তুমি কেন আগে আসোনি? পর্ব-১৮

0
616

“তুমি কেন আগে আসোনি?”

১৮.
লাল বেনারসি পরে টুকটুকে বউ সেজে বিছানায় বসে আছে অপ্সরা। কোলে রুহি। পাশে রাফি বসে চোখদুটো বড় বড় করে অপ্সরাকে দেখছে। অপ্সরা রাফির গোছানো চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,

— “কি দেখছো বাবা?”
— “মাম্মাম তোমাকে এদদম নুতুন বউ লাগছে।”

অপ্সরা আবার হাসলো। রাফি কালো একটা পাঞ্জাবি পরেছে। রুহিকেও কালো জামা পরাতে হয়েছে রাফির জন্য। রাফির এক বায়না সে যেই কালার পরেছে বোনকে সেই রঙের জামা পরতে হবে। রাফির আবদার রাখতেই রুহিকেও কালো জামা পরিয়ে দিয়েছে।

একটু পরে সিনথিয়া এবং অপ্সরার মামি রুমে প্রবেশ করলো। সিনথিয়ার ঠোঁটে মৃদু হাসি। অপ্সরার মামিও খুব খুশি। মনে হচ্ছে নিজের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে আজ। সিনথিয়া অপ্সরার পাশে বসে রসিকতা করে বললো,

— “এমা তুমি হাসছো কেনো? বউদের মুখ থাকে কাঁদো কাঁদো। আর তুমি কিনা হাসছো? কি ব্যাপার বলো তো? খালিদ ভাই কি কিছু বলেছে নাকি?”

সিনথিয়ার কথায় অপ্সরা লাজুক হেসে মাথা নিচু করে ফেললো। রাফি এখনো গোলগোল চোখে এখনো অপ্সরার দিকে চেয়ে আছে। কারণ তার মাম্মামকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। দীর্ঘ চারমাস পর আজকে তার মাম্মাম তাদের সাথে যাবে। এই কথাটা শুনার পর থেকেই রাফি খুশিতে বাবার সামনে কিছুক্ষণ লাফালাফি করেছে৷

যথাসময়ে তাদের বিয়ের সম্পন্ন হয়েছে। সবার মাঝে খুরমা বিতরণ করা হলো। অপ্সরা কালো বোরকা জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। আগে কখনো বোরকা পরেনি। আজ প্রথম পরেছে। অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে৷ নিজের কাছেই নিজেকে সম্মানিত লাগছে। আগে ছোট ছোট ড্রেস পরেছিলো তখন এমন অনুভূতি হয়নি। এই অনুভূতি একেবারে নতুন। প্রশান্তিকর অনুভুতি।

বিদায়ের সময় অপ্সরা কাদেনি। দিনটাকে খুব সুখকর মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এই সমাজের তিক্ততা থেকে মুক্তি মিলেছে খালিদের সংস্পর্শ পেয়ে। মামা-মামীকে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। ওর খারাপ সময়ে যদি এই দুইজন মানুষ পাশে না থাকতো তবে সে হয়ত সায়ানের অত্যাচারে মিটে যেতো অথবা অন্যকোনো ভাবে। সিনথিয়াকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলেছে অপ্সরা। এই মেয়েটার জন্য আজ নতুন একটা জীবন শুরু করতে পেরেছে। অনেক বেশি কৃতজ্ঞ মেয়েটার প্রতি।

.
মাঝারি সাইজের একটা ফ্ল্যাটে এসে ঢুকলো অপ্সরা। রাফি হাত ধরে রেখেছে। রুহি খালিদের কোলে। খালিদের মা ভীষণ খুশি। অপ্সরাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে ছিলো। অপ্সরাও খুশি। ভদ্রমহিলাকে খুব প্রছন্ন লাগছে। কালো রঙের হিজাবে খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে। ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক। গোলগাল মুখশ্রী। ছেলের বিয়ে বলেই হালকা সাজগোছ করেছে। খালিদের বাবা এগিয়ে এসে খালিদের কোল থেকে রুহিকে নিয়ে বললো,

— “এইতো আমার দাদুভাই চলে এসেছে। এতো দেরি কেনো করেছো দাদুভাই? তোমার জন্য কত অপেক্ষা করেছি জানো?”

অপ্সরা অবাক হয়ে খালিদের বাবার দিকে তাকালো। পরনে লুঙ্গি আর সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি। হয়ত শুয়ে ছিলেন এতোক্ষণ। সেখান থেকেই উঠে এসেছে। গালভর্তি দাড়িতে হালকা পাক ধরেছে। হাসি-খুশি একজন মানুষ। তিনি অপ্সরার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,

— “এই যে মামুনি, এবার তো চলেই এসেছো। আর যেতে দিবো না তোমাকে কোথাও। আমাদের কাছেই থাকবে আমাদের মেয়ে হয়ে। যদি কখনো খালিদ অশান্তি করে তোমার সাথে সেদিনই ওকে বের করে দিবো ঘর থেকে।”

খালিদকে শাসিয়ে বললো। খালিদ বেচারার মুখটা চুপসে গেছে। খালিদের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে অপ্সরা ফিক করে হেসে দিলো। পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলিয়ে নিলো। প্রচুর হাসি পাচ্ছিলো। রাফিও দাদুর কথায় তাল মিলিয়ে বললো,

— “দাদু তুমি তিক বলেচো। আমার মাম্মামতে আমি কোতাও যেতে দিবো না।”

খালিদের মা নাজনীন বললো,

— “অনেক কথা হয়েছে। অপ্সরা তুমি যাও এই কাপড় চোপড় খুলে পাতলা থেকে কিছু পরে নাও। হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে আসো খাবার দিচ্ছি। খালিদ তুইও যা রাফিকে নিয়ে। রুহি আমাদের কাছে থাক।”
— “না আমার বনুতে আমি দিবো না। ও আমাল কাচে তাকবে।” রাফি বললো।

নাজনীন হেসে রাফিকে কোলে নিয়ে বললো,

— “তোমার বোন তো সবসময় তোমার সাথেই থাকবে তাইনা? কিন্তু এখন তুমি তো বাইরে থেকে এসেছো। তোমার হাতে-পায়ে জীবাণু। তুমি যদি এভাবে তোমার বোনকে ধরো তাহলে তো বোন অসুস্থ হয়ে যাবে।”
— “তাই? তাইলে আমি একনি হাত-মুক দুয়ে আসচি দাদি।”
— “এইতো ভালো ছেলে। যাও এবার বাবার সাথে।”
— “তিকাছে।”

অপ্সরা রাফি এবং খালিদের সাথে ওদের রুমে গেলো। মাঝারি সাইজের রুমটায় অল্প-সল্প ফার্নিচার হলেও খুব গোছালো। রুমটায় স্বস্তি দায়ক একটা পরিবেশ রয়েছে। অপ্সরা বোরকা খুলে খাটে বসলো। রাফি তার বাবার সাথে ওয়াশরুমে গেছে হাত-মুখ ধুয়ে নিতে। হাত-মুখ ধোয়া শেষ হতেই অপ্সরার কাছে এসে বললো,

— “মাম্মাম আমার মুক মুচে দাও।”
— “এইতো দিচ্ছি।”

অপ্সরা এদিক সেদিক তাকালো। এরমধ্যেই খালিদ বের হয়েছে। তাওয়াল এগিয়ে দিলো অপ্সরার দিকে। অপ্সরা সেটা নিতে গিয়েও পারলো না। খালিদ শক্ত করে ধরে রেখেছে। অপ্সরা ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকিয়েছে খালিদের দিকে। লোকটার মুখে দুষ্টু হাসি দেখেই তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিলো তাওয়ালের অংশটা। পুরো শরীর কেঁপে উঠেছে লজ্জায়। এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। খালিদ একটু গলা খাকাড়ি দিয়ে আবার বাড়িয়ে দিলো তাওয়াল। অপ্সরা মাথা নিচু করে রেখেই সেটা নিয়ে নিলো।

রাফির মুখ মুছিয়ে দেয়া শেষ হতেই ছুটে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। বোনকে ছাড়া এক মিনিটও থাকতে পারবে না। এদিকে অপ্সরা বেশ অস্বস্তিতে পরে গেলো। লোকটার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না লজ্জায়। এমনটা আগে কখনো হয়নি। না প্রথম স্বামীর ক্ষেত্রে হয়েছে আর না সায়ানের ক্ষেত্রে হয়েছে। আঁচলের এক অংশ আঙুলে পেচাতে পেচাতে এদিক সেদিক তাকালো। খালিদ গম্ভীর মোলায়েম কণ্ঠে বললো,

— “উঠুন। অনেক ধকল গেছে আজ। ফ্রেস হয়ে নিন।”
— “জ..জ্বী।”

খালিদকে সরে যেতে দেখে অপ্সরা নিজের ব্যাগ থেকে নীল রঙের সূতির শাড়ি নিয়ে উঠে দাড়ালো। আগে কখনো শাড়ি পরতো না। পারতোও না। যেদিন সিনথিয়ার মুখ থেকে শুনেছিলো শাড়ি পরায় খুব মায়াবী লাগে সেদিন থেকেই শিখেছে শাড়ি পরা। এরপর প্রায় প্রতিদিন পরতো শাড়ি। আনমনে এসব ভেবেই মুচকি হেসে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। দুই কদম গিয়েই ধাক্কা খেলো। কিন্তু পরলো না। কারো সাথে লেপ্টে গেছে। অপ্সরা মুখ তুলে তাকিয়ে আবারও লজ্জায় পরে গেলো। খালিদ রসিকতা করে বললো,

— “আমিতো এখানেই আছি। তাহলে কল্পনায় কার কথা ভেবে ব্লাশিং হচ্ছেন?”

এমন কথায় আরো লজ্জা পেলো অপ্সরা। মৃদু স্বরে বললো,

— “আমি মো..মোটেও ব্লাশিং হচ্ছিলাম না। আপ..আপনি বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছেন। ছা..ছাড়ুন।”
— “ধরিই তো নি।”

খালিদের কথায় ভীষণ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেলো অপ্সরা। খালিদ মৃদু স্বরে বললো,

— “এই লাল শাড়িতে আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। নামের মতোই অপ্সরী লাগছে।”

খালিদকে পাশ কাটিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো অপ্সরা। এরকম কমপ্লিমেন্ট আগে বহু শুনেছে কিন্তু আজকের মতো অনুভূতি কখনো হয়নি। অন্যরকম ভালোলাগা মন-প্রাণ জুড়ে বয়ে গেলো যেনো। অপ্সরার এমন কান্ড দেখে খালিদ মুচকি হাসলো।

একেবারে গোসল করেই বের হলো অপ্সরা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি মুছে নিচ্ছে তাওয়াল দিয়ে। আনমনেই খালিদের কথা ভাবছে আর ব্লাশিং হচ্ছে। এই মুহুর্তে খালিদ রুমে নেই। ফ্রেশ হয়েই রুম থেকে বেরিয়েছে। অপ্সরার ভাবনার মাঝেই ঘাড়ে কারো স্পর্শ পেলো। অপ্সরা শিউরে উঠলো। তড়িঘড়ি করে আয়নার দিকে তাকিয়ে চুপসে গেলো। এখন খুব বেশিই অস্বস্তি হচ্ছে। যদিও খালিদকে পছন্দ হয়েছে তবুও একটু সময় চায় অপ্সরা। এখন কি তা পাবে না? অপ্সরার মন খারাপ হলো। খালিদ কিছুটা অবাক কণ্ঠে বললো,

— “তোমার ঘাড়ে, পিঠে এসব কিসের দাগ?”

খালিদের মুখে তুমি ডাক শুনে মন খারাপ ভাব কেটে গেলো। আবারও মন ভালো হয়ে গেছে। কারণ মানুষটার ছোয়ায় কামনা ছিলো না। হালাল অধিকার, ভালোবাসা, কেয়ার এবং দায়িত্ব ছিলো। অপ্সরার এতোসব ভাবনার মাঝে খালিদ আবার বললো,

— “কি হলো চুপ করে আছো কেনো? তোমার পিঠে, ঘাড়ে এসব কিসের দাগ। দেখি এদিকে ফিরো।”

অপ্সরাকে নিজের দিকে ফিরাতেই খালিদের নজর অপ্সরার গলায়, বুকে এবং কোমড়ে পরলো। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। চোখ ছোট ছোট করে কুচকে অপ্সরার দিকে তাকিয়ে বললো,

— “এসব কিসের দাগ? দেখে তো মনে হচ্ছে কেউ মেরেছে বেধড়ক।”
— “(—-)”
— “কথা বলছো না কেনো?” কণ্ঠ কিছুটা শক্ত শোনালো। অপ্সরা মিনমিনে স্বরে বললো,
— “আস..আসলে সায়ান…।”

অপ্সরা বেশ অপ্রস্তুত। সাথে ভিষণ লজ্জা পাচ্ছে। কি ভাবছে মানুষটা কেজানে। হয়তো ভাবছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করলে অন্য আরেকটা মেয়ের সংসার ভেঙে সেই ভালোবাসার বুঝি এই হাল? কিন্তু অপ্সরা তো জানতো না সায়ানের সাথে সিনথিয়ার বিবাহের কথা। বিষয়টা অনেক পরে জেনেছে। অপ্সরা মাথা নিচু করে ফেললো। খালিদের সাথে নজর মিলাতে পারছে না। খালিদের ব্যস্ত এবং ব্যকুল কণ্ঠে অপ্সরার ভাবনাগুলো মিথ্যে হলো। খালিদ বললো,

— “এখনো কি ব্যাথা আছে? আর কোথায় কোথায় দাগ আছে? বলো।”
— “হালকা হালকা ব্যাথা আছে। খুব বেশি নয়।”
— “হু..! বুঝেছি আমি। এদিকে বসো। আমি দেখি কি করা যায়।”
— “আপনি ব্যস্ত হবেন না প্লিজ। এসব এমনিতেই চলে যাবে। এর আগেও বহুবার এমন মার খেয়েছি। মলম পট্টি ছাড়াই সেরে গেছে।”

অপ্সরা কথাগুলো বলে খালিদের দিকে তাকালো। খালিদের গভীর মোলায়েম চাহনি দেখে চুপসে গিয়ে মুখ নামিয়ে নিলো। খালিদ এগিয়ে এসে অপ্সরার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

— “ওয়াদা করছি আজকে থেকে তোমার গায়ে একটা টোকাও পরবে না। যদি আমি কখনো তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে তুমিই আমাকে মেরো।”
— “এমা এসব কি বলছেন? আমি কিভাবে আপনাকে..?”
— “আচ্ছা মারতে না পারলে অন্য একটা বুদ্ধি দেই কি বলো?”
অপ্সরা উৎসুক হয়ে তাকালো। খালিদ বললো,
— “মারতে তো পারবে না। সেটার বদলে খুব করে আদর করে দিও হুম..! বউয়ের আদর খুব মজা।”

অপ্সরা লজ্জা পেয়ে ছিটকে সরে গেলো। খালিদ হাসছে। গা দুলিয়েই হাসছে। লজ্জায় এবং অস্বস্তিতে অপ্সরা মিইয়ে গেলো একেবারে।

.
রাতে শোবার সময় রাফি বায়না ধরে বললো,

— “আমি মাম্মামের সাতে গুমাবো বাবাই।”
— “ঠিকাছে ঘুমাও।” খালিদ বললো।
— “সত্যি?”
— “হ্যাঁ বাবা সত্যি।”
— “ইয়ে! একন তেকে আমি মাম্মামের সাতে গুমাবো।” রাফি হাত তালি দিলো।

বিছানা ঠিক করে বাবা-মায়ের রুম থেকে রুহিকে নিয়ে এলো খালিদ। উনারা চেয়েছেন নাতি-নাতনী দুজনকে নিজেদের কাছে রাখতে। খালিদই দেয়নি। রুহিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রাফিকে ঘুম পারাতে চাইলো। রাফি আজ বাবার কাছে ঘুমাবে না। আজকে মাম্মামের সাথে ঘুমাবে এবং মাম্মামকেই ঘুম পারাতে হবে। রাফির বায়নায় অপ্সরা হেসে দিলো। খালিদ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

— “আজ থেকে বাবাই আউট হয়ে গেছে। আচ্ছা ঘুমাও তুমি মাম্মামের সাথে।”

খালিদ বালিশ নিয়ে সোফার দিকে এগিয়ে গেলে অপ্সরা বললো,

— “আপনি কোথায় যাচ্ছেন বালিশ নিয়ে?”
— “ঘুমাতে। ওখানে তোমরা তিনজনই ঘুমাও।”
— “আপনি বুঝি সোফায় ঘুমাবেন?”
খালিদ দুষ্টামি করে বললো,
— “তুমি চাইলে তোমার বাহুডোরেও ঘুমাতে পারি।”

অপ্সরা আর কিছু বললো না। চুপচাপ শুয়ে পরেছে। রাফিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। ঘরে ড্রিম লাইট জ্বলছে। সেই আলোতে রাফির মুখের দিকে তাকালো অপ্সরা। এই মুখটায় হাজারো মায়া রয়েছে। রাফির কপালে চুমু দিলো। রাফি বললো,

— “মাম্মাম তুমি কি আবাল আমাকে চেড়ে চলে যাবে? তুমি আল যেও না মাম্মাম। তাহলে আমি কুব কাঁদবো। এর আগে যকন তুমি চলে গেচিলে আমি কুব কেঁদেচি। বাবাইও তোমাকে এনে দেয়নি। দাদিও না।”

অপ্সরার বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। রাফি যে ওর মায়ের কথা বলছে। একটুখানি বাচ্চাটা কত কষ্টই না পেলো। অপ্সরা রাফিকে আদর করে দিয়ে বললো,

— “মাম্মাম আর কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবে না। প্রতিদিন তোমাকে আদর করে বুকে নিয়ে ঘুম পারিয়ে দিবে। এবার ঘুমাও বাবা।”
— “আচ্চা মাম্মাম।”

ড্রিম লাইটের মৃদু আলোর মধ্যে দিয়ে অপ্সরা সোফার দিকে তাকালো। লোকটা গভীর ঘুমে আছে। একটুখানি সোফায় লোকটার জায়গা হয়নি। তবুও শুয়ে আছে। অপ্সরা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিলো।

____________________________
দশটার দিকে ফ্রেশ হয়ে বের হলো সিনথিয়া। আজকে একটু লেট হয়ে গেছে উঠতে। জাভেদকে দেখলো না রুমে। রুমে পানি না থাকায় রান্নাঘরে গেলো পানি খাওয়ার জন্য। পানি খেয়ে আবার রুমে এলো। বিছানা গোছানো হয়নি। এলোমেলো হয়ে পরে আছে। সিনথিয়া রুমে এসে অবাক হলো।

জাভেদ বিছানা গোছাতে শুরু করেছে। সিনথিয়া তাড়াতাড়ি জাভেদের কাছে গিয়ে বললো,

— “আরে এসব কি করছেন আপনি? আপনি কেনো করছেন এসব? সরুন আমি করে দিচ্ছি।”
— “কোথাও লিখা আছে এসব শুধু স্ত্রীরা করবে। স্বামীরা করতে পারবে না?”
— “না লিখা নেই। এবার সরুন।”
— “তুমি সরো তো। দেখছো না কাজ করছি।”
— “আপনি দিন দিন বেশ দুষ্টু হচ্ছেন।”
— “দুষ্টু হই আর যাই হই তোমারই তো।”

সিনথিয়া একটু থেমে গেলো। বুকের ভেতর ভালোলাগার ঢেউ খেলে গেলো। চোখে-মুখে প্রাপ্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে আবার বললো,

— “আচ্ছা বুজেছি। এবার সরুন।”
— “উফ! যাও তো যাও। কাজে বিরক্ত করো না।”
— “আমি বিরক্ত করছি?”

সিনথিয়ার অবাক চাহনির সাথে অবাক কণ্ঠ। জাভেদ সিনথিয়াকে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো,

— “এখানেই বসে থাকো। এক পা নড়লে খবর আছে।”
— “আপনি আজকে কাজে যাবেন না?”
জাভেদ বিরক্ত হলো। সে এখন কাঁথা ভাজ করছে। বিরক্ত হয়ে বললো,
— “আর যদি কিছু বলেছো তো………।”

সিনথিয়ার কান গরম হয়ে এলো। উহ! লোকটার মুখে একটুও লাগাম নেই। কেমন ঠোঁটকাটা স্বভাবের মানুষ। মুখে যা আসে তাই ফটাফট বলে দেয়। সিনথিয়া ভুলেও আর তাকালো না জাভেদের দিকে। এদিকে জাভেদ মহা খুশি। সিনথিয়াকে জব্দ করতে পেরেছে। লজ্জা পেয়ে একদম নেতিয়ে গেছে লজ্জাবতী গাছের মতো। মনে মনে মুচকি হাসলো জাভেদ।

রান্নাঘরে কাজ করার সময় আবার এসে উদয় হলো জাভেদ। সিনথিয়ার হাত থেকে কাজগুলো টেনে নিচ্ছে। সিনথিয়া বললো,

— “কি হয়েছে আপনার? কাজে না গিয়ে এসব কেনো করছেন,?”
— “আজকে আমি রান্না করবো বুঝেছো?”
— “না বুঝিনি। সব আমাকে জ্বালানোর ফন্দি। চুপচাপ দোকানে যান।”
— “যাবো না। হিহি। এবার সরো তো।”

জাভেদ সিনথিয়াকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই সবজি কাটতে শুরু করলো। সিনথিয়া হাজার বকেও থামাতে পারলো না মানুষটাকে। এরমধ্যে রান্না চড়ালো। সিনথিয়া বললো,

— “আচ্ছা আমাকে দিন এবার। আমি রান্না করি।”
— “এই তোমাকে কি কাজের বুয়া করে এনেছি নাকি? রাণী করে এনেছি। রাণীর মতো থাকো।”
— “তাই বলে আপনি রান্না করবেন?”
— “উফ যাও তো। এতো ফরমালিটি দেখিও না। একদিন রাধলে হাত ক্ষয়ে যাবে না।”
— “আজকে যদি রান্নায় একটু উনিশ বিশ হয় আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম।”

সিনথিয়া বেশ রেগেই বললো। সিনথিয়ার রাগি মুখটা দেখে জাভেদ মুচকি হাসলো। বললো,

— “বাহ! এইতো কর্তী ভাব ফুটে উঠেছে। এই না হলে আমার বউ। যাও বউ রুমে যাও। তোমার সেবায় এই গোলাম সর্বদা হাজির।”

সিনথিয়া হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

— “আচ্ছা আজকে আপনার হঠাৎ কি হয়েছে বলুন তো? এরকম করছেন কেনো?”

এরমধ্যে রান্নাঘরে সাবিনা এলো। জাভেদকে রান্নাঘরে দেখে বললো,

— “তুই এখানে কি করছিস?”
— “দেখুন না মা। সকাল থেকেই কি শুরু করেছে। কত বললাম আমি রান্না করি। কিন্তু উনি জেদ ধরে নিজেই রান্না শুরু করেছে।” সিনথিয়া বললো।

সাবিনা একবার রান্নাবান্নার হালত দেখে মুচকি হেসে চলে গেলেন। তিনি জানেন তার ছেলে মাঝে মাঝে এমন পাগলামি করে বউ-য়ের জন্য। আগেও করেছে কিন্তু সেই মেয়েটা বুঝেনি ছেলেটার ভালোবাসা। তরকারি একবার নেড়ে ঢেকে দিয়ে জাভেদ সিনথিয়ার দিকে ফিরে বললো,

— “একটা ডিল করি কি বলো?”
— “কিসের ডিল,?” ভ্রু কুচকে বললো সিনথিয়া।
— “যদি আজ রান্না ভালো না হয় তাহলে তুমি যা চাইবে তাই পাবে। রাজি?”
— “আচ্ছা রাজি।” সিনথিয়া হেসে বললো।
— “আর যদি রান্না ভালো হয় আমি যা চাইবো তাই দিতে হবে। রাজি?”
— “হু আচ্ছা।”
— “সত্যি তো? যা চাইবো তাই কিন্তু দিতে হবে।”

জাভেদের এমন কথায় সিনথিয়া কিছুটা ভড়কে গেলো। তবুও রাজি হয়ে গেলো।

.
দুপুরে সবাই খেতে বসেছে। সাবিনা এবং অতশি খেয়ে প্রসংশা করলো। সিনথিয়া ভাবলো হয়ত শান্তনা দিচ্ছে। তাই নিজেই একবার খেয়ে দেখলো। এমা! এতো ভালো রান্না কিভাবে রাধলো এই লোকটা? সিনথিয়া একবার জাভেদের দিকে তাকালো। জাভেদ এক ভ্রু উঁচু করে শয়তানি হাসি দিলো। যার অর্থ আজ যা চাই তাই দিতে হবে। সিনথিয়া কেঁপে উঠলো। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।

রাতের দিকে সিনথিয়া একটু টেনশনেই পরে গেলো। লোকটা কেমন যেনো অদ্ভুত আচরণ করছে। কি এমন চাইবে? এমন ভয় লাগাচ্ছে কেন? এরমধ্যেই জাভেদ উপস্থিত হলো। সিনথিয়াকে নিয়ে ছাদে গেলো।

চাঁদের আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে আছে। দূরের ওই দীঘিতে চাঁদের আলো পরায় মনে হচ্ছে যেনো আয়না ভাসছে। কাছে গিয়ে দাড়ালেই নিজেকে দেখা যাবে সেই আয়নায়। সিনিথিয়া সেদিক থেকে নজর সরিয়ে জাভেদের দিকে তাকালো। জাভেদ রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো,

— “যা চাই তাই কিন্তু দিতে হবে।”

সিনথিয়া একটু ভয় পেলো। ছাদ থেকে লাফ দিতে বলবে না তো? যেমন রহস্যময় কণ্ঠে বলছে। সিনথিয়া ভীতু চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার জাভেদের দিকে তাকালো। জাভেদ একটা কাগজ সিনথিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

— “মেঘেদের দেশে যাবে সিয়া?”

সিনথিয়া কিছু বুঝলো না। জাভেদের কথাটাই শুধু কানে বাজতে লাগলো। কিন্তু কথাটার অর্থ ধরতে পারেনি এখনো। জাভেদের মায়াময় কণ্ঠ শুনে জাভেদের দিকে তাকালো। এই লোকটা ওকে এতো ভালোবাসে কেনো? এতো কেয়ার করে কেনো? ওর মতো ময়লা রঙের একজন মানুষকে এতো সম্মান করে কেনো? কোনোকিছুই জানা নেই।

সামনের মানুষটার দিকে তাকাতেই মানুষটাকে অনেক বছরের চেনা, আপন এবং খুব কাছের মনে হলো। একেবারে হৃদয়ের কাছের। এই মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছে সিনথিয়া। খুব ভালোবাসে। অজান্তেই চোখের কোণ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো সিনথিয়ার। মানুষটার মায়াময় চাহনিতে নিজেকে বিলীন করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। একছুটে গিয়ে মিশে গেলো সামনের মানুষটার প্রশস্ত বক্ষে।

চলবে,,,
® ‘নুরুন নাহার’