তোকে চাই পর্ব-১২

0
1640

#তোকে_চাই
#পার্ট_১২
#লেখনীতে_সুহাসিনী_চৌধুরী(ছদ্মনামের লেখিকা)

শিরিনের কথা শুনে ইব্রাহিম হোসেন প্রচন্ড পরিমাণে রেগে গেলেন।তিনি তেড়ে গেলেন শাহেদের কাছে।

“তোর এতো বড় সাহস,তুই আমার সন্তানের খুনি বানিয়েছিস আমাকে।”

এই বলেই শাহেদের নাক বরাবর ঘুসি দিলেন ইব্রাহিম হোসেন।

“ইব্রাহিমমমমমমমমমন”

রিক্তর দাদুর চিৎকারে সবাই কেঁপে উঠল।

“তোমার সাহস হয় কি করে আমার ছেলের গায়ে হাত দেওয়ার?”

“বাহ বাহ শশুর মশাই বাহ!আপনার ছেলেকে মেরেছি বলে এতো কষ্ট হচ্ছে?আর আপনার ছেলে যে আমাকে আমার সন্তানের খুনি বানিয়েছে তাতে কিছুনা তাইনা?”

“তুমি কোন সন্তানের কথা বলছো হ্যা?যে সন্তানকে তুমি অবৈধ সন্তানের আখ্যা দিয়ে আমার মেয়েকে বিয়ের আসরে সবার সামনে নষ্টা অপবাদ দিয়ে চলে গেছিলে।সেই সন্তানকে আজ নিজের সন্তানের পরিচয় দিচ্ছো কেন?”

রিক্তর দাদুর কথা শুনে ইব্রাহিম হোসেন বলতে লাগলেন আজ থেকে প্রায় ২৭বছর আগের কথা…..

২৭ বছর আগে….

সেদিনটা ছিল আমার আর শিরিনের বিয়ের রাত।বিয়ে পরানোর সময় হঠাৎ করেই শিরিন মাথা ঘুরে পড়ে যায়।তৎক্ষনাৎ ওকে দেখতে আসে ডক্টর।আর ডক্টর ওকে দেখার পর যা বলে তার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।ডক্টর বলে যে শিরিন সারে তিন মাসের প্রেগন্যান্ট।যা শুনে আমি মুহূর্তের মধ্যেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।মেনে নিতে পারিনি এই কথাটা।কারণ আমার জানামতে শিরিন আর আমার তিন বছরের রিলেশনশিপে আমরা কখনো ফিজিক্যালি ইনভল্ভ হয়নি।তাই সেদিন আমি রাগের বশবর্তী হয়ে শিরিনকে অনেক বাজে কথা বলে ফেলি।একবারো ওর কথাটা আমি শুনিনি।সেদিন হয়তো ওর কথাটা শুনলে আমি আমার স্ত্রী,সন্তানকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারতাম।

বিয়ের আসর থেকে চলে এসে তার পরেরদিন রাতের ফ্লাইটেই আমি চলে যায় মুম্বাইয়ে।সেখানেই নিজের বিজনেস শুরু করি।শুরু হয় আমার নতুন পথচলা।বাবা-মা অনেকবার বলেছিল দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে।কিন্তু আমি পারিনি শিরিনের জায়গায় অন্য কারো স্থান দিতে।তাই আর কখনো বিয়ে করিনি আমি।

হঠাৎই একদিন আমাকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ওয়াজেদ ফোন করে।আর বলে,

“তুই মস্ত বড় ভুল করেছিস ইব্রাহিম।”

“মানে?কি বলতে চাইছিস তুই?কিসের ভুল?”

“শিরিনের পেটে বেড়ে ওঠা যে সন্তানকে অবৈধ বলেছিস সেটা যে তোরই সন্তান!”

“কি বলছিস তুই এসব?ওর সাথে আমি কখনো ফিজিক্যালি ইনভল্ভ হয়নি।তো বাচ্চাটা কি করে আমার হতে পারে?”

“তোকে একটা কথা জানানো হয়নি।তোদের থার্ড রিলেশনশিপ অ্যানিভার্সারিতে তুই যে পার্টি দিয়েছিলি সেখানে তুই অতিরিক্ত ড্রাংক থাকার ফলে শিরিনের সাথে ফিজিক্যালি ইনভল্ভ হয়ে পরিস।শিরিন অনেক চেষ্টা করেও তোকে আটকাতে পারেনি।তখন এই কথাটা শিরিন শুধু আমাকে আর তোর ভাবি আনিকাকে জানায়।আনিকা ওকে বুঝিয়ে শান্ত করে আর বলে সেই রাতের কথাটা তোকে বলে দিতে।তখন শিরিন বলে যে,তুই নাকি ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিস।তাই শিরিন বিয়ের রাতেই এই কথাটা তোকে বলবে।এর মধ্যেই একদিন শিরিন আমার হসপিটালে আসে।আনিকা যেহেতু একজন গাইনি স্পেশালিষ্ট তাই ওর কাছে এসে সবটা বলে শিরিন যে ওর বেশ কয়েকদিন ধরেই মাথা ঘুরায়,বমি বমি পায়,টক খেতে ইচ্ছে করে খুব।এসব শুনে আনিকা তখনি শিরিনের টেস্ট করে।আর রিপোর্টে আসে শিরিন প্রেগন্যান্ট।এটা শুনে শিরিন খুশিতে আত্মহারা হয়ে পরে।শিরিন তখনি তোকে এসব জানাতে চেয়েছিল।কিন্তু আমি আর আনিকা ওকে বলি এই কথা সারপ্রাইজ হিসেবে তোকে বাসর রাতে বলতে।আর সেটাই কাল হয়ে দাড়ায় তোদের জীবনে।সত্যি বলতে সেদিন বিয়েতে আমি আর আনিকা উপস্থিত থাকলে এমন কিছুই হতোনা।সবটা তোকে তখনি বলে দিতাম।কিন্তু আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী যেহেতু ডক্টর।তাই বিয়ের কিছুদিন আগেই আমাদেরকে একটা অপারেশনের জন্য দিল্লি যেতে হয়।সেখানে গিয়ে আটকে যায় আমরা।যার ফলে প্রায় সাত মাস ওখানের থাকতে হয় আমাদের।আর আমরা গতকালই দেশে ফিরেছি।আর ফিরেই এসব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছি।”

ওয়াজেদের কথাগুলো শুনে সেদিন আমি সর্বপ্রথম কেঁদেছিলাম।হ্যা,আমি নিজের পরিস্থিতি দেখে কেঁদেছিলাম।যাকে কিনা আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি সেই শিরিনকেই আমি ভরা বিয়ের আসরে যা নয় তাই বলেছি।নষ্টা মেয়ের তকমা লাগিয়েছি।এসব ভেবেই আমার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো।কিন্তু আমি শিরিনের কাছে আসার সাহস পাইনি।আমি খুব ভালো করেই জানতাম শিরিন ভালোবাসা যতটা গভীর,ঘৃণা তার থেকেও বেশি পরিমাণ ভয়ংকর।তবুও আমি এসেছিলাম ওর কাছে।কিন্তু বাংলাদেশে এসেই আমি যে কথাটা শুনি তা শোনার জন্য আমি মেটেও প্রস্তুত ছিলাম না।কারণ শিরিনের যেদিন ডেলিভারি হয় সেদিন রাতেই নাকি শাহেদ আমাদের বাচ্চাকে মেরে ফেলে।এসব শুনে আমার নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল আমি যেন নিজের মধ্যেই নেই।সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করি শাহেদকেও আমি ভালো থাকতে দিবোনা।আমি যেভাবে আমাদের সন্তানকে হারিয়েছি ঠিক সেভাবেই আমিও ওর বাচ্চাকে ওদের থেকে আলাদা করে দিবো।

তারপর থেকেই আমি সুযোগ খুজছিলাম শাহেদের বাচ্চাকে ওদের থেকে আলাদা করার।সেই সুযোগটা আমি পেয়েও যায়।তবে তা দীর্ঘ ১০ বছর পর।আমি চাইলেই সেই ঘটনার দুই বছর পর যখন শাহেদের প্রথম সন্তান সাইফ জন্ম নেয় তখন ওকে আলাদা করতে পারতাম।কিন্তু আমার কেন জানিনা মন বলছিল আরো অপেক্ষা করতে।তাই আমি অপেক্ষা করতে থাকি নতুন সুযোগের।সাইফ হওয়ার চার বছর পর খান পরিবারে জন্ম নেয় “ওয়ানিয়া রায়হান খান রোজ”। তখনি আমি সিদ্ধান্ত নেই এই মেয়েকেই আমি চুরি করবো।যেই ভাবা সেই কাজ।রোজের চতুর্থতম জন্মদিনের পার্টি থেকে আমি রোজকে চুরি করে ফেলে রেখে আসি গাজীপুর বাস স্ট্যান্ডে।সেদিন আমার মন খুশিতে ভরে গিয়েছিলো।কারণ আমি যে কষ্ট পেয়েছি সেই একই কষ্ট আমি শাহেদকে দিতেও সক্ষম হয়েছিলাম।

এই বলেই থামেন মিস্টার ইব্রাহিম হোসেন।

শিরিন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে টলতে টলতে শাহেদের কাছে এসে দাড়ালো।তারপর ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

“কেন এমনটা করলে তুমি আমার সন্তানের সাথে?আমি তো তোমার নিজের বোন তাইনা?তাহলে আমার সাথে কেন এমনটা করলে ছোট ভাই?জবাব দাও।চুপ করে থেকো না।জবাব দাওওওওওওওও!”

বোনের এমন অবস্থা দেখে শাহেদ বোনকে ধরতে যায়।শিরিন শাহেদের হাত ঝাড়া মেরে ছিটকে দাড়ায়।

“খবরদার তুমি আমাকে ছুঁবে না।তুমি একটা পিশাচ।তাই তো আমার কোল খালি করে আমার সন্তানকে মেরে ফেলেছো তুমি।কেন করলে এমনটা?কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার?”

শাহেদ প্রতিত্তরে বলে,

“ক্ষতি তুই করিসনি।ক্ষতি করেছিল ইব্রাহিম।”

ইব্রাহিম হোসেন অবাক হয়ে বলেন,

“আমি?আমি কিভাবে তোর ক্ষতি করেছি?”

“হ্যা হ্যা তুই,তোর জন্য আমি আমার প্রাক্তন ভালোবাসা শর্মিলাকে হারিয়েছি।”

“শর্মিলা?কোন শর্মিলা?”

“সেই শর্মিলা যার সাথে তুই তোর বন্ধু সাজ্জাদের বিয়ে দিয়েছিস।তুই যদি শর্মিলা আর সাজ্জাদকে পালিয়ে বিয়ে করতে সাহায্য না করতিস তাহলে ওর সাথে আমার বিয়ে হতো।এইসব কিছুর জন্য তুই দ্বায়ী।”

“তুই ভুল ভাবছিস শাহেদ।আমি যদি শর্মিলা আর সাজ্জাদকে পালিয়ে বিয়ে করতে সাহায্য নাও করতাম তবুও তুই শর্মিলাকে পেতিস না।কারণ শর্মিলা আর সাজ্জাদ একে-অপরকে ভালোবাসতো।”

ইব্রাহিমের কথা শুনে শাহেদের আগেই লামিয়া বললো,

“মিস্টার শাহেদ রায়হান খান!একজন স্বনামধন্য পুলিশ অফিসার।আপনার যশ,খ্যাতির কোনো অভাব নেই।আপনার বাবা মিস্টার শরীফ রায়হান খান নিজে পছন্দ করে আমাকে এই বাড়ির ছোট বউ করে এনেছিলেন।বিয়ের রাত থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি আমাকে পছন্দ করেন না।একটা মেয়ের জীবনে তার স্বামী,সংসার নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে।আমারো ছিলো।কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো স্বপ্নই রয়ে গিয়েছিলো।বাসর রাতে যখন আপনি আমাকে বললেন,আপনি শুধু বাবার কথা রক্ষার্থে আমাকে বিয়ে করেছেন।আপনার মনে অন্য কারো বসবাস।আপনি আমাকে কখনোই ভালোবাসতে পারবেন না,তখন নিজেকে দেখে বড্ড অবাক লাগছিলো।আমি ছিলাম ভার্সিটির সেরা সুন্দরীদের মধ্যে একজন।যাকে অনেক ছেলে ভালোবাসার প্রস্তাব দিলেপ তা প্রত্যাক্ষাণ করেছি আমি।কারণ আমি চেয়েছিলাম নিজের স্বামীকে ভালোবাসতে।কিন্তু সেই আমার কপালেই স্বামীর ভালোবাসা যোটেনি কোনোদিন।স্বভাবতই নিজের কামুকতা আর শারীরিক চাহিদার জন্য আপনি আমাকে কাছে টেনেছেন শুধু।বাকি সময়টা আপনার হ্যালাছেদ্দা সহ্য করেই কাটিয়েছি।তবুও কাউকে মুখ ফুটে কিছুই বলিনি।আপনার সেই শারীরিক চাহিদার ফলস্বরুপ আমার কোল আলো করে জন্ম নেয় সাইফ আর রোজ।আমি তো এই সংসার আর আমার বাচ্চাদের নিয়ে ভালোই ছিলাম।তবে কেন আপনি আমার কাছ থেকে আমার একমাত্র মেয়েকে কেড়ে নিলেন?কেন শিরিনের কাছ থেকে তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তার সন্তানকে কেড়ে নিলেন?জবাব দিন!”

লামিয়া রায়হান খানের কথা শুনে নিজের মাথা নিচু করে নিলো শাহেদ।ওর যে আজ সত্যি কিছু বলার মুখ নেই।কি বলবে ওও?যৌবন কালের সেই প্রাক্তনকে কাছে না পাওয়ার রাগ,ক্ষোভের কারণে ওর একটা ভুল আজ সবাইকে কাঁদাচ্ছে আজ।সেই সাথে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের জন্য আজ ওর মেয়ে বাবা-মা থাকা সত্বেও বড় হয়েছে হোমে।ওর বোন হারিয়েছে তার ভালো থাকার সবকিছু।আর নিজের স্ত্রী যে কিনা কখনো ওর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তেলেনি সেই নিষ্পাপ মেয়েটাও ওর জন্য সবকিছু হারিয়েছে।বঞ্চিত হয়েছে স্বামীর ভালোবাসা থেকে।হারিয়েছে এক সন্তানকে।এতোকিছুর জন্য একমাত্র শাহেদ নিজেই দ্বায়ী।অনুশোচনায় জ্বলে পুরে যাচ্ছে সে।আজ যেন নিজের চোখের পানিগুলোও বাঁধ ভেঙ্গে গড়িয়ে পরছে ইচ্ছে মতো।

সবার এই নিরবতার মাঝেই খান বাড়িতে এসে হাজির হলো মিস্টার ওয়াজেদ রাহমান আর মিসেস আনিকা রাহমান।সবাই এই মুহূর্তে এখানে ওয়াজেদ আর আনিকাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো।ইব্রাহিম হোসেন বললেন,

“তোরা এখানে?”

“হুম আমরা।”

“তোরা কি করে জানলি যে এখানে আমরা সবাই আছি!”

“আমাকে আমার ছেলে ফোন করে বলেছে যে খান বাড়িতে আজ গন্ডগোল হচ্ছে।তখনি বুঝে গেছি অতীতের সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে আজ এখানে।তাই আমাকে আসতেই হলো।কারণ আসল চমক এখনো বাকি।”

“মানে?কি বলতে চাইছিস তুই?আর কে তোর ছেলে?”

“আমার ছেলে……..”

চলবে???