তোকে ঘিরে পর্ব-৩৪+৩৫

0
1158

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৩৪
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁

– তুতুতুমি কিকি কররেছো? তুতুমি আমামাকে কোকোথা…

পূর্ণতার তোতলামিপূর্ণ কথায় খুব বিরক্ত হলো পূর্ব। ওকে উদ্দেশ্য করে হাতদুটো ভাঁজ করে বললো,

– তোমাকে দেওয়ানগন্জের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় এনেছি, দি গ্রেট প্লেস ‘লাওচাপড়া’! লুক এরাউন্ড পূর্ণ, সি দ্যা নেচার!
কথাটুকু বলতেই পূর্ব কালো প্যান্টের পকেটে দারুন স্মার্টনেসে হাতদুটো গুঁজে দাড়ালো। চোখে একরাশ মুগ্ধতা ছেয়ে আছে চমৎকার। পূর্ণতার চারপাশে তাকাতেই অবাকের সীমান্ত পেরিয়ে এবার পূর্বের দিকে মোহপূর্ণ চাহনিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। সাদা-কালোর অদ্ভুত কম্বিনেশনে দাড়িয়ে আছে ওয়াসিফ পূর্ব। কালো প্যান্টের দুপাশে লম্বা হোয়াইট লেগস্ট্রিপ, বাম পায়ের হাটুর উপরে ইয়েলো লোগো চিহ্ন। একটা হোয়াইট ফুলহাতা শার্ট পরিধানে যার কলারটা একদম কালো, সাদা হাতা দুটো উল্টে করে গুটানো। গুটানো অংশগুলোতে কালো রঙ ফুটে উঠেছে। চুল জেল দিয়ে শার্পলি ব্রাশ করা, গালের দাড়িগুলো সূক্ষ্ম শেপে কাটা। ভয়ংকর লুক তো! এই বেশভূষায় পূর্ব এলো কেন? মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে যে! কি সাংঘাতিক বাবা! শার্ট, টিশার্ট, পান্জাবী, শেরওয়ানি সব গেটআপ ছাপিয়ে এই ট্যূর পোশাকে তো আগের সব লুককে মাটিতে মিলিয়ে দিয়েছে! পূর্ণতা স্থির দৃষ্টিতে কয়েকবার ঢোক গিললো। পূর্ব এভাবে একের পর এক ডেন্জারাস লুক দেখিয়ে শুধু পূর্ণতাকে না আশপাশে যদি কোনো রমনী, মানবী, ললনা থাকে তারা তো দৃষ্টি দিয়েই গিলে খাবে, গলা শুকানো তো পরের ধাপ। পূর্ণতা চর্তুদিকে তাকালো কেউ আশেপাশে নেই একটা মানুষও নেই। থাকার কথা না, বর্তমানে ও একটা কাঠের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ যার প্রতিটা দেয়ালজুড়ে খোলা জানালার মাঝে বিছানায় ঘুমন্ত ছিলো। রুমের সিলিংটা কাঠের, ফ্লোরটাও কাঠের, দেয়ালগুলোও কাঠের। জানালা দিয়ে শো শো ধ্বনিতে বড্ড বাতাস আসছে। বাতাসের তালগোলে কাঠের খোলা জানালাগুলো ধপাস ধপাস বারি খাচ্ছে। সাদা পাতলা কাপড়ের স্বচ্ছ কার্টেনগুলো(পর্দা) দুমকা হাওয়ায় ঘরের ভেতরে ঢুকে উড়ছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূর দূরান্তের সবুজে শ্যামল উচু টিলা, ছোটবড় পাহাড়, সেই পাহাড়ের মাথার উপর শুভ্র মেঘগুচ্ছের নীলচে আকাশ। সীমাহীন আকাশে তুলোর মতো মেঘগুচ্ছ একদিক থেকে অন্যদিকে নিরবে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ মুখের কাছে তুড়ি বাজতেই পূর্ণতা সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো চমকে উঠে। স্থুল চাহনিতে পূর্বের দিকে তাকাতেই দেখলো ওর বাঁ হাতে হ্যাঙ্কার‍ ঝুলছে। তাতে ভাঁজ করা একটা সাদা পাড়বিশিষ্ট হালকা গোলাপির শাড়ি। শাড়িটা কি চমৎকার দেখতে যেনো সদ্য স্ফুটিত একটা ফুল!! হালকা গোলাপীর একগুচ্ছ গোলাপ ফুল যেনো পূর্বের হাতের মুঠোতে। পূর্ণতা চাপা খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো,

– এতো সুন্দর শাড়ি তুমি কখন কিনলে?
– এটা সিক্রেট বিষয় বিবিজান। বলা বারন। আপনি এখন উঠুন, এটা গায়ে জড়িয়ে আমাকে পুলকিত করুন। আমি আমার গোলাপী পূর্ণতাকে দেখতে চাই। দেখার সুযোগটা দিবেন?

পূর্ব ঠোঁটের হাসিটা আরেকটু প্রসার করে পূর্ণতার হাত ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। পূর্ণতা ওর হাতের দিকে একপলক তাকিয়ে বিনা ভাবনায় হাত ধরে বিছানা থেকে এক পা ফ্লোরে নামায়।। পূর্ণতার হাতে হ্যাঙ্কার ধরিয়ে পূর্ব তর্জনী উচিয়ে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দেয়। পূর্ণতা যেতেই হঠাৎ পূর্বের ফোনটা বাজতে থাকে পূর্ব পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ধরতেই জরুরী আলাপে মগ্ন হয়ে পরে।

– আমার পরশু পযর্ন্ত ছুটি চাই স্যার। একটা দিন কি ম্যানেজ করা সম্ভব না?
– পূর্ব তুমি কি তোমার কাজে এখন গাফিলতি শুরু করছো? তুমি কি জানো না? তোমার অনুপস্থিতিতে এখানে কীভাবে কাজ থমকে থাকে?
– আমি সেটা মানছি স্যার। কিন্তু আমার বিষয়টাও তো খেয়ালিপনা করলে চলেনা। আমি আগেও বলেছি স্যার, আমার পক্ষে রোবট হওয়া অসম্ভব ব্যাপার! আমি তো কখনো কথার বিরুদ্ধে যাইনা। আজ কেনো আপনার মনেহচ্ছে আমি এখানে কর্মচ্যুতি করছি?
– তোমার উপর আমি কখনোই এমন মতামত পোষণ করিনি এটা তুমি বেশ ভালো করেই জানো। একটা দিন বেশি ছুটি মানে তোমার উপর আরো হেব্বি প্রেশার। তুমি কি সেটা নিতে পারবে?

পূর্ব কলটা লাউড স্পিকারে ট্যাপ করে বিছানার উপর রাখলো। কথা যথারীতি চলতেই গায়ের গেন্জিটা একটানে খুলে ফেললো। খাটের নিচ থেকে লাগেজের চেইন খুলে একটা আইভরি রঙের পান্জাবী বের করে গায়ে জড়াতেই হাত দিয়ে চুল এপাশ ওপাশ করলো।। পান্জাবীর হাত গুটাতেই বিষন্ন মুখ করে বলে উঠলো,

– ঠিকআছে স্যার, আমাকে পরশু পাবেন। আমি সিউর দিচ্ছি পরশুদিন অফিসে থাকবো। আমি…

হঠাৎ কট করে দরজা খুলার শব্দ হতেই পূর্বের দৃষ্টি শব্দ উৎসের দিকে থমকে হাতা ফোল্ড করা আটকে যায়। এদিকে বিছানার উপর থেকে ক্রমাগত কেউ ‘পূর্ব তুমি জবাব দিলেনা?আমি কি তোমার জন্য গার্ড পাঠাবো? হ্যালো? হ্যালো ?’ করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে পূর্বের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। পূর্বের মন ও মস্তিষ্ক এখন রুমের ভেতরে গোলাপী শাড়ি পড়ুয়া পূর্ণ রমনীর পানে আটকে গিয়েছে। পূর্ণতা ব্যস্ত ভঙ্গিতে শাড়ির কুচি ঠিক করতেই বললো,
– কথা বলছো না যে? লোকটা চেচাচ্ছ।

পূর্ণতা যদি একবার তাকাতো হয়তো বুঝতে পারতো পূর্ব স্থিরদৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধতায় বশীভুত আছে। পূর্ব মাথা ঝাকিয়ে বিছানা থেকে ফোন তুলে বললো,
– স্যার আমার নতুন গাড়ি এসেছে। চিন্তা করবেন না। আমি পরশু নিশ্চিত আসবো।

শেষ বাক্যটা বলার সময় পূর্ব গলার স্বর নিচে নামিয়ে বললো যেনো কেউ শুনতে পাক। তাও একবার পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে দেখলো ও বুঝেছে কিনা, যদি জানতে পারে পূর্ব পরশু ওকে একা রেখে চলে যাবে তাহলে কোন ঝড়ের আলামত দেখাবে আল্লাহ্ ভালো জানে। পূর্ণতা আয়নার সামনে চুল আচঁড়াচ্ছে তারমানে ও কিছু শুনেনি, যাক বাঁচা গেলো। পূর্ব ফোনটা সাইলেন্ট করে পূর্ণতার ঠিক পেছনে দাড়িয়ে চুলে নাক লাগিয়ে বললো,

– তোমাকে মেরে ফেলি?
পূর্ণতা কিন্ঞ্চিত রাগ দেখিয়ে কপাল কুঁচকালো। বললো,
– মেরে ফেলার জন্য শাড়ি পরতে বললে? বাহ্ দারুণ টেকনিক তো! এখন তো খুনেরও দেখি রদবদল হচ্ছে। কদিন পর শুনবো ‘ভালোবাসো নাহলে মেরে ফেলবো’!
পূর্ব পেছন থেকে গলা জড়িয়ে চুলে নাক ডুবিয়ে আলতো হেসে দেয়। শক্ত করে জড়িতে ধরতেই আকস্মিক ব্যথায় ঠোঁট চেপে ভেতরে আবদ্ধ করে স্বাভাবিক গলায় উঠে,
– তুমি বড্ড পাজি হয়ে যাচ্ছো পূর্ণ। প্রতিদিন তোমার একেক রূপ দেখে আমাকে পাগল হতে হচ্ছে। তোমার তো কঠিন হওয়া উচিত। দেশের একজন তরুণ দেশব্রত রাজনীতিবিদকে তুমি ঘায়েল করে মারছো! তাকে মানুষের সেবা করতে দিচ্ছো না! তার উপর এমন ভুলিয়ে ভালিয়ে কথা শুনিয়ে আমাকে আরো হিপনোটাইজ করে ফেলছো! কি শাস্তি দিবো তোমায়! বলো? চুপ করে সত্যি মেরে ফেলবো!

পূর্ণতা গলা থেকে পূর্বের হাতজোড়া সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতেই বলে উঠে,
– মুখে সারাদিন ‘মেরে ফেলবো মেরে ফেলবো’ লেপ্টে থাকে কেন? একটু স্বাভাবিক হওয়া যায়না?

পূর্ব আরো কয়েক ধাপ জোর খাটিয়ে ধরতে নিলে ব্যথায় চোখ খিচুনি দিয়ে উঠে তবুও পূর্ণতাকে ছাড়েনা।

– অসম্ভব! তোমার সাথে কিসের স্বাভাবিক?প্রেম তো স্বাভাবিক জিনিস না।
– তুমি আমার প্রেমিক এখনো আছো?বিয়ে হয়েছে না?
– লেট মি ফিনিশ! আমি বলেছি বিয়ের পর চুটিয়ে প্রেম করবো। তো এখন প্রেম করছি সেটা কিসের সমস্যা? বিয়ে হচ্ছে সবার কাছে সার্টিফিকেট যেটা বয়ান দেয়, পূর্ণতা কবির একমাত্র দ্বিমাত্র ত্রিমাত্র, ইভেন সর্বমাত্র ওয়াসিফ পূর্বের।
– কি মাত্রা মাত্রি হিসাব বোঝাচ্ছো?
– তোমার মতো সেমি পাগলের মাথায় এসব ইজি ক্যালকুলেশন ঢুকবেনা।

পূর্ণতা তিরস্কারপূর্ণ কথা শুনে ঝট করে হাত ছাড়িয়ে তির্যকদৃষ্টিতে তাকাতেই থ হয়ে যায়! পূর্ব চোখের পলকে বাঁ হাতটা পেছনে লুকালো কেন? ওই হাতে কি কিছু ছিলো? আল্লাহ্!! সত্যি সত্যি ছুড়ি ছিলো নাকি ভয় দেখানোর জন্য? পূর্ণতা রাগে মুখ ফুলিয়ে চোখ ছোট করে কোমরে একহাত রেখে অন্যহাতে তর্জনী উচিয়ে বলে,
– আমাকে পাগল বলছো না? ভুলেও যদি কথা বলতে আসছো! হাতে কি ছিলো তোমার? দেখাও! দেখাও বলছি!
– তুমি তো পাগলই। কল্পনা জল্পনা করে এক্কেবারে সানডে মানডে ক্লোজ করে দিয়েছো।
– তোমাকে বলেছি হাতে কি সেটা দেখাতে!
– হাতে কিছুই নেই।
পূর্ণতার সন্দেহ হচ্ছে পূর্বের মিনমিন ভাব দেখে। ও ঘুরতেই কেনো হাতটা লুকিয়ে ফেললো? এতোক্ষন তো দিব্যি গলা জড়িয়ে বন্দিশালা করার ইচ্ছে ছিলো! পূর্ণতা খুব ভালো করেই জানে পূর্ব কত বড় নাছোড়বান্দা কথা বললে জীবনেও সেটা সোজাসাপ্টা করবেনা। পূর্ণতা জোর করে হাত টেনেও যখন ব্যর্থ হলো তখন উদাসীন মুখ করে বললো,
– তুমি ঠিকই আমাকে মার্ডার করার জন্য এমন সুনশান জায়গায় এনেছো। হাতে তোমার ছুড়ি তাইনা?

পূর্ব তাজ্জবের মতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পিঠে গুটানো হাত সামনে টান করে ধরলো। পূর্ণতা তাকাতেই ধড়ফড়িয়ে আচঁল টেনে হাতে চেপে ধরবে পূর্ব আচঁলের হাত খাবলে ধরে বলে উঠলো,

– এই থামো তুমি! পাগল নাকি? সামান্য কেটেছে এতে আচঁল ধরতে আসছো! শাড়িটা নষ্ট করার ধান্দা তোমার?
– হাত কাটলো কি করে! ব্লিডিং হচ্ছে তো!

পূর্ব এগিয়ে ড্রেসিং টেবিলে সাজানো টিস্যুবক্স থেকে দুটো টিস্যু নিয়ে হাতে চেপে বলে উঠলো,
– তোমার ওই বদমাইশ সেফটিপিন আমার হাতটাকে কেটে দিয়েছে! তুমি চুমু মেরে আমার ঠোঁট কাটো! তোমার সেফটিপিন ভালোবেসে আমার হাত কাটে! ফার্স্টে ঠোঁট এখন হাত! আমার খানাপিনা তো একদম গেলো!

পূর্বের চেপে ধরা টিস্যুদুটো তরল রক্তে ভিজে যাচ্ছে। পূর্ণতা আরো কিছু টিস্যু নিয়ে পূর্বের হাতে দিয়ে ফ্লোরে নিচু হয়ে লাগেজ খুললো। হেক্সিসল, তুলো, গজ বের করে পূর্বের হাতে ড্রেসিং করে দিলো। পূর্ণতা জানে পূর্ব প্রচুর সেফটি ম্যানটেইনের জন্য লাগেজ ও গাড়িতে ফার্স্ট এড বক্সের সরন্ঞ্জাম রাখে। কখন কিভাবে কাজে লেগে যায় কে জানে?

.

আকাশে প্রখর সূর্যের তেজ। স্নিগ্ধ পরিবেশটা উনুনের মতো গরম হতে শুরু করেছে। কাঠের একতলা বাড়িটার চতুর্দিকে সবুজ ঘাসের সমাহার। পূর্ণতা কাঠের সিড়িতে পা ফেলে নরম ঘাসের উপর পা রাখতেই পায়ের নিচটা সুড়সুড়ি লাগিয়ে শরীরে অদ্ভুত শিহরণ লাগে।কাটা দিয়ে উঠে লোমকূপ। ধূলো নেই, বালি নেই এমন নির্মল বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আহা…বাংলার প্রকৃতি! পরীক্ষায় আসা দেশ রচনায় ‘সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ’ বাক্যটা মতো পরিবেশটা আজ নিদর্শন দেখাচ্ছে। প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর আবেশে পূর্ণতা একপা একপা করে সামনের দিকে এগুচ্ছে। পেছন থেকে পূর্ব কাধে একটা এপেক্সের ব্যাগ ঝুলিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে আসছে। হঠাৎ কথা বলতেই দৃষ্টি গেলো পূর্ণতার নিরিবিলি সামনে এগোনোর দিকে। পূর্ণতার পায়ে জুতা কোথায়? ও খালি পায়ে নেমেছে কেনো? পূর্ব কলটা হোল্ডে চেপে জোরে গলা ছেড়ে বলে উঠে,
– এই মেয়ে জুতা কোথায়?
পূর্ণতা বেখেয়ালি সুরে শাড়ির আচঁলটা সামনে টেনে বলে,
– আমি খালি পায়ে হাটঁবো।
পূর্ব ওর থেকে কম হলেও বারো হাত দূরে। এখন কি একা ফেলে রুমের দিকে জুতা আনতে যাবে? ওকে কি পূর্ব সাধে সেমি পাগল ডাকে? কাজকর্ম তো বেকুবের মতোই! মাথা উঁচু করে বিরাট উচ্চতার টাওয়ারের দিকে তাকালো পূর্ব। এটা আসলে টাওয়ার না, প্রাচীন যুগে নিরাপত্তার জন্য এমন উচ্চতাসম্পন্ন সরু কেল্লা তৈরি করা হতো, সেখানে চব্বিশ ঘন্টার জন্য কয়েকজন পাহারাদার থাকতো যারা রাজ্যের বাইরে দূরবীন দিয়ে শত্রুর আগমন পর্যালোচনা করতো। অনেকটা সীমান্ত রক্ষী বা বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডদের পাহারা দেওয়ার মতো। পূর্ব মাথা নামিয়ে দেখলো পূর্ণতা এখন টাওয়ারে উঠার জন্য সিড়ির ধাপে পা ফেলেছে আচমকা হুশঁ ফেরার মতো পূর্ব হুড়মুড়িয়ে দৌড় দিয়ে পূর্ণতার সঙ্গ ধরলো। মনে মনে বললো, সিড়িগুলো যে পাহাড়ের সিড়ির মতো উঁচু!এই সেমি পাগলটা কি পায়ে ব্যথা পাবেনা? আজ একদম ওকে কোলে তুলবো না! আই সয়ার একদম দরদ দেখাতে যাব না!

পূর্ণতা জুতাহীন পায়ে নিরব হয়ে সিড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠছে। নিরবতার কারন পূর্বের সাথে কথা বলবেনা। পূর্ব উনিশ টু বিশ হলেই কথায়, কাজে বাজেখাবে রাগ দেখিয়ে খোটা মারে যেটা পূর্ণতার সহ্য না। একে তো না বলে ঘুমের ঔষুধ খাইয়ে এখানে নিয়ে এসেছে তার উপর হাত কাটা নিয়ে সেমি পাগল বলেছে। এগুলো কোন ধরনের অসভ্যতা? পূর্বকে চিনতে কি ভুল হলো কোথাও? পূর্ব এখন আগের তুলনায় বদ, ঠোঁট কাটা, বদমাশ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। কথায় কথায় হুটহাট চুমু দিয়ে বসে আবার বলে কিনা তুমি একটা সেমি পাগল, আমায় নিয়ে হ্যালুসিনেশন করে বিয়ে আগেই উল্টাপাল্টা কাজ করেছো। পূর্ণতার পেছন থেকে পাশ কাটিয়ে বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে পূর্ব এগিয়ে চলে গেলো। পূর্ণতা রাগে কঠিন চোখে কিছুক্ষণ থম মেরে তাকিয়ে থাকলে পরক্ষনে পা চালানো শুরু করলো। পূর্ব ঠিক ছয় সিড়ি আগে। একটু পর পর মাথা পেছনে ঘুরিয়ে পূর্ণতাকে দেখছে আর হাসছে। পূর্ণতার প্রচুর রাগ হচ্ছে এখন! ইচ্ছে করছে ঠাস করে একটা থাপ্পর মেরে এখান থেকে চলে যেতে কিন্তু পূর্ণতা সেটা আদৌ পারবেনা। পূর্বের গালে থাপ্পর মারা মানে নিজের বুকে ছুড়ি মোচড় দেওয়া।

বেহিসাবী সিড়ি ভেঙ্গে পূর্ণতা ক্লান্ত হয়ে যখন ১নং ভিউ পয়েন্টে পৌছালো হাটু গুজে জোরে জোরে হাফাতে লাগলো তখন একটু স্বস্তিবোধ হলে চারপাশে তাকাতেই হুট করে সমস্ত গ্লানি কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো। পূর্ণতা মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো! সবুজ সমারোহে গাছগাছালি যেন বাতাসের নড়চড়ে জীবন্ত লাগছে, দূর থেকে সুতোর মতো নদী-খাল-বিল ও পুকুরের দেখা মিলছে, আকাশের বুকে মেঘরাশি মুগ্ধতায় ভেসে বেড়াচ্ছে আজ হুমায়ুন আহমেদের সেই উপন্যাসের নামটা মনের কার্নিশে ঝুলছে ‘মেঘ বলেছে যাবো যাবো’। মেঘের দেশে খুব করে বেড়াবো, পূর্ব দিগন্তে মাতোয়ারা হবো, পূর্ণতায় ডানা মেলে খুশির ভুবনে বিচরণ করবো। ২নং ভিউ পয়েন্টে যাওয়ার জন্য আরো দশটি সিড়ি ভেঙ্গে উঠা লাগবে, পূর্ব আগেভাগে গিয়ে টুপ করে বসে আছে।

পূর্ণতা শাড়ি ধরে দশম সিড়িতে পা রেখে ২নং পয়েন্টে পৌছালে দেখে পূর্ব রেলিংয়ে দুহাত রেখে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাড়িয়ে আছে। বাতাসে মাথার তালুর চুল উড়ছে। এই দৃশ্য দেখলে বেহায়া হয়ে উঠে পূর্ণতার মন। পূর্ণতা ধীরপায়ে পূর্বের পাশে দাড়ায় পূর্বের দিকে আড়চোখে তাকায় একটু দৃষ্টি আর্কষনের জন্য গলা ঝাড়ে…লাভ হয়না। পূর্ব চোখ বন্ধ করে বাতাসের সাথে গা মিলিয়ে দিয়েছে। পূর্ণতার মন তীব্র আকাঙ্ক্ষায় আনচান করছিলো পূর্বের চোখের পাতায় ওষ্ঠধর ছোঁয়াতে। এই বদ্ধ চোখের স্নিগ্ধ মায়া দেখলে বুকের স্পন্দন হুল্কোগতিতে চলতে থাকে তখন। পূর্ব হঠাৎ চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে পূর্ণতার দিকে চোখ টিপ মেরে গানের সুরে বলে উঠে,
– Tum mere ho iss pal mere ho,
– Kal shayed ye lam, lam na rahe
– Kuch esa ho tum, tum na raho
– Kuch esa ho hum, hum na rahe

Yeh raste alaag ho jaye,
Chalte chalte hum kho jaye,

– Mein phir bhi tumko chahunga (2×)

পূর্বের গলায় এটা যেনো গান ছিলোনা, ছিলো কিছু অব্যক্ত কথা, অপ্রকাশিত শব্দ, না জানা গল্প। পূর্বের কঠিন খোলসযুক্ত মনটা ভালোবাসার চাদরে আচ্ছন্ন হয়ে নরম রূপে প্রকাশিত হচ্ছিলো। পূর্ণতার বুকটা ভয়ে ধুকধুক করছে। কানে সেই ধুকধুকনি ছন্দটা ধপ ধপ করে বারি দিচ্ছে। পূর্বের চোখে একটু আগের যেই ঝিলমিল খুশিটা দৃশ্যমান ছিলো তার বদলে নিগূঢ় কষ্টের আভাষ পাচ্ছিলো। গানের প্রতিটা লাইন কি ছিলো? কোনো সংকেত? কোনো বার্তা? কোনো ইশারা? কোনো প্রকাশ ভাষা? পূর্ণতা মনের সন্ধিক্ষনে অদ্ভুত কিছুর টের পেয়ে ছলছল চোখে পূর্বের গলা জড়িয়ে ধরলো। পূর্ব কাধের ব্যাগটা নিচে নামিয়ে পূর্ণতাকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় শূন্য উঠিয়ে রেলিংয়ে বসিয়ে দিলো। পূর্ণতা এখনো জোঁকের মতো গলা জড়িয়ে আছে। পূর্ব আকাশে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আগের ঘটনায় ডুবে গেলো।

পূর্ণতা রাগীরাগী মুখ করে দুপুরের খাবার পূর্বকে খাইয়ে দিচ্ছে। পূর্বও এই ফাঁকে পূর্ণতার আঙ্গুলে দাঁত বসানোর কর্ম ছাড়ছেনা। পূর্ণতা ব্যথায় চোখ কুঁচকালে পূর্ব মিটিমিটি হাসে পূর্ণতা চোখ খুললেই হাসি সরিয়ে গম্ভীর হয়ে যায়। খাওয়া শেষে প্লেটটা রেখে আসতে রুমের বাইরে গেলে পূর্বের সাইলেন্ট ফোন বিকটভাবে ভাইব্রেট হতে থাকে। পূর্ব পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে কলটা কানে ধরে,

– পূর্বদা! আপনি কি এখন রওনা দিতে পারবেন?
চুমুক দেওয়া মাঝপথে থামিয়ে বলে,
– কেন? আমি তো পরশু আসবো।
– সিরিয়াস কেস পূর্বদা! এক্ষুনি রওনা দিলে মঙ্গল! আপনি আসবেন?
– খুলে বলোতো কি হয়েছে? তোমার কথা স্বাভাবিক লাগছেনা কৈলেশ।
– পূর্বদা আপনার নামে কেস দায়ের হয়েছে। যে মামলা করেছে তার নাম মোখলেস। লোকটা নিতান্ত একজন গরীব মানুষ, ধমকে কথা বের করার সুযোগ পাইনি লোকটা পুলিশের তদারকিতে। আমি খোঁজ নিয়েও কোন সূত্র বের করতে পারছিনা পূর্ব দা। আপনার নামে কে জাল বিছিয়ে জঘন্য কাজটা করলো বুঝতে পারছিনা।
– কি নিয়ে মামলা করেছে আমার উপর? স্যার জানে এ বিষয়ে?
– এক্সিডেন্টের কেসে আপনাকে ফাসিয়েছে। তাছাড়া বসকে এখনো জানতে দেইনি কিন্তু জানতে পারলে কি হবে জানিনা।বাতাসের মতো কথা ছড়িয়ে পরছে পূর্বদা। ওমরকেও খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা।ওর বাড়িতে গিয়েছি ওর মা বললো ওকে নাকি একদল লোক এসে তুলে নিয়ে গেছে। উদ্যোগ সংগঠনের লোক এই নিচু কাজ করেছে কিনা খোঁজ নিয়েছি কিন্তু তথ্যমতে তারা কিছু করেনি। আপনি জলদি আসুন।

পূর্ব হতবুদ্ধির মতো কিছুক্ষণ ঝিম মেরে কানে ফোন লাগিয়ে বসে থাকলো। এক্সিডেন্টের কেসে মামলা ঠুকানো মানে ইনডাইরেক্টলি মার্ডার কেস! পুলিশ শীতকে শরৎ বানাতে এক্সপার্ট! ওমরকে কারা তুলে নিয়ে গেলো? একে একে কি হচ্ছে এসব? পূর্ব ঠান্ডা মেজাজে বলে উঠলো,

– তুমি কি আজকের দিনটা সামলাতে পারবে কৈলেশ? আমি এখন গ্রামে জানোই তো। বললেই তো আসা হয়ে যায়না। প্রোসেস না করলে বিপদ।
– পূর্বদা আমি জানি আপনি বউদিকে নিয়ে টেনশনে আছেন। আমি এদিকটা সকাল থেকেই কভার করছি। মিডিয়ার কানেও চলে এসেছে এই খবর। আপনার খোঁজ করতে কতক্ষন সময় লাগবে জানিনা। পুলিশ এখন কুত্তার মতো ব্যবহার করছে।
– কৈলেশ শোনো, মাথা ঠান্ডা রাখো। আমি এখন রওনা দিলেও রাত বারোটার আগে ঢাকায় পৌছতে পারবোনা। তুমি আজকের দিনটা যেভাবেই পারো সামলাও। টাকা লাগলে টাকা দাও আমি ফাইনেনশিয়াল সবকিছু পাঠিয়ে দিচ্ছি।
– পুলিশ দেখলাম। কিন্তু মিডিয়া কি করবো? তারা ইতিমধ্যে পলাশ স্যারের অফিসের সামনে রিপোর্ট করছে।
– বললামতো ঠান্ডা মাথায় কাজ করো। মানুষ বলের জোরে জিতে না, বুদ্ধির জোরে জিতে। যেভাবে বলি সব ওভাবেই করো। শোনো…

পূর্ব কৈলেশকে সবকিছু পরিকল্পনা রূপে বুঝিয়ে দিলো। কল কেটে আরো দু’গ্লাস পানি খেয়ে খোলা জানালার বাইরে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।দু’দিনের ট্রিপে লাওচাপড়া স্পট পুরোটা রিজার্ভ করেছিলো পূর্ব। চোখের সামনে সব ইচ্ছা, বাসনা, শখের পরিক্রমা ঠুনকো হতে দেখলো সে। কোন্ মুখে পূর্ণতাকে বলবে, ‘আমি সরি পূর্ণ, ট্রিপটা অনাকাঙ্ক্ষিত কারনে ক্যানসেল করতে হবে। তুমি বাড়িতে থাকো।’

পূর্ব পূর্ণতার হাতজোড়া আলগা করে গাল ধরে নম্র কন্ঠে বলে উঠলো,
– তোমাকে সেমি পাগল বলার জন্য আমি দুঃখিত। আর কখনো বলবো না। পাগলটা যে আমার জন্যই ছিলে তা আমি জানি। রাগ করো না আমার উপর। আমি দুঃখিত।
পূর্ণতা স্তব্ধ দৃষ্টিতে কয়েক মিনিট তাকিতে হঠাৎ নিচু স্বরে বলে উঠলো,
– তুমি কি আমাকে আগাম কিছুর আগে শক্ত হতে বলছো?

পূর্ব খুব অবাক হলো পূর্ণতা কি টের পাচ্ছে পূর্ব কিছু একটা বিষয় নিয়ে খুব চিন্তাপূর্ণ? পূর্ব হাসি দিয়ে পূর্ণতার কপালে থাকা ছোট চুলগুলো ফু দিয়ে সরিয়ে বললো,
– না তো। আমি তোমাকে আমার হামলার জন্য শক্ত হতে বলছি। হাত তো কেটে দিয়েছো এর শাস্তি কি পেতে হবেনা?

সাদা ব্যান্ডেজ কাপড়ে ড্রেসিং করা হাতটা দেখালো পূর্ব। পূর্ণতা হাতটা টেনে নিজের গালে রেখে ঠোঁট ছুয়িয়ে বললো,
– যদি ভুলের মাশুল গুণতে হয়, আমার কোনো আপত্তি নেই।

পূর্ব আজ মুখ ফুটে বলতে পারছেনা, ‘পূর্ণ আমার বুকে পুড়ছে, সেদিনের মতো একবার ঠোঁট ছুয়িয়ে দিবে?’ এই একটি কথাই যথেষ্ট শ্রেয়ার ধোকার পরে পূর্ণতার চোখে পানি আনতে। পূর্ণতা সিউর হয়েই যাবে পূর্ব ভয়ংকর কিছু লুকোচ্ছে। পূর্ব কথা গিলে ফেলার মতো ঢোক গিললো। বাতাসের অনুকূল ঝাপটায় পরম আবেশে পূর্ণতার গাল চেপে ঠোঁটজোড়ায় ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো পূর্ব। প্রতিটা ঝাপটানিতে পূর্ণতার চুল এবড়ে থেবড়ে পূর্বের কানের কাছে লুকোচুরি খেলছে। পূর্ণতা যদি ভুলবশত চোখের পল্লব খুলতো হয়তো দেখতে পেতো তার অতি কঠিনীভূত, বদমাশ, বদ, ঠোঁট কাটা স্বভাবের পূর্বের চোখদুটো আকাশের দিকে অভিযোগ শুনাতে ব্যস্ত। এই অভিযোগ নিজের জীবনের প্রতি, এই অভিমান নিজের প্রতি, এই যন্ত্রণা কেবল কর্মের প্রতি। কেন আমি অসহায়? সময় কি হবেনা সহায়? আজ কি অনুভূতির ছোঁয়া মেলে ধরবো না?

– ‘ চলবে ‘

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৩৫
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁

দুমকা বাতাসের এলোথেলো ঝাপটায় পূর্বের গভীরতম স্পর্শের কাছে প্রাণচাঞ্চল্যে মেতে উঠছে মন। পূর্বের ব্যান্ডেজ করা হাত আজ কঠিনভাবে গাল চেপে ঠোঁটের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে মগ্ন। চোখ খুললেই পূর্বের স্নিগ্ধ মুখের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য দেখলে আমি সত্যি মারা যাবো। আমার হার্টবিট থেমে যাবে আর এই থেমে যাওয়ার যদি স্থির হয়ে যায় সত্যি সত্যি আমার দম ফুরিয়ে মৃত্যু হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস দেখলে হৃদকম্প অস্থির হয়ে উঠে। আমার হৃদস্থলে অবস্থিত ছোট মাংশল পিন্ডটা প্রচুর ধপধপ করছে। পূর্বের ওষ্ঠযুগলের স্পর্শ চক্রবৃদ্ধির মতো গভীর থেকে গভীরতমে ডুবে যাচ্ছে। পূর্বের বিশাল ভারী নিশ্বাস যতবার আমার মুখের উপর পরছে মাত্রাধিক পরিমাণে কেঁপে উঠে তন।

পূর্বের হাত গাল থেকে সরিয়ে পিঠের চুল ভেদ করে পূর্ণতার ঘাড়ে চাপ প্রয়োগ হচ্ছে। পূর্ণতাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরেছে পূর্ব। হঠাৎ ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতেই পূর্ণতা চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে, পূর্বের উজ্জ্বল চেহারা কোনো এক কারনে বাচ্চাসুলভ লাগছে। পাপড়িময় চোখের বন্ধ পল্লব কাঁপাকাঁপি করছে, লালবর্ণের ঠোঁটদুটো দিয়ে হো হো করে শ্বাস ছাড়ছে, কালো চুলগুলোও ছুটাছুটি খেলছে এখন। ছোট্ট বাচ্চা যখন জিদ চাপিয়ে অপরাধীর মতো মুখ করে আদর পেতে আসে পূর্বকে ঠিক তেমনি লাগছে। পূর্ণতা কলার টেনে পূর্বের মুখ নিজের দিকে নুইয়ে চোখের পাতায় ঘন আবেশে ঠোঁট ছুয়িয়ে দেয়। পূর্ব রেলিংয়ে দুহাত রেখে পূর্ণতাকে মাঝখানে বসিয়ে অনেকটা নিচু হয়ে ওর মুখের উপর ঝুঁকে আছে। পূর্ণতা গলা জড়িয়ে পূর্বের কাধে থুতনি রেখে বলে উঠে,
– তোমার কিছু হয়েছে পূর্ব?

আমি খুব ভালো করেই জানি পূর্ব আমাকে কিছুই বলবেনা। ওর কার্যকলাপ বোঝার মতো ধূর্তবুদ্ধি অন্তত আমার পক্ষে নেই। পূর্ব শান্ত মস্তিষ্কে যখন আছে নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে জটিল কিছু হয়েছে। আমি আর জোর করলাম না। পূর্বের সুন্দর ঝলমলে চুলগুলো আরো এলোমেলো করতে ব্যস্ত হলাম। পূর্ব এবার চোখ খুলে কয়েক মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। রাগ করলো নাকি? আমি ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলাম, ‘কি মিস্টার? কি সমস্যা?রাগ করলেন ?’। পূর্ব আমার ইশারায় ঠোঁটে মিস্টি হাসি দিয়ে মাথা স্লো মোশনের মতো ডানেবামে নাড়ালো। হঠাৎ নাকে নাক লাগিয়ে আমার উপর ভর ছেড়ে দিলে আমি উল্টে রেলিংয়ের ওপাশে পরতেই ভয়ে চোখমুখ বন্ধ করে এক চিৎকার দেই। কয়েক ফিট উচু এমন ভিউ পয়েন্ট থেকে পরে আমার মাথার ঘিলু থেতলে দেহ পুরো ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সিউর! হঠাৎ মনেহলো আমার আত্মা আমার সাথেই আছে আমি কোথাও পরিনি এখনো মরিনি দিব্যি ঠিকঠাক মতো শ্বাস নিচ্ছি। কুঁচকানো এক চোখ খুলে দেখি আমার পিঠের নিচে পূর্বের শোয়া একমণের হাত! সেই হাত আমাকে রেলিংয়ের বাইরে আধশোয়া করে ধরেছে। আমি এতো ভয় আদৌ পাইনি যতোটা আকষ্মিক ধাক্কার দোটানায় আজ পেয়েছি। দুচোখ খুলে ডানে ঘুরিয়ে দেখি একটা কাক কা কা করে উড়ছে আর পূর্ব খিলখিল করে হাসছে। সর্বনাশ! আমার দম বুঝি আটকে এলো! চোখ খুলে রাখার সার্মথ্য পাচ্ছিনা! বুকে ঝড়ের তোলপাড় শুরু হয়েছে!অন্যদিকে চোখ বন্ধ করার শক্তি পাচ্ছিনা চুম্বকের মতো টানছে। এতো মারাত্মক কেন এই হাসি? বারবার, বারবার, বারবার…আমি হাসিটা দেখলেই বেকায়দায় ফাসি। পূর্বের এই হাসিটা যদি কোনো চিত্রশিল্পী দেখতো মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়েই থাকতো। জলরঙে আঁকিবুকি করে সাদা ক্যানভাসে ছবি তোলার কথা তার মনে থাকতো না। হাসির মুখরেই পূর্ব দুইগালে খাঁজ করে বললো,

– এতো ভীতু হলে চলে? তুমি আমার কাছে থেকেও এমন খুকীর মতো চিৎকার দাও?

আবার মত্ত হাসিতে ফেটে পরলো পূর্ব। আচ্ছা পূর্ব? তুমি কি জানো তোমার এই হাসিটা দেখলে বহু মেয়ের হার্টবিট এ্যাবনরমাল হবে?তোমার প্রাণনাশী হাসিটা দেখে কেউ হয়তো পথ ভুলে যাবে কেউ নির্বিচারে তাকিয়ে থাকবে কেউ নিজের বোধশক্তি বিলুপ্ত করে হুঁশ ফুরাবে। হাসিটা ধরে রাখার জন্য যদি কোনো যন্ত্র পাওয়া যেতো আমি দেদারসে রেকর্ড করতাম। মন খারাপ হলে রেকর্ডিং থেকে শুনতাম। পূর্ব পিঠে চাপ দিয়ে একটান মেরে কাছে আনতেই ঠোঁটে চাপ অনুভূত হলো। পূর্ব চুমু দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বললো,
– আমি তোমার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। যেখানে আমার কিছু হয়ে গেলেও তোমার কিছু হতে দিবোনা।

স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর মতো জো খুজেঁ না পেতেই পূর্ব রেলিং থেকে নামিয়ে দিলো আমাকে। আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে নিচ থেকে ব্যাগটা কাধে তুলতেই বললো,
– পায়ে ব্যথা করেনা?
– না। কেন করবে?
– ওহ্ আচ্ছা, শরীরে এনার্জী বেশি?
– কি? বুঝলাম না? এখানে এনার্জীর…

হুট করে কথার মাঝে হামেশার মতো দাড়ি বসিয়ে কোলে তুলে নিলো পূর্ব। দুমদুমিয়ে সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতেই ভিলেন মার্কা হাসি টেনে বলে উঠলো,
– খেলা হবে।।।
– আশ্চর্য!
– নো আশ্চর্য! কি ভেবেছো আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো? নো কুইন, আ’ম সরি। পায়ে প্রচুর ট্রাবেল নিয়েছো আর নিতে হবেনা, আমি আছি।
– আচ্ছা, তুমি যে রোমান্টিক সেটা তোমার চেহারা দেখলে বুঝা যায় না কেন?
– আমার চেহারা কি সাইনবোর্ড লাগে তোমার? এমনেই মেয়ে মানুষের জ্বালায় বাঁচি না। অসহ্য লাগে। তার উপর তুমি খালি দূর দূর করো ভালো লাগেনা।
– বেশি ইনোসেন্ট হয়ে যাচ্ছো না? দোষ তো তোমার। ঢাকনা খুলে রাখলে মাছি তো ভোঁ ভোঁ করবেই।
– তোমার মুন্ডু! আমি নিজের শার্টের বোতাম খুলি না ঢাকনা খোলার কেমন বিশ্রী উদাহরণ দিচ্ছো?
– চোখে সানগ্লাস, মুখে মাস্ক, গায়ে হুডি জ্যাকেট, পায়ে স্নিকার ব্যস! এভাবে চললে গ্যারান্টি দিচ্ছি কেউ তোমাকে গিলে খাবেনা।
– প্লিজ পূর্ণ! থামো! আই এডমিট কিছু মেয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে সেটার জন্য সব মেয়েদের দোষারোপ করতে যেও না। সবাই শ্রেয়া, আনিশার মতো আত্মসম্মান ভুলে বসেনা। আমি সমাজে ঢুকেছি তাদের সাথে যথাসম্ভব মিশেছি এবং এটাও দেখেছি একজন আঠারো বছরের মেয়ের মধ্যেও ম্যাচুরিটি সেন্স কতটা সুন্দর! তাদের মতো মেয়ে দেখলে সুফিয়া কামালের মতো মহিলাদের কথা স্মরণে আসে। বাংলাদেশ এমনে এমনেই উন্নতির শীর্ষে একপা একপা করে এগুচ্ছে না। গোড়া থেকে বিবেচনা করলে সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নারীদের ভূমিকাও আছে। ওরা মহীয়সী নারী বুঝলে? একজনের জন্য দশজনকে নোংরা বলতে যাবেনা। আগে চরিত্র দেখবে, পর্যবেক্ষণ করবে তারপর সিদ্ধান্ত নেবে।

পূর্ব খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো নারীদের ভূমিকা বোঝাতে। নারীকুলের সবাই যে শ্রেয়ার মতো মানসিকতা বদলায় না সেটাই হয়তো পরোক্ষভাবে বুঝালেন। পূর্ব সর্তকতার সাথে সিড়ি দিয়ে যখন নামছিলেন আমার ইচ্ছে জাগলো একবার জিজ্ঞেস করি ব্যাগ করে কি এনেছেন? কিন্তু প্রশ্নটা প্রশ্নরূপেই থেকে গেলো জিজ্ঞেস করা হলোনা। হঠাৎ দেখি আকাশের সাদা মেঘগুলো ঘনীভূত হয়ে কালো মেঘে পরিণত হচ্ছে। বাতাসের বেগও বাড়ছে। বৃষ্টি নামবে নাকি?

.

– আয়মান তুই ভাত খাবিনা বাবা? দেখ্ তোর জন্য শ্রেয়ার মা ডালের বড়া বানিয়েছে। আয় বাবা, গরম গরম ভাত দিয়ে ডালের বড়া খেয়ে যা।

আয়মান বিছানায় ট্রাউজার পরে খালি গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আফিয়া ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দুপুরের খাবার খেতে তোষামোদ করছেন। আয়মান সকালে এক কাপ চা ছাড়া কিছুই মুখে দেয়নি, দুপুর পেরিয়ে বিকেল চলছে এখনো পেটে ভাত পরেনি। উদ্বিগ্ন আফিয়া আরো ক’বার তোষামোদ করলে পেছন থেকে দরজা দিয়ে শ্রেয়ার মা শায়লা ঢুকে। বিনীত হাসি ফুটিয়ে শায়লা আফিয়ার পাশে দাড়িয়ে বলে উঠে,

– আয়মান কি রাগ করলো নাকি আপা? আয়মান? এই আয়মান? দেখো কি এনেছি!!

আয়মান শায়লার কথায় না উঠে পারলো না। শায়লার বচনভঙ্গিতে এমন জাদু আছে কেউ কোনো কথা অস্বীকৃতি করতে পারেনা। আয়মান চোখ কচলে শায়লার দিকে ঢুলুঢুলু চাহনিতে তাকালে শায়লা ভ্রু কুচকে বলে,
– কি ব্যাপার? এই ছেলে তোমার চোখ লাল কেনো? অসুখ?
বলতে বলতেই শায়লা আয়মানের কপালে হাত ছোঁয়ালো। শরীর হালকা মতো গরম ওর। জ্বর পুরোপুরি আসেনি এখনো। শায়লা হাতে থাকা প্লেট নিয়ে আয়মানের কাছে বসলে ভদ্রমহিলা প্লেটের উপর আরেক প্লেটের ঢাকনা সরিয়ে রাখে। গরম ধোয়া উঠা ভাতের এককোণায় ধনিয়া পাতা দিয়ে ডালের চারটা বড়া সাজানো। একসাইডে একটু লবণও রাখা। শায়লা আফিয়ার দিকে প্লেট এগিয়ে দিলে আফিয়া ভাত মেখে আয়মানের মুখে জোর করে লোকমা পুড়ে দেয়।

– আয়মান? কিছু নিয়ে মন খারাপ? সকাল থেকে দেখছি তুমি চুপচাপ হয়ে আছো। তোমার মতো ক্যাচক্যাচ করা মানুষটার কি হলো বলোতো?
– আন্টি কিছু না। মাথাটা একটু ব্যথা।
– মাথাব্যথা? হায় খোদা!! আগে বলবেনা!! দাড়াও এক্ষুনি আদা কুচি দিয়ে চা করে দিচ্ছি।
– আন্টি নাপা খেয়ে নিবো, প্রবলেম নেই।
– কি উটকো বলছো আয়মান? টোটকা থাকতে নাপা খাবে কেনো? আমি শ্রেয়াকে বলে দিচ্ছি বাড়ির পেছন থেকে তুলসী পাতা আনতে। শ্রেয়া? শ্রেয়া কোথায় রে তুই?

শ্রেয়াকে এক হাক দিতেই বাধ্য মেয়ের মতো হাজির হলো শ্রেয়া। আয়মানের সাথে চোখাচোখি হতেই আয়মান ঘেন্নার দৃষ্টিতে মুখ ফেরালো শ্রেয়ার এতে ভাবাবেগ হলোনা। স্বাভাবিক গলায় বললো,
– হ্যাঁ মা বলো। ডেকেছো কেন?
– চারটে তুলসী পাতা ছিড়ে আনতো। কচি দেখে আনিস।
– কিসের জন্য?
– তোকে এখন কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে?
– মা, প্লিজ গলাবাজি করো না। কারনটা বলে দিলেই তো পারো।
– আয়মানের জ্বর এসেছে। তুলসী পাতা গরম করে বুকে মালিশ করে দিবো। শুনেছিস তো? এখন যা।
– আমি পারবো না। তানিয়াকে বলো।

আয়মান কঠিন চোখ করে শ্রেয়ার দিকে তাকালো। মুখে আরেক লোকমা ভাত নিয়ে চিবুতেই বলে উঠলো,
– আন্টি আমি কারোর দয়ার উপর হাবুডুবু খেতে চাইনা। আমি নিজেই ছিড়ে আনতে পারবো। এমন অকর্মণ্য মেয়েকে সময় মতো দু চারটা চড় মেরে সোজা করা দরকার। থ্যাংকিউ আন্টি বাট আমি ক্যাপসুলই খাবো।

আয়মান বিছানা থেকে নেমে পানি খেতেই আরেকহাত দিয়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে ঔষুধের পাতা বের করলো। একটা ক্যাপসুল ছিড়ে সবাইকে ভ্যাবাচ্যাকা করে দিয়ে বলে উঠলো,

– অল ডান, ইনশাআল্লাহ্ জ্বর দুঘন্টার মধ্যে ছেড়ে দিবে। গোসল করিনি, আসি।

আলমারি খুলে পোশাক নিয়ে গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে শ্রেয়াকে ধাক্কা দিয়ে যেতেই হঠাৎ পিছু ফিরে বললো,

– ওহ্ সরি শ্রেয়া, আই এ্যাপলোজাইজ। নেক্সট থেকে ঠিকমতো চোখ কান খোলা রাখবো।

শ্রেয়া চোখ বিশাল বড় করে আয়মানের গমনের পথে হা করে তাকিয়ে রইলো। এটা কি গাধা, হাবলাকান্ত, ক্ষ্যাতমার্কা আয়মান? বন্দুকের নল দিয়ে ঢিসুম ঢিসুম বুলেট ছোঁড়ার মতো নিজের কেমন রূপ দেখিয়ে গেলো ও? কথার ধরন চেন্জ, এটিটিউট চেন্জ, চোখের শান্ত চাহনিও চেন্জ? শ্রেয়া কি নিজের ভুলের উপর পস্তাবে কখনো? আয়মান বহাল থাকবে নিজের কঠিন স্বীকার্যের উপর? কে জানে? উহু…সময় জানে। সময় সবকিছুর জন্য পরোপকার। কাউকে একফোঁটা কম দেয়না, কাউকে একফোঁটা বেশি। টাইম হেল্স এভ্রিথিং, উই শ্যুড ফরগেট সামথিং।

.

পূর্ণতা ওয়াশরুমে পা ধুয়ে রুমে ঢুকতেই দেখে পূর্ব রুমের সব জানালা আটকে রুমের নানা জায়গায় মোমবাতি জ্বালিয়েছে। সোনালি আভায় আনাচে কানাচে মোমের স্বর্ণালি শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। পূর্ণতা কানের পিছনে চুল গুঁজে আশ্চর্য দৃষ্টিতে রুমের মাঝখানে দাড়ালে হঠাৎ পেছন থেকে একজোড়া হাত এসে কোমর জড়িয়ে পিঠের চুল সরিয়ে দেয়। ঘাড়ে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিতেই পূর্ণতা পেটের উপর রাখা পূর্বের হাতজোড়া চেপে ধরে।

– পূর্ণ?

পূর্বের কন্ঠ শুনে পূর্ণতা আরেকবার কেঁপে উঠলো। কন্ঠের সর্বত্র যেন নেশা জাতীয় কিছু মেশানো। পূর্ণতা কোনো জবাব দিলোনা। পূর্বের দিকে ঘুরে দাড়ালো। পূর্বের চোখের দিকে তাকাতেই তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। ভয়ংকর ধারালো দৃষ্টি! এই দৃষ্টি তীক্ষ্ম ছুড়ির মতো বুকের ভেতর ছিন্নভিন্ন করে দেয়। পূর্ণতার কাঁচুমাচু মুখ দেখে পূর্ব আনমনে হেসে দিলো হুট করে পূর্ণতাকে উঁচু করে তুলে মাথা ওরদিকে উঁচিয়ে বলে উঠলো,

– আজ আমায় একটু ভালোবাসবে? প্রমিস করেছিলে প্রতিটা দিন শেষবারের মতো কাটাবে। আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি, তোমায় কষ্ট দিয়ে থাকি, তোমাকে দুঃখ দিয়ে কাঁদিয়ে দেই আমাকে মাফ করে দিও। আমিতো তোমাকে ভালো…

পূর্ব কথা আটকে পূর্ণতার দিকে ভাবশূন্য হয়ে মাথা নিচু করে নেয়। পূর্ণতা অস্থির হয়ে আছে পূর্বের মুখে প্রতীক্ষার শব্দ শুনতে! আজ কি পূর্ব বলবেনা? আমি তোমায় ভালোবাসি পূর্ণতা বলবেনা? পূর্ব পূর্ণতাকে নামিয়ে দিলো। অদ্ভুত অজানা বিষন্নতায় মুখ মলিন করে মাথার কাছে জানালা খুলে দিলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে একহাতে শার্টের বোতাম খুলতেই অন্যহাতে নাম্বার ডায়াল করে কল দিলো। পূর্ণতা এখনো ঝিম মেরে দাড়িয়ে আছে দেখে পূর্ব কানে ফোন এটেই বলে উঠলো,

– ঘুমিয়ে পরো পূর্ণ। কাল সকালে বাড়ি ফিরতে হবে। আমি জরুরী কলটা করে আসছি।

.

ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে পয়ত্রিশ। পূর্ব কল করার মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে রুমের বাইরে বসে এ্যালকোহল(ড্রিঙ্ক) খাচ্ছে। বিদেশী একবোতল আইটেম সে রেসোর্টের ম্যানেজারকে দিয়ে ব্যবস্থা করেছে। টানা চার ঘন্টা ধরে এক পেগ গ্লাসে যতবার চুমুক দিয়েছে ততবারই নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসার মতো বমি করেছে। আচ্ছা বস্তুটা পেটে পরলে বমি হচ্ছে কেন? একটু দুঃখ মেটাতে খাচ্ছে অথচ নেশা হয়েও হওয়ার মতো হচ্ছেনা, শরীর অসুস্থ করছে। পূর্ব সিড়িতে বসে পা ঘাসে উপর ফেলে মাথা নুয়ে আছে। হঠাৎ কে যেনো ওর নাম ধরে চিল্লিয়ে উঠলো। পূর্ব চোখ সরু করে ঝিমঝিম মাথায় কপাল কুঁচকে তাকালো।

– কে…
– তুই নিজেকে চিনতে পারছিস না?
– পারছি। তুমি আমার প্রতিচ্ছবি।
– হ্যাঁ, আমি তোর ভেতরকার পূর্ব। ইনার সাইড অফ পূর্ব। আচ্ছা তুই এখানে বসে বসে মদ গিলছিস তোর লজ্জা করছেনা?
– করছে।
– তাহলে কেন এখনো পেগ হাতে নিয়ে বসে আছিস? ফেলে দে ওটা!
– নেশা করতে চাচ্ছি। কিন্তু নেশা যে হচ্ছেনা!! আমার পূর্ণতার কাছে যেতে ভয় করছে।
– কেন? কিসের ভয়? ও তোর বউ না? ও কি তোর প্রেমিকা?
– আজ আমাল পূর্ণকে একটা গোলাপের মতো লাগছে। এমন একটা গোলাপ যাকে ছুঁয়ে দেখার আগে আমার সহস্রবার ভাবা লাগে।
– তোর স্ত্রীকে স্পর্শ করতে ভাবা লাগে? তুই কি দিনদিন মরে যাচ্ছিস? তোকে তো সবাই বুদ্ধিমান ভাবে! এই তোর বুদ্ধির নমুনা?
– আমি ওর সামনে গেলে কন্ট্রোল করতে পারবো না। ওর সামনে গেলেই আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।
– তুই কি জেলে ঢুকা নিয়ে ভয় পাচ্ছিস?
– আমি নিজের জন্য ভয় পাচ্ছিনা। ওর জন্য পাচ্ছি। আমার পূর্ণকে একা কার কাছে ফেলে যাবো? ও একমাত্র আমার দায়িত্ব। আমি ওকে নিজের কাছে রাখার জন্য ওয়াদা করেছি। কি করে একা ফেলে যাই?
– তোর পরিবার কি টপকে গেছে হারামজাদা? তুই এমন অবুঝের মতো প্রলাপ বকছিস কেন?
– পরিবার ওকে চব্বিশ ঘন্টা আগলে রাখলেও আমার থাকাটা জরুরী। রাতে যখন ঘুমাতে যাবে আমার বালিশটা শূন্য দেখবে তখন ও শান্ত থাকতে পারবেনা। প্রচুর কাঁদবে। শ্রেয়ার ঘটনা শেষ না হতেই আমার ঘটনা শুরু। আর কতো? ও আর কতো সহ্য করবে?
– তুই কোন্ সুখে রাজনীতি করছিস বেটা? ছেড়ে দে এসব! এসব ত্যাগ করে বাবার বিজনেসে বস! পারলে বিদেশ যা। তোর কি টাকা কম?
– মানুষের সেবা করার একমাত্র যোগ্য এবং উচিত পন্থাই হলো রাজনীতি। আমি সৎ হয়ে সৎ পথে রাজনীতি করছি। হ্যাঁ মানছি দু একটা মানুষ মেরেছি কিন্তু তারা আমার জন্য ছিলো ভয়ংকর। এছাড়া একটা নিরীহ মানুষের ক্ষতি আমি করিনি।
– দুনিয়ায় যে সত্যের মূল্য নেই ভুলে গেছিস?
– সত্যের মৃত্যু নেই — এটা বিশ্বাস করি।
– প্রবলেম সল্ভ হয়েই গেলো। যদি ভাবিস তুই কিছু করিসনি তাহলে পূর্ণতার সামনে যেতেও ভয় নেই। জেলে গেলেও ফেলত আসবি। এখন ওকে আগলে ধর। মেয়েটাকে নিজের কাছে নে। তোর জন্য মেয়েটা আজও কেন কষ্ট পাবে? এক্ষুনি যাবি তুই! এক্ষুনি যা!

পূর্ব ঈষৎ মাতালের ঘোরে দৌড় দিলো! হাত থেকে কাঁচের ছোট্ট গ্লাসটা ফ্লোরে পরে চুরমার হয়ে গেলো। শরীরে যতটুকু বল আছে সবটুকু খরচ করে সে কাঠের দরজা দিয়ে খুললো। যা ভেবেছে তাই! পূর্ণতা বালিশে মুখ উঠছে কেঁপে কেঁপে উঠছে দরজা খুলার দিকেও দৃষ্টি নেই।। পূর্ব পায়ে দরজা ঠেলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বেডের কাছে এসে সম্পূর্ণ শার্ট ছুড়ে মারলো। পূর্ণতা বালিশ থেকে চোখ ফুলিয়ে নাক লাল করে পূর্বের দিকে তাকাতেই পূর্ব উত্থাপিত তীব্র জলোচ্ছাসের মতো ঝাঁপিয়ে পরলো।। বিড়বিড় করে মাতালের মতো শুধু একবার বললো,

– আই এম সরি পূর্ণ। আই শ্যুড লাভ ইউ এভ্রি ডে, এভ্রি নাইট, এভ্রি মিনিট, এভ্রি সেকেন্ড, এভ্রিটাইম, মোর টাইম….আই এম সরি।

‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO