#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-০৯
“বসন্ত মানুষের জীবনে রঙ ঢেলে দেয়,তবে তোমার মনে রঙ নেই কেনো কন্যা?”
কায়ানের কথায় আর্শিকা পিছনে ফিরে তাকাতেই কায়ানকে নজরে পড়ে।আর্শিকা কায়ানকে সম্মান দিয়ে বলে,
“স্যার আপনি এখানে?”
“দেখলাম সবাই কাজে ব্যস্ত তুমি মুক্ত তাই তোমার সাথে গল্পচারিতা করতে চলে এলাম।”
“আসলে স্যার ওরা আমাকে রেখে কোথায় কোন কাজ করছে তা আমার অজানা। তাই আমি এভাবেই বসে আছি।”
“আর্শিকা তোমাকে বার বার আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করতে হবে না।তুমি তো আমার সাথে ফ্রি লি কথা বলতে পারো ঠিক পিহুর মতো?”
আর্শিকা মনে মনে বলে,”দুলাভাইও তো এখন বলতে পারবো না তবে আর কি বলবো?আর পিহু যে ঠোঁট কাটা ওরকম ঠোঁট কাটা হলে তো হয়েই গিয়েছিলো।”
“পিহু আজ ভার্সিটিতে আসে নি তাই নাহ?”
আর্শিকা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলে,”না স্যার। ও নাকি অসুস্থ তাই।”
“কোন অসুস্থ নাহ ও। বরং কাল ও আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিলো আমি প্রত্যাখ্যান করায় দেবদাসী রুপে চলে গেছে।”
কায়ানের এমন কথায় আর্শিকা অবাক।পিহু যে এতো ফার্স্ট তা আর্শিকার অজানা ছিলো।আর্শিকা অবাক হয়ে বলে,
“কি বলছেন এসব স্যার?”
“ঠিকই বলছি আমি।ওকে বলে দিয়ে এসব প্রেম নিয়ে সময় নষ্ট না করে নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে।”
কায়ান কথাগুলো একটু রাগ করেই বললো।আর্শিকা শুধু কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো।রাদাফ আর্শিকার পাশে এসে বলে,
“সামনে বসন্ত উৎসব আর তুমি এখানে মুক্ত হয়ে ঘুরছো।তোমাদের না গান গাওয়ার কথা যাও গানের রেওয়াজ করো।”
রাদাফ বেশ রাগী গলায় কথাগুলো বলে। আর্শিকা এবার ভীষণ রাগ লাগছে যে কেউ এসে যখন তখন তার উপরই রাগ ঝাড়ছে।আর্শিকা রেগে বলে,
“যার বিয়ে তার হুস নেই, পাড়া-পড়শীর ঘুম নেই।গান আমি গাইবো আপনি নয় সো কখন গানের রেওয়াজ করা উত্তম তাও আমি ঠিক করবো।”
“শিক্ষক আমি নাকি তুমি?”
“গানের শিক্ষক নিশ্চয়ই আমি নই।আমি তখনই আপনার কথা শুনবো যখন আমি আপনার ক্লাসের অধীনে থাকবো অন্যথায় আপনার কথা শোনার প্রয়োজন দেখছি না”
“তুমি আমার মুখে মুখে কথা বলছো।”
“একদমই না বরং আপনাকে আপনার জায়গাটা দেখিয়ে দিচ্ছি।”
কথাগুলো বলেই আর্শিকা চলে গেলো আর রাদাফের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো।এদিকে রাদাফও রেগে ফায়ার, কায়ান রাদাফের রাগ কিছুটা আন্দাজ করতেই পালিয়ে গেলো।
✨✨
পিহু একের পর এক টিস্যু পেপারে নাক মুছঁছে আর কাঁদছে। আর্শিকা,নয়না আর জয়া পিহুকে শুধু দেখছে। তারা সকলে পিহুর এই রুপ সম্পর্কে অজ্ঞাতও।মূলত আর্শিকা পিহুদের বাসায় এসেছিলো পিহুকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিবে,কিন্তু এসেই দেখে পিহুর চোখ ফোলা,মুখটাও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
পিহুর মায়ের কাছ থেকে শোনা পিহু কাল রাত থেকে না খেয়ে রয়েছে। একেবারে চুপ মেরে গেছে। পিহু তার বন্ধুমহল দেখে নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে পুনরায় কান্নায় নিবেশিত হয়।নয়না আর্শিকার কানে কানে বলে,
“হে রে আশু,এ’কি আমাদের সেই পিহু যে সবসময় চিল মুড, হাস্যকর কথা বলতো?”
জয়া আর্শিকাকে বলে,”এই পিহুকে তো আমরা চিনতেই পারছি না।এ বড় জটিল সমস্যারে পিহু।”
পিহু সবার কথা শুনছে কিন্তু কোন প্রতিউত্তর দিচ্ছে না।আর্শিকা পিহুকে ধরে বলে,
“পিহু কি হয়েছে আমাদের খুলে বল তো?”
পিহু নাক টানতে টানতে বলে,”আশু বেবি,আমি কি সত্যিই খারাপ দেখতে নাকি আমার কোনো গুণ নেই বল তো?হে মানছি আমি একটু মজা করি আর ক্রাসটা বেশি খাই তাতে কি আমার দোষ? ক্রাস খেলে কি কাউকে মন দিয়ে ভালোবাসতে পারবো না বল?কায়ান কি করে পারলো আমার ভালোবাসাকে অস্বীকার করতে?”
আর্শিকা কি বলবে তা বুঝতে পারছে না।এখানে তো সম্পূর্ণ দোষ পিহুরই।সে কেনো স্যারের মনের কথা না জেনে প্রেমের প্রস্তাব দিতে গেলো।কিন্তু এখন যদি এই কথা বলে তাহলে তো রণযুদ্ধ লেগে যাবে।
জয়া বলে,”আচ্ছা বল তো স্যার আসলে কি বলেছে?”
পিহু নাক টানতে টানতে বলে,”আমি যখন কায়ান স্যারকে প্রপোজ করি উনি ডিরেক্ট না করে দেয় আর বলে আমি যাতে পড়াশোনায় মনোযোগ দেই।উনাকে বেশি জোর করলে উনি বলে যেই মেয়ে ১০১ টা ছেলের উপর ক্রাস খায় সেই মেয়ে আর যাই হোক তাকে ভালোবাসতে পারে না।”
বলেই পিহু আবার নাক টানতে লাগলো।পিহুর কথায় নয়না গর্জে উঠে বলে,
“এ তো ভারি অন্যায়।একটা মানুষ ক্রাস খেতেই পারে তাই বলে কি সে কখনো রিয়েল লাভ করবে না?”
জয়াও রেগে বলে,”পিহু ওই ছেলের সাথেই তোর বিয়ে হবে।ব্যবস্থা আমরা করবো।বিয়ে যদি না করে সোজা তুলে আনবো ওকে দেখিয়ে দিবি যে ভালোবাসার জন্য কোন ক্রাস ফ্রাস খাওয়া লাগে না।”
আর্শিকা একটু ভেবে বলে,”কায়ান স্যারের ফোন নম্বর আছে?”
পিহু না সূচক মাথা নাড়ায়। আর্শিকা পিহুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,”তাহলে প্রেম করবি কিভাবে?প্রেমের প্রথম ধাপই যাস নি অথচ প্রপোজাল দিয়ে বসে আছিস।”
“তার মানে তুই রাজি?”
“সবাই রাজি থাকলে কি আমি নাহ করতে পারি?”
পিহু খুশিতে আর্শিকা জড়িয়ে ধরে পিহুর উপরে জয়া আর নয়নাও আর্শিকাকে জড়িয়ে ধরে।
✨✨
বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিলো নেশা
কারা যে ডাকিলো পিছে,
বসন্ত এসে গেছে
মধুর অমৃতবানী বেলা গেল সহজেই
মরমে উঠিল বাজি বসন্ত এসে গেছে
থাক তব ভুবনের ধুলি মাখা চরনে
মাথা নত করে রব ..
বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে।
চারিদিকে বসন্তের গানে পরিবেশটা উৎসব মুখর হয়ে গেছে। গাছে গাছে সদ্য জন্ম দেওয়া ফুল আর পাতার আগমন দেখা যাচ্ছে।বসন্ত উৎসবে পরিবেশটা হয়ে রয়েছে উষ্ণ। এই উষ্ণ পরিবেশের মধ্যে চার রমনী যেকোনো পুরুষের মনে ঝড় তুলতে বাধ্য।
আর্শিকা, জয়া,পিহু,নয়না চারজনে মিলেই লাল পাড়ে হলুড শাড়ি পড়েছে। মুখে সবারই হালকা সাজ,পিহু আর নয়না চুল ছাড়া রেখেছে আর আর্শিকা জয়া চুল খোঁপা করে বেলি ফুলের মালা দিয়ে গেথেঁছে।নয়না আর পিহু ভার্সিটির বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে আসে।তাদের পরিকল্পনা মতো তারা চারজন একসাথে ভার্সিটিতে যাবে।পরিকল্পনা মাফিক জয়া আর আর্শিকা এলে একসাথে ভার্সিটিতে ঢুকে।
জয়া আশেপাশে তাকিয়ে দেখে আজ সমস্ত রমনীরা শাড়ি পড়ে এসেছে।জয়া সবাইকে বলে,
“ধুর ভাবলাম নায়িকার মতো ভার্সিটিতে ঢুকবো ভার্সিটির সব ছেলেরা তাকিয়ে থাকবে তা আর হলো কই?এখানে তো সবাই শাড়িই পড়েছে।”
নয়না জয়ার প্রতিউত্তরে বলে,”বসন্ত উৎসবে ভার্সিটিতে শাড়ি পড়বে নাকি জিন্স প্যান্ট পড়ে আসবে?তোকে কি পিহুর রোগে ধরেছে নাকি?”
পিহু সবাইকে থামিয়ে বলে,”এই তোরা চুপ থাক না।দেখ না কায়ান স্যার কোথায়?”
আর্শিকা পিহুর মাথায় চাপর মে/রে বলে,”এতো কায়ান স্যার কায়ান স্যার করিস না তো।কিচ্ছুক্ষণ পরে আমাদের গানের অনুষ্ঠান সেটার দিকে মনোযোগ দে।”
পিহু কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,”কায়ান স্যার আমার গান পছন্দ করবে তো?”
নয়না রেগে বলে,”আজব তুই কি একা গান গাইবি নাকি আমরাও গাইবো।তোর নইলে কাকের গলা কিন্তু আমাদের তো কোকিলের গলা দেখবি আমাদের গানের সুরে তোর কাকের গলা মিলিয়ে যাবে তখন আর ওই ব্যাটা টের পাবে না।”
পিহু রেগে বলে,”দেখ নয়ন বাজে কথা একদম বলবি না।”
নয়না ক্ষেপে গিয়ে বলে, “ওই তোর কি আমারে ছেলে মনে হয়?নয়না আমার নাম, ঠিক করে বলতেও পারিস না।”
“ঠিক করে শোনার তোর অধিকার নেই।”
এইভাবে এক কথায় দুই কথায় ধরণী কাঁপিয়ে দুই মানবী ঝগড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।জয়া তাদের থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তারা থামতে নারাজ।এদিকে আর্শিকার মনে অজানা ভয় গ্রাস করছে।আজ ছয় বছর পর তার দুজন ঘৃণিত ব্যক্তির সাথে দেখা হতে যাচ্ছে। তাদের দেখে আর্শিকা ঠিক কি করবে তা আর্শিকার নিজেরও অজানা। প্রচন্ড মাত্রায় রাগ উঠলে আর্শিকা হিতাহিত জ্ঞান শুন্য হয়ে যায়। আজও কি তাহলে তাই হবে?
আর্শিকাকে ভাবনাগ্রস্ত দেখে নয়না আর পিহু নিজেদের ধরণী কাঁপানোর যুদ্ধের ইতি টানে। জয়াও আর্শিকার এই গুমুট ভাবটা লক্ষ্য করেছে বটে। জয়া আর্শিকাকে ডাকলেও আর্শিকা তার ভাবনা রাজ্যে ব্যস্ত। জয়া আর্শিকাকে হালকা ধাক্কা দিলে আর্শিকা তার ভাবনা রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
“কি রে কখন থেকে তোকে ডাকছিলাম শুনছিলি না কেনো?”
পিহু আর্শিকা ক্ষেঁপাতে বলে,”আরে দেখ আশু বেবির নিশ্চয়ই আশিক এসে গেছে।”
নয়না একটু রেগে বলে,”হে রে পিহু তোর কি সবসময় মজা না করলেই নয়?”
“না নয়। আমি মজাপ্রিয় ব্যক্তি তাই মজা করি।
পিহুর সোজাসাপ্টা উত্তরে নয়না তপ্ত নিশ্বাস ফেলে। আর যাই হোক পিহু কখনো মানুষকে কষ্ট দেওয়ার জন্য মজা করে না,সবসময় সবাইকে খুশি রাখা এই বিশাল দায়িত্ব ধরণী যেনো পিহুর উপর অর্পিত করেছে।আর্শিকা সবার নিরবতা উপেক্ষা করে বলে,
” ভার্সিটির প্রধান অতিথি কি এসেছে?”
জয়ার সাবলীল ভাবে উত্তর দেয়,”না কেনো?”
“তাকে তো বরণ করতে হবে তাই না।তোরা বরং তাকে বরণ কর আমি যাই।”
এই বলে আর্শিকা বন্ধুমহল থেকে বেরিয়ে আসতে নিলেই কোন এক পুরুষালি গলা আর্শিকাকে আটকে দেয়।
“প্রধান অতিথি চলে এসেছে।তোমাকে তাদের বরণ করে নিয়ে আসার জন্য ডাকা হয়েছে।”
আর্শিকা রাদাফের দিকে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে গলায় বলে,”স্যার আমি না গেলে হয় না।”
“প্রিন্সিপাল স্যারের কথা অগ্রাহ্য করবে?”
আর্শিকা মিইয়ে গেলো।নিজের বাবাকে ভালো না বাসলেও প্রিন্সিপাল স্যারকে নিজের পিতার স্থান দিয়েছে।আর্শিকার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ভার্সিটির গেটে এসে হাজির হয়।কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই কালো গাড়ি থেকে কোর্ট প্যান্ট পরিহিত মধ্যবয়স্ক একটা ভদ্র লোক বের হয়।মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে হালকা গোলাপি শাড়ি পড়া একটা ভদ্রমহিলা বের হয়।আর্শিকা তাকে দেখা মাত্রই রাগে ক্ষোভে ভেঙে পড়ে।নিজেকে সামলে রাখা খুব কষ্টের,এই তো সেই মানুষ যার জন্য আজ সে মাতৃহীন,যার জন্য আজ তার কোনো ভাই বোন নেই।
#চলবে