তুমি তাই পর্ব-১৪+১৫

0
440

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৪

অফিসিয়াল মিটিংয়ে জাহিদের সঙ্গে জরুরি আলাপে ব্যস্ত ছিলো রেজোয়ান। আচমকা টেলিফোনের রিং
বেজে উঠতেই মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো। রিসিভার তুলে কথা না বলে ফের রেখে দিলো রেজোয়ান। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। কল কেটে যাওয়ার পরেও বিরতিহীন ভাবে কল করা জারি রাখলো অপরপাশের ব্যক্তিটি। রেজোয়ান বিরক্ত হয়ে রিসিভার কানে তুলে নিলো,
-‘হ্যালো। রেজোয়ান স্পিকিং!’

-‘হ্যালো মি.মুরসালীন। রেজা হিয়ার,’

রেজার নামটা শুনে চোখ জ্বলে উঠলো রেজোয়ানের। হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললো। জাহিদকে উদ্বিগ্ন দেখালো। ইদানীং রেজোয়ানের শরীর ভালো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় যথেষ্ট চেঁচামেচি তাঁর শরীরের পক্ষে ভালো হবে না। সে জানে না রেজোয়ান কার সঙ্গে কথা বলছে তথাপি ইশারায় শান্ত থাকতে অনুরোধ করলো ।

রেজোয়ান কাট কাট গলায় প্রশ্ন করলো,’কি চাই?’

-‘আপনাকে আমাদের বিয়েতে ইনভাইট করার জন্য ফোন করেছি মি.মুরসালীন। আগামী এগারোই ফেব্রুয়ারি আমার এবং নিলির বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়েছে।’

রেজোয়ান চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও উঠলো না। নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বললো,’

-‘কংগ্রাচুলেশনস মি.রেজা। উইশ আ ভেরি ব্যাড লাক।’

-‘সরি?’

-‘ভুল হয়ে গেছে। গুডলাক হবে।

-‘থ্যাংক ইউ।

-‘ভালোই হলো আপনি ফোন করেছেন। একসঙ্গে আমার বিয়ের দাওয়াতটা পৌঁছে দেওয়া যাবে।’

-‘আপনার বিয়ে?’

-হ্যাঁ। আমারও বিয়ে। এগারোই ফেব্রুয়ারি আমারও বিয়ে।’

রেজা যেন আকাশ থেকে পড়লো! রেজোয়ানের কথা সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। রেজোয়ান কি তাঁর সঙ্গে মজা করছে তাও বুঝতে পারছে না। তবে অবাক হোক আর যাই হোক ব্যাপারটা জোরপূর্বক হজম করে গেলো সে। কৃত্রিম আন্তরিকতার সুরে বললো,

-‘তাই নাকি? হোয়াট আ কো ইন্সিডেন্স! এনিওয়ে কংগ্রাচুলেশনস মি.মুরসালীন।’

-‘কোইন্সিডেন্স তো বটেই আমার হবু স্ত্রীর নামও নিলি রহমান। ভেন্যুটাও সেইম।’

রেজোয়ান ইচ্ছে করে রেজার মনের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিলো। এতক্ষনে জাহিদের বোঝা হয়ে গেছে রেজোয়ান কার সঙ্গে কথা বলছে। মুখটিপে হাসলো সে। রেজোয়ান মুরসালীন একবার যার ওপর থাবা বসায় তাঁর আর মুক্তি নেই। রেজা আবার সেই থাবার শিকার হতে যাচ্ছে।

রেজোয়ান গলাটা আরেকটু খাদে নামিয়ে বললো,
-‘একটু সাবধানে থাকবেন ভাই। বিয়ের দিন কিডন্যাপ-টিডন্যাপ হয়ে গেলে তো সমস্যা। তখন তো আপনার বউ নিয়ে অন্যলোকে ভাগবে।’

শান্ত থাকার চেষ্টা করলেও রেজার পেটের কেমন করছে। রেজোয়ান সরাসরি তাঁকে থ্রেট দিচ্ছে। হাড়বজ্জাত ছেলে এই রেজোয়ান! একে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই নিলিকে টোপ হিসেবে বেছে নিয়েছে রেজা এখন উল্টে তাঁকেই টোপ বানানোর প্ল্যান করছে রেজোয়ান। ভাবছে বিয়ের আসর থেকে রেজাকে কিডন্যাপ করে সে নিজে বিয়ে করবে? আচ্ছা? এত সহজ। গতবার নাহয় রেজা কিডন্যাপের কথা জানতো না। কিন্তু এবার আর তো সে জেনে গেছে। এবার আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রাখবে। দরকার পড়লে বিয়ের দিন পুলিশ পাহারা বসাবে।

-‘আপনি ব্যবসা ছেড়ে মানুষ কিডন্যাপিং কবে থেকে শুরু করেছেন?’

-‘ধুর। মানুষ কিডন্যাপ শুরু করতে যাবো কেন? আমি তো কিডন্যাপ করবো একটা নেড়ি কুত্তাকে। চিড়িয়াখানায় যাওয়ার বহুত শখ হয়েছে কুত্তাটার।’

ইনডাইরেক্টলি রেজোয়ান তাঁকে কুকুর বলছে ভেবে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো রেজা। ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’মুখ সামলে কথা বলুন মি.মুরসালীন।’

জবাবে রেজোয়ান অত্যাধিক নমনীয়, কোমল কন্ঠে বললো,’আপনি কেন উত্তেজিত হচ্ছেন? আমি তো আপনাকে কুকুর বলি নি।’

রেজা বুঝলো কথার মারপ্যাঁচে তাঁকে অপমান করার ফন্দি এঁটেছে রেজোয়ান। আচমকা যেমনি রেগে গেছিলো তেমনি আবার শান্ত হয়ে গেলো। ফিচেল হেসে বললো,
-‘আপনি আমাকে যাই বলুন না কেন আপনার প্রিয়তমা কিন্তু আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভক্তিতে একেবারে গদগদ। আমি চাইলেই তাঁকে দিয়ে যেকোনো কাজ করাতে পারি। এমনকি নিজের শয্যাসঙ্গীও বানাতে পারি। কিন্তু আপনার কথা ভেবে মায়া হয়। শত হলেও আপনার পুরাতন প্রেমিকা, বিয়ের আগে এমন কিছু করেছে জানলে আপনি নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাবেন। তাই ছেড়ে দিয়েছি। তবে বিয়ের পর কিন্তু আর ছাড়বো না। ‘

রেজোয়ান হাসলো। বললো,
-‘সেই চেষ্টা যে আপনি করেন নি এ আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে বাগে আনতে না পারেন নি। তাই এসব ভুজুংভাজুং শুনিয়ে আমাকে রাগাতে চাইছেন। কি তাইতো?’

ধরা খেয়ে রেজার অঙ্গ জ্বলে উঠলো। মাথায় রক্ত উঠে গেলো। একথা সত্যি যে, রেজোয়ানকে অপদস্থ করার জন্যই নিলিকে বেছে নিয়েছিলো সে। কিন্তু এর বাইরেও যে নিলির প্রতি তাঁর আলাদা লোভ নেই সেকথা মিথ্যে। ভেবেছিলো ফুঁসলে ফাঁসলে কোনমতে একবার বিছানায় নিয়ে যেতে পারলেই কাহিনী খতম। বিয়ে-টিয়ে করার দরকার পড়বে না। কিন্তু নিলি তাঁকে সেই সুযোগই দেয় নি। ঐ হাত ধরাধরি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো সবকিছু।

রেজার নিরবতা রেজোয়ানের হাসিকে প্রশস্ত করে দিলো। শীতল বাতাস বসে গেলো সমস্ত শরীরে। আবেগ মিশ্রিত গলায় বললো,

-‘সি ইজ মাই গার্ল!…আই নো মাই গার্ল, সি উইল নেভার লেট ইউ গেট দ্যা চান্স।’

রেজা রাগে ক্রুদ্ধ হয়ে ফোন রেখে গেলো। যেই উদ্দেশ্যে সে রেজোয়ানকে ফোন করেছিলো সেই উদ্দেশ্য বিফল। উল্টে তাঁর নিজের মাথায় আগুন জ্বলছে। গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে রেজোয়ান আর তাঁর ঐ সতী সাবিত্রী প্রেমিকা।
নিজেকে শান্ত করা চেষ্টা করলো রেজা। প্রবোদ দিলো, আর তো মাত্র কয়টা দিন। বিয়েটা হয়ে গেলেই আসল খেলাটা শুরু করবে সে। নিজের অর্ধশত কোটি টাকা যদি রেজোয়ানের কাছ থেকে আদায় না করে ছেড়েছে তবে তাঁর নামও রেজা নয়।

রেজোয়ান ফোন রেখে জাহিদের দিকে তাকিয়ে হাসলো। জাহিদ হাসছে। বললো,

-‘আপনি কিন্তু ভীষণ ঝগড়া করতে পারেন স্যার। রেজা সাহেব নিশ্চয়ই এখন রাগে ফুঁসছে।’

ঝগড়ার প্রসঙ্গ উঠতেই চট করে তিন্নির কথা মনে পড়লো রেজোয়ানের। ছাদে সেদিন কথাগুলো বলার পর থেকে তিন্নির সঙ্গে আর দেখা হয় নি। মেয়েটা ভীষণ অভিমানী। কি করে নিজেকে সামলাচ্ছে কে জানে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রেজোয়ান। এখন তিন্নির সঙ্গে দেখা না হওয়াই ভালো। নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নেওয়ার জন্যে হলেও কিছুটা সময় দরকার।


পাঁচসাত দিন পরের কথা
তিন্নির রেজাল্ট বেরিয়েছে। অনেকদিন বাদে দেখা করতে এসেছে রেজোয়ান। তিন্নি তখন দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমাচ্ছিলো। রেজোয়ান এসেছে শুনে তড়িঘড়ি করে উঠে গেলো। তবে কোন অস্থিরতা দেখালো না। ধীরেসুস্থে ফ্রেশ হয়ে রেজোয়ানের সামনে গেলো। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে রেজোয়ান। তাঁর চেহারার অবস্থা দেখে তিন্নির চোখে পানি চলে এলো। চোখ মুখ বসে খুবই করুণ অবস্থা রেজোয়ানের। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে অর্ধেক হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি, মুখভর্তি দাড়ি। কেমন একটা বিষন্ন চেহারা।

গত দুরাত ঠিকমত ঘুমাতে পারে নি রেজোয়ান। দুদিন আগেই নিলির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো। কিন্তু ফিরে এলো তিক্ত মন নিয়ে। নিলি তাঁর সামনে দিয়েই রেজাকে নিয়ে বিয়ের শপিং করার জন্য বেরিয়ে গেছে। নিলিকে সে কোনভাবেই বোঝাতে পারছে না রেজোয়ান একটা মুখোশধারী শয়তান। নিলি তাঁর কোন কথাই কানে তুলছে না। এসব ভেবে অস্থির হয়ে আছে মান।

তিন্নি নিজেকে সামলে নিলো। গলা পরিষ্কার করে বললো,’কেমন আছেন রেজোয়ান ভাই?’

রেজোয়ান চোখ খুললো। অদ্ভুত বিষন্ন এক হাসি দিলো তিন্নির দিকে তাকিয়ে। তারপরই অভিমানের সুরে বললো,

-‘তুই আমাকে বদদোয়া দিয়েছিস তাই নারে তিন্নি?’

-‘আমি? আমি আপনাকে বদদোয়া কেন দেবো?’

-‘দিয়েছিস। আলবাত দিয়েছিস। নইলে নিলির অন্য জায়গায় বিয়ে করতে যাচ্ছে কেন?’

তিন্নির চোখে মুখে সীমাহীন বিস্ময় ফুটে উঠলো। বললো,

-‘অন্য জায়গায় বিয়ে করতে যাচ্ছে?’

-‘হ্যাঁ। অন্য জায়গায় বিয়ে করতে যাচ্ছে। তারওপর যাকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে সে আস্ত একটা বদমাইশ। আমি কোনভাবেই ওকে আটকাতে পারছি না। ওর ধারণা আমি ইচ্ছে করে রেজার নামে খারাপ খারাপ কথা বলছি।’

-‘তাঁর এমন ধারণার কারণ?’

-‘বদমাইশটা আমাকে জব্দ করার জন্য নিলির দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছ্র। নিলির বাবা অসুস্থ থাকাকালীর টাকা পয়সা দিয়ে ওকে সাহায্য করছে। আমার অফিস থেকে চাকরী ছেড়ে দেওয়ার পর নিলিকে নিজের পি.এস হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। আর সেইজন্যই নিলি ভাবছে ওর মত বুঝি মানুষ হয় না।’

-‘ভাবারই তো কথা। দুঃসময়ে যেই মানুষটা পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁকে আপনি খারাপ মানুষ বলছেন কি করে? হতেও তো পারে আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে?’

-‘ধুর। কোন ভুল হয় নি আমার। ও যে একটা বদমাইশ তাঁর প্রমাণ আমি নিজে। বদমাইশটা আমার আর নিলির পুরোনো ছবি ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে একশো কোটি টাকা দাবি করেছিলো আমার কাছ থেকে।’

তিন্নির চোখ কপালে উঠে গেলো। গোল গোল চোখে চেয়ে থেকে বললো,’একশো কোটি টাকা?’

-‘হ্যাঁ। একশো কোটি টাকা। তাহলেই বুঝ কেমন শয়তান?’

-‘আপনি টাকা দিয়েছিলেন?’

-‘পাগল নাকি। একশো কোটি টাকা কি মগেরমুল্লুক? যে চাইলো আর আমি দিয়ে দেবো? আমার ব্যবসা লাটে উঠতো তাহলে। অন্যভাবে শায়েস্তা করেছি। এবারও ছাড়বো না। সে যাই হোক তোর কি খবর? ভর্তি পরীক্ষা দিবি তো নাকি?’

-‘দেবো।’

-‘ঠিক আছে। পড়াশুনা করিস ঠিক মতো। আমি তাহলে আসি।’

রেজোয়ান বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলো। তিন্নি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো,

-‘একটা প্রশ্ন ছিলো রেজোয়ান ভাই?

-‘কি প্রশ্ন?’

-আপনার রাজকন্যা কি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসে? না মানে সে তো অন্য একজনকে বিয়ে করছে। হতে পারে রাগ করে করছে, তবুও বিয়ে তো।’

-‘তোর মনে হয় আমি সত্যি সত্যি বিয়েটা হতে দেবো? নিলি আমার ওপর অভিমান করে এসব করছে। আমিও তো কম কষ্ট দিই নি। তাই রাগ করেছে। জানিস তো, যেখানে ভালোবাসা বেশি সেখানে রাগ, অভিমান এগুলো বেশি। এসব কোন ব্যাপার না।আমি ওকে ঠিক আমার করে নেবো।’

কথা শেষ করে রেজোয়ান বেরিয়ে গেলো। যদিও নিলির ব্যাপারে সে ভীষণ টেনশনে আছে, নিলি আদৌ তাঁকে ক্ষমা করবে কিনা, আবার তাঁরা নতুন করে শুরু করতে পারবে কিনা এসব ভেবে অস্থির লাগছে। আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটা না বুঝে নিজের সর্বনাশ করতে চলেছে কিন্তু তিন্নিকে এসব কিছুই বুঝতে দিলো না। উপরন্তু কথাবার্তা বলার সময় এমন সাবধানে বলেছে যেন তিন্নির মনে তাঁকে নিয়ে বিন্দুমাত্রেও আশার সঞ্চার না হয়। রেজোয়ান চায় না তিন্নি মিথ্যে কোন আশা দিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখুক। নিজের জীবনটা সে নতুন করে গড়ে তুলুক।

রেজোয়ান বেরিয়ে গেলে তিন্নির অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো,’আমি আপনাকে অনেক বেশি ভালোবেসেছিলাম রেজোয়ান ভাই। আপনার ঐ রাজকন্যার চাইতেও বেশি। কিন্তু আফসোস আপনি আমার ত্যাগটুকু দেখতে পেলেন না।’

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৫

কপালে ভেজা রুমাল চাপা দিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফুয়াদ। কিছুক্ষণ আগেই তাঁর কপাল বরাবর কোকাকোলার একটা ক্যান ছুঁড়ে মারা হয়েছে। এবং এত জোরে ছুঁড়ে মারা হয়েছে যে কপাল ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে যিনি ছুঁড়ে মেরেছেন তাঁর বিন্দুমাত্রেও আফসোস নেই। বরঞ্চ রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর চিৎকারে ফুয়াদের কানে তালা লেগে গেছে। কানের কাছে শিঁইইই শিঁইইই টাইপ একটা আওয়াজ হচ্ছে।

ভর্তি পরীক্ষার দেওয়ার জন্য নিজের সার্টিফিকেট গুলো ফটোকপি করতে এসেছিলো তিন্নি। ফাইল থেকে পেপারগুলো বের করে দেখে নিচ্ছিলো কোনটা কোনটা ফটোকপি করতে দেবে, ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা কোকাকোলার ক্যান এসে কাগজের ওপর পড়লো। ভেতরের অবশিষ্ট পানীয় পড়ে ভিজে গেলো সার্টিফিকেটের কাগজগুলো। তাড়াহুড়া করে গুলো ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে সার্টিফিকেটের একাংশ টান লেগে ছিঁড়ে গেছে। ব্যস শুরু হয়ে গেলো লঙ্কাকাণ্ড।
কান্নাকাটি, চিৎকার চেঁচামেচি, ক্যান ছুঁড়ে মারা ব্যক্তির চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধারসহ সর্বোপরি তাঁর কপাল বরাবর পুনরায় ক্যানের বোতলটা ছুঁড়ে মেরেও শান্ত হলো না তিন্নি। রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে লোক জড় করলো ফুয়াদকে মারার জন্য।

ফুয়াদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে সামনে এগিয়ে এলো। তার কপালে তখনো রুমাল চাপা দেওয়া। মানুষ জন হাঁ করে তামাশা দেখছে। এই নিতান্ত ভদ্রটাইপ ছেলেটার সঙ্গে তিন্নির ঠিক কি কারণে শত্রুটা থাকতে পারে সেটা ওরা বুঝতে পারছে না।

ফুয়াদ তিন্নিকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বিনয়ী গলায় ডাক দিলো,

-‘এক্সকিউজমি ম্যাম। আমার নাম ফুয়াদ…’

সে কথা শেষ করার আগেই তিন্নি তেঁতে উঠলো। পারলে সে আবার ফুয়াদের মাথা ফাটিয়ে দেয়। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’ধন্য হলাম। ধন্য হলাম আপনার মত এমন অসভ্য লোকের নাম জানতে পেরে। আরো ধন্য হতাম যদি বাড়ি মেরে আবার আপনার কপালটা ফাটিয়ে দিতে পারতাম।’

-‘আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি আসলে ক্যানটা বিনে ফেলতে চেয়েছিলাম। ভুলবশত আপনার ফাইলের ওপর পড়ে গিয়েছে।’

-‘ভুলবশত? আপনি তিন মাইল দূর থেকে ক্যানের বোতল ছুঁড়ে মারবেন কেন? রাস্তাঘাট কি ক্যান ছোড়াছুঁড়ির জায়গা? এখন যে আমার সার্টিফিকেট গুলো নষ্ট হয়ে গেলো এর দায়ভার কে নিবে?’

ফুয়াদ লজ্জিত মুখে অনুনয় করে বললো,

-‘আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি আপনার পেপার গুলো নতুন করে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। টাকাপয়সা যা লাগবে আমি দেবো। ‘

-‘অবশ্যই দেবেন। কেন কিছু মনে করবো? জিনিস নষ্ট করেছেন, এখন সেটার ক্ষতিপূরণ দেবেন এখানে আমার মনে করার কি আছে? আপনি আজই যাবেন আমার সঙ্গে।’

ফুয়াদ মনে মনে অবাক হলেও রাজী হয়ে গেলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঝামেলা মিটিয়ে নিতে চাইলো। তিন্নির রাগ যদিও কমে নি তবে ফুয়াদের ফুলে থাকা কপালের দিকে তাকিয়ে খানিকটা শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছে।

রিক্সায় উঠে ফুয়াদ খানিকটা আলাপ জমাতে চেষ্টা করলো। কারণ, তিন্নিকে সে প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছে। এই মেয়েটার সঙ্গেই একবার বিয়ের প্রস্তাব উঠেছিলো তাঁর। কিন্তু কি একটা ঝামেলার কারণে ফুয়াদের ফুপু সম্বন্ধটা এগোতে দেন নি। এখন মনে হচ্ছে না দিয়ে ভালোই করেছে। এমন ঝগড়ুটে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে ফুয়াদের জীবনটা তামা তামা হয়ে যেতো। এই বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই।

তবে যাই হোক না কেন, ফুয়াদ এইমুহূর্তে ভীষণ লজ্জিত। সে খুবই রেস্পন্সিবল এবং ডিসেন্ট প্রকৃতির ছেলে। এরকম একটা আনসোশ্যাল কাজ তাঁর দ্বারা কোনদিন ঘটে নি। আজকে হঠাৎ কি হলো কে জানে। নেহায়েত ছেলেমানুষি করে ক্যানটা বিন বরাবর সই করতে গিয়েছিলো। তাতেই অঘটনটা ঘটে গেলো। সুতরাং তিন্নির রেগে যাওয়াটা একেবারেই অমূলক নয়। মোলায়েম কন্ঠে বললো,

-‘বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছা করে করি নি।আনফরচুনেটলি আপনার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটে গেছে। কেন যে হঠাৎ ক্যানটাকে ছুঁড়ে মারতে গেলাম! ভেবেছিলাম টার্গেট মিস হবে না। সরি, এক্সট্রিমলি সরি।… আপনি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছেন?’

-‘কেন রেগে থাকলে কি করবেন? পা ধরে মাফ চাইবেন?’

ফুয়াদ গলা খাঁকারি দিলো। নাহ! এই মেয়ের সঙ্গে কথা না বলাই ভালো। মানসম্মান রাখবে না। ঠোঁটকাটা, বদরাগী।
বোর্ড অফিসে পৌঁছানোর পর তাঁরা থানায় ডাইরী করতে বললো। সেখান থেকে তিন্নিকে নিয়ে থানায় গেলো ফুয়াদ। থানা থেকে জিডির কপি নিয়ে সেটা আবার বোর্ড অফিসে জমা দিতে হবে। একদিনে সমস্তটা সম্ভব নয়। তাই কালকে আবার বেরোতে হবে। থানা বেরোনোর পর ফুয়াদ ভদ্রতা রক্ষার্থে জিজ্ঞেস করলো,

-‘কিছু খাবেন? এতক্ষণ যাবত ঘোরাঘুরি করছেন নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছ?’

-‘তো?’

-‘না মানে খিদে না পেলে থাক।’

তিন্নি জবাব দিলো না। তাঁর মন মেজাজ ভালো নেই। ইদানীং আগের চাইতে অনেক বেশি খিটখিটে হয়ে গেছে সে। মায়ের সঙ্গে পর্যন্ত ঝগড়া বেধে যায়। আর ফুয়াদ তো বাইরের মানুষ। বললো,

-‘আমি এখন কিছু খাবো না। বাসায় যাবো।’

-‘ঠিক আছে আমি আপনাকে রিক্সায় তুলে দিচ্ছি।’

-‘লাগবে না। আমি উঠতে পারবো।’

-‘তাহলে আপনার ঠিকানা কিংবা ফোন নম্বরটা দিয়ে যান। কালকে তো আবার বোর্ড অফিসে যেতে হবে।’

এতক্ষণে কিছুটা শান্ত হলো তিন্নি। ছেলেটা নেহায়েত মন্দ নয়। অনিচ্ছাকৃত ভাবে একটা ভুল করে ফেললেও সেটা শুধরাতে চাইছে। নরম হয়ে এলো তাঁর গলা। বললো,

-‘আপনাকে আর যেতে হবে না। আমি জমা দিয়ে আসবো। ধন্যবাদ।’

-‘সেটা কি করে হয়? আমার জন্যই তো আপনার ক্ষতিটা হলো।’

-‘দেখুন আপনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমাকে সাহায্য করেছেন তার জন্য আপনাকে থ্যাংক ইউ। এর বেশি আর কিছু করার প্রয়োজন নেই। অপরিচিত কারো সঙ্গে আমি নিজের ফোন নাম্বার কিংবা বাসার ঠিকানা কোনটা শেয়ার করতে রাজি নই। সরি। ভালো থাকবেন। আসি।’

কথা শেষ করে চট করে একটা রিক্সায় উঠে পড়লো সে। ফুয়াদ নিজেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারায় নয় এই মেয়ের সঙ্গে তাঁকে আর কোথাও যেতে হবে না সেইজন্য। নিজের কৃতকর্মের জন্য ফুয়াদ অবশ্যই অনুতপ্ত কিন্তু তিন্নির সঙ্গে দেখা আবার করাটা খুবই কষ্টকর। ভালো মানুষেরও মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। রাগ উঠে যাবে ওর ত্যাড়াত্যাড়া কথা শুনলে। যদিও আজকে দোষটা ফুয়াদের কিন্তু সে বেশ বুঝতে পেরেছে তিন্নি স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই রাগী। আবার ঝগরুটেও।

নিলির বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রেজোয়ান এবং জাহিদ। রেজোয়ান বারবার জাহিদকে ঠেলছে ভেতরে যাওয়ার জন্য। জাহিদ ভয়ে রাজি হচ্ছে না। নিলির মেজাজ খারাপ। গতকাল রাতেও জাহিদকে ফোন করে রেজোয়ানের নামে নালিশ করেছে। বারবার করে বলেছে জাহিদ যেন রেজোয়ানকে বোঝায় সে ভুল করছে। রেজার মতন একটা ভালো মানুষের সঙ্গে অন্যায় করছে রেজোয়ান। এরজন্য নিলি তাঁকে কোনদিন ক্ষমা করবে না।
আর সেই জাহিদকেই কিনা এখন রেজোয়ান নিলিকে কনভিন্স করার জন্য পাঠাচ্ছে! অসহায় লাগছে জাহিদের। এদের দুজনের মাঝখানে পড়ে তাঁর অবস্থা দফারফা হয়ে যাচ্ছে। দুজনে দুদিক থেকে খারাপ করে দেয়।

রেজোয়ান পুনরায় তাড়া দিলো। জাহিদ মিনমিন করে বললো,’না মানে বলছিলাম কি স্যার, কথাগুলো আপনি গিয়ে বুঝিয়ে বললে ভালো হতো না?’

-‘আমি যতবার বলেছি ও কানে তোলে নি। ওর ধারণা আমি বানিয়ে বানিয়ে রেজার নামে খারাপ কথা বলছি। তাই তুমি গিয়ে বলবে। ওর রিয়েকশন যদি পজিটিভ হয় তখন আমি ভেতরে ঢুকবো।’

বাহ! তারমানে ঝড় যা যাক , সব জাহিদের ওপর দিয়েই যাক। রেজোয়ান সেইফ থাকলেই হলো। স্বার্থপর সুবিধাবাদী লোক একটা!
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জাহিদ। সে-ই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি যে কি না বসের হয়ে তাঁর প্রেমিকার ঝাড়ি খেতে যাচ্ছে। অথচ সে নিজে এই জীবনে একটা প্রেম করতে পারে নি। অর্ধেক জীবন কেটে গেছে রেজোয়ানের সমস্যার সমধান করতে করতে। পারিবারিক কিংবা ব্যবিসায়িক যাই হোক না কেন রেজোয়ানের সকল সমস্যার সমাধানে জাহিদের ভূমিকা অতুলনীয়।

রেজোয়ান অবশ্য এসব কিছু ভাবছে না। তাঁর ধারণা জাহিদের সঙ্গে কোনরূপ খারাপ ব্যবহার করবে না নিলি। জাহিদকে সে রেজোয়ানের চাইতে বেশি ভালো জানে। কিন্তু আধঘন্টা বাদে যখন জাহিদ চুপসে যাওয়া বেলুনের মত মুখ করে বেরোলো তখন রেজোয়ানের ধারণাটা পালটে গেলো। জাহিদ হতাশভাবে মাথা দুলিয়ে বললো,

-‘আই অ্যাম সরি স্যার। আই কান্ট হেল্প। সি ইজ এক্সট্রিমলি ফেড আপ উইথ ইউ। বিয়ের দিন মি. রেজাকে কিডন্যাপ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ‘

জাহিদকে দেখে প্রথমে খুশিই হয়েছিলো নিলি। ভেবেছিলো রেজোয়ানের কুকীর্তির কথা সব জানাবে। রেজার মুখ থেকেই শুনেছে সে রেজোয়ান নাকি বিয়ের দিন রেজার কিডন্যাপ করার হুমকি দিয়েছে। মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে।
সবশুনে মনে মনে রেজার প্রতি দুঃখ বোধ করলো নিলা। তাঁকে হেল্প করতে গিয়ে বেচারা বিনাদোষে বারবার রেজোয়ানের হাতে অপদস্থ হচ্ছে। ভীষণ রাগ হলো নিলির। জাহিদের সঙ্গে এর একটা বোঝাপড়া করে নিতে চাইলো। হয় জাহিদ রেজোয়ানকে বুঝাবে নতুবা নিলি নিজে থানায় গিয়ে রেজায়ানের নামে কমপ্লেইন করে আসবে।
কিন্তু এসবের মাঝখানে জাহিদের মুখ থেকে উলটো রেজার বদনাম শুনে খেপে গেলো। তাঁর ধারণা, রেজোয়ানের শেখানো বুলি কপচাতেই এসেছে জাহিদ। তাই রাগে দুঃখে, ভদ্র ভাষায় কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে বললো।
জাহিদের মুখে সব শুনে রেজোয়ানের একই সঙ্গে মেজাজ খারাপ এবং অসহায় লাগছে। রেজা খুব ভালোভাবে ব্রেনওয়াশ করেছে নিলির। কারো কথা বিশ্বাস করছে না সে। এভাবে চলতে থাকলে বিয়েটা কোনতেই ঠেকাতে পারবে না রেজোয়ান। জাহিদকে অপেক্ষা করতে বলে সে নিজে গেলো নিলির সঙ্গে কথা বলার জন্য।
চলবে।