তোকে ঘিরে পর্ব-২৪+২৫

0
864

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_২৪
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

পূর্ব ঠোঁট টিপে আলতো হেসে প্রশ্নের আশায় ভ্রু নাচালে পূর্ণতা লজ্জায় অন্যদিকে তাকায়। এই মূহুর্তে কিচ্ছু বলতে চাচ্ছেনা পূর্ণতা। পূর্বের হাসি দেখলে নির্ঘাত ঘন ঘন ফিট খেতে হবে। যখন পাশে থাকবে না তখন কেমন কষ্ট হবে এই হাসির কল্পনা করলে?

– আশ্চর্য তুমি লজ্জা পাচ্ছো কেন? নিজেই তো বললে আমি তোমার রোগ বাধিয়ে ফেলেছি। কি রোগ বাধালাম তাই তো বললে না। বলো? কি হলো? তুমি প্রেগনেন্ট?

পূর্ণতা ভ্রু কুচকে ঠোঁট উল্টে রাগত ভঙ্গিতে বলে উঠে,
– তুমি আমার কাছে পনের মিনিটের বেশি থেকেছো? আউল ফাউল কথা না বললে চলে না?

পূর্ব তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসিতে পূর্ণতার হাত টেনে বুকে রেখে বলে উঠে,
– তুমি কি চাচ্ছো আমি পনের মিনিটের বেশি থাকি?

পূর্ব এখন কোন ইঙ্গিতে কথাটা বোঝাচ্ছে তা বুঝতে পেরেছে পূর্ণতা। কপালে জোরালো রেখায় ভাজ ফেলে ভ্রু দুটো তীব্র কুচকে টান দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো পূর্বের বুক থেকে। কোল থেকে পূর্বের মাথা নামিয়ে বালিশে শুয়িয়ে বিছানা থেকে নামতেই পূর্ব কৌতুহল কন্ঠে বলে উঠলো,

– কোথায় যাচ্ছো? আমি কিচ্ছু খাবো না। ফজরের আযানটা দিলেই চলে যাবো।
– কতদিন ধরে না খাওয়া? পিটিয়ে কি করেছে তোমার শরীর। আয়নায় একবার দেখবে?
– আমি এসবে অভ্যস্ত পূর্ণ। তুমি প্লিজ ঝামেলা করো না আমার পাশে কিছুক্ষণ বসো।
– পাশে বসলে কি হবে? শরীর কি আগের মতো সুস্থ হবে? আমি কি মেডিসিন?
– মোটেও না। তুমি মেডিসিন কেন হবে আজব? পাশে থাকতে বলেছি চুপ করে পাশে বসো। আমার রাগ তুলো না।

শেষের কথাটা রাগী স্বরের মতো দৃঢ় কন্ঠে বললো পূর্ব। পূর্ণতা শুকনো গলায় ঢোক গিলে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে আবার পা উঠিয়ে পূর্বের কাছে বসলো। পূর্বের কথার খেলাফ পূর্ণতা কখনোই করতে পারেনা বা করতে চায়না। পূর্ব চোখ বন্ধ করে আছে এখন। একটু আগে হাসির ঝিলিকে মেতে উঠা স্নিগ্ধ মায়াময় মুখটা আচানক রাগের আক্রোশে গম্ভীর রূপ ধারন করেছে। পূর্ণতা চুপচাপ শান্তিশিষ্ট ভঙ্গিতে পূর্বের মাথায় হাত বুলিয়ে নিস্তব্ধ রুমের খোলা জানালার বাইরে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। বাতাসের সাথে ঝুম বৃষ্টি মিলেমিশে প্রকৃতিতে কি কঠিন তান্ডব করছে। কি ভয়ংকর লাগছে! মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী বিধ্বস্ত করার চেষ্টায় ক্ষেপণাস্ত্রের মতো মহড়া ছুড়ছে এই ঝড়োবৃষ্টি। বৃষ্টির দিনে অজানা কারনে মন উদাস হয়ে যায়। ভীষন একা লাগে। কাউকে কিচ্ছু বলা যায় না কেন একা লাগছে। পূর্ণতা শুধু ভাবছে যদি এই মানুষটার কিছু হতো তাহলে কি হতো পূর্ণতার? মরে যেতো? মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ধুকে ধুকে বাচঁতো? ঠিক কি হয়েছে পূর্ণতার? কেন এই পূর্ব নামক মানুষটার জন্যে মন কাঁদে? এই মানুষটা কেমন অসুখের মতো পূর্ণতার ঘুম, শান্তি, সুখ সব কেড়ে নিয়েছে! প্যানড্রাইভে ভাইরাস ঢুকলে পুরো কম্পিউটার যেমন অচল হয়ে যায় তেমনি প্রিয় মানুষটা মনের ভেতর একবার ঢুকলে সচল মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।

– আমার দিকে একটু ঝুকো তো পূর্ণ, কাজ আছে।

পূর্ণতার চিন্তার চাদঁরে ছিদ্র করে আদেশসূচকে বলে উঠলো পূর্ব। পূর্ণতা জানালা থেকে মুখ সরিয়ে পূর্বের দিকে ঝুঁকতেই হঠাৎ মাথায় একগুচ্ছ চুল খাবলে পূর্ণতার নাকে কামড় দিলে ব্যথায় শিউরে উঠে নিচু গলায় বলে উঠলো পূর্ণ, ‘আমি ব্যথা পাচ্ছি!! ছাড়ো!!’ চুলের মুঠো আলগা করে করে ছেড়ে দিলে পূর্ণতা হাতে নাক ডলে চোখ কুচকায়। চোখে পানি এসে গেছে ওর। মনে হচ্ছে নাকের নিচটা নেই ছিড়ে আলাদা হয়ে গেছে! ভীষণ ব্যাথা করছে!পূর্ব ভাবলেশহীন গলায় গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে উঠে,

– এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ব্যথা তুমি দিয়েছো। আমি তো চেঁচানোর সুযোগটা পযর্ন্ত পাইনি ঠোঁট কেটে দিয়েছো। যাইহোক, তোমার ফোন কোথায়?

পূর্ণতা এখনো ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে আছে। পূর্বের কথায় কোনো হেলদোল নেই ওর। পূর্ব বালিশের কাছে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে ফোন বের করে কাকে যেনো কল করে। পূর্ণতা মাথা নুয়িয়ে কামিজের শেষপ্রান্তটা দিয়ে চোখের কার্নিশ মুছে ফেলে। পূর্ব কি তাহলে শোধবোধ করলো? অসভ্য লোক! নাকে কেউ কামড় দেয়? কি করে কাল সকালে হলুদের আয়োজনে বসবে? কি উত্তর দিবে ও?

– হ্যালো আপি? এই শোন, এই। কি আশ্চর্য ঢঙ দেখাচ্ছিস কেন? থাপড়ানো উচিত তোকে! ছোট ভাইয়ের সাথে ফাজলামো করিস? ফোন কাটবি না! গাড়ি পাঠা আমি পূর্ণতার বাড়িতে। আবার প্রশ্ন করছিস! তোর প্রশ্নের…তুই কি এখন গাড়ি পাঠাবি নাকি বকবক করতেই থাকবি? বললাম না বাড়ি এসে বলছি এতো অধৈর্য হচ্ছিস কেন? আচ্ছা ওয়েট করছি।

পূর্ব কলটা কেটে দিতেই পূর্ণতা প্রচণ্ড উদ্বিগ্নে বলে উঠে,

– তুমি চলে যাচ্ছো? কেন যাচ্ছো? থাকো না।

পূর্ব ফোনটা বালিশের তলায় রেখে দুর্হতে ভর দিয়ে বিছানায় উঠে বসতেই বলে উঠলো,
– আমি ঘুমাবো।
– ঘুমাও। এখানে ঘুমালে সমস্যা কি?

পূর্ব এমন করে তাকালো যেন পূর্ণতা একটা বিশ্ব গাধা। পরক্ষনে চোখ সরিয়ে ফ্লোরে পা ফেলে এদিক ওদিক চোখ বুলাতেই পান্জাবীর অস্তিত্ব আলনায় দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল। গায়ে পান্জাবী জড়াতেই বলে উঠলো,

– তোমার সাথে থাকলে আমি পাগল হয়ে পাবনার আসামীতে রেকর্ড করবো বুঝছো?
– কেন? পূর্ণতার ভ্রু কুন্ঞ্চিত প্রশ্ন।
– তুমি যে আমার বউ সেটা তোমার মা নিশ্চয়ই জানেনা? এখন যদি ভুল করে তোমার রুমে আমাকে দেখে চড়টা কে খাবে? তুমি! আসো বিদায় দাও। কি হলো বসে আছো কেন?

পূর্ণতা বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে আকাশের মতিগতি দেখতে লাগল। বাইরের আবহাওয়া ভালো না এখন কি চলে যাওয়াটা ঠিক হবে? পূর্ব এককথার মানুষ। যা বলবে করেই ছাড়বে কারোর কথা কানে নিবেনা। মৃদ্যু শ্বাস ছেড়ে পেছনে ঘুরতেই পূর্ণতা দেখে পূর্ব পান্জাবীর পকেটে হাত গুজে আকাশে চোখ রেখে দাড়িয়ে আছে। পূর্ণতা মাথা নিচু করে ফ্লোরে তাকিয়ে রইলো। মনেমনে বলছে, পূর্ব? এই বৈরি আবহাওয়ায় তোমার যাওয়া লাগবে? মা চড় মেরে আমার গাল শেষ করে দিক সমস্যা নেইতো। তুমি রিস্ক নিয়ে যেও না। কিচ্ছু বলতে পারলো না ফ্লোরের ঠান্ডা পাঠাতনে শব্দযোগে নিশ্বাস ছাড়লো পূর্ণতা। হঠাৎ পূর্ব কয়েক পা এগিয়ে পূর্ণতার নিচু করে রাখা মাথাটার পেছনে চাপ দিয়ে বুকে ঠেকালো। পূর্ণতা জড়িয়ে ওকে ধরলো না। পূর্বের অন্যহাত পকেটে গুজা। ওর মাথায় থুতনি বসিয়ে আকাশ ফেটে শব্দহীন বজ্রপাতের ভয় দেখানো খেলা দেখতেই বলে উঠলো,

– থাকো তাহলে। কাল এসে নিয়ে যাচ্ছি।
পূর্ণতা ঠোঁট ভেদ করে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,
– মিটিংয়ের দিন কি হয়েছিলো?

পূর্ব চোখ বন্ধ করে পূর্ণতার মাথায় চুমু দিয়ে বলে উঠলো,
– কিচ্ছু হয়নি।

মাথা থেকে হাত সরিয়ে পূর্ণতাকে ছেড়ে দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পরলো। পূর্ণতা দরজা আটকানোর মনোবল পেলো না ফ্লোরে বসে টিনের দেয়ালে মাথা ডানে হেলিয়ে দিলো। বৃষ্টির ছাটঁ ঘরে ঢুকছে পূর্ণতাকে তিলতিল করে ভিজিয়ে দিচ্ছে মেঘের গর্জনে আকাশ চিড়ে প্রকৃতি ফর্সা হয়ে আবার আধারে মিলিয়ে যাচ্ছে। পূর্ণতা বৃষ্টির পানি ছোঁয়ার জন্য বাইরে হাত এগিয়ে দিলে পাচঁ আঙ্গুলের মুঠোবন্দিতে বৃষ্টির পানি জমা হয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে লম্বা হয়ে পানি পরছিলো। ঠান্ডা হিম শীতল পানি স্পর্শ করে মনে মনে বলে উঠলো, ‘তার জীবনের দুঃখগুলো আমার হয়ে উঠুক। আমার জীবনের শান্তিগুলো তার হাসিতে ফুটুক।’

.

সকাল সাতটা হলেও বাড়ির মধ্যে বেলা বারোটার মতো হরদমে কাজ চলছে। পূর্ণতার বাবা লুঙ্গি উঠিয়ে হাটুতে বেধে কর্মচারীর মতো বাবূর্চির পাশে হাত লাগাচ্ছে। পূর্ণতার মা খোদেজা, মামী, আয়মানে মা মাচা ঘর থেকে মসলার ব্যাগ এনে পূর্ণতার বাবাকে দিচ্ছে। পূর্ণতার খালারা, শ্রেয়ার মা মিলে কোমর বেকিয়ে ঝাড়ু দিচ্ছে উঠোন। ওয়াকিল, আয়মানরা দেখছে টেবিল চেয়ারের ডেকোরেশন। এতোসব আয়োজনের মধ্যে এলাকার বেশি কাউকে দাওয়াত দেয়নি ওরা। খুবই ঘরোয়াভাবে অতি অল্প মানুষের উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো হবে। যতো কম মানুষ তত ভালো কিন্তু কেন পূর্ব এই প্রস্তাব জারি করলো কেউ জানেনা এখনো। শহরে হলুদ লাগানো হয় বিয়ের একদিন পূর্বে সন্ধ্যার দিকে কিন্তু গ্রামের লোকজ ঐতিহ্য হিসেবে হলুদ ছোঁয়ানো হয় বিয়ের দিন সকালে। হলুদের জন্য ঠিক দশটার সময় ধার্য করেছে মহিলারা। পূর্ণতার জন্য হলুদ বাটাঁয় বসেছে ওর ফুপিরা। পিড়িতে বসে মাটির উপর চটের বস্তা বিছিয়ে তার উপর পাটা রেখে হাত দিয়ে হলুদ পিষছে। আনিশা, তানিয়া, শ্রেয়া পূর্ণতার রুমে সাজগোজের সরন্জামাদি আয়নার কাছে সাজাচ্ছে। বিছানার উপর গহনা, শাড়ি রেখে নিজেদের পোশাক নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।

– পূর্ণতা তুই কিন্তু এখনো বললি না তোর নাকে ওটা কিসের দাগ! সত্যটা বলতো কিসের দাগ?
পূর্ণতা ঢোক গিলে বলে উঠলো,
– আনিশা আপু এক কথা কতবার বলবো? খাট থেকে পরে গিয়েছি।
– উহু, মিথ্যা!খাট থেকে পরলে নাক ফেটে যেতো তোর তো নাক ফাটেনি। উল্টো দাগ বসেছে।

শ্রেয়া চুড়ির বাক্স থেকে চুড়ি বের করতেই পূর্ণতার বিব্রত চেহারাটা দেখলো। এরপর আনিশার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
– আচ্ছা খাট থেকে পরলে নাক ফাটে এমন তথ্য কোথায় দেওয়া আছে আপু? তুমি কি কখনো একজেম্প্যাল পেয়েছো?
– শ্রেয়া মাঝখানে কথা বলো না। আমি পূর্ণতাকে জিজ্ঞেস করছি সে বলুক।
– আমিও তো সেটাই বলছি। ও তো বলেই দিয়েছে খাট থেকে পরে ব্যাথা পেয়েছে তুমি এতো ব্যাপারটা টানছো কেন? আজ ওর বিয়ে প্লিজ ওকে ওর মতো ছাড়ো।
– তোমার সমস্যা কি শ্রেয়া? ওর পক্ষে কথা বলার জন্য এক্সট্রা ট্যাক্স পাও?
– আশ্চর্য! আমার বান্ধুবীর ব্যাপারে কথা বললে ট্যাক্স লাগবে এইসব আজগুবি পেচাল কোথায় পাও?
– তো? বিয়ের টপিক যে লাস্টে ঢুকালে সেটা কি দরকার ছিলো? বিয়ে কি আমি করিনি? আমি কি বিবাহিত না?
– আপু পূর্ণতার ব্যাপার নিয়ে নিজের সাথে তুলনা করবেনা। তোমার বিয়েটা কিভাবে হয়েছিলো সবাই জানে তাই দয়াকরে আজকের দিনে কিছু বলো না যাতে ও কষ্ট পাক।
– তুমি বেশি কথা বলছো শ্রেয়া!
– বয়সে ছোট বলে কিছু বলিনা তার মানে এটা না পূর্ণতাকে ইচ্ছা মতো শোনাবে। সকাল থেকেই দেখছি তুমি ওর পিছনে লেগে আছো! কি চাচ্ছো তুমি?

পূর্ণতা ওদের দুজনের তর্কাতর্কি দেখে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। আনিশা সকাল থেকেই পূর্ণতার পেছনে পরে আছে, পূর্বের কথা উঠিয়ে একটু পরপর খোচা মারছে। শ্রেয়া শেষবাক্যটা খুব জোর দিয়ে বললো আনিশাকে,

– অন্যের স্বামীর দিকে নজর দিয়ে নিজের বিয়েটার ক্ষতি করো না। পূর্ণতা? চল দশটা বাজে হলুদ লাগাতে হবে।

আনিশা খাম্বার মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। কত বড় স্পর্ধা শ্রেয়ার! রাগে শরীরের রক্ত ফুটলেও চেয়ার ধরে দাড়িয়ে থাকে ও। এদিকে শ্রেয়া পূর্ণতার হাত ধরে রুমের বাইরে চলে যায়। পূর্ণতার মাথায় হলুদ শাড়ির ঘোমটা টেনে দিয়ে বলে উঠে,

– হেতির জ্বলে বুঝিস না? মন টন খারাপ করিস না।
– আপু কি বুঝেছে পূর্ব যে কাল রাতে এসেছিলো?
– যাহ্ কি বলিস। আমি একটা ইদুরও তোর রুমের কাছে আসতে দেরি হেতি কিভাবে ঢুকবে?

পূর্ণতাকে উঠোনের এককোণায় বসিয়েছে শ্রেয়া। সবাই হলুদ শাড়ি পরলেও শ্রেয়ার শাড়িতে এলার্জী মানে এই বস্তুটা ওর সহ্য না তাই পরেনি। মাটিতে বিশাল পাটি বিছিয়ে পূর্ণতাকে একটা কাঠের পিড়িতে বসানো হয়েছে। মামী, খালা, ফুপিরা সবাই গোল করে বসেছে। পূর্ণতার পাশেই বসেছে হলুদ স্কার্টে বসেছে শ্রেয়া। আনিশা নানা পসরা সাজাতে সাহায্য করছে। খোদেজা বলে উঠলো,

– সুহাশ কোথায় গেলো? সুহাশ, এই সুহাশ?

সুহাশ এক ডাকেই কোত্থেকে হুড়মুড় করে উপস্থিত হলো হাপাতে হাপাতে বললো,
– খালা ডেকেছো?
– হলুদ নিয়ে ও বাড়ি থেকে কেউ এসেছে?

হঠাৎ কিছুটা দূর থেকে আয়মান চেচিয়ে বলে,
– আন্টি আন্টি!! পূর্বিকা আপু এসেছে। হলুদের বাটি নিয়ে যান। নানা ডাকে আপনাকে।

খোদেজা বসা থেকে উঠে দাড়াবে হঠাৎ আনিশা তৎপর কন্ঠে বলে উঠে,
– খালা আমি যাই? আমি নিয়ে আসি হলুদের বাটি?
– তুই যাবি? পারবি? আচ্ছা যা নিয়ে আয়।

শ্রেয়ার মনে সুক্ষ্ম ভয় জন্মালো আনিশা কি হলুদের বাটি ফালাবে নাকি? মন তো তাই বলছে। পূর্ণতা শ্রেয়ার তীক্ষ্মদৃষ্টিতে অবলোকন দেখে ওর হাত চেনে বললো,

– কি দেখছিস ওখানে?
– পূর্ণতা তুই বস তো। আমি আসছি।
– প্লিজ যাস না। আমার নার্ভাস ফিল হচ্ছে সঙ্গে থাক।

শ্রেয়া পূর্ণতার দিকে মুখ তুলে আর উঠার চিন্তা করলো না। একপলক চোখ বন্ধ করে পূর্ণতার হাতে হাত রেখে ইঙ্গিতে আশ্বাস দিলো ‘আমি আছি, টেনশন করিস না’। একটু পর পূর্বিকা হাসি মুখে পূর্ণতাকে একবার দেখতে এলো। পূর্বিকাকে দেখে মামী বলে উঠলো,
– নুহাশ? বাবা নুহাশ একটা চেয়ার এনে দে।
– না আন্টি আমি চলে যাবো। ওখানে কাজ আছে প্রচুর। যাওয়ার আগে পূর্ণতাকে একটু দেখতে এলাম।

পূর্বিকা ভিড় ভিঙিয়ে কাছে আসলে একটু নুয়ে পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে। পূর্ণতার কানে ফিসফিস করে বলে উঠে,
– তোমার বর তো উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে বুঝলে। আমি মুখে এক মগ পানিও ঢেলেছি উঠেনি। কান টেনে যেই বলেছি তোমাকে দেখতে আসছি ওমনেই চটান করে উঠে কি বলে জানো? বলে কি, তোমাকে এক্ষুনি এনে এনে দিতে। এই শোনো, খবরদার আজকে ওকে শান্তি দিবেনা। তুমি আজ আমার সাথে ঘুমাবে ওকে আমার পক্ষ থেকে শাস্তিস্বরূপ বলে এসেছি।

পূর্বিকার কথা শুনে লজ্জা করলেও প্রচুর হাসি পাচ্ছে পূর্ণতার। পূর্বিকা ওকে ছেড়ে দিয়ে থুতনি তুলে দেখে পুরো মুখে হাসির আভাস ফুটেছে বলে কি চমৎকার লাগছে! পূর্ণতার থুতনি ধরা আঙ্গুলগুলোতে ঠোঁট ছুয়িয়ে মিষ্টি ভঙ্গি প্রকাশ করে চলে যায় পূর্বিকা। পাশ থেকে শ্রেয়ার নিচু কন্ঠ,

– পূর্বিকা আপু কত মিষ্টি না পূর্ণতা? আমার না আপুকে সেই কিউট লাগে। কন্ঠটাও কি কিউট।
– হ্যাঁ ঠিক বলছিস।

.

– আপি? গিয়েছিস?
– শুয়ে আছিস শুয়ে থাক। এতো কথা কিসের?

পূর্ব ভোররাতে গোসল সেরে সেই যে শুয়েছে আর উঠেনি। এখনো বিছানায় উপুড় হয়ে পিঠে সাদা কাথা রেখে ঘুমে চোখ বন্ধ করে আছে। পূর্বিকা পূর্বের তছনছ করা অগোছালো রুম গোছাচ্ছে আর প্রলাপ বকছে, ঘুমা ব্যাটা ঘুমা! তোর বউ কিভাবে রাতে এই রুমে আসে আমিও দেখে ছাড়বো! মেয়েটাকে কষ্ট দিছিস না? তোকেও আমি কড়ায় দন্ডায় বোঝাবো। পূর্বিকা রুমের সব ধূলো ময়লা ঝাট দিয়ে আসবাবপত্র চকাচক পরিস্কার করে এখন শেরওয়ানি ইস্ত্রি করছে। পূর্বের রুমে ঢুকতেই সবার আগে চোখে পরবে বামদিকের বড় জানালা যেখান থেকে নীল আকাশের শুভ্র মেঘের ভেলা দেখা যায়। রুমের ঠিক মাঝখানে সাজানো বিছানা, বিছানার ডান পাশে আয়না, বামপাশে খালি। বারান্দা দিয়ে পুরো গ্রামের দৃশ্য দেখা যায়। পূর্ব গ্রামে এলে কখনো জোৎস্নারাত মিস করেনা! সোজা বারান্দায় গিয়ে বিছানা পেতে ঘুমায়। গ্রামের নির্মল সতেজ ধূলোহীন পরিস্কার বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়। মাটির একটা মিষ্টি গন্ধের সাথে বিভিন্ন পোকার ডাকহাক শোনা যায় তখন। দূর থেকে ব্যঙ ডাকার আওয়াজও পাওয়া যায়। নিশিরাতের জোৎস্না আলোতে স্বচ্ছ গ্রামের সূদুর নদের কলকল কলোধ্বনি শোনা যায়। কি অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি! আহ্…রাতেরবেলা গ্রামের প্রকৃতি কি শান্তি না দেয়!!
.

– পূর্ব ভাই এখনো উঠেনাই দেখছোস? মিথুন জাওয়াদ পেদানি খাওয়ার পরও মরলো না কেন?
– ফুয়েল শালারপুত! আস্তে বল! পূর্ব ভাই শুনলে কঠিন মাইর দিবো!
– ধুর বা*! শালা ওইটা মরে না কেন? মরলে একটু শান্তি পাইতাম। এইটা আর এইটার বাপের জন্য নিস্তার নাই উফ!

মিথুন চাপা স্বরে বলে উঠে,
– তোরা আজকের জন্য খারাপ কিছু করিস না কিন্তু। আগে ভালোয় ভালোয় ভাবী আসুক।

মিথুন যে পূর্বকে অতিরিক্ত ভয় পায় এজন্য গা জ্বলে ফুয়াদের! ফুয়াদ সরাসরি একটা চড় মেরে ক্ষেপে গিয়ে বলে,

– আলভোলা হইয়া থাকলে পূর্ব ভাই তোকে নমস্কার করবো না। আজকে আমি নিজেই উনার খাটের স্ক্রু লুজ করতে যাবো।

ফুয়াদের চড় খেয়ে গালে হাত দিতে মিইয়ে যায় মিথুন। হঠাৎ জাওয়াদ কি যেন চিন্তা করে সাবধানী গলায় কাছে এসে বলে,
– মিথুন ঠিকই বলছে ব্যাটা! আজকে কিছু করিস না। পরে দোষ পরবো।
– কি বলিস? হাত চুলকাচ্ছে ওর শান্তি দেখে! আর কতো শান্তি পাইবো বল? এদিকে ওইদিন কুত্তার মতো যে মার মারলো ভাবলে মনে চায় আমি নিজে গিয়ে খুন করে আসি উফ!

ফুয়াদ কিছুক্ষণ সাপের মতো ফোস ফোস করে নিজের রাগ থামালো। পূর্ণতার জন্য ওদের যে পিটুনি খেতে হয়েছিলো এখনো সে কথা ভুলতে পারেনি। কে জানে সামনের পরিনাম কি হতে যাচ্ছে?

.

আয়নার সামনে ভেজা চুলে তোয়ালে ডলছে পূর্ণতা। রুমে এখন একা। বাকি সবাই গোসলের জন্য লাইনে লেগেছে। চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি ঝরছে ওর। হঠাৎ রুমের দরজা আটকানোর শব্দ এলে পূর্ণতা চুল মোছা বাদ দিয়ে পেছনে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যায়! চোখের কোটর মুখছেড়া ভূত দেখার মতো বিশাল হয়ে যায় ওর! হাত থেকে ভেজা তোয়ালেটা ফ্লোরে পরে যায়। পূর্ণতা ঢোক গিলতে থাকতে শুধু…

‘ চলবে ‘

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_২৫
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

পূর্ণতা প্রচণ্ড ভয়ে হাপানির মতো হিড়িক তুলতেই আনিশা ওর হাত উল্টিয়ে পিঠে চেপে ধরে। রাগী কন্ঠে বলে উঠে,

– তোকে দেখে আমার এতো হিংসে হচ্ছে কেন ? তোকে আমার খুন করতে ইচ্ছা করছে পূর্ণতা! কি করি তোকে! কি করি বল ! তোকে মারলে আমি হিংসার অনল থেকে মুক্তি পাবো? ভয়াবহ কষ্ট হচ্ছে পূর্ণতা! পূর্ণতা তুই পূর্বকে বশ করেছিস কি করে? ট্রেনের বগিতে কাপড় খুলেছিস? পূর্ব তো কক্ষনো তোর সাথে ওকাজ করবেনা জানি! তুই নিশ্চয়ই ওকে কাবু করার জন্য ফাঁদ পেতেছিলি তাই না? বল না? কুফরী করেছিস ওকে?

পূর্ণতা চোখ কুচঁকে ব্যথা হজম করার কঠিন শক্তি খাটাচ্ছে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেই ‘রেডিও, আলনা’ পেশিদুটো ভয়ংকর ব্যথায় গা বিষিয়ে তুলছে। মাথা নিচু করে চোখ খুলতেই চোখের পাপড়ি থেকে টপ করে পানি খসে পরে। হঠাৎ আনিশা ওর থুতনি উচিয়ে বলে উঠে,

– সত্য বলতে হিমশিম খাচ্ছিস কেন? তুই ইচ্ছে করেই পূর্বদের গাড়ির সামনে লটকে শুয়েছিলি! যেনো ওরা তোকে দেখে গাড়ি থামায় আর দয়াবান পূর্ব এসে তোকে গাড়িতে তোলে! সব তো প্ল্যান মোতাবেক করেছিস এখন নিরীহ সাজছিস কেন?

পূর্ণতা ব্যথায় চিৎকার করতে চাইলেও আর্তনাদের প্রতিটা শব্দ গলার মধ্যে জড়তা পাকিয়ে আটকে রইলো। উপচে পরা ব্যথায় কেপে কেপে বলে উঠলো,

– আমি এমন কিছুই করিনি তুমি ভুল ভাবছো। আমি সত্যি সেদিন এক্সিডেন্টলি খারাপ জায়গায় ফেসেছিলাম তোমার চিঠি দিতেই গিয়েছিলাম কিন্তু কিভাবে যে সেন্সলেস হয়ে ওদের গাড়িতে উঠি আমি নিজেই জানিনা। আমাকে মিথ্যে অপবাদ দিও না। প্রচুর ব্যথা হচ্ছে আপু। বিশ্বাস করো হাতটা ছিড়ে যাচ্ছে।
– আমাকে তুই বোকা ভাবিস?কো-ইন্সিডেন্স শুধু তোর সাথেই হবে? তাও এতোগুলো? আমার বিয়ের দিনই তোর উপর গুন্ডা চাপলো? সেন্সলেস হলি? পূর্বের সামনে আসলি? ট্রেনে এক কামরায় লটকে এলি? কি ভাবিস আমাকে ? আমি দু মাসের বাচ্চা কিচ্ছুই বুঝিনা?

আনিশা হাত মচকানো শুরু করলে পূর্ণতা চোখ তুলে আনিশার দিকে সরাসরি দৃষ্টি দেয়! করুনার বদলে রাগ দেখতে পাচ্ছে ও! একটা মেয়ে হয়ে অপর মেয়ের সুখ দেখতে পারে না কেন? কি অদ্ভুত! পুরুষের বেলায় মেয়েদের মন নরম আর মেয়েদের বেলায় মেয়েদের মন হিংসা? এ কেমন উটকো অবস্থা! হঠাৎ পূর্ণতার ব্যথার পরিক্রমায় স্বস্তি ঢেলে দিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে খোদেজা,

– পূর্ণতা রেডি হওয়া শুরু কর। বরযাত্রী আসলে কিন্তু সময় পাবি না। আমি শ্রেয়াকে পাঠাচ্ছি।

খোদেজার আদেশ বার্তা স্বল্প হলেও আনিশার অত্যাধিক্য ব্যথা থেকে পূর্ণতা হাফ ছেড়ে বাচঁলো। আনিশা হাত ছেড়ে দিয়ে হনহন করে দরজা ভেজিয়ে চলে গেলো। পূর্ণতার সহ্য হচ্ছে না কিছু! কেন বারবার পূর্ব-আনিশার অতীতের জেরে নিজেকে ফাসতে হচ্ছে? আনিশা কি বুঝতে চাচ্ছেনা এতে পূর্ণতার কোনো দোষ নেই? যেখানে প্রকৃতি ওদের আচানক মিল ঘটিয়েছে সেখানে পূর্ণতার কি অপরাধ? চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো পূর্ণতা, ভেতরের সকল ব্যথা নিশ্বাসের সাথে ঝাড়া দিতে চেষ্টা করলো। হাতটা চোখের সামনে এনে কিছুক্ষন চোখ বুলিয়ে দেখলো লালচে আকার ধারন করেছে। ব্যথা জায়গায় দু একবার ফু দিয়ে শাড়িতে হাত দিলো সে। যত দ্রুত সম্ভব ওকে রেডি হয়ে থাকতে হবে যদি খোদেজা আবার এসে দেখে পূর্ণতা কথা ওর শোনেনি পরে বিরাট কান্ড ঘটাতে পারে। একের পর এক ঝামেলা আর পোহাতে পারছেনা পূর্ণতা, এবার একটু ঠাই চাই পূর্বের বুকে। তীব্রভাবে চাই তাকে।

.

পূর্ব গোসল শেষ করে কেবল ট্রাউজার পরে বারান্দায় এসে দাড়িয়েছে। বাইরে কড়া রোদের ঝাজঁ থাকলেও গাছপালার ছায়াতে বারান্দা ঢেকে আছে নিরিবিলি। বাতাস ছাড়লে গাছের ডালপালা নড়েচড়ে বারান্দার মেঝেতে রোদের অদ্ভুত আকিবুকি খেলা চলে। দেখতে কি দারুন লাগে! হঠাৎ পেছন থেকে অন্যরকম একটা কাশির শব্দ এলে পূর্ব বুঝে যায় কাশিটা দৃষ্টি আর্কষনের জন্য নিমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। পূর্ব পেছনে ঘুরে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে পকেটে হাত গুজিয়ে বলে উঠে,

– কিছু বলবে আব্বু? হঠাৎ আমার কাছে এলে যে? এনিথিং রং?

পূর্বের বাবা গম্ভীর ভাবে হেঁটে এসে পূর্বের মতোই প্যান্টের পকেটে হাত গুজিয়ে ফ্লোরে চোখ আটকে বলে উঠে,

– গাড়ি থেকে নামতে যেখানে তোমার আরেকজনের সাহায্য লাগছিলো সেখানে আপনার সাথে কি হয়েছিলো সেটা জানা কি আমার উচিত না?

আব্বু ইজ এ্যা ইন্ট্রেসটিং ম্যান। যেখানে সচরাচর ‘তুই’ দিয়ে গালিগালাজ করে চড়-থাপ্পর বসিয়ে ছাড়ে। সেখানে কনভারশেসন শুরু করলো ‘তুমি’ দিয়ে। আবার শেষে যে ‘আপনি’তে কনভার্ট হলো সেটাও কিন্তু একটা দেখার মতো দৃশ্য! আমি সহজ গলায় গলা ঝেড়ে বললাম,

– গাজীপুর গিয়েছিলাম। দলে কিছু নতুন ছেলে যোগদান করেছে এ বিষয়ে আমার একটা ব্রিফ করতে হতো। পার্টির নির্দেশ ছিলো অমুক জায়গায় নিজের গাড়ি ছেড়ে অন্য গাড়ির অপেক্ষায় থাকা লাগবে। আমিও ইন্সট্রাকশন মতো গাড়ি, ড্রাইভার সব ছেড়ে কলেজরোড এলাকায় একা দাড়িয়ে রইলাম। ঠিক দশ মিনিট পর একটা গাড়ি এসে আমার পরিচয় দিয়ে সঙ্গে নিয়ে গেলো। আমিও গেলাম। কিন্তু যে জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দিলো সে জায়গা আমি ঠিক করে চিনিনা। গাইডলাইনে বলা ছিলো দলের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবে বাট তারা একজনও ওখানে ছিলোনা। এরপর মাথায় রড জাতীয় কিছু দিয়ে বারি মেরে আমাকে সেন্সলেস করে ফেলে। যখন চোখ খুলি তখন আমার শরীরে কয়েক ধাপ মারা শেষ। চার্চের যিশুখ্রিস্টকে যেভাবে দুইপাশের দড়িতে হাত বেধে ঝুলিয়ে রাখে ওভাবে রেখেছিলো ওরা। দিনেরবেলা লাঠি দিয়ে পেটাতো, রাত হলে পৈশাচিক শয়তানের মতো রড দিয়ে মারতো। ওদের একটাই দাবি, আমি যেনো ওদের দলে ফিরি। আমিও নাছোড়বান্দা ওদের একটাও দাবি মানিনি।

এটুকু বলতেই পূর্ব ছোট্ট একটা ঢোক গিললো। গলা খানিকটা ভিজিয়ে আবার বলতে শুরু করবে হঠাৎ মাঝপথে কথা থামিয়ে দিলেন পূর্বের বাবা। প্রশ্ন ঝুলিয়ে বলে উঠেন ,

– তুই কি পূর্ণতার কথা চিন্তা করিস না?

পূর্ব বাবার প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে দিলো। উল্টো ঘুরে পকেট থেকে দুহাত বের করে রেলিংয়ের উপর পাচঁ আঙ্গুল বসিয়ে আকাশে তাকিয়ে মুগ্ধ নয়নে বললো,

– ওর কথা চিন্তা করলে সব এলোমেলো হয়ে যায় আব্বু। জানোয়ারগুলো যখন মারছিলো তখন ওর কথা প্রচুর মনে পরেছে। বায় চান্স যদি আমাকে মারার দৃশ্য ও দেখতো… কিভাবে সহ্য করতো? ও মরেই যেতো। আমি চাইনা ও কখনো আমার কালো দিনগুলো দেখুক। আমিতো কারিস্মার মতো বেঁচে গেছি আব্বু। শিউর ছিলাম ওদের হাত থেকে আমি জীবিত ফিরতে পারবো না। প্রতিবার মারের সময় আমি কালিমা পরে ফেলতাম যদি হুট করে রূহটা চলে যায়, এইজন্যে। কিন্তু কি থেকে কি হলো…অবিশ্বাস্য লাগছে আমি এখনো বেঁচে আছি।

পূর্বের বাবা হতাশার ভঙ্গিতে জোরে নিশ্বাস ফেললেন। কলেজ জীবনে নিজেও একসময় রাজনীতি করতেন। কি দারুন লাগতো!শুধু রাজনীতির ক্ষমতাবলে ঝামেলাপূর্ণ কঠিন কাজও পানির মতো করা যেতো । কিন্তু পূর্বের মতো এতো আসক্তি নিয়ে রাজনীতি করাটা পছন্দ ছিলো না কখনো। জীবনের তাগিদে ক্যারিয়ার গঠনে নেমে পরতে হয়েছিলো উনাকে। কিন্তু ছেলেকে কি উপদেশ দিয়ে সঠিক পথে আনবে ভেবে পাচ্ছেননা।

– চাচারা কি কোনোভাবেই বিয়েতে আসতে পারবে না? আসলে খুশি হতাম। বাড়িটা জমজমাট লাগতো।
– বিজনেস ডিলে আমি কম্প্রোমাইজ পছন্দ করিনা। ওরা ওখানে ব্যস্ত থাকুক।
– কাকিদের সঙ্গে পাঠিয়ে হানিমুনের সুযোগ করে দিয়েছো। এখন কি তারা বিজনেস ডিলে ব্যস্ত থাকবে? আই ডোন্ট থিংক।

ছেলে তো বড্ড অসভ্য হয়ে গেছে! মুখে কিছুই আটকায় না দেখি! বাবার সামনে কেউ এসব কথা বলে? পূর্বের বাবা কড়া দৃষ্টিতে কিছু বলবেন হঠাৎ পূর্বের মা এসে তাড়াহুড়ো কন্ঠে বলে উঠেন,

– পূর্ব রেডি হয়েছিস? একি! এখনো ভেজা চুলে দাড়িয়ে আছিস? একটাদিন নিজের চুলগুলো মুছলে কি হয়?

পূর্বের মা একটা টাওয়েল এনে ছেলেকে নিজের দিকে ঝুকিয়ে চুল মুছে দিলে পূর্বের বাবা ধীর পায়ে রুম থেকে চলে যায়। মায়ের সামনে আদরের ছেলেকে অপদস্থ করা মুশকিল। কোনো মা-ই সোহাগী ছেলের অপমান সহ্য করতে পারেনা। আর এই মহিলাটা তো আরো আগে পারেনা।

.

অফ হোয়াইট রঙের শেরওয়ানি, কলারে সুক্ষ কারুকার্যের নিপুণতা। খয়েরী রঙের আভিজাত্য পাগরীতে পূর্বকে চোখ ধাধানো সুন্দর লাগছে! বিয়ের পোশাকে নাকি কনেকে সবচেয়ে আর্কষনীয় লাগে তবে পূর্বকে দেখলে সেটা ভুল ধারনা পোষন করতে বাধ্য হবে। কেননা, পূর্বের দিকে যে সর্বপ্রথম চোখ আটকাবে এটা যে কেউ বলে দিতে বাধ্য! পূর্বিকা এসে ওর হাতে রুমাল গুজিয়ে বলে উঠে,

– তোর ফোন কি আমি অনলাইনে অর্ডার করবো? নাকি আপাতত আমার ফোনটা চালাবি?
পূর্ব পকেটে রুমাল ঢুকিয়ে মাথার পাগরী ঠিক করে বলে উঠে,

– আপাতত তোর ফোনটা দিস আমার একটা জরুরী কল করা লাগবে।
– আজকের দিনেও তোর কল করা লাগবে? তোকে রুমাল কি পকেটে ঢুকানোর জন্য দিয়েছি? মুখ ঢাক্! বর না তুই? লোকের সামনে রুমাল ছাড়া যাবি?
– রুমাল দিয়ে ওর চোখের পানি মুছবো। আমার কোনো বিশেষ দরকার নেই এটার। ফোনটা নিয়ে আয়।
– তুই যে আজ একা ঘুমাবি মনে আছে তো? পূর্ণতা আমার রুমে ঘুমাবে, আমার পাশে।
– আমার বউ নিয়ে তুই কোলবালিশ বানাতে চাস কেন? এ কোন্ স্বভাব?
– বউকে কাঁদাতে কষ্ট দিতে ভালোবাসিস আর তুই আমাকে স্বভাবের কথা বলিস? আজ কোনোভাবেই পূর্ণতা তোর কাছে আসবেনা। দরকার পরলে ওকে শিকলে বেধে রাখবো।
– ওকে ওভাবে বাধা তো আমার কর্তব্য তুই কেন পেরেশান হচ্ছিস? আমার বউ আমি বেধে যা খুশি তা করবো।
– চড় দিবো পূর্ব! অন্তত আজকের দিনে তুই চড় খাওয়ার মতো কথা বলিস না।

পূর্ব ঘাড় ঘুরিয়ে স্থিরদৃষ্টি ছুড়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
– তোকে আমি ভয় পাই না। ইউ নো ইট।

পূর্বিকা চুপসে যায় কিছুক্ষণের জন্য। পূর্বের রাগ উঠলে বিরাট সমস্যা হবে ওর রাগ সামলানো বড় কঠিন! পূর্বিকা চুপচাপ ওর ফোনটা এনে ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করে। পূর্ব ফোন নিয়ে একটা সেল নাম্বার বসিয়ে কল করতেই পরিচয়সূচকে বলে উঠে,

– ওয়াসিফ পূর্ব বলছি। কোনো নিউজ আছে?

ওপাশ থেকে নিচু গলায় সাবধানী উত্তরে কেউ যেন বললো,

– পূর্বদা আপনি পারলে বাড়ি থেকে দূরে সেফ কোথাও চলে যান।
– গ্রামেও রিস্ক আছে?
– হ্যাঁ পূর্বদা। বউদি-কে নিয়ে তাড়াতাড়ি কোথাও সরে যান। ওদের টার্গেট শুধু আপনি। আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্য না। তাছাড়া বুঝতেই পারছেন বউদির উপর রিস্ক আছে..
– কৈলেশ? তুমি তো জানো আমার…
– আপনার বিয়ে আমি জানি পূর্বদা। সর্তক থাকুন মনে হচ্ছে ওরা লোক পাঠাবে ওখানে চেক করতে। পারলে বউদিকে নিয়ে কোথাও চলে যান। বাড়িতে বসে থেকে কোনো রিস্ক নিয়েন না। বউদির অঘটন ঘটতে পারে।

আমার বুকে কিছু একটা মুষড়ে চাবুকের মতো আঘাত হানছে টের পাচ্ছি। কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা আমি…মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্য পূর্ণতার ক্ষতি হবে? কি করবো? বাড়িতেও কাউকে বলতে পারবো না। পূর্ণতাকে নিয়ে আজকের দিনে বের হওয়া মুশকিল! কিভাবে সেফ জায়গায় যাবো? হানিমুন ট্রিপের কথা বললেও দেরি হয়ে যাবে! মাথা থেকে পাগরী খুলে জানালার কাছে গেলাম। ফোনটা সুইচ অফ করে দিলাম ভুলেও যাতে কোনো কল না আসতে পারে। আমার ঠান্ডা মাথায় সিচুয়েশন পরোখ করা উচিত। আমার শক্ত মনের ভয়হীন জীবনে আজ এই প্রথম ভয়ের লেশ ঢুকেছে। এই ভয়টা কখনো অনুভব হতো না আমার। কত ডেয়ারিং কাজ করেছি একচতুর্থাংশ ভয় কাবু করেনি কিন্তু আজ ভয়ে আমার মাথা দেয়ালে ঠুকতে ইচ্ছে করছে। পূর্ণতাকে সেফহোমে না রাখলে আমি স্ট্যাবল থাকতে পারবো না। বাড়িতে বিয়ের আমেজে সবাই ফূর্তি করছে কাউকে বলাও পসিবল না। পূর্ণতা আমি কি করবো? তোমাকে এইজন্যই আমি বিয়ের বাধনে রাখতে চাইনি। আমার সূত্র ধরে ওরা তোমাকে ক্ষতি করবে আমি জানতাম! মানুষ সবার আগে দূর্বল জিনিসে আঘাত করে। তুমি আমার দূর্বল জিনিস জানতে পারলে কি থেকে কি হাল করবে অনুমান করতেও আমার গা শিউরে উঠছে। কেন আমি ও দলে গেলাম? না গেলে কি ভালো হতো না? কখনো নিজের সিদ্ধান্তের উপর অনুতপ্ত হয়নি আজ তোমার জন্য অতীতে করা রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রচণ্ড অনুতপ্ত হচ্ছি।। আমি কেন ও দলের ভুলভুলাইয়ায় ফাসলাম? আমার আর্দশনীতি যেখানে মানুষের সেবা করা, ন্যায্য অধিকার স্থাপন করা, নীতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে রোল মডেল করা ছিলো…সেখানে কি করে আমি মার্কসবাদী চিন্তাধারায় গেলাম? কার্ল মার্কস উনার জায়গামতে ঠিকই ছিলেন কিন্তু কালের বির্বতনে আজকের সমাজব্যবস্থায় যে নিয়মশৃঙ্খলা ঢুকেছে তা পুরোপুরি অন্যধারায় চলে গিয়েছে। যেখানে তিল থেকে তাল বানিয়ে রাজনীতির সংগ্রাম চলছে, যেখানে মূল্যবোধ নেই, যেখানে মানুষের মধ্যে নূন্যতম বিবেকও নেই…রাজনীতি জিনিসটা কখনো এমন ছিলোনা যা বর্তমানে নিকৃষ্ট রূপ ধারন করেছে। ১৪০০ বছর পূর্বে একটা আর্দশ সমাজ কিভাবে চলতো জানতে ইচ্ছে করছে। মরুভূমিতে উট চড়ানো সাধারণ বেশভূষার মানুষ নবী পাক (সঃ) কিভাবে একটু একটু করে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি এনেছিলো দেখতে ইচ্ছে করছে। শুনেছি এমন এক সময় আসবে যখন ‘শূন্য থেকে পূর্ণ’ হওয়ার পর আবার শূন্যতে ফিরে যেতে হবে। আচ্ছা এটাই কি তাহলে শেষ জমানা?যেখানে সবকিছুর অধঃপতন হয়ে মনুষ্যবোধই হারিয়ে যাচ্ছে? হয়তো পৃথিবীটা তলিয়ে যেতে বেশিদিন বাকি নেই…

.

বিয়ে — বলতে যতো সহজ তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ভয় কাজ করছে আমার। বাবাকে ছেড়ে মাকে ছেড়ে নতুন পরিবারে মানাতে পারবো? যেখানে পূর্ব আমার পাশে সবসময় থাকবে বলে গ্যারান্টি নেই সেখানে কোনো ঝামেলা হলে আমি কিভাবে মোকাবেলা করবো? মেয়েদের জীবনে নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই। জন্মের পর যে বাড়িতে টুক টুক করে সে বেড়ে উঠে একদিন সময় আসলে সেই জন্মনাড়ির বাড়িটা ছেড়ে নতুন পরিবেশে ভিড়তে হয়। নিজেকে সপে দিতে হয়। মেয়েরা পানির মতো, যে পাত্রে রাখে সেই পাত্রের আকার ধারন করে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হবে। বিয়ে করলে যে শুধু মেয়ের জীবন বদলায় তা কিন্তু ভুল, একটা ছেলের জীবনও পাল্টে যায়। সে দায়িত্বভার নিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে যায়, পদে পদে আর্থিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাড়ির বাইরে থাকে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রচুর পরিশ্রম করে। মেয়েদের জীবন রান্নাঘরে সীমাবদ্ধ থাকলেও ছেলেদের জীবন কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে আবদ্ধ থাকে। রোবটের মতো তারা নিজেদের অনুভূতি লুকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে যখন রাতে ক্লান্ত শূন্য ভারী দেহটা নিয়ে কলিংবেল টিপে তখন তারা আশায় থাকে একগাল মিষ্টি হাসির আবদার। প্রিয়তমা প্রেয়সী যখন ঘামে ভেজা চটচটে শার্টটা জোর করে খুলে দিয়ে পানি হাতে দাড়ায়.. এই দৃশ্য কি মনোরম না? হঠাৎ আমার রঙিন ভাবনার রংধনুতে পুরো কালো রঙ ঢেলে দিয়ে উপস্থিত হলেন বাবা। উনার হাতে স্ট্যাপলার দেওয়া তিন/চারটা কাগজ সম্ভবত ওগুলো কাবিননামার দলিলপত্র। আমার চারপাশ ঘিরে মা, শ্রেয়া, খালা, মামী সহ সব মহিলারা বসে আছে বিছানায়। বাবা আমার সামনে বিছানার উপর কাগজ ও কলম রেখে বললেন,

– সই করো মা। বরপক্ষ বেশি করতে চাচ্ছেনা।

দেরির ব্যাপার শুনে মামী প্রশ্নসূচকে বলে উঠলেন,
– বেয়াই দেরি করবে না মানে? বাজে কতো?সাতটাই তো বাজলো না।

আমি অশ্রুময় চোখে কলম চালিয়ে কাগজে সইন করে দিলাম। টুপ করে একফোঁটা জল পরলো যা পূর্বকে বিয়ে করার খুশিতে না সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার চাপা কষ্টে পরলো উত্তর দিতে পারছিনা। সই শেষে বাবা কাগজ নিয়ে কলম বন্ধ করে মামীকে বললেন,

– বিয়েতে বরপক্ষের ক্ষমতা বেশি থাকে জানেনই তো ভাবী? আমরা আর আগ বারিয়ে বাধা দেইনি। পাচঁ মিনিট পর পূর্ণতাকে নিয়ে বাইরে আসুন কেমন?

গ্রামে একটা তুচ্ছ নীতি আছে বিয়ের সময় বর ও কনে নিজেদের দেখতে পারবেনা এজন্য আলাদা আলাদা কক্ষে বসিয়ে কাজিকে পাঠিয়ে ‘কবুল’ উচ্চারণ করানো হয়। কাজেই আমি পূর্বকে বিয়ের সাজে এখনো দেখিনি। একপলক দেখার জন্য মন আকুলিবিকুল করছে আমার। না জানি কত সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। তাইতো আমার কাছে আনিশা আপু বসেনি উনি গিয়েছে বরপক্ষের ওখানে। একটু আগে শ্রেয়া এসে বলেছে,

‘দুলাভাইকে কি কিউট লাগছে পূর্ণতা বিলিভ কর!! আয়মান পযর্ন্ত আমার কানে এসে বলেছে ‘শ্রেয়া? ভাইয়াকে হাই স্ট্যান্ডার্ডের হ্যান্ডসাম লাগছে না?পূর্ণতা জোশ মাল পাইছে!’ বল আয়মানের কাছ থেকে এতো সুন্দর কম্প্লিমেন্ট ভাবা যায়?আমি এখনো টাস্কি! আনিশা আপু মাছির মতো চারপাশে ঘুরছে বেচারিকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছেনা…আহা’

জড়োয়া গহনা, ভারি শাড়ি পরার কারনে কিছুদিন যাবৎ দূর্বল হয়ে উঠা শরীরটা ভার সহ্য করতে পারছেনা। একসময় ডাক এলো আমাকে নিয়ে যাওয়ার। আমি বিছানা থেকে নামার শক্তি জোগাতে পারছিনা আছড়ে কান্না আসছে। মনে হচ্ছে আমি আর কখনো আমার শৈশবের স্মৃতি ধরে রাখতে পারবো না.. বিয়ের এই গতানুগতিক ধারায় সব হারিয়ে ফেলতে চলেছি আজ। বাড়ির উঠোনে যখন পা দিলাম তখন শুনি পূর্ব আমাকে ও বাবাকে একসঙ্গে একটা রুমে কিছু আলাপ করতে ডেকেছে। অবাক লেগেছে তখন ও কি যৌতুক টাইপ কিছু চাইবে? বলা তো যায় না পরিবারের চাপে চাইতেও পারে। বাবার পিছু পিছু যেতেই দেখি আমার রুমের পেছন দরজা খুলে হাত ভাজ করে দাড়িয়ে আছে সে। বিছানার উপর পাগরী রাখা। সে আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। কিছু কি হয়েছে? হঠাৎ এভাবে একা ডেকে কোন্ জুরিখে তলব করবে? বাবা হালকা হেসে গলা ঝেড়ে দিলে পূর্ব সাথেসাথে পিছনে ফিরে তাকায়। মনে হচ্ছিলো ও এতোক্ষন ধরে অন্যধ্যানে ডুবে ছিলো আমাদের আসার শব্দটুকু শুনতে পায়নি। পূর্ব চুপচাপ আমাদের সামনে দাড়িয়ে একবার আমার দিকে চোখ রাখলো। ওর চোখের ভাষা বলছে কিছু তো একটা নিশ্চয়ই হয়েছে কিন্তু ও আমাকে বলবেনা। হঠাৎ বাবার হাত ধরে নিজের দুহাতের আবদ্ধ করে চোখ নিচু করে বলে উঠলো,

– বাবা, আপনি ওর প্রথম পুরুষ। ছোট থেকে আজ পযর্ন্ত আপনি ওকে প্রচুর আদর দিয়ে যত্ন করে বড় করেছেন। আজ আপনার এই কলিজাটা সারা জীবনের জন্য নিয়ে নিয়ে যাচ্ছি বাবা। আপনার মতো করে দায়িত্ব পালন হয়তো করতে পারবো না কিন্তু কথা দিচ্ছি আপনার মেয়েকে আমি দুঃখ পেতে দিবো না। আমার জীবনও যদি ত্যাগ করা লাগে করবো কখনো ওর উপর অবহেলা করবো না, ক্ষতি করতে দিবো না, কষ্ট দিবো না ভরসা রাখুন। আমি কথা দিলাম।। আপনার জীবন থেকে পূর্ণতাকে নিয়ে আমি ঋণপত্রে নিজের নাম লেখালাম বাবা। এই ঋণ তো আমি শোধ করতে পারবো না। আজ থেকে আপনার কাছে দারুনভাবে ঋণী রইলাম। দোয়া করবেন আমি যেন আমার কথার তুলনায় বেশি বেশি ওকে আগলে রাখতে পারি। বাকিটা আল্লাহ্ ভরসা।

পূর্ণতার বাবা স্থির নয়নে বাকরুগ্ধ হয়ে গেলেন। রুমের ভেতর পিনপতন নিরবতা। কয়েক মিনিট স্তব্ধ থাকতেই হঠাৎ অঝোরে কেদেঁ উঠে পূর্বকে জড়িয়ে ধরলেন পূর্বের বাবা। এতোক্ষন এই মানুষটা কি শক্ত হয়ে চলছিলো যেনো মেয়ের বিদায়ের বেলায় কোনো আপোস নেই অথচ কি অবস্থা? এখন বাচ্চার মতো কাদঁছে।। পূর্ণতা ঝাপসা চোখে পূর্বের দিকে তাকিয়ে আছে। গাল ভিজে যাচ্ছে সেদিকে ওর খেয়াল নেই। পূর্ব মাথা ডানেবামে খুবই হালকা নেড়ে ইশারা দেয়, ‘কান্না করবেনা চুপ’। পূর্ণতা নিজের আঁচল খামচে ধরে। পূর্বের বাবা এখনো দুহাতের শক্ত বেষ্টনীতে পূর্বকে জড়িয়ে রেখেছেন। কান্নার পসরা থামলেও চোখ থেকে নাকের ডগায় পানি ঝরছে। পূর্ব পিঠে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
– শান্ত হোন বাবা। আমাদের বিদায় দিবেন না?

পূর্ণতার বাবা পূর্বকে ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে রুমাল বের করে চোখমুখ মুছলেন। পূর্বের কাধে হাত রেখে মেয়ের হাত ধরে বাইরে এসে বিদায় দিতে এলেন। পূর্বের বাবা আড়ালে এসে পূর্ণতার বাবার কাছে বললো,

– বেয়াই মশাই? আমার ছেলে কিন্তু খুবই চতুর..আপনাকে আবার কাঁদায় নি তো? বদমাইশটা দারুন অভিনয় করতে পারে।

পূর্ণতার বাবা হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,
– আমার ছেলের নামে কুটনামি করে লাভ নেই জনাব। হা হা..

মেয়ের জামাইকে এখনি ছেলে বলছে দেখে কিছুক্ষণ তাজ্জবের মতো তাকিয়ে থাকলো পূর্বের বাবা। হঠাৎ ফিক করে হেসে দিলে সাদরে দুজন কোলাকুলি করেন। পূর্ণতা হাউমাউ করে এমন কান্নাকাটি শুরু করেছে একবার মাকে ধরে কাঁদছে, আরেকবার মামীকে ধরে কাঁদছে, আবার ফিরে যাচ্ছে খালার কাছে। পূর্ণতাকে সবাই ধরে এনে গাড়িতে উঠাতে নেয় আবার পা ঘুরিয়ে দৌড়ে গিয়ে শ্রেয়ার গলা ধরে কাঁদে। এইবার পূর্বের প্রচুর রাগ লাগছে! আরে ভাই কিডন্যাপ করছি নাকি এতো কান্না কিসের? প্রেমের বিয়েতে কোথায় খুশি হয়ে আমার কোলে চড়ে চুমু টুমু দিবে তা না কান্নাই থামাচ্ছেনা! অসহ্য!

পূর্ব বিরক্ত হয়ে গাড়ির ভেতর থেকে বলে উঠলো,

– পূর্ণতা তুমি এতো যখন কাঁদছো তুমি এখানে থেকে যাও। আমি চলে যাচ্ছি।

পূর্ণতা শ্রেয়ার গলা ছেড়ে মাথা ঘুরিয়ে পূর্বের দিকে তাকায়। উপস্থিত সবাই তখন মিচকি মিচকি হাসছে। পূর্ব সেটা তোয়াক্কা না করেই আরেকদফায় বলবে হঠাৎ পূর্বিকা বলে উঠলো,

– আজকেও তোর কথামতো চলা লাগবে? ওর অবস্থা তুই বুঝবি? পরিবার ছেড়ে যাওয়া সহজ?

পূর্ব একটা কথা কানে না ঢুকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ডিরেক্ট পূর্ণতাকে কোলে তুলে! পূর্ণতা হা করে আশেপাশে উপস্থিত সবার হাসাহাসি দেখছে! পূর্ব গাড়িতে ওকে বসিয়ে দরজা আটকে দিয়ে গাড়ির পাশের দরজা খুলে বসে পরে। পূর্ণতা ঝিম করে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে…সবার সামনে লাজ শরম ভুলে পূর্ব এটা কি করলো? কি বিশ্রী কাজ করলো ছি ছি!! পুরোই মাথা কাটা গেলো! এরই মধ্যে রাগী গলায় ড্রাইভারকে ধমকে বললো পূর্ব,

– গাড়ি স্টার্ট দিতে বলিনি? কানে ঢুকে না কথা?

গাড়ির ড্রাইভার কঠিন একটা ধমক খেয়ে কাচুঁমাচুঁ করে গাড়ি স্টার্ট দিলে হঠাৎ পূর্ণতা অস্থির কন্ঠে বলে উঠে,

– কি হয়েছে? তুমি এমন ধমকাচ্ছো কেন?

পূর্ব মাথার পাগরীটা খুলে পেছনের সিটে ছুড়ে মারলো! গাড়ি চলতে শুরু করলে পাগরীটা পেছনের গ্লাসের সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পরে গেলো। পূর্ণতা চমকে উঠে চোখের কোটরে পানি জমিয়ে গলা নিচু করে বলে উঠে,

– বিয়ে না করতেই রাগ দেখাচ্ছো?

পূর্ব দাতঁ কটমট করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,

– আমাকে ক্রিমিনাল বানিয়ে এখন ইনোসেন্ট সাজো! ওভাবে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিলে কেনো? আমি কি জোর করে বিয়ে করেছি? বিয়েতে তোমার মত ছিলো না? কেন ওরকম বিহেভ করলে? কথা বলবেনা আমার সাথে!

‘ চলবে ‘