তোমাতেই খুজি আমার পূর্ণতা পর্ব-১৩

0
295

#তোমাতেই_খুজি_আমার_পূর্ণতা🤗 (১৩)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

সোমবার~
———-
এই দিনটি যেনো নূরার জন্য অনেক বেশি আনন্দের দিন। সারা সপ্তাহ ধরে ক্যফেতে কাজ করে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে , এই দিনে উত্তরাতে এসে অ’না’থ বাচ্চাদের মাঝে খাবার বিতরণ করার পর অন্যরকম সুখ খুজে পায় সে। গত সপ্তাহে তেমন ভালো খাবার আনতে পারে নি জন্য এই সপ্তাহে প্রতিদিন ওভার টাইম কাজ করে আরো বেশি টাকা জমাতে পেরে মনে মনে ভিষণ খুশি নূরা , এই সপ্তাহে আরো ভালো খাবার দিতে পারবে ভেবে নূরার মনের মাঝে আনন্দের ঢে’উ বয়ে যাচ্ছে যেনো।

উত্তরায় পৌঁছার পর পরিচিত হোটেল থেকে গরম ভাত, ডিম , আলু ভাজি আর ডাল দিয়ে ২০ জনের খাবারের প্যকেট বানিয়ে নেয় নূরা। তারপর একটা রিকশা নিয়ে ফুটপাতের যে স্থানে দাঁড়িয়ে প্রতি সপ্তাহে বাচ্চাগুলোকে খাবার দেয় সেখানে চলে যায়। কিছুসময় পর কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছানোর পর ফুটপাতের উপর কোনো বাচ্চাকে দাঁড়িয়ে থাকতে না দেখে তৃপ্তির কপালে কয়েকটা ভা’জ স্পষ্ট হয়। নূরার মনে প্রশ্ন জা’গে…

“কি ব্যপার প্রতিবারই তো থাকে বাচ্চারা তাহলে আজ কেনো নেই?”

খাবার গুলো সব রিকশা থেকে নেমে ফুটপাতের এক পার্শে দাঁড়িয়ে পরে নূরা। ভাবে ও হয়তো আজ তা’ড়া’তাড়িই এসে পড়েছে, তাই ঠিক করে কিছুসময় অপেক্ষা করবে। আধঘন্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো বাচ্চার দেখা পায় না নূরা। এবার বেশ চি’ন্তা’র কারণ হয়ে দাঁড়ায় বিষয়টি নূরার কাছে।

অনেক সময় পেরিয়ে গিয়েছে নাহ এবার আর দাড়িয়ে দাড়িয়ে অপেক্ষা করলে চলবে না , বাচ্চাগুলো হঠাৎ গেলো কোথায় সে বিষয়ে খোজ নিতে হবে এমনই মনঃস্থির করে নূরা। সামনের দিকে কয়েক কদম অগ্রসর হতেই দুইজন কালো পোশাকধারী লোক নূরার পথ আটকে দাড়িয়ে পরে। হু’ট করে নিজের সামনে অচেনা দু’জন লোককে দেখে কিছু ভ’য় পেয়ে দু’কদম পিছিয়ে যায় সে। কপাল কুঁচকে লোক দুটোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে…

“কে আপনারা? হু’ট করে আমার পথ আটকালেন কেন?”

লোক দুটোর মাঝে একজন রাশ ভাড়ি কন্ঠে বলে..

“আরে ভাবি ভ’য় পাবেন না , আমরা আপনাকে নিতে এসেছি”

“ভাবি? ও হ্যলো আপনার কোন জন্মের ভাইয়ের বউ লা’গি আমি যে আমাকে ভাবি বলছেন!”

লোক দুটো একে অপরের দিকে চো’খা-চো’খি করে নিজেদের ৩২ পা’টি দাঁত বের করে বলে..

“এই জন্মের আমাদের বসের বউ আপনি , সেই সূত্রে আমাদের ভাবী হন”

নূরা খাবারের ব্যগ দুটো ফুটপাতের উপর রেখে কমোরে দু’হাত রেখে দু’কদম সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই লোক দুটো চার কদম পিছিয়ে যায় , নূরা বিষয়টি লক্ষ্য করে সেখানে দাড়িয়ে পরে প্রশ্নসিক্ত কন্ঠে বলে…

“এই আপনাদের বস টি আবার কোন ক্ষে’তে’র প’চা মূলা শুনি? যে আমাকে , নামিয়া ইসলাম নূরাকে বউ বলে”

নূরার মুখে এহেনু কথা শুনে লোক দুটোর মুখ পা’ন’শে’টে হয়ে যায় মূহূর্তেই , শুকনো ঢো’ক গি’লে বলে…

“ভাবী আপনার সব প্রশ্ন আপাতত আপনার মধ্যে রাখুন, বসের হুকুম আপনাকে যতো দ্রুত সম্ভব যেনো তার কাছে নিয়ে যাই , এক সেকেন্ড লে’ই’ট হয়ে গেলে আমার কলিজা কে’টে ফুটপাতের কু’কু’র’দের খাইয়ে দিবে। আমাদের প্রানের কথা চি’ন্তা করে দয়া করুণ আর চলুন আমাদের সাথে কোনো কথা না বলে”

নূরা বি’র’ক্তি’তে মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে আর বলে..

“ঠিক আছে , যাবো। তবে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর জানার আছে…”

লোক দুটো এক তালে বলে উঠে..
“বলুন ভাবী কি প্রশ্ন?”

“আপনাদের বস দেখতে কেমন? মানে আবার কোনো টাকাওয়ালা টা’ক’লু বা প্রে’গ’ন্য’ন্ট মহিলার মতো ভুঁড়ি ওয়ালা নয়তো আবার?”

নূরার এমন কথায় লোক দুটো উচ্চ শব্দে হেসে উঠে। নূরা চোখ-মুখের আকৃতি কিছুটা কুঁচকে নিয়ে উচ্চস্বরে বলে…

“চুপপপ…..”

নূরার ধ’ম’কে’র সুর শুনে লোক দুটো পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায়। একজন মি’ন’মি’নি’য়ে বলে…

“আমাদের বসের সৌন্দর্য বর্ণনা করলে বলার ভা’ষাই কম পরে যাবে”

“হইছে হইছে এটা একটু বেশি বেশিই প্রশংসা করে ফেলছেন আপনারা , নিয়ে চলুন আমাকে আপনাদের বসের কাছে আমি নিজেই দেখে নিবো কেমন সৌন্দর্য তার যার বর্ণনা করতে গেলে আপনাদের বলার ভাষা ফু’রি’য়ে যাবে”

লোক দুটো খাবারের ব্যগ দুটো হাতে উঠিয়ে নিয়ে বলে..

“আসুন ম্য’ম , ঐতো সামনে গাড়ি দা’ড় করানো”

নূরা আর কথা না বাড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
—————————–
ঘন্টা খা’নে’ক পথ পেরিয়ে যাওয়ার পর একটা খোলা স্থানে এসে গাড়ি ব্রে’ক কষে। নূরা জানালা দিয়ে গাড়ির বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই কিছুটা দূরে একটা গেইট দেখতে পায় যেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা “অনাথ আশ্রম”। পরমুহূর্তে দরজা খুলে গাড়ির ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসে নূরা। নূরার পিছন সিটে বসা ঐ দু’জন কালো পোশাকধারী লোক ও গাড়ি থেকে নেমে নূরার হাতের বাম পার্শ্বে এসে দাঁড়িয়ে বলে…

“ভাবী চলুন, আশ্রমের ভিতরে”

নূরা একপলক লোক দুটো দেখে সামনের দিক হাঁটা ধরে। আশ্রমের গেইটের সামনে এসে দাঁড়াতেই গেইটে পা’হা’ড়া দিতে থাকা দু’জন সিকিউরিটি গা’র্ড বসা অবস্থা থেকে দাড়িয়ে পরে গেইট খুলে দিয়ে নূরাকে উদ্দেশ্য করে বলে…

“ভিতরে প্রবেশ করুন ভাবী”

সবার মুখে এই ‘ভাবী’ ডাক শুনতে শুনতে নূরার মনে হচ্ছে সে সকল জাতির ভাবী হয়ে গিয়েছে , আর এই মহান উপাধী দা’ন কারী মূল বসকে তো নোবেল পুরষ্কার দেওয়া উচিত।
নূরা ধীরপায়ে ভিতরে প্রবেশ করে , ভিতরের দিকে কয়েক কদম অগ্রসর হতেই ছোট ছোট বাচ্চাদের হাসির ক’ল ক’ল আওয়াজ নূরার কর্ণপাত হয়।

একদম ভিতরে প্রবেশ করে ছোট্ট মাঠের শুরুতে দাঁড়িয়ে একপলক চারপাশ দেখে , এখানে উপস্থিত ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মাঝে অনেক বাচ্চাই ওর পরিচিত। আজ এই বাচ্চাদের মাঝে খাবার বিতরণ করতেই ওর উত্তরাতে যে আসা। আর ওরা সকলে এখানে একত্রে আছে , কতো আনন্দ , হাসি-খুশি ভাবে সময় পা’র করছে ওরা। নূরার ঠোঁট প্রসারিত হয়ে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠে। এর মাঝেই হঠাৎ একটা বাচ্চা খেলতে খেলতে নূরাকে দেখে চি’ল্লি’য়ে বলে উঠে…

“আপু এসেছে, আপু এসেছে…”

বাচ্চাটির কন্ঠ কর্ণপাত হতেই বাকিরাও নূরার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে , যারা নূরাকে চিনে ওদের আনন্দ যেনো কয়েক গুণ বে’ড়ে যায় নূরাকে এখানে দেখে। এদিকে নূরার ঠোটের হাসির রেখা আরো একটু প্রসারিত হয় , সে হাটু ভে’ঙে সেখানেই বসে দু’হাত দু’দিকে মেলে দিয়ে বাচ্চাগুলো নিজের কাছে আসতে বলে। বাচ্চা গুলো এক ছু’টে নূরার কাছে আসে। নূরা ওর মেলে রাখা দু’হাত দিয়ে বাচ্চাগুলো আঁকড়ে ধরে। পরক্ষণেই বাচ্চা গুলোকে সাইড করে দাড় করায় আর ব’লে….

“তোমার এখানে কি করে এলে? কে এনেছে তোমাদের এখানে? জানো আমি তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে ফুটপাতে কতোক্ষন দাড়িয়ে অপেক্ষায় ছিলাম!”

একজন ৬-৭ বছর বয়সী মেয়ে বাচ্চা নূরার সন্নিকটে এসে ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে নূরার দু’গালে হাত রেখে ধীর কন্ঠে বলে…

“মন খা’না’প (খা’রা’প) ক’নো (করো) না আপু , আমাদে’ন (আমাদের) এখানে বন্ধু নিয়ে এসেছে। আম’না (আমরা) এখানে অনেক ভালো আছি। তিন বেলা ভালো ভালো খা’বা’ন (খাবার) পাচ্ছি, এতো সুন্দ’ন (সুন্দর) জায়গায় থাকতে পা’ন’ছি (পারছি)। এন (এর) আগে তো না’স্তা’য় (রাস্তায়) না’স্তা’য় (রাস্তায়) ভি’ক্ষা কনে (করে) খা’বা’ন (খাবার) জো’গা’ন (জোগার) কনতে (করতে) হতো। এখন আম’না (আমরা) প’না’শোনা (পড়াশোনা) কনান (করার) ও সুযোগ পেয়েছি শুধুমাত্র বন্ধু’ন (বন্ধুর) জন্য।”

নূরা তৃপ্তি ভরা দৃষ্টিতে বাচ্চা মেয়েটিকে দেখছে আর ওর বলা প্রতিটি কথা শ্রবণ করছে৷ একপলক ওর সামনে দাঁড়ানো বাকি বাচ্চাদের হাস্যোজ্বল মুখ দেখে নূরার মনের কোনে অদ্ভুত শান্তি অনুভব হয়। সে তো সবসময় এটাই চেয়েছিলো এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলো যেনো রাস্তায় রাস্তায় মানুষের নিকট হাত পে’তে ভি’ক্ষা না করে, ভালো খাবার, পোশাক আর থাকার জায়গা পায় কিন্তু ওর সামর্থের বাহিরে হয়ে যাওয়ায় চেয়েও ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে পারে নি ও।

কাঁপা কাঁপা হাতে ওর গালে হাত রাখা বাচ্চা মেয়েটির দুহাত আলতো করে মু’ষ্ঠি’ব’দ্ধ করে চু’মু খায় নূরা। ওর চোখ দুটো খুশির জলে চিক চিক করছে। সেইমূহূর্তে একজন পুরুষের রা’শ’ভা’ড়ি কন্ঠ কর্ণপাত হয় নূরা সব উপস্থিত সকল বাচ্চাদের। লোকটি বলে…

“কি ম্যডাম ওদের ভালো থাকতে দেখে তুমি কি এখন কে’দে দিবে নাকি?”

বাচ্চাগুলো পিছন ঘুরে একস্বরে বলে উঠে…
“বন্ধুউউউ”

#চলবে………..