# তোমাতে_আমাতে ২
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ১৩
বুজা চোখ দুটি আস্তে আস্তে খুলতেই সোনারঙা রোদের ঝলকানিতে দীঘির পানি চিকচিক করে উঠলো ৷ আলোর ঝলকানিতে দু চোখ আবার আবেশে বুজে আসতে চাইলো। আমরা মাঝখানে, পায়ের নিচে নৌকা চারপাশে অথৈ জল আর বাতাসের তাড়নায় উত্তাল ঢেউ৷ ইমন আমার কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
” এবার ভালো লাগছে।”
আমি ওর দিকে মুখ না ছোট্ট করে উত্তর দিলাম,
” খুব!।”
খোলা আকাশে মন ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম,
” দুচোখ বুজে থাকলেই যদি এতো সুন্দর যায়গায় আসা যায় তবে আজীবন তোমার হাতের মিষ্টি আঘাতে চোখ বুজে থাকতে চাই।”
উত্তরে ইমন কেবলই হাসলো। একটু থেমে বললো,
” আরেকটু আগেইতো কেমন আসতে চাইছিলে না। একরকম জোর করেই নিয়াসতে হলো।”
দৈবাৎ বিদুৎ চমকালো৷ খা খা রোদ্দুরে এক স্বাস্তির পশলা বৃষ্টি নামলো। এই বৃষ্টি যেন আমাদেরই শুভেচ্ছা জানাতে এভাবে হুট করেই নামলো। আমরাও প্রবল উচ্ছ্বাসে বৃষ্টির আহ্বানে সাড়া দিলাম। পদতলে দীঘির জল শিউরে বৃষ্টির ফোটা! গভীর ভালোবাসায় দুটি হৃদয় অবগাহন করতে লাগলো। কিছুটা সময় কাটলো ঝঞ্জাট আর ভুলেভরা পৃথিবী ছেড়ে অন্য এক অপার্থিব পৃথিবীতে। যেখানে সময় থমকে দাড়ায়, মুহুর্ত কাটে নিয়ন্ত্রিনহীন।
” এইভাবে বৃষ্টিতে ভিজেপুড়ে কোন যায়গাতে আসলা? ”
রাঙা দিদার কঠিন জেরায় দুজনেই তটস্থ হয়ে রইলাম। একটুপরেই চিৎকার করে মামনিকে ডাকতে লাগলেন। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি এমন অপরাধ করে ফেলেছি যে এভাবে মামনীকে ডাকতে হবে!
মামনী দুপুরে খেয়ে ভাতঘুম দিয়েছিলো।চেহারায় ঘুমের ছাপ স্পষ্ট। তড়িঘড়ি করে ছুটে আসতেই কেমন অগোছালো লাগছে।
” এই যে নীলা, ছেলের ছেলের বউকে কি কোনই শিক্ষা দিক্ষা দেওনাই। এই ঝুমবৃষ্টিতে ভিজা কাক হইয়া বাড়ি ফিরছে। ভিজুক সমস্যা নাই তোমার ছেলে একাই ভিজুক। বউকে কেন নিয়া গেছে। এই ভরদুপুর পোয়াতি মাইয়া যেখানে সেখানে ঘুরতাছে। বৃষ্টিত ভিজা ঠান্ডা লাগানোর তাল করতাছে। তুমি কি খাইয়া মা হইছো! ঘাস খাইয়া! পোয়াতি মাইয়া কোন বাচঁবিচাঁর কইরা চলতাছে না। এইসময় কিভাবে চলন লাগে এই শিক্ষাটুকুও তুমি দেও নাই। ”
কথাগুলো শুনে মামনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু রাঙা দিদা উত্তেজিত হয়ে বললেন
” তোমারে এইসব বলতাছি কেন? আমারতো মনেই নাই পোয়াতি মাইয়াগো প সম্বন্ধেওতো তোমার ধারণা নাই। পাইছোতো এক্কেরে রেডিমেড কোনই কষ্ট হয় নাই।”
দুম করে একরাশ প্রস্ন মাথায় দিয়ে রাঙা দিদা চলে গেলো। মামনি পাথরের মতো নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে নিচে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন৷ আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছিলো। ইমন ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” মামনি সরি, আমার জন্য তোমাকে এতগুলো কথা শুনতে হলো। ট্রাস্ট মি আমি আর জীবনেও এমন কিছু করবোনা৷ সবার আগে তোমার পারমিশন নিবো।”
মামনি ইমনকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিৎ।
বিকেলে আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছিলো। এক কাপ চা হলে ভালো হতো। চা বানাতেই উঠতে যাচ্ছিলাম তখনি ইমনের দূর সম্পর্কের এক ফুফু এসে বসলো।
সাধারণ কথাবার্তার পর তিনি হুট করেই বললেন,
” তোমার শাশুড়ী তোমার সাথে ঠিক কিরকম ব্যাবহার করে ভালো! ”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
” ভালো কিনা জানিনা। উনি আমাকে মেয়ের মতো দেখেন। আমার মা আর উনার মাঝে কোন তফাৎ এখনো আমার চোখে পড়েনি।”.
” ভালো হইলেই ভালা। তা ইমনের সাথে সম্পর্কটা কেমন!”
আমি উনার কথায় হেসে উঠলাম৷ হাসতে হাসতে বললাম,
” এটা একটা প্রশ্ন হলো ফুফু! ছেলের সাথে মায়ের যেমন সম্পর্ক থাকা উচিৎ তেমনই। আর প্লিজ এমন বোকার মত প্রশ্ন আর কাউকে করতে যাবেন না। অনেকে অনেক কিছুই বলে ফেলতে পারে।” আমি আবার হাসতে লাগলাম। উনি রাগে জ্বলে উঠে বললেন,
” হাসো বেশি করে হাসো। না জানলে বুঝলেতো বোকাগো মতই হাসবা। ” উনি মুখ গোমড়া করে উঠে গেলেন৷
উনার এখানে আসার বা চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকলো না।
রাতে আমার হালকা জ্বরজ্বর ভাব আর ঠান্ডা লেগে গেলো। ইমন এসে বারবার সরি বলতে লাগলো।
আমার খুব রাগ হলো। ইমন আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” আদি, তুমি এমন রাগ করলে কেন? আমিতো তোমাকে সরি বলেছি। “.
” তুমি আমাকে সরি বললে কেন? তোমার কি আমাকে সরি বলা উচিৎ। তুমি কি এমন অপরাধ করেছো? ”
” এই যে আমার বাড়াবাড়িতেই তোমার জ্বর ঠান্ডা লেগে গেলো।”.
” তোমার এইসব বাড়াবাড়িতে হাজারবার অসুস্থ হতে রাজি।”
ইমন হুট করেই চুমু খেতে লাগলো। আমি একরকম অপ্রস্তুত হয়ে ওকে ধাক্কা দিতে লাগলাম ৷ দূরে যাওয়ার বদলে কিঞ্চিৎ আরো কাছে চলে এলো। আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে অজান্তেই গলা জড়িয়ে ধরলাম।
” কি হলো, হয়নি আরো কিছু চাই।” ইমনের ফিসফিস করে বলা কথায় আমি ঘোর থেকে একরকম অনিচ্ছা সত্বেও বের হলাম। ইমন ভ্রু নাচিয়ে এটাই বোঝালো সে ছেড়ে দিলেও আমি এখনো ওর গলা জড়িয়ে ধরে আছি। আমি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলাম। ইমন হো হো করে হেসে উঠলো।
” কি হলো এটা?”
” লিপস্টিক! ”
” হুয়াট!”
ইমন আমাকে টেনে আয়নার সামনে নিয়ে যায়।
” দেখো তোমাকে লিপস্টিক লাগিয়ে দিলাম। কেমন লাল টকটকে পুরো ঠোঁট, সুন্দর লাগছেনা! এরপর থেকে প্রতিবার বাইরে যাওয়ার আগে আমার কাছে আসবে। আমি ঠিক এমন সুন্দর করেই লিপস্টিক লাগিয়ে দিবো। যাকে বলে ন্যাচারাল লিপিস্টিক! কোন ভ্যাজাল নাই। হি হি।”
দুষ্টু হাসিতে ইমনের ঠোঁটের কোণ বাকাঁ হয়ে গেলো।
আমি ওকে একরকম ধাক্কা দিয়ে বললাম,
” সরোতো, আমার এমন লিপস্টিক চাইনা। কি বুদ্ধি আপনার! আমি বাইরে যাওয়ার সময় আপনার কাছে আসব ন্যাচারাল লিপিস্টিক লাগাতে! আর আপনি কি করবেন আমার বাইরে যাওয়াটাইতো ক্যানসেল করে দিবেন৷ থাক বাবা লাগবে না। আপনার বাহানা ভালোমতই জানা আছে।”
” সুইটহার্ট বাহানা বলেনা৷ চোখের সামনে এরকম অপ্সরী থাকলেতো দুই একদিন একসিডেন্টতো হতেই পারে এতে আর কি এমন দোষ!”
” একসিডেন্ট! ইচ্ছে ঘটিত একসিডেন্ট!
তা আপনার কর্মক্ষেত্রেতো আরো অপ্সরী আছে নিশ্চয়ই! ওদের দেখেও নিশ্চয় এমন অশ্লীল চিন্তাই হয়।”
” নাউজুবিল্লাহ! তোমার না মুখে কিছুই আটকায় না৷ সবাইতো আমার বিয়ে করা বউ! দেখলেই করতে ইচ্ছে হবে! আমিতো লুচ্চা মনেতো হবেই।”
রাগে ইমনের নাক লাল হয়ে যায়। চোয়াল মুহুর্তেই শক্ত হয়ে যাচ্ছে। হাসি পাচ্ছে এত্ত রাগ বাবারে বাবা! রামগড়ুরের ছানা একটা বিড়বিড় করে বললাম।
” আচ্ছা তুমি এরকম মেয়েদের মতো গাল ফুলিয়ে বসে থাকো কেন?”
” কেন ছেলেরা করলে কি দোষ হবে?”
” হুম মস্তবড় দোষ!”
” তাহলে ছেলেদের কি করা উচিৎ! ”
” সবার কথাতো বলতে পারিনা৷ তবে একটু লুচ্চামি করলে ক্ষতি নেই। তবে সেটা বউ এর ক্ষেত্রে এপ্লাই করলেই হয়।”
কথাটা বলতেই ইমন খপ করে আমার হাত টেনে ধরে।
” তাহলে এখনি এপ্লাই করি কি বলো!”
“এই না ”
আমি ওকে একরকম ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দৌড়ে ঘরের বাহিরে চলে এলাম।
” না, মানে বললেই হলো।” ইমন হাসতে হাসতে আমার পিছে ছুটে।
কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। আমরাও রাঙা দিদার সামনে পড়ে যায়।
” রাতের বেলায় এমন লাফালাফি কিয়ের! যাও টেবিলে যাও। খাবার দেয়া হচ্ছে। ”
আমি আর ইমন ধীর পায়ে টেবিলের দিকে গেলাম। আমাদের দেখেই মামনি বললেন,
” এসেছো ভালোই হয়েছে। আমি আরো তোমাদের ডাকতে যেতে চাইছিলাম।”
ইমন খেতে বসে গেলো যথারিতী। আমার এক্টুকুও খেতে ইচ্ছে করছেনা৷ আমি বারবার মামনিকে না করলাম আবার বুড়ীর ভয়ে উঠতেও পারছিনা।
” আহা, আদৃতা এইসময় এভাবে না খেয়ে থাকতে নেই৷ বাচ্চারা কষ্ট পাবে। একটু খেয়ে নে৷ অল্প একটু আমি না হয় খাইয়ে দিচ্ছি। তোর হাত লাগাতে হবে না। একটু হা করবে। ”
মামনি ভাত মাখিয়ে আমার সামনে প্লেট নিয়ে আসে৷ শুধু কথা রাখতে আমি হা করি। আচমকাই প্লেট ফ্লোরে গড়াগড়ি খায়। রাঙা দিদা কোন এক অদ্ভুত কারণে প্লেটটা ছু মেরে নিতে গিয়ে ফেলে দেয়। বাবা আর ইমন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে পড়ে৷ চারপাশে পিনপতন নীরবতা ।
উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,
” নীলা, তুমি কি জানোনা তোমার হাতে খাওয়া নাতবৌ এর বারণ! এটা তুমি জানতে না এতবড় ভুল করো কেমনে! আমি বাইচাঁ থাকতে এই বাড়ির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীর অমঙ্গল হতে দিমুনা। আজকের পর থেকে এই কাম করনের দুঃসাহস ও দেখাবা না। ”
চলবে…