তুমি নামক প্রাপ্তি পর্ব-২৬

0
2600

#তুমি_নামক_প্রাপ্তি
part:26
#Suraiya_Aayat

হন্তদন্ত হয়ে জেলের ভিতর ছুটে এল আরিশ ৷ আরমান সাহেবকে জেলে রাখা হয়েছে তবে আলাদা ভাবে, আর বাদবাকি সবাই কেও জেলে রাখা হয়েছে, আরমান সাহেব জেলে ঢোকার পর থেকেই উন্মাদের মতো ব্যবহার করছেন, জেল থেকে পালানোর চেষ্টা করছেন আর বারবার একই কথা বলছেন যে উনি এসব কিছুই জানেন না ৷ বারবার আফসানা বেগমকে ডেকে দিতে বলছেন,তার স্ত্রীকে যেন ডাকা হয় ৷ তার স্ত্রী নাকি উনার হয় হাজীরা দেবেন ৷ এমনটাই বারবার বলে চলেছে ৷ উনি হয়তো ভাবছেন এতো বছরের সংসারের টানে নিজের স্বামীকে বাঁচানোর জন্য হয়তো উনি আসবেন আর ওনার হয়ে কথা বলবেন ৷

আরিশ জেলের ভিতর ঢুকতে ঢুকতে আরমান সাহেবের গলার আওয়াজ পেয়েছে, ওনাকে সামনে পেলে যে কি করবে ওর নিজেরই জানা নেই ৷

আরু হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে আর ওর পিছনে মিনহাজ সাহেব ও জোর পায়ে হাটছেন ৷মিনহাজ সাহেব ঢুকতেই সবাই ওনাকে সালাম দিলেন,প্রায় একমাস হলো উনি এই থানার হেড হিসেবে জয়েন করেছেন ৷
আরিশ পুরো থানা চোখ বুলিয়ে দেখলো সব আসামী এক একটা জেল জুড়ে আছে, তাদের মধ্যে আরমান সাহেবকে কোথাও পেল না ৷ তবে একটা জেল থেকে আরমান সাহেবের গলার আওয়াজ ভেসে আসতেই আরিশ সেদিকে গেল ৷

আরমান সাহেব আরিশকে দেখে যেন আকাশের চাঁদ খুঁজে পেলেন ৷ আরিশকে দেখামাত্রই বললেন
” আরিশ বাবা দেখো এরা আমাকে এখানে ধরে এনেছে,আমার কোন দোষ নেই, আমি তো এয়ারপোর্ট চত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই সেখানে আমার একটা ফ্রেন্ড কাজ করে তাই ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, আর এরা আমাকে অপরাধী হিসাবে ধরে এনেছে ৷ এখন তো শুনছি আমার আরু মা নাকি নিখোঁজ ৷ কোথায় গেল আমার মেয়েটা ! ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ! ওকে তোমরা খোজার ব্যবস্থা করো, তার আগে আমাকে এখান থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো ,আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে ৷

আরমান সাহেবের এমন কথা শুনে ইলমাজের শরীর জ্বালা দিয়ে উঠলো, ইলমাজ কিছু বলতে গেলেই আরিশ ইলমাজকে থামিয়ে দিয়ে মিহিরকে ঈশারায় বলল সে যেন জেলের তালাটা খুলে দেয় ৷ আরিশের এমন ইশারাতেই আরমান সাহেব খুশিতে আত্মহারা, উনি ভাবলেন আরিশ হয়তো ওনাকে ছাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা করছেন, কিন্তু নাহ, মিহির দরজাটা খুলে দিতেই আরিশ ভিতরে ঢুকলো ৷
আরিশ ঠান্ডা কন্ঠে আরমান সাহেবকে সামনের চেয়ারে বসতে বললেন
আরিশের কথা শুনে উনি আবার বলতে শুরূ করলেন
” দেখো বাবা এরা তোমাকে মিথ্যা বোঝাচ্ছে, আমার ওপর মিথ্যা দোষারোপ করছে, তাছাড়া আমি তো তোমার মামা, নিজের মামার ওপর তোমার এতটুকু বিশ্বাস নেই ৷”

আরিশ একইভাবে বললো
” বিশ্বাস আছে তাই জন্যই তো আরুকে খুজতে না গিয়ে আগে আপনার কাছে এলাম ৷ চেয়ারে বসুন ৷”

আরমান সাহেবের মুখে চমৎকার এক হসি ফুটে উঠলো,নিজেকে একজন বিজয়ী ভাবছেন, সকলকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে নিজের মাঝে রাজার রাজা ফিল আনছেন ৷
তাড়াতাড়ি করে চেয়ারে বসে আরিশের কাছে খানিকটা ঝুকে বললেন
” বাবা আমার জামিন হবে তো !”

আরিশ ওনাকে উপেক্ষা করে বললেন.
” আমার আরু কোথায় ?”

আরমান সাহেব যেন এবার নিজে বোকা বনে গেলেন, এতক্ষনে তার মুখে বিজয়ী বিজয়ী যে আভাটা ছিল সেটা ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে ৷
আরমান সাহেব থতমত খেয়ে বললেন
“এটা তুমি কি বলছো বাবা, আমি আরুর কথা কি করে জানবো, আমি নিজেও তো ওর খোঁজ নিচ্ছি ৷”

আরিশ আবার শান্ত কন্ঠে বলল
” আমার আরুপাখি কোথায় ৷”

” আমি সত্তিই জানিনা আরু কোথায় ! কি বললে তুমি বিশ্বাস করবে বলো তো ৷”( কাঁদোকাদো ভঙ্গিতে)

” আরুপাখিকে কোথায় রেখেছেন বলুন, তাহলে আমি আপনার কথা একটিবার হলেও ভেবে দেখবো ৷”

” বলছি তো আমি জানি না আরু কোথায় ৷ আর আমি বুঝতে পেরেছি তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না, তুমি তোমার আফসানা আন্টির কাছে কল ধরাও তো, ওকে আসতে বলো টাকা নিয়ে, দরকার হলে উকিলের সাথে কথা বলতে বলো, আমার এখানে ভালো লাগছে না ৷”

আরিশ আর সহ্য করতে পারছে না, উঠে গিয়ে আরমান সাহেবের কান বরাবর সপাটে একটা চড় মারলো, কিছুক্ষনের জন্য আরমান সাহেব থথথথ হয়ে গেলেন, কানের মধ্যে শো শো আওয়াজ শুনছেন ৷ আরিশ ইতিমধ্যে নিজের আসল রুপে ফিরে এসেছে, হাত মুঠি করে রেখেছে কেবল মুখ বরারবার পাঞ্চ করা বাকি ৷
কিছুটা সময় পর আরমান সাহেব মাথা ঝাকালেন, এক কানে কিছু শুনতে পারছেন না ৷
আরিশের দিকে আবুল হয়ে তাকাতেই আরিশ ওনার মুখ বরাবর পাঞ্চ করলো,সাথে সাথে ওনার একটা দাত ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল, আর একটা দাঁত ভেঙে ঠোটের সাথে আটকে গিয়ে ফোঁটের নরম মাংস ফেটে রক্তবার হচ্ছে ৷ এগুলো আরু আর আর্শিয়ানের প্রতি হওয়া অন্য৷য়ের প্রতিশোধ, ওনার মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে ৷ আরমান সাহেবের ওনার মুখের রক্ত দেখেই ওনার কলিজা কেপে উঠলো, সোজা হয়ে উঠতে গেলেই আরিশ ওনাকে মেঝেই ফেলে ওনার বুক বরাবর পাঞ্চ করতেই আরমান সাহেব আহহ করে চেচিয়ে উঠলেন ৷আরিশ ওনাকে বেশ কয়েকটা ঘুষি মারলো, ওনার অবস্থা কাহিল ৷ ওনার আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই ৷ আধমরা অবস্থা ৷ আরিশ আর গোটা চারেক ঘুষি দিলেই ওনার জীবন সংকটে পড়বে ৷ আরিশ ওনার মুখে বেশ কয়েকটা ঘুষি দিতেই ওনার দাঁতের পাটি নড়বড়ে হয়ে গেল, কথা বলার ক্ষমতা বোধহয় হারিয়েছেন ‌৷
আরমান সাহেব মাটিতে কাতরাচ্ছেন, ওনার সারা জরীরজুড়ে রক্ত ৷এতদিন উনি যা পাপ করেছেন সেগুলির কাছে এটা যেন খুবই নগন্য একটা ব্যাপার ৷
মিহির ওনার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল, আরিশ বেধড়ক মেরেই চলেছে, বাইরে ওনার তীব্র আর্দনাত স্পষ্ট ৷ মিহির তাড়াতাড়ি আরিশের কাছে ছুটে গিয়ে বলল
” .sir ওনাকে আর মারবেন না, আর মারলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে ৷”

আরিশকে ওনার থেকে সরিয়ে আনলেন ৷
আরিশ ওর চোখের কোনা বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলটা শার্টের হাত দিয়ে মুছে বাইরে বেরিয়ে গেল ৷
ইলমাজ আরিশের জন্য অপেক্ষা অরছিলো, আরু কোথায় থাকতে পারে বা আরুকে কে নিয়ে যেতে পারে সে নিয়েই কথা বলছিলো মিনহাজ সাহেবের সাথে ৷

আরিশ জেলের বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে মাথা থেকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো,চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে, বাঁচার ইচ্ছে টুকু আর ওর মাঝে নেই ৷ আরিশের কান্নার আওয়াজ শুনে আবির গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো , দেখলো আরিশ কাঁদছে ৷ আরিশকে আগে এতোটা ভেঙে পড়তে আবির দেখেনি ৷ আবির গিয়ে আরিশকে জড়িয়ে ধরে বললো
” sir ,আপনি কাদবেননা, আপনাকে কাঁদলে একদম ভালো লাগে না ৷ আর আর্শিয়ান ঠিক হয়ে যাবে mamও ফিরে আসবে ৷”

আরিশ আবিরের কাঁধে হাত রেখে বলল
” এত বছর পর আমি আবার আমার আরুপাখিকে হারিয়ে ফেললাম , কেন আবির তুমি বলতে পারো ৷ আমি ওকে সুরক্ষা দিতে পারলাম না, আগলে রাখতে পারলাম না নিজের কাছে ৷ আমি সত্যিই খুব খারাপ ,এই পৃথিবীর নিকৃষ্ট একজন ৷ আমি ওকে ভালভাবে রাখতে পারিনি ওকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছি ৷আমার আরুপাখি কোথায় আবির ! ওকে আমি এখন কোথায় খুঁজবো ৷ ওকে না পেলে আমি আর বাঁচবো না ৷” ( চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে )

“স্যার ম্যাডাম ঠিক ফিরে আসবে আপনি চিন্তা করবেন না আর তাছাড়া আপনি ভেঙে পড়লে আরশিয়ানকে কে দেখবে বলুন তো !
স্যার আপনি কান্নাকাটি বন্ধ করুন, পুলিশরা ম্যাডামকে খুঁজছে, ম্যাডাম ঠিক ফিরে আসবে ৷ আপনি দেখবেন ৷ আর আপনি এখন আর্শিয়ানের সাথে দেখা করতে যাবেন চলুন ৷”

আরিশ এবার দৃঢ কন্ঠে বলল
” কোথাও যাবো না আমি, কোথাও না ৷”

“আরিশিয়ানকে দেখতে যাবেন চলুন ৷”

” যতক্ষন না আমি আমার আরুপাখিকে খুজে পাবো ততখন আমার কোন প্রিয়জন নেই, আমি একা, শুধু আমার আরুপাখি আমি, আমি তার , আর কারোর না ৷”
কথাটা বলে আরিশ পাগলের মতো করে টলমল হয়ে রাস্তা দিয়ে হাটতে লাগলো ৷
আরিশ রাস্তা দিয়ে হাটছে আর বিড়বিড় করছে ৷
” আমার আরুপাখি শুধু আমার, শুধু আমার ৷”

মিনহাজ সাহেব, ইলমাজ এবং মিহির বাইরে এসে দেখলেন আবির একা দঁড়িয়ে আছে, আরিশ কোথাও নেই ৷
” আরিশ কোথায়?”(ইলমাজ)

“sir,চলে গেছেন,তবে কোথায় বলে যাননি ৷”

মিহির দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল
” sir ওনার বাসায় যাবেন, ওনাকে একটু একা ছেড়ে দেওয়া ভালো, আরুশিকে খুঁজে পেতে ওনার মানসিকভাবে বিশ্রামের প্রয়োজন ৷”

মিনহাজ সাহেবের মাথায় অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে, মেয়েকে খোজার জন্য সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছেন ৷ সফল যে ওনাকে হতেই হবে ৷

” আমি আর্শিয়ান দাদুভাইয়ের কাছে যাই, ওর শরীরটা খুব খারাপ ৷ আমার মেয়েকে আমি খুজে বার করবোই ৷”
কথটা বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলেন উনি ৷ আরিশ যখন ওনাকে বলেছেন যে আরু ওনার মেয়ে তখন ঠিক কতখন যে আরিশের হাত ধরে উনি কেঁদেছিলেন সেটা বলার মতো না ৷
সুন্দর জীবন যাপনের মুখাপ্রেক্ষী সকলেই, অপেক্ষা করার কেবল একটা ভালো দিনের ৷

#চলবে,,,,