তুমি কেন আগে আসোনি? পর্ব-১৯

0
624

“তুমি কেন আগে আসোনি?”

১৯.
অনেকদিন ধরেই শয্যাশায়ী হয়ে আছে আসমা। সারাদিন বিছানায় পরে থেকে বালিশ ভিজায় মেয়ের শোকে। শেষবার জাভেদ এবং সিনথিয়া চলে যাওয়ার পর আর যোগাযোগ করেনি। সবদিক থেকেই যোগাযোগ বিছিন্ন করে দিয়েছে। যার ফলে এখন চেয়েও মেয়ের সান্নিধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ের মর্ম এখন হারে হারে টের পাচ্ছে।

সিনথিয়ার বাবা আরশ এইমাত্র রুমে ঢুকলো। আসমা স্বামীকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। শরীর পুরোপুরি যেনো অচল হয়ে গেছে। কাতর কণ্ঠে স্বামীকে প্রশ্ন করলো,

— “মেয়েটার খোঁজ পেয়েছো?”

আরশ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো বিরস মুখে। মুখ থেকে মাস্ক খুলে হাতে নিলো। মাস্কটার দিকেই চেয়ে রইলো পলকহীন। আজকাল বাইরে বের হলে মুখ ঢেকে বের হতে হয়। মুখ খুলে চলা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা যেনো। পাড়া-পড়শী দেখলেই ছি! ছি! করে। ছেলে এবং ছেলের বউদের ঘটনা খুব বিশ্রীভাবেই রটে গেছে মহল্লায়। আবার ছোট ছেলেটা বউ-এর প্রতারণা সইতে না পেরে সুইসাইড করলো। এই ঘটনার পর থেকেই পাড়া-পড়শী আরো মুখ ঘুড়িয়ে নিয়েছে।

স্বামীর চুপটি করে বসে থাকা দেখে আসমা ব্যথিত মনে সিলিং-এর দিকে তাকালো। মেয়েটার কথা মনে হলেই যেনো কলিজা ছিঁড়ে যায়। কত কষ্ট দিয়েছে মেয়েকে, কত মারধর করেছে। প্রতিবার মারের পর তিন-চার দিন বিছানা থেকেই উঠতে পারেনি। কত অপমান, অপদস্ত করেছে সবার সামনে। অথচ মেয়েটা কখনোই টু-শব্দ করেনি। নিরবে মেনে নিয়েছে। কখনো উঁচু গলায় কথাও বলেনি। শেষবার যখন সায়ানদের অভিযোগ শুনে বাপ-ভাই মিলে মারলো টানা একঘন্টা অজ্ঞান হয়ে পরে ছিলো মেয়েটা। একটু কাছে গিয়ে দেখেনি মেয়েকে।

ছোটবেলায়ও কখনো মমতা নিয়ে জড়িয়ে ধরেনি। কখনো সেভাবে সময় কাটায়নি। সবসময় অবহেলা করেছে। তিরস্কার করেছে। খোঁচা মেরে কথা বলেছে৷ মেয়েকে বোঝা ভেবেছে সবসময়। আসমা চোখ বুজে নিলো। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমে এলো। এখন খুব ইচ্ছে করে মেয়েটাকে একটাবার বুকে জড়িয়ে নিতে৷ একটু খোঁজ নিতে। অথচ আজ মেয়েটা একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

যখন দ্বীনে ফিরেছে কতবার সতর্ক করেছে ভাই-ভাবিদের ওপেন চলাফেরা নিয়ে। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কত যে বলেছে মেয়েটা। শেষবার তো মেয়ের উপর গরম খুন্তি ছুড়ে মেরেছিলো। আর-তো যা নয় তাই বলে গালিগালাজ করেছে। অথচ আজ মেয়েটার কথাই সত্যি হলো। বোরকা-নিকাব পরতো বলে কত বকেছে, মেরেছে মেয়েকে। আর আজ তাদের সবাইকে মুখ লুকিয়ে চলতে হয়। মেয়ের উপর করা জুলুমের ফল আজ পাচ্ছে। পুরো সংসারটা তছনছ হয়ে গেছে। সব সুখ-শান্তি এক নিমিষেই হারিয়ে গেছে।

.
হাসাহাসির আওয়াজ শুনে মিম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে লিডিংরুমে এলো। আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলো স্বামী এবং সতীনের খুনশুটি। নিরবে চোখের পানি মুছে নিলো। এই ঘরের রাজত্ব একসময় তার হাতে ছিলো। আর আজ এই ঘরের চাকরানীতে পরিণত হয়েছে। মিম আবার তাকালো সামনে। রিহা হামিদের বুকে হেলান দিয়ে বসেছে। মিমের খুব কষ্ট হলো৷ এই বুকে মাথা রাখার অধিকার একমাত্র তার ছিলো। কিন্তু সেই অধিকার অন্য কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে৷ মিমের খুব ইচ্ছে হলো একটাবার হামিদের বুকে মাথা রাখার কিন্তু সেটা এখন সম্ভব নয়। এখন এই ঘরের এবং হামিদের জীবনের রাণী হলো রিহা। রিহা যদি রেগে যায় তাহলে হামিদ তার উপর অনেক নির্যাতন করে৷ সাহস নেই ওদের সামনে যাওয়ার।

পুনরায় ফিরে এলো রান্নাঘরে। হামিদকে কিছুতেই রিহার সাথে সহ্য করতে পারেনা মিম। মানুষটার আদর, যত্নের স্টাইল ছিলো অন্যরকম। সেই ভালোবাসা ফেলে সে কিনা অন্য পুরুষে মত্ত হয়েছিলো। অন্য এক নারীর সংসার ভেঙেছে তাইতো আজ পাপের ফল ভোগ করছে। ডাক পরতেই দ্রুত চায়ের ট্রে নিয়ে গেলো লিডিংরুমে। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে একপাশে দাড়ালো মিম। রিহা কিছুটা চা খেয়ে সেই অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ হামিদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। হামিদও সেটা ভালোবেসে খেয়ে নিলো। এমন দৃশ্য দেখে বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটালো মিমের। হামিদ অফিসের যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে এখন। রিহার কপালে চুমু দিয়ে উঠে দাড়ালো। মিম করুন ভাবে তাকিয়ে রইলো হামিদের দিকে। হামিদ ব্যাগ হাতে নিয়ে বললো,

— “রিহার দিকে খেয়াল রাখবে। ওর যাতে কোনো কষ্ট না হয়।”

হামিদ চলে গেলো। মিম ব্যথিত মন নিয়ে হামিদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। রিহা তাচ্ছিল্য হেসে বললো,

— “সবই তোমার কর্মের ফল। এমন একজন মানুষকে ফেলে কিভাবে পারলে অন্য পুরুষের মাঝে মত্ত হতে? আমিতো অয়নের অবহেলা দেখে সরে পরেছি। তুমি কেনো বেঈমানী করলে? এমন ভালোবাসা পেয়ে কিভাবে পায়ে ঠেলে দিলে? আপসোস তোমার জন্য।”

রিহা চলে গেলো। মিম সেখানে বসে পরলো। হ্যাঁ সে আসলেই বেঈমান। তাইতো এমন একজন মানুষের ভালোবাসা পেয়েও কদর করেনি। নিজের করা কীর্তিকলাপের কারণে বাবা-মাও ঠায় দেয়নি। তারা কঠিন ভাবে জানিয়ে দিয়েছে বাঁচলেও সতীনের ঘর করতে হবে। মরলেও সতীনের ঘর করতে হবে।

____________________________
রাফিকে খাইয়ে দিতে দিতে একবার খালিদের দিকে তাকালো অপ্সরা। রুহিকে কোলে নিয়ে হাটছে, কথা বলছে। মাঝেমধ্যে কপালে চুমু দিচ্ছে। অপ্সরার ভালো লাগলো দৃশ্যটা। রাফির মুখ মুছিয়ে দিতেই দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। সকাল থেকেই বায়না ধরেছে বোনের জন্য খেলনা কিনবে। ছোট ছোট হাড়ি-পাতিল কিনবে। সেই জন্যই এখন দাদার সাথে বাজারে যাচ্ছে। অপ্সরা খাট থেকে নেমে দাড়ালো। বিছানাটা গুছিয়ে পেছন ফিরতেই দেখলো খালিদ দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছে৷ অপ্সরা ভ্রু কুচকে খালিদের দিকে তাকালো। এমন করে রেখেছে কেনো চেহারা সেটাই বুঝতে পারছে না।

খালিদ মুখ গোমরা করে বললো,

— “দেখো মেয়ের কান্ড। হিসু করে ভিজিয়ে দিয়েছে আমাকে।”

অপ্সরা খালিদের গেঞ্জির দিকে তাকিয়ে ফিক করেই হেসে ফেললো। মেয়েটা হিসু করে পুরো গেঞ্জিই ভিজিয়ে দিয়েছে। অপ্সরা রুহিকে কোলে নিয়ে ওর কাঁথা পালটে দিলো। খালিদকে বললো গেঞ্জি পালটে নিতে। অপ্সরার বেশ হাসি পাচ্ছে। লোকটার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আপাতত তা চেপে রেখেছে।

খালিদ গেঞ্জি খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপ্সরার মুখ টিপে হাসা দেখছে। খালিদ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো,

— “আমাকে গেঞ্জি এনে দাও তো।”
— “বারান্দাতেই আছে। নিয়ে নিন না।”
— “পারবো না। তুমি এনে দাও।”

অপ্সরা খালিদের দিকে তাকালো। খালি গায়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। নাক কুচকে ফেলছে একটু পরপর। অপ্সরা তাগাদা দিয়ে বললো,

— “এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে ফেলুন শরীর অথবা গোসল করে নিন। আপনি তো এখনো গোসল করেননি।”
— “পারবো না। তুমি মুছে দাও।”
— “অদ্ভুত! সব কিছুতে এমন পারবো না পারবো না করছেন কেনো? কি হয়েছে?”
— “আতুর হয়ে গেছি বউ।”

কথাটা বলেই হতাশার মতন নিশ্বাস ফেলে অপ্সরার পাশে ধড়াম করে শুয়ে পরলো। অপ্সরা মুখ কুচকে বললো,

— “আপনি রুহির হিসু পরিষ্কার না করেই শুয়ে পরেছেন, ছি! ওয়াশরুমে যান।”
— “উহু, তুমি একটু হেল্প করতে পারছো না? সারাদিন তো বসেই থাকো।”

খালিদ মুখ ভেঙালো। অপ্সরা বিস্ফোরিত চেয়ে রইলো খালিদের দিকে। কিছুক্ষণ এভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ধপধপ শব্দ করে উঠে গেলো অপ্সরা। খালিদ মিটিমিটি হাসছে। বারান্দা থেকে তাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো ভিজিয়ে নিতে। অপ্সরা বেশ খেয়াল করেছে খালিদ ইচ্ছে করেই পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে মজা নেয়। আস্ত ঝগড়ুটে লোকটা, হুহ! ভেজা তাওয়াল নিয়ে খালিদের পাশে বসে খালিদের শরীর মুছে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বললো,

— “দুধের বাচ্চা উনি নিজে কিছু করতে পারবে না হুহ ঢঙ দেখে বাঁচি না। বাচ্চাদের মতন গাঁ মুছিয়ে দিতে হবে, খাইয়ে দিতে হবে ন্যাকামি। আমার রাফিটাও এতো ন্যাকামি করে যতটা করে রাফির বাবাটা৷”

খালিদ অপ্সরাকে বিড়বিড় করে কিছু বলতে দেখে আয়েশ করে শুয়ে বললো,

— “কি বিড়বিড় করছো? জোড়ে বলো আমিও শুনি।”
— “ওতো শুনে লাভ নেই আপনার। দিনদিন আপনি কেমন ঝগড়ুটে হয়ে যাচ্ছেন। আমি মেয়ে হয়েও এতো ঝগড়া করি না। আপনি যতটা করেন।”
— “ঝগড়া করলে এনার্জি পাওয়া যায়। বুঝলে?”
— “ঘোড়ার ডিম পাওয়া যায়।” বিড়বিড় করলো অপ্সরা।

রুহিকে কোলে নিতে চাইলে খালিদ খপ করে অপ্সরার হাত ধরে থামিয়ে দিলো৷ অপ্সরার এলোমেলো চুল কানের পেছনে গুজে দিয়ে বললো,

— “এখনো নাস্তা না খেয়ে বসে আছো কেনো? যাও নাস্তা খেয়ে আসো। আমি রুহিকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।”
— “কিন্তু….।”
— “কোনো কিন্তু না যাও। খেয়ে তাড়াতাড়ি এসো। তোমাকে কিছু কথা বলার আছে।”
— “জ্বী আচ্ছা।”

অপ্সরা উঠে গেলো। বেরিয়ে যেতে গিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকালো। খালিদ রুহিকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। অপ্সরা মুচকি হাসলো। হৃদয়ে ভালোলাগার ঢেউ বয়ে গেলো। আসলে খালিদ যখন দুষ্টামি করে ইচ্ছে করেই ঝগড়া করে তখন অপ্সরারও ভালো লাগে খুব। যদিও ঝগড়ার সময় ভিষণ রেগে যায়। একেবারে বোম হয়ে যায়। কিন্তু পরে বেশ ভালো লাগে। ওকে রাগাতেই খালিদ এমন করে। খালিদের সবকিছুতেই মুগ্ধতা খুজে পায় অপ্সরা।

নাস্তা খেয়ে অপ্সরা রাফিকে খুজলো। শ্বাশুড়ি মা জানালো রাফি এখনো ফিরেনি। অপ্সরা রুমে এলো। খালিদ রুহিকে জড়িয়ে ধরেই শুয়ে ছিলো। অপ্সরাকে দেখে উঠে বসলো। চোখের ইশারায় বারান্দায় আসতে বলে নিজেই আগে চলে গেলো।

দুজনে পাশাপাশি বারান্দার সোফায় বসলো। সোফায় বসেই খালিদ মাথাটা অপ্সরার কাধে এলিয়ে দিয়ে বললো,

— “বিয়ের তো একমাস পেরিয়ে গেলো। টেরই পেলাম না কবে দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে গেলো। তোমার সাথে ঝগড়া করতে করতে খুব তাড়াতাড়িই কেটে গেলো সময়।”
— “হুম..! আপনি কি যেনো বলবেন বলেছিলেন।”
— “হানিমুনের কথা ভাবছিলাম বুঝলে। ভাবলাম বাচ্চাদের সহ নিয়ে যাই হানিমুনে। আমাদের মতো বাচ্চা নিয়ে কয়জনই যায় বলো। বেস্ট হবে তাইনা?”

অপ্সরা লজ্জা পেলো খানিকটা। কিন্তু সেটা চেপে রাগি ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো,

— “আমি কিন্তু এখন ঝগড়া করতে চাচ্ছি না মোটেও।”
— “আহা রাগছো কেনো? হানিমুনের ব্যাপারটা তোমার পছন্দ হয়নি।”
— “ফাজলামি বাদ দিয়ে সোজা কথায় আসুন।”
— “ঠিকাছে ঠিকাছে। বলছি।”
— “হু বলুন।”
— “চুলে একটু হাত বুলিয়ে দাওনা। এমন কিপটা কেনো তুমি? একটু স্বামীর সেবা করলেই তো পারো।”

কথাটা বলেই খালিদ অপ্সরার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। অপ্সরা রাগি লুক দিয়ে খালিদের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। উৎসুক হয়ে খালিদের দিকে চেয়ে রইলো কি বলে তা শুনার জন্য। খালিদ এবার সিরিয়াস হয়ে বললো,

— “জাভেদ ভাবিকে নিয়ে ট্যুরে যাচ্ছে আমাকে বলেছিলো। আমি তোমাকে জানিয়ে সিন্ধান্ত নিতে চাইলাম। বলো যাবে?”
— “কোথায় যাবে তারা?”
— “মেবি সাজেক ভ্যালি যাচ্ছে।”
— “ওহ!”
— “যাবে তুমি?”
— “আপনি প্লিজ রাগ করবেন না। আসলে আমি এখন কোথাও যেতে চাইছি না। মাত্রই তো একমাস হলো বিয়ের। আমি রাফিকে সময় দিতে চাই। ওর সাথে মিশতে চাই আরো। আমি ওর মা হয়ে উঠতে চাই। ওর সব চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে জানতে চাই, বুঝতে চাই। যাতে কখনো রাফির ফিল না হয় আমি ওর সৎ মা।”

অপ্সরার কণ্ঠনালি কেঁপে উঠলো শেষের বাক্যটা উচ্চারণ করতে গিয়ে। খালিদ শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো অপ্সরার দিকে। মেয়েটা আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে। নাকটা লাল হয়ে গেছে। খালিদ উঠে বসলো। অপ্সরাকে টেনে আনলো নিজের দিকে। বলিষ্ঠ হাতে মুড়িয়ে নিলো নিজের বক্ষে। অপ্সরাও বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে গেলো। মাথা তুলে একবার খালিদের দিকে তাকালো। খালিদ মুখ এগিয়ে এনে কপালে দীর্ঘ উষ্ণ ছোঁয়া দিলো। আদুরে গলায় বললো,

— “আলমারিতে একটা প্যাকেট আছে দেখো। সেখানে লাল পাড়ের একটা সাদা শাড়ি, একটা আলতা, একজোড়া ঝুমকা আর এক ডজন কাচের চুড়ি আছে। আজ রাতে একটু সেজো। তোমাকে ওভাবে খুব দেখার ইচ্ছে আমার। বিষেশ করে তোমার আলতা রাঙা পা দেখার খুব ইচ্ছে। সাজবে তো?”
— “জ্বী আমি সাজবো।”

অপ্সরা লাজুক হেসে বললো। খালিদ নিজেও হাসলো।

________________________________
শীত আসবে আসবে এমন একটা ভাব চারিদিকে। জাভেদদের বাড়ির পাশের বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে বসে একটা কৌকিল মিহি সুরে ডেকে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর। সিনথিয়া বারান্দায় বসে পড়ন্ত বিকেলের প্রকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখছে। মৌসুম পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি যেই স্নিগ্ধ সাজে সজ্জিত হচ্ছে সেটাই দেখছে মুগ্ধ হয়ে। দীঘির পাড়ে কিছু ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ছোট্ট জাল। মাছ ধরতে এসেছে মনে হয়। সিনথিয়া সেটাই দেখছে। সিনথিয়ারও এখন ইচ্ছে হচ্ছে এসব আনন্দগুলো উপভোগ করতে। তার শৈশবে কখনো এমন আনন্দ পায়নি। অবহেলা, তিরস্কার ছাড়া।

— “সিয়া দেখো তো আর কিছু নেয়া বাকি আছে নাকি।”

জাভেদের কণ্ঠস্বর শুনে সিনথিয়া উঠে দাড়ালো। বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো জাভেদ ব্যাগ গোছগাছ করছে। সব গোছানো শেষ এখন শুধু একটু চেক করবে কিছু বাদ রয়েছে নাকি। আগামীকালই তারা মেঘেদের দেশে যাবে। সিনথিয়া তার অনুভূতি কিছুতেই ব্যক্ত করতে পারছে না। একটু পরপরই আপ্লুত হয়ে উঠছে।

তেইশ বছরের এই জীবনে কেউ তাকে নিয়ে এতোটা ভাবেনি যতটা ভাবছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা। তার চাওয়া-পাওয়া পূরণ করার জন্য খুব বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছে। এতটুকু দুঃখ যাতে না পায় সেটা নিয়ে সারাক্ষণ তৎপর হয়ে থাকে এই মানুষটা। সিনথিয়া মুচকি হাসলো। সে জানে এসবই তার রবের দান। তার ছোট্ট জীবনে মহান রব একটুখানি সুখ ঢেলে দিয়েছে। কত শুকরিয়া আদায় করবে সিনথিয়ার জানা নেই। মনে হয় যত শুকরিয়া আদায় করবে ততই কম হবে।

সিনথিয়ার ভাবনার মাঝেই নিজেকে কারো উষ্ণ বক্ষে আবিষ্কার করলো। বিড়ালছানার মতো মাথাটা তুলতেই মানুষটা কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিলো। সিনথিয়া সেই মানুষটার বক্ষে নিজের মাথা এলিয়ে দিলো। এখানে সে অনেক প্রশান্তি খুজে পায়। নিরাপদ মনে হয় নিজেকে এই মানুষটার বাহুডোরে।

— “কি এতো ভাবছো সিয়া?” জাভেদের কথায় ধ্যান ভাঙলো সিনথিয়ার।
— “আপনি আমার মতো ময়লা রঙের মানুষকে এতো দেখতে পারেন কেনো বলুন তো?”
— “আবার একই কথা? তোমাকে আমি এসব কথা বলতে নিষেধ করিনি? তাও কেনো বলো? তুমি এসব বলে মূলত সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে অপমান করছো। মানুষের হাতে কিছু নেই সিয়া। মানুষের রুপ, রঙ সব রবের হাতে। তিনি চেয়েছেন তুমি এই রঙের হবে তাই হয়েছো। এতে তোমার নিজেরও হাত নেই। নেক্সট টাইম থেকে এসব যদি বলেছো না এমন মার মারবো তোমায় যে, নিজেকেও চিনতে পারবে না।”
— “আপনি সত্যিই আমায় মারবেন?”

সিনথিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো। জাভেদ সিনথিয়াকে নিজের বক্ষে টেনে এনে বাহুডোরে আবদ্ধ করে বললো,

— “হুম মারবো। তবে সেটা ভালোবাসার মার।”

কানের কাছে ফিসফিস করে বললো জাভেদ। সিনথিয়া লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেললো জাভেদের প্রশস্ত বক্ষে। জাভেদ হাসলো গাঁ দুলিয়ে। ড্রয়িংরুম থেকে সাবিনা চেচিয়ে ডেকে বললো,

— “এই তোরা দুইটা ভাত খেতে আসবি নাকি আমি এখন খুন্তি নিয়ে আসবো দুটোকে পিটাবার জন্য?”

সাবিনার এমন শাসনভরা কথা শুনে সিনথিয়া হেসে ফেললো। জাভেদকে ছেড়ে বললো,

— “চলুন খেতে। মা অপেক্ষা করছে।”
— “চলো।”

সিনথিয়া ড্রয়িংরুমে গিয়ে সাবিনাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— “এইতো এসে গেছি আর খুন্তি নিয়ে ছুটতে হবে না তোমার।”
— “হয়েছে আহ্লাদ দেখাতে হবে না। এবার বস খেতে। না খেয়ে না খেয়ে হাড্ডীসার হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন। সেই খেয়াল আছে? সারাদিনে তোর খাবারের খেয়াল থাকেনা একেবারেই। ট্যুর থেকে ফিরে আয়। তারপর দেখিস তোকে আমি কিভাবে মোটা বানাই।”

সিনথিয়া একটু ঢোক গিলে আঁড়চোখে জাভেদের দিকে তাকালো। শ্বাশুড়ি মা-টাও না। উনার সামনে বলার কি দরকার ছিলো? লোকটা এমনিতেই প্রতিদিন দোকানে যাএয়ার আগে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে থ্রেট দিয়ে যায়। জাভেদের কড়া চাহনি দেখে সিনথিয়া তাড়াতাড়ি টেবিলে বসে পরলো খেতে। আজকে রাতে নিশ্চিত ওকে আরো থ্রেট দিবে সাথে উনার দুষ্টু আচরণ তো আছেই।

— “তোরা তো কাল সকালেই যাবি তাইনা?” অতশি বললো।
— “হ্যাঁ।”
— “যা একটু ঘুড়িয়ে আন মেয়েটাকে। এর আগে কখনোই কোথাও যেতে পারেনি সিনথিয়া।”
— “এবার থেকে যাবে। প্রতি ছয়মাস পরপর ট্যুরে নিয়ে যাবো সিয়াকে। তুমি চিন্তা করো না আপু।”

অতশি মুচকি হাসলো। সিনথিয়া খাওয়া থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো জাভেদের দিকে। প্রতি ছয়মাস পরপর ট্যুরে যাবে? সত্যিই? অনেক ঘুরাঘুরি করতে পারবে তাহলে। অনেক আনন্দ লাগছে সিনথিয়ার। জাভেদ কিছুটা ধমকে বললো,

— “খাচ্ছো না কেনো? দিনদিন তো শুকিয়ে কাঠ হচ্ছো। আমি জানতে চাইলেই বলো খেয়েছি। তাড়াতাড়ি খাও এখন।”

জাভেদের চোখ রাঙানিতে সিনথিয়া চুপসে গিয়ে মাথা নিচু করেই খেয়ে যাচ্ছে। লোকটা চোখ দিয়েই যেনো শাসাচ্ছে হুহ! এমন একটা গুলুমুলু বউকে কেউ শাসায়? সিনথিয়া আঁড়চোখে আবার তাকালো জাভেদের দিকে। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো। আস্ত বজ্জাত লোকটা। এখনো কেমন কটমট করে তাকিয়ে আছে। বেচারি ভয় পাচ্ছে এখন।

সাবিনাকে কাজে সাহায্য করে সিনথিয়া হেলেদুলে রুমে এলো। বেমালুম ভুলে গেছে তখনকার ঘটনা। জাভেদের চোখ রাঙানি। দরজা আটকে সামনে ফিরতেই হেচকা টানে গিয়ে পরলো জাভেদের বাহুডোরে। হুট করে চমকে উঠলো সিনথিয়া। এবার ভয় লাগছে। ইশ! এখন কি হবে? সিনথিয়া কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জাভেদ খাটে হেলান দিয়ে বসে বললো,

— “একটু দূরে যাও। সেখানে গিয়ে কান ধরে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকো।”
— “মা..মানে?” সিনথিয়া অবাক হলো।
— “মানে বুঝতে পারছো না? শাস্তি দিচ্ছি তোমাকে। এতোদিন যে আমাকে ঘোল খাওয়ালে সেটার শাস্তি। কত নিখুঁত ভাবে বলেছো সারাদিন খেয়েছো। যাও এবার শাস্তি ভোগ করো।”
— “স..সরি। আর কখনো এমন হবে না। প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দিন।”
— “টেবিলের দিকে তাকাও।”

সিনথিয়া টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানে বড় প্লেটে একপ্লেট ভাত রাখা। সেটা দেখে সিনথিয়া একটু ঢোক গিলে জাভেদের দিকে তাকালো ভীতু নয়নে। জাভেদ এবার আয়েশ করে শুয়ে বললো,

— “হয় কান ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। নাহয় এখনই প্লেটের সব খাবার সাবার করবে। দুটোর যেকোনো একটা করতে হবে। এবার তুমি চিন্তা করো কি করবে। যদি একটুও হেরফের হয় তো আজ সারারাত ছাদে দাড় করিয়ে রাখবো।”
— “(—–)”
— “নাউ চয়েস ইজ ইউরস। জলদি ডিসিশান নাও।”

সিনথিয়া করুন চোখে তাকালো জাভেদের দিকে। জাভেদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,

— “আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। দেরি হচ্ছে কিন্তু। যত দেরি করবে ততই তোমার শাস্তি বাড়বে।”

সিনথিয়া তাড়াতাড়ি করে কান ধরে একপা উঠিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। পাষাণ একটা লোক। একটুও দয়ামায়া নেই। সামান্য একটা ভুলের জন্য কেউ এমন শাস্তি দেয়? সিনথিয়া একটু ঢলে পরতে নিলেই জাভেদ বললো,

— “একবার পা নামালে এরজন্য দশ মিনিট করে বাড়বে।”
সিনথিয়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
— “একটু আগেই ভাত খেয়েছি এখন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে।”
— “আমাকে মিথ্যে বলার আগে মনে ছিলো না এসব?”

সিনথিয়ার মুখটা এতটুকুন হয়ে গেলো। মুখ নামিয়ে নিলো। চোখে পানি টলমল করছে সাথে বেড়েছে অভিমান। একটুও কথা বলবেনা পাষাণ লোকটার সাথে হুহ। মনে মনে সেটাই ভাবলো সিনথিয়া। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হয়ে গেছে। তারউপর একটু আগে ভাত খেয়েছে। সাবিনা আজকে ধমকে ধমকে বেশি করে খাইয়ে দিয়েছে। এখন হাসফাস লাগছে। ঢলে পরে যেতে নিলেই জাভেদ ধরে ফেললো। আর একটু হলে পরে গিয়ে টেবিলের সাথে বাড়ি খেতো। পাগলিটা এখনই হয়ত কেঁদে দিবে। শাস্তির সময়টা একটু বেশিই হয়ে গেছে।

সত্যিই সত্যিই সিনথিয়া কেঁদে ফেললো। জাভেদ কোলে তুলে বিছানার মাঝে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসলো। সিনথিয়া জাভেদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে বললো,

— “সরুন আমার কাছ থেকে। একদম ছোবেন না আমায়। সরুন।”
— “আহারে আমার বউটা রাগ করেছে।”
— “বেশ করেছি। আপনার কি তাতে?”
— “আমারই তো সব। আচ্ছা আসো শুয়ে পরো। কাল খুব তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।”
— “ঘুমাবো না আমি। যাবো না কোথাও আপনার সাথে। হুহ!” নাক টেনে বললো সিনথিয়া।
— “বউটা অভিমান করেছে বুঝি। এখন তো তাহলে অভিমান ভাঙাতে হবে আমার বউটার।”

জাভেদ সিনথিয়াকে জোর করে শুইয়ে দিলো। নিজেও শুয়ে সিনথিয়াকে জড়িয়ে ধরেছে যাতে নড়তে না পারে। সিনথিয়া ছটফট করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য। আজকে কিছুতেই জাভেদের সাথে ঘুমাবেনা। দরকার হলে বারান্দায় থাকবে। তবুও এই পাষাণ লোকটার বাহুডোরে আর থাকবে না। ছটফট করে সিনথিয়া হাপিয়ে গেছে। কিন্তু মানুষটার কাছ থেকে একটুও নড়তে পারেনি। একপর্যায়ে ঘুমিয়ে গেছে।

সিনথিয়ার কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে মুচকি হাসলো জাভেদ। সিনথিয়ার সব ধরনের আচরণ ভিষণ ভালো লাগে জাভেদের। তাইতো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রাগিয়ে দিবে। আবার শাসাবে। ভয় দেখাবে। সিনথিয়ার ভীতু চেহারাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালোলাগে জাভেদের।

চলবে,,
® ‘নুরুন নাহার।’