তোকে চাই পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
2290

#তোকে_চাই
#পার্ট_১৩(শেষ পর্ব)
#লেখনীতে_সুহাসিনী_চৌধুরী(ছদ্মনামের লেখিকা)

“আমার ছেলে শান্ত!”

সবাই এই কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো।

ওয়াজেদ আর আনিকা বাসার ভেতরে প্রবেশ করে।তারপর ওয়াজেদ বলে,

“শান্ত আমার আর আনিকার ছেলে ঠিকই।তবে সে আমাদের নিজের সন্তান নয়।”

শান্ত এই কথা শুনে চমকে তাকালো ওয়াজেদ আর আনিকার দিকে।

“মানে কি বাবা?কি বলছো এসব তুমি?”

আনিকা ছেলের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

“হ্যা বাবা,তুমি আমাদের নিজের সন্তান নও।পালিত সন্তান।”

ওয়াজেদ ইব্রাহিম হোসেনের কাছে এসে বলতে শুরু করলেন,

“শিরিনের যেদিন ডেলিভারি হয় সেদিন সেই হসপিটালে আমিও ছিলাম।একটা অপারেশন করতে গিয়েছিলাম।অপারেশন রুম থেকে বের হওয়ার পর আমি দেখতে পাই শাহেদ একটা নবজাতককে নিয়ে চুপিচুপি কই যেন যাচ্ছে।কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে আমিও পিছু নেই ওর পেছনে।এবং দেখি শাহেদ একটা গাড়িতে চরে কোথায় যেন যাচ্ছে।আমিও একটা গাড়িতে করে পলো করি শাহেদকে।শাহেদ হসপিটাল থেকে প্রায় অনেকটা দূরে এসে একটা ময়লার ট্রেতে করে বাচ্চাটাকে ফেলে চলে যায়।আমি দ্রুত সেখানে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নেই আর নিজের বাসায় নিয়ে যায়।সেই সময় আমাদের বাচ্চা হয়নি।তাই ঐ বাচ্চাটাকে পেয়ে আনিকা অনেক খুশি হয়।কিছুদিন পর আমি জানতে পারি বাচ্চাটা শিরিন আর ইব্রাহিমের।সেদিন থেকেই আমি আর আনিকা শান্তকে নিজেদের পরিচয়ে বড় করেছি।”

ওয়াজেদ সাহেবের কথা শুনে সবাই চমকে যায়।শিরিন দৌড়ে এসে শান্তকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কাঁদতে লাগে।শান্ত কি করবে বা কি বলবে কিছুই যানে না।শুধু চুপ করে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে।আনিকা শিরিনের মাথায় হাত দিয়ে বলে,

“কেদো না বোন।এই দেখো তোমার সন্তান তোমার সামনে।আমি আর ওয়াজেদ ওকে কখনো নিজের ছেলে ছাড়া অন্যকিছু ভাবিনি।ওকে নিজেদের ছেলের পরিচয়ে বড় করেছি।আজ আমরা মুক্ত।কারণ তোমার সন্তানকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি আমরা।”

এই বলেই চোখের পানি মুছে নিলেন তিনি।শিরিন আনিকার হাত ধরে কৃতজ্ঞতার সুরে কাঁদতে কাঁদতেই বললো,

“আজ যদি তুমি আর ওয়াজেদ ভাই না থাকতে তাহলে হয়তো আমি শান্তকে কখনোই ফিরে পেতাম না।তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দিবো আমি তা বলার ভাষা নাই আমার আপু।”

“ধুর বোকা মেয়ে এতে ধন্যবাদের কি আছে?আল্লাহ চেয়েছেন বলেই এসব সম্ভব হয়েছে।সবই আল্লাহর ইচ্ছা।শুকরিয়া করো আল্লাহর কাছে।”

ইব্রাহিম আস্তে আস্তে শান্তর কাছে এসে দাড়ালো।দুই চোখ ভরে নিজের সন্তানকে দেখছে সে।এ যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেয়েছেন তিনি।খুশিতে দু’চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরছে।ছেলেকে দু হাতে আগলে নিলেন তিনি।শান্ত কিছুক্ষণ নিরব থেকে নিজেও জড়িয়ে নিলো নিজের জন্মদাতাকে।

শিরিন শান্তর কাছে এসে আকুতি ভরা কন্ঠে বললো,

“একবার আমাকে মা বলে ডাক না বাবা।একবার শুধু মা বলে ডাক।”

শান্ত বাবাকে ছেড়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“মা!”

ব্যাস!এই একটা ডাক শুনেই শিরিনের বুক শিতল হয়ে গেলো।খুশিতে আবারো দু-চোখ ছলছল করে উঠলো।

ধীরে ধীরে সবাই শান্তর কাছে এগিয়ে আসলো।সবার সাথে কুশল বিনিময় করে শান্ত বললো,

“আমি লাকি।কারণ আমার একটা নয় বরং দুই দুইটা মা আর দুইটা বাবা।আমি তোমাদের সবার ভালোবাসা পেয়েছি।এটা তো ভাগ্যের ব্যাপার তাইনা!”

শান্তর কথা শুনে সবার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।

এতোক্ষণ পর সবার খেয়াল হলো রোজের কথা।দাদু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো রোজের কাছে।

“দাদুভাই,তুই আমাকে মাফ করে দিস।আমি না জেনে তোকে অনেক কথা বলেছি।পারলে আমাকে মাফ করে দিস।”

দাদুর হাত জোর করা দেখে রোজ দাদুর হাত দুটো নামিয়ে নিয়ে বললো,

“এভাবে বলো না দাদু।যা হওয়ার হয়েছে।আমি কিছু মনে করিনি।”

রোজের বাবা রোজের কাছে আসতেই রোজের মা সামনে এসে দাড়ালো রোজের।

“খবরদার মিস্টার শাহেদ রায়হান খান,আপনি আমার মেয়ের ত্রিসীমানায় ও আসবেন না।”

“কি বলছো তুমি এসব লামিয়া?আর আমাকে আপনি করে বলছো কেন?কি হয়েছে তোমার?”

“আপনার মতো বাবা থাকার থেকে না থাকা ভালো।আপনার জন্য আমি আমার মেয়েকে হারিয়েছে।আজ এতোগুলো বছর পর ওকে ফিরে পেয়ে আর হাড়াতে চাই না।আপনি আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকুন।”

রোজের বাবা অসহায় চোখে তাকিয়ে বললেন,

“লামিয়ে আমি মানছি আমি অন্যায় করেছি।তুমি আমাকে শাস্তি দাও।বোন,তুইও আমাকে শাস্তি দে।কিন্তু দয়া করে আমার মেয়ের থেকে আমাকে আলাদা করে দিও না তোমরা।”

মিস্টার শাহেদ রায়হান খানের কথায় রোজের মনে দয়া হলো।রোজ বলতে লাগলো,

“ছোটবেলা থেকেই আমি বাবা-মায়ের ভালোবাসা পাইনি।পাইনি পরিবারের সাথে বড় হয়ে উঠতে।যেখানে প্রত্যেকটা সন্তান তার বাবার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শেখে,সেখানে আমি হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেলেও কেউ এগিয়ে আসেনি আমাকে তুলতে।নিজেই কেঁদেছি।আবার নিজেই উঠে দাড়িয়েছি।প্রত্যেকটা সন্তান তার মায়ের হাতে খেলেও আমার ভাগ্যে সেই আদর যোটেনি।নিজের হাতে খেতে গিয়ে কখনো খাবার পড়ে যেতো।আবার কখনো মাছের কাটা বাছতে গিয়ে হাতে কাটা ফুটতো।সব যন্ত্রণা সহ্য করে নিতাম।দিন যতই যাচ্ছিলো বুঝতে পারছিলাম আমি তো এতিম।আমার বাবা-মা নেই।আমাকে এভাবেই বড় হতে হবে।স্কুলে যখন দেখতাম আমার বাকি সহপাঠীরা দামী দামী খাবার খায়,কে কত টাকার জামা পড়ে,কে কত হাজারটা টাকা হাত খরচ পায়,কে কত টাকার শপিং করে সব শুধু শুনতাম।আর আমার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরতো অশ্রুকণা।নিজেকে বোঝাতাম এগুলো তোর জন্য নয় রোজ।তুই তো এতিম।তোর কেউ নেই।তোকে নিজের জন্য লড়তে হবে।বাঁচার জন্য লড়তে হবে।যখন জ্বরের ঘোরে মা মা বলে গোঙ্গাতাম,তখন কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে খাবার খাওয়াইনি।ওষুধ খাওয়াইনি।যখন ধীরে ধীরে বড় হলাম।তখন শুনতে হতো নানা রকম মানুষের হরেক রকম কথা।অনেকেই বলতো আমি নাকি অবৈধ সন্তান।তাই তো আমার বাবা-মা আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে।বিশ্বাস করুন সবাই,তখন মনে হতো আমি কেন বেঁচে আছি?আমি মরে কেন গেলাম না?এ জীবন রেখে কি লাভ?ঠিক সেই সময় আমার পাশে এসে দাড়ায় আমার দুই কলিজার টুকরা লিয়া আর সাফরিন।ওরা আমাকে নতুন জীবন দেয়।আর মাদার!তার কথা কি বলবো?সে না থাকলে তো আমার রোজ হয়ে ওঠায় হতো না।হয়তো কারো ভোগ পণ্যের শিকার হতাম আর নয়তো শেয়াল,শকুনের খাবার হতাম।মাদার না থাকলে আজ আমি বেঁচে থাকতাম না।তার অবদান আমার জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে স্বরণীয়।আজ আমি আমার পরিবারকে পেয়েছি শুধুমাত্র মাদারের জন্যই।কিন্তু দিন শেষে একটা কথা আমি কখনোই ভুলতে পারবো না।সবার বলা সেই বিখ্যাত কথা,”তুমি তো অবৈধ সন্তান।”

রোজের কথা শুনে প্রত্যেকের চোখেই পানি এসে গেছে।একটা মেয়ে তার পরিবার থাকা সত্বেও ঠিক কতটা অসহ্যনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে বড় হয়েছে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রোজ।

সবাই রোজের কাছে এসে মাফ চাইলো।নতুনভাবে সবটা শুরু করতে বললো।রোজ কিছু না বলে মাদারের দিকে তাকালো।মাদার ইশারায় বললেন,

“সবটা মেনে নিয়ে নতুনভাবে শুরু করো।”

রোজও সবার দিকে তাকিয়ে আবার সবটা নতুনভাবে শুরু করলো।

রিক্ত কোনো কিছু না বলেই রোজকে কোলে তুলে নিলো।রোজ অবাক হয়ে তাকালো রিক্তর দিকে।বাকি সবাই হাসছে।কারণ,”রিক্ত যে তার প্রাণকে ফিরে পেয়েছে।”

রিক্ত রোজকে রুমে নিয়ে গিয়ে দাড় করালো।তারপর গেট লক করে এগিয়ে আসতে লাগলো রোজের দিকে।রোজ ভয় পেয়ে পেছাতে লাগলো।এক সময় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো ওর।রিক্ত ওর দুই গাত রোজের সামনে এনে রোজকে আটকে ফেললো।আর আচমকাই রোজের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।রোজ যেন মূর্তি হয়ে গেলো।একদম স্ট্রেট হয়ে দাড়িয়ে রইলো।এই প্রথম কোনো ছেলে ওকে টাচ্ করলো।জীবনে অনেক ছেলের প্রপোজাল পেয়েছে।কিন্তু ওর এসব বিষয়ে কখনোই ইন্টারেস্ট ছিলো না।বিধায় রোজ কখনো রিলেশনশীপে জড়ায়নি।কিন্তু রিক্তর এভাবে হঠাৎ হামলায় রোজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো।প্রায় দু মিনিট পর রিক্ত রোজকে ছেড়ে দিয়ে ওর কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বললো,

“দীর্ঘ সতেরোটা বছর তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি।প্রতিটা ক্ষনে ক্ষনে শুধু তোমাকেই চেয়েছি।অনেক কষ্ট দিয়েছো আমাকে এবার সবকিছুর সুদেআসলে শোধ তুলবো আমি।”

“আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাইনা?তাহলে সেদিন রিসোর্টের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কাকে লাই ইউ মিস কুইন বলেছেন হু?”

“আরে ওটা তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নিহান বলেছিল তুই কি এখনো ওয়ানিয়াকে ভালোবাসিস?সেই জন্য তার উত্তরে বলেছিলাম।”

“হুহ,জানেন আমার কত কষ্ট হয়েছিল?”

“কেন তোমার কেন কষ্ট হবে?”

রোজ মুখ অন্যদিকে ঘুড়িয়ে বললো,

“জানিনা।”

রিক্ত বাঁকা হেসে রোজকে বললো,

“এই ওয়ান মিনিট,তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?সেইজন্য তোমার কষ্ট হয়েছিল?”

রোজ মুখ ফুলিয়ে বললো,

“ধুর,নাহ।”

“উমমমমম,,,সামথিং সামথিং!”

“নাথিং নাথিং”

এই বলেই দুজন হেসে উঠলো।

৩মাস পর…..

এই তিন মাসে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে।শিরিন আর ইব্রাহিমের ঘরোয়াভাবে বিয়ে সমপন্ন হয়েছে।শান্ত এখন তিন দিন শিরিনের কাছে থাকে।আর তিন দিন আনিকার কাছে থাকে।আর একদিন সবার সাথে খান প্যালেসে থাকে।সাইফ আর জেরিনের এনগেজমেন্ট করে রাখা হয়েছে।রাকিব আর রাইসাও বিয়ে করে নিয়েছে।শান্ত আর মিরা চুটিয়ে প্রেম করছে।রুমকির সাথে শুভর রিলেশন ছিল অনেক দিন ধরেই।কিন্তু তা প্রকাশ পেয়েছে কিছুদিন আগে।মেরিন আর সাহাফ তো টম এন্ড জেরির মতো সব সময় লেগেই থাকে।শাহেদের সাথে লামিয়ার সম্পর্কটা ঠিক হয়ে গেছে অনেকটায়।এখন সবাই অনেক ভালো আছে।রাইতা এসব প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে নেই।সে তো নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত।অন্যদিকে রোজের দুই বেস্ট ফ্রেন্ড লিয়া আর সাফরিন।সাফরিন এখনো সিংগেল।কিন্তু লিয়ার সাথে রিক্তর বেস্টু নিহানের রিলেশন চলছে।রিলেশনে জড়িয়েছে দুজন অদ্ভুত ভাবে।লিয়া নিজেও জানতো না নিহান ওকে পছন্দ করে।ওদের প্রথম আলাপও রিক্তদের বাসাতেই হয়।সেই থেকেই নিহান ফলো করতো লিয়াকে।একদিন লিয়া জিজ্ঞেস করে ওকে ফলো করার কারণ কি?তখন হুট করেই নিহান ওকে প্রপোজ করে।লিয়া বেশ কয়েকদিন পর সবার কথাতে নিহানকে এক্সেপ্ট করে।ধীরে দীরে দুজনের ভালোবাসা বারতে থাকে।এভাবেই হাসি-খুশিতে চলছে সবার জীবন।

আজ রোজ আর রিক্তর বিয়ে।গতকাল গায়ে হলুদের সময় রিক্ত নিজেই প্রথম হলুদ ছুয়ে দিয়েছে রোজকে।সে কি যে অবস্থা!সবাই তো রোজকে এই নিয়ে খোঁচা দিয়ে দিয়ে নাজেহাল অবস্থা করে দিয়েছে।

খান প্যালেস আজ আলোয় ঝলমল করছে।রিক্ত রায়হান খান আর ওয়ানিয়া রায়হান খান রোজের বিয়ে বলে কথা।বাগানের একপাশে স্টেজ সাজানো হয়েছে।

রোজকে নিজের কোলে করে রিক্ত স্টেজে নিয়ে যাবে।তাই রিক্ত বাসার নিচ তলায় অপেক্ষা করছে।তখনি রিক্তর চোখ যায় রোজের দিকে।রিক্ত মুগ্ধ নয়নে নিজের প্রেয়সীকে দেখছে।সাদা লেহেঙ্গা,গা ভর্তি ডাইমন্ডের গহনা।মাথায় হিজাব করে ক্রাউন বসানো।হালকা সাজ।মুখে গাড় লাল লিপস্টিপ।এতেই যেন ওকে স্নো ডল মনে হচ্ছে।

রিক্ত নিজেও সাদা শেরওয়ানি পরেছে।মাথার চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা।মুখ ক্লিন সেভ করা।ঠোঁট গুলো গোলাপের ন্যায় লাল।এক কথায় চকোলেট বয়।মেয়েরা সব ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।তা দেখে রোজ রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে।

বিয়েতে সাদা কে পড়ে তাইনা?আসলে রোজের কথাতেই সাদা রংয়ের পোশাক পরেছে ওরা দুজন।রোজের ভাষ্যমতে সাদা শুভ্রতার প্রতীক।আর ওদের ভালোবাসা তো শুভ্রতার আরেক প্রতীক।তাই ওরা বিয়ে করবে একদম আলাদা সাজে।নিজেদেরকে সাজাবে সাদা রংয়ে।তাই এই সাজ!

হঠাৎই রোজ রিক্তর দিকে তাকিয়ে শিড়ি দিয়ে নামার সময় ওর পায়ের সাথে লেহেঙ্গা বেজে গড়িয়ে পড়ে শিড়ি দিয়ে নিচে।রিক্ত রোজ বলে চিৎকার করে দৌড়ে আসে রোজের কাছে।এসে দেখে রোজ সেন্সলেস হয়ে গেছে।রিক্তর চিৎকারে সবাই এসে হাজির হলো হল রুমের সামনে।মুহূর্তের মধ্যেই বিয়ে বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেলো।রেজের মা রীতিমতো কাঁদতে শুরু করেছেন।সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।এর মধ্যেই মিস্টার ওয়াজেদ এসে রোজের পালস্ চেক করলো কিন্তু একি!পালস্ তো পাওয়া যাচ্ছে না।এই কথা শুনে রিক্ত রোজকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে সোজা গাড়িতে বসালো।আর ড্রাইভ করে হসপিটালের দিকে যেতে লাগলো।পেছন পেছন বাকি সবাইও আসতে লাগলো।হসপিটালে গিয়েই রিক্ত চিৎকার করে ডক্টরকে ডাকতে লাগলো।

“ডক্টর!!ডক্টর!!ডক্টররররররররররররররর!!”

রিক্তর চিৎকারে ডক্টর আলফাজ আর নার্সরা হন্তদন্ত করে বেরিয়ে আসলো।

“আরে মিস্টার রিক্ত আপনি এখানে?আর একি,মিস রোজের কি হয়েছে?”

“ডক্টর দেখুন নাহ ওর কি হয়েছে সব তো ঠিকই ছিলো।হঠাৎই ওও শিড়ি থেকে নিচে পড়ে গেলো।আর অজ্ঞান হয়ে গেলো।”

“ওকে ওকে।আপনি একটু শান্ত হন।আমরা দেখছি।নার্স ইমারজেন্সি মিস রোজকে নিয়ে আইসিইউ রুমে যাও।কুইক!”

“ওকে স্যার।”

এই বলেই রোজকে নিয়ে নার্স আর ওয়ার্ড বয় সবাই মিলে তারাতাড়ি চলে গেলো আইসিইউ রুমে।

“মিস্টার রিক্ত,আমি জানি আজ আপনার আর মিস রোজের বিয়ে ছিলো।চিন্তা করবেন না।আমরা দেখছি।আর সবাই মিলে আল্লাহর কাছে প্রে করুন।”

এই বলেই ডক্টর আলফাজ চলে গেলো রোজকে দেখতে।

এদিকে সবাই হসপিটালে এসে হাজির।সবার চোখেই পানি চিকচিক করছে।কি থেকে কি হয়ে গেলো এটায় ভাবছে সবাই।

পেরিয়ে গেছে প্রায় এক ঘন্টা।সবাই আইসিইউ রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে।রিক্তর দাদু আর দাদীমা চেয়ারে বসে আছেন।রিক্ত বারবার রুমের ভেতর যেতে চাইছে।পাগলামি শুরু করেছে এক প্রকার।অনেক কষ্টে সবাই ওকে আটকে রেখেছে।এর মধ্যেই ডক্টর আলফাজ বিষন্ন মুখে বেরিয়ে এলেন।রিক্ত ঝড়ের গতিতে ডক্টর আলফাজের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ডক্টর কি হয়েছে?রোজ ঠিক আছে তো?ওর জ্ঞান ফিরেছে?আমি যাবে ওর কাছে।”

এই বলেই রিক্ত রোজের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ডক্টর আলফাজ কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

“স্যরি মিস্টার রিক্ত,আমরা রোজকে বা,বাঁচাতে পারিনি।আমি তো আগেই বলেছিলাম মিস রোজের বুকের ঐপাশে আবার আঘাত লাগলে তাকে আর বাঁচানো যাবে না।কিন্তু আমরা অনেক চেষ্টা করেছি”

এই কথা বলেই ডক্টর আলফাজ মাথা নিচু করে নিলো।

এই একটা বাক্য!হ্যা এই একটা বাক্য শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো।রিক্তর পা থমকে গেলো।রোজের মা এই কথাটা শুনে আর স্থির থাকতে পারলেন না।জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন ফ্লোরে।সাইফ দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে মাকে ধরলো।সাফরিন আর লিয়া তো ঠাস করে মেঝেতে বসে পরলো।সাইফ কি বলবে?নিজের বোনকে এতোগুলো বছর পর কাছে পেয়েও হাড়িয়ে ফেললো।রোজের বাবা এই খবরটা মেনে নিতে পারেননি।উনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।সবাই তারাতাড়ি করে তাকে নিয়ে গিয়ে বেডে শুয়ে দেওয়া হলো।রিক্তর দাদু আর দাদীমা সটান হয়ে বসে আছেন।সিআইডি টিমের প্রত্যেকটা মেম্বার কাঁদছে।খুব করে কাঁদছে।শান্ত মিরাকে ধরে দাড়িয়ে আছে।রাইসা রাকিবের বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছে।রুমকি আর মেরিন চুপ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁদছে।শুভ নিজেও কাঁদছে।সাহাফ তো এর মধ্যেই একদম চুপ করে গেছে।জেরিন ঠোঁট কামরে ধরে কান্না আটকানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে।নিহান রিক্তর কাছে গিয়ে ওকে ধরলো।নিহান নিজেও বুঝতেছে না যে কি করবে ও,রিক্তকে আদৌ সামলানো যাবে তো?এসব ভেবেই ওর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎই রিক্ত টলতে টলতে রোজের কাছে গেলো।সবাই ওর পিছু পিছু গেলো।রিক্ত রোজের মাথার কাছে বসে বলতে লাগলো,

“কেন এমনটা করলি তুই?তুই কি জানিস না আমি তোকে কতটা ভালোবাসি?তোকে ছাড়া যে আমি অসম্পূর্ণ।আমি প্রতিটা মোনাজাতে তোকে চাই।আমার শিরা-উপশিরা সবাই তোকে চায়।আমার হার্ট ও তোকে চায়।আমার যে অনেক স্বপ্ন ছিলে তোকে নিয়ে।প্রতিটা পূর্নিমা দেখার জন্য হলেও আমার তোকে চাই।এক সাথে নদীর পারে হাঁটার জন্যও আমার তোকে চাই।রাতের নিস্তব্ধ শহরে তোর হাতে হাত রেখে পথ জন্য হলেও আমার তোকে চাই।বৃষ্টিতে দুজন একসাথে ভেজার জন্য হলেও আমার তোকে চাই।টিএসসি চত্বরে দুজন একসাথে বসে চা খাওয়ার জন্য হলেও আমার তোকে চাই।বসন্তের উৎসব একসাথে কাটানোর জন্য হলেও আমার তোকে চাই।শীতকালের সেই মুহূর্তগুলো তোর সাথে রোমান্স করার জন্য হলেও আমার তোকে চাই।গরমের সেই দিনগুলোতে একসাথে দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটি করার জন্য হলেও আমার তোকে চাই।শরতের কাশফুল বাগানে তোর সাথে সেলফি তোলার জন্য হলেও আমার তোকে চাই।হেমন্তের নবান্ন উৎসবে তোর হাতে বানানো পিঠা খাওয়ার জন্য হলেও আমার তোকে চাই।একটা ছোট্ট প্রিন্সেস পাওয়ার জন্য হলেও আমার তোকে চাই।পরিশেষে এই আমিটাকে বাঁচানোর জন্য হলেও আমার তোকে চাই।তাই তোকে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।এ জীবনে আমি নাই বা পেলাম তোকে।কিন্তু পরকালেও আমার শুধু তোকে চাই।তাই আমি আসছি তোর কাছে।কারণ,তুই ছাড়া এই আমিটা যে অসম্পূর্ণ,অসমাপ্ত।তাই আমার এই আমিটাকে পরিপূর্ণ আর সমাপ্ত করার জন্য হলেও আমার তোকে চাই!আমি আসছি,আমি আসছি তোর কাছে।তবুও শুধু আমার তোকেই চাই।”

এই বলেই রিক্ত নিজের কমোড় থেকে গান বের করে সোজা শ্যুট করলো নিজের মাথায়।আর রোজের বুকের উপর রিক্তর নিথর দেহটা পড়ে রইলো।

এই ঘটনা দেখেই রিক্তর মা চিৎকার করে ওখানেই জ্ঞান হারালেন।রিক্তর দাদু হার্ট এ্যাটাক করলেন।রাইতা ঠাস করে লুটিয়ে পরলো ফ্লোরে।রিক্তর রক্তে রিক্তর আর রোজের সাদা পোশাক লাল হয়ে গেলো।রিক্তর ফুপি তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কাঁদতে লাগলেন।আর রিক্তর বাবা!তিনি তো ঠায় দাড়িয়ে আছেন পাথর হয়ে।

এই অসমাপ্ত কাহিনী আরো একবার ভালোবাসার দৃষ্টান্ত হয়ে রইলো।রিক্ত আর রোজ!দুজন দুজনকে পেতে একসাথে পারি জমালো পরকালের দুনিয়ায়।ভালোবাসা গুলো সব সময় পূর্ণতা পায়না।কিছু কিছু ভালেবাসা অসম্পূর্ণই রয়ে যায়।তবে রিক্ত আর রোজের ভালোবাসা অসম্পূর্ণ নয়।তারা তো মৃত্যুর পরে হলেও এক হতে পেরেছে।তাই এই ভালেবাসাটা মোটেও অসম্পূর্ণ বা অসমাপ্ত নয়।তারা তো নিজেেদের জীবন দিয়ে নিজেদের ভালোবাসা অমর করে রেখে গেলো সবার জীবনে।রিক্ত তার রোজকে পাওয়ার জন্য সবকিছু করতে পারে।তার প্রমাণ সে দিয়ে গেলো।রিক্ত পরকালে হলেও যে তার রোজকে নিজের জন্য চাই।তাই তো তার প্রতিটা রক্তের ফোঁটাও বলে দিচ্ছে একটি কথা বারংবার।সেই কথাটা হলো #তোকে চাই!

~সমাপ্ত~
ধন্যবাদ সবাইকে❤️❤️❤️❤️