#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৪৬
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁
আকাশ কালো মেঘে পুন্ঞ্জীভূত হয়ে আছে। চারপাশে পৈশাচিক আওয়াজে বাতাসের শো শো শব্দ চলছে। কয়েকটা নাম না পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উদাস ভঙ্গিতে কালো আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত একটা স্তব্ধ পরিবেশ। মানুষও যেনো নেই আশেপাশে। গাড়ির কোলাহলও আজ ক’টা দিন যাবৎ একেবারেই কমে গেছে। মাটির নিচে চারদিন আগে শুয়ে পরা মানুষটির কতোটা যন্ত্রণা হচ্ছে তা কেউ জানেনা। আত্মহত্যা মানে ইহকাল-পরকাল দুইকালেই নিজেকে হত্যা করা। মানুষ মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে জানলেও বীভৎস রূপ সম্বন্ধে খুবই অল্প জানে। মাটির নিচে শ্রেয়ার এখন ইসলামিক পরিভাষায় ‘আজাব’ হচ্ছে নয়তো হিন্দু শাস্ত্রমতে স্বর্গ বা নরকে স্থান নিয়ে ফেলেছে। শুষ্ক, ক্লান্ত, ভারাক্রান্ত চক্ষুদুটোতে অশ্রুর পরিমাণ শুকিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে এখন আর কাঁদে না সে। গায়ের সাদা শার্টটাও কাদায় মাখামাখি হয়ে অন্যবর্ণ ধারণ করেছে। কবরটার মাথার কাছে হরেক রকমের জিনিস সাজানো যা এখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কোন্দলে ভিজছে। সিলভার রঙের টাইটান ব্র্যান্ডের দামী ঘড়ি, একটা ক্যাপহীন কালো কলম, সোনালী ফ্রেমে বাধানো বর্গাকার শেপের ফটো-এ্যালবাম, যেখানে দেখা যাচ্ছে চারটে হাসিখুশি প্রফুল্লচিত্তের মুখ। কালো স্কার্ট, গোলাপী টপস ও সাদা ওড়না গলায় পেচানো গোলগাল মুখে প্রাণবন্ত খিলখিল হাসির পাশে ভাবুক চিন্তিত ভার মুখে পকেটে হাত গুজানো সুন্দর তরুণ। তরুণটার পাশে এবং তারই কাধে কনুই উঠিয়ে পোজ দিয়ে দাড়িয়ে আছে মিষ্টি মেদুর হাসিতে কুর্তি পড়ুয়া মেয়ে। মেয়েটির বামপাশে দু’হাত বুকের উপর ভাজ করে দাড়িয়ে আছে আরেকটি হাস্যজ্জ্বল চেহারার তরুণ। পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখা ‘এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান’। এ্যালবামটার নিচে সেই ছবিতে থাকা খিলখিল হাসির মেয়েটার সাদা ওড়নাটা রাখা যা চারদিনে কাদায় প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।কবরটার চারিদিকে ছোট ছোট গর্ত খুড়েছে আয়মান। সেই সাথে বস্তাভর্তি কিছু জিনিসও এনেছে তাও কোত্থেকে যেনো সংগ্রহ করে। নিজ হাতে কবরের চর্তুপাশে নরম মাটির গর্তগুলোতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে নানাপ্রকার চারাগাছ। কয়েকটা গাছ গোলাপ ফুলের, কিছু গাছ বেলীফুল, রক্তজবা, শিউলী, পাতাবাহার ও রজনীগন্ধা। সবগুলো চারাগাছ মাটিতে গুঁজে মাথার কাছে আরেকটি গর্ত খুড়লো তবে সেটা ছিলো কিছুটা বড়। মাটিতে হাটু গুটিয়ে সেই গর্তে এতোক্ষন সাজিয়ে রাখা জিনিসগুলো এক এক করে রেখে দিচ্ছে। প্রতিটি জিনিস রাখার পূর্বে একবার করে বুকে জড়িয়ে শান্ত ভঙ্গিমায় চুমু খেয়ে গর্তে পুড়ে ফেলছে। এরপর মাটি চাপা দিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে কবরটার মাথার দিকে দিকে কতক্ষন চেয়ে ছিলো যেনো শ্রেয়ার মুখটা সে মাটির নিচেও স্বহাস্যে দেখতে পাচ্ছে। শ্রেয়া যেনো বলছে, কিরে ইবলিশ? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমাকে দেখে কষ্ট হচ্ছে? চিন্তা করিস নারে, আমি বেঁচে থাকলে কখনো তোর মুখোমুখি হতে পারতাম না। তুই তো আমাকে ভীতুই ডাকতি। কিন্তু দ্যাখ, আজ আমি সত্যিই ভীতুর পরিচয় দিয়ে দিয়েছি। তুই আমাকে প্রতিদিন দেখতে আসবি? জানিস মাটির নিচ থেকেও আমি তোকে দেখতে পাই কিন্তু কথা বলতে পারিনা। কিযে কষ্ট হয়!! তোকে অনেক ধন্যবাদ আয়মান, আমার শয়নশয্যার পাশে কতগুলো সুন্দর গাছ লাগিয়ে দিয়েছিস। আমার আজাবটা সম্ভবত মাফ হবেনারে, আত্মহত্যার মতো অপরাধ আমাদের ধর্মে আর দ্বিতীয়টা নেই। তুই চিন্তা করিস না, আমি আমার পাপের ফয়সালা পেতে শুরু করেছি। তুই কষ্ট পাস না। একদিন সত্যি আমাদের দেখা হবে। হয়তো অন্য কোনো দুনিয়ায় নয়তো অজানা কোনো বেশে। তখন দোয়া করবো, আমার তন-মন যেনো তোর উপরেই আসে। তোর জন্য যেনো আমি মরিয়া হয়ে উঠি। তোর মতো বিশস্ত একজন মানুষকে যেনো ভালোবাসার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মাতে পারি। যদি কখনো সম্ভব হয়, আমাকে মাফ করে দিস। আমাদের আবার দেখা হবে আয়মান। আমি আয়মান শিকদারকে কখনো ভুলবো না।
আয়মান লুটিয়ে পরলো আবার মাথা নুয়ে কবরটার পাশে। মুখ দু’হাতে ঢেকে কাঁদতে লাগলো। সময়কে যতো নিষ্ঠুর ভেবেছে ভাগ্য এরচেয়েও নিষ্ঠুর। ‘ মানুষ যা চায় তা সে ভাগ্য করে পায়, নয়তো সে ভুল করে হারায় ‘।
.
ভোরের আকাশটা ধূসরবর্ণে ছেয়ে আছে। আকাশের মতিগতি জানান দিচ্ছে দুইদিন বিরতি শেষে বৃষ্টি আবার হামলা দিবে। হোয়াইট টিশার্ট ও ব্ল্যাক ট্রাউজার পরে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে পূর্ব। সে দুইহাতে দুইটা ডাম্বেল নিয়ে ক্রমাগত বাহুর বাইসেপ্স ও ট্রাইসেপ্স পেশির ব্যায়াম করছে। কপালের উপর থাকা চুলের ফাকে ফাকে সুক্ষ্ম ঘামের কণা। গলার দিকটায় লাল হয়ে ঘেমে আছে। টিশার্টও প্রায় ঘামার্ক্ত অবস্থা। ইদানিং খুব ভোরে উঠে পূর্ব। ফজরের আযান দেওয়ার কিছু সময় আগেই সে অন্ধকার রাস্তায় বেরিয়ে পরে। কখনো জগিং বা কখনো ওকিং এর উছিলায় সময়টা নিরবে কাটাতেই কানে আযানের ধ্বনি বাজে। মসজিদের দিকে যাত্রা ধরে নামাজটা ওখানে শেষ করে শূন্যদৃষ্টিতে চলে যায় মসজিদের অপজিটে। লোহার গেইটটায় বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘গোরস্থান’। পূর্বের ধীরগতির পা দুটো সন্তর্পণে কাঙ্ক্ষিত জায়গাটার কাছে চলে আসে। নিরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওখানকার কর্মচারির কাছ থেকে ঝাড়ু এনে কবরটার চারপাশ সে পরিস্কার করে। এটা তার নিত্যদিনের কর্ম। একদিন দারোয়ান এসে কৌতুহল মেটাতে পূর্বকে বলেই বসে,
– পূর্ব ভাই? হেয় কি আমনের কাছের কেউ?
পূর্ব গম্ভীর ভঙ্গিতেই জবাব দেয় যেটা ইদানিং সে পূর্ণতা বাদে সবার সাথেই করে।
– বোন হয়। রক্তের সম্পর্ক ছাড়া বোন।
ছোট ছোট চারাগাছগুলো ধীরেধীরে বড় হলেও তা যেনো একটু জলদিই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূর্ব চোখ বন্ধ করে কিছুটা সময় সেখানে ব্যয় করে ফিরে আসে বাসায়। পলাশের শারীরিক অবস্থা আর আগের মতো বর্তায়নি। এখন বেশিরভাগ সময় সে বিছানায় শুয়ে থাকে। হার্ট এ্যাটাকটা যতো ছোট ছিলো ঠিক ততই যেনো শরীরের ভেতরে ক্ষতি করেছে। পলক ও পরশ আপাতত থম মেরে বসে আছে। পূর্ণতাকে নিয়ে তারা এখন মাথা ঘামায়না কেনো জানি। পূর্ব চুপ থাকলেও উপর-নিচ সব ঘটনার কারনই তার জানা। পলাশের যে বিজনেস সেটা মূলত তিনভাই মিলেই দেখতো। কিন্তু মূল অথোরিটি বা হেড যেহেতু পলাশ তাই পলাশের অসুস্থতার খবর শুনে বায়ার ও ডিলাররা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে। ফলাফল বিজনেস ডাউন। পূর্বকে বিজনেসের হাল ধরতে তোষামোদ করার সাহস ওরা কিছুতেই পাচ্ছেনা।
পূর্ব বেশ কিছু সময় ব্যায়াম করে ডাম্বেল দুটো রুমের এককোণায় রেখে দিলো। ঘড়িতে এখন সাতটা। বড় বিছানায় সাদা ব্লাঙ্কেট গায়ে ডানকাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে পূর্ণতা। একপলক পূর্ণতার ঘুমন্তাবস্থার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ হেঁটে পূর্ণতার পিঠের পাশে এসে বসলো। মুখটার উপর থেকে চুলের পসরা সরিয়ে দিলো। টুকটুকে গালটা দেখে পূর্বের মনটা কেমন করে হলো! আচমকাই পূর্ণতার গালে নিজের গাল কিছুটা জোরেই ঘষে দিলো। সূইয়ের মতো খোচা খোচা কিছু অনুভব হতেই পূর্ণতা শিউরে উঠে ঘুম থেকে হড়কে বসে পরে। গালে হাত ডলতে ডলতে ভ্রু কুঁচকে রাখান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়। পূর্ব বেডের হেডসাইডে পিঠ হেলিয়ে মাথার নিচে দুহাত রাখে। চোখেমুখে ‘বেপরোয়া’ ভাব! পূর্ণতা রাগের মাথায় বলেই বসলো,
– তুমি একটা অসভ্য লোক! খুবই অসভ্য! এভাবে কেউ ঘুমের মধ্যে জ্বালায়?
– ত্যাড়া কথা বলছো কেন? তুমি কি কাঠ না মোমবাতি? জ্বালাবো কেন?
পূর্ণতার আরো রাগ উঠলো পূর্বের এই আচরণ দেখে। লোকটা দিনদিন খুবই অসভ্য তো হচ্ছেই এখন এমন একটা ভাব ধরে থাকে যেনো কিছুই করেনি। পূর্ণতা দাঁত কিড়মিড় করে রাগী সুরেই বললো,
– তোমার মতো অসভ্য লোক আর দুটো দেখিনি!
– মানে আমাকে বকার জন্য কি একটাই ওয়ার্ড খুজে পেয়েছো? আর অসভ্যতার কি করলাম?
– ধাপ্পাবাজি করা কেউ তোমার থেকে শিখুক! তুমি যে আমার গালে তোমার শূলের মতো দাড়ি ঘষে দাও! গালটার কি অবস্থা করে ফেলো, দেখছো? বাড়ির মানুষগুলো কি ভাবে বলো তো?
– তোমার গালটার সাথে টাচ করার অনুমতি অবশ্যই আমার প্রয়োজন নেই। আমি নিজের বেডরুমেই আছি। যা করার বেডরুমেই করি। এখানে কে কি ভাবলো সেসব ভেবে আমার কি লাভ? তুমি কি চাও আমি অন্যমেয়ের গাল টাচ করে নিজের ইচ্ছা মেটাই?
পূর্ণতা আহাম্মকের মতো কিছুক্ষন নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই প্রচণ্ড রাগে পূর্বের দিকে কাথাটা ছুড়ে মারলো। বিরক্ত মুখভঙ্গিতে বেড থেকে নামতে যাবে হঠাৎ আঁচলে টান অনুভব করে পিছু ফিরে তাকাতেই দেখে পূর্ব শান্ত চাহনিতে ওর আচঁল খামচে ধরেছে। সম্মোহন করা সেই শান্ত চোখের ঘনীভূত পাপড়ির পল্লবে দৃষ্টি থেমে যায় পূর্ণতার। বুকটা দুরুদুরু করতে থাকে। বারান্দা দিয়ে জাকিয়ে আসা হিমেল হাওয়া এসে শরীরে শিরশির অনুভূতি জাগিয়ে দেয়। পূর্ব ততক্ষণে আচঁল টানতে টানতে পূর্ণতাকে জোরপূর্বক বুকের উপর টেনে আনে। পূর্ণতার হাত দুটো কাধে ফেলে পিঠ জড়িয়ে ধরে ওর। পূর্ণতা নিষ্পলক দৃষ্টিতে মোহপূর্ণ ঘোরের মাঝে আবদ্ধ হয়ে গেছে। পূর্বের কর্মকাণ্ডের দিকে ধ্যান অবশ্য নেই। পূর্বের ঠোঁটের কোণে মৃদ্যু হাসির আভাস। পিঠ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উপরে আসা হাতটা ঘাড় ডিঙিয়ে কানের পাশ দিয়ে ওর গালের কাছে স্পর্শ হলো। পূর্ণতা চৈতন্য ফিরে পাওয়ার মতো চমকে উঠতেই দেখলো পূর্বের মাদকপূর্ণ ঠোঁটজোড়া তিরতির করে এগিয়ে আসছে। আচমকা ওর কাধে ভর দিয়ে পূর্বকে ঠেলে দিতে চেষ্টা করে, কিন্তু লাভ হয়না। পূর্ণতার আপত্তি ব্যাপারটা বুঝতেই হেসে ফেলে পূর্ব। হাসতেই নিশ্বাসটা পূর্ণতার উপর ফেলে ওর চোখজোড়া সাময়িক স্থিতিতে বন্ধ করে বললো,
– আমিতো তোমাকে ছাড়া আর কাউকে এতোটা কাছে আনার স্পর্ধা দেখাতে পারবো না পূর্ণ। তুমি আমার কাজে বিরক্ত হচ্ছো ব্যাপারটা খুবই আন-এক্সপেক্টেড। আমি কি তোমার সাথে জোরজুলুম করছি? আমি তোমাকে দূরে রাখতে পারবো না বলেই চট করে বিয়েটা করে ফেলেছি। দেখো, চাইলে তো প্রেমটা করতে পারতাম না? আমি কিন্তু লুকোচুরি করেই তোমার জন্য টাইম বের করতাম। ব্যাপারটা আমার কাছে সস্তা লাগে পূর্ণ। যদি তোমার উপর অধিকার খাটাতে না-ই পারি তাহলে এসব উটকো ফাউল প্রেম করার মানে কি?
ঘোরদৃষ্টিতেই পূর্ণতা অপ্রসন্ন কন্ঠে বললো,
– আমি কি তোমার কোনো কাজে বাধা দিতাম?
– এটাই তো সমস্যা! বিয়ের আগে আমাকে বাধা না দিলে আমি যে বেহায়া হয়ে যেতাম। ওই মূহুর্তে তুমি শুধু আমার ইশারায় ঘুরতে। আমি যদি কন্ট্রোল হারিয়ে অন্যকিছু করে ফেলতাম, সেটা কি ঠিক হতো? এখন তো বিয়ে করেছি। তুমি না চাইলেও অদৃশ্য একটা জোর বা অধিকার আমি সত্যিই খাটাই। কিন্তু সেটা তো কেবল তোমার উপর। তুমি বলো পূর্ণ, আমার কি করা উচিত? তুমি এই সুন্দর সুন্দর দুটো গাল নিয়ে কি মিষ্টি করে ঘুমাও, আর আমি সব কাজ ফেলে দূর থেকে তোমার ওই মুখটাই দেখি। গালদুটো ধরে আমার কি করতে ইচ্ছে করে সেটা তো তুমি জানো না। এইযে এখন কতো ইচ্ছে করছে একটু আদর-টাদর করি, কিন্তু হামেশার মতো তুমি ধাক্কা মেরে সরাও।
– মাথা কি নষ্ট হয়ে গেছে? সকাল সকাল কি হাবিজাবি প্রলাপ বকছো?
পূর্ব কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পূর্ণতাকে সরিয়ে উঠে দাড়ালো। পূর্ণতা ওর এহেন কাজটা ঠিক ধরতে পারলো না। এই অসভ্য, ফাজিল, বেয়াদব লোকটা কখনো এতো কাছে টেনে কিছু না করেই এতো সহজে ছেড়ে দিয়েছে তা যেনো স্বপ্নেও ভাবা যায়না। পূর্ব কি রেগেছে? পূর্ণতা গুটিশুটি ভঙ্গিতে বিছানায় এখনো বসেই আছে। পূর্ব আলমারির একদ্বার খুলে শার্ট বের করছে। আড়চোখে পূর্ণতার পিটপিট চাহনি লক্ষ করে ব্যস্ত ভঙ্গিতেই বলে উঠে,
– আমি আর কখনোই যেচে যেচে তোমার কাছে যাবো না। তুমি নিজে যদি আমাকে চাও তবে বাধা দিবো না। কিন্তু শুনো রাখো, আমি নিজ থেকে ভুলেও তোমার হাতটাও ধরবো না।
কথাগুলো শুনে পূর্ণতার ইচ্ছে হলো এক্ষুনি এইমুহূর্তে দৌড়ে গিয়ে পূর্বের অভিমান গুড়িয়ে চুমু দিতে। কিন্তু সে সুযোগটা পূর্ব আর দিলো না, গলায় টাওয়েল ঝুলিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। ঠাই বসে রইলো পূর্ণতা বিছানার দিকে তাকিয়ে। শ্রেয়ার মৃত্যুর পর কয়েকটা দিন পেরিয়ে এখানকার অবস্থা স্বাভাবিক হলো ঠিকই কিন্তু আয়মানের অবস্থা আরো দূর্দশাপূর্ণে ন্যস্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায় দুটো সাবজেক্টে ইম্প্রুভ দেওয়া লেগেছে ওর। পড়াশোনা দিনদিন গোল্লায় যাচ্ছে আয়মানের সেটা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে সে। অদ্ভুত কোনো কারনে পূর্বের সাথেও ঠিক করে কথা বলতে পারেনা পূর্ণতা। সারাটাক্ষন শ্রেয়ার সাথে কাটনো স্মৃতিখুলো নিয়ে ভাবতে থাকে। পূর্বের প্রতি অযত্নশীল হয়ে পরেছে সেটা খুব করে টের পেলেও অবসাদগ্রস্ত মনের জন্য কিচ্ছু করতে ইচ্ছে জাগেনা।
.
নাস্তার টেবিলে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। পূর্ব চুপচাপ খাওয়া শেষ করে ড্রাইভারকে নিয়ে বেরিয়ে পরে। আজ ওর দলের সাথে জরুরী একটা তলব আছে। পূর্ণতা অনেক চেষ্টা করেছে দৃষ্টি আর্কষনের জন্য কিন্তু অভিমানভরা মনটা ওকে এখনই মাফ করতে চাইছেনা। ঢাবির আশেপাশে ছাত্রদের ভালোই তোড়জোড় দেখা যায় রাজনীতি নিয়ে। কেউ কেউ তর্ক করে নিজের দলকে উঁচু বানাতে একপা পিছায় না। পূর্ব বর্তমান সরকারের আন্ডারে থাকা বহু এমপি, ডিসি, আইজিদের সাথেও উঠাবসা করে দেখে অনেকের চোখেই সেটা হিংসাত্মক। যদিও তরুণ তবুও কেউ ওকে অদক্ষ, অপক্ক, অক্ষম ভাবার মতো ভুল করেনা। এ নিয়ে ওর দলের মধ্যে যারা সবচেয়ে প্রবীণ চারজন বা চৌমাথার উচ্চপদস্থ নেতারা আছেন তাদের মধ্যে দু’জন ড. ইশহাক হোসেন ও মাওলানা সিরাজুল ইসলাম পূর্বের চটান চটান কর্মে বড়ই নারাজ। রিলিফের নাম দিয়ে সরকারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের একখানা বাজেট হাতানোর ফন্দিটা পূর্ব কোনোভাবেই মানতে চাইছেনা। যদিও পার্শেন্টেজ হিসেবে পূর্বকে বড় অঙ্কের টাকা দেওয়ার ওয়াদা করেছিলো পূর্ব মানেনি। সরকারি চাল, ডালের যে হিসাব সেটা পূর্বের জন্য এদিক-ওদিক করতে পারছেনা, পূর্ব ঠিকঠিক সেগুলো ধরে ফেলে। মোটকথা দলের কিছু মানুষ পূর্বকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করার জন্য নীল নকশা সাজিয়েছে। এখন তো সেটা বাস্তবায়নের পালা।
.
ফুয়াদের দিকে তাকালে ফুসে উঠে আফরিন। গায়ের চামড়া যেনো আগুনের মতো দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে ওর। নাক দিয়ে খাবার নিতে নিতে ঘা হয়ে গেছে নাসাপথে। খেতেও পারেনা জীবন্ত শাশের মতো শুয়ে থাকা ফুয়াদ। আফরিনের হুট করেই মেজাজটা এতো চড়া হলো সে হনহন করে সিড়িতে দাপুটে পা ফেলে পূর্ণতার রুমে অনুমতি ছাড়াই ঢুকলো। পূর্ণতা তখন গোসল শেষ করে বারান্দায় কাপড়গুলো নাড়ছিলো হঠাৎ পেছন থেকে কারোর আসার আওয়াজ হতেই সে ঘুরে দাড়ালো। ওমনেই অচিন্তনীয় একটা কান্ড করলো আফরিন! কষে এক থাপ্পর মেরে দিলো পূর্ণতার গালে। পূর্ণতা চোখ খিচ মেরে মাথা নুয়ে চুপচাপ স্তব্ধ ভঙ্গিতে দাড়িয়ে ছিলো। কিন্তু আফরিন যেনো রাগ না ঝেড়ে পারলো না,
– তোর মতো বেলাজাগুলোকে দেখলে স্যান্ডেল মেরে পেটাতে ইচ্ছে করে! তোকে দেখলে বিশ্বাস কর আমার মনটা চায় চুলের মুঠিটা ধরে দেয়ালে ইচ্ছামতো ঠুকে দেই! আজ তোর জন্য আমার বুকের মানিকটাকে এভাবে পরে থাকতে হচ্ছে। কি করেছিলি তুই ওইদিন? বুকের আচঁল ফেলে লোভাতুর করেছিস নিশ্চয়ই! পূর্বকে কিভাবে বশ করলি সেটাই ভেবে পেতাম না কিন্তু আজ ঠিকই সেটা বুঝলাম! তুই যেমন পূর্বও ওমন!
পূর্ণতা এতোক্ষন সব কথা সহ্য করলেও শেষবাক্য শুনে তৎক্ষণাৎ মাথা উঠিয়ে গরম চোখে তাকায়। আফরিন আরো সাংঘাতিক কিছু বলতে যাচ্ছিলো হঠাৎ চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। পূর্ণতা একপা এগিয়ে এসে চোখে চোখ ফেলে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
– আপনি বয়সে যথেষ্ট বড় বলে আমি যে আপনাকেও ছাড় দিবো তা কিন্তু না। আপনি আমাকে নিয়ে বারো মাসের ৩৫৬ দিন গালিগালাজ করলেও কিচ্ছু বলবো না, কিন্তু খবরদার আমার ব্যাপার নিয়ে উনাকে দোষারোপ করলে!
পূর্ণতার কথার তেজ দেখে হতবাক আফরিন। পূর্ণতার রাঙানো চোখের দিকে তাকিয়ে আর দাড়িয়ে থাকতে পারলো না, রুম ত্যাগ করতে বাধ্য হলো। পূর্ণতা নিজেকে বেশ সময় নিয়ে ঠান্ডা করলো। কিন্তু কিছুতেই কথাগুলো শুনে শান্তি পেলো না। ওর মনে পরছেনা আদৌ কেউ ওকে এভাবে কথা শুনিয়েছে। পূর্ণতা বিছানার উপর থেকে ফোনটা নিয়ে কল করবো পূর্বকে। আজ এই ঘটনার কথা ওকে শুনাবেই। আজকের কথাগুলো অতি মাত্রায় বিশ্রী এবং অশোভনীয়। পূর্ব গাড়ির পেছনের সিটে মাথা হেলে বসেছিলো হঠাৎ ফোনটা বাজতে থাকতে তাকিয়ে দেখে পূর্ণতার নামটা। ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে ঈষৎ কুঁচকে এলো। কলটা রিসিভ করে কানে এঁটে বললো,
– কি প্রয়োজন?
কন্ঠ শুনেই এতোক্ষন যাবৎ গুছিয়ে রাখা কথাগুলো এলোমেলো করে ফেললো পূর্ণতা। আমতা আমতা করে বললো,
– আমি জানিনা।
– জানিনা তো কল করেছো কেন?
– আমি একটু তোমার ওখানে আসি?
– আজব তো! কতো বড় সাহস তোমার! তুমি জানোনা আমি তোমাকে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বের হইনা?
– আজ একটু দরকার যে…একটু আসি? আমাকে তো কেউ চিনেনা। সালোয়ার কামিজ পরে আসলে নিশ্চয়ই তোমার ওয়াইফ ভাববেনা?
– তুমি আমার সামনেও আসবেনা!
কথার প্রলয়ে কেঁপে উঠলো পূর্ণতা। মিনমিন করে আবার বলে উঠলো অপ্রস্তুত কন্ঠে,
– আমার খুব অসহ্য লাগছে পূর্ব। সেদিনের মতো অসহ্য…যেদিন তোমাকে এতোগুলো কল করেও পাশে পাইনি। আমি কি তোমার কাছে দিনেরবেলায় একটু স্পেস পাবো না?
ধরা গলায় কথাগুলো শুনতেই এপাশ থেকে অদ্ভুত লাগলো পূর্বের। বাসায় কি আবার ওকে কিছু বললো নাকি? চাচির কটু কথা সময়ে-অসময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। নিশ্চিতরূপে বলাই যায় পূর্ণতাকে কিছু বলেছে। পূর্ব কানে ফোন এঁটেই ড্রাইভারকে বললো গাড়ি ঘুরাতে। ড্রাইভার মাথা পিছু ঘুরিয়ে বলে,
– বাবা, আপনের না আজ জরুরী কাজ আছে? ফালায়া যাইবেন?
পূর্ণতা ফোনের বিপরীতে এখনো মিনতি করছে একটু দেখা করার জন্য পূর্ব সেটা শুনেও কোনো হু-হা শব্দ করছেনা। ড্রাইভার উন্মুখ হয়ে আছে উত্তরের আছে। পূর্ব সেটা চোখ দিয়ে ইশারা করলো কথা না বারিয়ে গাড়ি ঘুরাতে। পূর্ণতার আকুতিমিনতি করা থামছেই না,
– তুমি আমার সামনেও এসো না পূর্ব। শুধু অফিসটার জানালায় একটু তাকিয়ে থেকো? আমি রাস্তার ওপাশ থেকেই তোমাকে দেখে চলে যাবো। আমি কারোর চোখে পরবো না গ্যারান্টি দিচ্ছি। আমি আসি? আচ্ছা যাও তোমার জানালা দিয়ে তাকাতেও হবেনা, শুধু জানালার পাশে একটু বসে থেকো?….
পূর্ণতার অহেতুক কথা চুপচাপ শুনছেন পূর্ব। ঘড়ির দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চোখ রেখে আড়চোখে বুঝতে পারছে গাড়িটা ওয়াসিফ ভিলার সদর গেট পেরিয়ে ঢুকলো। পূর্ণতা কথার দোটানায় এতোই মশগুল ছিলো গাড়ি আসার শব্দ সে খেয়ালই করেনি। পূর্ব ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে কানে ফোন লাগানো অবস্থায় ভেতরে ঢুকলে সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। পূর্বিকা প্রায় চিৎকার দিয়েই ‘পূর্ব তুই!’ বলবে পূর্ব ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বললো। এরপর সিড়ি ধরে বিনাশব্দ করে রুমের দিকে চলে এলো। পূর্ণতা জানালার কাছে বেচইন অবস্থায় আকুলিবিকুল ভঙ্গিমায় এমন ভাব করছে যেনো কেদেঁ দিবে দিবে অবস্থা। পূর্ব হেঁটে ওর একদম পিছনে দাড়াতেই পূর্ণতা একটা শব্দ পেয়ে তীব্র বিরক্তিতে পিছনে ফিরে তাকালো। এরপর সন্দিগ্ধ মুখে আবার আকাশে দৃষ্টি রাখতেই চকিত ভঙ্গিতে চোখ বড় করে ফেললো পূর্ণতা! তড়িৎ গতিতে পুরোপুরি ঘুরে দেখলো পূর্ব বাঁ-কানে ফোন লাগিয়ে পকেটে হাত গুঁজে গম্ভীর মুখে দাড়িয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড মৌনব্রত কাটতেই পূর্ণতা ফোন ফেলে ঝাঁপিয়ে পরলো পূর্বের উপর।
– ‘ চলবে’
#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৪৭
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁
বাতাসটা শান্তির। ঠান্ডা ঠান্ডা, নির্মল ও পরম শ্রান্তির। বক্ষস্থল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডটা মুখপথ দিয়ে জোরেই বেরুলো যেনো। পূর্ণতা কতক্ষণ যাবৎ জাপটে ধরে আছে সেটাই হয়তো ঘড়িতে তাকিয়ে চিন্তা করছে পূর্ব। মেয়েটা বড়ই পাগল। এমন পাগলামী দেখলে ওর মনটা বড্ড বখাটে আচরণ করে নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে। পূর্ণতা ওকে ছাড়ছেনা। পূর্ব একবার ভাবলো ওকে কি ছাড়তে বলবে? না, থাক। আজ একটু নিয়মশৃঙ্খলা ভেস্তে যাক। অন্তত পূর্ণতার মুখে একটুকরো কিরণফোঁটার মতো হাসি পাক। পূর্ণতা প্রাণভরে মানুষটার গায়ের সুঘ্রাণটা টেনে নিচ্ছে। কৃত্রিম সুগন্ধি ছাড়াও অন্যরকম সুগন্ধ হিসেবে একটা আলাদা যে সুভাষ থাকে সেটা যেনো অনাবিল সৌহার্দ্যে উপভোগ করছে। মানুষটার বক্ষস্থলে ঢ্রিমঢ্রিম আওয়াজে যে ছন্দপূর্ণ শব্দ হচ্ছে পূর্ণতা উক্ত জায়গাতে নিলম্বনে ওষ্ঠযুগল ছুয়িয়ে দিচ্ছে। পূর্ব চমকে যায়। বেশ জোরালো ভাবেই চমকে যায়। মাথা নিচু করে বুকের কাছটায় মাথাটা দেখে। পূর্ণতা সুকৌশলে ধীরেধীরে অভিমানের স্তর যেনো ভেঙ্গে দিচ্ছে পূর্বের। পিঠের শার্টটা খামচে ধরেই হৃদস্থলের জায়গাটায় ক্রমাগত অধর স্পর্শ চালাচ্ছে। পূর্ব ভেবেচিন্তে জিজ্ঞেস করে,
– তোমাকে চাচী কিছু বলেছে?
– উহু,
– মিথ্যাটা একটু কম বলার চেষ্টা করো। পরিণাম অবশ্যই ভালো হবেনা।
পূর্ণতা চট করে মুখ তুলে তাকায়। চোখাচোখি হয়ে যায় পূর্বের তুখোড় দৃষ্টিপাতের দিকে। চোখদুটোতে কিছুটা রাগ, কিছুটা অভিমানের সংমিশ্রন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। একদৃষ্টিতে তীক্ষ্ম চাহনি ফেলে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো গলায় ঢোক গিললো পূর্ণতা। একটু হুঁশ হলে খেয়াল করলো পূর্ব ওকে বিন্দুমাত্র না ছুঁয়ে পকেটে হাত গুজানো অবস্থাতেই দাড়িয়ে আছে। অজানা লজ্জায় হাতের বাধন আলগা করে পূর্বকে ছেড়ে মাথা নুয়ে দাড়িয়ে থাকলো পূর্ণতা। দারুণ বিপাকে পরেছে সে পূর্বকে হুটহাট সামনে পেয়ে। তার উপর যেই দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সেই দৃষ্টিকোণ চোখ রাখতে বুকটা কামড়ে উঠে। পূর্ব গম্ভীর প্রকৃতিস্থ কন্ঠে বললো,
– একা থাকার অভ্যাস আছে?
চকিত দৃষ্টিতে মুখ তুলে পূর্ণতা অবাক কন্ঠে বললো,
– কেনো?
– যেটা জিজ্ঞেস করা হয়েছে সেটার জবাব দাও।
– পারি। আমি আগে একা একাই ফ্ল্যাটে থাকতাম। মা হাসপাতালে চলে গেলে বাবাও সকাল সকাল অফিসে চলে যেতো।
– তার মানে একা থাকতে সমস্যা নেই তাইতো?
– কিন্তু কেনো?
– লাগেজ গুছাও।
পূর্ণতা হকচকিয়ে চেচিয়ে উঠে,
– কিহ্!
– বাংলা ভাষায় বলেছি ‘লাগেজ গুছাও’। আর একটা বাড়তি কথা বলতে যাবা না। লাগেজ রেডি করো আমি মোমিনকে পাঠাচ্ছি।
পূর্ব একই ভঙ্গিতে নাকের ডগায় গম্ভীর ভাবার্য রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পূর্ণতা অবুঝের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নির্দেশ মোতাবেক লাগেজ গুছিয়ে রেডি করতেই পূর্বের ড্রাইভার মোমিন এসে সেটা নিয়ে গেলো। পূর্ব কি করতে চাইছে, কি তার মূখ্য উদ্দেশ্য, কিছুই বোঝা সম্ভব হচ্ছেনা। পূর্ণতা সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই দেখলো পূর্ব সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে সাহেবীপনার মতো বসে আছে। মুখের অবস্থা অবর্ণনীয়! ছিটেফোঁটা হাসি নেই। হাসতেই পারেনা এমন কাঠিন্য মুখ করে রেখেছে সে। হঠাৎ অচিন্তনীয় কাজ করে বসলো পূর্ব! সবাইকে চিল্লিয়ে জড়ো করে আফরিনকে সকলের সামনেই বলে উঠলো,
– আপনার কি কাজকর্ম নেই চাচী? সমস্যা কি আপনার? নিজেকে থার্ড ক্লাস প্রমাণের জন্য কেনো ঝামেলা করছেন?
– জবান সামলে কথা বলবে পূর্ব! বড়দের সম্মান করতে না জানলে একদম চুপ থাকবে!
– এদিকে সম্মান শব্দটা আসলো কেন? সম্মান দিয়ে কি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো?
– আমি কিন্তু চুপ থাকবো না বলছি! চুপ করো!
আফরিনের তিরিক্ষি মেজাজের সুরে পূর্বের রাগ দ্বিগুণ বারিয়ে দিলো। পাশ থেকে পরশ আফরিনের পক্ষ ধরে খেকিয়ে বললো,
– তুমি এই দুদিনের মেয়ের জন্য আমাদের সাথে ঝগড়া করছো? লজ্জা হওয়া উচিত! রাজনীতি করেও বউদের নীল নকশা ধরতে পারছো না, ছিঃ!!
আজ পূর্ণতা শত ইশারা করেও পূর্বকে আটকাতে পারলো না। পূর্ব ভীষণ রাগে কাঁচের টি-টেবিলে এমন লাত্থি মারলো সমস্ত গ্রাউন্ড ফ্লোরে সেই ঝংকার শব্দ সবাইকে শিউরে দিলো! রুম থেকে ছেলের বাজখাই গলার আওয়াজ ও অদ্ভুত একটা শব্দ শুনতেই নার্সের সহযোগিতায় নিচে নামলেন পলাশ।। এসেই দেখলেন সবাই গোল হয়ে দাড়িয়ে আছে, আর কেন্দ্রস্থলে পূর্ব দাড়িয়ে রাগে ফোস ফোস করছে। পূর্বিকা আয়েশাকে ধরে রেখেছে আপাতত। পূর্বের রাগের বেলায় কেউ ওকে বোঝাতে গেলে উল্টো ভয়াবহ তেজে ক্ষেপে যায়! পূর্ণতা চুপচাপ নত মাথায় পূর্বের কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে দাড়িয়ে আছে। যা-তা ব্যবহার ও অলক্ষুণে ঝগড়ায় নিজেকে প্রচণ্ড অপরাধী ভেবে চোখের পানি ফেলছে। ফ্লোরে লাঠি ঠকঠক করে এগিয়ে আসলো পলাশ। লাঠির আওয়াজে সবাই মুখ ঘুরিয়ে এমনকি পূর্বও সচকিত চাহনিতে দেখলো বাবা এগিয়ে আসছে। রোগাক্রান্ত পলাশ ডানহাতে লাঠি ধরে বামহাতে কেয়ারটেকারের সাহায্য নিয়ে ঠিক পূর্বের সামনে এসে দাড়ায়। ছেলে উনার ভয়ংকর ভাবে রেগে আছে তা উনি বুঝে গেছেন ইতিমধ্যে। কেয়ারটেকারকে ছেড়ে বামহাতটা পূর্বের কাধে ফেললেন পলাশ। ছেলেকে নিজের দিকে দৃষ্টি আর্কষন করিয়ে নম্র কন্ঠে বলে উঠলেন,
– আমি কি বেঁচে নেই তোর কাছে? মরে গেছি?
– অসম্ভব! কি বলছো এগুলো?
– তাহলে তুই আফরিনের সাথে এমন ব্যবহার করলি কেন? আমি তোকে এগুলো শিক্ষা দিয়েছি?
– আব্বু তুমি যা জানোনা তা নিয়ে কথা বলো না।
– ঘটনা আমাকে বলাটা উচিত না? আমাকে না বলে তুই ঝামেলা বাধাচ্ছিস কেনো? কি হয়েছে সেটা বল।
পূর্ব স্থির দৃষ্টিতে পলাশের দিকে তাকিয়েই পূর্ণতার দিকে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল ইশারা করলো। আড়চোখে পূর্বের আঙুল নিজের দিকে পরতেই পূর্ণতা চমকিত দৃষ্টিতে কেঁপে উঠে ভেজা সিক্ত মুখখানা উপরে তুলতেই সাথেসাথে নিচে নামিয়ে ফেলে। পলাশ পূর্ণতার দিকে সরু দৃষ্টিতে চোখ ছোট রেখে কি যেনো গভীরভাবে নিরক্ষ করলেন। এরপর আফরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– তুমি ওকে মেরেছো আফরিন?
আফরিন থতমত খেয়ে চোখ নিচু করে কাঁচুমাচু করতে থাকে। পলাশ দুইমিনিট উত্তরের আশায় তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে আবার পূর্ণতার মলিন মুখটার দিকে তাকায়। পূর্ব এখনো একদৃষ্টে চেয়ে আছে বাবার কীর্তিকলাপের দিকে। পলাশ যদি এইমূহুর্তে না আসতো তাহলে বিরাট অঘোর কাজ পূর্ব করেই ফেলতো! পলাশ নিরবতার জালে ছিদ্রবহুল করে বললো,
– তুই কি বাড়ি থেকে চলে যেতে চাচ্ছিস?
– কি করবো? পথ আছে কোনো? ওকে তো আমার শান্তি দেওয়া লাগবে আব্বু! উনাদের মতো বিজ্ঞ মানুষের নিকৃষ্ট আচরণ দেখলে আমার নিজেরই গা-পিত্তি জ্বলে উঠে।
– তুই গেলে সব ঠিক হবে? বল?
– শত জিদ উঠলেও আমি ওর উপর হাত তুলিনা, উনি কোন্ সাহসে হাত উঠালো? এই অধিকার কে দিয়েছে উনাকে? এমন নরকতুল্য জায়গার চেয়ে রাস্তার খেকো কুকুরের কাছে থাকা ভালো। ওকে দরকার পরলে আমি পাতালেও লুকিয়ে রাখবো তবুও এ বাড়িতে আমি একটা সেকেন্ড থাকতে দিবো না। এ্যাই পূর্ণ? চলো!
পূর্ব শক্ত চোয়ালে আর একটা শব্দ বললো না। পূর্ণতার কবজি ধরে ওকে টেনেই নিয়ে যেতে লাগলো বাইরে। দরজার বাইরে যেই পা দিবে আবারও মুখ ঘুরিয়ে কঠোর চাহনিতে একে একে সবার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
– বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি! দুনিয়া ছেড়ে না! আমার আব্বুর সাথে যদি উনিশ-বিশ হয় সবাইকে জবাই করবো! এক্কেবারে জবাই করবো! আমি কাউকে ছেড়ে দেওয়ার মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্মাইনি! ভুলো না যেনো।
পা চালিয়ে হনহন করে চলে যেতে লাগলে পূর্বিকা বহুবার পূর্বকে হাক ছেড়ে থামতে বলে। আজ পূর্বের হাটার গতি ছিলো যেনো অদ্ভুত! পূর্বিকা দৌড়ে লন পেরিয়ে পার্কিং সাইডে এসে হাপাতে হাপাতে বলে উঠলো,
– ভাই! প্লিজ থাম্! পূর্ব প্লিজ রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নিস না! তুই আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবি? পাগল হয়েছিস? আফরিন চাচীর জন্য তুই কেনো যাবি?
পূর্ব কঠোর মুখেই ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে সরে যাওয়ার ইশারা করতেই পূর্ণতার জন্য গাড়ির দরজা খুলে দেয়। পূর্ণতা আকুল চাহনিতে পূর্বিকার দিকে তাকিয়ে আছে। পূর্বিকা কতো জোড়াজুড়ি করছে, কতো আকুতি-মিনতি করছে না যাওয়ার জন্য কিন্তু ফলাফল একেবারেই শূন্য। পূর্ণতাকে দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ড্রাইভিং সিট থেকে এক ধমক দেয় পূর্ব। পূর্ণতা আরেকদফায় চমকে উঠে ভয়জনিত উৎকন্ঠায় সিটে বসে দরজা লাগিয়ে দেয়। পূর্বিকা দৌড়ে এসে পূর্বের জানালায় নিস্পলক তাকিয়ে থাকে। পূর্ব স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে গাড়িতে চাবি ঢুকাতেই বলে উঠে,
– থাপ্পরটা ইনডাইরেক্ট তোর ভাইয়ের উপরই মেরেছে আপি। তুই যে বোকার মতো চুপ করে থাকবি সেটা সত্যিই আমি আশা করিনি। আমাকে মারলে তুই যেভাবে রুখে দাড়াতি, পূর্ণর জন্য সেটা তুই করলি না। রিজন কি জানিস? ও আজ মেয়ে বলে!
শো করে গাড়ি ছেড়ে দিতেই পূর্বিকা নির্বাক চাহনিতে গাড়ির পেছন অংশটা দেখছে। আকাশটা সূর্যের জন্য পড়ন্ত বিকেলের মার্ধুয্যে ছেয়ে আছে। পূর্বের কালো SUV গাড়িটা দৃষ্টিসীমানার বহু বাইরে চলে গেছে। আজ এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো? কি নিয়ে জ্বালা?
.
আকাশের বেগুনি রঙটা ধীরেসুস্থে কালো চাঁদরে ঢেকে গেলো। সারা রাস্তায় পূর্ব টু শব্দ করেনি। পূর্ণতা অনেকবার সাহস জুগিয়ে পূর্বের সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু গাম্ভীর্য মুখের গম্ভীর ভাবটা অন্যদিনের তুলনায় বেশি থাকায় সাহসে পেরে উঠেনি। গাড়ির ভেতরে লাইট অফ থাকার কারনে আশেপাশের যানবাহনের লাল, হলুদ, সাদা আলোগুলো একটু পরপর মুখ আলোকিত করে ছুটে যাচ্ছে। পূর্বের দুটো হাত স্টিয়ারিংয়ে এমনভাবে ধরা যেনো ‘কার রেসিং’- এ আছে। পূর্বের দিকে তাকিয়ে থাকতেই পূর্ণতার স্পষ্ট বুঝতে পারলো এক্সিলেটরে পা কষে পূর্ব গাড়ির স্পিড তুঙ্গে চড়াচ্ছে। ভয়ে ধড়ফড় করছে পূর্ণতার। ওর তাকিয়ে থাকার পরও পূর্ব কেনো বুঝছেনা পূর্ণতা ভয় পাচ্ছে? শুকনো হয়ে থাকা কাঠ-কাঠ গলায় ঢোক গিলতেই জানালার দিকে তাকিয়ে বুকটা ধব্ক করে উঠলো পূর্ণতার! আচমকা এমনভাবে চেচিয়ে উঠলো সারা শরীর যেনো অসাড় হয়ে আসছে সেই দৃশ্য দেখে! জানালা দিয়ে গাড়ির সাইডে থাকা ব্যাক মিররে দেখলো পেছন থেকে একটা ট্রাক স্বহাস্যে ধেয়ে আসছে। মন বলছে ওই ট্রাকটা গাড়ি উল্টে দেওয়ার মতলবে আছে! পূর্ণতা সিটে মাথা হেলে চোখ খিচুনি মেরে অজ্ঞাতসারে কাঁপা হাতটা কোনোরকমে পূর্বের বাহু স্পর্শ করলো। পূর্ব একপলক কম্পমান হাতের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরালো সামনের দিকে। চোখ জানালার বাইরে লেফট মিররে একঝলক স্থির রেখে আবারো এক্সিলেটরে পা চেপে দিলো। পূর্ণতার কম্পনরত হাতটা ধীরগতিতে খামচে আসছে বাহুর উপর। বেকায়দায় স্পিড বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। পূর্ব দৃঢ় কন্ঠে বললো,
– সিটবেল্টটা টাইট দাও পূর্ণ!
পূর্ণতা ভয়ের পরিক্রমায় কিচ্ছু শুনতে পারলো না। থরথর করে অবিরামভাবে কাঁপতে লাগলো। পূর্ব বামে তাকিয়ে দেখে পূর্ণতা বিড়বিড় করে কি যেনো জপছে। এই কঠিন মূহুর্তে ওই দৃশ্য দেখে না হেসে পারলো না পূর্ব। সামান্য এটুকুতেই ‘লা ইলাহা…’ জপমালা শুরু? ফিক করে হেসে দিয়েও হাসি আটকে নিলো পূর্ব। পেছন থেকে আগত ট্রাককে বারবার মিররে পর্যবেক্ষণ করতেই হঠাৎ দুম করে আরো উচ্চ স্পিড বারিয়ে সামনের দুটো গাড়িকে ওভারটেক করে আড়াল হতে চাইলো। পূর্ব আড়চোখে পূর্ণতার নাজেহাল অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসি সামাল দেওয়ার কায়দায় আছে। হাসি তো থামতেই চাইছেনা!! বহুকষ্টে নিচের ঠোঁটকে দাঁতে চেপে হাসি আটকানোর ছোট্ট প্রয়াস করলো পূর্ব। এক্সিলেটরে পা হালকা করতেই স্পিড কমে যেতে লাগলো গাড়ির। শহরের বাইরে আসতেই একটা নিরিবিলি জায়গার ভেতর গাড়ি পার্ক করলো পূর্ব।
– এই মেয়ে? চোখ খুলো। দেখো এসে গেছি।
পিটপিট করে চোখের পাতা খুলতেই পূর্ণতা নিজেকে আলোয় আলোকিত করা সুন্দর শৃঙ্খল শৌখিন বাঙলোর কাছে আবিস্কার করলো।। সদর গেটটা বিশাল বড় এবং পুরো এরিয়াটাও যেনো আলোকিত। কোনো কোলাহল নেই, সাড়াশব্দ নেই, মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই আশেপাশে। শুধু লম্বা লম্বা দম্ভভরে দাড়িয়ে থাকা অনেকগুলো গাছ-গাছালী। বাঙলোটা একতলা বাড়ি। ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো বড় ডাইনিং রুম ও দুটো বেডরুমের অস্তিত্ব। একটা বেডরুমের একদিকের দেয়ালজুড়ে বিশাল বড় কাঁচের জানালা। জানালার থাই গ্লাস টেনে বারান্দায় যাওয়ার পথ। জানালার সাথে লাগোয়া নরম ফোমের বেড। জানালা বরাবর ঠিক ডানদিকে কাপড় রাখার সেট। বামদিকে আরেকটা জানালা তবে সেটা ছোট। পূর্ণতা শোবার জন্য বিশাল জানালার রুমটাই পছন্দ করলো। পূর্ব এখনো চুপচাপ। বিশেষ প্রয়োজনীয় কথাগুলো সে মাথা ঝাকিয়ে নতুবা হু-হা উত্তরেই সেরে ফেলছে। ব্যাপারটা মোটেই সহ্য হলো না পূর্ণতার। ব্যাটা রোমান্টিক প্লেস সিলেক্ট করে চুপ করে থাকবে? উহু…পূর্ণতা সেটা হতেই দিবেনা।
.
আকাশটা যেনো নিগূঢ় অভিমানে হঠাৎ বৃষ্টি ছেড়ে দিয়েছে। প্রকৃতি যেনো বৃষ্টির সাথে সখ্যতা করতে চাইছে। গুড়িয়ে দিতে চাইছে তার ক্ষুদ্রমনার অভিমান। অভিভূত করতে চাইছে নিজের আলিঙ্গনে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে গোসলটা সেরে শান্তি অনুভব হচ্ছে পূর্ণতা। কালো শাড়ির বেশভূষায় ভেজা চুলে তোয়ালে ডলতেই জানালার কাছে এসে থমকে যায়। বৃষ্টির ছন্দতালে আজ মন জুড়িয়ে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে। আহ্..প্রকৃতির সেই বৃষ্টি!! ঠান্ডা পরশ জাগানো, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দোল লাগানো টাপুর টুপুর বৃষ্টিতে পাগল মনটা ভিজার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। পূর্ণতা থাই গ্লাস সরিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে দুহাত দুইদিকে প্রসার করে বিলিয়ে দেয় বৃষ্টির মূর্ছনাতে। কতোদিন পর আহ্লাদী বৃষ্টি মনকে শান্ত করছে!! বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় আবার ভিজতে থাকে সে। সদ্য মুখহাত ধুয়ে নেভিব্লু নাইক টিশার্ট পরে রুমে ঢুকতেই থেমে যায় একজোড়া চোখ। হাতের তোয়ালেটা বেখেয়ালে বিছানার উপর রেখে এগুতে থাকে সম্মোহন দৃষ্টিতে। আজ তার পূর্ণতা বৃষ্টির পূর্ণধারায় গা সইয়ে ভিজছে। চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে পা দুটো বারান্দায় গিয়ে পূর্ণতার একদম পেছনে এসে দাড়িয়েছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে পূর্বের দাম্ভিক শরীরটাও। সিক্ত করে দিচ্ছে অভিমানী মুখটা। গাঢ় নীলের টিশার্টটা বৃষ্টিতে ভিজে আরো গাঢ়ত্ব ধারণ করছে। চোখ বন্ধ করে পেছন থেকে হাত বারিয়ে দেয় পূর্ণতার কোমরের দিকে। হুট করে লালবর্ণের নরম ওষ্ঠধর লাগিয়ে দেয় পূর্ণতার চুলের উপর নিজের । কিন্ঞ্চিত চমকিত ভঙ্গিমায় কেঁপে উঠে পূর্ণতা। মাথা কিছুটা নুয়ে দেখে পেছন থেকে পেটের উপর মাংশল দুটো ফর্সাটে হাত আষ্টেপৃষ্টে ধরা। ধ্বক ধ্বক করে বুকে কাপুঁনি উঠতে লাগলো পূর্ণতার। মানুষটার কখন, কিভাবে, কোনসময় পেছনে এসে দাড়িয়েছে একটুও খেয়াল হয়নি। খেয়ালিপনায় বেখেয়ালি হয়ে বড্ড ভুল হয়েছে। উচিত ছিলো রাশভারী লোকটাকে আরো বহুমাত্রায় জ্বালানো। অতো সহজে ধরা দেওয়াটা ওর ঠিক হয়নি । মাথার পেছন দিকে চুলের উপর ওষ্ঠজোড়ার বেগতিক স্পর্শ পাচ্ছে পূর্ণতা। হাতদুটোও বেহায়া হয়ে উঠছে তার। আবারও সেই অদ্ভুত সুঘ্রাণটা তীব্ররূপে নাকে পাচ্ছে সে। সেই নেশা নেশা মাতাল করা অদ্ভুত সুভাষ। তার প্রতিটি স্পর্শ যেনো বুকের ভেতরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পূর্ণতা আবেশের ঘোরে তার হাতদুটোর একটায় জোরে চিমটি কাটে। ব্যথায় অস্ফুট শব্দে ‘উফ..’ করে ছেড়ে দেয় পূর্ণতাকে। ছাড়া পেতেই তার দিকে ঘুরে রেলিংয়ে শরীর ঠেকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে পূর্ণতা। চিমটি দেওয়া জায়গাটায় হাত ডলতেই কপট রাগী চোখে তাকায় পূর্ব। ভ্রুদুটোও বেজায় কুঁচকানো। তার রাগী মুখটা যেনো হাসির ছলকে আরো রাগান্বিত হয়ে উঠছে। পূর্ণতা তা দেখেই আস্তেআস্তে হাসি থামিয়ে চট করে উদাস হয়ে যায়। পূর্ব হাত ডলতে ডলতে পূর্ণদৃষ্টিতে একপা একপা করে এগুচ্ছে ওর দিকে। পূর্ণতা পেছনে রেলিংয়ের উপস্থিতি বুঝতে পারছে। রাঙানো চোখের দৃষ্টিকে প্রচুর ভয় লাগছে ওর। পূর্ব দূরত্ব ঘুচিয়ে রেলিংয়ে দুইপাশে ধপ করে হাত ফেলে। মাঝখানে বন্দী করে ফেলে পূর্ণতাকে। তুমুল বৃষ্টির কারণে পূর্বের দিকে তাকাতেই হিমশিম খাচ্ছে পূর্ণতা। পূর্ব যেভাবে দেখছে নিশ্চয়ই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে? আচ্ছা লাশটা কোথায় রাখবে? টুকরো করবে নাকি জঙ্গলে ফেলে দিবে? কি করবে? নানা উদ্ভট চিন্তার মাঝেই হঠাৎ অকল্পনীয় কাজে মারাত্মক চমকে উঠলো পূর্ণতা! শক্ত মাসেলের একটা হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো কোমরটা! আরেকটা হাতের বিচরণ চলে গেলো গলার কাছে। বৃষ্টির তুখোড় বর্ষনে সখ্যপূর্ণ সৌহার্দ্যে ওষ্ঠযুগল খুজেঁ পেলো আরেক তৃষ্ণার্ত অধরজোড়া। খেয়ালী মস্তিষ্কে বেখেয়ালি চিত্তে উন্মত্ত হলো দুজনের স্পর্শ বদল। অভিমানের পাহাড় গুড়িয়ে বৃষ্টির উন্মাদনায় আপ্লুত হলো তৃপ্তিযুগল ভালোবাসা। ওষ্ঠস্পর্শের দীর্ঘতম সময়টায় চোখ খুললো পূর্ণতা। দেখতে পেলো মানুষটার বদ্ধচোখের মায়া। সেই মায়ায় ডুবে গেলে পুনরায় উঠা মুশকিল। মানুষটার অভিমান সহ্য করার চেয়েও মুশকিল।
-‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO