তোমার তুমিতেই আমার প্রাপ্তি পর্ব-৩১+৩২

0
645

#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৩১

বিরস মুখে বারান্দায় বসে বই হাতে নিয়ে সামনে বৃষ্টি দেখছে ঈশা। এমন ভাগ্য কয়জনের হয় বিয়ের পরেরদিন সন্ধ্যা বেলায় শশুর বাড়ির লোকজন জোর করে ধরে পড়তে নিয়ে বসায়। তাও আবার এতো রোম্যান্টিক একটা ওয়েদারে। আর ইভানের এমন বিরক্তিকর আচরনেও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে সে। বিয়ের আগে কতো ভালো ছিল। বিয়ের আগে তো গায়ে এসে পড়তো। আর বিয়ের পরে পাত্তাই দিচ্ছে না। এমন ব্যবহার করছে যেন বাবা মা জোর করে ধরে বিয়ে দিয়েছে। আর সেই বউকে মানতে তার কষ্ট হচ্ছে। চোখ মুখ কুচকে ধপ শব্দে বইটা বন্ধ করে ফেলল। সমস্ত রাগ যেন উপচে বেরিয়ে আসছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে সে। রাগে শরীরটা কেমন জলে যাচ্ছে। মাথার ভিতরেও কেমন দপ দপ করছে।

–বইএর উপরে এভাবে রাগ দেখালে হবে? কাল তোর পরিক্ষা। বিয়ের জন্য তো পড়ালেখা সব তুলে রেখেছিস।

ইভানের এমন কথা শুনে রাগটা যেন আরও চাড়া দিয়ে উঠলো। দাতে দাত চেপে বলল
–আমার পড়ালেখা নিয়ে যখন এতই চিন্তা তাহলে বিয়েটা করলে কেন?

ইভান ঠোট চেপে হেসে গ্রিলের সাথে পিঠটা ঠেকিয়ে দিলো। ঈশা সামনেই তাকিয়ে আছে। ইভানের দিকে তাকাল না। ইভান গম্ভীর গলায় বলল
–নিজের কাছে রেখে ভালো করে পড়ালেখা করানর জন্য। ওই বাড়িতে থেকে কেমন পড়ছিস সেটা তো দেখতে পেতাম না। তাই সবটা খেয়াল করার জন্যই এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করেছি।

ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। নিজের রাগটা দমন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো। চোখ খুলে ইভানের দিকে তাকাল। বৃষ্টির ফোটা ফোটা পানি গ্রিল বেয়ে পড়ছে। তার পুরো পিঠ ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে চোখ রেখেই স্বাভাবিক ভাবে বলল
–তুমি ভিজে যাচ্ছ।

ইভান খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–তাতে কি আমার তো আর পরিক্ষা না। আমি অসুস্থ হয়ে গেলেও সমস্যা নেই।

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। উঠে ইভানের হাত ধরে টানতে লাগলো। কিন্তু ইভান সরল না। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে রাগি সরে বলল
–তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে সেবা তো আমাকেই করতে হবে। এতে আমার পড়ার ডিস্টার্ব হবে। আমার না পরিক্ষা!

ইভান শব্দ করে হেসে ফেলল। ঈশাকে টেনে গ্রিলের দিকে ঘুরিয়ে দাড় করে দিলো। ঈশার রাগ কমে গেলো। একটু হেসে গ্রিলে লেপটে থাকা বৃষ্টির ফোটা গুলো আঙ্গুলে ছুয়ে দিলো। দুই হাত বের করে বৃষ্টি ধরছে। ইভান পেছন থেকে গ্রিলে হাত রাখল। ঈশার গালের সাথে নিজের গাল স্পর্শ করে সামনে তাকিয়েই বলল
–এতো পছন্দ বৃষ্টি?

ঈশা ছোট্ট করে ‘হুম’ বলল। ইভান আবার জিজ্ঞেস করলো
–আমার থেকেও বেশী?

ঈশা নিজের ভেজা হাত গুলো ভিতরে ঢুকিয়ে নিলো। গ্রিলে রাখা ইভানের হাতে রেখে বলল
–যদি বেশী পছন্দ হয়েই থাকে তাহলে কি করবে?

ইভান একটু ভাবল। তারপর খুব শান্ত কণ্ঠে বলল
–বৃষ্টিকে তো আমি আটকাতে পারব না। কিন্তু যখন বৃষ্টি আসবে তখন আমার ভালবাসা দিয়ে সেই মুহূর্তটা ভুলিয়ে দিতে পারব। বৃষ্টির কথা মনে পড়বে না আর।

–এতো ভরসা নিজের উপরে?

–উহু। ভালবাসার উপরে বিশ্বাস। আমি আমার ভালবাসা দিয়ে তোকে পুরো দুনিয়া থেকে আলাদা করে রাখতে পারব। তুই কোনদিন কোন কিছুর অভাব বোধ করার সুযোগ পাবি না। আমার ভালবাসার চাদরে তোকে এমন ভাবে মুড়িয়ে রাখবো তুই নিজেও সেখান থেকে বের হতে চাইবি না। আমি আমার অবাধ্য ভালবাসা দিয়ে তোকেও ভালবাসতে বাধ্য করেছি জান। আমার ভালবাসার উপরে অগাধ বিশ্বাস আমার।

ঈশা হেসে বলল
–আমি এই ভালবাসার বাধন থেকে বের হতেও চাই না।

ইভান এবার একটু কঠিন গলায় বলল
–অনেক হয়েছে বৃষ্টি বিলাস। এবার পড়তে বসেন। সব সময় এতো আবেগের মধ্যে থাকলে কি জীবন চলে?

ঈশার মেজাজ টা আবার আগের মতো হয়ে গেলো। সে এক ঝটকায় ইভান কে সরিয়ে দিয়ে চলে গেলো ঘরে। ইভান ঘাড় বেকিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে হাসল। কিছুক্ষন বারান্দায় দাড়িয়ে থাকলো একা একা। তারপর ভিতরে চলে এলো। ভিজে যাওয়া টি শার্ট চেঞ্জ করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। খানিকবাদে দুই কাপ কফি নিয়ে এলো। ঈশার সামনে একটা কাপ ধরল। ঈশা বই থেকে মুখ তুলে বিরক্তিকর গলায় বলল
–খাবনা।

ইভান সামনে বসে পড়ল। একটু কঠিন গলায় বলল
–না শুনতে আমি অভ্যস্ত না। এটা এতদিনে বুঝে গেছিস।

ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। এভাবে কথা বলার কি আছে। ভালো করে বললে কি হতো। ঈশাকে বই এর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভান আবার সামনে কাপটা ধরল। শান্ত গলায় বলল
–এটা খেলে মাথা ব্যাথাটা কমে যাবে। প্লিজ জান।

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের দিকে তাকাল। বলল
–তোমাকে কে বলল আমার মাথা ব্যথা করছে?

–আমাকে কেউ বলবে তারপর সেটা আমি জানব? তোর কি তাই মনে হয়?

ঈশা কোন কথা বলল না। কফির কাপটা নিয়ে তাতে চুমুক দিচ্ছে আর বই এর পাতা উলটাচ্ছে। তার সামনে বসেই ইভান ফোনে কি যেন মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ঈশা বই রেখে ইভানের দিকে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর ইভান ফোনের দিকে তাকিয়েই বলল
–আমাকে দেখার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে। কিন্তু সারাজীবন ধরে তোর এক্সাম নেয়ার জন্য কেউ বসে থাকবে না। তাই আমার দিকে মনোযোগ না দিয়ে বই এর দিকে দে। কাজে দিবে।

ঈশা চোখ মুখ খিচে আবার পড়তে শুরু করলো। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে হাসল।

—————
রাত ১২ টা বাজে এখনো ঈশা পড়ছেই। কখনও হেটে হেটে পড়ছে। কখনও বিছানায় বসে। কিন্তু কোনভাবেই পড়া থামাচ্ছে না। সে ঠিক করেছে আজ সারা রাত পড়বে। পড়ে পড়ে মরে গেলেও কোন আফসোস নাই। পিছনে হেলানি দিয়ে অসহায়ের মতো বসলো। তার নিজের বাড়িতেও এতো অত্যাচারিত হয়নি পড়া নিয়ে যতটা না শশুর বাড়িতে হচ্ছে। তার মা তো তাকে বুঝিয়ে পাঠিয়েছিল যে শশুর বাড়ির লোকজনের সেবা করতে। কিন্তু এখানে তো পুরোই উলটো। পড়ার ঠেলায় তারাই তার সেবা করতে ব্যস্ত। তাকে নিচে খেতেও যেতে দেয়নি। শাশুড়ি মা নিজে হাতে উপরে এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে। আর কড়াভাবে বলে গেছে কিছু লাগলে যেন কাউকে ডাকে। সময় নষ্ট করার কোন দরকার নেই। আর ইফতিটাও আজব। ছেলেরা এতো পড়ে নাকি? পরিক্ষার সময় দুই তিন দিন নাকি ঘর থেকেই বের হয়না। কই একটু বসে আড্ডা দিবে তা না। পড়া নিয়ে ব্যস্ত। ঈশা অধৈর্য হয়ে গেলো। প্রায় সাড়ে ১২ টা নাগাদ ইভান রুমে ঢুকল। ঈশা দেখেও না দেখার ভান করে বসে থাকলো। ইভান ঈশার পাশে বসলো। ঈশা তাতেও কোন কথা বলল না। এমন কি মুখটা তুলেও দেখল না। ইভান বইটা ঈশার হাত থেকে নিয়ে বন্ধ করে ফেলল। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–আমি পড়ছি। বিরক্ত করছ কেন?

ইভান উঠে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিতে দিতে বলল
–অনেক হয়েছে পড়ালেখা। আর না।

ঈশা দাতে দাত চেপে বলল
–কেন? অনেক হবে কেন? কেবল তো শুরু। এখনো পুরো রাতটা পড়ে আছে।

ইভান কোন কথা বলল না। জানালাটা বন্ধ করে এসি টা অন করে বিছানায় বসে পড়ল। ইভান কে বসতে দেখে ঈশা উঠে যেতে নিলো। ইভান হাত ধরে ফেলে। ঈশা হাতের দিকে তাকিয়ে বলল
–ছাড়ো আমাকে?

ইভান ঈশাকে টেনে কোলে বসিয়ে নিলো। ঈশার দুই গালে হাত রেখে বলল
–ছাড়বো কেন? বউকে ছেড়ে রাখার জন্য বিয়ে করেছি?

ঈশা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল
–ওহ! বিয়ে করেছ বউ আছে সেটা মনে আছে তোমার?

ইভান ঠোট টিপে হেসে বলল
–ভুলতে চাইলেই কি তুই দিবি?

ঈশা ইভানের কথা শুনে রেগে গেলো। নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। কঠিন গলায় বলল
–আমি কি তোমাকে বেধে রেখেছি? ছেড়েই রেখেছি। ভুলতে চাইলে ভুলে যাও।

ইভান ঈশাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ঘাড়ে নাক ঘোষতে ঘোষতে বলল
–বেধে রাখিস নি কিন্তু ছেড়েও তো দিস নি। পাগল করে রেখেছিস আমাকে।

ঈশা অভিমানি কণ্ঠে বলল
–আমার ভালো লাগছে না। ছাড়ো। আমি ঘুমাব।

ইভান ছেড়ে দিলো। ঈশা দু পা বাড়াতেই ইভান আবার তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে নিলো। কোমরে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল
–কাল ঘুমাতে দিয়েছি বলে আজকেও ঘুমাতে দিবো সেটা কিভাবে ভাবলি?

কথা শেষ করে ঈশাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঈশা উঠতে চাইলে ইভান তাকে চেপে ধরল বিছানার সাথে। ঈশা মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। ইভান ঈশার গালে নাক ঘসে বলল
–আমি প্রতিদিন সকালে চোখ খুলেই তোর মুখটা দেখতে চাই জান। তোর চেহারা দেখেই আমি আমার দিন শুরু করতে চাই।

ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইভান ঈশার ঠোঁটে ঠোট ছোঁয়াতে যাবে ঠিক তখনি ফোন বেজে উঠলো। বিরক্ত হল সে। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমার উপরে টর্চার করার জন্য সবাই সব সময় রেডি থাকে। একটা মিনিটও দেরি হয়না কারও।

ঈশা ঠোট টিপে হাসল। ইভান তীক্ষ্ণ চোখে ঈশার দিকে তাকাল। তারপর বলল
–আজ কোন ফোন ধরব না। ফোনটাকেই বন্ধ করে দিবো।

বলেই পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিলো। নাম্বারটা দেখে ভ্রু কুচকে নিলো। ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসলো। ঈশা ইভান কে এভাবে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলো
–কার ফোন?

ইভান কোন কথা বলল না। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল। ঈশা সেটা শুনতে পেলো না। কিন্তু ইভান সেটা শুনেই চিৎকার করে বলল
–হোয়াট?

ঈশা ইভানের চিৎকার শুনেই বুঝে গেলো কিছু একটা হয়েছে। ইভান একটু থেমে আবারো বলল
–আমি আসছি।

বলেই ফোনটা রেখে দিলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশা ইভানের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–কোন সমস্যা?

ইভান ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল
–মেঘলা সুইসাইড করেছে।

ঈশা আঁতকে উঠলো। বিচলিত হয়ে বলল
–সুইসাইড করেছে মানে?

ইভান কোন কথা বলল না। ঈশার গালে হাত রাখল। করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–শুয়ে পড় জান। আমাকে যেতে হবে।

চলবে……।

#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৩২

দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে আছে ইভান। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। কিন্তু তার থেকেও বেশী মানসিক যন্ত্রণাটা। প্রচণ্ড টেনশন আর অপরাধ বোধ নিয়ে পার করেছে নির্ঘুম একটা রাত। পরিস্থিতি এভাবে পালটে যাবে সেটা হয়তো তার ধারনা ছিল না। মাথা তুলে সামনে তাকাল। সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে মেঘলার জ্ঞান শুন্য দেহটা। খুব খারাপ কিছু নাহলেও ভালো কোনভাবেই বলা যায়না এটাকে। অতিরিক্ত ব্লাড লসের কারনে বডি শকে চলে গিয়েছে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি জ্ঞান না ফেরে তাহলে কোমায় চলে যাবে। মৃত্যু পর্যন্ত ঠিক হবে কিনা সেটা কেউ বলতে পারবে না। এক পাশে স্যালাইন আর এক পাশে রক্তের ব্যাগ ঝুলছে। ইভান অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। ইভানের বিয়ের কথা শুনেই নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি মেঘলা। নিজের পালস কেটেছে। সময় মতো হসপিটালে আনলে হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকতো। কিন্তু তার বাবা মা তাকে আনতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। আর ডক্টর হিসেবে মেঘলা ভালো করেই জানত কিভাবে কি করলে তাকে আর ফেরান সম্ভব হবে না। পুরোটাই প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু উপর ওয়ালার হয়তো সেরকম কোন ইচ্ছা নেই। তাই তার প্রস্তুতি তেমন একটা কাজে দেয়নি। এক মাত্র মেয়ের এরকম জীবন মরন আশংকায় তার বাবা মা দিশে হারা। ইভান কোনভাবেই তাদের সাথে কথা বলতে পারছে না। যদিও তার কোন দোষ নেই। তবুও কেন জানি একটা অপরাধ বোধ তার মাঝে কাজ করছেই। যদি মেঘলার বড় কোন ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে এর জন্য ইভান সারাজীবন নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবে। সারা রাত পাশে বসে মেঘলার সেবা করেছে সে। সে চায় মেঘলা সুস্থ হয়ে উঠুক। স্বাভাবিক জিবনে ফিরে যাক। প্রতিটা মানুষের সুখী হওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু মানুষ জিবনের সুখের চেয়ে না পাওয়ার বেদনাটাকে বড় করে দেখে। প্রতিটা মানুষের জিবনে অপূর্ণতা থাকেই। সেগুলকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকার লড়াইটাই মুখ্য। অপূর্ণতার জন্য জীবনকে শেষ করে দেয়ার মাঝে কোন প্রাপ্তি নেই। ইভানের ভালবাসা না পেয়ে নিজেকে শেষ করার কথা না ভেবে জদি মেঘলা নিজের জিবনে ভালো থাকার লড়াই করতো তাহলে হয়তো ইভানও আজ এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেত। নিজেও ভালো থাকতে পারবে না। আর তার ভালবাসার মানুষটাকেও ভালো থাকতে দিচ্ছে না। অদ্ভুত নিষ্ঠুরতার স্বীকার আজ ইভান। মেঘলা চাইলেই তাকে এই পরিস্থিতি থেকে বের করতে পারতো।

ইভানের ভাবনার মাঝেই নার্স এসে ঢুকল। ক্ষীণ সরে বলল
–স্যার ম্যাডামকে ইঞ্জেকশন দিতে হবে।

ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–তুমি সব কিছু এরেঞ্জ করো আমি দিচ্ছি।

নার্স ইঞ্জেকশন রেডি করে ইভানের হাতে দিলো। ইভান সেটা নিয়ে মেঘলার হাতে খুব সাবধানে পুশ করলো। নার্স ইভান কে বলল
–স্যার আপনি একটু রেস্ট নেন। আমি ম্যামের কাছে আছি।

ইভান মাথা নাড়িয়ে মেঘলার দিকে তাকাল। তারপর বের হল। বের হতেই মেঘলার মা এসে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। মুখে আচল চেপে ডুকরে কেদে উঠলো। ইভান নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। সন্তানকে এই অবস্থায় দেখে তার কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা অনুভব করতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারছে সে। ইভান অসহায়ের মতো বলল
–এভাবে কান্না কাটি করলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আপনি রেস্ট নেন। আমি আছি তো।

মেঘলার বাবা মা দুজনেই গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলো। মেঘলার বাবা ইভানের হাত ধরে বলল
–আমার মেয়েটাকে ঠিক করে দাও বাবা। আমি ওকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। ওকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো। একবার ঠিক হয়ে যাক।

ইভান নত দৃষ্টিতে মেঘলার বাবাকে বলল
–দোয়া করেন আঙ্কেল। ইনশাহ আল্লাহ মেঘলা ঠিক হয়ে যাবে।

তার কথা শেষ হতেই ইফতি এসে সামনে দাঁড়ালো। ইভান কে জিজ্ঞেস করলো
–ভাইয়া মেঘলা আপু এখন কেমন আছে?

ইভান কোন কথা বলল না। মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলো খুব ভালো নেই। ইফতি যা বুঝার বুঝে গেলো। কিছু বলতে গিয়েও মেঘলার বাবা মাকে কাঁদতে দেখে থেমে গেলো। ইভান কে উদ্দেশ্য করে বলল
–তোমাকে খুব টায়ার্ড লাগছে। তুমি একটু রেস্ট নাও।

ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–হুম। আমি বাসায় যাবো। ফ্রেশ হয়ে তারপর আসবো। তুই তো আছিস। কোন প্রবলেম হলে ফোন করিস।

–আমার পরিক্ষা আছে ভাইয়া। শেষ হলে আমি ফ্রি।

ইফতির কথা শুনে ইভানের মনে পড়ে গেলো ঈশারও আজ পরিক্ষা আছে। একটু ভেবে বলল
–ঈশা কোথায়?

–ওপাশে হয়তো সারাদের সাথে কথা বলছে।

ইভান চোখটা বন্ধ করে ফেলল। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–ঈশাকে আমার কেবিনে আসতে বল। আমি ওখানেই আছি।

কথা শেষ করে ইভান ওর কেবিনের দিকে গেলো। আর ইফতি ঈশার কাছে। ইভান কেবিনে ঢুকে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে ঈশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু সেটা বেশিক্ষন সম্ভব হল না। ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নার্স বিচলিত কণ্ঠে বলল
–মেঘলা ম্যামের পালস ড্রপ করছে। তাড়াতাড়ি আসুন স্যার।

ইভান খুব দ্রুত চলে গেলো মেঘলার কাছে। গিয়ে দেখল সত্যি সত্যি মেঘলার অবস্থা ক্রিটিক্যাল। ইভান নার্সকে বলল
–ইমিডিয়েট ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থা করো আর আব্বুকে একবার আসতে বল।

নার্স বের হয়ে গেলো। কিছুক্ষন পর ফিরে এসে বলল
–চেয়ারম্যান স্যার এখনো আসেন নি।

ইভান একটু বিরক্ত হল। নার্সের হাত থেকে ইঞ্জেশনটা নিয়ে পুশ করে ফোনটা হাতে নিলো। ইমতিয়াজ রহমান কে ফোন করে বলল
–আব্বু মেঘলার কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল। তোমাকে আসতে হবে এখনি।

ইমতিয়াজ রহমান চিন্তিত ভঙ্গিতে ‘আচ্ছা’ বলেই ফোনটা রেখে দিলো। ইভান যথাসাধ্য চেষ্টা করছে মেঘলার পালস স্বাভাবিক করার জন্য। কিন্তু কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। যত সময় যাচ্ছে ততই অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।

ঈশা ইভানের কেবিনে এসে দেখল কেউ নেই। বের হয়ে বাইরে দাড়াতেই ইফতি এসে বলল
–ভাইয়া মেঘলা আপুর কেবিনে। পালস ড্রপ করছে। অবস্থা ভালো না।

ঈশা বিস্ময় নিয়ে বলল
–মানে?

ইফতি উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে এগিয়ে গেলো। ঈশা বুঝে গেলো বিষয়টা খুব খারাপ পর্যায়ে। সেও তার পিছে পিছে গেলো। ইফতি দরজা খুলে ঢুকল ভিতরে। ইভান চমকে তাকাল। ইফতি মনিটরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো অবস্থা ভালো না। সব কিছু এখন ভাগ্যের হাতে। ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল
–মেঘলার কিছু হলে আমি নিজেকে কখনও মাফ করতে পারব না। ওর বাবা মাকেই বা কি জবাব দিবো। তাদেরকে শান্তনা দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই।

ইফতি ইভানের ঘাড়ে হাত রাখল। ইভান ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখল ঈশা দরজায় দাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভানের কথাটা যে ঈশা শুনেছে সেটা সে বুঝতে পারছে। ঈশার মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছে সে। চোখে মুখে অসহায়ত্ব। কষ্টের ছাপ। ঈশা যে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে সেটা ইভান ভালো করেই জানে। কিন্তু সে কি করবে। সে যে বড় অসহায়। ইভান উঠে দাঁড়ালো। ঈশার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঈশা দৃষ্টি ফিরিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। ভীষণ ক্লান্ত সে। ঈশা জানে ইভানের ক্লান্তি এই বিমর্ষতা কিভাবে দূর করতে হবে। একটু হেসে বলল
–ঘুমাওনি সারা রাত না?

ইভান উত্তর দিলনা। উলটা ঈশাকেই বলল
–তুইও তো ঘুমাস নি।

ঈশা ইভানের কথার উত্তর না দিলেও স্বাভাবিক ভাবে বলল
–সকাল থেকে কিছুই তো খাওনি। আব্বু আসলে একটু রেস্ট নিও। নাহলে যদি তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো তাহলে আরও প্রবলেম হয়ে যাবে।

ইভান ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ঈশা ইফতিকে উদ্দেশ্য করে বলল
–চল। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ইফতি মাথা নাড়িয়ে বের হতেই ইভান ঈশার গালে হাত রাখল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–থ্যাঙ্কস!

ঈশা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে ফেলল। ইভান বলল
–জীবনের কঠিন সময় গুলতে আমাকে এভাবে সামলে নেয়ার জন্য।

ঈশা হালকা হেসে বলল
–তোমার মতো করে আমি হয়তো ভালবাসতে পারিনি কিন্তু তোমার কাছ থেকে দায়িত্ব বোধটা ঠিক মতো শিখে নিতে পেরেছি। তুমি আমাকে সব সময় সামলে নিয়েছ। জীবনের অনেক কঠিন সময়ের কথা আমাকে জানতেও দাওনি। এমন অনেক কিছুই আমি আঁচ করার আগেই তুমি সামলে নিয়েছ। তোমাকে সামলানো আমার দায়িত্ব।

ইভান ঈশার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–যেতে দিতে ইচ্ছা করছে না।

ঈশা হেসে বলল
–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ইভান আর কিছু বলল না। ঈশা চলে গেলো। নিজেকে খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রকাশ করলেও ঈশার ভিতরে কি চলছে সেটা ইভানের বুঝতে কষ্ট হল না। ঈশাকে সে খুব ভালো মতো চেনে। তার অনুভূতিগুলোর সাথে খুব ভালভাবে পরিচিত সে।

চলবে………