#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৮
” অ্যাই শোনো না। ”
” বলে ফেলো। ”
” বলছি মানলিচেন ক্যাবল কার স্টেশন আর কতদূর? এক্সাইটমেন্টের চক্করে হাঁটতে ইচ্ছে করছে না তো। ”
সঙ্গিনীর কোমল হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে তূর্ণ মুচকি হাসলো। জবাবে বললো,,
” এই তো আমরা চলে এসেছি। ”
দিবাকরের আলোয় উজ্জ্বল চারিপাশ। তূর্ণ’র কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হলো মেয়েটি। অধরে খেলে গেল মিষ্টি হাসির রেখা। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল মানলিচেনবাহন ক্যাবল কার স্টেশন। আধুনিক রূপে সজ্জিত স্টেশনটি। নির্দিষ্ট স্থানে দন্ডায়মান একটি গন্ডোলা। গন্ডোলা হলো ছয় আসনের একটি কেবল কার। দুয়া আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে চলেছে। দেখছে সবকিছু। তূর্ণ সেখানে নিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে আলাপণ সেরে নিলো। ওদের জন্য শূন্য একটি কেবল কার প্রস্তুত। তূর্ণ তার মাইরা’র সঙ্গে আলাদাভাবে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করার জন্য একটু বেশি খরচ করেই একটা কেবল কার বুক করেছে। যেখানে থাকবে শুধু তূর্ণয়া! যথারীতি কেবল কার দাঁড়িয়ে। তূর্ণ দুয়া’র পানে হাত বাড়িয়ে দিলো। উচ্ছসিত মেয়েটি স্বামীর হাতে হাত রাখলো। দুজনে প্রবেশ করলো কেবল কারে। দুয়া ফটাফট গিয়ে বসলো জানালার পাশে। উত্তেজনা বিরাজমান তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তূর্ণ তা লক্ষ্য করে নিঃশব্দে হাসলো। পা গ লী মেয়েটা সামান্যতেই কত খুশি! আত্মহারা হয়ে যায়! দুয়া’র বিপরীত দিকের আসন গ্রহণ করলো তূর্ণ। বদ্ধ হলো কেবল কারের দ্বার। দুয়া দ্রুততার সহিত সাইড ব্যাগ হতে ক্যামেরা বের করলো। সে পুরোদমে প্রস্তুত। তূর্ণ তা লক্ষ্য করে হেসে উঠলো। বললো,
” আরে বাবা আস্তে। কেবল কার ছুটে পালাচ্ছে না তো? হ্যাভ প্যাশেন্স। ”
দুয়া মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে বললো,
” সেটাই তো পারছি না। আ’ম সো এক্সাইটেড! দেশে তো কতবার কেবল কারে চড়েছি। খুব আনন্দময় ছিল! এখন দেখার পালা বিদেশের মাটিতে কেমন লাগে। ”
” ইনশাআল্লাহ্ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ”
অতঃপর একটু ভাব নিয়ে বললো,
” আফটার অল সঙ্গী হিসেবে রয়েছে আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ। স্মরণীয় হতে বাধ্য। ”
মুচকি হাসলো দুয়া। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো বাহিরে। ফর্মালিটিজ সমাপ্ত করে চলতে আরম্ভ করলো কেবল কার। আস্তে ধীরে চলতে চলতে কেবল কার স্টেশন ত্যাগ করলো। নেমে এলো সামান্য নিচুতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবুজ তৃণভূমির উপরিভাগে চলতে লাগলো কারটি। বিমুগ্ধ দুয়া একের পর এক দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করতে লাগলো। চারিদিকে দুর্দান্ত দৃশ্য! গাছের উচ্চতায় উড়ে যাওয়া যেন এক জাদুকরী কেরামতি! পিছনে দেখা মিলছে গ্রিন্ডেলওয়াল্ড এবং ওয়েটারহর্নের সমস্ত পথ। সম্মুখে মাটি দুই হাজার ফুট দূরে লাউটারব্রুনেন উপত্যকার নীচে পড়ে গেছে। চারপাশে বরফে আচ্ছাদিত পাহাড়ের চূড়া। রৌদ্রজ্জ্বল এ দিনে পাহাড়ের কোল যেন চিকচিক করছে। লাগছে অসাধারণ! বিমোহিত দুয়া’র পানে হাত বাড়িয়ে দিলো তূর্ণ। ধ্যান ভঙ্গ হলো মেয়েটির। ইশারায় জানতে চাইলো কি হয়েছে। তূর্ণ হাতে হাত রাখার আহ্বান জানালো। মুচকি হাসলো দুয়া। পাশে ক্যামেরা রেখে অর্ধাঙ্গের হাতে রাখলো কোমল হাতটি। তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো তূর্ণ। একটানে নিজের নিকটে নিয়ে নিলো দুয়া’কে। হতবিহ্বল মেয়েটি ভারসাম্য বজায় রাখতে আঁকড়ে ধরলো অর্ধাঙ্গের দু কাঁধ। ঘন শ্বাস পড়ছে। বড় বড় চোখে তাকিয়ে। দুরুম দারুম করছে অন্তঃস্থল। আকস্মিক কাণ্ডে বেশ ভয় পেয়েছে কিনা। তূর্ণ মৃদু হেসে ললাটে অধর ছুঁয়ে দিলো। হাতের ইশারায় নিজের ডান পাশের দৃশ্য অবলোকন করতে বললো। আস্তে ধীরে স্বাভাবিক হলো দুয়া। তূর্ণ’র বক্ষদেশে নিজের ভর ছেড়ে দিলো। তাকালো ডান পাশে। মুহুর্তের মধ্যেই প্রসারিত হলো অধর কোল। মনোমুগ্ধকর সে দৃশ্য! বিমুগ্ধ দুয়া টেরও পেলো না কখন দু’টো পেশিবহুল হাত তার কটিদেশ বেষ্টিত করে নিয়েছে।
” দারুণ! কি সুন্দর লাগছে! অ্যাই তাড়াতাড়ি ক্যামেরাটা দাও তো। ফটো তুলবো। ”
অর্ধাঙ্গিনীর অনুরোধ রক্ষার্থে তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ রেখেই বিপরীত সিট হতে ক্যামেরা হাতে নিলো তূর্ণ। তুলে দিলো দুয়া’র হাতে। দুয়া খুশিমনে ফটো ক্লিক করতে লাগলো। কখনো সুউচ্চ হতে নিম্নের দৃশ্য। কখনো বরফের আচ্ছাদনে রৌদ্রের খেলা। কখনোবা পার্শ্ববর্তী কোনো কেবল কার। পাইন গাছ। একাধিক ফটো তুলতে ব্যস্ত মেয়েটি। খানিক বাদে কর্ণ কুহরে পৌঁছালো তূর্ণ’র কণ্ঠস্বর,
” ফটো তোলা শেষ? ”
” হুঁ? হ্যাঁ। আপাতত শেষ। ”
” তাহলে এবার পার্সোনাল ফটোসেশন হয়ে যাক? ”
বুঝতে না পেরে বাঁ কাঁধে মুখ আনলো দুয়া। তাকালো জিজ্ঞাসু নয়নে। তূর্ণ অধর কা’মড়ে হাসলো। পকেট হতে বের করলো নিজের মোবাইল। ক্যামেরা অপশনে গিয়ে সেলফি মোড নিলো। দুয়া’র বাঁ কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে কর্ণ পাতায় ছুঁয়ে দিলো অধর। ফিসফিসিয়ে বললো,
” হয়ে যাক কাপল সেলফি? ”
লজ্জা মিশ্রিত হাসলো দুয়া। ইশ্! মানুষটি এমন ভাবনা চিন্তার কথা বলছিল! সে তো বুঝতেই পারেনি। বুঝবে কি করে? তার পার্সোনাল ফটোগ্রাফার যে অন্য সবার মতো নয়। একটু বেশিই রোমান্টিক কিনা! লজ্জালু আভা ফুটে উঠলো মুখমণ্ডলে। ক্যামেরায় তাকালো দুয়া। শিরশিরানি অনুভূত হচ্ছে শিরায় উপশিরায়। মানুষটির এতখানি ঘনিষ্ঠতায় দেহ বুঝি অবশ প্রায়। বেকাবু কোমলতায় আচ্ছাদিত চিত্ত। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে রাখা মানুষটি সেভাবেই ক্যামেরা বন্দি করলো নিজেদেরকে। ফটোতে এক ঝলক তাকিয়ে লাজে রাঙা মেয়েটি তৎক্ষণাৎ সরে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু বাঁধাপ্রাপ্ত হলো তৎক্ষণাৎ। তার উদরে স্থাপিত পুরুষালি হাতটি চাপ প্রয়োগ করে নিজের সনে আরো মিশিয়ে নিলো। বাঁ কপোলে ছুঁয়ে দিলো অধর। সে দৃশ্যও ক্যামেরা বন্দি হলো। লাজুকতার ন্যায় গুটিয়ে গেল মেয়েটি। চলমান কেবল কারে এখন প্রেমময় অনুভূতির আনাগোনা। ঘন হয়ে আসছে শ্বাস। আস্তে করে মোবাইলটি বাম পাশে সিটে রাখলো তূর্ণ। নিজেকে নিয়ে গেল মাইরা’র আরেকটু সান্নিধ্যে। মুখ ডুবালো উন্মুক্ত দীঘল কেশে। শুভ্র রঙা বিয়ানির নিম্নে ডুবানো একান্ত জনের মুখখানা। আবেশে নিমীলিত হলো মেয়েটির নেত্র জোড়া। আঁকড়ে ধরলো উদরে রাখা হাতটি। দীঘল কেশে মুখ গুঁজে রাখা মানুষটি নাসিকা গ্ৰন্থিতে শুষে নিতে লাগলো একান্ত প্রিয় সুবাস! মোহনীয় মা*দকতায় বুজে এলো আঁখি পল্লব। কিছুটা সময় সেভাবেই পেরিয়ে গেল। নিজেকে কোনোরূপ সরিয়ে নিলো তূর্ণ। আলতো ছোঁয়ায় দুয়া’কে ঘুরিয়ে নিজের মুখোমুখি আনলো। বদ্ধ আঁখি পল্লব, মায়াময়ীর চেহারা! প্রবলতর রূপে তারে আকর্ষিত করতে লাগলো। জাগতিক ভাবনা, হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে বসলো প্রেমিক পুরুষটি। দু হাতের তালুতে ভরে নিলো মাইরা’র মুখখানি। কোমল ওষ্ঠের ওপরে তপ্ত শ্বাসের বহর অনুভূত হতেই নেত্র মেলে তাকালো দুয়া। নে’শালো নয়নে মিলিত হলো নয়ন। পড়তে পারলো সে চোখের ভাষা। আকুলতা! শিরশির করে উঠলো কায়া। নিজেকে মুক্ত করতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। যেন অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা সে। তাকে বন্দী করে রেখেছে মানুষটির সনে। তূর্ণ বুঝি চাহনিতেই ছুঁয়ে দিচ্ছে। অবর্ণনীয় লাজে ম|রি ম|রি অবস্থা মেয়েটির। তূর্ণ আরো কিছুটা সন্নিকটে এলো। আগত মুহুর্ত অনুধাবন করেই মিইয়ে গেল দুয়া। ধীরে ধীরে বদ্ধ হলো দু’জনার আঁখি। ঘুচে গেল সামান্য দূরত্বটুকুও। একত্রিত হলো দু’জনার তপ্ত শ্বাস। তূর্ণ’র একটি হাত বাম কপোলে রাখা। আরেক হাত স্থাপিত কটিদেশে। দুয়া কোমল দু হাতে আঁকড়ে ধরে স্বামীর কাঁধ। জাগতিক হুঁশ হারিয়ে গ্রিন্ডেলওয়াল্ড এর আকাশ পথে তৃপ্তিময় ছোঁয়ায় মগ্ন সে যুগল।
•
তৃতীয়বারের মতো বেজে উঠলো কলিংবেল। বিরক্ত হয়ে শয্যা ত্যাগ করলো নিশাদ। নামলো বিছানা হতে। অসময়ে এলো টা কে? বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করছে না। খামোখা তার আরামদায়ক ঘুমটা ভেঙে গেল। বিরক্তিতে ছেয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল নিশাদ। নিশ্চয়ই বন্ধুরা এসে এমন আকাম করছে। যদি টগর কিংবা রাজীব হয় না পি|টিয়ে ছা”লচামড়া আলাদা করে দেবে। নিশাদ দরজা উন্মুক্ত করেই হতবিহ্বল! বিপরীতে থাকা তিন রমণীও কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। বোকা বোকা হাসি দিয়ে কলিংবেল হতে হাত সরিয়ে নিলো পুষ্পি। চতুর্থবারের মতো বাজাতে যাচ্ছিল কিনা!
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছেন? ”
বড় করে সালাম দিলো বিন্দু। আস্তে করে দুই বান্ধবীর অন্তরালে লুকিয়ে পড়লো তৃষা। যদিওবা নিশাদের দৃষ্টির আড়াল হতে পারলো না। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রেয়সীর পানে। পুষ্পি ফট করে বলে উঠলো,
” ভাইয়া অ্যাক্সিডেন্টে মাথার সাথে কানেও আঘাত পেয়েছিলেন কি? ”
ভ্যাবাচ্যাকা খেল নিশাদ। তৃষা হতে দৃষ্টি সরিয়ে ওদের দিকে তাকালো। বুঝতে না পেরে বললো,
” সরি? ”
বিন্দু বললো, ” আসলে ভাইয়া আপনি সালামের উত্তর দিলেন না। এমনকি কেমন আছেন সেটাও বললেন না। তাই পুষ্পি দুষ্টুমি করছিল। ”
বলেই পুষ্পির দিকে গরম চোখে তাকালো। নিশাদ নিজের ওপর বিরক্ত হলো। কোনোমতে নিজেকে ধাতস্থ করে মুচকি হেসে বললো,
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তোমরা দাঁড়িয়ে কেন? এসো ভেতরে এসো। যদি না প্রবলেম থাকে। ”
তৃষার দিকে তাকিয়ে শেষোক্ত কথাটা বললো নিশাদ। সে বলতে না বলতেই হাসিমুখে ঢুকে পড়লো পুষ্পি। পিছুপিছু বিন্দু। এখনো দরজায় একাকী দাঁড়িয়ে তৃষা। অবনত তার মুখখানি। নিশাদ আস্তে করে বললো,
” ভেতরে এসো। ”
এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে নিলো তৃষা। ধীরপায়ে ফ্লাটে প্রবেশ করলো। দেখতে পেল পুষ্পি এবং বিন্দু চোখ বুলিয়ে ফ্লাটের এদিক ওদিক দেখছে। পুষ্পি কাউকে দেখতে না পেয়ে বললো,
” ভাইয়া বাসায় আর কেউ নেই? ”
ওদের সোফায় বসতে ইশারা করে নিশাদ বললো,
” না। আমি একাই থাকি। ”
বিন্দু সোফায় বসতে বসতে প্রশ্ন করলো,
” একা থাকেন? কেন? আংকেল আন্টি? ”
” বাবা গত হয়েছে ছয় বছর। মা গ্রামে থাকে। ”
পুষ্পি মাথা নাড়িয়ে বললো,
” হুম বুঝলাম। ভাই-বোন নেই তাই না? ”
নিশাদ মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। তৃষা আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলো মানুষটির অবস্থা। মাথায় এখনো শুভ্র ব্যান্ডেজের অস্তিত্ব বিদ্যমান। পড়নের নীলাভ টিশার্ট সামান্য কুঁচকে। চোখেমুখে ঘুমের রেশ। বোধহয় ঘুমিয়ে ছিল। ইশ্! তারা অবেলায় এসে বিরক্ত করলো। নিশাদ ওদের বিপরীত দিকের সোফায় বসলো।
” এবার বলো তোমরা কেমন আছো? হঠাৎ এই ভাইয়ের কাছে আসা? ”
পুষ্পি ফট ফট করে বলতে লাগলো,
” আমরা তো আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই আছি ভাইয়া। আর হঠাৎ করে আসি নি কিন্তু। দু’দিন ধরে আসবো আসবো করে আসা আর হয়নি। ব্যস্ত ছিলাম কিনা! শেষমেষ আজকে তৃষ এর ঠেলাঠেলিতে চলেই এলাম। মেয়েটা আসার জন্য পা`গল হয়ে যাচ্ছিল একপ্রকার। ”
বি*স্ফোরিত চাহনিতে তাকালো তৃষা। এতবড় চাপাবাজি! লজ্জায় মেয়েটার মুখখানি লাল হয়ে গেল। নিশাদ তা লক্ষ্য করে বক্র হাসলো। মুখে শুধালো,
” তাই? তৃষা আসার জন্য এতটাই উদগ্রীব ছিল? ”
বিন্দু বললো,
” সে একটুআধটু ছিল। আপনার অ্যাক্সিডেন্টে বেশ ভয় পেয়ে গেছিল মেয়েটা। আমরাও ভাবলাম একবার দেখা করা উচিত। তাই আজ চলে এলাম। অবেলায় এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো? ”
তৃষার দিকে তাকিয়ে নেতিবাচক মাথা নাড়লো নিশাদ। পুষ্পি খুশি খুশি বললো,
” আমাদের আগমনে আজ পর্যন্ত কেউ বিরক্ত হয়েছে নাকি? আমরা তো যেখানেই যাই খুশির বক্স নিয়ে যাই। তাই না তৃষ?”
তৃষা ওর দিকে গরম চোখে তাকালো। এতগুলো চাপাবাজি ঢেলে আবার প্রশ্ন করা হচ্ছে? ওকে তো চিপায় নিয়ে কে”লাতে ইচ্ছে করছে। নেহাত নিশাদ ভাইয়া আছে। নাহলে…! নিশাদ উঠে দাঁড়ালো। কিচেনের দিকে যেতে যেতে বললো,
” আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা বসো। ভাইয়া আসছি। ”
” অ্যাই না না। অসুস্থ শরীরে কিছু করতে হবে না। ”
তৃষার আপত্তি কর্ণপাত হতেই তৎক্ষণাৎ পিছু ঘুরে তাকালো নিশাদ। কিচ্ছুটি বললো না। বক্র হেসে চলে গেল কিচেনে। তৃষার মাথায় হাত। আগ বাড়িয়ে কথাটা বলার দরকার ছিল কি? পুষ্পি ও বিন্দু একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
•
” উঁহু হুঁ! ঠাণ্ডা। ”
শীতল হিমবাহের পরশে দাঁড়িয়ে লোমকূপ। বরফের ন্যায় জমে যাওয়ার মতো দুরবস্থা। শ্বাসের সঙ্গে শীতলতা বেরিয়ে আসছে। দুই বাহুতে হাত বুলাতে লাগলো দুয়া। ডান পাশে সঙ্গী তূর্ণ।
পাহাড়ের উপরে বসে থাকা এই বিশাল নীল বরফের উপর দিয়ে হাঁটা! এ যে এক রোমাঞ্চকর এবং নম্র দুঃসাহসিক কাজ। প্রত্যয়িত এক গাইড সহ সুইস আল্পসের হিমায়িত আশ্চর্যভূমি অন্বেষণে মগ্ন তূর্ণ, দুয়া যুগল। দু’জনে আজ এসেছে রোন গ্লেসিয়ার (রোনেগলেটচার) অন্বেষণ করতে। বৃহৎ রোন হিমবাহের পরিমাপ ৭.৬৫ কিমি ( ৪.৭৫ মাইল ) এবং সেথায় একটি বরফের গুহা রয়েছে যেখানে দর্শনার্থীরা হিমবাহের অভ্যন্তরীণ অন্বেষণ করতে পারে। দু’জনে গাইডকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলছে। নীল বরফের উপর দিয়ে সরু পথ ধরে হাঁটা! উফ্! কি দুর্দান্ত অনুভূতি! শীতে কম্পনরত যুগল হাত ধরে অগ্রসর হতে লাগলো। গাইডের কথা শোনার পাশাপাশি ক্যামেরা বন্দি করতে লাগলো গ্লেসিয়ার ওয়াক এর মুহূর্তটি। নীলাভ আভায় আচ্ছাদিত স্থানটি। পায়ের নিচে বরফ। কাঁচের মতো দেয়ালের বাইরেও বরফের উপস্থিতি। উফ্! মনোমুগ্ধকর! ওদের মতো আরো অনেকেই বিমোহিত সেথায় হাজির হয়ে!
.
সুইজারল্যান্ডের আল্পাইন অঞ্চল, প্রচলিতভাবে সুইস আল্পস (আল্পি সুইজরে, রোমাঞ্চে: আল্পস সুইজরাস) নামে পরিচিত। এটি দেশের একটি প্রধান প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এটি সুইস আল্পস সহ জুরা পর্বতমালার মালভূমি এবং সুইস অংশের তিনটি প্রধান ভৌতিক অঞ্চলের একটি। সুইস আল্পস পশ্চিম আল্পস এবং পূর্ব আল্পস উভয় জুড়ে বিস্তৃত, একটি অঞ্চলকে ঘিরে রেখেছে কখনো কখনো সেন্ট্রাল আল্পস নামে পরিচিত। যদিও বার্নিজ আল্পস থেকে অ্যাপেনজেল আল্পস পর্যন্ত উত্তরের রেঞ্জগুলি সম্পূর্ণরূপে সুইজারল্যান্ডে, মন্ট ব্ল্যাঙ্ক ম্যাসিফ থেকে বার্নিনা ম্যাসিফ পর্যন্ত দক্ষিণ রেঞ্জগুলি ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রিয়া এবং লিচেনস্টাইনের মতো অন্যান্য দেশের সাথে ভাগ করা হয়েছে।
তূর্ণ এবং দুয়া! দু’জনে সুইস আল্পসে হাইকিং করতে ব্যস্ত। পাশাপাশি হেঁটে চলেছে তারা। হাতে ওয়াকিং স্টিক। বরফের বুকে স্টিক গেঁথে এগিয়ে চলেছে তারা। ঠাণ্ডায় পা জমে যাবার উপক্রম। দূর দূরান্তে যেদিকে দৃষ্টি পড়ে শুধু বরফ আর বরফ। পাহাড়ের কোলে বরফের শুভ্র আচ্ছাদন।
” সাবধানে। পড়ে যেয়ো না আবার। ”
” পড়বো না গো। কিন্তু শীতে জমে যাবো কনফার্ম। আল্লাহ্ কি শীত! উঁহু হুঁ। ”
তূর্ণ দুয়া’র অবস্থা অনুধাবন করতে পারলো।
” এজন্য বলেছিলাম ভারী পোশাক পড়ো। শুনলে না তো। এখন বোঝো ঠ্যা লা। ”
” ধ্যাৎ! আমি কি জানতাম সুইস আল্পসে এত ঠাণ্ডা? আমি তো ভেবেছিলাম সহনশীল ঠাণ্ডা। এখন তো দেখছি..! ”
তূর্ণ হাঁটা থামিয়ে দিলো। তা দেখে দুয়াও থামলো। শুধালো,
” কি? থামলে কেন? ”
তূর্ণ দুয়া’র হাতে নিজের ওয়াকিং স্টিক ধরিয়ে দিলো। কাঁধ হতে নামালো ছোট ব্যাগব্যাক। সেথা হতে রেশমী শীতের পোশাক বের করলো। দুয়া তো অবাক! এসব আনলো কখন? দুয়া কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই ওকে শীতবস্ত্র পড়িয়ে দিলো তূর্ণ। আরাম পেয়ে পোশাক আঁকড়ে ধরলো দুয়া। এতক্ষণে স্বস্তি মিললো। তূর্ণ ওর দিকে নজর বুলিয়ে প্রশ্ন করলো,
” হয়েছে? ”
মুখ ফুলালো দুয়া।
” পঁচা লোক! তোমার কাছে শীতের পোশাক ছিল। আগে দিলে না কেন? ”
মৃদু হাসলো তূর্ণ। ওর সুডৌল নাক টিপে দিয়ে বললো,
” যাতে পরবর্তীতে সচেতন হও। ”
” হুহ্! যতসব লেইম এক্সকিউজ। ”
ভেংচি কাটলো দুয়া। তবে মনে মনে আওড়ালো,
” তোমার যত্ন, ভালোবাসা পাওয়ার লো ভে আমি আরো অসচেতন হতে রাজি প্রিয়। ”
মুগ্ধ আঁখি জোড়া নিবদ্ধ হলো তূর্ণ’তে!
চলবে.