তুমি হাতটা শুধু ধরো পর্ব-৩৩+৩৪

0
700

#তুমি_হাতটা_শুধু_ধরো
#পর্বঃ৩৩(বোনাস)
#Jhorna_Islam

রুশের কাছে দায়ানের অতীত শুনে সোহা নিরবে অশ্রু বিস’র্জন দিয়ে চলেছে।হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কথাগুলো শুনেই ভিতরটা কষ্টের দা’বানলে ধাউ ধাউ করে পুরছে। আর দায়ান সেতো সব সহ্য করেছে।

রুশ সোহার দিকে তাকিয়ে কিছু বলেনা।কাদছে যখন কাদুক।রুশের চোখ দিয়েও পানি পরছে।অনেক চেষ্টা করছে আঁটকে রাখার জন্য তাও বে’হা’য়া অশ্রু বেরিয়েই আসছে চোখের কোণ বেয়ে।

নাক ছিচ’কে রুশ আবার বলতে শুরু করে,,,,, দায়ান তখন নিজের বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দা’য়ী করে চলেছে।সে কি পা’গ’লামি। কোনো ভাবেই দায়ানকে শান্ত করতে পারছিলাম না।

ঢাকায় দায়ানদের কোনো আত্নীয় স্বজন নেই।ওর নানা বাড়ির কেউ ছিলো না।দায়ানের নানা নানির একটা মাত্র মেয়েছিলো আন্টি। তারাও অনেক বছর আগেই মারা যান। তাই দায়ানের নানা বাড়ির কোনো লোক ছিলো না।

আপন বলতে দায়ানের একটা চাচাই ছিলো।আমি আর চাচা মিলে দায়ানকে কোনো ভাবেই সামলাতে পারছিলাম না।ও বার বার সু’ইসা’ইড করার চেষ্টা করতে ছিলো।নিজেকে ওনাদের খু/নী ভেবে।

আমি আর চাচা অনেক বুঝালাম।তোকে কি ম’রার জন্য ওনারা নিজে ম’রে বাঁচিয়ে রেখে গেছে? নিজেকে সামলা শ’ক্ত হো। কি বলে গেছে আংকেল আন্টি,,, বলেছে নিজের খেয়াল রাখতি।ভালো থাকতি।আর তুই ম’রতে চাস?

দায়ান তখন শান্ত হয়ে গিয়েছিলো। হয়তো মাথা থেকে সু’ই’সাইড এর ভূ’ত টা নেমেছে।তবে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলো।

আর সারাক্ষণ বির বির করতো,,আমার কেউ রইলো না রে,,পৃথিবীতে আমার কেউ রইলোনা আমি একা হয়ে গেলাম।আপন বলতে কেউ নাই।খাওয়া,ঘুম বাদ দিয়ে এসবই বলতো সারাক্ষণ।

দায়ানের জন্য খুব চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম।এভাবে চলতে থাকলে ছেলেটা আর এমনিতেই বাঁচবে না।

পরোক্ষনেই আমার তিশার কথা মাথায় আসলো।হয়তো মেয়েটা দায়ানকে একটু স্বাভাবিক করতে পারবে।তিশাকে ফোন লাগালাম।সব খুলে বললাম।ভেবেছিলাম দায়ানের ব্যাপারে তিশা যানে না। পরে দেখি সবই নাকি জানে।খুবই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম শুনে।তাও এতো দুশ্চিন্তার মধ্যে মাথায় নিলাম না ব্যাপারটা।

বললাম দায়ানের বাড়ি আসতে। মুখে মুখে না করে দিলো আসতে পারবেনা।

বললাম দায়ানের অবস্থা ভালো না।এমন চলতে থাকলে বাঁচানো যাবে না। তাও নানান বাহানা দিতে থাকলো।

অনেক অনুরোধ করে বোঝানোর পর রাজি হলো আসতে।
আমি বুঝতেই পারিনি তিশা কে আনা যে আমার কতোটা ভুল হয়ে গেছে। ভালো করতে গিয়ে আরো খারাপ করে দিলাম।তিশা এ বাড়িতে আসলো তো ঠিকই।তবে দায়ানকে সাপোর্ট দিতে না।একে বারে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে।

দায়ান তিশাকে দেখে হয়তো একটু ভরসা পেয়েছিলো।ভেবেছিলো মেয়েটা তো তাকে পা’গলের মতো ভালোবাসে।এখন তিশাই তার স’ম্বল।

কিন্ত তিশা দায়ানকে আর আমাকে ভু’ল প্রমান করে,,,যা নয় তাই বলতে থাকলো।আমি অনেক বাঁধা দিয়েও আটকাতে পারিনি।

দায়ানের মতো একটা এ’তিম লোকের সাথে নাকি সে থাকবেনা।বাবা মা মেনে নেবে না।দায়ান নাকি এখন সংসারের কিছুই বুঝবেনা।বুঝবে কি করে এখন তো তার কেউ নেই।সে একটা এ’তিম ছেলের সাথে কিছুতেই থাকবেনা।এখন তো ভবিষ্যতের ও ঠিক নেই দায়ানের।বিজনেসম্যান রসা’তলে যাবে।আরো নানান কথা বলে দায়ানকে ক্ষত বিক্ষত করেছে।

শে’ষে দায়ান সহ্য করতে না পেরে তিশাকে থা’প্পড় মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।

নিজে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।যাওয়ার আগে আমাকে বলে যায় যেনো ডাকাডাকি না করি।নিজের নাকি কোনো ক্ষতি করবে না।আমি সব কিছু নিরব দর্শক হয়ে শুধু দেখছিলাম।

কোথাও না কোথাও নিজেকেই দোষী মনে হতো।আমিই জোর করেছিলাম দায়ান কে রিলেশনে জড়াতে।আমিই তিশা কে এখানে আসতে বলেছিলাম।

তারপর দুইদিন দায়ান রুমে বন্দি ছিলো।দুই দিন পর আশ্চর্য জনক ভাবে স্বাভাবিক হয়ে যায়। হয়তো এই দুইদিন নিজেকে সময় নিয়ে বুঝিয়ে ছে।পৃথিবীতে একলাই বাস করতে হবে।নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে নেই কারো কাছে।নিজের ভিতরেই দুঃখ গুলোকে মাটি চাপা দিয়েছে। মন খুলে কাদার জন্য একটা আশ্রয় বা কোল পায়নি আমার ভাইটা। আমি ওর সাথে চোখ মেলাতে পারতাম না নিজেকে অপরাধী মনে হতো।

দায়ান হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলো।আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো,,,তুই নিজেকে দোষী ভাবিস না ভাই।আমি তর উপর একটুও রে’গে নেই।দায়ানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিয়েছিলাম।কিন্তু সে নির্বাক।এক ফোটা পানিও বের হয়নি চোখ থেকে।

সেই থেকে হাসতে ভুলে গেছে। নিজের যত্ন নিতে ভুলে গেছে।বাঁচার মতো বাঁচতে ভুলে গেছে। কেমন যেনো হয়ে গেছে। রা’গী হয়ে গেছে।

চুপ করো ভাইয়া চুপ করো।আমি আর নিতে পারছি না ভাইয়া।বলেই কান চেপে কাঁদতে থাকে। আমি পারছি না নিতে।

রুশ সোহাকে কিছু সময় দেয় নিজেকে সামলে নিতে।

তারপর বলে,,,,আমি এতো বছর পর ঐদিন দায়ানকে হাসতে দেখলাম।তাও প্রান খুলে হাসতে।সেটা তোর জন্য সম্ভব হয়েছে বোন।তুই পেরেছিস আমার বন্ধু কে হাসাতে।

ঐদিন আমি বুঝে গিয়েছিলাম একমাত্র তুইই পারবি ওরে,,আগের মতো হাসাতে।ভালোভাবে বাচতে শিখাতে।

সোহা মুখ তুলে রুশের দিকে তাকায়। রুশ চোখের ইশারায় বোঝায় হ্যা।

তোর জন্য দায়ানের চোখে যে ভালোবাসা দেখেছি। সেটা আমি তিশার জন্য ছিটেফোঁটা ও দায়ানের চোখে দেখিনি।ঐদিন তোকে না পেয়ে প্রায় কেঁদেই দিতে ছিলো বেচা’রা।

বন্ধু টা আমার ভালোবাসার কা’ঙাল বোন।তুই একটু ভালোবাসা দে,দেখবি সুখ তর পায়ের কাছে এনে হা’জির করবে।তুই ধোঁকা দিয়ে দূরে চলে যাস না।তাহলে হয়তো আমার বন্ধু টা আর বাচবেই না রে।

সোহা এবার বলে উঠে,,,, এসব কথা আর একদম বলবানা রুশ ভাইয়া। আমি ওনাকে অনেক ভালোবাসি।অনেক কষ্ট পেয়েছেন উনি।আর না এবার উনি প্রাণ খুলে বাঁচবেন। আমি উনার পাশে সবসময় থাকবো।কখনো ছাড়বোনা উনাকে।

রুশ এবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সোহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,,আমি এবার আসি।আমার কাজ শেষ। এবার তর বরটাকে তুই সামলে নে।

বলেই রুশ বিদায় নিয়ে চলে যায়। সোহা নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকে। দায়ানের এতো কষ্ট ছিলো।ভাবতেই বুক ফেটে আর্তনাদ বের হয়।

———————————————-

সারাদিন সোহা রুমেই কেঁদে কেটে পার করে দেয়।রুম থেকে নিজেও বের হয় নি।কতো ভাবনা চিন্তা করেছে,,,সে নিজেও জানে না।

খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। দুজনের মধ্যে কেউই রুম থেকে বের হয়নি।আর খাওয়া ও হয়নি।

এখনো সোহা বসে হাঁটুর উপর মাথা ঠেকিয়ে এক ধ্যানে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।

ঘড়ির কাটা যখন ঢংঢং করে রাত আটটার জানান দেয়।তখন সোহার ধ্যান ভাঙে।উঠে দাঁড়ায় বসা থেকে। লোকটাকে যে করেই হোক খাওয়াতে হবে। নয়তো অসুস্থ হয়ে পরবে। বু’কে ব্যাথা করবে।ভাবতে ভাবতে সোহা রান্না ঘরে গিয়ে ঝটপট খাবার তৈরি করে। প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে দায়ানের রুমের দিকে যেতে থাকে।

রুমের পাশে এসে অনেক সাহস যোগিয়ে দরজায় টোকা দওয়ার জন্য হাত দেয়।টোকা দেওয়ার আগেই বুঝতে পারে,,,দরজাটা খুলাই আছে ভিড়ানো।

আস্তে করে ঘরের ভিতর ঢুকে টেবিলের উপর খাবার রাখে।

ঘরটাতে তেমন আলো নেই বারান্দা দিয়ে বাইরে থেকে ল্যাম্প পোস্টের আবছা আলো আসছে। দায়ান খাটের সাইডে বসে হাঁটুর উপর কুনুই ঠেকিয়ে,,হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে।

সোহা আস্তে করে দায়ানের পাশে দাঁড়ায়। দায়ানের কাঁধে হাত রাখতে গিয়েও বারবার সরিয়ে নেয়।কেমন জড়তা কাজ করছে। এক পর্যায়ে সাহস যোগাতে না পেরে চলে আসতে পা বাড়ায়।

ঠিক তখনই পিছন থেকে সোহার হাতটা আকড়ে ধরে দায়ান।সোহা কিছুটা কেঁপে ওঠে। পিছনে ঘুরে দায়ানের দিকে তাকায়।

দায়ান ততক্ষণে সোহাকে কাছে টেনে নিয়ে আসে।পা’গলি আমার না এখানে অনেক কষ্ট হচ্ছে গো।বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে দেখিয়ে।বলেই সোহার কোমড়ে দুই হাত পেচিয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।

পা’গলি আমার সাথে কেনো এমন হলো? কি দোষ ছিলো আমার।কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলো বাবা মা? আমাকে কেনো তাদের সাথে নিলো না।বলো না? আমার তো কেউ নেই গো।আমি একা বড্ড একা। আমার সব শেষ। বলেই কাদতে লাগে।

সোহা দায়ানের মাথাটা নিজের বুকের সাথে ঝাপটে ধরে রাখে।একটু কাঁদুক কেঁদে হালকা হোক। মনের ভিতরের চাপা কষ্ট টা দূর করুক। এতোদিন হয়তো এরকম একটা ভরসার কাউকে খুজতে ছিলো নিজের কষ্ট দূর করার জন্য। সোহা ও নিরবে কাঁদতে লাগলো।

প্রায় অনেকক্ষন হয়ে গেলো দায়ান একই ভাবে কেঁদে চলেছে।থামাথামির নাম নেই। আর এক কথা বারবার বলে চলেছে,,আমার কেউ নেই।আমি বড্ড একা।

আর কাঁদে না গো।মাথা ব্যাথা করবে।কে বলেছে আপনার কেউ নাই? আমি আছি না? আমিকি আপনার কেউ হইনা? আমি সব সময় আপনার সাথে আছি।কখনো ছেড়ে যাবো না।আমাদের ও পরিবার হবে। সব হবে। আমরা অনেকগুলা বেবি নিবো।বেবি দিয়ে বাড়ি ভরে ফেলবো ওকে?

দায়ান এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সোহা বলে আমার কিন্তু কষ্ট হচ্ছে।

সোহার কষ্ট হচ্ছে শুনে দায়ান নিজের কান্না থামিয়ে দেয়। মুখ তুলে সোহার দিকে তাকায়।
সোহা মুচকি হেসে দায়ানের মুখ মুছে দেয় ওড়না দিয়ে। তারপর কপালে একটা চুমু খায়।

আজকেই প্রথম আর আজকেই শে’ষ। আর যেনো কাদতে না দেখি ঠিক আছে? হাত মুখ ধুয়ে আসেন খাবেন।
দায়ান প্রথমে খেতে চায়নি সোহা জোর করে দায়ানকে খাইয়ে দেয়।এক প্লেট থেকে নিজেও খেয়ে নেয়।
সোহা হাত ধুয়ে দায়ানের মুখটা মুছিয়ে দিয়ে,,রান্না ঘরে প্লেট রেখে আসে।

দায়ানকে শুয়ে পরতে বলে,,হাটা দেয়।দায়ান সোহাকে আঁটকে দেয়।

আজ যেওনা প্লিজ।
সোহা দায়ানের কথাতে পাত্তা না দিয়ে,,ঘুরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে। দায়ান এখনো বসে থেকে সোহাকে দেখছে।

সোহা শুয়ে দুই হাত বাড়িয়ে দায়ানকে চোখের ইশারায় কাছে আসতে বলে।দায়ান সোহার ইশারা পেয়ে এক মূহুর্ত ও দেরি করে না।সোহার বুকে ঝাঁপিয়ে পরতে।

‘”জান আজ যদি আমি একটু অবাধ্য হই তুমি কি রা’গ করবা?”

সোহা কোনো কথা না বলে,,,দায়ানকে শক্ত করে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে।
আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে।আজ থেকে আপনাকে আমি নিজের প্রান থাকতে কখনো ছেড়ে যাবো না।সুখে দুঃখে সব সময় আমায় পাশে পাবেন।

#চলবে,,,,,

#তুমি_হাতটা_শুধু_ধরো
#পর্বঃ৩৪
#Jhorna_Islam

আজ সকালটা সত্যি অন্য রকম স্নিগ্ধতা ঘেরা।কিছু পাওয়ার আনন্দ। কতোজন পারে নিজের ভালোবাসার মানুষের মায়াময় মুখ দেখে সকালটা শুরু করতে? সবার ভাগ্য থাকেনা নিজের ভালোবাসার মানুষটির কোমল স্পর্শে ঘুম থেকে জেগে উঠতে।

সোহার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ পিট পিট করে তাকায়।ঘুম এখনো চোখে আছে।তাও প্রতিদিনে অভ্যেসে হয়তো ঘুমটা ভেঙে গেছে। অনেক সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে। নিজের বুকের উপর ভা’রি কিছুর আভাস পেতেই যেনো হকচকায়।তারাতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে তাকায়।দায়ানকে দেখে কয়েক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। বুঝতেই পারতেছিল না উনি এখানে কি করছে।সকালে ঘুম থেকে উঠলে কয়েক মিনিটের জন্য সব মাথা থেকে আউট হয়ে যায় সোহার। তাই হঠাৎ করে দায়ানকে দেখেও তাই হয়েছে।কিছু সময়ের জন্য সব কিছু ভুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো দায়ানের ঘুমন্ত মুখ’শ্রী’র দিকে। পরোক্ষনেই কালকের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা মাথায় এসে যায়। সারারাত দায়ানের ভালোবাসাময় পা’গলামির কথা ভাবতেই চোখ মুখ রক্তিম আভায় ছেয়ে যায়। দায়ানের ভালোবাসার গভীরতা কতো টা তা সে কালকে খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পেরেছে।

এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের হাত বাড়িয়ে দায়ানের অগোছালো চুল গুলোর ভিতর হাত গলিয়ে দেয়। মনে মনে এক অজানা শিহরন কাজ করছে।

দায়ান শান্তিতে ঘুমুচেছ।কি নিষ্পাপ মুখ।সোহার ভাবতেই শরীরের লো’ম দাড়িয় যায়।এই মানুষটা তার।সম্পূর্ণ তার।এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে।নাই বা বলল মুখে ভালোবাসি।প্রতিনিয়ত নিজের কাজের দ্বারা প্রমান করে চলেছে নিজের ভালোবাসা। মুখে মুখে সারাদিন বললেই ভালোবাসা হয় না।কাজের দ্বারা প্রমান করতে হয় ভালোবাসার।
সোহা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দায়ানের দিকে। সকালের মিষ্টি রোদ চোখে এসে পরায় চোখ মুখ মাঝে মাঝে কুঁচকে ফেলছে দায়ান। সোহার খুব ব্যাপারটা ম’জা লাগলো।সোহা দায়ানের মুখের কাছে হাত রেখে রোদ আঁটকায় । চোখের উপর থেকে রোদের আ’ভা সরে গেলে দায়ান মুখটা স্বাভাবিক করে ফেলে। সোহার মাথায় দুষ্টুমি চাপে।সে একবার হাত দিয়ে রোদ আটকায় তো একবার হাত সরিয়ে দেয়।সোহা হাত সরালেই দায়ান চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।

অনেকবার এমন করার পর সোহা শব্দ করে হেসে দেয়।
সোহার হাসিটা যেনো রুমে ঝংকার তুলছে।দেয়ালের প্রতিটি কোনায় কোনায় যেনো সেই সুর বারি খেয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

সোহার মিষ্টি হাসির শব্দে দায়ানের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে তাকায়।সামনে তাকিয়ে নিজের মনটা ভ’রে উঠে সোহাকে হাসতে দেখে।সোহাকে আরেকটু নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে,,ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে,,,,গুড মর্নিং মাই লাইফ।
— সোহা মিনমিনিয়ে বলে গুড মনিং।
— কখন ঘুম থেকে উঠলে?
— এইতো একটু আগেই।
— এতো সকালে উঠার কি দরকার ছিলো।আরেকটু ঘুমোতে পারতা তো। এমনিতেই তো সারারাত ঘুমোও নি।এতো সকালে উঠে পরলে শরীর খারাপ করবে তো।
— কিছু হবে না।তারপর আবার কাল রাতের কথা মাথায় আসতেই লজ্জায় মিইয়ে যায়। মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে দায়ানকে নিজের উপর থেকে সরাতে চায়।

সোহা দায়ানকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ধাক্কায়। সোহা যতোবার দায়ানকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ধাক্কায় দায়ান তার হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে আগলে ধরে সোহাকে।

ওমা আলুর ভর্তা বানিয়ে দিলোগো আমায়।সরুন প্লিজ হাড্ডি গুড্ডি সব গুঁড়ো করে দিলো।দায়ান তার হাতের বাঁধনটা কিছুটা শিথিল করে,তবে ছাড়ে না।

সোহার মুখের কাছে নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে,গালে নাক ঘ’ষে সোহা দায়ানের এরকম ভালোবাসাময় স্পর্শে শি’উরে উঠে। দায়ানের শার্ট বিহীন খালি পিঠে খামচে ধরে।

কাঁপা কাঁপা গলায় বলে কি-কি শুরু করছেন ছাড়ুন প্লিজ। আমি উঠবো।ফ্রেশ হয়ে রান্না করতে হবে তো।জমেলা খালা অসুস্থ। খাবার খাবো না? বেলাতো অনেক হয়েছে।আপনার অফিস নাই?

এভাবেই থাকোনা প্লিজ। এক বেলা না খেলে কিছু হবে না।আর অফিস আমার শা’লা সামলে নেবে।

শা’লা মানে? কে সামলে নিবে?

কেনো তোমার ভাই।রুশ।
ওহ। তাও উঠুন শাওয়ার নিয়ে রান্না করতে হবে খুব খিদে পেয়েছে আমার।

এমন করো কেনো জা’ন।একটু থাকোনা।দায়ানের কন্ঠে আ’কুলতা।
সোহার কলি’জাটা ধ’ক করে উঠে দায়ানের কন্ঠ শুনে। মনে পরে যায় দায়ানের বিষা’ক্ত অতীত। দুই হাতে দায়ানের মুখটা নিজের মুখের কাছে এনে সারা মুখে ভালোবাসার পরশ একে দিতে থাকে।দায়ান মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে নিজের প্রিয়তমার ভালোবাসা ময় স্পর্শ উপভোগ করতে থাকে।

তারপর দায়ান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে।যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।

দায়ান সোহার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,, জা’ন আর একটু ভালোবাসি?
— একদম না।ছাড়ুন আমি উঠবো।ফ্রেশ হয়ে রান্না করতে হবে খুব খিদে পেয়েছে।

— খিদে না ছাই।আমার থেকে শুধু পালানোর ধা’ন্দা। তারপর সোহাকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে বলে চলো দু’জন এক সাথেই ফ্রেশ হবো।

— এই একদম না।ছাড়ুন আমায়।আগে আমি গিয়ে ফ্রেশ হবো তারপর আপনি যাবেন।

— উহু একসাথেই হবো।

— আরেএএএএ,,,,,, সোহা আর কিছু বলতেই পারে নি।দায়ান সোহার কথাতে পাত্তাই দেয় নি।

প্রায় ত্রিশ মিনিট পর দু’জনেই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে।

সোহা কটমট দৃষ্টিতে দায়ানের দিকে তাকাচ্ছে শুধু।
দায়ান সোহার দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসে।
— “অ’স’ভ্য”
— হুু তোমার বর। বলেই খাটের উপর বসে পরে।চোখ দিয়ে ইশারা করে সোহাকে দেখিয়ে দেয় মাথা মুছে দেওয়ার জন্য।

সোহা এগিয়ে এসে নিজের ওড়না দিয়ে দায়ানের চুল মুছতে থাকে। দায়ান সোহার কোম’ড় জড়িয়ে ধরে চুপটি করে বসে থাকে।

মাথা মোছানো শে’ষ করে বলে,,, নিন আপনি এবার যা করার করুন।আমি গেলাম রান্না ঘরে।

— আপনার কফি লাগবে?

—দিলে মন্দ হয়না।মাথাটা একটু ভা’র ভা’র লাগছে।তোমার অসুবিধা হলে থাক।

— এতো বেশি বুঝতে হবে না আপনাকে।চু’প করে বসুন।আমি কফি দিয়ে যাচ্ছি।
বলেই সোহা বেরিয়ে যায়। দায়ান সোহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শুয়ে পরে বিছানায়।

——————————————-

সকাল থেকেই নোহার শাশুড়ী আর তমা যেনো কি নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে।দেখে মনে হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মিটিং চলছে। নোহা ওনাদের চা দিতে গিয়েছিল। নোহাকে দেখেই দু’জন চুপ হয়ে যায়। একেবারে নিরব কারো মুখে কোনো কথা নেই।যেনো ওনারা কথা বলতেই জানেনা।এতো সময় চুপচাপ ছিলো,এরকম একটা ভা’ব।

নোহার এদের কান্ডে বেশ অবাক হয়।কি এমন কথা বলছে এরা? যে আমাকে দেখেই চুপ হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবে নোহা।

রান্না ঘরে যাওয়ার সময় নানি শ্বাশুড়ি ডেকে উঠে উনার রুম থেকে।নোহা এগিয়ে যায় নানির রুমে।

— নানি ডেকেছেন আমায়?

— হ্যা। আয় বসতো নাত বউ আমার পাশে।

— নোহার খুব ভালো লাগে।নানি এখন আর গম্ভীর হয়ে থাকে না। কথা বলে।নোহার সাথে নানান গল্প করে।

— ওমিরে সুখবর টা দিয়েছিস?
— না,নানি উনি রাতে আসলে দিয়ে দিবো।
— হ্যা, দিয়ে ফেলিস।
— হুম।
— বাড়িতে জানিয়েছিস?

— না মানে আসলে লজ্জা লাগছে নানি।মা বাবার সাথে কি করে বলি।

— আহারে আমার লজ্জাবতী নাত বউ টা রে।

— বিনিময়ে নোহা মুচকি হাসে।

— সব সময় এরকম ভাবে হাসবি।হাসলে তোকে খুব মানায় বুঝলি? নে এবার তোর বাপ -মাকে ফোন লাগিয়ে দে আমি বলে দেই।
নোহা বাবার কাছে কল দিয়ে নানির কাছে দেয়।নানি নোহার বাবার সাথে কুশলদারি বিনিময় করে,,,সব খুলে বলে।ওনারা শুনে অনেক খুশি হয়।আরো কিছুসময় নানান আলাপ করে ফোন কাটে।

নানি নোহাকে নানান পরামর্শ দিতে থাকে।কি খাবে।কোন কোন কাজ করতে পারবে না আরো নানান কিছু।নোহা সম্মতি জানিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এই সুখবর টা নিজে সোহাকে জানাবে।বোন যে কি খুশি হবে ভাবতেই নোহার আনন্দ লাগছে।

নোহা যদি জানতো তার শ্বাশুড়ি কি খেলা খেলতে চলেছে তার সাথে,,,,,,,,,,,

—————————————
নোহা নিজের রুমে এসে সোহাকে ফোন লাগায়।

সোহা নিজের ফোনটা রান্না ঘরের তাকের উপর রেখে রান্না করতেছিলো।সেই সময়ই নিজের ফোনটা বেজে উঠে।

সোহা রান্না থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিজের ফোনের দিকে তাকায়। ফোনের স্ক্রিনে আপু নামটা জ্বল জ্বল করছে।সোহার মনটা আনন্দে নেচে উঠে। হাতে হলুদ লেগে আছে।সেটা ধুয়ে হাত মুছে তারাতাড়ি ফোনটা হাতে নেয়।

— হ্যালো,,,,,আপুওওও। কেমন আছিস? আমার কথা তর এতোদিনে মনে পরলো?

— হ্যা বোন ভালো আছি। সরি সো’না সংসারের ব্যস্ততায় কল করে উঠা হয় না সব সময়। তা বল তুই কেমন আছিস?

— আমি অনেকক ভালো আছি আপু।

— তা কি করছে আমার বোনটা?

— তোমার বোনটা রান্না করছে হিহিহি।

— এতো বেলা হয়ে গেলো এখন রান্না করছিস? খাবি কখন?

— ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে তাই আরকি।

— নোহা অবাক গলায় বলল,,বাব্বাহ,,, তোর ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয় ভাবা যায় এগুলা?

— না- মানে আসলে হয়েছে কি আপু,,,,,,,

— আর বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি। সারা রাত জেগে থাকলে সকালে উঠতে তো লে’ট হবেই। মজার ছলে বলে উঠে নোহা।

— সোহার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। ধ্যাত আপু তুমিও না। ভুলে যেওনা আমি তোমার ছোটো বোন।

— হ্যা,,, পাকনি বু’ড়ি আমার।আর লজ্জা পেতে হবে না।শুন,,তোর জন্য একটা সুখবর আছে।

— তাই নাকি? কি সেটা তারাতাড়ি বলো।আমার তর সইছে না।

— তুই খালামনি হতে চলেছিস।

— কি বললা আপু? সত্যি বলছো?

— হুম।

সোহা কি যে খুশি হয়েছে। বোনকে এটা করো না। ওটা করো না,,এইটা খাবানা ঐটা খাবা নানান ধরনের পরামর্শ দিতে থাকে।

নোহা মিটমিটিয়ে হাসে,,,, ছোটো বোন হয়ে বড় বোনকে শিখিয়ে দিচ্ছে কি করতে আর কি না করতে।
আরো কিছু সময় কথা বলে ফোন রেখে দেয়।সোহা নিজের আনন্দ সামলাতে না পেরে চিল্লিয়ে লাফিয়ে উঠে। দায়ান ড্রইং রুমের সোফায় বসেই কাজ করছিলো।সোহার চিল্লানো শুনে দৌড়ে আসে।

ঠিক আছো তুমি জা’ন? কি হয়েছে? কোথাও ব্যাথা পেয়েছো বলেই সোহার হাত চে’ক করতে লাগলো।কি হয়েছে বলছো না কেনো?

বেবি হবে!!!

দায়ান সোহার কথা শুনে শুকনো মুখেই বি’ষম খায়। কি বলছে কি মেয়েটা।

এসব কি বলছো পা’গলি এতো তারাতারি কি বেবি হয় নাকি? এগুলা সময়ের ব্যাপার।এসব নিয়ে একদম মাথা ঘামাবানা।পড়াশোনায় মন দাও। কালকে যে বলেছিলা আমরা অনেক গুলা বেবি নিবো।ঐ কথাই মাথায় ঘুরতেছে তাই না?

আরে আমি আমার কথা বলতেছি নাকি? আমার আপুর বেবি হবে।ওয়াওও আমার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। আমি খালামনি হবো।আপনি খালু।এইই আমি আপুর সাথে দেখা করতে যাবো নিয়ে যাবেন?

ওকে আর কয়েকটা দিন যাক তারপর নিয়ে যাবো বাড়িতেও একেবারে ঘুরে আসবা।

সোহা খুশিতে দায়ানকে জড়িয়ে ধরে। দায়ান ও মুচকি হেসে সোহাকে জড়িয়ে ধরে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,,,, আমি সেই দিনটার অপেক্ষায় আছি।কবে তুমি আমাকে সেই সুখবর টা দিবা। আশা করি বেশি অপেক্ষা করতে হবে না।

সোহা লজ্জায় দায়ানের বুকে মুখ গুঁজে বলে যাহ্,,।

———————————-
বিকেলে সোহা বাগানে এসে গাছে পানি দিচ্ছে আর ফুল গুলো ছুঁয়ে দেখছে।দায়ান ও সোহার সাথে এসে দোলনায় বসে আছে।

সোহার হঠাৎ করে মনে হলো রুশ বলেছিলো ঐই শাক’চু’ন্নি তিশা কি কারণে যেনো সু’ই’সাই’ড করেছিলো।দায়ানের থেকে জেনে নিতে।তাই ভেবে দায়ানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

শুনুন!! রুশ ভাইয়া কাল আপনার সম্পর্কে সব আমায় বলেছে।এমনকি ঐই ডা/ইনী তিশার কথাও।শুধু একটা কথা ছাড়া।
দায়ান ব্রু উঁচিয়ে বলে সব বলেছে তোমায়।ভালোই হয়েছে।তোমার সব জানার দরকার ছিলো।বলেই সোহাকে টান দিয়ে নিজের কোলের উপরে বসায়।

এবার বলেন আমার ক’লিজা কি জানতে চান।কি বলেনি আপনার ভাই আপনাকে।বলেই নাক ঘষতে থাকে সোহার গালে।

সোহা আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়।কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,, তিশা কেনো সু’ই’সাইড করেছিলো?

সোহার কথায় দায়ান হঠাৎ করেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে। এইরে কা’ম সারছে।শা’লা রুশ এইটা কেনো বলতে গেলি। এখন কি বলবো,? সত্যি টা বললে তো মহারানী ঝা’ড়ু পেটা করবে,,,,,,বলেই শুকনো ঢুক গিলে সোহার দিকে তাকায়।

সোহা দায়ানের দিকেই তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়।

দায়ান সোহার দিকে তাকিয়ে জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে আমতা আমতা করতে থাকে।

#চলবে,,,,,,,,,,