#তুমি_হাতটা_শুধু_ধরো
#পর্বঃ৩৯
#Jhorna_Islam
আজ সকালটা অন্য রকম। কোলাহলহীন শুনশান নীরবতায় ঘেরা।নাকে এসে বারি খাচ্ছে ধানের মিষ্টি সুবাস।শরীর ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে সকালের স্নিগ্ধ বাতাস।
রুশ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে আসে। গ্রামে তার এই প্রথম আসা।এর আগে কখনো আসা হয়নি।তাই যখন সুযোগ পেয়েছে গ্রাম টা ঘুরে দেখার হাত ছাড়া করেনি।বেরিয়ে পরেছে আশেপাশে ঘুরে দেখার জন্য। গ্রামীন জীবনের আলাদা একটা ছন্দ আছে।রুশের খুব ভালো লাগছে গ্রাম টা দেখতে।এতোটাও সেকেলে নয়।গ্রামে ও এখন শহরের ছোঁয়া লেগেছে। সব কিছু উন্নতি হচ্ছে।
এসবই ঘুরে ঘুরে দেখছে রুশ।
সোহা ও সকাল সকালই উঠে পরেছে ঘুম থেকে।রান্না ঘরে গিয়ে রুশ ও দায়ানের জন্য কফি বানিয়ে বের হতেই দেখতে পায় রুশ বাড়িতে ঢুকছে।সোহা অবাক হয়ে বলে,,,
— রুশ ভাইয়া তুমি বাইরে গেলে কখন? আর এতো সকালে তোমার ঘুম ভেঙে গেলো?
— আজ অনেক সকালে ঘুম ভেঙে গেছে বোন।আর গ্রামে আমার এই প্রথম আসা।ভাবলাম ঘুরে দেখি। আবার ভাগ্য হয় কিনা দেখার কে জানে?
— সে বেশ করেছো ঘুরে দেখেছো।ভাগ্য হবে না কেনো দেখার? আমরা যতোবার আসবো তোমাকে সাথে করে নিয়ে আসবো।
— সে দেখা যাবে।
— আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম কফি নিয়ে।
— ওহ দে আমার কাছে আমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিবো।
— আচ্ছা নাও।বলেই কফিটা রুশের হাতে দেয়।
— দায়ান উঠে নি।
–নাহ এখন গিয়ে ডেকে তুলবো।
–আচ্ছা। আমি রুমে যাই।বায় দা ওয়ে তোদের গ্রামটা অনেক সুন্দর। আমার ভালো লেগেছে।
বিনিময়ে সোহা মুচকি হেসে রুমে ঢুকে যায়।
দায়ান এখনো মনের সুখে ঘুমে বিভোর। সোহা আস্তে করে কফির কাপটা রেখে দায়ানের পাশে গিয়ে বসে। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসে,ওড়নার কোন পেচিয়ে দায়ানের কানে শু’ড়’শু’ড়ি দেয়।দায়ান নরেচরে কানে হাত দেয় কয়েকবার। সোহা বেশ মজা পায়।আবার দিতে যায়।তার আগেই দায়ান সোহার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে।একটানে বিছানায় সোহাকে শুইয়ে দেয়। তারপর সোহার উপরে উঠে সোহার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকে।
সোহা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠে,,, কি শুরু করেছেন সকাল সকাল? আপনি কিন্তু দিন দিন লু’চু হয়ে যাচ্ছেন।
ছাড়ুন আমায়।রান্না করতে হবে।খাবেন না? রুশ ভাইয়া ও কিন্তু বাড়িতে।
তো? এখনতো আমি অন্য কিছুর মুডে আছি।
এই সরেন বলছি। কফি এনেছি খেয়ে নিন ঠান্ডা হয়ে যাবে।
আর হাসপাতালে যাবো তো উঠে তৈরি হয়ে নিন।তারাতাড়ি যেতে হবে।
যাচ্ছি বলেই দায়ান সোহার ঘাড়ে কা’মড় বসিয়ে দেয়।
ও আল্লাহ রা/ক্ষস একটা।
———————————————
সকালের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সকলে হাসপাতালে যাবার জন্য বেরিয়ে পরে। হাসপাতালের সামনে গাড়ি আসতেই দায়ান আর সোহা নেমে পরে।
রুশ গাড়ি নিয়ে ঢাকা ফিরে যাবে এখন। অফিসটা কয়দিন রুশই সামলাবে।
দায়ান কিছুদিন এখানেই থাকবে সোহার সাথে।রুশকে বলে দিয়েছে ঐদিকটা সামলে নিতে।
রুশ বিদায় নিয়ে চলে গেলে দায়ান আর সোহা হাসপাতালে চলে যায়। তারপর সোহা তার বাবা মাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।ওনাদের খেয়ে দেয়ে,বিশ্রাম প্রয়োজন। কাল থেকে অনেক ধ’কল গিয়েছে উপর দিয়ে।নয়তো অসুস্থ হয়ে পরবে।
ওনারা ও সোহা আর দায়ানকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে।
দায়ান সোহা কে বলে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় নোহার ব্যাপারে কথা বলার জন্য । আর সোহা খাবার নিয়ে ক্যাবিনে ঢুকে যায়। খাইয়ে ঔষধ খাওয়াতে হবে।
— গুড মনিং আপু।ভালো আছিস?
— গুড মনিং সোহা সো’না। ভালো আছি।
— এই দেখ আমি নিজ হাতে রান্না করে তর জন্য নিয়ে এসেছি।খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবি তাহলে আরো ভালো হয়ে যাবি।
তারপর বোন কে খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয় সোহা।এর মধ্যে হ’ন্ত দ’ন্ত হয়ে ক্যাবিনে প্রবেশ করে নোহার শ্বশুর।
এসব আমি কি শুনছি নোহা? তুমি তোমার শ্বাশুড়ি আর ওমিকে জেলে দিয়েছো? তাদের নামে খু/নের আর নারী নির্যা’ত’নের কেস দিয়েছো? পা’গল হয়ে গেছো তুমি?
আমি বাড়িতে ছিলাম না আমায় জানাতে পারতে।তাই বলে তুমি এসব করবে? ওদের ছাড়াতে গিয়েছিলাম।পুলিশ তো আমার কোনো কথাই শুনছে না।কে’স নাকি কোর্টে উঠবে।নিজের পরিবারের লোকের সাথে কেউ এসব করে?
ওরা না হয় একটা ভুল করেই ফেলেছে তাই বলে তুমি?
সোহার শরীর রাগে জ্বলে উঠে। কিছু বলতে নিবে তার আগেই নোহা হাত দিয়ে ইশারা করে সোহা কে থামিয়ে দেয়।
“বাহ্ বাবা বাহ্ নিজের স্বার্থ ছাড়া আপনি কিছুই বুঝলেন না।আমার এই অবস্থা আর আপনি এসে আমাকে ঝাড়ছেন? একবার আমার কি অবস্থা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ও মনে করেন নি। আর ভুল একটা মেয়েকে নি’র্যা’তন করে তার পেটেই তার অনা’গত সন্তান কে মে’রে ফেলা ভুল? দিনের পর দিন একটা মেয়ের উপর মা’নসিক,শা’রী’রিক নি’র্যা’তন করা ভুল?এগুলা যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে ভুলের শাস্তি ও পেতে হবে।
দায়ান ও তখন ক্যাবিনে এসে ঢুকে।
আপনারা অনেক ব্যবহার করেছেন আমায় আর না। আপনি ব্যবহার করেছেন রা’জ’নৈতিক কারনে। আপনার বউ ব্যবহার করেছে কাজের মেয়ে হিসাবে।আর আপনার ছেলে ব্যবহার করেছে নিজের চা’হিদা মিটাতে।বলেই নোহা চোখ বন্ধ করে ফেলে।এই কথা গুলো বলতেও নিজের রু’চি তে বাঁধছে। কিন্ত এই লোক গুলো বারবার বাধ্য করে।
বাহ্ কথা ফুটেছে মুখে দেখতে পাচ্ছি।
কথা মুখে আগেই ছিলো।এতোদিন সম্মানের খা’তিরে কিছু বলিনি। এখন আমার আফসোস হচ্ছে যাদের আমি সম্মান দিতে গিয়েছি ষোল আনার,,তারা এক আনা সম্মানের যোগ্য ও না।
নোহা তুমি ভাবতে পারছো না এর ফল কি হবে।এতো বাড়াবাড়ি করে লাভ আছে? সেইতো আমাদের দুয়ারেই তোমাকে ফিরতে হবে।
কে বলেছে আপনাদের দুয়ারে ফিরবো? আপনার ছেলেকে আমি ডি’ভো’র্স দিবো।অমন কা/পুরুষ স্বামী থাকার চেয়ে না থাকা ঢের ভালো। আর কে’স তো কোর্টে উঠবেই আপনার ছেলেকে ভেবেছেন দয়া দেখিয়ে ছেড়ে দিবো?
অতি বাড় বেড়োনা।এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।ওদের তো আমি ছাড়িয়ে আনবো। আমার পাওয়ার সম্পর্কে তোমার কোনো ধারনা নেই।এর ফল ভোগ করতে হবে।
এবার দায়ানেট মাথায় রা’গ চড়ে যায়।তাই নাকি? আপনার ছেলে কি করে ছাড়ান আমিও দেখে নিবো।ভেবেছিলাম সবটা নোহার উপর ছেড়ে দেব ও যা করতে চায় তাই হবে।বাট,,,এখন আমিও দেখে নেবো আপনার মতো একটা মে’ম্বা’র কি করে আপনার ছেলেকে ছাড়ান।কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করাবো।ঐরকম জা/নো’য়ারদের বাইরের পরিবেশে মানায় না।ওরা চৌদ্দ শি’কের ভিতরেই ঠিক আছে। পারলে নিজের ছেলেকে ছাড়িয়ে দেখাবেন।
এবার ওমির বাবা একটু দ’মে যায়।ভেবেছিলো হু’মকি ধা’মকি দিলে ভয়ে ওদের ছাড়িয়ে আনবে।কিন্তু এরা দেখি এবার দ’মার পাত্র নন।তাই কিছু না বলে,, রাগে হনহন করে বেরিয়ে যান।
নোহা শ্বশুরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।সোহা একপাশ দিয়ে সাবধানে বোনকে জড়িয়ে ধরে রাখে।
দায়ান নোহার দিকে তাকায়,,, তুমি কোনো চিন্তা করো না নোহা।এরা কিছুই করতে পারবে না।আমি এদের যতাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করবো।আর আমি উকিলের সাথে কথা বলেছি।ডি’ভো’র্স টা খুব শিঘ্রই হচ্ছে। তুমি নিশ্চিত থাকো।ওমি তার পা’পে’র যথাযথ শাস্তি পাবে।
—————————————————-
দেখতে দেখতে আরো পাঁচ ছয়দিন কেটে যায়। নোহাকে তিনদিন পরই বাড়িতে আনা হয়েছে।
এখন অনেকটাই সুস্থ নোহা।হাটা চলা সব কিছুই করতে পারে।শরীরে মারের দা’গ গুলো আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে।
তবে পেটে সেলাই করা জায়গাটা শুকাতে একটু টাইম লাগবে।
আজ সকলে এক সাথে দুপুরে খেতে বসেছে। সোহা নোহা,ওদের বাবা আর দায়ান।সোহার মা বেড়ে দিচ্ছে। সবাই অনেকবার বলেছিলো বসে পরার জন্য উনি এখন খাবেন না।পরে খাবেন বলে জানিয়েছে। তাই কেউ আর জোর করেনি।
সোহার মা দায়ানকে নিয়ে ব্যস্ত।এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। নিজে প্লেটে তুলে দিচ্ছে। দায়ান না করার পর ও। দায়ান সোহার দিকে তাকায় অসহায়ের মতো।সোহা মিটমিট করে হেসে বলে আরে খেয়ে নিন।
জামাই আদর।শ্বাশুড়ির এমন আদর আর কই পাবেন?
সোহার হাসি দেখে দায়ান চোখ গরম করে তাকায়।
সোহার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,, আন্টি প্লিজ আর দিয়েন না।
সোহার মা দায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,, আমরা কি তোমার এতোই পর বাবা? যে আন্টি ডাকছো।মা কি ডাকা যায় না?
আমিতো তোমার মায়ের মতোই।দায়ান ছলছল চোখে তাকায় সোহার মায়ের দিকে।
হ্যা রমিলা ছোটো আব্বা মনে হয় আমাদের আপন ভাবতে পারেনি।তাইতো আংকেল আন্টি বলে।
সোহা দায়ানের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারে।দায়ানের বাম হাতটা নিজের হাতের মঠোয় নেওয়ার চেষ্টা করে। দায়ান আবার সোহার দিকে তাকায়। সোহা দায়ানকে চোখের ইশারায় ভরসা দেয়।
দায়ান নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,,, আজ থেকে আমি তোমাদের বাবা-মা বলেই ডাকবো।তোমাদের ও আমাকে নিজের ছেলের মতো ভাবতে হবে।
সোহার মা দায়ানকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে মাতায় হাত বুলিয়ে দেয়। কখনো নিজেকে একা ভেবো না।
এই যে আমরা আছি।এখন থেকে আমাদের উপর তোমার সোহার থেকেও বেশি অধিকার।
তুমিতো কিছুই খাওনি বাবা।আসো আমি তোমায় খাইয়ে দেই।বলেই প্লেট টা হাতে নিয়ে নেয়।খুব স্নেহের সাথে খাইয়ে দিতে থাকে।
সোহা ঠোঁট উল্টে বলে,,হ্যা এখনতো উনিই তোমার সব।আমি আর আপুতো তোমার কেউ না।তাই আমাদের খাইয়ে দেয়না,কেউ।নোহা সোহার দিকে তাকিয়ে মাথায় টোকা দিয়ে বলে,,নে’কি কা’হিকা।
সোহার বাবা বলে,,কে বলেছে আমার আম্মাদের কেউ ভালোবাসে না।আমি আছি না? আমি আমার দুই আম্মা কে খাইয়ে দিবো।এসো এসো আমার পাশে এসে বসো।
নোহা আর সোহা দু’জন বাবার দুপাশে বসে পরে। দুইবোন বাবার হাতে আর দায়ান সোহার মার হাতে খাচ্ছে।
দায়ান মনে মনে বলে,,, কে বলেছে আমার কেউ নেই,,এই যে বাবা মা পেলাম।হাসি খুশি একটা পরিবার পেলাম।এতো ভালোবাসা পেলাম।নিজেকে কেমন সুখী লাগছে,,এই পরিবারের একটা সদস্য হয়ে উঠতে পেরে।কতো হাসি খুশি, আনন্দ। এই আনন্দ কখনো যেনো ফুরিয়ে না যায়।সবাই যেনো এমন হাসি খুশি হয়ে থাকে।দায়ান নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবে এই পরিবারটাকে।
————————————————–
খাওয়া দাওয়া শেষ করে দুপুরে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে যে যার রুমে। দায়ান আর সোহা ও শুয়ে ছিলো। এমন সময় দায়ানের ফোনটা বেজে উঠে। সোহা টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে দায়ানের কাছে দেয়।
তারপর দায়ান কল টা রিসিভ করে কথা বলতে থাকে।সোহা এই ফাঁকে রুম থেকে বের হয়ে বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ের দিকে চলে আসে ।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে সামনে কাউকে এসে দাঁড়াতে দেখে সোহা থেমে যায়। সামনের ব্যক্তিটার দিকে কপাল কুঁচকে তাকায়।
#চলবে,,,,,,
#তুমি_হাতটা_শুধু_ধরো
#পর্বঃ৪০
#Jhorna_Islam
আমি আপনার সাথে ফিরে যাবো না দায়ান।আমি আর কখনোই আপনার সাথে ফিরবো না।আপনি একাই চলে যান।আমি আর আপনার সাথে থাকতে চাইনা।
দায়ানের বুকে ধক করে উঠে সোহার এসব কথা শুনে।কাঁপা কাঁপা হাতে সোহার দুই গাল ধরে বলে,,,তুমি আমার সাথে মজা করতেছো তাই না জা’ন?
সোহা দায়ানের হাত গুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,,”একদম মজা না।আমি সত্যি বলছি।আমার পক্ষে আপনার সাথে থাকা আর সম্ভব নয়।
কি বলছো তুমি পা’গলি নিজে যানো?দেখো এসব আমার একদম ভালো লাগছেনা।এসব ব্যাপার নিয়ে ম’জা করতে আসবা না।
সোহা এবার কিছুটা চিল্লিয়ে বলে,,,আমি বলছিতো আমি কোনো ম’জা করছি না।আপনি প্লিজ চলে যান।
আমার দোষটা কি আমায় বলবা? আমি কি কোনো ভুল করেছি জা’ন? বলো আমায় আমি শুধরে নিবো।তাও একথা বলো না।আমি মরেই যাবো এবার।প্লিজ তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো নাতো কলিজা।বলেই টলমল চোখে সোহার পানে তাকায়।দায়ানের এখন চিৎকার করে কাঁদতে মন চাচ্ছে।
একা কখনো সংসার করা যায় না।আমি সব সময় চেয়েছিলাম আমার একটা ভ’রা সংসার হবে।শ্বশুর -শ্বাশুড়ি,, ননদ-দেবর নিয়ে।আর আপনিতো একা আপনার কেউ নেই। আর এসব ভালোবাসা দুই দিন পরই হারিয়ে যাবে।
এভাবে বলো না জা’ন।প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা।প্লিজ আমি তোমায় অনেক সুখে রাখবো দেখো।প্লিজ যেওনা।
সোহা হঠাৎ করে ঘুমের মাঝে বিরবির করে কথা শুনে উঠে বসে।দায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখে দায়ান বলছে, আমাকে ছেড়ে প্লিজ যেওনা সোহা। তুমি এবার চলে গেলে মরেই যাবো।প্লিজ জা’ন এমন করো না।দায়ানের পুরু শরীর ঘেমে গেছে। সোহা দায়ানের হাত ধরে হাত গুলো ঠান্ডা হয়ে আছে।
সোহা দায়ানকে ডাকতে থাকে,,এই কি হয়েছে আপনার ঠিক আছেন? এমন করতেছেন কেনো? আমি কেনো আপনাকে ছাড়বো? আর কোথায়ই বা যাবো।কোথায় যাবো নাতো।দায়ান এই,, কোনো সারা শব্দ না পেয়ে ধাক্কা দেয় দায়ানকে।
দায়ান চোখ তুলে তাকিয়ে তাড়াহুরো করে বসে পরে।হাঁপাচ্ছে এদিক ওদিক তাকিয়ে।
সোহা টেবিলের পাশ থেকে পানির গ্লাস নিয়ে দায়ানের সামনে ধরে।দায়ান গ্লাস টা হাতে নিয়েও রেখে দেয়।
সোহা নিজের ওড়না দিয়ে দায়ানের কপালের ঘা’ম মুছে দেয়। দায়ানের মুখটা সোহার দিকে ঘুরিয়ে জানতে চায়,,কি হয়েছে আপনার? শরীর ঠিক আছে?
দায়ান সোহার দিকে তাকিয়ে শক্ত করে নিজের বুকের ভিতর আগলে ধরে। এতোটাই শক্ত করে ধরেছে যে সোহা ব্যাথা পাচ্ছে। তাও কিছু বলল না। লোকটা হয়তো ভ’য় পেয়েছে। কি হয়েছে বলেন আমায়।খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন?
দায়ান কাঁপা গলায় বলে,, জা’ন,,,আ-আমি।
সোহা দায়ানকে থামিয়ে দিয়ে বলে,, থাক বলতে হবে না।দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তাই না? আমায় নিয়ে দেখেছেন যে আপনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
দায়ান সোহার গলায় মুখ ডুবিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে কিছু বলে না।
আপনি দুপুরের ঘটনা সব শুনেছেন তাই না? আর ঐসব ভেবেই স্বপ্ন দেখেছেন।দায়ান মাথা নাড়ায়।
বিকেলে যখন সোহা পুকুর পাড়ে ঘুরতেছিলো,,তখন তার সামনে তাদের ই গ্রামের এক বড় ভাই এসে দাঁড়ায়।
সোহা সামনে তাকিয়ে বলে,, কি ব্যাপার রনি ভাই আপনি এখানে? আর আমার সামনে এসেই বা দাড়ালেন কেনো?
যাক আমায় ভুলনি দেখছি।মনে আছে আমার কথা।আমিতো তোমায় কতো ভালোবেসেছিলাম সোহা।
কিন্ত আমি বাসিনি।
কেনো? আমার মাঝে কিসের কমতি ছিলো?
আমার আপনাকে ভালো লাগে না। তারউপর আর কোনো কথা থাকতে পারে না।
হ্যা আমাকে ভালো লাগবে কেনো? ভালোতো লেগেছে ঐই বড়লোক এ’তিম ছেলেকে।সংসার জীবনে টাকা পয়সা ছাড়া আর কিইবা দিতে পারবে তোমাকে? শ্বশুর শ্বাশুড়ি পরিবারের ভালোবাসা তো পাইবা না।এখনো তুমি চাইলে চলে আসতে পারো।আমি তোমায় মেনে নেবো আমার কোনো সমস্যা নাই।
দায়ান সোহাকে খুঁজতে পুকুর পাড়েই এসেছিলো।এই কথাগুলো কর্ণ’গো’চর হতেই থমকে যায়।অসহ্য য’ন্ত্রনা শুরু হয় বুকে।
সোহা রনির কথা গুলো একদমই নিতে পারেনি ঠাস করে চ’ড় লাগিয়ে দেয়।খবরদার রনি ভাই মুখ সামলে কথা বলবা।যা বলেছো বলেছো দ্বিতীয় বার আর বলবানা।নয়তো তোমার জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলবো।
দায়ানের মনে ঐকথা গুলো গেঁথে গিয়েছে তাই এসব স্বপ্ন দেখেছে।
সোহা দায়ানের মুখটা ঘাড় থেকে তুলে।এসব আপনি শুনেছেন বলেননি কেন আমায়? নিজের মনের ভিতর চেপে রেখে কষ্ট পাচ্ছিলেন।পা’গল আপনি? কিসের জন্য ভ’য় পাচ্ছিলেন হ্যা? কোথায় যাবো আপনাকে ছেড়ে আমি?
আপনাকে আমি ছাড়ছিনা ওকে? মরে গেলেও ভূত হয়ে আপনার ঘাড়ে চেপে বসে থাকবো।আমি কোথাও যাবো না আপনাকে ছেড়ে।সব সময় সুখে দুঃখে পাশে পাবেন।এতোই সহজ ছেড়ে যাওয়া? আপনি বললেও আপনাকে ছাড়বোনা।
“ভালোবাসিতো আমার এই বরটাকে”। মানুষ যা বলার বলুক।সবসময় মনে রাখবেন,,,,
“আমি আপনার পরিবার।আর আপনি আমার।আর কাউকে লাগবে না আমাদের।এসব ঠুনকো কারণে আপনাকে আমি ছাড়ছিনা জনাব।”
বলেই দায়ানের কপালে চুমু একে দেয়।
দায়ান ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে সোহাকে।
—————————————–
“যে রত্নকে সস্তায় পাওয়া গেল তারও আসল মূল্য যে বোঝে সেই জানব জহুরি।”
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
ওমিও নোহার মতো আসল হীরে চিনতে পারলো না।তাইতো হেলায় হারালো।কথায় আছে ” কু’কু’রের পেটে কখনো ঘি হ’জ’ম হয়না।তাই ওমির ও নোহার মতো ভালো মানুষ তার কপালে সহ্য হয় নি।
নোহার ও মন উঠে গেছে ওদের উপর থেকে। সিরিয়ালের নাইকাদের মতো আর ফিরে যাবে না সুযোগ ও দিবে না।অনেকতো হলো আর না।
ওমিদের কে’স টা কোর্টে উঠেছিলো।ওমির মা আর তমাকে জা’মিনে ছাড়াতে পারলেও ওমিকে পারে নি।ওমির ৪ বছরের জে’ল হয়েছে।কোর্ট থেকেই নোহা আর ওমির ডি’ভো’র্সের সকল ব্যবস্থা করেছে।এবং নি’র্বি’ঘ্নে সব কিছু হয়েছে।এসব কিছু দায়ান নিজে পাশে থেকে সামলেছে।ওমির মা ও তমা ভালো মতো শাস্তি না পাওয়ায় সবারই মনটা একটু খারাপ ছিলো।
নোহা সবাইকে বলে তোমরা মন খারাপ করো না।ওদের পাপের শাস্তি ওরা ঠিক পাবে। রিভেঞ্জ অফ নেচার বলে একটা কথা আছে না।আমার একটুও আফসোস নেই।কারণ এটা দিয়ে ওদের শাস্তি মাত্র শুরু হয়েছে।
নোহা মনে মনে প্রার্থনা করে,,ওমির মুখ যেনো এই জীবনে আর কোনোদিন ও দেখতে না হয়।
———————————–
প্রায় অনেকদিন হয়ে গেছে সোহা আর দায়ান সোহাদের বাড়িতে আছে।
ঐদিকে সব কিছু পরে আছে।রুশ একের পর এক কল দিচ্ছে। সবকিছু একা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বে’চারা।কতো কতো মিটিং ঝুলিয়ে রেখেছে।
এখানে আর বেশিদিন থাকলে দায়ানের ব্যবসা লা’টে উঠবে।
তাই সিধান্ত নিয়েছে কালই সোহা আর দায়ান ফিরে যাবে।নোহা এখন সুস্থ আছে।
সকাল থেকেই সোহার মনটা খারাপ হয়ে আছে। কান্না পাচ্ছে। এতোদিন থেকেছে সবার সাথে।মুক্ত পাখির মতো উড়েছে।আবার সেই বন্দী জীবন।তাও একটা কথা ছিলো দায়ান সাথে থাকলে।কিন্তু উনিতো পরে থাকে অফিসে।এক সকালে বের হয় রাতে আসে।কাজের চাপ না থাকলে মাঝে মাঝে দুপুরে এসে এক সাথে খায়।আর সারাক্ষণ একা ঘরে বন্দী পাখি।
সোহা আরো কিছুদিন এখানে থেকে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দায়ান দিচ্ছে না।
তার এক কথা অনেকদিন এখানে থেকেছো আর না।তোমার ভার্সিটি আছে।আমার অফিস আছে।এখন আর থাকা যাবে না।পরের বার আবার এসে অনেকদিন থাকবো।আমি তোমায় নিয়ে আসবো।
অনেকবার বলার পরও যখন দায়ান রাজি হলো না।তখন সোহা মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দায়ান কথা বলতে আসলে উত্তর দেয় না। এড়িয়ে চলে যায়। কথাই বলবে না লোকটার সাথে হুহ।আর কয়টা দিন থাকতে দিলে কি এমন হতো?
লোকটা যা বলে তাই করবেই করবে।কোনো দাম নাই সোহার কথায়।
রাতে খাবার খাওয়ার সময় দায়ানের পাশে বসে খায়নি সোহা।চুপচাপ অন্য পাশে বসে খেয়ে উঠে চলে গেছে।দায়ান শুধু তাকিয়ে সোহার কর্ম’কান্ড দেখছে।
সোহা রুমে এসে বিছানায় অন্য পাশ ফিরে শুয়ে থাকে।দায়ান যখন রুমে এসে ঢুকে, সোহা ঘুমানোর ভা’ন করে চুপ হয়ে থাকে।
দায়ান সোহার দিকে তাকিয়ে বলে,, আমি জানি তুমি ঘুমোও নি।সো এদিকে ফিরো।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
এদিকে ফিরতে বলছি আমি সোহা।তুমি শুনতে পারছো না?
তাও সোহা কোনো কথা বলছেনা।দায়ান এবার সোহাকে নিজের কাছে টেনে আনে।ইসসস রে আমার জা’ন আমার উপর এতো অভিমান করেছে? আমার কাছে আসছে না।আমার দিকে তাকাচ্ছে না।বলেই সোহাকে নিজের বুকের উপর উঠিয়ে নেয়।এতো অভিমান করতে হবে নাতো জা’ন। আমরা আবার আসবো বলছিনা? তুমি এখানে থাকলে আমি কি করে থাকবো বলোতো? আমার মন এখানেই পরে থাকবে।একটুও কাজে মন দিতে পারবো না।খাওয়া দাওয়া তো সব বাদ ই দিলাম।পরে কিছুদিন পরে গিয়ে দেখবা আমিই নাই হয়ে গেছি।মরে গেছি।
সোহা তারাতাড়ি করে দায়ানের মুখে হাত দেয়।কপট রাগ দেখিয়ে বলে,,, এসব বললে কিন্তু খবর আছে।আর একদিন ও যেনো এসব কথা না শুনি।ঠিক আছে যাবো আমি।
বলেই দায়ানের বুকে চুমু খায়। দায়ান সোহাকে ঘুরিয়ে নিচে ফেলে সোহার উপর উঠে জড়িয়ে ধরে। এইই উঠেন আল্লাহ আমি ভর্তা হয়ে যাবো।
হয়ে যাও।
—————————————–
ভোর সকালেই সোহা ঘুম থেকে উঠে পরে।দায়ান এখনো ঘুমুচ্ছে।
নোহা আর সোহা বেরিয়ে পরে একটু দুই বোন একা সময় কাটানোর জন্য। গ্রামের আকা বাঁকা মেঠো পথে হেটে চলেছে। আবার কবে দুই বোনের দেখা হবে কে জানে।তাই কথার ঝুড়ি খুলে বসেছে।অবশ্য সোহাই বেশি বকবক করে চলেছে।নোহা বোনের কথায় উত্তর দিয়ে চলেছে।তার বোনটার স্বভাব একটুও বদলায়নি।সেই আগের মতো চঞ্চলই আছে।
দুই বোন যখন হেঁটে চলেছে মনের সুখে। তখনই গ্রামের কিছু লোক নোহার দিকে কেমন করে যেনো তাকাচ্ছে। নোহা তা বুঝতে পারছে।তাই সোহাকে তাড়া দিয়ে বলে বোন অনেক হয়েছে এবার বাড়ি চল।তর উনি হয়তো উঠে তোকে খুঁজছে। আবার বেরোতেও তো হবে।পরে আবার দেরি হয়ে যাবে।দুই বোন আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। তখনই কানে আসে কিছু কথা।
দেখ দেখ নিজের সংসার ভেঙে কিভাবে আনন্দে ঘুরে বেরাচেছ যেনো কিছুই হয় নি।আরে না হয় মানলাম স্বামী একটু মেরেছে।তাই বলে পুলিশে দিবি? নিজের সংসার ভেঙে ফেলবি? কেমন নি’র্ল’জ্জের মতো আবার ঘুড়ে বেড়ায়।আমরা হলেতো বাড়ি থেকে বেরই হতাম না।
সোহা কথাগুলো শুনে এগিয়ে যেতে চায় জবাব দেওয়ার জন্য। কিন্ত নোহা আঁটকে দেয়। বোন মাথা ঠান্ডা কর। এসবে কান দিস না।ওদের কাজই হলো মানুষের নামে আজে বা’জে কথা বলা।চুপচাপ বাড়ি চল।এসব আমার গায়ে লাগেনি।
কিন্তু আপু,,,,,
কোনো কিন্তু না বাড়িতে চল। বলেই সোহাকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসে।
বাড়িতে দায়ান আর সোহার বাবা বসে গল্প করতে ছিলো।সোহার মা তাদের চা নাস্তা দিচ্ছে। সোহা রাগে হনহন করতে করতে ওদের পাশে গিয়ে বসে। বাবা তোমরা সবাই রেডি হও।আমার সাথে তোমরা ও চলে যাবে।এখানে থাকতে হবে না।সবাইকে নিয়ে চলে যাবো।
কি বলো ছোট আম্মা এগুলা? আমরা কোথায় যাবো? আর কি হয়েছে?
গ্রামের লোক আপুর নামে নানান কথা বলছে।আমি চাই না আপুকে কেউ ছোটো করুক।তাই তোমরা ও আমাদের সাথে যাবে।
— আমরাতো আমাদের ভি’টে মাটি ছেড়ে যেতে পারবো না ছোট আম্মা।
— তাহলে আপুকে আমাদের সাথে যেতে বলো।
–পাশ থেকে নোহা বলে,,পা’গল হয়ে গেছিস সোহা এসব কি বলছিস?
— আমি ঠিকই বলছি।তুমিও যাবা।নয়তো আমি যাবো না।দায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,, আপনি একটু আপুকে বোঝান না।প্লিজ।
হ্যা নোহা চলো আমাদের সাথে।আমিতো সারাদিন বাড়িতে থাকতেই পারি না।দুই বোন এক সাথে থাকবে ভালো লাগবে।না করো না ভাইয়ের কথাটা রাখো।নয়তো তোমার বোনকে তো চিনো।যাবেনা তোমায় ছেড়ে।সোহার বাবার দিকে তাকিয়ে বাবা আপনি পার্মিশন দিন না যাওয়ার।
সোহার বাবা অনেক ভেবে চিন্তে রাজি হয়।মেয়েটা এখানে থাকলে লোকের কথায় বাঁচতে পারবেনা।তার থেকে শহরে চলে যাওয়াই ভালো।হ্যা নোহা মা সোহা আর ছোটো আব্বা যখন বলছে তখন যাও ঘুরে আসো।
বাবা তুমিও? হাহ ঠিক আছে যাবো।
সোহার খুশি দেখে কে? আনন্দে লাফিয়ে উঠে। দায়ানের দিকে তাকায়,, দায়ান বসা থেকে উঠে মুচকি হেসে সোহার মাথায় টোকা দেয়।রুমে যেতে যেতে বলে,,তারাতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। ড্রাইভার আংকেল গাড়ি নিয়ে আসলো বলে।
তারপর সবাই খাওয়া দাওয়া করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
নতুন শহরেই হয়তো নোহার জীবনটা নতুন ভাবে শুরু হবে।শুধু সময়ের অপেক্ষা।
#চলবে,,,,,,,