তোমার আসক্তিতে আসক্ত পর্ব-০৭

0
305

#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-০৭

আর্শিকা বাসায় এসে তার লকেটটা তন্ন তন্ন করে খুঁজছে।কিন্তু না লকেটটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না।আর্শিকা দিশেহারা হয়ে পড়ছে।একমাত্র এটাই তার মায়ের দেয়া শেষ স্মৃতি হিসেবে তার কাছে রয়ে গেছে।এই লকেটটা সে খুব যত্ন করে রাখতো, কখনো নিজের থেকে আলাদা করতো না।এই লকেট তার সাথে থাকলে মনে হতো তার মা তার সাথে আছে।আর্শিকা ভেবে না পেয়ে জয়াকে ফোন দেয়।

“হ্যালো জয়া শোন না, আমার লকেটটা কোথায় তুই বলতে পারিস?”

“তোর লকেট কোথায় তা আমি কি করে জানবো?”

“না মানে স্যারের রুম থেকে বের হওয়ার সময় তুই তো আমাকে ধরে এনেছিলি তাই হয়তো?”

“না রে আমি জানি না।তুই মনে হয় তখন অস্থির হয়ে স্যারের রুমে লকেটটা খুলে ফেলিস বাহ পড়ে গেছে।কাল গেলে খোঁজ নিবো নি।”

“কিন্তু স্যারের রুমে যদি না থাকে?আমার খুব ভয় হচ্ছে।”

“আরে একটা লকেটই তো কিচ্ছু হবে না।আর হারিয়ে গেলে আরেকটা কিনি নিবি সিম্পল।”

আর্শিকা আর কিছু বলতে পারল না।আর্শিকা জানে, জয়া জানে না এই লকেটটা তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর্শিকা জয়ার সাথে টুকটাক কথা বলে রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়ল।খুব অস্থির লাগছে তার,আজ এতোবছর পর লকেটটা তার কাছ থেকে হারিয়ে গেলে ভাবতেই বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে।

✨✨

রাদাফ লকেটটা হাতে নিয়ে বসে আছে।আজ সে ভীষণ খুশি নিজের প্রিয় কিছু সে পেয়েছে।রাদাফ যখন খুব মমনোযোগ দিয়ে লকেটটা দেখছে আর মুচকি হাসছে তখনই একটা মেয়েলি গলার স্বর শুনতে পায়।

“আমার ছেলেটাকে কোন পরী ধরলো যে বদ্ধ ঘরে তারই কথা মনে করে মুচকি মুচকি হাসছে?”

রাদাফ পিছনে তাকাতেই তার জন্মধাত্রী মা মিসেস কাশফিয়া রহমানকে দেখতে পায়।রাদাফ পিছন গিয়ে তার মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে,

“তেমন কিছু না আম্মু।”

“তাহলে কি সেটা আমিও একটু জানি?”

“হুম জানবে তো সময় হলে সবটা জানবে।তা তুমি হটাৎ আমার ঘরে?”

“তোর জন্য ফল নিয়ে এসেছি।সন্ধ্যায় তো কিছুই খেলি না তাই।”

“ওও”

রাদাফ কাশফিয়া রহমানের কাছ থেকে ফল নিয়ে খাওয়া শুরু করে। কাশফিয়া রহমান রাদাফের পাশে বসে বলে,

“রাদাফ আমাদের তো বয়স হয়েছে এবার যদি….”

রাদাফ কাশফিয়া রহমানকে থামিয়ে বলে,”আম্মু বিয়ের সময় হলে আমি ঠিকই বিয়ে করবো আর তোমার ছেলের আহামরি কোনো বয়স হয় নি যে এখন বিয়ে না দিলে তোমার ছেলের বিয়েই হবে না।সো রিল্যাক্স আমি এখনই এসব প্যারায় জড়াবো না।”

কাশফিয়া রহমান আর কিছু বলতে পারলো না।সে জানে তার ছেলের এক কথা এখন হাজার বুঝালেও সে বুঝবে না।সে আপন মনে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

✨✨

আর্শিকা ভার্সিটি গিয়েও তার লকেট খুঁজে বাট পায় না।এমনকি রাদাফের টিচার রুমে গিয়েও পায় না।এখন সারা ভার্সিটির আর্শিকা রাদাফকে খুঁজছে।শুধু আর্শিকা না রাদাফকে খুঁজছে তার চার বান্ধুবীসহ।আর্শিকা রাদাফকে খুঁজতে খুঁজতে লাইব্রেরিতে গেলে রাদাফকে একটা বই পড়তে দেখতে পায়।আর্শিকা সবিনিময়ে রাদাফকে সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“স্যার গতকাল কি আপনি টিচার রুমে কোন লকেট পেয়েছেন?”

“না তো কেনো?”

না উত্তরটা শুনে আর্শিকার সমস্ত আশা ভেঙে গেলো।মুখে হাজারো কালো মেঘ এসে জমা হলো।আর্শিকা উত্তর না দিয়ে চলে যেতে নিলেই রাদাফ পিছন থেকে ডেকে এনে বলে,

“আচ্ছা এটা কি তোমার সেই লকেট যেটা তুমি খুঁজছো?”

আর্শিকা তাকিয়ে দেখে রাদাফের হাতে সেই লকেটটা। আর্শিকা রাদাফের হাত থেকে ছোঁ মেরে লকেট নিয়ে বুকে আকঁড়ে ধরে থাকে। মনে হচ্ছে কোন অমূল্য সম্পদ পেয়ে গেছে।হে অমূল্যই তো আর্শিকার কাছে এই লকেটটা নিজের জীবনের চেয়েও বেশি।লকেটটা পেয়ে আর্শিকা খুশিতে কেঁদে দেয়।আর্শিকা কৃতজ্ঞতার সুরে বলে,

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি এই লকেটটা কোথায় কোথায় না খুঁজেছি। শুকরিয়া আপনাকে।”

“এটা তোমার মায়ের স্মৃতি তাই নাহ?”

আর্শিকা অবাক হয়ে বলে, “হ্যা আপনি জানলেন কি করে?”

“তোমার চোখের পানি দেখে।খুব প্রিয় কেউ না হলে একটা সামান্য লকেটের জন্য কেউ কাঁদে না।”

আর্শিকা নিশ্চুপ হয়ে যেতে নিলেই রাদাফ আর্শিকাকে ডাক দেয়।

“আশু?”

“জ্বি স্যার কিছু বলবেন?”

“না কিছু না।”

আর্শিকা রাদাফের আচরণে একটু অবাক হয়ে। পরক্ষণেই আর্শিকা নিজ রাস্তায় পা বাড়ায়।কিচ্ছুক্ষণ পর রাদাফ ঘর থেকে বের হলেই আর্শিকাসহ তাদের বান্ধুবীদের খুব জোরে জোরে হাসির আওয়াজ পায়।আর্শিকাও তাদের মধ্যে মুচকি মুচকি হাসছে হয়তো কোনো হাস্যকর ঘটনার কথা উঠেছে। আর্শিকার হাসি রাদাফের কাছে মিষ্টি লাগলেও আর্শিকার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে রাদাফের মাথার রক্ত গরম হয়ে উঠল। এক হুংকারে আর্শিকার কাছে গিয়ে সবাইকে সজোরে ধমক দিলো।

“এখানে হচ্ছে টা কি?এটা ভার্সিটি কোনো হাস্যশালা নয়?”

“স্যার এটা মাঠ আপনার কোন ক্লাস নাহ যে আমরা শান্তিতে হাসঁতেও পারবো না।”

“তুমি একজন টিচারের মুখের উপর কথা বলছো?জানো এর শাস্ত কিস্বরুপ হতে পারে?”

“আপনার ক্ষমতা আছে তাই বলে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করলে স্টুডেন্টদের ক্ষমতার পরিণামটাও আপনার দেখা হয়ে যাবে।”

আর্শিকা তেজী গলায় রাদাফ কিছুটা দমে গেলো।এদিকে আর্শিকাকে একজন শিক্ষকের সাথে এমন আচরণ করতে দেখে তার সকল বান্ধুবীই অবাক।আর যাই হোক আর্শিকা কখনোই কোনো শিক্ষক অসম্মান করে নি।রাদাফ রেগে জয়াকে বলে,

“জয়া প্রিন্সিপাল স্যার তোমাদের ডাকছে।আর হে কাউকে বলে দিও যদি হই হুলোড় করতে হয় ভার্সিটির বাহিরে গিয়ে করতে।”

বলেও রাদাফ তার বড় বড় পা ফেলে চলে যায়।পিহু আর্শিকার কানে কানে বলে,”আশু বেবি আর ইউ ওকে?তুই এমন তেজী উঠলি কেনো?”

“আরে তেজে উঠবো না তো কি করবো?দেখলি না আমার পাশে এসেই উনি হুংকার দিলো কেনো আমি কি বয়রা? ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো আমার আশে পাশে আসলেই চিল্লায়।”

নয়না বলে,”আরে না উনি হলো চুম্বক।দূরে থাকলে তোর প্রতি আকর্ষিত হয়ে কাছে আছে আর কাছে এলে নিজের ধর্ম নেগেটিভ থেকে পজিটিভ করে তোর সাথে সংঘর্ষ লাগে।”

জয়া বলে,”আচ্ছা চল,গিয়ে দেখি বাবা মানে স্যার কেনো ডাকলো।”

নয়না জয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আর স্যার বলতে হবে না।এখন আমরা পরিচিত ছাড়া কেউ নেই।তাই স্যারকে বাবাই বল।”

জয়া আর আর্শিকা মিলে প্রিন্সিপাল স্যারের ঘরের দিকে রওনা হয়।জয়া এই ভার্সিটির প্রিন্সিপালের মেয়ে তাই নয়না জয়াকে প্রিন্সিপাল স্যারকে বাবা বলতে বলেছে।প্রিন্সিপাল স্যারের ঘরের সামনে গিয়ে আর্শিকা দরজা ধাক্কা দিয়ে বলে,

“আসবো স্যার?”

“আরে জয়া আর আর্শিকা যে আসো আসো।তা তোমরা হটাৎ এখানে?”

“স্যার রাদাফ স্যার বললো আপনি নাকি ডেকেছিলেন?”

“আমি? ও হ্যা?সামনেই তো শীতের মহাপ্রকোপ তারপর তো বসন্ত আসবে।আর বসন্ত উৎসবের প্রথমেই তো ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান হবে সেই নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকেছিলাম।তোমরা তো খুব ভালো গান করো তো বসন্ত উৎসবে গান গাইবে নাহ?”

“স্যার আমি?”

আর্শিকার কথার মাঝেই জয়া বলে উঠে,”বাবা তুমি কোনো চিন্তা করো না।আমরা খুব ভালো ভাবে নিজেদের রেওয়াজ করবো।”

প্রিন্সিপাল স্যার হাসিমুখে বলে,”ওকে যেখানে আমার প্রিন্সেস বলে দিয়েছে সেখানে তো চিন্তার কোন কারণই নেই।”

জয়ার তার বাবার সাথে হাসির তাল মিলায়।জয়া আর প্রিন্সিপাল স্যারের সম্পর্কটা আর্শিকার বেশ ভালো লাগে।আজ যদি তার মা বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো তার আর তার বাবার সম্পর্কটাও এমন হতো।এসব ভাবতেই আর্শিকার ভিতর থেকে দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে।প্রিন্সিপাল স্যার জয়াকে বাহিরে যেতে বলে আর্শিকার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলে।জয়াও বাবার কথা মতো বাহিরে গেলে প্রিন্সিপাল স্যার প্রথমে আর্শিকাকে বসতে বলে,

“আর্শিকা আজমলের ফোন তুমি তুলো না কেনো?”

আর্শিকা এলোমেলো চোখে বলে,”না মানে স্যার ফোন সাইলেন্ট থাকে তো তাই।”

“মিথ্যা বলো না আর্শিকা।ছয় বছর ধরে তোমায় চিনি।ভালো করেই জানি কেনো তুমি ফোন তুলো না।”

“যখন জানেনই স্যার তাহলে এই প্রশ্ন তোলার অর্থ কি?”

প্রিন্সিপাল স্যার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”তুমি কি জানো আর কিছুদিনের মধ্যে আজমল দেশে ফিরবে?”

কথাটা শুনে আর্শিকার চোখ ছলছল করে উঠে।না চাইতেও আজমল নামক ব্যক্তি তার বাবা।যতই তাকে কষ্ট দিক সে তো তারই বাবা ছিলো, আছে আর থাকবে।প্রিন্সিপাল স্যার থেমে বলে,

“দেশে ফিরলে আজমলের সাথে সব সম্পর্ক ঠিক করে নিও।”

“স্যার আজমল স্যার নিশ্চয়ই আপনার বন্ধু তাই আপনি তার হয়ে সাফাই গাইতেই পারেন কিন্তু আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল। সে যে ভুল করেছে তার মাশুল তাকে দিতেই হবে আর তাও তার চোখের সামনে।”

কথাটা বলেই আর্শিকা চলে যায়।এখানে থাকতেও তার কষ্ট হয়।যেখানে তার বাবার কথা উঠে সেখানে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। আর্শিকার কাছে পৃথিবীর সমস্ত ছেলেরা খারাপ৷ পৃথিবীতে যদি দ্বিতীয় কাউকে ঘৃণা করা যায় তাহলে আর্শিকা তার বাবাকে করবে আর প্রথমজন সে আপাতত অজানাই থাক।

রাতে আর্শিকার কাছে একটা আননোন নাম্বারে কল আসে।আর্শিকা ফোনটা ধরতেই তার গলা শুকিয়ে আছে।রাগে, ভয়ে কথা বন্ধ হয়ে আসে।

#চলবে