তোমাকে নিয়েই গল্প পর্ব-০৭

0
1037

#তোমাকে_নিয়েই_গল্প
#পর্ব:৭
#জুনাইনাহ_তাসনিম_অরহা

অভ্র ভাই নিজের হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে,
–উঠে এসো।
–……………..
–কি হলো ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?এসো।

আমি হাত বাড়িয়ে দিই।কিন্তু অভ্র আমার হাত ধরে তোলার আগেই আমি ওনার হাত ধরে উলটা টান দিই।আর অসভ্যটা এসে পড়ে আমার পাশে।মুখ থাবড়ে পড়েছে।পড়ার কিছুক্ষন পর ওনার হুশ ফিরলে উনি আমার দিকে তাকায়।

–এই এই তুমি কি পাগল??আমাকে কাঁদায় এনে ফেললে কেন?বেয়াদব মেয়ে..
(ওনার মুখটা পুরো কাদায় লেপ্টে গেছে।খুবি ফানি লাগছে ওনাকে কিন্তু আমি হাসি চেপে রাখলাম।ওদিক থেকে আয়ানও কাকু কাকু বলে চিল্লাচ্ছে)

–আমি তো ইচ্ছা করে কিছু করিনি অভ্র ভাই।

–কি?তুমি ইচ্ছা করে করোনি?একদম মিথ্যে কথা বলবে না।তুমি ইচ্ছা করেই এটা করেছো।আর তার জন্যে তোমাকে আমি,তোমাকে আমি উচিত শিক্ষা দিবো বুঝলে???

–ধুর মিয়া বললাম না ইচ্ছা করে করিনি।আর আপনারই তো ভালো হলো প্রাকৃতিকি মাটি মুখে লেগে গেলো।রুপচর্চা হয়ে গেলো ভালো না??বাই দা ওয়ে আপনাকে এখন কিসের মতো দেখতে লাগছে জানেন??

–কিসের মতো??

–কাদা মাখা বাদরের মতো।হাহহাহাহহাহহাহহাহাহহহহহ….আপনাকে এইভাবেই স্যুট করে।প্লিজ উঠবেন না আমি একটা ছবি তুলবো আপনার তারপর উঠবেন।

আমি কথাটা বলে উঠতেই যাবো তখনি অভ্র ভাই আমার হাত ধরে টান দেন।আর আমি গিয়ে পড়ি ওনার বুকের খুব কাছে।উনি বাম হাত দিয়ে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নিলেন।আর সাথে সাথে আমার কানে হার্টবিটের আওয়াজ এলো,ধাক ধাক ধাক,ধাক।কিন্তু ওনার না আমার হার্টবিট তা বুঝে উঠতে পারছি না।উনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে,ওনার চোখের দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলাম না,চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।আস্তে করে বললাম,
–কি করছেন এটা??ছাড়ুন আমায়।
–………….(কে শোনে কার কথা)
–অভ্র ভাই(আমি এবার অনেকটা চিল্লিয়েই বললাম)
–হ্যা??
–ছাড়ুন আমাকে

উনি এতোক্ষনে যেন বুঝতে পারলেন আর ছেড়ে দিলেন।কয়েক সেকেন্ড পর আবার স্বাভাবিক হয়ে নিজের অসভ্য রুপে ফিরে এলেন।
–কাজটা ঠিক করলে না।এর শোধ তো আমি নেবোই।
(কথাটা বলেই উনি উঠে গেলেন।আমিও ওনার পিছু পিছু উঠে গেলাম)

১২.
সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর মা,বাবা,আমি,মামা-মামি,অন্তু ভাই,স্নিগ্ধা ভাবি,আপু,সৌরভ সবাই চা,নাস্তা খাচ্ছি।সেই সময় অভ্র ভাইও এসে বসলো।
সবার সাথে আছে কিন্তু তারমাঝেও ফোন নিয়ে ব্যস্ত।জিএফের সাথে কথা বলছে হয়তো।মা,মামা,বাবা সবাই কতো কথা বলছে কিন্তু জনাবের কোন হুশই নেই তিনি আছেন ফোনের জগতে।মা এক পর্যায়ে বলেই উঠলো,
–অভ্র আমরা এখানে এতো গল্প করছি আর তুই ফোন নিয়ে পড়ে আছিস কেন??রাখ তো তোর ফোন।
–শুনছি তো ফুপি তোমাদের কথা।তোমাদের ছোটবেলার গল্প,তোমার ছেলেমেয়েদের গল্প।আমার বাবা তার ছেলেদের গল্প বলতেছে।শুনছি তো।
–তাও তুই ফোন রাখ।তোদের এই জেনেরেশনের যে মোবাইলে কি এমন আছে বুঝি না।আমার ছোট মেয়েকেই দেখো সারাদিন ফোনে কি গ্রাম টাম চালায়।
–গ্রাম??!সে আবার কি ফুপু?(স্নিগ্ধা ভাবি বিস্ময় নিয়ে শোনে)
–ভাবি মা ইন্সটাগ্রামের কথা বলছে(আমি মুখ শুকনো করে বলি ভাবিকে)মা তোমাকে কতোবার বলেছি ইন্সটাগ্রাম কে গ্রাম ট্রাম বলবা না।(রেগে)
–হ্যা হ্যা হলো।আমি কি ওতো কিছুর নাম জানি নাকি??
–সেটাই তো সূচী।তুই রাগ করিস না আমরা পুরোনো দিনের মানুষ ওতো বুঝি না।(মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন)
–হ্যা কা রাগ করো না।(কোথা থেকে আয়ানও এসে পড়ে বলে ওঠে)
–আচ্ছা দাদুভাই তুমি সূচীকে কা বলে ডাকো কেন??(মামা জানতে চান)
–দাদাভাই এইটা আমার আর কার সিক্রেট,তোমাদের বলা যাবে না।
–সিক্রেট?কিসের সিক্রেট?তোমার সাথে যে আমার কোন সিক্রেট আছে বলে আমার মনে পড়ে না(আমি অবাক হয়ে বলি)
–আছেই তো এদিকে এসো বলছি।(আমি আয়ানের মুখের কাছে কানটা এগিয়ে দিই)আরে পাগলী মেয়ে সবার সামনে তো তোমাকে কাকি বলে ডাকা যাবে না তাই কা বলে ডাকি(পিচ্চিটা হোহহোহ করে হাসতে থাকে)

কথাটা শুনে আমি কি রিয়াক্ট করবো জানি না।এতো পাকা কেউ কিভাবে হয়??এটাই আমার মাথায় ঢোকে না।

রাতে ঘুমিয়ে আছি হটাত মনে হলো সৌরভ,আপু,মামি যেন কান্নাকাটি করছে।আমি ওতো পাত্তা দিলাম না।ঘুমের ঘোরে ভুল শুনেছি হয়তো।কিন্তু না কান্নার শব্দ আরো তীব্র হয়ে উঠছে ক্রমশ।আমি হটাত করেই এবার চোখ মেলে তাকাই।পাশে তাকিয়ে দেখি আপু পাশে নেই।কান্নার শব্দটা এবার স্পষ্ট হয়ে আমার কানে আসছে।বালিশের নিচ থেকে ফোন দেখি রাত ২টা ১৯ বাজে।এতো রাতে সবাই এভাবে কাঁদছে কেন??তাহলে কি কোন বিপদ হলো??নানির কিছু হলো না তো আবার।নানির কথা ভেবেই যেন হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার।সমস্ত শরীর যেন কেউ একজন চেপে ধরেছে।নড়াচড়ার বল টুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছি।আমি পাথরের মতো বসে আছি।হটাত কেউ যেন আমার গায়ে হাত দিলো আমি কেঁপে উঠি।তাকিয়ে দেখি আয়ান কাঁদছে।
–কা কা তুমি তাড়াতাড়ি চলো,ছোটদিদা ছোটদিদা ওখানে।তুমি তাড়াতাড়ি চলো কা(আয়ানের মুখে ছোটদিদা শুনে আমি যেন কথা বলার সামরর্থ্যটাও হারিয়ে ফেলেছি।আয়ান আমার মাকে ছোটদিদা বলে ডাকে।তার মানে আমার মায়ের কিছু হয়েছে সেই কারনে সবাই এভাবে কান্নাকাটি করছে।আমি মুখ দিয়ে আয়ানকে কিছুই বলতে পারছিনা খালি এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।ও এখনো কেঁদে চলেছে।ও আমার হাত ধরে টানতে লাগতো)
–কা চলো ছোটদিদার কাছে চলো।কা..
–মা(আমি মুখ দিয়ে শুধু মা টুকুই বলতে পারলাম আর কিছু বলতে পারলাম না)

খাট থেকে নেমে ছুটে গেলাম মায়ের রুমের দিকে।আমার পিছন পিছন আয়ান ও কাঁদতে কাঁদতে দৌড়াচ্ছে।আমাকে মায়ের রুমের দিকে যেতে আয়ান বলে
–কা ছোটদিদা বড় ঘরে।
আয়ান ড্রয়িংরুমটাকে বড়ঘর বলে তার মানে মা ড্রয়িংরুমে।আমি ছুটে ড্রয়িংরুমে গেলাম।সোফার ওপর মা সেন্সলেস হয়ে শুয়ে আছে মামির কোলে।মায়ের পার কাছে মাটিতে বসে আপু আর সৌরভ কাঁদছে।সোফার পিছন দিকে স্নিগ্ধা ভাবি মাকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে।আর অন্য পাশের সোফায় বাবা আর মামা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।আমি দূরেই দাড়িয়ে রইলাম।কোথা থেকে অভ্র ভাই প্রেশার মাপার যন্ত্রপাতি এনে মায়ের প্রেশার চেক করতে লাগলেন।উনি দুবার করে প্রেশার মাপলেন।মামা বলে উঠলেন,
–বাবা কি বুঝছিস??মনির কি হলো??
–……………..
–কি হলো তুই চুপ করে আছিস কেন??বল কি হয়েছে আমার বোনের?
–বাবা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।একেক বার একেক রকম প্রেশার দেখাচ্ছে।
–কিছু বুঝতে পারছিস না মানে কি??এতো টাকা খরচ করে তোরে ডাক্তারি পড়াইছি কি এই কথা শুনার জন্যে??(মামা রেগে উঠলেন)
–আহ ভাইজান,ওর ওপর রাগ করবেন না।বাবা অভ্র তুই কি কিছুই বুঝতে পারছো না??(বাবা বলে ওঠে)
–ফুপা আমার ধারনা অনুযায়ী ফুপির মিনি হার্ট এট্যাক হয়ছে।
–হার্ট এট্যাক?!(মামি আরো জোরে কেঁদে ওঠে)
–মা প্লিজ কাঁদবেন না এইভাবে।দাদি শুনতে পাবে।যদি একবার দাদির ঘুম ভেঙে যায় বুঝতে পারছেন কি হবে?(স্নিগ্ধা ভাবি বাতাস দিতে দিতে বলে)
–হ্যা এখন কান্নাকাটি করে কোন লাভ নেই।তার থেকে বরং ফুপিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় ভালো হবে।ভাইয়া তুমি গাড়ি বের করো।

অভ্র ভাইর কথায় অন্তু ভাই গাড়ি বের করে।মামা,বাবা,মামি মায়ের সাথে যেতে চায় কিন্তু অভ্র ভাই এই রাতে বয়স্কদের যেতে নিষেধ করে।অভ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
–সূচী চলো আমাদের সাথে।যাও ওড়না পরে এসো।(আমি বোকার মতো দাড়িয়ে থাকি,উনি ধমক দিয়ে ওঠে)কি হলো যাও(আমি ওড়না আনতে রুমে দৌড় দিই।কারন তাড়াহুড়াই আমি ওড়না বাদেই চলে এসেছিলাম)সূমনা চলো আমরা গাড়ির দিকে যায় সূচী চলে আসবে।

আপু অভ্র ভাইয়ের কথায় কোন উত্তর দেই না।চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।
–কি হলো সূমনা যা…(মামা বলে ওঠে)
আপু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে দৌড়ে চলে আসে তারপর অনেক জোরে দরজা দিয়ে দেই।আপুর দরজা দেয়ার শব্দে যেন পুরো বাড়ি কেঁপে ওঠে।
–অভ্র ও ওর মাকে এইভাবে দেখে হয়তো অনেক ভেঙে পড়েছে।ও থাক তোমরা যাও বাবা(আমার বাবা বলে ওঠে)

আমি,অভ্র ভাই আর অন্তু ভাইয়া মিলে মাকে উপজেলার এক হাসপাতালে নিয়ে যায়।হাসপাতালে পৌছাতেই এক ডাক্তার এসে অভ্র ভাইকে জড়িয়ে ধরে।
–আরে ইয়াং ম্যান কি অবস্থা?
–এই তো স্যার আছি।আপনার ভালো আছেন?
–হ্যা আমি তো সবসময়ই ভালো থাকি কিন্তু তোমার মুখটা এরকম শুকনো কেন?
–স্যার আসলে আমার ফুপি হটাত করেই অসুস্থ হয়ে গেছেন।আমার ধারনা ওনার হার্ট এট্যাক হয়ছে সেই জন্যেই এই রাতে এখানে আনা হয়েছে।
–বলো কি??
–জী স্যার।ডাক্তার দেখছেন।
–কোন ডাক্তার?
–স্যার তাড়াহুড়াই তো নাম ওইভাবে জানা যায়নি তবে মনিরুজ্জামান না কি যেন।
–আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি ওই ফাকিবাজ ঘুষখোরের পাল্লায় পড়েছো তাহলে।কাজের বেলায় নেয় টাকা খাওয়ার ধান্দা খালি।
–স্যার মানে?তাহলে উনি তো আমার ফুপিকে দেখবেন না ভালো করে।
–দাড়াও দেখছি আমি।নার্স নার্স মনিরুজ্জামান কে গিয়ে বলো এমারজেন্সির পেশেন্টকে আমি দেখতে আসছি।যাও….
–স্যার থ্যাংক ইউ সো মাচ।
–আরে ধুর থ্যাংক্স বলা লাগবে না।চলো আমার সাথে তোমার ফুপিকে দেখে আসি।
–স্যার আমি যাবো??
–হ্যা তুমি।
–কিন্তু
–হ্যা আমি জানি তুমি এখনো ডাক্তারি পাশ করোনি।কিন্তু তোমার মতো টপ করা স্টুডেন্টকে পাশ না করলেও বিশ্বাস করা যায়।চলো।

অভ্র ভাই আর ডাক্তার সাহেব মায়ের ওটির দিকে গেলেন।আমি হাসপাতালের চেয়ারে বসলাম।অভ্র ভাই যে ডাক্তারি পড়ে সেটা তো আমার জানাই ছিলো না।বেশ কিছুক্ষন পর অভ্র ভাই এলো।আমি অভ্র ভাইয়ের কাছে ছুটে গেলাম।উনি মুখ শুকনো করে দাড়িয়ে কোন কথা বলছে না।আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,
–মা?
(উনি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলেন)
–ভাইয়া কোথায়?
–উনি উনি তো একটু বাইরে গেলেন।আমার মা,কেমন আছে আমার মা?
–সূচী আসলে…….

চলবে।