীষণ পছন্দ হল, তারা ছেলেকে ফোন করে বললেন,
মেয়ের জন্য কিছু উপহার কিনে নিয়ে ও বাড়িতে যেতে। আধঘন্টার মধ্যে ভদ্রলোক ও বাড়িতে পৌঁছে গেলো….। মিম বেশ চমকে গেলো সেই ভদ্রলোক কে দেখে। সকালেই তার সাথে দেখা হলো আর সে কিনা এখন তার বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে পৌঁছে গেছে? এবার আজমির সাহেব মুখ খুললেন, তিনি হাসিমুখে বললেন,
– “আমাদের আপনার মেয়েকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে”
মিম তার কথা শুনে বলে উঠলো,
– “আমাকে পারলে ক্ষমা করে দেবেন আঙ্কেল। আমি চাইনা এখুনি বিয়ে-থা করতে। নেহাৎ, মা জোরাজুরি করলো তাই।
নাহলে আমি কখনো এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতাম না আপনাদের কাওকে।”তখন মিসেস এমা
হেসে উঠলেন, তিনি বললেন,
– “মা তোমার কথাবার্তা প্রথমেই আমাদের মন ছুঁয়ে গেছে৷ যা বুঝলাম, তুমি স্পষ্ট ভাষী। কিন্তু, আমাদের ছেলে বলেছে সে বিয়ে করলে শুধু মাএ তোমাকেই করবে।
এখানে আমাদের পছন্দ হলো ভিন্ন কথা ছিলো, কিন্তু আমার ছেলেটা বোধহয় গত ছয়-সাত ধরে’ই তোমার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছে?” মিম এবার কিছু টা চিন্তিত হয়ে পরলো, তবুও সে বললো,
– “দেখুন আন্টি,
আমার মনে হয় না যে আমাকে দেখে পাগল হওয়ার মতোন কিছু আছে। আমি এতো টা আবেদনময়ী নই
আকর্ষণীয় নই। মনে হচ্ছে, আপনাদের রাজপুত্রের মাথা টা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে।”
ভদ্রলোক এবার হেসে উঠলো, তিনি সরাসরি হালিমা এবং ফাইজান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো,
– “আমি কি আলাদা ভাবে কথা বলতে পারি ওনার সাথে?” মিম সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলো, সে নিজের ঘরে যেতে যেতে বলে উঠলো,
– “অসম্ভব, আপনারা পারলে ক্ষমা করে দেবেন আমাকে।”
ভদ্রলোক অস্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো, মিম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। হালিমা রেগে গিয়ে মেয়েকে দুষতে লাগলেন।
ভদ্রলোক চলে যাওয়ার আগে বললেন,
– “আন্টি, আপনি দয়া করে ভুল বুঝবেন না ওনাকে। প্রতিটি মানুষ আলাদা, হয়তোবা তার কোনো নিজস্ব পছন্দ আছে?
আর হ্যাঁ, ওনার জন্য আমি খুঁজে খুঁজে কিছু ইউনিক গিফট কিনেছিলাম। আশাকরি, আপনি এই জিনিস গুলো পৌঁছে দেবেন তার হাতে।
তবে হ্যাঁ, তাকে আমার ব্যাপারে জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই। মা হয়ে আপনি তাকে না বুঝলে কে বুঝবে তাকে?”
ভদ্রলোকের কথায় হালিমার রাগ কিছু টা কমে গেল এই কাহিনির প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে মিম একদিন টি.এস.সি’র মোড়ে অনেক অনেক বেলুন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ সে খেয়াল করে দেখলো কিছুটা দূরেই সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে।
তার পাশে অসম্ভব সুন্দরী এক রমনী দাঁড়িয়ে, মিম কেন যেন অনেক স্বস্তি পেলো ভদ্রলোককে হাসিখুশি দেখে হঠাৎ সেই ভদ্রলোক তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো, মিম এতে ভয় পেয়ে বেলুন নিয়ে ছুট লাগাল সামনের দিকে। ভদ্রলোক নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো, বললো,
– “যাক, তাহলে এখনো ভুলে যায়নি আমাকে?”

চলবে।