তুমি কেন আগে আসোনি? পর্ব-১৬

0
702

“তুমি কেন আগে আসোনি?”

১৬.
রান্নাঘরের কাজ ফেলে রুমে দৌড়ে এলো অপ্সরা। মেয়েটা কাদছে সেই কখন থেকে। কেউ ধরছেই না। অপ্সরা বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো সায়ান প্রেমের আলাপ জুড়েছে তার নতুন প্রেমিকার সাথে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। মেয়েটা সায়ানের নয়। এখানে আসার আগে অপ্সরার আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো একজন ফরেনারের সাথে। বিয়ের এক বছরের মাথায় মানুষটা মারা যায়। অপ্সরা একেবারেই ভেঙে পরেছিলো। সেই মুহুর্তে সায়ান এসেছিলো ওর জীবনে। প্রাক্তন প্রেমিক ছিলো বিধায় ওর বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেন সায়ানের সাথে অপ্সরার বিয়ে দিবেন।

বিয়েটা ঠিক হওয়ার দুইদিন আগে সায়ান সিনথিয়াকে ডিভোর্স দিয়ে অপ্সরাকে বিয়ে করে নেয়। তখনও বুঝতে পারেনি যে অপ্সরার ভেতরে নতুন একজন সদস্য বেড়ে উঠছে। এখানে আসার পর যখন ছয় মাস চলছিলো প্র‍্যাগনেন্সির তখন গিয়ে বুঝতে পেরেছিলো। সেদিন থেকেই মা, ছেলের অত্যাচারের পরিমাণ দেখেছে অপ্সরা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে সায়ানের আচরণে। প্র‍্যাগনেন্সির সময়ও ওর কামভাব পূরণ করতে একটুও ছাড় দেয়নি। এতোটা জালিম এই লোক। অপ্সরার চোখ থেকে কয়েক ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো। সেটা মুছে মেয়েকে দোলনায় শুইয়ে দিয়েছে। ঘুমিয়ে গেছে বাবুটা। মেয়েটা ওর বাবার মতো হয়েছে।

কোমড়ে চাপ পরতেই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো অপ্সরা। সায়ান ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েও পারলো না। এই লোকটার সংস্পর্শে আসলে ঘৃণা হয় ভিষণ। অপ্সরা কিছুটা রেগে বললো,

— “সায়ান ছাড়ো আমাকে। এতোটা পাষাণ কেনো তুমি? মেয়েটা কাদছিলো তারপরেও ধরলে না?”
— “কেনো ধরবো? ও কি আমার মেয়ে নাকি? পরের মেয়ের জন্য এতো দরদ দেখাতে ভালো লাগেনা।”
— “সায়ান তুমি সব জেনেই আমাকে বিয়ে করেছিলে।”
— “তখন কি জানতাম নাকি তোমার সাথে এই আপদটাও ফ্রি পাবো।”
— “সায়ান!!!!!”
— “চিৎকার করো না তো। কাছে আসো।”
— “যদি ওর বাবা মারা না যেতো তাহলে তোমার মতো জালিম, চরিত্রহীন লোককে কখনোই বিয়ে করতাম না। আমার সাথে এতোটা করছো। না জানি সিনথিয়ার সাথে কতটা করেছিলে।”
— “উফ এতো কথা ভালো লাগছে না। এখন মুডে আছি। মুড খারাপ করো না। নাহলে আজ তোমার সহ্যসীমা অতিক্রম হবে।”
— “কেনো এমন করছো? প্লিজ একটু তো রহম করো আমার উপর।” ভাঙা গলায় বললো।
— “আরে আসো তো বেডে।”
— “কেনো তোমার মিম ভাবি বুঝি এখন টাইম দিতে পারছে না? সেদিন দুজনে মিলে সিনথিয়াকে কি অপমানটাই না করলে। শেষ পর্যন…। আহ!”

সায়ানের হঠাৎ আক্রমণে অপ্সরা চুপ হয়ে গেলো। গালটা জ্বালা করতে লাগলো। গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো নোনাপানি। একটা মানুষ এতোটা নির্দয় এবং জালিম কি করে হতে পারে অপ্সরা ভেবে পায়না। সায়ান ছোট্ট বাবুটাকে কোলে নিয়ে বললো,

— “ফেলে দেই?”
— “সায়ান কিসব বলছো? ও একটা দুধের বাচ্চা। প্লিজ ওকে এসবে এনো না।”
— “আর যদি মুখ চালাও তো…।” সায়ান বাবুকে ফেলে দেয়ার উপক্রম করতেই অপ্সরা কেঁদে দিয়ে বললো,
— “না না প্লিজ সায়ান। আমার মেয়েকে কিছু করো না। আমি আর কখনো কিছু বলবো না।”
— “গুড।”

অপ্সরা মেয়েকে কোলে নিয়ে একটু আদর করে দোলনায় শুইয়ে দিলো। সায়ান হেচকা টানে অপ্সরাকে বিছানায় ফেলে দিলো। ওর উপর চড়ে বসলো। নিজের কামভাব মিটাতে মিটাতে বললো,

— “জানো সিনথিয়ার কোন দিকটা আমার ভালো লাগতো? ওর বোবা স্বভাবটা। যাই করতাম সবসময়ই বোবা হয়ে থাকতো। বেশ মজাও পেতাম।”

অপ্সরা চোখ বন্ধ করে নিলো। সায়ান জানোয়ারের মতো ব্যবহার করছে। এক সময় শরীরের ভার ছেড়ে দিলো অপ্সরা। তলিয়ে গেলো গভীর অন্ধকারে। অপ্সরার সহ্যশক্তি সিনথিয়ার মতো নয়। যার কারণে প্রায় সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সায়ানের জানোয়ারের মতো আচরণে। আজও তাই হলো।

.
মধ্যরাত। অপ্সরা উঠে বসলো। ড্রিম লাইটের আলোতে ঘরটা আবছা আলোকিত হয়ে আছে। দোলনায় চোখ পরতেই দেখলো মেয়েটা হাত, পা নাড়ছে। অপ্সরা উঠে দোলনার পাশে গেলো। মেয়েটা নিজে নিজেই হাসছে আর হাত, পা নেড়ে খেলা করছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলো অপ্সরা। খুব ভালোবাসে মেয়েটাকে। মানুষটাকে সে খুব ভালোবাসতো। তার শেষ স্মৃতি এই ছোট্ট জানটা। পুরো মুখে অসংখ্য চুমু দিলো অপ্সরা। ও চায়না এখানে থেকে নিজের মেয়েটারও ওর মতো করুন পরিণতি হোক। যেভাবেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে।

রুমে এসে খুব সাবধানে সায়ানের মোবাইলটা উঠিয়ে নিলো। বারান্দায় গিয়ে নিজের মায়ের নাম্বারে ফোন দিলো। সায়ান ওর ফোনটা ভেঙে ফেলেছে অনেক আগেই। আর নতুন ফোন কিনে দেয়নি। কারণ এরা চায়না এদের আসল রুপ কেউ জানুক। তাইতো বন্দীর মতো করে রেখেছে অপ্সরাকে। মায়ের ফোনে কয়েকবার রিং পরার পর অচেনা একজন রিসিভ করলো। অপাশ থেকে সবটা শুনে অপ্সরা মেঝেতে ধপ করে বসে পরলো। চোখ থেকে অশ্রুকণা ঝরে পরছে বাধাহীন ভাবে। এখন সে কোথায় যাবে? এখান থেকে পালিয়ে কোথায় আশ্রয় নিবে? অপ্সরার একমাত্র ভরসার জায়গা সেই বাবা-মা যে ফ্যাক্টেরিতে আগুনে পুড়ে মারা গেছে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে অপ্সরা।

অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়েছে। তবে যাইহোক এদের মতো জালিমদের সাথে আর থাকা সম্ভব না। কি করবে, কোথায় যাবে এসবই ভাবতে লাগলো অপ্সরা। তখনই মনে পরলো এখানে ওর একজন মামা আছেন। হুম, তার কাছেই যাবে। মামার বাসায় গিয়ে সায়ানকে প্রথমে ডিভোর্স দিবে। তারপর কোথাও চাকরি পেলে মেয়েকে নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ছোট একটা ব্যাগে নিজের একজোড়া কাপড়, মেয়ের প্রয়োজনীয় সব নিয়ে ব্যাগটা লুকিয়ে রাখলো। আগামীকাল সুযোগ বুঝেই এখান থেকে পালাবে।

.
সারাদিন কাজের ফাকে অল্প সময় পেয়েছে মেয়েকে খাওয়ানোর। বান্দীর মতো খাটায় এখানে এরা। অপ্সরা অল্পতেই হাপিয়ে যায়। এসব কাজ করে অভ্যস্ত নয় তাই। বাবা-মায়ের ননীর পুতুল ছিলো সে। কখনো কাজ করায়নি। আর এরা? ইদানীং তো সায়ান যখন তখন গায়ে হাত তুলে। আগে এমনটা করেনি। হুট করেই এই পরিবর্তন হয়েছে। অপ্সরা ভাবতে লাগলো ওর বাবা-মায়ের মুত্যুর খবর নিশ্চয়ই সায়ান জানে। এখন তো কোনো গার্জিয়ান নেই ওর। তাই এখন ওকে টর্চার করলেও কেউ ওর পক্ষে বলবে না। এইজন্যই হয়ত এমন করে।

দুইমাস আগেই অপ্সরা জানতে পেরেছে সিনথিয়ার বড় ভাবি মিমের সাথে সায়ানের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া আরো অনেক মেয়ের সাথেও সায়ানের সম্পর্ক আছে। প্রথম প্রথম কষ্ট পেয়েছে। এসব নিয়ে ঝগড়া করেছে। এখন আর কিছু বলে না। বলে লাভও নেই। তাছাড়া এখন এসব নিয়ে কিছু বললে উল্টো মার খেতে হয় অপ্সরার।

সারাদিন সুযোগ খুজেছে পালিয়ে যাওয়ার কিন্তু পায়নি। সন্ধ্যায় সায়ান এলো। ওকে দেখেই অপ্সরার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। কেমন করে তাকাচ্ছে। ওর হাসিটা দেখলে অন্তর আত্মা কেপে উঠে অপ্সরার। যেদিন এভাবে হাসে সেদিনই অপ্সরার জন্য কাল হয়েছে। সায়ান অপ্সরার চারপাশে ঘুড়ে ঘুড়ে বললো,

— “পাখি বুঝি খাঁচা থেকে পালাতে চাইছে?”

অপ্সরা ভয়ে কেপে উঠে। ভাবছে সায়ান কি করে জানলো? মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। ওর উপর রেগে গিয়ে না জানি মেয়ের ক্ষতি করে বসে। আচমকাই সায়ান গাল চেপে ধরলো অপ্সরার। হিসহিসিয়ে বললো,

— “বেশ সাহস বেড়েছে তোর তাইনা? পালাতে চাইছিস আমার খাঁচা থেকে? কিন্তু পালাতে তো তুই পারবি না। এখানেই থাকতে হবে তোকে। আমার রক্ষিতা হয়ে।”
— “ছাড়ো আমায়। তোমার মতো জানোয়ারের সাথে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।”
— “তাহলে মরে যা।”

কথাটা বলেই হাত উঠালো অপ্সরার গায়ে। চড় মেরেছে সায়ান। মনে হচ্ছে যেনো কাঠ দিয়ে বাড়ি মেরেছে গালে। ভনভন করে ঘুড়তে লাগলো অপ্সরার চারপাশ৷ সায়ানের বেধড়ক মারের কারণে লুটিয়ে পরেছে মেঝেতে। আজ জ্ঞান হারায়নি অপ্সরা। সায়ান হাপিয়ে গিয়ে সোফায় বসেছে। অপ্সরা কোনোরকমে উঠে। মেঝে থেকে মেয়েকে কোলে নিলো। মেয়েটা চিৎকার করে কাদছে। বিছানার পাশের ড্রয়ারের উপর থেকে ফুলদানি নিয়ে ছুড়ে মারলো সায়ানের দিকে। নিশানা বরাবরই পরেছে। সায়ান আর্তনাদ করে উঠলো। এই সুযোগে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

অনেকটা পথ দৌড়ে এসেছে অপ্সরা। দাঁড়িয়ে গিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। কোন রাস্তায় এসেছে জানা নেই ওর। চারিদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনা যাচ্ছে। সামনে থেকে একটা মোটরসাইকেল আসতে দেখে অপ্সরা সেদিকে ছুটলো। দাঁড়িয়ে গেলো মোটরসাইকেলের সামনে। মোটরসাইকেলে বসা লোকটা তাড়াতাড়ি ব্রেক কষলো। আরেকটু হলেই এক্সিডেন্ট হয়ে যেতো। লোকটা কিছু বলবে তার আগেই অপ্সরা বলে উঠলো,

— “জাভেদ ভাই আপনি?”
— “আপনি কে? আমাকে কিভাবে চিনেন?”
— “আমি.. আমি অপ্সরা। সায়ানের বউ। আমাকে একটু সাহায্য করুন প্লিজ।”
— “মানে? এতোরাতে আপনি এখানে কেনো?”
— “প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করুন। আমি খুব বিপদে পরেছি।”

জাভেদ কাজ শেষ করে বাসায় যাচ্ছিলো। পথিমধ্যেই অপ্সরার সাথে দেখা হলো। জাভেদ দুশ্চিন্তায় পরলো। বারবার মনে হচ্ছে এটা কোনো ফাঁদ। সায়ান যেই ধুন্ধুর পাবলিক। নিশ্চয়ই এখন বউকে লেলিয়ে দিয়েছে। জাভেদ কিছু বলবে তার আগেই অপ্সরা কেঁদে বললো,

— “ভাই দয়া করুন আমার উপর। আমার এখানে থাকাটা মোটেও সুবিধার নয়। যেকোনো সময় সায়ান এসে যাবে। একবার যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায় তো ও আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলবে। আর আমার সাথে কি করবে সেটা আমার জানা নেই।”

জাভেদ এবার ভালো করে তাকালো অপ্সরার দিকে। মুখে মারের চিহ্ন স্পষ্ট। ঘোমটা দেয়ার কারণে যদিও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। কোলে বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটা চিৎকার করে কাদছে। জাভেদ এবার কিছুটা নরম হলো। বললো,

— “আপনার এ অবস্থা কেনো?”
— “সব পরে বলবো। আমাকে প্লিজ এখান থেকে নিয়ে চলুন।”
— “কোথায় যাবেন?”

অপ্সরা ঠিকানা বলতেই জাভেদ বললো,

— “ওহ! আমাদের বাসাও ওইদিকেই। আচ্ছা উঠুন আপনি।”

অপ্সরা তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। এমনভাবে বসলো যাতে জাভেদের গায়ের সাথে একটুও না লাগে। মেয়েকে শক্ত করে চেপে ধরেছে বুকের সাথে। রাত এগারোটায় পৌছুলো তারা অপ্সরার মামার বাসায়। জাভেদদের বাসা শহর থেকে দূরে। কিছুটা গ্রাম এরিয়া এদিকটা। এখানে এগারোটা মানে অনেক রাত।

ঘরে বেল বাজানোর কিছু সময় পর দরজা খুললো মাঝ বয়সি এক লোক। অপ্সরার দিকে তাকিয়ে আতকে উঠে বললো,

— “অপ্সরা এই অবস্থা কেনো তোর? আর উনি কে?”
— “সব বলছি। আগে বাসায় ঢুকতে দাও মামা।”
— “হ্যাঁ আয় আয়।”

জাভেদও ঢুকে সোফায় বসলো। এরমধ্যে অপ্সরার মামি এসে উপস্থিত হয়েছে। অপ্সরাকে দেখেই মৃদু চিৎকার দিয়েছে। জাভেদও বুঝতে পারছে না বিষয়টা। পানি খেয়ে কিছুটা শান্ত হলো অপ্সরা। মেয়েকে ঘুম পারিয়ে মামা-মামির পাশে রুমে শুইয়ে দিলো। উনাদের ছেলেমেয়ে নেই। একাই থাকে এতবড় বাড়িতে। অপ্সরা এবার সবার সামনে বসলো। একে একে সব খুলে বললো।

সিনথিয়ার সাথে ঘটা প্রতিটা ঘটনাও খুলে বললো অপ্সরা। এমনি ওর মিচক্যারেজ এর ব্যাপারটাও বললো। জাভেদ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে ছিলো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো যে, সিনথিয়ার সাথে এতোটা জুলুম করেছে সায়ান এবং ওর মা। সবশেষে অপ্সরা বললো,

— “ভাইয়া সিনথিয়া সুখ খুবই কম পেয়েছে। তাই আপনাকে বলবো ওর ব্যাপারে কেউ কিছু বললে বিশ্বাস করবেন না। ওকে সুখে রাখুন। আগলে রাখুন এবং ভালোবাসুন।”
— “হু! ধন্যবাদ। আমাকে সব জানানোর জন্য।”

অপ্সরা মলিন হাসলো। জাভেদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

— “আজ আসি। কোনো দরকার হলে ফোন দিবেন।”

জাভেদ নিজের দোকানের একটা কার্ড এগিয়ে দিলো। অপ্সরার মামা-মামি থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো।

_____________________________
দরজার টোকা পরতেই তড়িঘড়ি করে দরজা খুললো সিনথিয়া। এতোক্ষণ অপেক্ষায় ছিলো প্রিয় মানুষটার। জাভেদ ঘরে ঢুকে এক পলক সিনথিয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটার মুখে মৃদু হাসি। জাভেদ জানে এখনো খায়নি মেয়েটা। এতোক্ষণ ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলো।

জাভেদের তোয়ালে, টাউজার, গেঞ্জি এগিয়ে দিলো সিনথিয়া। সেগুলো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। সিনথিয়া একটু চিন্তায় পরেছে। প্রতিদিন বাসায় আসলে লোকটা খুব দুষ্টুমি করে। আজ এতো নিরব কেনো? কিছু হয়েছে কি?

জাভেদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো সিনথিয়া শরবতের গ্লাস নিয়ে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে জাভেদকে জিজ্ঞেস করলো,

— “কিছু হয়েছে কি? আপনাকে কেমন বিষন্ন দেখাচ্ছে।”

জাভেদ কিছু বললো না। শরবত খেয়ে সিনথিয়ার দিকে তাকালো। হঠাৎই মনে পরলো সেদিন অযথাই চড় মেরেছিলো মেয়েটাকে। সিনথিয়াকে বুকে টেনে নিয়ে কেঁদে ফেললো জাভেদ। সিনথিয়া হতভম্ব। কি হলো কিছুই বুঝলো না। সিনথিয়া মাথা তুলে জাভেদের দিকে তাকিয়ে বললো,

— “কি হয়েছে আপনার? কাদছেন কেনো? কোনো বিষয়ে কি কষ্ট পেয়েছেন?”

জাভেদ কিছু বললো না। আরেকটু শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরলো সিনথিয়াকে। বারবার শুধু অনুতপ্ত হচ্ছে সেদিনের ঘটনার জন্য। আচমকা চড় মারায় মেয়েটা একদম বোবা হয়ে গেছিলো। সিনথিয়াও চুপ করে রইলো। মনে হাজার প্রশ্ন উকি দিচ্ছে। জাভেদ মোলায়েম কণ্ঠে বললো,

— “তোমার মিচক্যারেজ হয়েছিলো তাইনা?”
সিনথিয়া চমকালো। চমকে বললো,
— “আপনি কিভাবে জানলেন? এসব কে বলেছে আপনাকে? আমার বাসার কেউ তো এসব জানে না।”
— “এতোটা কষ্ট চেপে রেখেছিলে নিজের মধ্যে? আমাকে একটু জানালেও না।”
— “এম..এম…নি।”
— “আমি ভাবতাম আমার কষ্ট বেশি। ভালোবাসার মানুষটা বিট্রেয় করে ছেড়ে চলে গেছে এরচেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে আমার কারণটা নিতান্তই তুচ্ছ ছিলো। তোমাকে দেখে অবাক হচ্ছি সিয়া। শুধুমাত্র দীনের উপর অটল থাকার কারণে এত অত্যাচার সহ্য করেছো। সবার অমানবিক অত্যাচার মেনে নিয়েছো। আর আমি…।”

সিনথিয়া মুখ নামিয়ে রেখেছে। জাভেদ এখনো আলিঙ্গনের মধ্যে দিয়ে সিনথিয়াকে তার প্রশস্ত বক্ষে চেপে ধরে রেখেছে। অনেকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সিনথিয়া মুখ তুলে বললো,

— “আপনি এসব কিভাবে জানলেন?”
— “অপ্সরার সাথে দেখা হয়েছিলো। সেই-ই বলেছে।”
— “এত রাতে?”

সিনথিয়া খানিকটা অবাক হলো। জাভেদ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সিনথিয়াকে চিন্তিত লাগছে। চিন্তিত স্বরে বললো,

— “অপ্সরা কি কোনো বিপদে পরেছে? আমার মনে হচ্ছে ওরা অপ্সরার সাথেও জুলুম করেছে। কিন্তু ওরা তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো।”
— “ভালোবাসা না ছাই। সায়ানের স্বভাবই হলো মেয়েদের নিয়ে ড্যাটিং করা। শালা চরিত্রহীন একটা। অপ্সরার স্বামী মারা যাওয়ার পর ফুসিয়ে ফাসিয়ে বিয়ে করেছে হারামখোর।”

জাভেদের চেহারায় বিরক্ত দেখা গেলো। সিনথিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সিনথিয়া বললো,

— “অপ্সরার আগে বিয়ে হয়েছিলো?”
— “হু! একজন ফরেনারের সাথে। বিয়ের একবছরের মাথায় সে লোকটা মারা যায়। তখন ওদের পরিবার প্রায় ভেঙ্গে পরেছিলো। বিশেষ করে অপ্সরা। তখনই সায়ান সহমর্মিতার নাম করে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। শালা বিশ্বাসঘাতক। এরপর যখন জানলো অপ্সরার বাবা-মা মারা গেছে তারপর থেকেই নির্যাতন শুরু করেছে।”
— “ইশ! কতটা খারাপ হলো। আমি ওকে নিয়ে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। ওদের মেয়েটার কি হবে?”
— “ওটা সায়ানের মেয়ে নয়। অপ্সরার আগের স্বামীর মেয়ে। সায়ানের সাথে বিয়ের সময় জানতেই পারেনি যে সে গর্ভবতী।”
— “ওহ! এখন কি হবে?”

জাভেদ সিনথিয়াকে অপ্সরার পরিকল্পনার কথা জানালো। সিনথিয়া এবার চুপচাপ বসে আছে। জাভেদ তাগাদা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

— “চলো খেয়ে নিই। এখনো তো খাওনি।”
— “হু..। চলুন।”

______________________________
তিনদিন পর। বিকেলবেলা। সিনথিয়া ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘেরা উড়ে যাচ্ছে। সেটাই উপভোগ করছে সিনথিয়া। জাভেদ এসে পাশে দাড়ালো। সিনথিয়ার মতো করে আকাশের দিকে তাকালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

— “মেঘ দেখতে ভালো লাগে?”
— “হু..। অনেক। আমার ইচ্ছে করে মেঘেদের ছুঁয়ে দিতে।”
— “ছুঁয়ে দিতে চাও?”
— “হু চাই। কিন্তু কিভাবে?”

সিনথিয়ার বলার ভঙ্গি দেখে জাভেদ হেসে ফেললো। নাকটা হালকা টেনে দিয়ে বললো,

— “অপেক্ষা করো কয়েকদিন। তারপর…. উম! উম!”
— “তারপর কি?”
— “সারপ্রাইজ। বলা যাবে না এখন।”

সিনথিয়া গাল ফুলিয়ে ফেললো। অভিমান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। জাভেদ হাসে। সিনথিয়ার অভিমান ভরা মুখটা দেখতে খুব মায়াবী লাগে। নিজের বাহু দিয়ে সিনথিয়ার বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,

— “বউ দেখছি অভিমান করেছে।”
— “মোটেও না।”
— “আহা এটা কি হলো।”

সিনথিয়া মুখ ঘুড়িয়ে জাভেদের দিকে তাকিয়ে বললো,

— “কি হয়েছে?”
— “তোমার নাক।”
— “আমার নাক কি হয়েছে?”
— “লাল টমেটো হয়ে আছে। কুটুস করে কামড় দিয়ে দেবো কিন্তু।”

সিনথিয়া তৎক্ষনাৎ নাকে হাত দিয়ে ঢেকে ফেললো। জাভেদ এবার হো হো করে হাসছে। সিনথিয়া ভেঙচি কেটে মুখ ঘুড়িয়ে নিলো। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো জাভেদের। হাসি মুখে সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে মোবাইল কানে ঠেকালো। অপাশের কথাবার্তা শুনে অনেকটা বিচলিত হয়ে গেলো। কোনোরকমে ব্যাপারটা সামলে নিতে বলে ফোন কেটে চিন্তিত হয়ে গেলো। সিনথিয়া এগিয়ে এসে জাভেদের হাত ধরে বললো,

— “কি হয়েছে? আপনাকে চিন্তিত লাগছে।”
— “সায়ান অপ্সরার মামার বাসায় গিয়ে অনেক হাঙ্গামা করছে। সে অপ্সরাকে নিয়ে যেতে চাইছে। তাই ফোন দিলো।”
— “এখন কি হবে?”
— “ওদেরকে বলেছি ব্যাপারটা সামলে নিতে। আমি সেখানে গেলে বিষয়টা খুব বিশ্রী হয়ে যাবে। আর সায়ানকে তো তোমার চিনায় আছে। ইনিয়ে বিনিয়ে হাজার কথা রটাবে। ফালতু লোক।”
— “হুম বুঝতে পারছি। কিন্তু অপ্সরা এবং ওর মেয়ের কি হবে?”
— “সেটা ভাবার জন্য ওর মামা-মামী আছে। আমরা বেশি নাক গলাতে গেলে সব দায়ভার এসে আমাদের উপর পড়বে।”

সিনথিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

— “আমি একটু অপ্সরার সাথে দেখা করতে চাই। আমাকে নিয়ে যাবেন প্লিজ।”
— “আচ্ছা সময় করে নিয়ে যাবো।”

_____________________________
একমাস কেটে গেছে চোখের পলকেই। সিনথিয়া আজ অপ্সরার সাথে দেখা করতে এসেছে। সাথে একটা প্রপোজাল নিয়ে এসেছে। যদিও জানে না অপ্সরা এতে রাজি হবে কিনা। কিন্তু রাজি না হলে ওর-ই বিপদ। সিনথিয়া অপ্সরার মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করলো। ঘুমিয়ে যাওয়ায় দোলনায় শুইয়ে দিয়ে বললো,

— “এরপর কি ভাবলে কি করবে?”
— “সায়ানকে ডিভোর্স দিবো।”
— “তারপর?”
— “কোথাও জব পেলে মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠবো। মা-মেয়ে দুজন মিলে বেশ চলে যাবে।”
— “আমার মনে হয়না সায়ান তোমাকে এতো সহজে মুক্তি দিবে।”
অপ্সরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— “ওর সাথে সংসারের এই দেড় বছরে কখনো মনে হয়নি আমি ওর স্ত্রী। সায়ান সবসময় আমাকে ফিল করিয়েছে আমি ওর রক্ষিতা ছাড়া কিছুই না।”
— “হুম জানি।”

অপ্সরা অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। ভাবতে লাগলো কিভাবে কি করবে। সিনথিয়া ঠিকই বলেছে সায়ান ওকে এতো সহজে মুক্তি দিবে না। তাই এবার ভাবলো সে আবার কানাডা ফিরে যাবে। পরমুহূর্তেই মনে পরলো সায়ান ওর পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলেছিলো। লোকটা সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে ওর। সিনথিয়া অপ্সরার হাত ধরে বললো,

— “তোমাকে একটা কথা বলি যদি কিছু মনে না করো।”
— “হু..।”
— “তুমি আবার বিয়ে করে নাও।”
— “সিনথিয়া এটা কখনোই সম্ভব না। সংসারের স্বাদ মিটে গেছে আমার। ভয় হয় এখন। পরবর্তী লোকটা যদি সায়ানের মতো নরপশু হয়!”
— “আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। কিন্তু তুমি ভাবো একবার এইভাবে অভিভাবক বিহীন তুমি টিকে থাকতে পারবে না। আর না সায়ান তোমাকে ভালো থাকতে দিবে। তাই বললাম।”

অপ্সরা চিন্তায় পরলো। সিনথিয়ার কথা ফেলার মতো নয়। কিন্তু মনের ভয় কিছুতেই কাটতে চাইছে না। সায়ানের সাথে সংসারের মাঝামাঝি সময় থেকেই ওদের আসল রুপ দেখেছে অপ্সরা। সেই বিভৎস দিনগুলোর কথা ভাবলে ভয়ে অন্তর-আত্মা কেঁপে উঠে। সিনথিয়া জানালো,

— “উনার একজন বন্ধু আছে। এইতো বেশকিছু দিন আগে স্ত্রী মারা গেছে। দু বছরের একটা ছোট্ট ছেলে আছে। সারাদিন কাঁদে মা মা বলে। তিনি বাচ্চাকে কিছুতেই সামলাতে পারছেন না। তুমি যদি রাজি হও তাহলে তোমার মেয়ে বাবার আদর পাবে আর ওই পিচ্চি বাবুটা মায়ের ভালোবাসা পাবে।”
— “কিন্তু.. সায়ানের সাথে আমার এখনো ডিভোর্স হয়নি। আর আমি আসলে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে চাইছি না। আমার একটু সময় প্রয়োজন।”
— “ঠিকাছে নাও সময়। তারপর ভেবে দেখো। আজ আসি।”

সিনথিয়া বেরিয়ে গেলো। জাভেদের মোটরসাইকেলে বসে পরলো। জাভেদ মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— “কি বললো সে?”
— “সময় চাইছে।”
— “হু..। আমি অপ্সরার মামা-মামীর সাথে কথা বলেছি। উনারা রাজি আছেন। এখন শুধু অপ্সরা মানলেই হলো।”

তারপর আর কথা হলো না দুজনের মাঝে। মোটরসাইকেল নিয়ে দুজনেই পারি দিলো একটা অজানা গন্তব্যে। যদিও জাভেদের জানা আছে সে কোথায় যাচ্ছে। সিনথিয়া জানে না। তাই অধির আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে সেই পথের দিকে।

চলবে,,
® ‘নুরুন নাহার।’