তোকে ঘিরে পর্ব-৫২+৫৩

0
1870

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৫২.
#ফাবিয়াহ্_মমো

আকাশ কালো চাঁদরে গা ঢাকা দিয়ে মেঘের সাথে গর্জন করছে। সেই সাথে বড় ফোঁটায় বৃষ্টি হচ্ছে। কালো মেঘে আড়াল হয়ে গেছে তেজালো সূর্য। দিনের আলোটা ধারণ করেছে সন্ধ্যার মতো কালো। পূর্ব বিছানা থেকে উঠতে পারেনা। পা নাড়াতে গেলে প্রচণ্ড ব্যথা হয় ওর। আজ পূর্ণতার জন্য ইচ্ছে করে ব্যথা কামড়ে পা নাড়াতে বাধ্য হয়েছে পূর্ব। সেই থেকে শুরু হয়েছে বীভৎস ব্যথা, যা এখনো কমছেনা। ঘড়িতে বাজে দুপুর বারোটা। পূর্ণতা ভেবেই পায়না এই কয়টা দিন পূর্ব নিজেকে কিভাবে সামলেছে। কিভাবে এই ব্যান্ডেজ পা নিয়ে নিজের সকল কাজ করেছে। অবশ্য বেডের পাশে দুটো স্ক্র‍্যাচ দেখে এটুকু অনুমান করেছে, পূর্ব বগলে স্ক্র‍্যাচ চেপে নিজের প্রয়োজন সেরেছে। পূর্ণতা ঘন্টাখানিকের মধ্যে রান্নাটা সেরে পূর্বের ড্রাইভারকে বলে বাসা থেকে লাগেজ আনিয়ে ফেলে। খোদেজা এ নিয়ে নানা প্রশ্ন করলেও পূর্বের এক্সিডেন্টের খবর শুনে আর একটা কথা তোলেনি। পূর্ব বিছানায় শুয়ে আছে। পায়ের নিচে নরম কুশন ও সাদা ব্লাঙ্কেটটা বুক পযর্ন্ত ঢেকে দেওয়া হয়েছে। পূর্ণতা ওয়াশরুমে বালতি ভর্তি করে পূর্বের পাশে এসে বসে। গোসলের সময় হয়েছে। এই কয়দিন গোসলের জন্য মোমিন এসে সাহায্য করলেও এখন এই কাজটা সম্পূর্ণ পূর্ণতা করতে চায়। চোখ বন্ধ করে থাকা পূর্বের কপালে হাত রাখে পূর্ণতা। নরম কন্ঠে বলে উঠে,

– ঘুমাচ্ছো?

পূর্ব কন্ঠ ও স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকায়। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে মাথাটা ‘না’ সূচকে নাড়ায়। পূর্ণতা কপাল থেকে হাত সরিয়ে পূর্বের বাহু চেপে বলে,

– উঠো, গোসল করবে।

পূর্ব প্রথমে আশ্চর্য হলেও পরে বাঁকা হাসি দিয়ে বলে,
– পাজি কোথাকার, লজ্জা দিনদিন নেমে যাচ্ছে। আমাকে গোসল করাবে তুমি? এতো শক্তি তোমার? আচ্ছা আমার হাতটাই ঠিকমতো উঠাতে পারো কিনা দেখো তো।
– তুমি নিজেই গোসল সারবে বুঝলে? আমি দরজার বাইরে থাকবো। তোমার পঁচাশি কেজির বডি টানার শক্তি আমার নেই। উঠো।
– বুঝলাম তো, তুমি আমার সামনে একদম পুচকে। একটু ধরো আমি নিজেই উঠছি।
– আচ্ছা গোসলটা না করলে হয়না? আমি গা মুছে দেই?
– আমি আমার ত্রিশ বছরের জীবনে গোসল ছাড়া থাকার বাজে অভ্যাস করিনি। আমাকে ধরে একটু ওয়াশরুমে নিয়ে যাও পূর্ণ। এতেই চলবে।

.

খাওয়া, গোসল শেষে ঘড়িতে এখন দুইটা বাজে। পূর্বের কড়া আদেশে চারদিনের অভ্যাস ত্যাগ করে শাড়ি পরেছে পূর্ণতা। শাড়িটা খয়েরী রঙের, আচঁলটা কালো। দিনটা এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন। বৃষ্টি একটু বিরতি নিতেই আবার ঝমঝমিয়ে একনাগাড়ে মুষলধারে হচ্ছে। ফ্যানের বাতাসটাও কেমন শীতের মতো হিম বসিয়ে দিচ্ছে। পূর্ণতা চুল ঝেড়ে বিছানায় উঠে পূর্বের মাথার কাছে বসে। কাঁচের স্বচ্ছ জানালার বাইরে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পূর্ব। মুখের উপর আর গম্ভীরতার ছাপ নেই। চারদিন আগের সেই রাগী মুখের বদলে এখন স্থান নিয়েছে একরাশ মায়া। পূর্ণতা জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে বুঝতে পারলো, প্রকৃতি যেনো উন্মত্ত বারিধারায় সকল কিছু ভিজিয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে সিক্ত করছে মনের উঠোন। পূর্ণতা আবার চোখ ফিরিয়ে পূর্বের দিকে তাকিয়ে দেখে, চোখদুটো বন্ধ করেছে পূর্ব। শান্ত মুখটা কেমন আদুরে দেখাচ্ছে। পূর্ণতা সাথেসাথে তার শীতল হাতদুটো দিয়ে পূর্বের মাথাটা কোলে তুলে নেয়। আকস্মিক কাজে পূর্ব চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে পূর্ণতা ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিটা কেমন নেশালো, আকৃষ্ট, অদ্ভুত প্রাণঘাতী। পূর্ব ভ্রুঁ নাচিয়ে হাসি মুখে বললো,

– তাকিয়ে আছো কেন? কি দেখছো?

পূর্ণতা সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকানো অবস্থায় ঠান্ডা কন্ঠে বললো,

– তোমাকে দেখছি। এই দেখার সাধ যে আমার কোনোকালেই মিটবেনা, সেটাই ভাবছি।

পূর্ব ওর ছেলেমানুষি কথায় শব্দ করে হেসে দেয়। হাসির আওয়াজ শুনে পূর্ণতা সেই একই ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে বলে,

– তুমি এভাবে হাসলে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠে। এটা তুমি বুঝো না?

পূর্ব এবার হাসি থামিয়ে সজাগ চাহনিতে তাকালো। পূর্ণতার ঘাড় চেপে নিচে নুইয়ে নিজের দিকে ঝুঁকিয়ে বললো,

– তোমার আজ কি হয়েছে পূর্ণ? আসার পর থেকেই একটার পর একটা নতুন রূপ দেখাচ্ছো। আমি অসুস্থ না হলে তোমাকে কোলে তুলে পুরো বাঙলো এরিয়া ঘুরে বেড়াতাম। পা-টা ঠিক হোক, দাড়াও।

ঘাড়ে এখনো পূর্বের হাতের চাপ লাগছে। মাথাটা পূর্বের স্নিগ্ধ শান্ত চেহারার উপর আটকে আছে। দূরত্ব সামান্য হলেও অন্তঃস্থল হৃদয়ের সংযোগ যেনো এক হয়ে আছে। পূর্ণতা খানিকটা সময় বাদে বললো,

– তুমি কি খুশি?

পূর্ব প্রাণ উচ্ছ্বসিত হাসিতে বললো,

– বোঝ না তুমি?

আর শোনার বাধ রাখলো না পূর্ণতা। দুহাতে জড়িয়ে ধরলো পূর্বের মাথাটা। শক্ত করে চেপে রাখার অদম্য বাসনার পূর্বকে জড়িয়ে রেখেছে পূর্ণতা। অজস্র ওষ্ঠষ্পর্শ দিয়ে ভরিয়ে তুললো পূর্বের শান্ত নিষ্পাপ চেহারায়। পূর্ণতার উদ্ভট আচরণে না হেসে পারলো না পূর্ব। ব্যঙ্গ হাসিতেই বললো,

– প্রেগনেন্সীতে কেউ রোমান্টিক হয়ে যায়? আসতাগফিরুল্লাহ্! এই অবস্থা করলে তো সমস্যা হবে। কন্ট্রোল, কন্ট্রোল। এই তোমার মুড সুইং হচ্ছেনা কেনো? তোমার সাথে কি পরিমাণ রাগারাগী করলাম, সেই হিসাবে তো আমার গলায় ছুড়ি চালানো উচিত।

পূর্ণতা নির্মল দৃষ্টিতে তাকালো। পূর্বের কপালে হাত রেখে বললো,

– আমি ভয়ে ছিলাম হয়তো তুমি এখুনি এসবের জন্য প্রস্তুত হবেনা। আমার এই কাজের জন্য তুমি খুব রাগ করবে। কিন্তু তুমি খুশিতে কাঁদবে আমি ভাবতেও পারিনি পূর্ব।

– শোনো পূর্ণ, আজ কয়েক ঘন্টার জন্য যদি আল্লাহ্ আমার পা-টা ঠিক করে দিতো তাহলে তুমি দেখতে আমি কতটা খুশি হয়েছি। আমার ভাগ্যটা এতো খারাপ, তোমার জন্য কিচ্ছু করতে পারছিনা। উল্টো তোমার নির্ভর হয়ে পরে আছি।
– বাজে কথা বলছো কেন? আমি কখনো বলেছি তুমি আমার জন্য বোঝা?

পূর্ব মৃদ্যু শ্বাস ছেড়ে পূর্ণতার পেটে হাত রাখলো। অসহায় দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,

– আমি যদি নাও থাকি তখন ও তোমার সঙ্গে থাকবে। আমার শেষ ইচ্ছা এটাই পূর্ণ। দোয়া করবো, আমার যতো বাজে গুণ আছে সেগুলোর বিপরীত গুণ যেনো ও পায়। তোমার আর আমার সব ভালো গুণ নিয়ে ও পৃথিবীর আলো দেখুক। ভাগ্য যদি আমাকে ওকে দেখার সুযোগ না দেয়, ও তোমার আঙ্গুল স্পর্শ করে বড় হোক পূর্ণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে, ও জীবনের সব কায়দা শিখে একদিন আমার চেয়েও অনেক বড় হয়ে দেখাবে। তুমি তো অবশ্যই হেল্প করবে তাইনা?

পূর্ণতা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো পূর্বের দিকে। পরিস্থিতি এমন ছিলো যেনো শ্বাস নেওয়াই ভুলে গেছে পূর্ণতা। কেউ ওর বুকের ভেতর বিষযুক্ত ছুড়ি দিয়ে জমের আঘাত দিচ্ছে। স্থির দৃষ্টিকোণে অজান্তেই পানি জমতে শুরু করেছে ওর। সহসা পৃথিবীর সকল চাকচিক্য এখন মেকি লাগছে পূর্ণতার কাছে। সে ঢোক গিলবে-গিলবে করেও গিলতে পারছেনা। পূর্ব ওর মুখভঙ্গি দেখে সবটা আঁচ করতেই পেটের উপর থেকে হাত সরিয়ে সেখানে চুমু দেয়। পূর্ণতার দুই হাত নিজের বলশালী হাতের মুঠোয় মিলিয়ে হেচকা টানে পূর্ণতার পিঠ জড়িয়ে নিজের বুকের সঙ্গে মিলিয়ে ধরে। পিঠের উপর ছেড়ে দেয়া ভেজা চুল সরিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বলে উঠে,

– ভয় পেও না। আমি তো জানি আমার পূর্ণ আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। আমার জন্য পূর্ণতা নামের মেয়েটা সব করতে পারবে, সব! তার জীবনের সবচেয়ে দূর্বল দিকটা যে আমি। আমি সেটাও জানি। কিন্তু জীবন তো কারো জন্য থেমে থাকবেনা পূর্ণ। আমি যে পথে আছি, সত্যি বলতে বাঁচি না মরি সেই গ্যারান্টি নেই। একবার যে রাজনীতিতে ঢুকে সে কখনো বের হতে পারেনা। গাড়ির টায়ারটা পায়ের উপর দিয়ে না উঠে যদি আমার শরীরের উপর দিয়ে উঠতো, তখন তুমি কি করতে? আমি তো তখন জানতেও পারতাম না তুমি আমার সন্তান পেটে ধারণ করেছো। দুঃখ তখন কেমন হতো বলো? এখন তো পাশে আছি। টেনশন করো না।

.

ওয়াসিফ ভিলার আবহাওয়া আচমকা বদলে গেছে। চারপাশে তাকালেই এখন বিয়ের রমরমা সাজ। গ্রীষ্মের খরতপ্ত চৌচির মাঠের বুকে বর্ষার বৃষ্টির মতো প্রাণের সন্ঞ্চার হলো যেনো। সবার মুখ এখন খুশিতে পরিপূর্ণ। পূর্বিকার এতোদিনের কাবিননামায় এখন শ্বশুরবাড়ির তকমা জুটছে। পূর্বিকার স্বামী এক সপ্তাহ হলো বিদেশ থেকে ফিরেছে। এখন তোড়জোড় চলছে পূর্বিকার বিদায়ের জন্য। পূর্ব বাবার অনুনয়ের কাছে নত স্বীকার করে ওয়াসিফ ভিলায় ফিরেছে। বিয়ের সকল কার্যাদি জৌলুস মনে করছে সে। পায়ের অবস্থা আগের তুলনা ভালো। ব্যান্ডেজ সরিয়ে ফেলা হয়েছে কিছুদিন হলো। হাটাহাটিও স্বাভাবিক ভাবে করতে পারছে পূর্ব।।সেই সাথে পূর্ণতার ছয়মাস পূর্তি হলো গর্ভধারণের। পূর্ণতার এই খুশির সংবাদে সবাই যেনো আরেকদফায় প্রাণোচ্ছাসে মেতে উঠেছে। একসঙ্গে দুইটা খুশির আবহাওয়া একত্র হয়ে সবার মন ও মেজাজ এখন খুশিতে আত্মহারা করেছে। পূর্বের চাচা পলক ও পরশ ওয়াসিফ যেভাবে খুশির ফোয়ারার আয়োজন করেছে তা নিয়ে পূর্ব অবাক! সবকিছুই যেনো রাজার ভঙ্গিতে সাজিয়ে তুলছে। আফরিন মাঝেমাঝে মুখ গুমড়ে থাকলেও পূর্বিকার খুশিতে আর উদাস হয়ে থাকেনা সে। শেফালীও এখন পূর্ণতার দেখভালের জন্য তৎপর। আচমকাই যেনো শান্তির ভুবনে ডুবে গেছে পরিবারের প্রতিটি সদস্য। কারো মনে কোনো ক্লেশ নেই, দুঃখ নেই, অতীত নিয়ে ভাবনার দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে।

আজ পূর্বিকার হলুদ ছোঁয়া। হলুদ ফুলে সজ্জিত হয়েছে বাড়ির প্রতিটি কোণা। পূর্বের ভয়ে টুকটাক কাজ ছাড়া কিছুই করছেনা পূর্ণতা। পূর্ব পূর্ণতার বাড়ির সকলকে নিমন্ত্রণ করেছে আপির বিয়েতে। তাই বাড়িতে মেহমানে গিজগিজ অবস্থা। সায়মার ন্যাকামি বেড়েছে আজকাল। সেই সাথে ফুয়াদের ঘটনার জন্য এখনো মুখে তালা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায় জাওয়াদ। মিথুন এতো জলদি দেশে ফেরার অনুমতি পায়নি। আনিশাও আসতে পারেনি চারমাসের গর্ভধারণের জন্য। পূর্ণতা বিছানায় পা ছড়িয়ে মুখ কুঁচকে বসে আছে। পূর্ব এ নিয়ে প্রচুর ক্ষেপে আছে ওর উপর। দফায় দফায় রাগ ঝারছে পূর্ব। কেনো পূর্ণতা শাড়ি পরবেনা? পেট ফুলেছে তো কি সমস্যা? অন্যদিকে পূর্ণতার উত্তর, শাড়ি পরলে পেটের জন্য মটরশুঁটি লাগবে ওকে। মানুষ ওকে দেখে হি হি করে হাসবে। কথাগুলো শুনেই রাগ চড়ে আছে পূর্বের। ক্লোজেট থেকে হলুদ রঙের শাড়ি বের করে পূর্ণতার সামনে রাখলো পূর্ব। গমগম গলায় বললো,

– এটা যদি না পরেছো আমি কুটিকুটি করে ডাস্টবিনে ফেলবো!

পূর্ণতাও অটল গলায় উত্তর দিলো,

– আমি শাড়ি পরবো না।
– তো কি পরবে? লুঙ্গি পরবে? তোমার বাবার লুঙ্গি আনবো?
– আমার সাথে বাজেভাবে কথা বলবেনা! একদম বলবেনা!
– কি বাজে বলেছি? হলুদের দিন মানুষ শাড়ি না পরে কি পরে? তোমার মাথায় কিসের পোকা ঢুকেছে পূর্ণ?
– তুমি আমাকে পাগল বলছো?
– আশ্চর্য! পাগল কোথায় বললাম?
– বলে অস্বীকার করছো কেন?
– আরে বাপ! মিছেমিছি নিজেকে পাগল বলছো কেন?
– কি! আমি নিজেকে পাগল বলেছি? তুমি আমাকে পাগল বলে এখন কথা ঘুরাচ্ছো? এইদিন দেখার জন্য আমি বেঁচে আছি? আমার উপর থেকে চোখ সরে গেছে তাইনা?

পূর্ব আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে। ‘ক’ থেকে ‘কলিকাতা’ বানাতে টাইম নিচ্ছে না পূর্ণতা। পূর্ব বাধ্য হয়ে পূর্ণতাকে বিছানা থেকে টেনে দাড় করায়। ভয়ংকর রাগ দেখিয়ে ধমক দিয়ে শাড়ি পরতে পাঠিয়ে দেয়। যদি বেশি দেরি করে তাহলে আজ তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিবে পূর্ব। পূর্ণতাও কাঁচুমাচু করে কিছু সময়ের মধ্যে শাড়িটা পরে বের হয়। এসেই দেখে আয়নার সামনে মেরুন রঙের পান্ঞ্জাবী পরে পূর্ব চুলে ব্রাশ করছে। বুকের উপর বোতাম খোলা। পূর্ণতা শাড়ির কুচি ঠিক করতেই ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে জানালার কাছে দাড়ালো। লনে বিশাল লাইটিং করে বড় প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। সবাইকে সেখানে দেখা যাচ্ছে। পূর্ণতা চুলের মাঝে সিথি তুলে চুল খন্ডে দুপাশে এনে আঁচড়াতে লাগলো। পূর্ব ওর পাশে এসে কখন দাড়িয়েছে খেয়াল ছিলো না পূর্ণতার। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, মানুষটা আগের তুলনায় আরো সুদর্শন হয়ে গেছে। চুলের হেয়ারস্টাইলও চেন্জ। কানের দুপাশে ট্রিম কাট। মাথার চুলগুলো জেলের কারনে খাড়া খাড়া। গালের দাড়িগুলোও শেপ। তার উপর মেরুন পান্ঞ্জাবীটা চমৎকার মানিয়েছে। পূর্ণতা চিরুনি করা থামিয়ে পূর্বের দিকে ফিরে বললো,

– তুমি আমার সঙ্গে বাইরে যেও না। আমাকে তোমার সঙ্গে মানাবে না।

পূর্ব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেঁচিয়ে উঠে,
– মানে?

পূর্ণতা মুখ নিচু করে বলে,
– আমাকে দেখতে বিশ্রী লাগে।

একমূহূর্ত যেনো বাতাসের শিরশির আওয়াজ হলো! এরপর পূর্ব ভয়ংকর রেগে গিয়ে পূর্ণতার হাতের চিরুনিটা নিয়ে বাইরে ছুড়ে মারলো। ভারী শরীর নিয়ে ভীতু চেহারায় তাকিয়ে রইলো পূর্ণতা। নিজের দিকে তাকালে পূর্বের পাশে দাড়াতে এখন বড্ড অস্বস্তিকর লাগে, এই তেতো সত্য ওকে কিভাবে বোঝাবে? পূর্ব একপা ওর দিকে এগিয়ে এসে ফোলা পেটের উপর দুহাত রাখে। পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি দিলেও পূর্ণতার চোখ ফ্লোরে আবদ্ধ তখন। পূর্ব শান্ত গলায় বললো,

– কি সমস্যা? কি নিয়ে তুমি সকাল থেকে আবোলতাবোল বলে আমার রাগ উঠাচ্ছো? কেনো এমন করছো বলোতো? শরীর খারাপ লাগছে? যদি বেশি খারাপ লাগে নিচে যেতে হবেনা। আমি আপিকে উপরে এনে হলুদ লাগিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।

পূর্ণতা মুখ তুলে পূর্বের চোখের দিকে তাকায়। বিষন্ন কন্ঠে বলে,

– একটা সত্যি কথা বলি? তুমি দয়াকরে মন খারাপ করো না। যেদিন থেকে এসেছি সেদিন থেকেই আমার মনটা কেমন কুকড়ে আছে। জানিনা, কিন্তু আমার মন বলছে কিছু একটা অঘটন ঘটবে।
– কি নিয়ে এমন মনে হচ্ছে? ফুয়াদের জন্য?
– আমি জানিনা। মনের কোথাও জোর পাচ্ছিনা। তুমি আমার কাছে থাকার পরও কেনো যে ভয়টা গ্রাস করেছে, আমি জানিনা। আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই।
– আমাকে কাল দুপুরটুকু সময় দাও??আমি এখানে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েই তোমাকে নিয়ে চলে যাবো।
– আমি আয়মানকে বা ড্রাইভারকে নিয়ে আজই চলে যাই?
– না, অসম্ভব। তুমি আমার সাথে এসেছো। আমার সাথেই যাবে। আচ্ছা এক কাজ করো, তুমি ঘুমাও। তোমার নিচে যাওয়ার দরকার নেই। আমি হলুদটা টাচ দিয়েই তোমার কাছে ফিরে আসছি। থাকতে পারবে তো? শুধু আধঘন্টা? একটু কষ্ট করো?

.

বাড়িতে মানুষশূন্য অবস্থা। সবাই লন সাইডে হৈচৈ করে তীব্র গান বাজনার মধ্যে মেতে উঠেছে। পূর্ণতা রুমের মধ্যে একা আছে। এ খবর পূর্ব ছাড়া আর কেউ জানেনা। পূর্বিকা বহুবার পূর্ণতার জন্য প্রশ্ন করলেও পূর্বের শক্ত অজুহাত ওকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। পূর্ব আধঘন্টার জন্য শুধু পূর্বিকার সঙ্গে থাকার চিন্তা করলেও মন পরে ছিলো পূর্ণতার দিকে। পূর্ণতা কখনো এমন কুসংস্কারগ্রস্ত কথাবার্তা বলেনা। আজ হঠাৎ কেনো এরকম কিছু বললো? পূর্ব নিজেকে বোঝালো হয়তো মুড সুইংয়ের জন্য এমনটার বোধ হচ্ছে। সময় যত এগুচ্ছে ততই ডেলিভারি ব্যাপারটা নিয়ে পূর্ণতা হয়তো মনে মনে ভয় পাচ্ছে। পূর্ব ভাবলো, আজই পূর্ণতাকে নিয়ে কিছু ভালো সময় কাটিয়ে ওর মনে সাহস জুগাবে।। সবচেয়ে ভালো গাইনী ডাক্তার যেহেতু তার মা, তাই খোদেজার উপর ভরসা রাখতে বলবে। এখনো ইলেকশনের প্রচার করতে কিছুদিন বাকি আছে। কাজেই সবদিক মিটমাট করে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ালো পূর্ব।

শাড়িটা আর পাল্টায়নি পূর্ণতা। তার ক্ষেপাটে পূর্বটা একবার আসলেই সে অনুমতি নিয়ে শাড়িটা বদলে নেবে তখন। পূর্ণতা চুলে হাতখোপা বাধিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো। পা-দুটো বেশ টনটন করছে। মাঝেমাঝে এমন ফুলে যায় তখন নিরুপায় হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। সবাইকে দেখার জন্য পূর্ণতার মনটা আকুপাকু করছিলো। সে ধীরে ধীরে পা ফেলে জানালার কাছে দাড়ায়। দখিন দিকের জানালায় আসলে লন সাইডের সম্পূর্ণ এরিয়া দেখা যায়। প্যান্ডেলে বাসন্তী রঙের শাড়িতে পূর্বিকা বসে আছে। একে একে সবাই এসে ওকে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। মনোযোগটা সেখানে আটকে গেলে হঠাৎ পেছন থেকে দরজা আটকানোর শব্দ আসলো। পূর্ণতা শব্দটা পেতেই লনের দিকে চোখ ঘুরায়। পূর্ব লনের কোথাও নেই। স্বস্তির ভঙ্গিতে পেছনে ফিরতেই যে দৃশ্য দেখে পূর্ণতার বুকটা ধ্বক করে উঠে! কপাল কুঁচকে চেচিয়ে বলে,

– দরজা লাগালে কেন? আর এখানে কি?

হলুদ পান্ঞ্জাবী পড়ুয়া কাঠিন্য দৃষ্টির মানুষটা কোনো উত্তর দিলো না। নির্লিপ্তে পান্ঞ্জাবীর হাতা কনুইয়ের হাড্ডিতে গুটাচ্ছে। চোখের দৃষ্টিজোড়া পূর্ণতার দিকে। পূর্ণতা নিজেকে সামলে নিলো। ভেতরের ভয়টা কোনোরকমে বাইরে প্রকাশ হতে দিলো না। ঠান্ডায় শীতল হয়ে আসছে পূর্ণতার হাত। বুকে ধড়াস ধড়াস লাফাচ্ছে। পূর্ণতা পেটের উপর হাত রেখে মনোবল শক্ত করে বললো,

– তুমি এখানে কি জন্যে এসেছো? জরুরী কোনো কথা আছে?

বাক্যদুটো ছিটকে আসতেই আবারও দরজা খুলে আরেকজন ব্যক্তি ঢুকলো। এবার পূর্ণতার ভয়টা পারদ স্কেলের উচ্চাঙ্গে পৌঁছে গেলো। এখানে আসার পর অবচেতন মনটা অমঙ্গল ব্যাপারে যে হুশিয়ারি দিচ্ছিলো তা এই দুজনের আগমনে স্পষ্ট ঠেকলো পূর্ণতার। একমনে পূর্বকে ডেকে যাচ্ছে পূর্ণতা। সাংঘাতিক বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। হঠাৎ দুজন তেড়ে এলো পূর্ণতার কাছে। সায়মা দৌড়ে জানালাটা বন্ধ করতেই গলা থেকে লেহেঙ্গার ওড়না নিয়ে পূর্ণতার মুখ বেধে দিলো। চিৎকার বা প্রতিবাদের সুযোগটুকু ওরা দিলো না! জাওয়াদ ততক্ষণে পিছু করে পূর্ণতার হাতদুটো রশি দিয়ে বাধছে। পূর্ণতা সমস্ত শক্তি দিয়েও ওদের দুজনের কাছে পারছিলো না। চোখ উপচে পানির ফোয়ারা পরছিলো পূর্ণতার। আকুতি করছিলো চোখ দিয়ে। ভাগ্য ওকে আরেকবার এমন কঠিন পরিস্থিতির কাছে ঠেলে দিবে যেখানে পূর্ব নেই, সেটা অকল্পনীয় ছিলো ওর জন্য! জাওয়াদ কতোক্ষন বিশ্রী চাহনিতে পেটের দিকে তাকিয়ে থাকলে সায়মার ধমক খেয়ে চোখ সরিয়ে ফেললো। সায়মা এগিয়ে এসে ঠাস ঠাস করে পূর্ণতার গালে চড় মারলো। চুলের খোপটা ধরে ক্লোজেটের সাথে ঠেসে ধরতেই পূর্ণতার পেটে হাত দিয়ে চাপ রেখে বললো,

– তুই ভেবেছিস আমরা ফুয়াদের কথা ভুলে গেছি? সেদিন ফুয়াদের সাথে রঙ-তামাশা করতে পারিসনি বলে পূর্বকে বেধড়ক মার খাইয়েছিস। তুই ঠিকই জানতি পূর্ণতা! তুই অবশ্যই জানতি পূর্ব ফুয়াদকে কুকুরের মতো পেটাবে! বল জানতি না?

পূর্ণতার চক্ষুকোল থেকে পানি গড়িয়ে পরলেও সায়মার দিকে শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওই জানোয়ারের জন্য প্রতিশোধ নিতে সায়মা আর জাওয়াদ এসেছে, সেটা পূর্ণতা বুঝে গেছে। পেটের উপর বীভৎস জ্বালা শুরু হলেও সহ্য করা ছাড়া উপায় ছিলো না। পূর্ণতা আর কোনোক্রমেই ওদের সাথে কথা বলছিলো না। প্রতিশোধ যদি নিতেই চায় সেটা মুখের উপর করুক, এসিড এনে মুখ জলসে দিক! তবুও যেনো পেটে কোনো ক্ষতি না করুক ওরা, মনেমনে তীব্র চেতনায় আওড়াচ্ছিলো পূর্ণতা। কিন্তু ভাগ্য হয়তো দূর্দশা দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলো।জাওয়াদ দুইমিনিটের মাথায় সায়মাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পূর্ণতার পেট বরাবর লাত্থি মারলো! সায়মা সোফায় ছিটকে যেতেই জাওয়াদের অপ্রত্যাশিত কাজে চোখ বিরাট বড় করে চিল্লিয়ে উঠে! লাত্থির জোরটা এতো বেশি ছিলো রুমের মধ্যে ঝংকারের বিকট শব্দ হয়! চাপা আর্তনাদ পূর্ণতার মুখ থেকে বেরিয়ে পরতেই ফ্লোরে লুটিয়ে পরে তৎক্ষণাৎ! সায়মা দৌড়ে এসে জাওয়াদকে থাপ্পড় মেরে পূর্ণতার কাছে ফিরে যায়। গালে ঝাকুনি দিয়ে তাড়াতাড়ি পূর্ণতার হাতের রশি খুলে সেটা সোফার তলায় ছুড়ে মারে। মুখের উপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে অনবরত ডাকতে থাকে ওকে। কোনো লাভ হয়না। সায়মা ভীষণ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,

– পূর্ণতার কিছু হলে পূর্ব আমাদের মেরে ফেলবে ভাই… তুমি এটা কি করলে?

জাওয়াদের চুপটি দেখে সায়মা এবার পাগলের মতো কথা বলতে থাকে,

– পূর্ব আমাদের ছাড়বেনা, ও কখনোই ছাড়বেনা। পূর্ব আমাদের জবাই করে ফেলবে। পূর্ণতার এই অবস্থা দেখলে ও আমাদের জবাই করবে জাওয়াদ। আমাদের বাঁচতে দিবেনা।

জাওয়াদ লাত্থিটা দেয়ার পরেই বুঝতে পেরেছে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা সে করে ফেলেছে! রাগের মাথায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লাত্থিটা দেওয়া ঠিক হয়নি। পূর্ণতা বেঁচে গেলেও পেটের বাচ্চাটা হয়তো ওমন লাত্থির জোরে আর বাচঁবেনা। জাওয়াদ মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,

– মাথা ঠিক ছিলো না। মরেছে কিনা দ্যাখ বাল! নিশ্বাস পরছে কিনা চেক কর তাড়াতাড়ি!

সায়মা পূর্ণতার নাকের কাছে আঙ্গুল রাখতেই থমকে গেলো। জাওয়াদ আরেকবার চেঁচানো সুরে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সায়মা যেনো সৎবিৎ ফিরে পেলো। জাওয়াদের দিকে কেমন নিস্তেজ ভঙ্গিতে মাথা তুলে তাকালো! তাকানোর কয়েক মিনিটের মাথায় ডুকরে কেদেঁ উঠলো সায়মা। প্রচণ্ড ভয়ে গলা দিয়ে আর কিছুই বলতে পারলোনা…

– ‘ চলবে ‘

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৫৩.
#ফাবিয়াহ্_মমো

বিকট উত্তেজনায় জমকালো হলুদের আমেজটা পন্ড হলো। পূর্বের মাথা যেনো ঠিক নেই সে এমন ভঙ্গিতে চিল্লাচিল্লি করছে। আজ পূর্বকে এমন হালেও দেখবেন তা হয়তো আশা করেনি খোদেজা। এ যেনো পূর্ব নামধারী অন্য পুরুষ! সন্ধ্যার আকাশটাও যেনো পূর্বের গুমোটপূর্ণ অবস্থার সাথে গুমড়ে যাচ্ছে। বাড়ির প্রতিটি সদস্য নির্বাক, হতবাক, বাকরুদ্ধ! পূর্ব পাগলের মতো পূর্ণতাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছে। আজ স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে গাড়ি চালাতেও পারেনি সে। প্রিয়তমাকে ওমন বীভৎস অবস্থায় দেখে ওর রূহ কেপে উঠেছে তৎক্ষণাৎ। প্রাণটা যেনো চলে যাওয়ার অপেক্ষা গুণছে পূর্বের। আয়মান গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছে। চোখ বেয়ে টলটল করে অশ্রুধারা পরছে, বুকে যেনো উত্থাল-পাত্থাল ঝড়। পূর্ব গাড়ির পেছন সিটে বসে পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে চিৎকার করছে তাড়াতাড়ি চালানোর জন্য। আয়মানের বেগতিক স্পিডের পরেও গাড়ি যেনো রাস্তা শেষ করতে পারছেনা। গাড়িতে আরো একজনের উপস্থিতি ছিলো যার অশ্রুদৃষ্টি সম্পূর্ণ মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে দেখছে। পূর্বের দফায় দফায় চিৎকার শুনে খোদেজাও পূর্বকে রণচন্ডী রূপে অপমান করতে পারছেনা। আচলে মুখ ঢেকে হু হু করে ফুপিয়ে কাঁদছে। পূর্বের কোলের উপর বেঁহুশ পূর্ণতার মাথা। পূর্ণতার মুখের উপর কারো অশ্রুজল এসে ঠেকছে। পূর্ব কখনো চিন্তা চেতনা হারিয়ে এভাবে চিৎকার করবে পূর্ণতা সজ্ঞানে থাকলে অবাক হতো। গাড়ির জানালা খোলা থাকলে রাস্তার প্রতিটা মানুষ জানতো একজন ব্যথিত ব্যক্তি তার প্রিয় জিনিস হারানোর ভয়ে চারপাশ ভুলে উন্মাদগ্রস্ত হয়েছে। খোদেজা নিজের কর্মরত হাসপাতালে পূর্ণতাকে এডমিট করিয়ে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করে। এদিকে এসেও পূর্ব থেমে থাকেনি। হাসপাতালের প্রতিটা নার্সকে সে হাতজোর করে পূর্ণতার সেবার জন্য নিয়োজিত হতে বলেছে। কোনোরূপ গাফিলতি যেনো নাহয় পূর্ণতার চিকিৎসার দিকে। খোদেজা ডাক্তারের বেশভূষা গায়ে দিয়ে ওটিতে ঢুকতে নিলে পেছন থেকে পূর্ব ওকে আকুতির সুরে বলতে থাকে,

– মা আমাকে ভেতরে যেতে দিন, আমার পূর্ণ ভেতরে একা একা কষ্ট পাচ্ছে। আমি এখানে থেকে কি করবো মা? আমাকে ওর কাছে যেতে দিন। আমার উপর রহম করুন।

খোদেজার মাথায় চট করে রুমের মধ্যে পূর্ণতার সেই রক্তাক্ত অবস্থার কথা মনে পরে যায়। ক্রোধে তিনি সকলের সামনেই এতোক্ষন যা করেননি তাই করে ফেললেন। ঠাস করে উপস্থিত সবার সামনে থাপ্পর মারলেন পূর্বকে। রাগান্বিত দৃষ্টিতে মুখের মাস্ক থুতনিতে টেনে বললেন,

– আমার মেয়ে যদি আজ মরে যায় আমি তোমার সবকিছু শেষ করে দিবো পূর্ব!

পূর্ব থাপ্পর খাওয়ার পরে মুখটা খোদেজার দিকে ঘুরিয়ে অসহায় গলায় বলে,

– আমার সবকিছু ওকে ঘিরে মা। ওর কিছু হলে আমি এমনিতেও শেষ হয়ে যাবো। আমি তো বাঁচতে পারবো না। আমাকে দয়াকরে ওর কাছে যেতে দিন। আল্লাহ্ পাকের দোহাই দিচ্ছি মা!

খোদেজা চোখ রাঙানো অবস্থায় জোর গলায় বলে,
– সামনে থেকে তোমার জঘন্য মুখ সরাও পূর্ব! আর পারলে এই হাসপাতাল থেকে বিদেয় হও! আমি কোত্থাও তোমার চিহ্নটুকু দেখতে চাইনা!

খোদেজার কঠিন জবাব শুনেই পূর্বের পেছন থেকে ওয়াসিফ পরিবার হৈহৈ করে উঠলো! পূর্বিকা তেড়ে পূর্বের পাশ কাটিয়ে খোদেজার সামনে এলো। চোখদুটো কান্নায় ফুলে গেলেও এখন সেই চোখে স্পষ্ট রাগ। পূর্বিকা চেচিয়ে উঠলো,

– আপনি বড় বলে সম্মান করছি আন্টি! কিন্তু খবরদার আমার ভাইকে আপনি অপমান করতে যাবেন না! আপনার দৌড় যে মোল্লার মসজিদ পযর্ন্ত সেই সম্পর্কে আমাদেরও ধারণা আছে! পাওয়ারের কথা বললে আমার ভাই নিজেই সেটা যথেষ্ট দেখাতে প্রস্তুত! আপনি ওকে ভেতরে যেতে দিন বলছি!

পূর্বিকার ক্রোধপূর্ণ কথায় খোদেজার শরীর জ্বলছিলো। এদিকে পূর্বের ইচ্ছে করছিলো ঠাটিয়ে পূর্বিকার গালে মারতে! বড় বলে আজ পযর্ন্ত খোদেজার কটু কথার কোনো ভারি জবাব দিলো না, সেখানে বড়বোন এসেই অসম্মান করছে। পূর্ব রেগে গিয়ে ওর দিকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

– তোকে আমার সাইড কথা নিয়ে বলতে বলেছি? সামনে থেকে যা!

পূর্বের গর্জে উঠা কন্ঠ শুনে পূর্বিকা কিছু বলতে যেয়েও বললো না। ঠোট ফুলিয়ে আবার কেদেঁ দিতেই পিছিয়ে গেলো। খোদেজা যেই পা ঘুরিয়ে থিয়েটারে ঢুকবে ওমনেই পায়ের কাছে ভার অনুভব হলো তার। মাথা নিচে ঝুকাতেই সাথে সাথে সে পা পিছিয়ে ফেললো। পূর্ব হাটু গুজে পা ধরে মিনতি করছে ভেতরে যাওয়ার জন্য। পেছন থেকে পুরো পরিবার সেটা অশ্রুচোখে আশ্চর্য দৃষ্টিতে দেখছে। পলাশ ওয়াসিফ ছেলের অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে বুকে চাপড় মারতে নিলে তাড়াহুড়ো করে আয়েশা সেটা থামিয়ে দেয়। খোদেজা সবার দিকে দৃষ্টি ফেলে শেষে ভেতরে ঢুকে গেলেন তিনি। পূর্ব তখনও ফ্লোরে হাটু মুড়ে ওটির বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়েছিলো। খোদেজার নিষ্ঠুর আচরণে বুকের ভেতরটা আরো দগ্ধ হচ্ছিলো ওর।

আয়মান পূর্ণতার বাবার সাথে পূর্ণতাকে রক্ত দেওয়ার জন্য অন্য কক্ষে গিয়েছিলো। এসেই তারা জানতে পারেন খোদেজা আরো একবার নিজের মেয়ের জামাইকে বিশ্রীভাবে অপমান করেছেন। পূর্ব সেই থেকে চুপচাপ। সবাই যার যার আসন নিয়ে সিটে বসে কাঁদলেও পূর্ব ওটির দরজায় হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। চোখদুটো বন্ধ থাকলেও দুইকোণা থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছিলো।আয়মান সবার অবস্থা একপলক চেয়ে দেখতেই পূর্বের পাশে গিয়ে সেও হেলান দিয়ে বসলো। পূর্ব চোখ খুলে বামে তাকিয়ে আয়মানকে দেখতেই আবার মূখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। খানিকক্ষন বাদে আয়মান পূর্বের কাধে হাত রেখে বললো,

– পূর্ব ভাই, টেনশন করবেন না। দুজনই ভেতরে দুজন সুস্থ থাকবে।

পূর্ব কান্নায় জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে চোখ বন্ধ করা অবস্থায় বললো,
– আমি শুধু ওকে চাই। আমার বুকটার মধ্যে ও ফিরে আসুক আমি আর কিচ্ছু চাইনা।

আয়মান আর কথা বাড়ালো না। পূর্ণতার অবস্থা স্বচক্ষে দেখার পর মনটা কোনোভাবেই শক্ত হতে চাইছেনা। আজ কতমাস পর চোখ উপচে পানি পরছিলো জানা নেই। শ্রেয়ার মৃত্যুর পর আজ পূর্ণতার জন্য বুকের ভেতরটা পুরে যাচ্ছিলো। কোনো অশান্ত আগুন যেনো সবকিছু ছাড়খার করে দিচ্ছিলো ওর। এদিকে সায়মা নিঃশব্দে কেদেঁ গেলেও সেটা শুধুমাত্র পূর্বের ভয়ের কারনে হচ্ছিলো। জাওয়াদের অবস্থা আরো করুণ! জীবনে এতোটা ভয় আগে কখনো পায়নি যতটা সে পূর্বের কারনে পাচ্ছে। পূর্ব যদি ভুলেও সত্যটা জানতে পারে হিংস্র শেয়ালের মতো ছিড়ে ফেলবে। সায়মা যখন পূর্ণতার দম আছে কিনা চেক করছিলো তখনই পূর্ণতার নিশ্বাস খুব কম পরছিলো। সায়মা সেটা দেখেই অনবরত কাঁদতে থাকলেও জাওয়াদ সেখানে দূধর্ষ একটা বুদ্ধি আঁটে। পূর্ণতার পায়ের কাছে পানি ঢেলে জগ ভেঙ্গে রাখে। সবাই যেনো রুমে এলে এটাই ভাবে পূর্ণতা পা পিছলে পরে গেছে। এরপর সায়মাকে সেখান থেকে নিয়ে পালিয়ে যেতেই কিছু সময় বাদে পূর্ব রুমে ঢুকে। ওর এক চিৎকারেই পুরো বাড়ির অবস্থা একদম নাস্তানাবুদ! কেউ আর লনসাইডে বসে থাকার সাহস জুটাতে পারেনি। একছুটে এসেই দেখে, পূর্ণতার মাথা বুকে চেপে পূর্ব পাগলের প্রলাপ করছে।

.

টিকটিক করে সময় পেরিয়ে গেলো দুঘন্টা। ওটি থেকে এখনো বের হয়নি খোদেজা। মাঝেমাঝে কিছু নার্স নানা সরন্ঞ্জাম নিয়ে আসা-যাওয়া করলেও পূর্ব ওদের ডেকে বিরক্ত করেনি। পলাশ ওয়াসিফ ছেলের কড়া আদেশের কাছে নিচু মুখ করে বাড়িতে ফিরতে বাধ্য হলেন। পরশ ও পলক ওয়াসিফ বড় ভাইকে নিয়ে মাইক্রো গাড়িতে রওনা হলেও পূর্বকে বারবার বলে গেছেন যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো সময় কল দিয়ে বলতে। পূর্ব সেটাই হ্যাঁ বোধকে ইশারা করে বিদায় জানায়। পূর্বিকা আর যেতে পারেনি পূর্ণতার জন্য। হাসপাতালে এখন শুধু আয়মান, পূর্বিকা, পূর্ব। সময় যতো এগুচ্ছিলো পূর্বিকার ফুপানো কান্না ততই পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতা করছিলো। আয়মান অনেক বুঝিয়েও পূর্বিকাকে থামাতে পারেনি। হঠাৎ আয়মানের অশ্রুচোখ থম মেরে কোথাও আটকে যায়! পূর্বের পায়ের দিকে তাকিয়ে অস্থির কন্ঠে পূর্বের কাধ ধরে বলে,

– ভাই রক্ত পরছে। আপনি আর দাড়িয়ে থাকবেন না!

পূর্ব আয়মানের দৃষ্টি লক্ষ করে নিজের পায়ের দিকে তাকায়। ডানপায়ের ক্ষত থেকে আবার রক্ত পরছে ওর। দুটোদিন যাবৎ পায়ের উপর যেভাবে ধকল নিয়েছে হয়তো ক্ষত জায়গাটা আবার কাচা হয়ে রক্ত ঝরছে। পূর্ব শান্ত দৃষ্টিতে ব্যথিত গলায় বলে উঠে,

– তোমাকে অনুরোধ করছি আয়মান, দয়াকরে আমার শরীরের দিকে খেয়াল রাখা বন্ধ করো। ওটিতে যে মৃত্যুর জন্য যুদ্ধ করছে তাকে বলো আমার কাছে ফিরে আসতে। আমি তাকে পেলেই সুস্থ হয়ে যাবো। আমি এখানে বসে নিশ্বাস নিতেও কষ্ট পাচ্ছি। সে আমাকে বুঝতে চাইছেনা। ওকে বলো আয়মান। ওকে আমার কাছে ফিরতে বলো।

আয়মান স্থিরদৃষ্টিতে ঠোঁট কামড়ে দাড়িয়েছিলো। এই ভাঙ্গাচুরা ব্যক্তিত্বের পূর্বকে সে চিনতেই পারছেনা। এই মানুষটার নাম শুনলেই চোখের পর্দায় এক বলিষ্ঠ চেতনার নেতৃত্বাধীন চেনামুখ ভেসে উঠে, আজ সেখানে তার মুখ কান্নায় জর্জরিত। পূর্বিকা দ্রুত উঠে গিয়ে পূর্বের পায়ের কাছে বসে পরলো। তার হাতে যে রুমালটা ছিলো সেটা দিয়ে তাড়াতাড়ি পূর্বের পা মুছতে লাগলো। পূর্ব হুলস্থুল আকারে চেঁচাচ্ছে, পূর্বিকা শুনছেনা। আয়মানও হঠাৎ দৌড়ে গেলো লিফটের দিকে। পূর্ব নিরুপায় হয়ে ফ্লোরে বসে খপ করে পূর্বিকার হাত ধরে আটকালো। রাগত স্বরে চোখ গরম করে বললো,

– ছোট ভাইয়ের পা ধরে পূন্য কামাতে চাচ্ছিস? থাপ্পর খেতে চাস? কেনো এমন করছিস? উঠ বলছি। এখুনি উঠবি।

পূর্বিকা হাত ঝাড়া দিয়ে পূর্বের উদ্দেশ্যে বললো,

– তুই যদি বড় বোনের গায়ে হাত তোলার স্পর্ধা দেখাতে পারিস, তো আমি কি পারবো না? পা দেখতে দে পূর্ব। রক্ত পরছে সেটা মুছতে দে। হাত সরা।
– তুই আমার উপর হুকুম করছিস আপি?
– আমি তোর একবছরের বড়! সাবধানে আমার সাথে কথা বলবি। পা দেখতে দে।

পূর্বিকা জোর করে রক্ত মুছে দিলেও আয়মানের আনা ঔষুধ সে লাগালো না। পূর্ণতার জন্য সেই একই ভঙ্গিতে পায়চারি করতে থাকলে কিছু সময় পর ওটি থেকে বেরিয়ে আসে খোদেজা। খোদেজার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে চোখের পাতা ভীষন ভারী, বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া ফর্সা গালটা লাল। পূর্ব ছুটে গিয়ে খোদেজাকে অস্থির হয়ে বললো,

– মা.. মা ও কেমন আছে? ওকে একবার দেখা যাবে? আমি একটু ভেতরে যেতে চাই মা। আমাকে ওর অবস্থার ব্যাপারে বলুন!!

খোদেজার ক্রোধদৃষ্টি তখন পূর্বের দিকেই নিষ্পলক ছিলো। পূর্বের দিকে তাকিতে তিনি মাস্কটা টেনে খুললেন। ক্ষুদ্ধ গলায় বললেন,

– আজ থেকে ও তোমার কাছে মরে গেছে।আর কখনোই তুমি ওর কাছে যাওয়ার দুঃসাহস দেখাবেনা ওয়াসিফ পূর্ব! আমার একমাত্র সোনার টুকরোকে তুমি আর কোনোদিন দেখবেনা!

বলতে বলতেই হু হু করে কেদেঁ উঠলেন খোদেজা। কান্নার উচ্চাশব্দে পূর্ব পাথরের মতো তাকিয়ে থাকলে আয়মান ও পূর্বিকা সাথেসাথে দৌড়ে আসে। আয়মান উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

– আন্টি, পূর্ণতা কেমন আছে? আন্টি কাদবেন না প্লিজ! পূর্ণতার খবরটা বলুন! ও কেমন আছে?

খোদেজা কাদতে কাঁদতেই নাক টেনে আয়মানের দিকে তাকালেন। আয়মানের বুকে মাথা রেখে ফের কেদেঁ উঠলেন তিনি। আয়মান হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো! হাত পায়ে কাটা দিচ্ছিলো ওর। ঢোক গিলতেও পারছেনা সে। খোদেজার মাথাটায় হাত রেখে স্তব্ধ কন্ঠে উচ্চারণ করলো,

– আন্টি, পূর্ণতা..?

খানিকটা সময় বাদে মুখ খুললেন খোদেজা। চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললেন,

– পূর্ণতার বাচ্চাটা পেটেই মরে গেছে আয়মান। বাচ্চাটা বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বাচ্চাটা পূর্ণতার শরীরের সব শক্তি নিয়ে চলে গেছে। আমার কলিজার টুকরাটার শরীরে একটুও রক্ত রাখেনি। জীবনে এই দিনও যে দেখতে হবে আমি মা হয়ে ভাবতে পারিনি গো আয়মান। আমার মেয়েটা অবচেতন অবস্থায় কি পরিমাণ কাতরাচ্ছিলো…আমার বুকটা ছিড়ে যাচ্ছিলো ওই অবস্থা দেখে। এই জানোয়ার আমার মেয়েটাকে বিয়ের পর শান্তি দেয়নি। ওকে একটুও শান্তি দেয়নি।

খোদেজা আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। পূর্ণতার বিবরণ শুনে পূর্বের বুকটা ঝাঁজরা হয়ে যাচ্ছিলো। সে না পারছিলো চিৎকার করে কাঁদতে, না পারছিলো নিজেকে শেষ করতে। ভাগ্য এমনভাবে পরিহাস করলো অকল্পনীয় ছিলো পূর্বের কাছে। পূর্ব বহুকষ্টে নিজের ভেতর শক্তি জুগিয়ে বললো,

– আমাকে একবার ওকে দেখতে দিন মা। আমি শুধু একবার ওর মুখটা দেখবো। এরপর আপনি আমাকে যা শাস্তি দিবেন আমি মেনে নিতে প্রস্তুত। আমার মতো অধমের উপর শেষবার কৃপা করুন মা।

খোদেজা ইচ্ছে করছিলো আরো কয়েকটা চড় বসিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে পূর্বকে বের করে দিতে। কিন্তু আয়মানের অনুরোধে তিনি ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেও সেখানে শর্ত জুড়ে দিলেন শাস্তিস্বরূপ যা বলবেন তা পূর্ব যেনো মেনে নেয়। পূর্ব আপাতত সেটাতে রাজি হয়ে গেলে পূর্ণতাকে দেখার সুযোগ পায় রাত একটার দিকে। পূর্ণতাকে নরমাল প্রাইভেট কেবিনে শিফট করলে পূর্ব কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে যায়। সাদা বেডের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে পূর্ণতা। হাতে নানাপ্রকার নল লাগানো। অন্যহাতে স্যালাইনের তীক্ষ্ম সূচের নল ঢুকানো। সাদা রঙের পাতলা কাথাটা পেট পযর্ন্ত ঢেকে দেওয়া। পায়ে পায়ে হেঁটে এসে বেডের উপর বসলো পূর্ব। লালবর্ণের অশ্রুপূর্ণ চোখদুটো পূর্ণতার বেহুশ মলিন মুখের উপর আটকে আছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে পূর্ব। তার শ্বাস নিতে বুকে ভার অনুভব হচ্ছিলো। পূর্ণতার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে পেটের উপর দৃষ্টি আটকে গেলে মাথা নুয়ে মুষড়ে কেদেঁ দেয় পূর্ব। সন্ধ্যায় পূর্ণতা কতকিছু শোনালো এই ফোলা অবস্থার জন্য। কোথায় গেলো সেই অনাগত মানুষটা? চার দেয়ালের কেবিনের ভেতর পূর্ব নিজেকে সামলাতে পারছিলো না। চিৎকার করে কেদেঁ বলছিলো,

– কেনো আমার সাথে এই কাজ করলে খোদা? কি দোষ আমার? দুনিয়ায় কি পাপ করেছিলাম যার খেসারত আমার প্রিয়তমাকে এভাবে চুকাতে হলো? আমার সন্তানটার কি অপরাধ ছিলো এই দুনিয়ায়? ওকে কেনো সহ্য করতে হলো? আমাকে শরীরের সবকিছু নিয়ে যেতে তবুও আমার দুজন মানুষকে সহি-সলামত ফিরিয়ে দিতে? আমি কি মুখ নিয়ে পূর্ণর সামনে দাড়াবো?

পূর্ব নিজেকে সামলাতে সক্ষম হচ্ছিলো না। গম্ভীর, রাশভারী চেহারার আদল বদলে গিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ, দিশেহারা চেহারা বেরিয়ে আসছিলো।। পান্ঞ্জাবীর হাতায় চোখ ডলে পূর্ণতার পেটের উপর হাত রাখলো পূর্ব। স্ফীত হয়ে আসা পেটটা আগের মতো হয়ে গেছে। পূর্ব সেখান থেকে হাত সরিয়ে পূর্ণতার বিষণ্ণ মুখটার কাছে গেলো। গালে হাত রেখে কপালে, বদ্ধ চোখের পাতায়, গর্তময় থুতনিতে ঠোঁটে ছুঁয়িয়ে দিলো। পূর্ণতার শুষ্ক চৌচির ঠোঁটে নিজের ঠোঁটজোড়া এগিয়ে নিবে হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। পূর্ব মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে খোদেজা। পূর্ব দ্রুত বেড থেকে উঠে দাড়ালো। খোদেজা মেয়ের দিকে একপলক তাকিয়ে পূর্বকে ইশারা করলো রুমের এককোণায় আসতে। পূর্ব কিছুই পারছিলো না খোদেজা কেনো এখন কথা বলতে চাইছে। পরক্ষনে খেয়াল হলো, হয়তো শাস্তির কথা বলবে। খোদেজা শক্ত চাহনিতে পূর্বের মুখোমুখি দাড়িয়ে বার্তা পেশ করলো,

– আশাকরি আমার মেয়েকে মন ভরে দেখেছো। ও একদম সুস্থ নেই। মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে। সামনে তোমার ইলেকশনের প্রচার শুরু হবে। তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে দেশের জন্য কিছু করার। কিন্তু ওয়াসিফ পূর্ব, একজন মা-কে তুমি আশ্বাস দিতে পারবে? তুমি যে সামনে ইলেকজনের জন্য লড়াই করবে সেখানে আমার মেয়েটা কি তোমার কাছ থেকে সুখটা পাবে? আজ আমি একজন মেয়ের মা হয়ে কথাগুলো বলছি পূর্ব। একজন ডাক্তার হয়ে বলছিনা। আমি ওর উপর কড়াকড়ি করলেও কখনো এমন হালে ফেলে দেইনি যাতে ও মরে যাবে। কিন্তু তোমার কাছে যাওয়ার পর আমার মেয়েটা বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। কি করেছো তুমি ওকে বলো? আজ তুমি কিভাবে ওর প্রতি অযত্ন করলে?

পূর্ব হাত ভাঁজ করে সব কথা চুপচাপ শুনলো। এরপর শান্ত মেজাজে বললো,

– মা আপনি আমাকে উত্তম শাস্তি দিতে পারেন। আজ আমি এটাও স্বীকার করছি ওকে আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। কি শাস্তি আমার জন্য উপযুক্ত আপনি বলুন,
– তোমার প্রচারণার কাজ কবে থেকে শুরু?
– হাতে কিছুদিন সময় আছে মা।

খোদেজা একটু চুপটি থেকে কিছু ভাবলেন। এরপর পূর্বের দিকে কঠিন গলায় বললেন,

– তুমি এমপি পদপ্রার্থীটা ছেড়ে দাও। যদি তুমি আমার মেয়েকে নিজের জীবনে আগের মতোই ফিরে পেতে চাও তাহলে তোমার রাজনীতি ছাড়তেই হবে।।

পূর্ব হকচকিয়ে যায় খোদেজার কথায়। আশ্চর্য দৃষ্টিতে তীব্র উৎকন্ঠায় বলে উঠে,

– অসম্ভব মা! আপনি আমায় এ কেমন শাস্তি দিচ্ছেন? আপনি নিজে একজন সমাজসেবিকা হয়ে আরেকজনকে সেবা ছাড়তে বলছেন?
– আমি তোমার পেশায় নিয়োজিত নই পূর্ব। নিজের কর্মের সাথে আমার পেশা তুলনা করতে আসবেনা।
– ঠিক বলেছেন। তুলনা হয়না। আপনারটা শুধু রোগের চিকিৎসা হয়। কিন্তু আমারটা অন্নকষ্টের চিকিৎসা, রাস্তার চিকিৎসা, জলাবদ্ধতার চিকিৎসার সহ সমাজের সকল চিকিৎসা করা লাগে। আপনি খুবই নিচুমনের শাস্তি দিচ্ছেন মা! আমার শত্রুদের তুলনায়ও আপনার শাস্তি গর্হিত! আপনি আমার কাছ থেকে আমার স্ত্রীকে আলাদা করতে চাইছেন না?

পূর্ব জোর গলায় প্রশ্নটা ছুড়েই পূর্ণতার বেডের দিকে একপলক তাকালো। এরপর মুখ ঘুরিয়েই আগের সেই বলিষ্ঠ রূপে জবাব দিলো,

– আমি আপনার শাস্তি মেনে নিলাম মা। পারিবারিক এবং রাজনৈতিক দুটোর মধ্যে আমি রাজনীতিটাই পছন্দ করলাম। আজ আপনি আমার কাছ থেকে জিতে গেলেন অবশ্য। কিন্তু আপনাকে আমি এটুকু নিশ্চয়তা দিচ্ছি, পূর্ণতা আমাকে ছাড়া আপনার কাছে শান্তি পাবেনা।

খোদেজার প্রতিক্রিয়াটুকু পূর্ব আর দেখলো না। পা চালিয়ে পান্ঞ্জাবীর হাতায় চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। খোদেজা ওর যাত্রার দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকে মনেমনে বললো, হায় পূর্ণতা! তুই হুঁশে থাকলে বুঝতি, এই মানুষটা আবারও তোকে ধূলো দেখিয়ে চলে গেলো। তুই কার জন্য পাগলামি করেছিলি? ও তোকে কখনো ভালোই বাসেনি। সময়ের উত্তেজনায় তোকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।

.

সময়টা বিকেল। কোনো সাড়াশব্দ নেই আশেপাশে। কয়েকটা কাক কুৎসিত গলায় ‘কা কা’ করে উদাস ভঙ্গিতে আকাশে উড়ছে। সেই শব্দটাই কানে তীব্রভাবে এসে ঢুকছে। পূর্ণতা অনেক কষ্টে চোখের পাতা টেনে খুললো। আশেপাশের সবকিছু দেখে বেশ সময় নিয়ে বুঝতে পারলো সে এখন হাসপাতালে। চারধার থেকে হাসপাতালের ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগছে। মাথাটা ডানে কাত করে থাই জানালার দিকে তাকালো। মাথাটা এখনো ঝাকুনির মতো লাগছে। শরীর অত্যধিক মাত্রায় দূর্বল। হাতের আঙ্গুল নাড়াতেও শরীরে ধকলের মতো ঠেকছে। হঠাৎ একজন নার্স এসে বেডের কাছে দাড়িয়ে বললো,

– ম্যাম আপনি কেমন বোধ করছেন? খারাপ লাগছে?

পূর্ণতা মাথাটা না বোধকে মৃদ্যু নাড়াতেই চোখের কোটর থেকে একফোটা পানি গড়িয়ে পরলো। ঠোঁটে নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে পূর্ণতা কিন্তু দূর্বলতার জন্য শব্দের জোরটা হচ্ছেনা। নার্স ওর মুখের কাছে ঝুকতেই শুনলো,

– পূর্ব কোথায়? আমার কাছে পাঠিয়ে দিন।

নার্স পূর্ণতার মুখের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর উঠে দাড়িয়ে চুপচাপ খোদেজাকে ডেকে কেবিনে পাঠালো। খোদেজা এসে পূর্ণতাকে প্রথমে কিছুই বললেন না। কিন্তু সময় যত যাচ্ছিলো পূর্বকে না দেখতে পেয়ে পূর্ণতার বেচেইন মন তত উদগ্রীব হয়ে যাচ্ছিলো। ইচ্ছা করেই খোদেজা কিছুদিন ওকে ঘোরের মাঝে রাখলেও পূর্ণতা যখন একটু সুস্থ বোধ করে সেদিনই জানিয়ে দিলেন পূর্বের ব্যাপারে।

– ও তোকে ছেড়ে এমপির ইলেকশন লড়ছে পূর্ণতা। তুই এখানে মরে গেছিস কিনা এতোদিন সেটাও খোঁজ করেনি। আশাকরি তুই বুঝে গেছিস তুই কেমন মানুষকে নিজের জীবনে জড়িয়েছিলি। তোর থাকা না-থাকা ওয়াসিফ পূর্বের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না। তুই ওকে যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবি তৌর জন্য মঙ্গল। আর যদি পাগলামি করতে চাস, করতে পারিস। আমি কোনো বাধা দেবো না।

পূর্ণতা সেই সত্যটা শুনে স্তব্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে পারছিলো না। পূর্ব ওকে ছেড়ে রাজনীতিতে পরিপূর্ণভাবে যুক্ত হয়েছে শুনে কাউকে আর প্রশ্নবিদ্ধ করলো না। পূর্ণতা নিজের মনে ভেবে নিলো হয়তো পূর্বের রাজনৈতিক কার্যকলাপে এতোদিন কাটার মতো বিদ্ধ ছিলো, যেটা এই ঘটনার জন্য সরে গেছে। নিজের কপালের উপর তাচ্ছিল্যরূপে হাসলো পূর্ণতা। পূর্বের সিদ্ধান্ত শুনে সেও আর পূর্বের জীবনে বিশৃঙ্খলা করতে চাইলো না। পূর্ব যদি শান্তিমতো থাকতে পারে তাহলে পূর্ণতা ওর দিকে ফিরেও তাকাবেনা! কখনোই না!

পূর্ণতা দীর্ঘদিনের চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে উঠলে একদিন খোদেজাকে না জানিয়ে আয়মানের সঙ্গে ওয়াসিফ ভিলায় যায়। পূর্ব এতোদিনের মধ্যে একটাবারও পূর্ণতাকে একনজর দেখতে আসেনি। প্রত্যেকটা রাত পূর্ণতা ছটফট করে নির্ঘুম কাটাতো পূর্বের জন্য। আশার প্রদীপ নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতো এইতো পূর্ব আসছে। কিন্তু পূর্ব কখনো আসতো না। ধীরে ধীরে পূর্ণতার নরম মনে অভিমানের স্তরটা পুরু ও মোটা হতে থাকে। সে নিজেই আর পূর্বের জন্য আশা রাখার পাগলামি করলো না। নিজের আত্মগরিমা নিয়ে প্রচণ্ড কঠোর হতে শুরু করলো সে। আবেগ, আহ্লাদ, শখ, আশাকে সে পূর্ববিহীন করতে লাগলো ধীরেধীরে। যেখানে পূর্বই ওকে ছাড়া ভালো থাকছে সেখানে পূর্ণতা আর দ্বিতীয়বার যাওয়ার মতো ভুল করবেনা।

পূর্ণতা ওয়াসিফ ভিলায় প্রবেশ করলে সেখানকার পরিবেশ দেখে আর বুঝতে বাকি রইলো না এখানেও কারো মনে শান্তি নেই। পলাশ আরেকদফায় যে হার্ট এ্যাটাক করেন এতে চিরকালের জন্য প্যারালাইসিস হয়ে গেছেন। আয়েশা আর্থাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শায়িত। চাকর ছাড়া তিনি ফ্লোরে পা পযর্ন্ত রাখতে পারেন না। পূর্বিকা এতোদিনে শ্বশুরবাড়িতে পাড়ি জমিয়ে স্বামীর সাথে বিদেশে গমন করেছে। এদিকে চাচীরা কেউ বাড়িতে নেই। তারা কোথায় আছেন জানতে সেটা চাকরকে জিজ্ঞেস করলে তারা জানায় জাওয়াদ দীর্ঘ একমাস যাবৎ হাসপাতালে। সেখানেই চাচীরা আছেন। জাওয়াদকে কাঁচের চূর্ণিত মোটা চাবুক দিয়ে কে যেনো পিটিয়েছে। কোন ব্যক্তি পিটিয়েছে সে সম্পর্কে কেউ জানেনা আজো। সায়মা মেন্টাল হসপিটালে এডমিট হয়েছে সপ্তাহ দুয়েক আগে। এতোদিন সাইক্রিয়াটিস্ট দেখিয়েও ওকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি বাড়িতে। একের পর এক চান্ঞ্চল্যকর খবর শুনে শিউরে উঠছিলো পূর্ণতা। অজান্তেই ওর বুকে ধুকপুক ধুকপুক করছিলো ঘটনা শুনে। সব ঘটনার সমীকরণ মিলিয়ে যেটা আচঁ করতে পারলো সেটা বুঝার পর থেকে আর একসেকেন্ডও সেখানে থাকলো না। ওয়াসিফ ভিলা থেকে একপ্রকার পালিয়ে এলো পূর্ণতা। আয়মান অনেকবার জোর করলো কি হয়েছে সেটা খুলে বলতে। কিন্তু পূর্ণতা কোনোভাবেই সেটা বললো না। মায়ের কাছে সেই নয়তলার বিল্ডিংয়ে ফিরে এলো সে। পূর্ব সারাদিন বাসায় ছিলো না। রাতে যখন বাসায় ফিরলো তখন পূর্ণতা এসেছে শুনে কোনো বিশেষ ভাবাবেগ দেখা গেলো না। ‘কিছুই হয়নি’ ভঙ্গিতে নিজের রুমে যেয়ে শুয়ে পরলো। চাকররা অবাক হয়েও পূর্বের কর্মকাণ্ড দেখে ভাবতে পারলো না, এই কি সেই পূর্ব? যে শুধুমাত্র পূর্ণতার কথা চিন্তা করে অসুস্থ বাবাকেও একা ফেলে দূরে পাড়ি জমিয়েছিলো?

রাতের খাবার খেয়ে পূর্ণতা বিছানায় শুতেই আয়মানের কল এলো। সে বালিশে মাথা হেলিয়ে কল রিসিভ করে বললো,

– কিরে কল দিলি যে? কিছু বলবি নাকি?

আয়মানের নিষ্প্রভ উত্তর,

– তুই কিছু শুনেছিস পূর্ণতা?

পূর্ণতা কিছুটা কৌতুহল গলায় বললো,
– কিসের ব্যাপারে?

আয়মান হঠাৎ চুপ করে গেলো। পূর্ণতা সাথেসাথে বিছানায় উঠে বসে ওকে প্রশ্নের ফোয়ারা ছুড়লো,

– তুই কিছু বলবি? কোন ব্যাপারে বলতে চাচ্ছিস? কি হয়েছে সেটা বলতে হিমশিম খাচ্ছিস কেন?

আয়মান এবার অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে বেশ উদ্বেলিত কন্ঠে বললো,

– জাওয়াদ কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে। খবর পেলাম।

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO