তুমি নামক অনুভূতি পর্ব-০৫

0
709

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৫
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ]

স্বচ্ছ, শুভ্র রঙের এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি পার্কিং করলেন উনি। আমি ওনার দেওয়া আকাশী রঙের মাস্কটা হাতে নিয়ে বসে আছি। আর অশান্ত, অস্থির মন নিয়ে ভাবছি, বাসার সামনে এসে কেন উনি আমাকে মাস্ক পড়তে বললেন? আমার এই ছোট্ট মস্তিষ্কে বিষয়টা রহস্যময় মনে হচ্ছে।

মোবাইল ফোন হাতে করে গাড়ি থেকে বের হলো সমুদ্র। অবিরাম দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেও ক্লান্ত হয়নি সে। কিন্তু তার মনের মাঝে মেহেরকে নিয়ে অস্বস্তি বিদ্যমান। প্রচন্ড বিরক্ত সে মেহেরের উপর। সারা রাস্তা মেয়েটা নিরবে চোখের পানি ফেলেছে। এতে সমুদ্র বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারেনি। বর্তমানে মেহেরের প্রতি পূর্বের ন্যায় বিরক্ত সে। কারণ এখনো মেয়টা গাড়ি থেকে বের হয় নি। মাস্ক হাতে নিয়ে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা। মেহেরের ফ্যাকাশে মুখটা দেখেও তার মন নরম হলো না। রাগ মাখা তিক্ত কন্ঠ বলে উঠলো,

–এই মেয়ে, গাড়ি থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না? গাড়িতে থাকতে চাও? ওকে ফাইন তুমি থাক।

লোকটার ভর্ৎসনা শুনে আমি হাল্কা কেঁপে উঠলাম। গাড়িতে বসে জানালার কাঁচ ভেদ করে উনার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করলাম। আকাশী রঙের মাস্ক এবং কালো সান গ্লাসের আড়ালে ঢেকে রয়েছে তার মুখের গঠন। তার ভ্রূ যুগল দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে সে খুবই রেগে আছেন। অসীম বিরক্ত সে। তৎক্ষণাৎ মাস্কটা মুখে পড়ে, বিহ্বল হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। সে আমার অপেক্ষা না করেই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলছেন। আমি বিচলিত হয়ে দৌড়ে গেলাম তার নিকটে। তার পায়ের তালে তাল মিলিয়ে চলতে লাগলাম। তিনি অতিদ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে লিফটে উঠলেন। আমিও তার সঙ্গে লিফটে চলে এলাম। সিক্স ফ্লোরে এসে লিফট থেমে গেল। বুঝতে পারলাম সে সিক্স ফ্লোরে থাকেন। লিফট থেকে নেমে সে তার ফ্লাটের মেইন ডোরের লক খুলে রুমের ভিতরে প্রবেশ করলেন। সারা ঘর জুড়ে অন্ধকার বিরাজমান। অন্ধকার জিনিসটা বারংবার আমার অপছন্দ। এক কথাই অন্ধকারে আমার ফবিয়া আছে। সেকেন্ড পাঁচেক অন্ধকার ফলে আমার শরীরে কাঁপুনি শুরু হয় গিয়েছে। খানিক বাদেই উনি লাইট অন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠলো। স্বপ্ন, পরিষ্কার ঘরটা আলোতে চকচক করে উঠলো। এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে আমি থতমত। লোকটা সত্যি অনেক স্মার্ট। ঘরটা এতোটাই পরিষ্কার যে সাদা ফ্লোরটা চকচক করছে। বদ্ধ ঘর হওয়ার সত্বেও কোথাও ধুলো বালির উপস্থিতি নেই। আমি হা করে ঘরটা পর্যবেক্ষণ করছি। পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম আমি যে ঘরটা অবস্থান করছি তা হলো ড্রইং রুম। আমাকে ঘরটা ঠিক মতো দেখতে দিলেন না সমুদ্র নামের খারাপ লোকটা। তিনি সান গ্লাস পরিহিত অবস্থায় আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে বলে উঠলেন,

–এই পুঁচকি, সামনে দিকে যে রুমটা দেখতে পাচ্ছ ওইটাতে তুমি থাকবে। আর হ্যাঁ আমার রুমের আশেপাশেও যেন তোমাকে না দেখি। গো,,

বলেই আমাকে উপেক্ষা করে তিনি কোট খুলে হাতে নিয়ে নিজের গন্তব্যে চলে গেলেন। আমি খেয়াল করলাম, ওনার ফ্লাটে তিনটে রুম। একটা উনার বেডরুম। অন্যটা গেস্ট রুমে অর্থাৎ এখন থেকে বর্তমানে আমি যেখানে থাকব। তাছাড়া কিচেন, ড্রইং রুম আছে যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
__
ঘরে এসে একটানা এক ঘন্টা শাওয়ারে মত্ত ছিল সমুদ্র। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রুমে এসেই সমুদ্র খেয়াল করলো তার ফোনটা অনবরত বেজে চলছে। সিল্কি চুলগুলো মুছতে মুছতে সে এগিয়ে গেল ফোনের দিকে। ফোনের স্কিনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তার মুখশ্রী বিরক্তিতে বিষাদগ্রস্ত হয়ে উঠলো। বিরক্ততে ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে মৃদু আওয়াজ বের করলো। ফোন রিসিভ করে বেলকণিতে চলে গেল।
_____
আসরের সালাত আদায় করে একপলক ঘড়ির দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলাম। পনে চরটা বাজে। শীতের দিন হওয়ার সুবাদে খানিক বাদেই বেলা ডুবে যাবে। সূর্যের আলো বিদায় নিয়ে রাত্রির অন্ধকারে ডুবে যাবে চারপাশ। এখনো দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। খিদেয় আমার পেটে লঘু ব্যথা অনুভব হচ্ছে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার ফলে মাথাটা ভারী হয়ে রয়েছে। এখন অবধি শাওয়ার নেওয়া হয়নি। তাই হয়তো মাথা ভারী হয়ে আসছে। খাবারের সন্ধানে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে এলাম। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফার উপর বসলাম। ড্রইং রুমের সামনে উনার রুম তাই ওনার খোঁজে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। কিন্তু পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম তিনি রুমে নেই। ভাবলাম ওয়াশরুমে আছেন।
খানিকক্ষণ বাদে মেইন ডোর খুলে ভিতের প্রবেশ করলো সমুদ্র। তার হাতে দুটো প্যাকেট বিদ্যমান। ডোর লক করে একপলক মেহেরের দিকে তাকিয়ে টেবিলে উপর খাবারের প্যাকেট দুটো রাখলো। কিচেন থেকে দুটো প্লেট এনে খেতে বসে পড়লো সে। মেহেরের দিকে না তাকিয়ে গর্জন স্বরে বলল,

–খাওয়া ইচ্ছে নেই?

সোফার উপর চোখ বুজে বসে ছিলাম। মূহুর্তেই লোকটার কঠিন গলা শুনে আমার চোখ খুলে গেল। বুঝতে পারলাম খাবার খেতে ডাকছেন। খাবার দেখে আর এক মূহুর্তেও বসে থাকলাম না। জলদি গিয়ে টেবিলের সামনে বসে পড়লাম। তাকে উপেক্ষা করে, তার দিকে না তাকিয়ে খেতে আরম্ভ করে দিলাম।

খাওয়া শেষ করে উনি নিজের প্লেটটা নিয়ে কিচনে চলে গেল। আমি খাওয়া শেষ করে ভুলবশত প্লেটের উপর হাত ধুয়ে ফেললাম। তৃপ্তি ভরা মন নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা এসে ক্রোধের সহিত বলে উঠলেন,

–ছি, কি করলে? বেসিনে গিয়ে হাত ধুলেই তো পারতে। এই ধরনের বাজে অভ্যাস আমার মটেও পছন্দ নয়।

তার কথাগুলো কর্ণপাত হতেই আমি অপ্রতিভ হয়ে উঠলাম। মন গহীন হতে বিন্দু পরিমাণ অভিমান হলো তার ওপর। দৌড়ে রুমে চলে এলাম।
______
সন্ধ্যা হয়েছে। চারপাশে অন্ধকার বিরাজমান। বেলকণি হতে মৃদু ঠান্ডা হিমেল হাওয়া আসছে। আমি চোখ বুজে খাটের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে রয়েছি। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি সইতে পারছি না। একা একা ঘরটাতে থাকতে ভয় হচ্ছে। কোন কিছুই ভালো লাগছে না। কারো সঙ্গে কথা বলার মতোও উপায় নেই। কারন আমার নিজস্ব ফোন নেই। হঠাৎ কলিন বেলের আওয়াজ কর্ণপাত হতেই চোখ মুছে নিলাম। অতঃপর বেরিয়ে পড়লাম দরজার খোলার উদ্দেশ্য।

ড্রইং রুমে উপস্থিত হতেই সমুদ্র নামক প্রানীকে দেখতে পেলাম। এই শীতে তিনি আকাশী রঙের টি শার্ট এবং কালো রঙের টাউজার গায়ে দিয়ে রয়েছেন। প্রচন্ড শীত ও তাকে গ্রাস করতে পারছে না। ভয় পাচ্ছে! আমি আড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে পড়লাম। অতঃপর তার সামনে দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে রূপকথা গল্পের মতোন অতি সুন্দরী মেয়ে। মেয়টার পরনে ওয়েস্টান পোশাক। আমি আপুটার দিকে আশ্চর্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সে আমার নিকট এগিয়ে এলেন। আচমকা মিষ্টি হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আকস্মিক অপরিচিত আপুর এমন কান্ডে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। আপুটা আমার দিকে খানিকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ চিৎকারে করে বলে উঠলেন,

–হায় আল্লাহ! বেবিটা কত কিউট রে। সমুদ্র আমি ওকে নিয়ে যেতে চাই।

অহনার চিৎকার শুনে এক মূহুর্তের জন্য বিচলিত হয়ে পড়লো। তার ভ্রূ যুগল আপনাআপনি কুঁচকে গেল। ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–নিয়ে যা। মানা করেছে কে!

অহনা সমুদ্রকে উপেক্ষা করে বলল,
–এভাবে বললি কেন? ওর চোখ দুটো দেখ যেন এক মায়ার সমুদ্র। আন্টির পছন্দ আছে বলতে হবে! আমার তো ওকে আদর করতে ইচ্ছে করছে। তোর করে না?

অহনা গভীর দৃষ্টিপাত দিয়ে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেহের অতিশয় অপ্রতিভ হয়ে পড়েছে। মেহের শহরের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্য লজ্জা, দ্বিধা টুইটুম্বুর। অহনার এমন আজব কথাবার্তা শুনে তার মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে রয়েছে। সে যেন ব্যাপক বিচলিত।

(চলবে)