তোমাতে আমাতে পর্ব-১৩

0
1550

#তোমাতে_আমাতে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ১৩

আমার বিষয়ে এত সিরিয়াসনেস দেখানোটা বোধহয় ওর রক্তে মিশে আছে। দুনিয়ার সবার কাছে আমরা পার্ফেক্ট কাপল শুধু আমরাই জানি কে কার জন্য কতটা পার্ফেক্ট?
এতগুলো দিন গেল একটা রাত বাসায় থাকলো না। এতগুলো এক্সাম আমি কিভাবে যে দিলাম সেটা আমিই জানি। এক্সাম হলে দিয়ে যায় আর ঠিক টাইমে এসে আবার নিয়ে যায় দায়িত্ব যেন এই পর্যন্তই…
বাসায় যেতে বললে কিছুতেই যাবেনা। কেনরে বাবা আমার সাথে একটা রাত থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো?
ধুর স্বামীর কাছ থেকে এতোটা অবহেলা সহ্য করাটা কতটা কষ্টের সেটা ওকে কিভাবে বুঝাই। জানি ও এটা বুঝবেনা কোনদিন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওর মাথার কোন একটা স্ক্রু ঢিলা। ছিটিয়াল!
— আদি কি ভাবছো এত?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর দিকে তাকালাম।
— আচ্ছা এক্সামতো শেষ! এবার প্ল্যান কি?
ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ওকে জিজ্ঞাস করলাম।
— আচ্ছা তুমি কি আজকেও বাসায় যাবে না?
— কেন গেলে কি খুশি হবা?
— নাহ খুশি হতেও পারি ঠিক নাই।
— আচ্ছা আগে ঠিক করো। তারপর আসবোনি।
গাড়ি থেকে নামো বাসায় এসে পড়ছি।
আমি গাড়ি থেকে নেমে ওর দিকে তাকালাম।
ও গাড়ী থেকে নেমে এলো কি জানি কি মনে করে।
আমার মাথায় হাত রেখে বললো,
— আদি তুমি বাসায় যাও তোমার এখন রেস্ট নেওয়া উচিৎ অনেক ধকল গেছে। আমার তোমার সাথে যাওয়া উচিৎ কিন্তু আমি এক্সট্রেমলি সরি। এখন গেলে শুধু শুধু তোমাকে বিরক্ত করবো আই থিংক না যাওয়াটাই বেটার।
আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।
ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো । কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না। একটুপর ওকে ছেড়ে দিয়ে আমি দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। ও আমাকে পিছন থেকে ডাকতে লাগলো কিন্তু না শোনার ভাণ করে চলে এলাম।
মা আমার চোখ মুখের অবস্থা দেখে জিজ্ঞাস করছিলো আমার এক্সাম কি খারাপ হয়েছে নাকি।
আমি মাকে আশ্বস্ত করি যে আমার এক্সাম ভালো হয়েছে।
এরপর দিনে দিনে ইমন ওর স্টাডি নিয়ে খুব বিজি হয়ে যায়। আমাকে সময় খুব কম দিতে লাগলো। মামনী ফোন করে বলতো কবে আমাকে বাসায় আনবে? তার ছেলে সারাদিন রাত স্টাডি রুমে পড়ে থাকে। এফ সি পি এস পড়ার চিন্তায় দিন রাত এক করে ফেলেছে। তিনি হয়তবা ভাবতে লাগলেন আমি এলে ও একটু ফ্যামিলির প্রতি মনোযোগী হবে। কিন্তু আমি বুঝে ওকে ঠিক করা আমার পক্ষে এজন্মেও সম্ভব না।
যদিও আমাকে ফোন করতো তবুও শুধু পড়ার কথাই বলতো। ওর পড়া পড়া শোনতে শোনতে আমার কান ঝালাপালা হয়ে যেত।
আর অন্যকোন কথা তার মুখ দিয়ে আমি বের করতেই পারতাম না। প্রচন্ড অভিমান হতে থাকলো ওর প্রতি।
আমিও ভার্সিটি কোচিং নিয়ে বিজি হয়ে পড়লাম। ওকে ভুলে থাকার জন্য পড়াটাকেই মেডিসিন হিসেবে নিলাম। কিন্তু যখনি মনে পড়তো দু চোখ ফেটে জল পড়তো। তবুও কাউকে কিছু বুঝতে দিতাম না। তারপর আমার রিজাল্ট হলো এ প্লাস পেলাম। আশা করে ছিলাম ইমন একবার হলেও আসবে। উহু সারাদিনেও এলো না।
আমি দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলাম।
একটুপর আমার ফোনে রিংটোন বেজে উঠলো। ইমন ফোন করেছে।
চোখ মুছে ফোন ধরলাম।
— হ্যালো..
কোন কথা বলছিলাম না।
— কি হলো কথা বলো। আমি বুঝতে পারছি তুমি রেগে আছো। কিন্তু কথাতো শুনবা।
— কি শুনবো কিচ্ছু শোনার নাই । আমি কারো উপর রেগে নেই।
এই প্রথম অভিমান হয়ে কিছু বলতে লাগলাম।
— আচ্ছা তুমি কখন ঘুমাবা?
— কেন?
— কারণ আমি লাইব্রেরিতে আছি পড়তেছিতো পড়া শেষ হলে তোমাদের ওখানে আসতে চাইছিলাম। কিন্তু যদি ঘুমাই যাও তাহলে এসে কি হবে?
— আমি এখনি ঘুমাবো তোমার আসা লাগবেনা। অযথা টাইম ওয়েস্ট করার কোন মানেই হয়না।
তুমি এক কাজ করো পারলে সারা রাত লাইব্রেরিতে থাকো আর মনোযোগ দিয়ে পড়ো কেমন।
রাখছি।
জানি আমার কোন অভিমানের কোন মূল্য ওর কাছে নেই তবুও প্রচণ্ড অভিমানে ফোনটা কেটে দিলাম।
ইদানীং রাগ হলে আমার কেন জানি সবকিছু ভুলে পড়তে ইচ্ছে হয়। হয়তবা ইমন তারছিড়া টার পাল্লায় পড়ে আমিও বদলে গেছি।
কিছুক্ষন পর দরজায় নক করার শব্দ হলো। কান খাড়া করে শোনতে লাগলাম হ্যা আমার রুমের দরজা। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি ইমন ওর মুচকি হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি পলকহীনভাবে ওর চোখের দিকে তাকিয়েই আছি।
— কনগ্রাচুলেশন কিউটি
বলেই আমার এক গালে আলতো করে ছুয়ে দিলো।
আমি অদ্ভুত সম্মোহনে ওর দিকে তাকিয়ে আছিতো আছিই।
আমার আরেকহাতে একটা গোলাপ গুঁজে দিলো।
— সুন্দরী এইটা তোমার।
আমি গোলাপটা উপরে তুলে দেখতে লাগলাম।
— কি দরজায় দাড় করাই রাখবা নাকী রুমে আসতে দিবা
আমি খানিকটা লজ্জা পেয়ে সরে দাড়ালাম।
ও বিছানায় গিয়ে বসতে বসতে বললো,
— আমার গাছের প্রথম গোলাপ তোমার জন্যই বোধ হয় ফুটেছে।
তোমার প্রছন্দের হলুদ গোলাপ ম্যাম! বহু কষ্টে এনেছি। কাটা ফুটে গিয়েছিল সুন্দরী।
আমি ফুলটা বেডসাইড টেবিলে রেখে ওর হাতের আংগুল দেখতে লাগলাম।
— এই করো কি?
— কোথায় কাটা ফুটেছে। দেখাও??
হাতটা সরিয়ে নিতে নিতে বলে,
— ফুটেছে তবে হাতে নয় বুকে। বুঝবেনা তুমি?
— আচ্ছা কে বুঝবে তাহলে?
— হয়তবা কেউ না। আমি নিজেই নিজেকে বুঝিনা, আর তোমার আনাড়ি মেয়ে বুঝবে!
আমি চুপ করে গেলাম হয়তবা ও সত্যিই বলছে।
— আচ্ছা তুমি না লাইব্রেরিতে ছিলা? আমাকে মিথ্যে কেন বললা?
— নাহ দেখলাম তুমি অভিমান করে কি কি করতে পারো?
একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবার তাকালো।
— তা বিছানায় বই পত্র হড়ানো হিটানো ছাড়া কিছুই করতে পারো না।
— হুম আর কিছু পারলেওতো লাভ নাই। প্রতিভা দেখানোর সুযোগ দেয়ার সক্ষমতাতো আপনার কাছে নাই।
আমার কথা শুনে ইমন অসহায়ের মত আমার দিকে তাকালো। মনে হয় একটু বেশি বলে ফেলেছি।
গলাটা নরম করে বললো,
— আদি আমার পাশে একটু বসবা।
কোনরকম ভণিতা ছাড়া সরাসরি ওর গা ঘেষে বসলাম আমি। তারপর দুজনেই নিশ্চুপ।
হঠাৎ করেই আমার হাতে একটা বক্স ধরাই দিলো। আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। এতক্ষন নিচে তাকাই থাকার জন্য আমার খেয়াল হয় নাই।
— দেখোতো তোমার প্রছন্দ হয় কিনা। আজকেই কিনলাম ফোনটা।
কেমন যেন ভাললাগা ছুয়ে যেতে লাগলো। তবুও মুখে বললাম,
— কিন্তু আমারতো ফোন আছেই। এইটা অযথা কেন কিনতে গেছ?
কিছুক্ষন চুপ থেকে আমার দিকে তাকালো।
— শোন তোমাদের বাসার কাজের মেয়ে লতিফা না কি যেন নাম। ভাল না লাগলে ফোনটা ওকে দিয়ে দিও কেমন।
ধপ করে খাট থেকে নেমে পড়লো।
মনে হয় রেগে গেছে। আমি নিচ থেকে উপরে তাকাতেই দেখি ওয়াশরুমে চলে গেল।
কিছুক্ষন থুম মেরে বসে থাকলাম।ফোনটা নেড়ে চেড়ে দেখলাম। কেমন ছেলেরে বাবা! কথায় কথায় মেয়েদের মত ঠোট ফোলায়। পুরাই মেয়েদের স্বভাব। সামান্য কথাতেই এত এত রাগ। মনে হয় রাগের কারখানা।
— বিড়বিড় করে এইসব কি বলছো?
যদিও জানি তুমি এইসব আমাকেই বলছো।
আমি ওর দিকে আড়চোখে তাকালাম। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আমার দিকেই আসতেছে।
আমি বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম,
— কই নাতো। কিছু বলছিলাম নাতো।
— না বললেই ভালো। শোন আমার খুব খিদা লেগেছে।
— এখানে নিয়াসবো? না টেবিলে যাবা?
— এখানেই নিয়াসো। তবে একটা শর্ত আছে।
— আগে নিয়াসো তারপর বলছি।
আমি কিচেনে গেলাম খাবার আনতে। আজ এতদিন পর ও আর আমি ভালো সময় স্পেন্ড করছি নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। মনে হয় আজকের মত বাকী দিনগুলোও যদি এভাবেই কাটতো।
— আদি তুমি কি খাওয়াই দিবা? আমি কতক্ষন হা করে আছি।
— মানে আমি?
— হুম দাও।
আমি ভাত মেখে ওকে খাওয়াই দিতে লাগলাম অদ্ভুত এক ফিলিংস হতে লাগলো। এরপর সেও আমাকে খাওয়াই দিলো। আমার কাছে মনে হলো ও যেন ভালবাসা মেখে আমার মুখে তুলে দিতে লাগলো। লজ্জা, ভয়, রাগ সব কিছু ছাপিয়ে এক অদ্ভুত অনুভুতি হতে লাগলো।
খাওয়া শেষ করলে মা আমাকে আর ইমনকে ডেকে নিয়ে যায়। ড্রয়িংরুম এ বাবা ও ভাইয়া দুজনেই ভাইয়ার বিয়ের ব্যাপারেই কথা হচ্ছিলো।
কিন্তু ভাইয়া যে শেষ পর্যন্ত ইশিতা আপুকেই বিয়ে করবে এইটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। ভাইয়া চোখ ইশারা করে আমাকে বলতে বললো বিষয়টা। কিন্তু এখনতো এই বিষয়ে কথা বলাই যাবেনা। আমিও চোখ ইশারা করে ওকে বোঝালাম যে আমি পরে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলবো।
ফ্যামিলি মিটিং শেষ হলে আমি রুমে এসে পড়লাম।ইমনের একটা ফোন আসাতে ও আরো আগেই রুমে এসে পড়ছিলো।
ইমন বালিশ হেলান দিয়ে বসে বসে পড়ছিলো। আমিও ওর পাশে গিয়ে বসলাম। ও আমাকে দেখে এক হাত দিয়ে আমাকে ওর বুকের কাছে নিয়ে যায়। আমি আমার একহাত ওর পিঠে দিকে দিয়ে ওর বুকে মাথা রাখি। ওর নিঃশ্বাসের শব্দ খুব কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছি। চোখটা বন্ধ করে ওর হার্টবিটটাও শুনতে পারছি। চোখ খুলতে খুব ইচ্ছা হলো। শার্টের সামনের বোতাম খুলা থাকায় ওর গলার কাছের তিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে ওখানে গলার কাছটায় একটা কিস করলাম। ইমন চমকে আমার দিকে তাকালো। আমি লজ্জায় সরে যাচ্ছিলাম। ও আমার হাতটা ধরে ফেলে।
— কোথায় যাও।
কোন কথা বলছিলাম না।
ও আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
— প্লিজ কাছে আসো। যেভাবে ছিলে ওভাবেই থাকোনা ভালো লাগিছিলোতো।
আমি ওর দিকে ঘুরে ওর বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। ও আমার হাত বুলাতে লাগলো।
কিছুক্ষন পর আধো আধো গলায় বলতে লাগলো।
— আদি ঘুমিয়ে গেছে।
কয়েকবার জিজ্ঞাস করিছিলো।
কিন্তু আমি কোন উত্তর দিচ্ছিলাম না দেখে ও ভাবলো আমি ঘুমিয়ে গেছি।
কিছুক্ষন পর ও আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
চলবে…