তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
154

৫||
বিচার পর্ব শুরু হতে একটু দেরিই হয়ে গেল। বিচারের লোকজন এখনও আসা শুরু করেনি। সবাই হয়তো রাতের খাওয়া সেরে আসছে। গ্রামের লোকজন এমনিই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। শহর হিসেবে এটা সন্ধ্যা।
রাহিমা চাচি জানালেন অন্যান্য দিন এসময়টায় হাকিম মোল্লা চাচা আর ইনজাম দুজনেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে। আজ বিচারের কারণে তাদের নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। কারণ বিচারটা কোন সাধারণ নারীর না, একজন ইমামপত্নীর। তার সম্মানের দিকটা মাথায় রেখেই এই রাত্রি আয়োজন। চাচী আরো বললেন, ” রাতের অন্ধকারও একটা পর্দা।”

বিচারের ঘরে আসার আগে রাহিমা বেগম নিজের পরনের পোশাকের উপর আরেকটা জিলবাব চাপালেন। অথচ বিচার ঘরে চাদরের এপাশে সবাই মহিলা। ইশারা মনে মনে কিছুটা বিস্মিত হলেও মুখে কিছু বললো না। সে বেশ আগ্রহ নিয়েই বিচারের আয়োজন দেখছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিচার পর্ব শুরু হবে। চাদরের ওপাশে একাধিক পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ পেয়ে রাহিমা চাচি থম ধরে গেলেন। অথচ পুরো সন্ধ্যা অনর্গল কথা বলেছেন। ইশারা অবাক হয়ে তাকে দেখছিল। একজন বয়স্ক মানুষের এই লজ্জাবোধ ওকেই যেন লজ্জায় ফেলে দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত চাচির দেখাদেখি ইশারা নিজেও মাথায় ওড়না দিতে বাধ্য হলো। কিছু পরিবেশের দাবিই এমন হয় যাকে অগ্রাহ্য করা যায়না ।

বিচারে খুব বেশি লোকের সমাগম হয়নি। হাকিম মোল্লা চাচার কঠোর নির্দেশে বাইরের কাউকেই বিচারে আসতে দেয়া হয়নি।
চাদরের ওপাশে পুরুষদের দিকে আছেন হাকিম মোল্লা চাচা সহ তার পুত্র ইঞ্জিমাম, ইমামপুত্র আব্দুল্লাহ এবং প্রয়াত ইমাম সাহেবের একমাত্র শ্যালক অর্থাৎ ইমামপত্নী নাবিলার সহোদর ভাই যিনি নিজেও একটি মাদ্রাসার উস্তায।
চাদরের এপাশে মেয়েদের দিকে আছেন রাহিমা চাচি, ইমামের বিধবা পত্নী নাবিলা ও তার প্রৌঢ়া মাতা জমিলা বিবি। বাইরের লোক বলতে একমাত্র ইশারা। সেও ইঞ্জামের ভাষায়।

বিচার শুরু হবার পরেই চাচার এক প্রশ্নে ইমামপুত্রের বুকফাটা কান্না শুনে সবাই থেমে গেল। চাদরের এপাশে বসে৷ তারা সবাই আরেকটি ফোঁপানির শব্দ শুনলো। ইশারা ধারণা করলো ইনি প্রয়াত ইমাম সাহেবের শ্যালক। তিনিও ভাগনের সাথে কাঁদছেন। তাদের সেই কান্না সংক্রমিত হলো চাদরের এপাশেও। প্রয়াত ইমাম সাহেবের প্রৌঢ়া শ্বাশুড়ীও কেঁদে উঠলেন। বাকিরা সবাই স্তম্ভিত। চাদরের একপাশে ক্রন্দনরত কিশোর পুত্র আব্দুল্লাহ আর অপর পাশে তার ক্রন্দনরতা নানী জমিলা বিবি।
বিচারক হাকিম মোল্লা চাচা নির্বাক। বাকিদের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। ইশারা শুধু পরম বিস্ময়ে ইমাম পত্নী নাবিলাকে দেখছিলো। সে নিজে সুশ্রী বলে চাপা একটা গর্ব ছিলো তার। কিন্তু ইমামপত্নী নাবিলাকে দেখার পর নিজেকে ওর সামনে কুশ্রী মনে হতে লাগলো। কী চমৎকার দুধে আলতা গায়ের রঙ আর কী কমনীয় মুখশ্রী। যেন কোনদিন সূর্যের আলো পড়েনি ঐ ত্বকে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না যে তিনি এতো বড় একটি পুত্রের মা। ইশারা তারচেয়ে বেশি অবাক হলো নাবিলার শক্ত মুখ দেখে এবং সে মোটেও কাঁদছিলো না। বরং তাকে দেখাচ্ছে ঠিক একটা পাথরের মুর্তির মতো।

একসময় কান্না পর্ব স্তিমিত হলো। ইশারা শুনতে পেলো, চাদরের ওপাশে নাবিলার ভাই কান্নাভেজা ভাঙা কণ্ঠে বলছেন, ‘ ফুপাজান। আপনি মুরুব্বি। এই গ্রামের মাথা। আমরা এখন কী করবো একটা বুদ্ধি দেন। আমার মাথা আর কাজ করেনা ফুপা। এর একটা বিহিত করেন। এই পাপীষ্ঠাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার অনুমতি দেন আর নয়তো দোররা মারার অনুমতি দেন আমি ওকে মেরে রক্তাক্ত করি। দেখি ওর ঐ একরত্তি শরীরে কত শক্তি ধরে। এতোবার বলেছি, এসব বাদ দে। ফিরে আয়। জান্নাতের পথ ধর। তার কানে এসব ঢোকেনা। ঐ জাহান্নামী নিজেও জাহান্নামে যাবে আমাদেরকেও নেবে।’ বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মওলানা।

সেই কান্নার সাথে তালমিলিয়ে নাবিলার মাও কাঁদলেন। রাহিমা চাচির হাত ধরে বিড়বিড় করে বললেন,” আম্মা, আমি নিজেও তে অল্প বয়সের বিধবা। আপনারা তো জানেন, আমার স্বামী মারা যাবার পর থিকা জীবনের এতোগুলো বছর পর্দা পসিদার ভিতরে থাকছি। কোন পরপুরুষের দিকে চক্ষু তুইলা চাই নাই। সবুর করছি। এক হাতে এই ছয়টা পুলাপান মানুষ করছি। কারণ আমি জানি, রাসুল সাঃ বলছেন, যে নারী স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের সতীত্ব আর স্বামীর মাল সম্পদ রক্ষা করে, স্বামীর সামনে তার লগে কথাবার্তা সাবধানে বুইজ্যা বলে এবং শিশু সন্তান সহ বিধবা হওনের ফরেও যে নারী সন্তানগো আঁকড়াইয়া ধইরা রাখে আর তাগো ক্ষতি হওনের ডরে বিয়াশাদী না কইরা সন্তানগো দেখাশোনা করে, লালন ফালন করে সেই নারী জান্নাতী (কিতাবুল কাবায়ের – ইমাম আযযাহাবী রাঃ)। আর আমার এই মাইয়া আমার পেটে জন্ম নিয়াও আইজকা রঙ্গিন চশমা পিনছে। মনে করসে আমি কিছু বুজিনা। সেয় রাত বিরাইতে গুসুল করে। জিগাইলে কয় তাহাজ্জুদ পড়ুম। কত্ত বড় সিয়ানা বলেন আম্মা। সেয় কুথা থিকা এক মুবাইল জুটাইসে জানিনা। সেইহানে আবার কারে জানি বন্ধুও বানাইসে। নাউযুবিল্লাহ। হেই বেটা অহনে সমানে ফুন দেয়। কয়, বিয়া করবো। এই মাইয়ারে আমি কেমনে বুঝাই। ওরে জেনাকারিনী এই দুনিয়ার জীবন দুই দিনের । এই শরীর তো পুকা মাকড়ের খাইদ্য।’ জমিলা বিবি চাপা স্বরে আরো কয়েকটা কথা বলে মেয়েকে বকতে লাগলেন। তিনি হয়তো আরো কিছু বলতেন কিন্তু তার আগেই হাকিম মোল্লা চাচার খাকারিতে রাহিমা হাত দিয়ে তাকে থামতে ইশারা করলেন। বাকিরাও সবাই থেমে গেল।

হাকিম মোল্লা পর্দার এপাশের বিচারপ্রার্থিনীর উদ্দেশ্যে বললেন,” এক পক্ষের কথা তো শুনলাম। এবার আব্দুল্লাহর আম্মার মতামতটাও জানতে চাই। ইঞ্জামের আম্মা, আপনি উনার কথাগুলো মন দিয়ে শুনেন। ওনার ইচ্ছেটা জানেন। কারণ ইসলাম ধর্মে বিধবা বিবাহের অনুমতি আছে। কাজেই আব্দুল্লাহর আম্মা যদি চান তাহলে শরীয়ত মতো…!’

বৃদ্ধ হাকিম মোল্লা তার কথা শেষ করতে পারলেন না তার আগেই হাউমাউ রব উঠল।
‘ না ফুপা। এই গজব কইরেন না ফুপা। আমাদের মানসম্মান থাকবে না। ইমাম সাহেবের একটা সুনাম আছে এলাকায়। তার সন্তানরা থাকতে ওদের মা বিয়ে করবে এটা কেমন দেখায়।’ হাকিম মোল্লাকে থামিয়ে দিয়ে এবার ইমাম শ্যালক তথা আব্দুল্লাহর মামা প্রবল বিরোধিতা করে উঠলেন। মামার কথার সাথে সাথে আব্দুল্লাহও চিৎকার করে কেঁদে উঠল আর তারপরই ছুটে গিয়ে পাকা দেয়ালে কপাল ঠুকতে লাগল। এপাশে জমিলা বিবিও দু হাতে কপাল চাপড়াতে লাগলেন। মুহূর্তে পুরো বিচার সভা উত্তেজিত ও অশান্ত হয়ে উঠলো। উত্তেজনায় ইশারা নিজের ঠোঁটগুলো দাঁত দিয়ে শক্ত করে কামড়ে ধরলো। হায় আল্লাহ , কী হবে এই মেয়ের। এ যেন অনাঘ্রাতা, অপাপবিদ্ধা। এ তো যেন এমন ফুল যার পত্রপল্লবে এক ফোঁটা ধূলো পড়েনি। এই মেয়েকে কী তবে জোর করে আজীবন এভাবে বেঁধে রাখা হবে ? হায়, ধর্মের নিয়মগুলো এতো কঠোর কেন। ইশারা কান্না পেয়ে গেলো হঠাৎ।

এমন সময় ইঞ্জিমামের গমগমে সুর পরিবেশটাকে কিছুটা শান্ত করলো। ইশারা শুনতে পেলো ইঞ্জিমাম বলছে ,’ আব্বা আপনার অনুমতি নিয়ে আমি আব্দুল্লাহ আর ওর মামাকে দুটো প্রশ্ন করতে চাই।’

হাকিম মোল্লা মাথা নাড়লেন। ইঞ্জিমাম বলল,’ মওলানা সাহেব। আপনি তো মাশাআল্লাহ দ্বীন জানা লোক। শারঈ বিধান জানেন। আব্দুল্লাহ এখনও ছোট ওর হয়তো জানা নাও থাকতে পারে। তবু দুজনকেই প্রশ্ন করছি। আপনারা কী রাসুল সাঃ কে অনুসরণ করেন বা নিজেকে তার উম্মত দাবি করেন ?’

‘ জি অবশ্যই।’ দুজনেই সমস্বরে বলল। আব্দুল্লাহ তখনও ফোঁপাচ্ছে।

ইন্জিমাম বলল,’ মাশাআল্লাহ। আপনারা কী রাসুল সাঃ এর স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামার সাথে বিয়ের ঘটনা জানেন ? মওলানা সাহেব আপনি বলুন, জানা আছে সেই ঘটনা? ”

মওলানা খানিকটা দমে গিয়ে বললেন,’ জি জানা আছে জনাব।’

” আলহামদুলিল্লাহ । তাহলে তো এটাও জানেন যে রাসুল সাঃ এর সাথে সেই একাধিক সন্তানের জননী উম্মে সালামার বিয়ে হয়েছিলো তার নয় বছরের পুত্র উমারেরই তত্ত্বাবধানে ?’

মওলানা এবারও মাথা নাড়লেন, ‘জি জনাব।’

‘ তাহলে এবার বলুন, আপনি কত বড় ইজ্জতদার হয়ে গেছেন যার ইজ্জত রাসুলের ইজ্জতকে টপকে গেছে ? আপনি আপনার অল্পবয়সী বিধবা বোনকে বিয়ে দিলে আপনার সম্মান লুট হয়ে যাবে কারণ তার দুটো বাচ্চা আছে। কাল যখন আপনার স্ত্রী মারা যাবে আর আপনি বিয়ে করবেন তখন আশাকরি কারো সম্মান লুটিয়ে যাবে না। কী বলেন ? যতদুর জানি, আপনার নিজেরও দুটো বাচ্চা আছে?’

মওলানা নিরব। নিরব গোটা বিচারিক মজলিশ। ইশারা স্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শুনতে লাগলো। মাত্র কয়েক মিনিট আগেই এই ছেলের ব্যবহারে সে রাগ করেছিল। পণ করেছিলো জীবনে আর ইঞ্জিমামের সাথে কথা বলবেনা। যে কিনা তার বাল্যবন্ধুকে অস্বীকার করে শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে। সেই ইঞ্জিমাম বলছে এই কথা !

ইশারাকে বিস্মিত করে দিয়ে ইঞ্জিমাম পুনরায় বললো, ‘ জমিলা চাচি আপনার কথাগুলো আমি শুনেছি। চাচি আপনি মুরুব্বি মানুষ তাই সহজ করে বলি। সবাই একরকম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় না। সবাই আপনার মতো এতো দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখতে পারবে না। আপনার জন্য সাধুবাদ কিন্তু যে বিধান আল্লাহতা’লা স্বয়ং রেখেছেন তার বান্দার জন্য তাতে যদি আপনাদের মানসম্মান যায় তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহর বিধানের উপর আপনারা সন্তুষ্ট নন, নাউযুবিল্লাহ। আর রাসুল সাঃ এর যে হাদিসটা আপনি বললেন তার পাশাপাশি এটাও জেনে রাখুন, রাসুল সাঃ বলেছেন, ‘যে আমার সুন্নতকে অপছন্দ করলো সে যেন আমাকেই অপছন্দ করল। ” এ পর্যন্ত বলে থামতেই জমিলা চাচি এপাশে গুনগুন করে কেঁদে উঠলেন। মওলানা এবারও নিরব।

কেবল আব্দুল্লাহ এগিয়ে এসে ইঞ্জিমামের হাত ধরে বলল,’ আপনি যা বলছেন তা সত্যিই ভাইজান ?’

” সিরাহ পড়ে দেখো। উস্তাদদের জিজ্ঞেস করে জেনে নাও। তুমি জানো আমি মিথ্যে বলিনা। তাও কিনা আমার নবীর শানে! এ জিভ খসে পড়ুক।’

‘ আমি আম্মাজান উম্মে সালামার পুত্র উমারের মতো হতে চাই ভাইজান।’ আব্দুল্লাহর কণ্ঠে অন্য রকম দীপ্তি। ইঞ্জিমাম সামান্য হাসলো।

” মাশাআল্লাহ। এটাই ঈমানী জযবা। এই ট্যাবু ভাঙতে হবে ভাই। তিনি তোমার মা এটা যেমন সত্য তেমনি তিনি আল্লাহর একজন দুর্বল বান্দি। রক্তমাংসের একজন মানুষ এটাও সত্য। কুরবানী নিজে দেয়া যায় আব্দুল্লাহ। কারো কাছ থেকে আশা করা যায় না। আল্লাহ তোমাকে একটা সুন্নাহ পালনের সুযোগ দিয়েছেন। সুযোগটা কাজে লাগাও। ”

এর পরের ঘটনাগুলো একটার পর একটা ঘটে গেলো। মওলানা এবং জমিলা বিচারের রায় মেনে নিয়ে কন্যা বিয়ের জন্য সম্মত হয়ে বিদায় নিলেন। তাঁদের শেষ প্রশ্ন ছিলো,’ লোকজন মন্দ বললে তারা কী উত্তর দিবে! ‘

হাকিম মোল্লা তাদের বললেন, ‘তোমরা আমার নবীর কথা ভাবো তাহলে উত্তর পেয়ে যাবে। এই দুনিয়ায় আইনের প্রয়োগ হয় জনগনের উপর দিয়ে। আইন প্রণেতারা এর বাইরে থাকে। একমাত্র ইসলামই সেই বিধান যার আইন প্রনয়নের পর তার প্রয়োগ প্রথম শুরু হয় তার নেতাকে দিয়ে। আমাদের নবীকেও সে যুগে তাঁর কিছু বিয়ের কারণে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। আম্মাজান আইশা রাঃ , আম্মাজান যাইনাব বিনতে জাহাশ রাঃ যিনি তার পালক পুত্রের স্ত্রী ছিলেন। এসব বিয়ে ছিলো সেসময়ের গোঁড়ামীর মূলে কুঠারাঘাত। আমাদের নবী সেসব সহ্য করেছিলেন। আজও যখন কিছু কুলাঙ্গার আমাদের নবীর জীবনী না জেনে তাঁর একাধিক বিবাহ নিয়ে আলোচনা করে তখন তোমরা ওদের সাথে ঝগড়া করো ঠিকই কিন্তু বাস্তবে ওদের কথারই বাস্তবায়ন কর। ‘

হাকিম মোল্লা থামলে ইঞ্জিমাম আব্দুল্লাহকে বললো, ‘ শোন, আব্দুল্লাহ দেশীয় আইনে তুমি নাবালক হলেও শরীয়া আইনে তুমি সাবালক। কারণ তোমার গোসল ফরয হয়ে গেছে। আর কয়েক বছর পর ইনশাআল্লাহ বিয়েও করে ফেলবে। মাকে এভাবে আটকে রেখো না। বিয়েটা সহজ করে দাও তাহলেই জেনা কঠিন হয়ে যাবে। আজ বিয়ে কঠিন বলেই জেনা সহজ।”
=====
একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরলো ইশারা। রাতে ছোটমায়ের সাথে বিচারের বিষয়বস্তু নিয়ে টুকটাক আলাপ করলো। বাকি রাত ঘুম হলোনা ইশারার।
পরদিন নাস্তার টেবিলে বড়ভাইয়া জানালেন, ইশারা এখন থেকে মাসুমার কাছেই থাকবে। কলেজ খোলা থাকলে হোস্টেলে যাবে নয়তো ছুটিছাটা সহ বাকিটা সময় সে মাসুমার ঢাকার বাড়িতে থাকবে। এটা ওদের সব ভাই বোনদের মিলিত সিদ্ধান্ত। তাছাড়া মাসুমার যে দেবর ওকে বিয়ে করতে আগ্রহী তাকে বলে দেয়া হবে আরো তিনচার বছর পর আসতে। ইশারার ইন্টার্নী শেষ হবার পর। ইশারা যেন নিজের ভবিষ্যত নিয়ে একদম না ভাবে। তাছাড়া ও একজন ডাক্তার। ওর জন্য পাত্রের অভাব হবেনা ইত্যাদি। ছোটমার ব্যপারেও সবকিছু ভাবা হয়েছে। তিনি তার বাপের বাড়ি চলে যাবেন। তাকে এককালীন কিছু টাকা দিয়ে দেয়া হবে যেটা ব্যাংকে রেখে তিনি আজীবন খেতে পারবেন।

ইশারা সব শুনলো কোন মন্তব্য করলো না। গ্লাসে পানি ঢেলে নেবার সময় রুমানা আর গোধূলির অসন্তুষ্ট মুখটাও একবার দেখে নিলো। ইশারা ভালো করেই জানে ওরা মুখে হাসিখুশি ভাব ধরে রাখলেও মনে মনে নারাজ। অবশ্য ইশারার সম্পত্তি দেখাশোনার ভার মাসুমা আপার বরের হাতে চলে যাচ্ছে এটা ওদের সহ্য না হবারই কথা। আজ ইশারার চেয়ে বেশি দাম ওর সম্পত্তির।

ইশারা শান্ত মুখে পুরো নাস্তা শেষ করলো তারপর উঠে চলে গেলো ভিতরে। সেখানে ছোটমাকে দেখা গেলো মুখ গুঁজে পড়ে আছেন। ইশারা তার পাশে বসলো। পিঠে হাত রাখলো।
” কী হয়েছে মা?”
” কিছু হয়নাই।” বলে উঠে বসলেন ময়না বিবি। চাপা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন, ” আর কয়দিন বাদে তুমি চইলা যাইবা। এর লিগা মনডা খারাপ।’
” বাহ্ কী সুন্দর করে মিথ্যা বলো তো তুমি ? কার কাছ থেকে এমন করে মিথ্যা বলা শিখলে ? ”
ময়না বিবি চুপ মেরে গেলেন। ইশারা তার মাথার ঘোমটাটা ঠিক করে দিয়ে বললো,” তুমি কোথাও যাবেনা। এখানেই থাকবে। আমার কাছে।”

ময়না বিবি চমকে তাকালেন। ইশারা আর কোন কথা না বলে সোজা উঠে রাহিমা চাচির ঘরে চলে এলো। এবারও ওকে দেখে ইঞ্জিমাম দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল তবে যাবার আগে ওর বিরক্তিটা ইশারার নজর এড়ায়নি। ইশারার যখন তখন আগমন ওকে বিরক্ত করছে সন্দেহ নেই। ইশারা ওর বিরক্তি আজই শেষ করে দিবে।

ইশারা রাহিমা চাচির মুখোমুখি বসলো। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে তারপর দ্বিধা কাটিয়ে ফেললো। স্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, ” চাচি, আমি আপনাকে ঐ দিনের ব্যপারে বলতে এসেছিলাম।”

রাহিমা প্রথমটায় হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন ইশারার দিকে। যেন ওর কথাটা ধরতে পারছেন না। তারপরই মৃদু স্বরে বললেন,” কী কথা, বলো না মা।”

ইশারা মুখ নামিয়ে বললো,’ গতকাল সারারাত আমি অনেক ভেবেছি চাচি। আপনার প্রস্তাবটা আমার জন্য সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে। তাই আমি স্থির করেছি আপনার পরামর্শটাই আমি বাস্তবায়ন করব। আমি আপনার ছেলের সাথে বিয়েতে রাজি। তবে আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে চাচি। ”

” কী অনুরোধ বলো।’ রাহিমা হাসছেন।

” আমার ছোটমাকে আমি নিজের কাছে রাখতে চাই। আমি চাই ছোটমা তার জীবনের বাকি দিন তাঁর স্বামীর ভিটাতেই থাকুন। আমার বিয়ের পর আমি এখানেই থিতু হতে চাই। যেমনটা আপনি চান সাহেদ ভাই থাকুন।”

” মাশাআল্লাহ মা। খুবই সুন্দর ইচ্ছা। তা মা সাহেদ কী তোমাকে এখানে রাখতে রাজি হবে? আমি নাহয় সাহেদকে ফোন করি, করব! ‘
ইশারা এবার জবাব না দিয়ে রাহিমার হাত ধরে মুখ লুকলো। চোরা হেসে বললো, চাচি আমি শাহেদ ভাইয়ের কথা বলিনি।”

” ওমা, তাহলে?” রাহিমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। আর ইশারার চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করলো। ওর চেহারা দেখেই রাহিমা যা বোঝার বুঝে নিলেন। এবার তিনি সামান্য মুচকিও হাসলেন। খুশি হয়ে ইশারার কপালে চুমু দিলেন। ইশারা ইতস্তত করে বলল,’ ও কী রাজী হবে চাচি ! ‘
‘ অরাজি হবে বলে মনে হয়না। কথা বলে দেখি।’ ইশারা সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস চাপলো।

===

হাকিম মোল্লা চাচার বাড়ি থেকে ফিরেই ইশারা বড় ভাইয়ের কাছে এলো। আখতার তখন সবার সাথে একত্রে চা পান করছিলেন। ইশারা সবার সামনেই বললো, ‘আমার কিছু কথা আছে ভাইজান। তোমাদের সবার সাথে।’

আখতার ছোটবোনের দিকে তাকাল। সস্নেহ হাসি দিয়ে বলল,” আয় না বুবু। বস এখানে। কী বলবি বল।’ আখতারের কণ্ঠই বলে দিচ্ছে সে খুব খুশি।

‘ ভাইজান, আমি চাই ছোটমা এখানে থাকুন। গ্রামে এই বাড়িতে।’ যথেষ্ট সময় নিয়ে ধীরে ধীরে কথাগুলো বললো ইশারা। আখতার তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু না বললেও গোধূলি তেতে উঠল। তীক্ষ্ম স্বরে বললো,
” মানে ? সে কেন এই বাড়িতে থাকবে! আর এই সিদ্ধান্ত দেবার তুই কে ? ”
‘ আমি লালমিয়ার ছোটমেয়ে আর ময়না বিবি লালমিয়ার বিবাহিতা স্ত্রী, এইজন্য।” ইশারা বিচলিত হলোনা। সে শান্ত রইলো। এরইমধ্যে রুমানা বলে উঠল।
” বাহ। অনেক বড় হয়ে গেছিস মনে হয়। এখনও বিয়েশাদি হয়নি। জীবন শুরু করিসনি। আর এখনই সিদ্ধান্ত দেয়া শুরু করেছিস?”
গোধূলি পাশ থেকে ফোড়ন কাটলো, ” বুঝবে না কেন। দুদিন ধরে তো ঐ বাড়ি থেকেই বুদ্ধি ধার নিচ্ছে। কত বুদ্ধি গজাবে এখন মাথায়? ”

ইশারা ম্লান হাসলো। ” ঠিকই বলেছো আপু। আমার বুদ্ধি আসলেই গজাতে শুরু করেছে। যেদিন থেকে আমার পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে সেদিন থেকেই আমি বুঝতে শিখেছি আমার ফেরার জায়গাটা নাই হয়ে গেছে। তোমরা সবাই একদিন যার যার বাড়ি ফিরবে। তোমাদের ঘরে। আর আমি ফিরবো হোস্টেল। সেখান থেকে বড়আপার বাড়ি। আরেক হোস্টেল। অন্তত আমার জন্য। আর এভাবে ততদিন চলবে যতদিন আমার নিজের কোন ঘর না হয়।”

” কেন, একথা হবে কেন। তুই একদিন ডাক্তার হবি। কত নাম ডাক হবে তোর। তোর এতো ভাবনার কী আছে!’ রুমানা বললো। তবে তার জবাব দেবার আগেই আখতারুজ্জামান নরম সুরে বললেন, ” আচ্ছা, আমরা কী তোর কেউ না ! এভাবে করুণ গলায় কথা বলছিস কেন রে!’ আখতারের গলা কিছুটা ভিজে এসেছে বলে মনে হলো ইশারার। সে বলল,’ তোমরা অবশ্যই আমার অনেক কিছু তবে সেটা সাময়িক সময়ের জন্য। অনেকটা ওয়েটিং রুমের মতো। যেটা না হলে গন্তব্য বদলানো যায় না। আমি আমার গন্তব্য পৌঁছাতে চাই ভাইয়া। যেখানে আমি বারবার ফিরতে পারব। যেখানে গেলে আমার মনে হবে,’ আই এম হোম। যেটা হবে আমার একখন্ড আশ্রয়।’
‘ বাব্বাহ, এতো কিছু ঠিক করে ফেলেছিস। তা এটা কী করে ভাবলি যে তোর কথায় ছোটমাকে এখানে থাকার অনুমতি দেব আমরা!’ মাসুমা বলে উঠল। ইশারা হাসল।
‘ আমি তোমাদের কাছে তো অনুমতি চাইনি আপা। যেটা বাবা নিজে দিয়ে গেছেন সেটা থেকে তোমরা তাকে বঞ্চিত করতে পারবেনা। এটা জুলুম।”
” ছোটমা নিজে না দাবী নামায় স্বাক্ষর করে তার মতামত জানিয়ে দিয়েছেন। এখন আর এসব বলে লাভ নাই।’ রুমানা মুখ ভ্যাঙচানোর মতো করে বললো। ইশারা মুচকি হেসে বললো,” সেটা কোর্ট বুঝবে। স্বামী মারা যাবার দ্বিতীয় দিনে কেউ কাউকে লিখে পড়ে জমি দিয়ে দেয় এটা আজ প্রথম জানলাম। যাই হোক, ভাইয়া, তোমাকে বলছি। তুমি আমার বড় ভাই। আমার বর্তমান অভিভাবক। যদিও আইনগত ভাবে আমি নিজেই বিয়ে করতে পারি তবু আমি চাইবো অন্তত আমার আকদের দিন তুমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার গন্তব্য বদলে দাও। আমার জন্মগত অভিভাবক হয়ে আমাকে আমার স্থায়ী ঠিকানা পর্যন্ত পৌঁছে দাও।’

মুহূর্তেই শোরগোল পড়ে গেলো ঘরের মধ্যে। মাসুমা রুমানা গোধূলি একসাথে চেঁচাতে শুরু করলো। গোধূলী তো বলেই বসলো, বাপ মরেছে দুদিনও হয়নি। আর উনার মনে রঙ লেগেছে। কেবল আখতার নিরব বিস্ময়ে বোনকে দেখতে লাগল। ইশারা ওদের কোন কথারই কোন জবাব দিলো না। এক মুহূর্তের জন্য ওর নিজেকে নাবিলা বলেও মনে হলো।
আখতার এবার প্রশ্ন করলো,’ছেলেটা কে রে! ‘

ইশারা মুখ নামালো। নাম বললো। মাসুমা গোধূলি আর রুমানার মুখে এবার তালা পড়ে গেলো। বিস্ময়ে তাদের চোখে পলক পড়ছে না। আখতার শুধু বললো,’ যা বলছিস ভেবে বলছিস তো!’
‘ জি ভাইয়া। ঠান্ডা মাথায়। ইনফ্যাক্ট আমার ইচ্ছের কথাটা একটু আগে জানিয়েও এসেছি চাচিকে। দুদিন বাদে তোমরা সবাই চলে যাবে। আমারও কলেজ খুলে যাবে। তোমরা এই গ্রামে আবার কোনদিন আসবে কিনা জানিনা। এলেও সবাইকে একসাথে পাবো কিনা তাও অনিশ্চিত। এসব কিছু ভেবেই আমি চলে যাবার আগে নিজের জন্য একটা গন্তব্য রচনা করতে নিয়েছি। ওটাই হবে আমার ঘর,আমার ডেসটিনি।’
‘ হম, আমি অবশ্য সাহেদকে ধারণা করেছিলাম। ও ডাক্তার ছিল। তুইও ডাক্তার হবি দুদিন বাদে। মানাতো তোদেরকে।’
‘ দুজনেই ডাক্তার হলে সব ঠিকমতো চলবে এমন কোন যুক্তি নেই ভাইয়াা। ইনজাম মানুষ হিসেবে সাহেদের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে।’
‘ যাক তুই সংসার করবি তুই ভাল বুঝিস।
ইনজাম তো আবার তোর বাল্যবন্ধু। ” বলে আখতার থেমে গেলো। এবার আর কেউ কোন কথা বললো না। আখতার এই প্রথম ইশারার কাঁধে হাত রাখলো। মৃদু স্বরে বললো, ” আমি বেঁচে থাকতে তুই নিজের বিয়ের কথা নিজে চালাচালি করবি এটা ঠিক না। চল, আমাকে চাচার কাছে নিয়ে চল। ‘

======

এর ঠিক পাঁচদিন পর এক অনাঢ়ম্বর পরিবেশে ঘরোয়া পরিসরে ইশারা আর ইনজিমামের বিয়ের আয়োজন করা হলো। মায়ের জরুরী তলব পেয়ে সাহেদ চলে এলো গ্রামে। এবার সে এসেই প্রতিবারের মতো পরদিন দৌড় মারেনি। ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা শুনে রয়ে গেছে। পরিবারের সবার খুশিতে সেও খুশি। আনন্দে আবেগে দারুণ আপ্লুত। কেবল খুশি মনে হলো না শুধু একজনকে। আকদের দিন বিকেলেই তার রাগান্বিত মুখ দেখলেন রাহিমা। ছেলের মেজাজি প্রশ্নের উত্তরে তিনি কেবল অসহায়ের মতো বললেন,’ আরে বাবা, আমি কী করব ! ইশারা নিজেই বলল, আকদের পরদিন সে চট্টগ্রাম চলে যাবে। সামনের সপ্তাহে কলেজ খুলবে ওর। এদিকে সাহেদও বেশিদিন থাকবে না বলছে। কাকে রেখে কাকে আটকাব ! ‘
‘ সেজ ভাই যাচ্ছে যাক। কিন্তু বিয়ের কনে বিয়ের পরদিনই উধাও হয়ে যাবে এটা কোন নীতি ! সে আবার কবে ফিরতে পারবে, কবে ছুটি হবে তার কী ঠিক আছে ! এসবের কী কোন মানে হয়! ‘
‘ জানি না। হুট করে সব ঠিক হলো। এতো কথা বলতে পারিনি ! তুই একটু ওর সাথে কথা বলে দেখ না। বলে কয়ে দুই একটা দিন রাখতে পারিস কিনা। ইশারা এমনিতেও তোর উপর রেগে আছে। সেদিন নাকি খারাপ ব্যবহার করেছিলি !’
‘ আরে আশ্চর্য্য, আমি খারাপ ব্যবহার করলাম না সে করল !’ বিস্ময়ে বাকহারা হবার যোগাড় হলো ইনজিমামের।
‘ কী জানি, ইশারার সাথে কথা বললে বোঝা যেত। তুই কথা বলে দেখবি ! তবে বিয়ের আগে কনের সাথে একা কথা বলা ঠিক হবে না। চল আমিও যাই তোর সাথে।’ রাহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।
‘ তোমার যেতে হবে না। ঐ বাড়িতে অনেক লোকজন আছে। আমি যা বলার তাদের সামনেই বলব। ‘

মায়ের সাথে কথা শেষ করেই সরাসরি লালমিয়া ব্যপারীর বাড়ি চলে এল ইঞ্জিমাম। এ বাড়িতে আখতারের আয়োজনে ইশারার বিয়ের ধুম পড়েছে। বোনের আকদ সম্পন্ন করে কাল সবাই যার যার গন্তব্যে চলে যাবে। ইশারাও তাদের সাথেই রওনা দেবে।
ইনজিমামকে দেখে আখতার নিজেই এগিয়ে এলো। তাকে দেখে মনে হলো সে বেশ খোশ মেজাজে আছে। বিয়ের পাশাপাশি চলে যাবার গোছগাছও চলছে এ বাড়িতে। সে ইঞ্জিমামকে দেখেই সাদরে অভ্যর্থনা জানালো। ওর হাত ধরে বললেন, ‘ আরে ইনজিমাম যে। এসো ভাই।’ বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল আখতার।’ আমি ভাবতেই পারিনি ইশারা নিজের জন্য তোমাকে বাছাই করবে। যা একরোখা মেয়ে। আজ থেকে তুমিই হবে ওর অভিভাবক। আমার বোনটাকে সবসময় দেখে রেখ ভাই। ও একটু জেদি মেয়ে। ওর উপর কখনও রাগ করবে না। কোন সমস্যা হলে বুঝিয়ে বলবে।
‘ জি, ইনশাআল্লাহ। আমি একটু ইশারার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম আখতার ভাই।”
‘ ওহ তাই নাকি। দাঁড়াও, ওকে বলছি। তুমিই ভেতরে এসো না।’
‘ না, ও আপনার সামনে আসুক। সমস্যা নেই। আমি শুধু জানতে এসেছি, সে আমার সাথে কথা না বলে কালই কলেজে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারলো । আকদ মানে তো বিয়েই। আল্লাহ চাইলে আর কিছুক্ষণ পর আমাদের আকদ হয়ে যাবে। আমাদের সমস্ত সিদ্ধান্ত হবে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে। সে একা এই সিদ্ধান্ত নেবে কেন। ওকে ডাকুন !’

ইনজিমামের গোয়ার্তুমি সম্পর্কে ধারণা আছে আখতারের। সে বোনকে ডাকলে ইশারা জানালো আকদের আগে হবু বরের সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই ওর। ইনজিমাম রেগে গেল এবার। আখতারের অনুমতি নিয়ে গটগট করে রুমের ভেতরে ঢুকে গেল। গমগমে গলায় বলতে লাগল, ‘ ইশারা, আমি আখতার ভাইয়ের সামনেই বলছি। আগামী সাতদিনের আগে কোথাও যাওয়া হবে না তোর। বিয়ে কোন রেজিস্ট্রেশন ফর্ম ফিলাপ না যে সই করেই দৌড় দিবি। এটা কোন ফাজলামি না যে মনমত যা ইচ্ছে তাই করবি! ‘
ইশারা তার ছোটমায়ের হাত ধরে তার দিকে মুখ করে বসে ছিল। ময়নাবিবির মত তার মাথায়ও আজ লম্বা ঘোমটা। ইনজিমামের কথাগুলো শুনে মুখ নামিয়ে রাখলো ইশারা। জবাব দিলো না। ওর পেছনে আখতার আর ইনজিমাম দাঁড়ানো। ইশারা আজ কোন তর্কও করলো না। অধোবদনে বসে রইলো। ইনজিমাম আখতারকে বলল, ‘ আখতার ভাই, আপনার বোনকে বলুন সে যেন কালকেই চলে না যায়।
অবস্থা বেগতিক দেখে আখতার নিজেই এবার বলল , ‘ আচ্ছা আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি। ও কালকে যাবেনা অন্তত। বাকিটা তোমরা পরে আলাপ করে নিও।’ ইঞ্জিমাম একবার ইশারার পেছন থেকে দেখল তারপর বেরিয়ে গেল।

ঘন্টাদুয়েক পর খুবই সাধারন এক মজলিশে লাল মিয়ার নিজের ঘরে ইশারা আর ইনজিমামের বিয়ে পড়ানো হয়ে গেল। ইশারা জানতো না বিয়ের মত এত বড় একটা ব্যপার এত সাধারণভাবে সম্পন্ন হতে পারে। কবুল বলা আর স্বাক্ষর করার পর ওর হাতে যেন আর কোন কাজ রইলো না। চুপ করে বসে রইলো ইশারা। একটু পরেই ওকে আনুষ্ঠানিক ভাবে রহিমা চাচির বাড়ি নেয়া হবে। সেরকমই আয়োজন চলছে। জিনিসপত্র আগেই বেঁধে রেখেছিল। এগুলোর সাথে ইশারা আজ আনুষ্ঠানিকভাবে ইনজিমামের ঘরে আর জীবনে প্রবেশ করবে। ভাবতে গিয়ে অবাক হলো ইশারা। গত কয়েকদিন অন্তত শতবার এ বাড়ি ও বাড়ি করেছে। ওর সাথে কাউকে যাবার দরকার পড়েনি। আজ ঐ বাড়ি যাবার জন্য কত আয়োজন আর আনুষ্ঠানিকতার দরকার পড়ছে। কারণ আজকের যাওয়া অন্যদিনের মত নয়। আজ থেকে ওদের দুজনের সমস্ত সিদ্ধান্তে পরস্পরের সম্মতির মোহরের দরকার পড়বে। যে সিদ্ধান্তে দুজনের মৌন সম্মতির স্বাক্ষরটুকু না থাকবে সেই সিদ্ধান্ত হবে হঠকারী সিদ্ধান্ত। কী অদ্ভুত এই জীবন।

খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না ইশারাকে। কিছুক্ষণ পরেই ইনজিমাম দরাজ কণ্ঠে সালাম দিয়ে রুমে প্রবেশ করলে সামান্য নড়েচড়ে বসল ইশারা। ইঞ্জিমাম দেখলো হালকা কলাপাতা রঙের স্বচ্ছ ওড়নায় ইশারার মুখাবয়ব অস্পষ্ট। তবে ওর ডিম্বাকৃতি মুখের আদলটা স্পষ্ট। ঐটৃকুই ইঞ্জিমামের রক্তে দোলা দিলো। সে নিরবে কিছুক্ষণ দেখল ওকে। বলল, ‘ সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব।’
‘ জবাব দিয়েছি আগেই।’ মৃদুস্বরে বলল ইশারা। ইনজিমাম এবার হেসে ফেলল, ‘ গতদিন গুলোতে তো দেখলেই বেহায়ার মত ছুটে আসা হতো। খোঁচানোর চেষ্টায়ও ত্রুটি দেখিনি। আজ যে বড় ঘোমটার আশ্রয়ে চলে গেলি !’
ইশারা মুখ তুলল। ইনজিমাম দেখল পরিপাটি খোঁপা আর হালকা সাজের জন্য ইশারার মুখখানি ভারি কমনীয় দেখাচ্ছে। ওড়নার আড়ালটা সরাতে ইচ্ছে করছে না। ভারি স্বরে বলল, ‘ কিছু বলবি ? ‘
ইশারা নিজেই ঘোমটা তুলে দিলো মাথায়। ইনজিমামকে স্থির বসে রইলো। চটজলদি বেচাল হতে রাজি নয় সে। ইশারা ভ্রু কুঁচকে বলল,’ আমার যাত্রা পেছানোর মানে কী ! সামনে আমার এনাটমির ক্লাস আছে। আখতার ভাই বলেছে বলে কালকের দিন বাদ দিয়েছি কিন্তু পরশু তো যেতেই হবে আমাকে ! ‘
‘ পরশু যাওয়া হবে না। ‘
‘ কেন! ‘
‘ কেন’র কোন উত্তর নেই ইশারা। ‘ ইনজিমাম রাগ চাপতে কষ্ট হলো এবার। ‘ তুই যে আমার ওপর শোধ নিচ্ছিস তা ভাল করেই বুঝি আমি ! তোর সঙ্গে লটরপটর করিনি বলে জেদ করে বিয়ে করলি আর এখন বিয়ের পরদিনই দৌড় দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিস ! ‘
‘ আমি কোন শোধ নিচ্ছিনা। আমার ক্লাস আছে, যেতেই হবে।’
‘ যেতে হলে যাবি, কিন্তু আমাকে তোর সাথে নিতে হবে। আমাকে না নিয়ে একপা নড়তে পারবি না।’ একগুঁয়ে ভঙ্গিতে বলল ইনজিমাম।
‘ তোকে নেব মানে ! ওখানে গিয়ে তুই কী করবি!’
‘ কী করব আবার ! তোকে রেঁধে খাওয়াব, চুল আঁচড়ে দেব। কাপড় ধুয়ে দেব আরো যা যা লাগে সব করব কিন্তু আমাকে ফেলে যেতে দেব না। বিয়ে মানেই দায়িত্ব। আজ থেকে আমার সব দায়িত্ব তোর। ‘
‘ দায়িত্ব হলেই তোকে আমার সাথে নিতে হবে ! ওখানে তুই থাকবি কোথায়, খাওয়া দাওয়া কীভাবে কী ! ‘
‘ সেসব তোর চিন্তা। ‘
‘ এসব পাগলামির কোন মানে হয় না ইনজি। আমাকে যেতে হবে। সেটা কাল না হলেও পরশু।’
‘ গেলে যাবি, সমস্যা কী। আমার মনের এনাটমির চেয়ে যদি তোর মানুষের এনাটমির পাঠ নেবার আগ্রহ যদি বেশি হয় তাহলে যাবি ! আমি মরলেই তোর কী আর বাঁচলেই কী। ‘ ক্লান্ত সুরে বলল ইনজি। ইশারা চুপ করে গেল এবার।
ইনজিকে মুখ ভার করে বসে থাকতে দেখে ওর বিশাল হাতের থাবাটা নিজের কোমল হাতে তুলে নিলো। তারপর তর্জনী আর মধ্যমাকে দুপায়ের ভঙ্গিতে হাঁটিয়ে দিলো ইনজিমামের লোমশ হাতের উপর দিয়ে। ইনজি নিরবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইশারার এই আচরণটা নতুন নয়। খুব ছোটবেলায় ওরা যখন একজন আরেকজনকে সুড়সুড়ি দিতে চাইতো তখন এই ভঙ্গিতে বাহু পর্যন্ত দু় আঙুলে হেঁটে গিয়ে থেমে যেত তারপর হুট করে বগলে বা পেটে সুড়সুড়ি দিতো আর ছড়া কাটতো।
ছোট ঘরে ইঁদুর
বড় ঘরে যায়
বড় ঘরের ইঁদুর
কাতুকুতু দেয়।

ইশারার আঙুল হেঁটে ইনজির বাহু পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেল। ইনজি তাকিয়ে আছে ইশারার পরবর্তী আচরণের অপেক্ষায়। ইশারা হাত সরিয়ে নিলে ইনজি খপ করে ওর আঙুল চেপে ধরল, ‘ কী হয়েছে ! সরে যাচ্ছিস কেন ! সেদিন তো খুব খোঁচা মারতে এসেছিলি ! এখন যখন গুঁতো কাতুকুতু সবই হালাল তখন সরে যাচ্ছিস কেন ! ‘
‘ এমনিই।’
‘ এমনিই না। এখন সরে যাচ্ছিস কারণ ভাল করেই জানিস পাল্টা খেতে হবে, এই ভয়ে। ঠিক বলেছি না ! ‘
ইশারা জবাব দিলো না। সরে বসতে গেলে ইনজি টেনে ধরল ওকে, ‘ তুই কী সত্যি পরশু চলে যাবি ! ‘
‘ পরশু আমার ক্লাস ইনজি। মিস দিতে পারবো না।’
‘ তাহলে বিয়ে করলি কেন। পড়াশোনা শেষ করেই বিয়ে করতি। আমাকে কী রোবট মনে হয় তোর ! ‘
‘ অনেকটা। তবে রোবট না গবেট।’
ইনজিমাম শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ সেদিন আমরা পরস্পরের জন্য হারাম ছিলাম ইশু। তোর ব্যপারে অমন কঠোরতা না করে আমার উপায় ছিল না। তুই হয়ত আশা করেছিলি আমি তোকে জড়িয়ে ধরে..!’
‘ কখনো না। ‘ তীব্র প্রতিবাদ করে উঠল। ‘তুই একটা মিথ্যুক।’
‘ আর তুই পাষান। ‘ ইনজি শক্ত গলায় বলল।
ইশারা কোন জবাব দিলো না একথার। ইনজিমাম একটু নিরব থেকে বলল, ‘ আচ্ছা ঠিক আছে। যদি কাল বা পরশু চলে যেতে চাস তো যা। আমি বাধা দেব না। চাইলে কালই চলে যা। আমি আমার সংসার সেদিনই শুরু করব যেদিন তোকে পুরোপুরিভাবে পাবো। ‘ ইশারার হাত ছেড়ে একেবারে সরে বসল ইনজিমাম। তারপরই বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। ইশারা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। চোখে যতনা বিস্ময় তারচেয়ে বেশি রাগ। ওর আশা ছিল ইনজিমাম হয়ত নিজের অধিকার দেখাবে ! ওকে নির্বিকার দেখে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর দাঁড়িগুলো মুঠো করে ধরে বলল, ‘ সারাটা জীবন আমার সাথে বাঁদরামি করে এসেছিস অসভ্য কোথাকার। আজ বিয়ের দিনও বাঁদরামি! কী ভেবেছিস, তুই না ছুঁলে আমি মরে যাব ! ‘
ইনজিমাম এবার মুচকি হেসে দুহাতের মাঝে জাপটে ধরলো তার নবপরিণীতাকে। হেসে বলল, ‘ আমি বাঁদরামি করলাম কই ! আসল বাঁদরামি তো তুই করছিস। ছোঁবার অধিকার দিয়ে আমাকে একা ফেলে চলে যাবার পরিকল্পনা করে।’
‘ না গিয়ে পারা যাবে না যে..।’
‘ তাহলে এমন হুট করে বিয়ের তাল তুললি কেন। আমার যে কষ্ট হবে তুই জানিস না।’
‘ যাক, অবশেষে স্বীকার করলি তাহলে !’ ইশারা হেসে ফেললেও ইনজির শক্ত বাহুবন্ধনে ভাষা হারিয়ে ফেললো। ইনজি কাতর স্বরে বলল,’ কেন এরকম করছিস আমার সাথে ! ‘
‘ প্রতিশোধ নিচ্ছি।’ বলে মুখ গম্ভীর করতে গিয়েও ফিক করে হেসে ফেললো ইশারা।
ইঞ্জিমাম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ যাসনা প্লিজ, খুব কষ্ট পাবো।”
‘ তোর জন্য উচিত শিক্ষা।’
‘ হম, আসলেই উচিত শিক্ষা হচ্ছে আমার।’ বলে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইলো ইশারার দিকে। ওর করুণ ভঙ্গিমা এবার ইশারাকে দুর্বল করে ফেললো। সে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিলো ইনজির চওড়া বুকের দেয়ালে। হঠাৎ শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো ওর। ইনজিমাম মৃদু শব্দে বলল,’ কান্না করার কী হলো! ‘
‘ প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছি রে !ইমামপত্নীর বিচারের দিন তুই যেভাবে পরিস্থিতির জট ছাড়াচ্ছিলি সেদিনই হঠাৎ মনে হলো ঠিক তোর মত একজনকেই আমি আজীবন মনে মনে চেয়ে এসেছি।’
‘ আর আমি যেদিন তোকে বিচারের রুমে চাদর টানাটানি করতে দেখলাম সেদিন কী মনে হচ্ছিল জানিস! ‘
‘ কী ! ‘
‘ মনে হচ্ছিল তোকে কোথায় যেন দেখেছি। পরক্ষণেই কথাটা মনে পড়ে গেলে চোখ ফিরিয়ে নেই। কারণ জানি তাকালেই ঐ দৃশ্যটা মনে পড়বে আর চোখে ভাসতে থাকবে। বিনা পরিশ্রমে আমি গুনাহগার হতে থাকব ৷ ‘
‘ কী এমন দৃশ্য যে তুই ভাবলেই গুনাহগার হতি !’
‘ বলা যাবে না। বললেই তুই আমাকে খারাপ ভাববি ! ‘
‘ ছি ইনজি ! ‘ আচমকা ধাক্কা দিয়ে সরে যেতে চাইলে ইনজিমাম ওকে আঁকড়ে ধরল।
‘ ছি মানে ! ছির কী আছে এখানে ! ‘
‘ তুই এখনই বললি তুই আমাকে কীভাবে দেখতি।’
‘ হ্যাঁ, তাতে ছি বলবি কেন ! আমি তোকে দেখতাম আমার জন্য রান্না করতে, আমার গোসলের সময় পিঠ ডলে দিতে, আমার চুল মুছিয়ে দিতে, আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে।’
এগুলোতে ছি বলার কী আছে ! ‘
‘ তাহলে যে বললি গুনাহগার হতি ! ‘
‘ বাহ্, কার না কার বউ ! আমার জন্য রান্না করছে, আমার গা মেজে দিচ্ছে, আমার লুঙ্গি কেঁচে দিচ্ছে, বুকে তেল মালিশ করে দিচ্ছে এসব ভাবাটা অপরাধ না! ‘
‘ তা অবশ্য। ‘
‘ তুই কী ভেবেছিলি ! ‘
‘ কিছু না।’
‘ আমি জানি তুই কী ভেবেছিলি। শহরে থেকে ফাত্রা তো কম হসনি। বলব কী ভেবেছিলি ! ‘
‘ এই না খবরদার।’ ইনজিমামের মুখ চেপে ধরলো এবার ইশারা। ইনজিমাম থেমে গেল। ইশারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ লুকালো ইনজির বুকের অরণ্যে। বলল, ‘ তোমাকে ফেলে একদম যেতে ইচ্ছে করছে না আমার।’
ইশারার মুখে তুমি ডাক শুনে হাসলো ইনজি।
‘ ইচ্ছে না করলেও তো যেতে হবে। এতোটা দুর্বল হলে চলবে কেন। তুমি যাবে সময়মতোই যাবি এবং হাসিমুখে। আমিই তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব। যেভাবে তোমাকে সেদিন স্বাধীন আর স্বেচ্ছাচারী অবস্থায় পেয়েও সাময়িক লোভে পড়ে নিজের জন্য বৈধ করে নেইনি। তেমনই আজও তোমাকে নিজের করে পেয়ে আমার বাকি দিনগুলোর স্বস্তি হারাম করব না। এটা তো আল্লাহর রহমত যে আমরা একে অন্যের গন্তব্য হতে পারছি। তুমি আমার কাছে ফিরবে আর আমি তোমার কাছে। দুজন হবো দুজনের আশ্রয়।’ ইশারা কোন কথা বললো না। মন দিয়ে উপলব্ধি করতে লাগলো প্রিয় বন্ধুর নৈকট্য।’
~সমাপ্ত~