তোকে ঘিরে পর্ব-২৬+২৭

0
1156

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_২৬
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

আকাশে গুচ্ছাকারে মেঘ জমছে যেকোনো সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে মেটো রাস্তা কর্দমাক্ত করে দিবে। পূর্ব আমার থেকে বিশাল দূরত্ব বজায় রেখে জানালার পাশে চেপে বসেছে। আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি ওর চোখ মুখ কঠিন। আমি বুঝতে পারছিনা হঠাৎ আমার উপর রেগে আছে কেন! আমি ওকে রাগিয়ে দেওয়ার মতো কিছুই এখনো করিনি শুধু বিদায়ের বেলায় যতটুকু কেদেঁছি। এটাই কি আমার অপরাধ? বিদায়ের বেলায় মেয়েরা কি কাদেঁ না? আমি অশ্রুপূর্ণ চোখ মুছে ডানে ওর দিকে তাকালাম, পূর্ব জানালার বাইরে রাগান্বিত মুখ করে তাকিয়ে আছে। ওর ওই অবস্থা দেখে আমার সাহস হচ্ছেনা ওর হাতটা ধরে একবার বলি ‘আমার ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করো’। ওর রাগ মানেই ভয়াবহ বস্তু আমি প্রচুর ভয় পাই। কিছুটা সময় হুরহুর করে পেরিয়ে গেলে গলায় ঢোক ফেলে একটু কাছে যেয়ে বলি,

– আমার সাথে এখনি রাগারাগী করছো? আমার ভুলটা কি শুধুই কেদেঁছি বলে? তাকাও না একটু।

আমি যে একটা জ্যান্ত মানুষ আকুতি বিকুতি করছি তার কোনো ভাবাবেগ নেই একদম সরল, স্বাভাবিক, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আকাশে মেঘের পসরা দেখছেন। ড্রাইভার নরমাল গিয়ারে গাড়ি টানছেন আশেপাশে রাস্তায় চলা মানুষগুলো আমাদের দেখছে তাদের কাছে গাড়িতে চড় মানুষগুলো রাজা-বাদশার মতো লাগে। কয়েক ঘন্টা পূর্বেও আমি বাবার কাছে ছিলাম, মায়ের দিকনির্দেশনা শুনছিলাম, শ্রেয়ার ফাজলামি শুনছিলাম, আয়মানের বলা উল্টাপাল্টা কথায় হো হো হাসছিলাম…জানিনা সময়টা এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে চলে গেলো। আমার এই গাড়িতে পূর্বের পাশে বসেও বড্ড শূন্যতা অনুভব হচ্ছে। খালি খালি লাগছে বুকের ভেতরে মনে হচ্ছে আমার সবকিছু ‘বিয়ে’ নামক চুক্তিতে ছিনিয়ে গেছে। আচ্ছা পূর্বকে বিয়ে না করলে কি ঠিক হতো না? আমি কেন ওর জন্য পাগলামি করলাম? আজ যেখানে পূর্ব আমার পাশে, এতোটা কাছে, নিজের ডানদিকে…সেখানে আমি ওকে নিছক ঘটনার জেরে স্পর্শ করতে পারছিনা। ওর হাতের বাহুডোরে নিজের হাত মিলিয়ে চওড়া কাধে মাথা হেলিয়ে আমি দুঃখপূর্ণ অনুভূতি ঝেড়ে ফেলতে পারছিনা। ও আমাকে মূল্য দিচ্ছেনা। মাথা নিচু করে কোলের উপর রাখা হাত দুটোর উপর নিঃশব্দে নোনাজল ফেলছি পূর্ব আমার দিকে এক সেকেন্ডের জন্য তাকাচ্ছে না। আরো ধেয়ে বুক ফাটিয়ে কান্না আসছে! ওর অবহেলা আমি সহ্য করতে পারছিনা! ইচ্ছে করছে ওর গলা জড়িয়ে বুকে মাথা লুকিয়ে সর্বস্ব ছেড়ে আসার যন্ত্রণায় তুমুল কান্নাকাটিতে মন হালকা করি। বাবার সাথে এতো বড় বড় ওয়াদা করলো সেই ওয়াদার কি হলো? ও কি মিথ্যে কথার জালে বাবাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দিলো, ‘বাবা আপনি টেনশন করবেন না আপনার মেয়েকে দুঃখ ছাড়া কিছুই দিবো না’? আমি যদি এখনি ওর অবহেলাপূর্ণ রাগ সহ্য করতে না পারি পরে কি অবস্থা হবে আমার? জানিনা আমি। শুধু এটা জানি আমি মরে যাবো। যার জন্য আমি আমার স্বাভাবিক জীবনে অস্বাভাবিক আচরন করেছি, মায়ের কাছ থেকে সার্বক্ষনিক বকা, মার, কটু কথা শুনেছি, নিজের অবস্থা দূর্বিসহ করেছি…তার কাছ থেকে এটা আশা আমি কোনোদিন করিনা। দুহাতের আঙ্গুলে চোখের কার্নিশ মুছে পূর্বের দিকে তাকিয়ে বলি,

– আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছো না? তোমার কথা বলাও লাগবেনা। আমি একবার মরে যাই তারপর একদম শান্তি করে দিবো।

পূর্ব চমকে গিয়ে আমার দিকে ভয়ংকর আশ্চর্যজনক চাহনিতে তাকালেন। ভ্রু কুচঁকে আমার দিকে কিছুকালব্যাপী স্থির থেকে ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি থামাতে! ড্রাইভার ভিড়মি খেয়ে হঠাৎ ব্রেক কষে দিলে আমি তাল হারিয়ে সামনে সিটের সাথে জোরে কপালে বারি খাই। পূর্ব ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বাজে একটা গালি দিয়ে একা ছাড়তে বললো। ড্রাইভার বের হতেই পূর্ব আমার কাছে এসে আমার কপালে ডলা হাত সরিয়ে দেখতে চাইলে আমি এক ঝটকায় সরিয়ে দেই।

– মার খেতে চাও তুমি? হাত সরাচ্ছো কোন্ সাহসে? দেখতে দাও পূর্ণতা! তুমি কি আমার হাতে কঠিন মার চাচ্ছো?

পূর্ণতা অশ্রুসিক্ত নয়নে লাগাতার পূর্বের হাত কপাল দেখা থেকে বাধা দিচ্ছে। এতে পূর্ব তিন ডাবল আরো ক্ষেপে যাচ্ছে! একটু আগে যে কথাটা বলেছে তার জন্য রাগে দাউদাউ করছে পূর্বের শরীর! মাথার রগ উত্তপ্ত হয়ে ফুলে উঠছে! অবস্থা আরো বেগতিক হলে পূর্ব পূর্ণতার গলা চেপে ধরার মতো রাগে কাঁপতে থাকে। পূর্ণতা দুঃখে, ভয়ে, কান্নায় থেমে থেমে শিউরে উঠে। ও পূর্বের এই রূপ কক্ষনো দেখতে চায় না, চায়না পূর্ব কখনো এভাবে রেগে ওর উপর হামলে পরুক! পূর্ণতা হু হু কান্নায় চোখ কুচকে বলে উঠে,

– তোমার এই রাগের জন্য রাজিবের সামনে সেদিন ‘চিনি না’ বলেছিলাম। তোমাকে আমি ওইসময় চিনতে পারিনা…তুমি আমাকে মেরে ফেলো! এখুনি মেরে ফেলো! গলা টিপে দম বন্ধ করে দাও। তুমি আমার জীবনে এসে দুঃখ ছাড়া কিছুই দাওনি বাকি জীবনও যে দুঃখবিহীন হবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। (একটু থেমে ঢোক গিলে) গলা ধরে আছো কেন? হাত চালাও। মেরে ফেলো।

পূর্ব চোখ বন্ধ করে পূর্ণতার গলা ধরে চুপ করে আছে। কৈলেশের কাছ থেকে চ্যাটার্জীর লোক পাঠানোর খবর শোনার পর আর থেকে স্বাভাবিক থাকতে পারছেনা পূর্ব। মনের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় চলছে, মাথা ভো ভো করছে, বিগত ক’দিনের নৃশংসতায় কিচ্ছু ভাবতে পারছেনা।পূর্ব জোরে নিশ্বাস ছেড়ে চোখ খুলে পূর্ণতাকে একটানে বুকে চেপে ধরে। চোখ বন্ধ করে গাড়ির সিলিংয়ে মাথা নিবদ্ধ করে নিচু কন্ঠে বলে,

– আমি থটলেস হয়ে আছি পূর্ণতা। আমার সামনে এসব কথা বলো না।

পূর্ণতা আছড়ে পরা কান্নায় আটকে যাওয়া গলায় একটু একটু করে বলে,
– তাহলে আমার সাথে এমন আচরন কেন?কি দোষ আমার?

পূর্ব সিলিং থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নুয়ে বুকে চেপে ধরা মানুষটার দিকে তাকায়। ভেতরে আকাশপাতাল ঘুরপ্যাঁচ চিন্তায় পূর্ণতার সাথে অযথা রাগ দেখাচ্ছে, চুপ করে আছে, অদ্ভুত আচরন করছে আরো কত কি। পূর্ব শক্ত করে পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে জোরালো ভাবে চেপে ধরলো। পূর্ণতার দম আটকে আসলো কিনা কে জানে? পূর্ব তোয়াক্কা না করে ধীরভাবে শান্ত গলায় বললো,

– পার্টির কাজে আমি একটু চিন্তিত পূর্ণ। দয়াকরে আর কখনো ওসব ছাইপাঁশ কথাবার্তা বলবেনা।

পূর্ণতা চুপ করে থাকে কিছু বলতে গিয়েও বলেনা। যে সাক্ষাৎ একজন রাজনীতির সাথে জড়িত তার মাথায় কেমন গোজামিল অবস্থা হতে পারে পূর্ণতা একটু ধারনা পেলো যেনো। পূর্বকে ছেড়ে চোখ মুছে পূর্বকে বলে উঠলো,
– ড্রাইভার চাচাকে আসতে বলো। আমার এখানে ভালো লাগছেনা। বাড়ি নিয়ে চলো।

পূর্ব জানালার কাঁচ নামিয়ে ড্রাইভারকে আসতে বললে সে দ্রুতবেগে ছুটে এসে গাড়িতে উঠে। পূর্ব পকেট থেকে রুমাল নায়ে পূর্ণতার চোখ মুছে দিচ্ছে। কাজল লেপ্টে চোখের নিচে নষ্ট হয়ে গেছে। ড্রাইভার আড়চোখে মিররে দেখলেও পূর্ব সেদিকে ধ্যান না দিয়ে পূর্ণতার চোখ ঠিক করে দিলো।

গাড়ি গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির ফটকের সামনে থামতেই দেখতে পেলো ছোটখাটো ভিড়। আম্মু, পূর্বিকা আপি, দাদী,দাদা সহ সবাই দাড়িয়ে আছে। ওদের গাড়িটা মাঝরাস্তায় থেমেছিলো বলে সবাই ওদের আগেই উপস্থিত। পূর্ব গাড়ি থেকে নেমে পূর্ণতার হাত ধরে সাবধানে নামালে পূর্বিকা এসে ভেতরে নিয়ে যায়।
পূর্ব নিজের রুমের দিকে যাত্রা ধরবে হঠাৎ দাদাভাই পেছন থেকে কাধ কাধ আটকে বলে উঠে,
– দাদুভাই এখনই রুমে যেতে নেই, আসো এখানে বসো।

দাদা ওকে বারান্দায় খাটানো চৌকির উপর বসতে বলছে। পূর্ব সবার আদেশ অমান্য করলেও দাদাভাইয়ের আদেশ অমান্য করার মতো স্পৃহা এখনো হয়নি। ফুয়াদ একটা কাঠের চেয়ার টেনে পূর্বের পাশে বসে, মিথুন বসে পূর্বের পাশে চৌকিতে, জাওয়াদ প্লাস্টিকের টুল টেনে দাদার কাছে বসে। দাদী সবার উদ্দেশ্যে মিষ্টি, সন্দেহ, পায়েস, রসমালাই, দই এনে বাটিতে সাজিয়ে ট্রেতে করে জগ ও জনপ্রতি পানির গ্লাস রেখে যায়। পূর্বের দাদা একটা মিষ্টি পুরো মুখে ঢুকিয়ে বললেন,

– দাদুভাই একটা কথা বলবে?
– জ্বী দাদাজান বলুন।
– তুমি জানো আমি একসময় সংসদ সদস্য ছিলাম। রাজনীতি করেছি, সংসার করেছি, ভবিষ্যত নিয়েও ভেবেছি। কিন্তু কাজের সাথে কখনো পরিবার মিলিয়ে চলিনি।

পূর্ব আচঁ করতে পেরেছে দাদাভাই ওকে কি বুঝাতে এই কথা তুলেছে। পূর্ব চুপ করে থাকলে কথার মাঝখানে হঠাৎ জাওয়াদ প্রশ্ন করে উঠে,
– দাদু, আমার এখন পলিটিক্সের প্যাঁচামুখো কথা শুনলে ভয় করে। এগুলো ভালো লাগেনা। অন্যকিছু বলেন না!! যেই হরতাল, অবরোধ, হাবিজাবি সংঘর্ষ এগুলো সহ্য হয়না।

পূর্বের দাদা স্মিত হেসে জাওয়াদের পিঠ চাপড়ে বলে উঠেন,
– নাম নিতেই ভয় পাও আর বাড়িতে আস্তো একটা আগুন পুষে রেখেছো।
– এ্যা…দাদু কি বললেন বুঝলাম না।

মূসা ওয়াসিফ পূর্বের তীক্ষ্ম দৃষ্টির দিকে চোখ রেখে বলে উঠলেন,
– বাড়িতে আগুন পুষলে আগে নিজের হাত পুড়া লাগে তারপর অন্যকে পুড়াতে হয়।

জাওয়াদ এ দফাও বুঝলো না দাদাভাই ওকে কি বোঝাতে চাচ্ছে। পূর্ব ঠিকই সব বুঝে ফেলেছে কিন্তু মুখের উপর ‘কিছুই বুঝেনি’ ভাব রাঙিয়ে বসে আছে। এবার ফুয়াদ বলে উঠলো,

– আপনি যে রাজনীতি করতেন তখনকার সাথে এখনকার সময় তুলনা চলে? আগে সুশৃঙ্খল ভাবে সুন্দর রাজনীতি চলতো কিন্তু এখন দেখেন? পুলিশের চেয়ে ছাত্ররাই দাপট দেখায়। আর মাথা নষ্ট হলে তো গাড়িতে পেট্রোল মারতেও সময় লাগেনা। আগে কি এগুলো ছিলো?
– অবশ্যই ছিলো। রাজনীতি মানেই রাজপথে নামা লাগবে। রাস্ট্রীয় রীতিনীতি নিয়ে দলীয় সরকার, অন্যান্য দল, ডানপন্থী – বামপন্থীর ঢল সবই থাকবে। কিন্তু মানুষের লোকসান করা কখনো রাজনীতির কাতারে পরে না। এখানে পুলিশের দোষ দিয়ে তো লাভ নেই। তাদের উপর আদেশই থাকে ছাত্রদের হানি করা যাবেনা।
– দাদু আপনি একটা কথা বলেন, ১৯৭১সালে যেই রাজনীতির প্রেক্ষাপট ছিলো ওগুলার সাথে এখনকার রাজনীতির কিছু মিলে? ছাত্রদের কথাই ধরেন, ওরা তো একাই একশো। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রদের কেমন ডেন্জারাস পাওয়ার ছিলো ভাবুন! গদি থেকে একটা সরকার নামিয়ে ফেলে খুব অদ্ভুত না? আর আজকের অবস্থা বিবেচনা করেন দাদু। এদিকে ধর্ষণের মতো হাজারটা কেস কোট-কাচারিতে স্তুপ হয়ে যাচ্ছে, সরকার কিছুই করতে পারছেনা। আবার ছাত্ররা রাস্তায় নেমে অরাজকতা সৃষ্টি করলে পুলিশ কিছুই করতে পারেনা। এসবের মানে কি দাদু?

অনেকক্ষন পর এবার পূর্ব গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,

– তুই দাদাজানের কাছে কোন আক্কেলে এমন বেকুবের মতো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিস সেটা বুঝা! উনি তোকে একটা বুঝায় তুই বুঝিস আরেকটা, আবার মুখেও বলছিস অন্য আরেকটা। শোন্ বেকুব, তৎকালীন সরকার নিয়ে মানুষের ক্ষোভের ব্যাপারটা বেশি ছিলো তাই রাস্তায় নেমে পুলিশ হটিয়ে সরকার সরাতে টাইম লাগেনি। বাঙালি জাতিকে ঘুমন্ত হিংসের সাথে তুলনা করা হয়। তুই একবার যদি ঘুম ভেঙ্গে ফেলিস তোর রক্ষে নেই! ১৯৬৯ সালে ঠিক এমনটাই ঘটেছে যার ফলাফল সামরিক সরকারের পতন। এবার এ যুগের ধারায় আসি, এ যুগে রাজনৈতিক আলাপন নিয়ে যে তুচ্ছ উদাহরণ দিলি আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছিলো। ধর্ষণের কেস সামনে আনলি এটা কোনো কথা হলো? এটা কিসের উদাহরন দিলি হারামজাদা? সরকারকে নিচু করলি নাকি বিরোধী দলের চামচামি করলি? নাকি বামপন্থীর মতো নখ দিয়ে কথা তুললি? কোনটা ভাববো? ছাত্রদের কথা যেহেতু তুললি একটা জিনিস বলি, ২০১৮ সালে ‘সড়ক দূর্ঘটনা’ নিয়ে যে তুমুল হুঙ্কার রাজপথে নেমেছিলো! শত শত তরুণ ছাত্রছাত্রীরা কি হাঙ্গামা করেছিলো ভুলে গেলি এতো তাড়াতাড়ি? কোনো মন্ত্রী- মিনিস্টার, ডিজি-আইজি ওরা মানেনি। গাড়িতে লাইসেন্স না পেলে রাস্তায় কিভাবে ইজ্জত খসিয়েছে সেটা সবাই জানে! মনে করিয়ে দেই, এক নামকরা নেতার গাড়িতে লাইসেন্স পায়নি বলে সামান্য একটা কলেজ স্টুডেন্ট তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে কঠিন কথা শোনায় এরপরও তুই বলবি এ যুগের ছাত্ররা কিছু পারেনা? আরে ছাত্ররা না থাকলে রাজনীতির ‘র’-ও টিকবেনা। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল সবার আগে তরুণ সমাজকে শলা-মসুরা দেয়। তাদের এগিয়ে আসতে বলে, তাদের দ্বারা দেশের মান গৌরব উজ্জ্বল করতে পরামর্শ দেয় সেখানে এসব কি ফাউ কথার উদাহরণ টানিস? কোনো দলকে হেঁট করবি যুক্তি দিয়ে কর! এসব ফাউল উক্তি দিয়ে যুক্তি টানার চেষ্টা করবি না।

পরিবেশ জমজমাট। বিয়ের আমোদ শেষ না হতেই রাজনৈতিক বিষয় দিয়ে যে দফা দফায় কথা উঠছে তা তর্কযুদ্ধের চেয়ে কম না। মূসা ওয়াসিফ নাতীদের নিয়ে একটু খোশগল্পে পূর্বের আলাপ করতো সেটা উল্টো ঘুরে তর্কের দিকে চলে গেলো। বলে রাখা ভালো, ফুয়াদ বর্তমান সরকারকে মোটেও পছন্দ করেনা। সবসময় খুঁত বের করার জন্য ওত পেতে থাকে। ফুয়াদের এই আচরনের জন্য পূর্ব প্রতিবার যুক্তি দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেয় তাতে খুব ক্ষুদ্ধ হয় ফুয়াদ।। মিথুন এবার নিজের পক্ষপাত পেশ করে বলে উঠলো,

– মানুষের জন্য যেখানে রাজনীতির সৃষ্টি সেখানে মানুষের অসুবিধা সৃষ্টি করে সরকার পায় কি? কোন জায়গায় লিখা আছে রাজনীতির জন্য মানুষ ক্ষতি করা যাবে? হরতাল, ধর্মঘট, মানববিক্ষোভ এসব করে কি পায়? উল্টো মানুষের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়। দেখো ভাই, আমরা জানি তুমি আগামীতে ইলেকশন লড়বা, তোমার পার্টির মান রক্ষা করবা। কিন্তু এর মানে তো এটা না তুমি মানুষের অধিকার নিয়ে চিন্তা করা ভুলে যাবে।

– তোর মার্কসবাদী চিন্তাধারা এখানে ভুলেও ফলাতে আসবিনা মিথুন। মুখে তালা লাগা।

পূর্ব সত্যি ক্ষেপে গেছে ওর চোখ মুখ লাল হতে শুরু করেছে। পূর্বের অবস্থা বুঝতেই মূসা ওয়াসিফ নাতিদের তুমুল আকারে ফেটে পরা তর্কবিদ্যায় ঘাটা বসিয়ে বলে উঠেন,

– দাদুভাইরা তোমরা এবার থামো। আজ তোমার ভাইয়ের বাসর ওকে আর জ্বালাতন করো না। দাদুভাই? তুমি ভেতরে আসো..চলো।

.

পূর্ণতা লম্বা ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকে জবুথবু হয়ে বিছানার মাঝখানে বসে আছে। বিশ মিনিট ধরে পূর্বের জন্য ব্যকুল হয়ে অপেক্ষা করছে। পূর্বিকা অনেক তোষামোদ করলেও পূর্ণতাকে নিজের রুমে রাখার প্ল্যান সফল হয়নি। শাশুড়ি আম্মা কঠিন একটা ধমক দিয়েছে পূর্বিকা আপু। ছোট ভাইয়ের বউকে নিজের কাছে রাখা নিয়ে বকা খেয়ে আপুর মুখটা পটকার মতো চুপসে গিয়েছিলো তখন। আমার খারাপ লাগছিলো প্রচুর আম্মা শুধুশুধুই আপুকে বকা দিলেন। হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে পায়ের আওয়াজ আসতে না আসতেই ধপ করে দরজা খুলে যায়। ঘোমটার আড়ালে স্পষ্ট দেখলাম পূর্ব রুমে এসে হাজির সে দরজার ছিটকিনিতে হাত দিতে গিয়েও হাত সরিয়ে ফেলছে।। দরজা লাগানো নিয়ে ও দ্বিধাগ্রস্ত কেন? দরজা না লাগিয়েই পূর্ব আমার দিকে ধীরেসুস্থে আসতে লাগলো। আমি চোখ নামিয়ে ফেলি তৎক্ষণাৎ প্রচুরপরিমাণে নার্ভাস লাগছে আমার। এই প্রথম এতোটা অস্বস্তিকর লাগছে পূর্বের আগমন দেখে। সবসময় ওকে কাছে পেয়ে আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতাম আজ সবকিছু উল্টাফুল্টা হয়ে যাচ্ছে নিজের কাছে। পূর্ব বিছানার কাছে দাড়িয়ে আমার দিকে নিজের দুহাত বারিয়ে বললেন,

– বিছানা থেকে একটু নামবে পূর্ণ?

আমি ঘোমটা দেওয়া মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখি পূর্ব আমার হাত ধরার জন্য নিজের হাত এগিয়ে অপেক্ষা করছে। আমি হাটু থেকে হাতযুগল সরিয়ে তার দুহাতে আমার হাতদুটো দিতেই পূর্ব আমাকে বিছানা থেকে নামাতে সাহায্য করলেন। পূর্বের মাথায় কি চলছে? হঠাৎ আমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলো কেন? দরজাটাও লাগায়নি? আমার মাথায় প্রচুর প্রশ্নমালা ঘুরপাক খেতেই পূর্ব আমার ঘোমটা উঠিয়ে গালে দুহাত রেখে বলে উঠলো,

– তুমি আপুর রুমে চলে যাও পূর্ণ, আমার কাছে পরে থেকো।

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_২৭
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

আমি পূর্বের কথা শুনে হতভম্ব! সে আমাক বাসরঘর থেকে পাঠাতে চাচ্ছে কেন? মনে কি ক্ষোভ লুকিয়ে আছে নাকি অন্যকিছু চেপে রেখেছে? কিচ্ছু পরিস্কার হচ্ছেনা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমি গাল থেকে ওর হাত সরিয়ে বললাম,

– কি সমস্যা? তুমি আমার সাথে এখনো রাগারাগী করছো? সরি বললামতো। মাফ করে দেও। আমি অন্য কোথাও যেতে চাইনা পূর্ব।

পূর্ব আমার দিকে ওর ঠোঁটটা ভিজিয়ে হালকা শ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

– একটা সমস্যা হয়েছে বটে। আপাতত তুমি পূর্বিকা আপির কাছে যাও। আমি কাজটা শেষ করে আসছি। টেনশন করো না।

পূর্ব আমাকে বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত দরজার দিকে চলে গেলে আমি পেছন থেকে সচকিত গলায় বলে উঠি,
– কোথায় যাচ্ছো? যেও না! আজকেও যাওয়া লাগবে?

হঠাৎ পা থামিয়ে স্ট্রেটভাবে দাড়িয়ে কিছু সেকেন্ড পর মুখটা ডান কাধ বরাবর করে ঘুরিয়ে জবাব দিলো,

– আমি বাড়ির আশেপাশেই আছি। চিন্তা করতে না করেছি আমি পূর্ণ। চুপচাপ যা বলেছি করো।

কন্ঠে জোরালোপূর্ণ তেজ ছিলো ওর! আমি শুনেই চমকে উঠে ভ্রু কুঁচকে থতমত হয়ে যাই। পূর্ব একমিনিটও দাড়ালো না অতিদ্রুত চলে গেলো যেন বাইরে ওর জন্য কেউ তীব্ররূপে অপেক্ষা করছিলো! ঘড়িতে তখন ন’টা বাজে আমার কি এখন পূর্বিকা আপুর রুমে যাওয়া ঠিক হবে? সবাই তো ঘুমিয়ে পরেছে। বুকে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে, শিরায়-শিরায় অস্বাভাবিক হারে রক্ত ছুটে চলছে, গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে পশমস্তর! নাহ্… আমার মন কোনোভাবে মানছে না, ও নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু লুকোচ্ছে! ঘড়ির দিকে আবার তাকালাম এখন ঘড়িতে পনে দশটা। কি আশ্চর্য! একটু আগে দেখলাম নয়টা বাজে আর এখন পনে দশটা? এতো তাড়াতাড়ি সময় চলে যাচ্ছে? এখন ব্যাপক অস্থিরতা কাজ করছে আমার ভেতর , রুমের উত্তর টু দক্ষিন দিকে পায়চারী করতেই প্রবল উত্তেজনায় শাড়ি ধরে শেষমেশ বাইরে বেরিয়ে যেয়ে পূর্বের সেই ‘জরুরী’ খ্যাতনামা কাজটা দেখার সিদ্ধান্ত নেই। বাইরে পা দিয়ে দেখি একসারিতে সব রুমের দরজা আটকানো, লম্বা বারান্দায় একটা কাক-পক্ষিও নেই শুধু বারান্দায় একটা হলুদ বাতি জ্বালানো। গ্রামীন আবহাওয়া তার উপর রাত পনে দশটা মানে এখন গভীর রাত। বাইরে ঝিঁঝিপোকার শব্দতরঙ্গ ভেসে আসছে। ঠান্ডা হাওয়ায় দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কুনো ব্যাঙের ডাক। ছোট্ট উঠোনের পুরোটাই ঘুটঘুটে অন্ধকার নিস্তব্ধ পরিবেশ এককথায় ভূতুড়ে অবস্থা। বারান্দার কাছে রেলিংয়ে নিচে তাকালাম কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। পূর্বের রুমটা কোণার দিকে শেষ মাথায় লম্বা বারান্দা পেরিয়ে আসতে হয় তারপর সিড়ি ধরে নিচে যাওয়ার পথ। আমি সাবধানে দুহাতে শাড়ি উঁচু করে লম্বা বারান্দা পেরিয়ে পরপর পূর্বিকা আপু, ফুয়াদ, মিথুনসহ সবার রুম অতিক্রম করে সিড়ি ধরে নিচে নামি। চোরের মতো লাগছে নিজেকে, শ্বশুরবাড়িতে বর খুঁজতে কত কি না করতে হচ্ছে। নিচতলার এসে দেখি মূল দরজা খোলা, পূর্ব যে বেরিয়েছে সেটা আমি ছাড়া কেউই জানেনা। আবারো শাড়ি উঁচু করে আমি দরজা ফাঁক করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলাম। পায়ে জুতো নেই ঠান্ডা মাটির কারনে শরীরে অদ্ভুত দোল ঠেকছে আমি অন্ধকারে চোখ সয়ে হাঁটছি। হঠাৎ গেটের কাছে সাদা শেরওয়ানি গায়ে পূর্বকে দেখতে পেলে আমি ‘পূর্ব’ বলে ডাক দিবো ওমনেই বুকটা ধ্বক করে গলা আটকে গেল। কিছুক্ষণের জন্য মনেহলো আমি বুঝি আমিতে নেই! পূর্ব চোখের সামনে একটা লোকের মুখ চেপে বুকে ছুড়ি ঢুকিয়ে মোচড় দিচ্ছে! লোকটা বাঁচার জন্য লাফালাফি করছে, পা মাটিতে ঠুকছে, মুখ দিয়ে অনবরত আত্মহুতিতে গোজাচ্ছে! পূর্ব চোখের পলকেই ছুড়িটা টেনে ছ্যাত করে লোকটার বাঁ পাশটা চিড়ে দিলো। ওই অবস্থা দেখে আমার হাত-পাসহ পুরো শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে অসাড় হয়ে আসছে। বুকে একটনের ভারী পাথর পরলে যেমন নিশ্বাস আটকে যায় আমার দম তখন স্থির হয়ে যাচ্ছিলো। পূর্ব লোকটাকে টেনে জঙ্গলের ওদিকে নিয়ে যেতেই আমার মুখ থেকে অস্পষ্ট গলায় শব্দ বেরিয়ে যায়। পূর্ব আমার দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড অবাক হয়ে লোকটাকে ছেড়ে দিয়েও আবার চট করে হুড়মুড় করে ধরে ফেলে। তাড়াহুড়ো করে জঙ্গলে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে এসে আমার সামনে দাড়ায়। হাতদুটো তাজা রক্তে টলটল করছে।

– পূর্ণ তুমি বাইরে বেরিয়েছো কেনো? কেনো বাইরে বেরিয়েছো?

আমি ভয়ে থরথর কাঁপছি একটু পরপর শরীর কেমন ঠান্ডার শিহরনে ঝিমুনি দিয়ে উঠছে! প্রচন্ড বিহ্বল লাগছে, গলা শুকিয়ে আসছে, হঠাৎই শরীরে প্রবল দূর্বলতা অনুভব হচ্ছে। পূর্ব আমার থতমত নির্বাক চাহনি দেখে সবটা টের পেয়ে খানিকক্ষন বাদে গম্ভীর সুরে বলে উঠে,

– ভেতরে চলো। বাইরে থাকা ঠিক না।

বাইরে ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে। আকাশের মতিগতি দেখলে বোঝা যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারী বর্ষনের আবেশে পুরো গ্রাম ভিজবে। এখন রীতিমতো মেঘ ডাকতে শুধু করেছে। পূর্ণতা থ হয়ে খাম্বার মতো স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকলে পূর্ব ততক্ষণে বাড়ির পাশে নলকূপের হাতল চেপে হাতদুটো ধুয়ে আসে। ফিরে এসে দেখে পূর্ণতা অনবরত কাঁপছে ওর চোখের কোটরে বড় বড় অশ্রুজল জমা হয়েছে। পূর্ব একটা মানুষকে বীভৎস ভাবে খুন করলো এখনো মেনে নিতে পারছেনা পূর্ণতা। বুকে ছুড়ি ঢুকিয়ে কমপক্ষে পাচঁবার মোচড় মেরেছে। লোকটার মুখ চেপে না ধরলে পুরো গ্রাম শুদ্ধো শুনতে পারতো লোকটার গগনবিদারী চিৎকার। পূর্ব ভেজা হাতে পূর্ণতার চোখ মুছিয়ে দিলে পূর্ব হঠাৎ বুকে সজোরে ধাক্কা অনুভব করে পিছিয়ে যায়। দূরে ছিটকে বুকে হাত রেখে ভ্রু কুচকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায়…পূর্ণতার শরীর ভয়ংকর ভাবে কাঁপছে, চোখ ধেয়ে একের পর এক অশ্রুপাত হচ্ছে। পূর্বকে আশ্চর্যের স্তম্ভে নিক্ষেপ করে পূর্ণতা হঠাৎ চিৎকার চেচামেচি শুরু করে। পূর্ব দৌড়ে পূর্ণতার মুখ চেপে ধরে পূর্ণতা মুখ থেকে পূর্বের চেপে ধরা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে…চেষ্টা বিফল হয়! পূর্বের শক্তির কাছে ওই লোকটা পেরে উঠলে পারলো না পূর্ণতা কিভাবে পারবে? পূর্ণতা দাপাদাপী করতে লাগলো, পূর্বের হাতে অনবরত নখ বসিয়ে চিড়ে দিলো, পূর্ব ভুলেও ওকে ছাড়লো না। পূর্বের সন্ধানী চোখ এখন বাবার গাড়ির দিকে, এই গাড়ি দিয়ে বরযাত্রী হিসেবে বউ বাড়িতে এনেছে আর মজার ব্যাপার হলো গাড়ির চাবিটা এখন তার পকেটে। পূর্ণতাকে এই অবস্থায় বাড়ি ঢুকানো মানে বিরাট কাহিনী হবে যা পূর্ব মূলত চায় না। পূর্ব একহাতে পূর্ণতার মুখ চেপে অপর হাতে পকেট থেকে রিমোট বের করে কিছু একটা করতেই গেটের কাছ থেকে ‘টুট টুট’ শব্দ বেজে ফ্রন্ট লাইট জ্বলে উঠলো। পূর্ণতা স্পষ্ট দেখতে পেলো পূর্ব ওকে গাড়িতে তোলার জন্য সব প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে তাই আরো তিনগুণ স্পিডে দাপাদাপী শুরু করেছে। পূর্ব রিমোট পকেটে পুরে অপর পকেট থেকে রুমাল নিয়ে পূর্ণতার মুখ বেধে দিলো। পূর্ণতা কান্নায় চোখমুখ ইতিমধ্যে একাকার করে ফেলেছে, মুখ বাধতে গিয়েও পূর্বের প্রচুর ধকল পোহাতে হলো পূর্ণতা কিছু জায়গায় নখ ঢুকিয়ে ক্ষত করে দিয়েছে। পূর্ণতাকে টানতে টানতে গাড়িতে তুলে নিজেও গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ছেড়ে দিলো পূর্ব।

দূর থেকে গাড়ি আনলকের আওয়াজ পেয়ে ঘুমুঘুমু চোখে দরজা খুললো পূর্বের বাবা। গাড়ি চলে যেতেই জানালা দিয়ে ছেলেকে দেখতে পেয়ে কিছু একটা বুঝে মুচকি হাসলো। মনেমনে বললো, ওরে ব্যাটা, তোর বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় বাসর করার শখ ছিলো সেটা আমাকে বললেই পারতি। কুলাঙ্গার কোথাকার।

পূর্ণতা রুমাল খুলে কান্না গলিত সুরে চিৎকার করছে! ঘোমটা আলগা হয়ে খুলে গেছে, মাথার কয়েক জায়গা থেকে পার্ল ক্লিপ ঝুলছে, চোখের কাজল লেপ্টে চোখের নিচটা কালো আকার ধারন করেছে। এখনো পূর্বের উপর হামলা করা ভুলেনি বারবার চিৎকার দিয়ে বলছে, ‘তুমি একটা খুনি! তুমি মানুষ খুন করো! তুমি খারাপ!জঘন্য!নির্লজ্জ!তুমি…! তুমি…’ বলতে বলতেই কেদেঁ দেয় পূর্ণতা। পূর্ব এমন ভঙ্গিতে গাড়ি চালাচ্ছে যেনো কিছুই হয়নি ইভেন পূর্ণতার কথাও সে কানে শুনতে পাচ্ছেনা একদম কাম এন্ড কুল হয়ে চুপ করে আছে। পূর্ণতার চিৎকার যেন বাইরে না যেতে পারে তাই জানালা আটকে গাড়ির ভেতর অন্ধকার করে দিয়েছে। বাইরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে এখন। পূর্বের খামোস অবস্থা দেখে পূর্ণতার ঘা ঘিনঘিন করে উঠছে! সে একটা পৈশাচিক খুনির পাশে বসে আছে ছিঃ! পূর্ণতা রাগের মাথায় খুবই অপ্রীতিকর কান্ড ঘটিয়ে ফেললো নিজের মাথা জানালার কাঁচে ধুম করে বারি দিলো! পূর্ব ঘটনাক্রমে অপ্রস্তুত হয়ে হুড়মুড়িয়ে ব্রেক কষে দেখে, পূর্ণতা এখনো জানালায় কপাল ঠেকিয়ে আছে। পূর্ব আকস্মিক ভয়ে চেচিয়ে উঠে,

– এ কি করলে তুমি পূর্ণ!

পূর্ব তাড়াতাড়ি নিজের সিটবেল্ট খুলে পূর্ণতার দিকে ঝুঁকে ওর কাধ ধরে টান দিতেই দেখে জানালার কাঁচ কয়েক রেখায় ফেটে সেখানে রক্ত লেগে আছে। পূর্ব রিমোট চেপে জানালার কাচঁ নামিয়ে পূর্ণতার দিকে তাকায়। পূর্ণতা চোখ মেলে ঠিক করে তাকাতে পারছেনা। ওর কপালের ডানপাশটায় ফেনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। পূর্ব স্তব্ধ দৃষ্টিতে ঠোঁট কাপাচ্ছে। ওর হাতের বাহুডোরে ঢলে পরেছে পূর্ণতা। পূর্ব খুব অসহনীয় ভাবে ঢোক গিলে পূর্ণতার কপালে এসে পরা চুলগুলো সরিয়ে বলে,

– তুমি এমন করলে কেন? আমার মাথা ফাটিতে দিতে। পূর্ণতা চোখ খুলো। ঠিক করে চোখ খুলো। পূর্ণতা?

পূর্ণতার গাল আলতো করে ঝাক্কাতে লাগলো পূর্ব। পূর্ণতা গভীর আবেশ চোখের পলক নামিয়ে ফেলছে কিন্তু চোখ খুলছে খুবই ধীরেধীরে মৃত্যুশয্যা রোগীর মতো। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে দুজনকে। ছাটের পানিতে পূর্ণতার কপালের রক্ত আরো তরলীভূত হয়ে ডানপাশে কানের কাছ ঘেঁষে টপ টপ করে সিটে পরছে। পূর্ব পূর্ণতার দিকে চোখ রেখে জানালার বাইরে হাত এগিয়ে পানি মুঠো করে ছিটিয়ে দেয় ওর মুখে। পূর্ণতা চোখ কুচঁকে কয়েকবার চোখ ঝাপটানি দিয়ে ঠিক করে তাকায়। পূর্বকে এতো কাছে দেখে পূর্ণতা ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দেয়। পূর্ব গাড়ির সিলিংয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে ঘাড়ে ব্যথা পেয়ে নিজের জায়গায় বসে পরে। পূর্ণতা জানালার দিকে মুখ করে কপালে টনটন করা ব্যথাটা আলতো আলতো করে স্পর্শ করে। পেছন থেকে নিচু গলায় শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে,

– কিছু হলে মাথা বারি দেও কেন? তোমার মাথা কি ফুটবল? কি হতো যদি কাচঁ ভেঙ্গে ঢুকে যেতো?

পূর্বকে চরম অবাক করে দিয়ে পূর্ণতা বলে উঠলো,
– মরে যেতাম। অন্তত তোমার মতো ভয়ঙ্কর খুনির কাছ থেকে বেঁচে যেতাম।

পূর্ণতার কথা শুনে প্রচুর রাগ উঠলো! পূর্ব কি ওকে কোনো ক্ষতি করেছে? উল্টো ওর সেফটির জন্য তাড়াতাড়ি লোকটাকে মেরে ফেলেছে। কৈলেশ রাস্তায়, আসতে দেরি হবে বলে পূর্ব আর রিস্ক নেওয়া উচিত মনে করেনি লোকটাকে মেরে ফেলেছে। পূর্ব রাগী গলায় ফোঁস ফোঁস করে বললো,

– আমি কি তোমাকে খুন করেছি? নিজে নিজে আমাকে ভয়ঙ্কর বানাও কেন? থাপড়িয়ে চাপার দাঁত খুলে ফেলবো বাজে কথা বললে!

– আমাকে মেরে ফেলো দয়াকরে। খুনির ট্যাগ নিয়ে তুমি বেঁচে থাকলেও আমার দ্বারা বউয়ের ট্যাগ নিয়ে শ্বাস নেওয়াও পসিবল না। আমি হাতজোর করে অনুরোধ করছি, আসো মেরে ফেলো।।

পূর্ব ধাম করে গাড়ির ড্রাইভিং হুইলে ঘুষি মারলো। পূর্ণতা চমকালো না স্থির হয়ে পূর্বের দিকে তাকিয়ে বললো,

– ঘুষির শক্তিটা ওখানে খরচ না করে আমাকে মেরে ফেলার জন্য করো। না থাকবো আমি, না হবে তোমার কষ্ট। তুমি চুটিয়ে মানুষ মেরে পলিটিক্স করতে পারবে।

পূর্ব রাগে কাঁপছে। আরো রাগুক! রেগে এমন পর্যায়ে চলে যাক যেন মাথা খারাপ হয়ে পূর্ণতাকে মেরে ফেলুক। পূর্ণতা ভেবেছিলো পূর্ব অন্য দশটা লোকের মতো রাজনীতির উদ্দেশ্যে মানুষ মারেনা, সে সৎরূপেই চলছে কিন্তু না! পূর্বও অন্য সবার মতো মুরগির মতো মানুষ জবাই করতে পিছপা হয়না, আত্মা কাঁপে না, জড়তা কাজ করেনা। পূর্ণতা আবার বলে উঠলো,

– আমি যদি জানতাম তুমি একটা খুনি আমি মরলেও তোমার কাছে ভিড়তাম না পূর্ব! সেদিন তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি মানুষ খুন করো? তুমি যে কৌশলে কথা ঘুরিয়ে দিয়েছো তখন সত্যি আমি বুঝতে পারিনি। পূর্ব, আমি তো বাঁচতে পারবো না বিশ্বাস করো। তোমার মতো অতো দুঃসাহস আমার ভেতরে নেই। আমার গলাটা কয়েক মিনিট টিপে ধরলেই আমি দম ছেড়ে দিবো তোমার ওই লোকটার মতো ছুড়ি ঢুকিয়ে কষ্ট করতে হবেনা। আমায় মেরে দিয়ে বাড়ি চলে যাও।

পূর্ণতার কথায় চক্রবৃদ্ধি হারে আরো কঠিনভাবে কাঁপছে পূর্ব। কাঁপা কাঁপা হাতে শেরওয়ানির হাতাদুটো ফোল্ড করতেই পূর্ণতা বুঝে যায় পূর্ব এবার রাগের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে। পূর্ণতা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে আচঁল খামচে পূর্বের হাতের নিজের অন্তিম দেখার জন্য মন শক্ত করে। চূড়ান্ত রাগ উঠলে কোনো মানুষের স্থিতিজ্ঞান থাকেনা, ছেলেদের আরো আগে না। পূর্ব হঠাৎ পূর্ণতাকে এমন ধাক্কা দেয় পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে শেষ শব্দ জপতে থাকে। কয়েক সেকেন্ড পেরুলে মনে হয় ওর মুখের উপর ঝর্ণার মতো পানি পরছে, ঠিক করে চোখ খুলে তাকাতেও পারছেনা। ঘাড়ের নিচে লম্বা মতোন কিছু ঠেকছে যা ঘাড়ে তীব্র ব্যথা দিচ্ছে। পূর্ণতা চোখ আধ খুলে তাকিয়ে দেখে জানালার বাইরে ওর মুখ বেরিয়ে আছে, ঘাড়ের নিচে জানালার কাঁচ, মাথার কাছে চুল মোচড়ে ধরেছে, মুখের উপর গম্ভীর পূর্ব। তার মানে পূর্ব ওকে ধাক্কা দিয়ে জানালার বাইরে মুখ নিয়ে চেপে ধরেছে। গলা কি আলাদা করে দিবে ? নাকি গলা টিপে ধরবে? পূর্ণতার সব অদ্ভূত চিন্তার মধ্যে পূর্ব বৃষ্টির মধ্যে পূর্ণতার কানের কাছে চুলে হা ডুবিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে। পূর্ণতা আশ্চর্যের সপ্ত আকাশে! চোখের অক্ষিগোলক বড় করে আরো দুদফা অবাক হয়ে গেলো। পূর্ব ওকে মেরে ফেলছে না কেন? চুমু দিচ্ছে? কি আশ্চর্য! পূর্বের বীভৎস রাগ কোথায় গেলো? বৃষ্টির প্রবলতার জন্য চোখ পুরোপুরি মেলে রাখাও যাচ্ছেনা! পূর্বকে সরানো যাচ্ছেনা! নিজে থেকে উঠাও যাচ্ছেনা! পূর্ব কঠিনভাবে জানালার বাইরে চেপে ধরেছে পূর্ণতাকে। পূর্বের চুল ভিজে কপালের উপর আছড়ে আছে, সেই চুল থেকে টুপ টুপ করে বৃষ্টির পানি পূর্ণতার মুখের উপর পরছে। গায়ের নিচে চাপা পরা হাতটা পূর্ণতা খুব টেনেটুনে বের করে পূর্বের কানের কাছে রাখে। পূর্ব এখনো আবেশে চোখ বন্ধ করে থাকলেও রাগে অন্যত্র অত্যাচার চালাচ্ছে। পূর্ণতা কানের পাশ থেকে হাত এনে পূর্বের কপালের চুল পেছনে সরিয়ে দিতেই দেখে পূর্বের নাক লাল হয়ে আছে। গাড়ির ফ্রন্ট লাইটে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে পূর্বের নাক লাল হয়ে আছে। পূর্বের রাগ উঠলে তো নাক লাল হয়না। তাহলে এখন কিসের জন্য লাল হলো? পূর্ব কি কাঁদছে? বৃষ্টির পানির সাথে চোখের পানি মিলেমিশে আছে বিধায় পূর্বের চোখ নির্গত পানি আলাদা করা যাচ্ছেনা? অত্যাচার নমুনা আরো বেড়ে যাচ্ছে। পূর্ব নিজেকে কঠোরভাবে চোখ বন্ধ করে প্রকাশ করছে। পূর্ণতা নিরুপায় ভঙ্গিতে দুহাতে ওর বুকে ধাক্কা দিয়েও সরাতে পারলো না। ঝমঝম বৃষ্টির প্রাকৃতিক পরিবেশে নিস্তব্ধ গ্রামীণ রাস্তায় মানুষশূণ্য অবস্থায় পূর্বের বদ্ধ চোখ দুটি ছাড়া কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। বৃষ্টির পানি পেয়ে চোখের পাপড়ি আরো ঘণ হয়ে আছে। কি অদ্ভুত মায়া জড়িয়ে আছে এই চোখে! এই স্নিগ্ধ চোখের দৃষ্টি একেকটা প্রাণঘাতী ছুড়ির মতো হৃদ গহ্বরে বিধে। আজও এই বদ্ধ চোখের মায়া প্রাণনাশক হয়ে উঠছে। পূর্ণতা কপাল থেকে হাত নামিয়ে চোখের পাপড়ি আঙ্গুলের আলতো বুলোয়। পূর্ণতার ঠান্ডা হাতের স্পর্শ চোখের পেয়ে পূর্ব ঝট করে পূর্ণতাকে ছেড়ে ড্রাইভিং সিটে হেলান দিয়ে জোরে শ্বাস ছাড়ে। পূর্ণতা ঘাড়ে হাত ডলতে ডলতে জানালার বাইরে থেকে মাথা উঠিয়ে পূর্বের দিকে তাকায়। ঘুমন্তপরীর রাজ্যের মতো নিরবতা ঘিরে ধরেছে। পূর্ণতা কথা বলতেও আড়ষ্ট অনুভব করছে। পূর্ব সিটে পিঠ লাগিয়ে বুকের কাছে শেরওয়ানির দুটো বোতাম খুলে চোখ বন্ধ করে আছে। কিছুকালব্যাপী চুপ থেকে বদ্ধ চোখে বলে উঠে,

– আবার যদি বলে মরে যেতে চাও, আমি তোমাকে সত্যি সত্যি মেরে ফেলবো।

পূর্ণতা ডোন্ট কেয়ার মুডে গড়গড় করে বলে উঠে,
– আমি মরে গিয়ে তোমার কাছ থেকে নিস্তার পেতে চাই।

এবার পূর্ব চট করে চোখ খুলে বাম ভ্রুটা উচুঁতে তুলে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাতেই পূর্ণতাকে একটানে নিজের কোলে বসিয়ে ধাক্কা মেরে ড্রাইভিং হুইলের সাথে চেপে ধরে। পূর্ণতা চোখ কুঁচকে থেমে থেমে বলে উঠে,

– পিঠে…ব্যথা…পাচ্ছি
– ক্ষতবীক্ষত হয়ে যাক!
– তুমি আমাকে মারতে চাইলে একেবারে মেরে ফেলো। তিলতিল করে যন্ত্রণা দিচ্ছো কেন?
– তিলতিল করে কারা মারে বলো তো শুনি?

পূর্ণতা কুঁচকানো চোখ খুলে বলে,
– সিরিয়াস কিলার,
– আমি অবশ্যই সিরিয়াস কিলার না। আমি একজন পলিটিক্সের ছেলে। দাপট নিয়ে পলিটিক্স করি। এর বেশি আর একটা শব্দ না!
– তুমি ওই লোকটাকে মেরে ফেলেছো! খুন করে…

পূর্ণতাকে বলতে না দিয়ে মুখের কথা ছিনিয়ে পূর্ব তীক্ষ্ম সুরে বলে উঠে,

– গলায় কাটা আটকালে কি করো? গলায় বিদ্ধ রাখো? নিশ্চয়ই না। দ্রুত কাটা নামিয়ে ফেলো। জাস্ট এটাই ভাবো, আমিও কাটা নামিয়েছি।
– তুমি ওকে মেরেছো!
– আমি যে তোমাকে মারবো এ কথা কোন আক্কেলে ভাবো? আমি যা করার ওই বদমাইশের বাচ্চাকে করেছি! তোমাকে তো কিছু করিনি!

পূর্ণতা চুপ করে থাকলে পূর্ব আবার বলে উঠে,
– বলো? আমি তোমাকে কেন মারতে যাবো? তুমি আমার কি হও তা কি জানো না?

এ দফায়ও চুপ পূর্ণতা। চুপটি দেখে পূর্ব জোরে ঠেসে বলে উঠে,

– পূর্ণ প্লিজ স্পিক আপ! তুমি আমার ওয়াইফ! আমার সবকিছুই এখন তোমার। তোমার অধীনে। তবুও তুমি আমার কাছ থেকে দূরে যেতে চাচ্ছো? হোয়াই?

পূর্ণতার পিঠে ড্রাইভিং হুইলের দাগ বসে যাচ্ছে। পূর্ব এখনো ওকে ছাড়ছেনা। ভীষণ ব্যথা হচ্ছে পিঠের হাড্ডিতে। হঠাৎ পূর্ব পূর্ণতার দুবাহুর মাঝ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে পিঠের নিচে হাত রেখে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে। পূর্ণতার গলার নিচে মুখ ডুবিয়ে দেয়। পূর্বের ভেজা চুল পূর্ণতা গলার নিচে ঘষা লেগে ঠান্ডা পরশের শিরশির অনুভূতি দিচ্ছে।। পূর্ব চোখ বন্ধ করে শীতল কন্ঠে বলে উঠে,

– আমাকে ছেড়ে যেও না পূর্ণ। তুমি আমার কাছ থেকে নিস্তার পেতে চাইছো, আমিতো কখনো তা চাই না।

পূর্ণতা নির্বাক হয়ে যায় পূর্বের সম্মোহন কথায়। ইচ্ছে করছে পূর্বের কপালটা ধরে ছুঁয়ে দিতে। অন্যের রাগ, অভিমান, দুঃখগুলোকে ভষ্ম করার অদম্য ক্ষমতা আছে ছেলেদের। তাইতো একটু আগের অভিমানগুলো জলের মতো তরল হয়ে গেছে পূর্ণতার। পূর্ণতা মাথা নিচু করে পূর্বের মুখ দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু ভেজা চুল ছাড়া কিচ্ছু পরিদৃষ্ট হচ্ছেনা। পিঠে এখন ব্যথা লাগছেনা, পূর্ব ড্রাইভিং হুইলের উপর নিজের হাতযুগল রেখে তাতে পূর্ণতার পিঠ ঢেকে জাপটে ধরেছে যেনো ব্যথা লাগলে নিজের হাতে লাগুক তবুও পূর্ণতার পিঠে না। পূর্ণতা পূর্বের পাশে থাকা বদ্ধ জানালায় চোখ দিয়ে বৃষ্টি দেখতে মনোযোগী হলো। বৃষ্টির ছন্দময় শব্দের সাথে পূর্ব বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

– তুমি সেই অনুভূতি যার অনুভবে শুধু আমি আছি, তুমি সেই স্বপ্ন যাকে দেখার জন্য দিনরাত ঘুমন্ত থাকি। তোমার হাতে হাত রেখে হাটঁতে চাই বহুদূর, তোমার কাছে সপে দিতে চাই নিজেকে। তোমার জন্য মাতাল হতে রাজি আমি কিন্তু ভয়াবহ বিচ্ছেদ আমি কখনো চাইনি।

পূর্ণতা কাধে ভেজা সিক্ততা অনুভব করছে। গাড়ির ভেতরে তো বৃষ্টির পানি পরছেনা তাহলে কাধে ভেজা লাগছে কেন? পূর্ণতা ছেড়ে যাওয়ার কথা যতবার বলেছে ততবারই পূর্ব….না, হতেই পারেনা! পূর্ণতা হকচকিয়ে তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে পূর্বের গাল ধরে মুখ তুলে। মাথার সামনে গাড়ির ফ্রন্ট লাইটের তীর্যক আলোকরশ্মি পূর্বের মুখে পরলে পরিস্কার বোঝা যায় চোখের পাপড়ি ঝিকমিক করছে। তার মানে চোখ ভিজা! পূর্ণতা অস্থিরচিত্তের মতো ছটফট ভঙ্গিতে আলতো করে পূর্বের চোখে অসংখ্যবার ঠোঁট ছুয়িঁয়ে দেয়। পরক্ষনে ক্ষান্ত হয়ে বলে উঠে,

– আমি তোমায় মারবো! তোমার এই প্রাণঘাতী চোখ দিয়ে ভুলেও পানি বের করবেনা। ভুলেও না।

পূর্ব চোখ তুলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বলে,

– হু,

– ‘ চলবে ‘