তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব-০৬

0
323

#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(০৬)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

নজরাত কফি হাতে মাত্র‌ই পা রাখলো রুমের ছোট বেলকনি কাম ছাদটায়।রাদ দোলনায় বসে বসে ফোন স্ক্রল করছিল। তখন নজরাত কফি এগিয়ে দিয়ে বলল,
—” কফি।
রাদ শাহমাত একপলক নজরাত এর দিকে তাকায়, তারপর নজরাত এর হাত থেকে কফি নেয়।
নজরাত নিজেরটা নিয়ে ছাদের এক কোনায় দাঁড়ায়। আসেপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে কফির মগে চুমুক দেয়, দেখলো ছাদের সাথে একটা কড়োই গাছে টুনটুনি পাখি বসে আছে। নজরাত দৌড়ে গিয়ে রুম থেকে কাগজ আর কলম হাতে ফিরে আসে। গাছের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবে আর লিখে। সবটাই অবলোকন করে রাদ। তবে আমলে নিল না, ফোনে আবার মনোনিবেশ করে।
নজরাত খানিকক্ষণ পর কলম কামড়ে ধরে বললো,
—” আচ্ছা আপনি টুনটুনি পাখি সম্পর্কে জানেন? দরজি পাখি টুনটুনি (অর্থোটমাস সুটোরিয়াস ) হল একটা গায়ক পাখি যাকে ক্রান্তীয় এশিয়া জুড়ে দেখা যায়। গাছের পাতা একসঙ্গে ‘সেলাই’ করে বাসা বানানোর জন্যে এই পাখি জনপ্রিয় এবং রুডইয়ার্ড কিপলিং তার দ্য জাঙ্গল বুক বইতে একে অমর করে রেখেছেন, শহরের বাগানে এটা একটা সাধারণ বাসা। যদিও এই লাজুক পাখিরা গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে, তাদের জোরালো ডাকাডাকি তাদের উপস্থিতির জানান দেয়। লম্বা খাড়া ল্যাজ থাকায় তাদের স্বাতন্ত্রসূচক লাগে, শরীরের ওপর দিকটা সবুজাভ এবং ছাইরঙা কপাল ও মাথা। এই চড়াই-জাতীয় পাখি বৈশিষ্ট্য মূলক ভাবে দেখা যায় খোলা খামার জমি, ঝোপ, বনপ্রান্ত এবং বাগানে। দরজি পাখিরা বাসা গড়ার ঢঙ থেকে তাদের নামটা পেয়েছে। গাছের বড়ো পাতা ঠোঁট দিয়ে সূঁচের মতো একসঙ্গে গাছের আঁশ অথবা মাকড়সার জালের রেশমি সুতো দিয়ে কাঠামো করে তার মধ্যে আসল বাসা গড়ে।
আচ্ছা আপনি..

নজরাত পিছনে ফিরে দেখল রাদ কোথাও নেই! দোলনায় কফির মগ রাখা। নজরাত দৌড়ে রুমে এসে দেখে রাদ হাতে ঘড়ি পড়ে, ওয়ালেট পকেটে গুঁজে, গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে গেল! সবকিছুর মাঝে নজরাত খেয়াল করলো রাদ এর মুখশ্রীতে কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে তোলা। নজরাত পিছন থেকে বলল,
—” জ্যাকেট না নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই রাদ এর হনহন করে বেরিয়ে গেল সে।
কি এমন ঘটনা ঘটলো যার দরুন রাদ এভাবে বেরিয়ে গেল? নজরাত কফির মগ গুলো হাতে নিয়ে নিচে নেমে আসে। ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে ল্যাপটপ ইউজ করছে রূপক। নজরাত কে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলল,
—” এই অবেলায় তোর বর কোথায় ছোটলো বোনু?
নজরাত অস্ফুট গলায় বলল,
—” আমি জানি না ভাইয়া। তবে নিশ্চয়ই কোন জরুরী কাজ পরে গিয়েছে।
হাতের কাপ গুলো কিচেনে রেখে এসে ভাইয়ের পাশে বসে বলল,
—” আচ্ছা ভাইয়া তোমার কি কোন মেয়ে পছন্দ করা আছে?
রূপক ল্যাপটপে চোখ রেখে নির্বিকার মুখে বলল,
—” হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
—” এমনিতেই, তবে না থাকলে মেয়ে দেখতাম আর কি।
—” সে সব বাদ দে। এবার বল তোর গল্পপুড়ি কেমন চলছে?
_______

নদীর পাশে দাঁড়িয়ে রুপকথার জন্য অপেক্ষা করছে রাদ। রা’গে মেজাজ খিট’খিটে হয়ে আছে তার! মিনিট দুয়েক না পেরোতেই আবার রুপকথার ফোনে কল করে, এই নিয়ে কতো সতো বার কল করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
ফোন কর্ণধারে ধরতে পিছন থেকে ডাক দিল রুপকথা। রাদ কিছুটা এগিয়ে চাপা রা’গের গনগনে গলায় বলল,
—” তুমি কি এতো দিন নাটক করেছো আমার সাথে! সত্যি করে বলো কে..
রুপকথা চটজলদি রাদ এর হাত ধরে বলল,
—” বেব ক কি হয়েছে? তুমি না বললে আমি কিভাবে বুঝবো বলো?
রাদ ফোন ঘেঁটে কিছু একটা বের করে রুপকথার সামনে ধরে বলল,
—” কি এটা? তোমার দ্বিতীয় আইডি আছে বলো নি কেন এতো দিন?
রুপকথা ফোনের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে কিছুটা তোতলাতে তোতলাতে বলল,
—” অহ এই ব্যাপার? আসলে কি জানো তো আমি আমার পার্সোনাল আইডিতে রিলেটিভ ছাড়া অন্য কাউকে এড করি না। ওটা তো আমার ফ্যান ফলোয়ার দের জন্য দ্বিতীয় আইডি খোলা হয়েছিল। তো নতুন ব‌ই আসতে চলেছে এখন যদি ফ্যান ফলোয়ার দের নিয়ে আলাদা আড্ডা না দেই তাহলে আমার ব‌ইয়ের প্রচার কি করে হবে বলো? তা.তাই এটা করা।
—” তাহলে এখানে কেন বললে? আমার একটাই আইডি! আমার নামে অন্য আইডি দেখলে বুঝবেন ফেইক আইডি!

আশ্চর্য বিষয় এই শীতের মৌসুমেও রুপকথার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম বের হয় যা ওরনা দিয়ে মুছে নেয় রুপকথা! তারপর শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে চেটে বলল,
—” আমি আমার পার্সোনাল আইডি হাইড রাখতে এ কথা বলেছি রাদ। আর তুমি কিনা এভাবে আমাকে সন্দেহ করছো? তুমি আর আমাকে আগের মত করে ভালোবাসো না রাদ! আমি বুঝতে পারছি তুমি তোমার স্ত্রীর প্রেমে পড়ে গেছ!

তারপর ওরনা মুখে চাপা দিয়ে দৌড়ে গিয়ে বেঞ্চে বসে রুপকথা। রাদ নিজের কাছে নিজেকে কেমন পা’গল পা’গল লাগছে।চুল গুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে, তাড়াহুড়ো করে শীতের পোশাক ও নিয়ে আসেনি। এখন শীত অনুভব হচ্ছে। তবে সেসব তোয়াক্কা না করে রুপকথার কান্না থামাতে গেল সে।

তখন নজরাত দের বাসায় দোলনায় বসে বসে ফোন স্ক্রল করতে করতে নিউজ ফিডে “রুপকথা” পেইজের পোস্ট দেখতে পায় রাদ। পোস্টটি বায়ান্ন মিনিট আগে করা হয়েছে। পোস্টটি ছিল এমন,
—“সতর্কমূলক পোস্ট,
আমার নামে অনেক ফেইক আইডি খোলা হয়েছে, ফেইক লোকজন দের ফাঁদে পা দিবেন না। আমার আইডি লিঙ্ক নিচে দেওয়া হলো। এটা ছাড়া আর কোন আইডি নেই আমার।
রুপকথা (লেখিকা)
_______

জানালার ধারে আড়ষ্ট ভাবে বসে আছে নজরাত। মাগরিব এর সালাত আদায় করে বসেছে এখানে। প্রায় দুই ঘণ্টা হতে চললো কিন্তু রাদ এর আসার খবর নেই। সাজেদা চৌধুরী, তারা আসরের পর পর র‌ওনা হয়ে চলে গেছেন। সাজ্জাদ হোসেন এর ইচ্ছেতে রাদ আর নজরাত রয়ে গেছে এ বাসায়। কথা হয়েছে তারা কিছুদিন এ বাসায় থাকবে। কিন্তু রাদ কোথায় গেল ? তার প্রতিক্ষাতেই বসে আছে নজরাত।

খাবার খাওয়ার জন্য সাজ্জাদ হোসেন নিজে এসে নজরাত কে খেতে যেতে বললেন। নজরাত মৃদুস্বরে বলে,
—” তোমার জামাই আসলে একসাথে খাবো বাবা। তুমি বরং ভাইয়া কে নিয়ে খেয়ে নাও। তখন রূপক ও আসলো।বলল,
—” ঠিক আছে তাহলে আমরাও অপেক্ষা করি।
তারপর তিনজন মিলে আরো ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করেও ফলাফল শূন্য পেলো।বাবা আর ভাইয়ের জোড়াজোড়িতে শেষে না খেয়ে পারলো না নজরাত। তারপর একসময় অপেক্ষা করতে করতে নিচে ড্রয়িং রুমে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়লো।

রাদ রুপকথার সাথে রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করে নিজের বাসায় ফিরে। সাজেদা চৌধুরী নিজের রুমে ছিলেন বলে দেখতে পায়নি। রাহা দেখতে পায়, ভাঙা গলায় বলে,
—” ভাইয়া তোমার তো ওবাড়ি থাকার কথা ছিল। চলে এসেছো যে?
রাদ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়ায়, বলল,
—” রুপকথার সাথে দেখা করতে এসেছি!
—” ভাবীমণি কে বলেছিলে? উনি তো দুশ্চিন্তা করবেন।
রাদ শাহমাত ভ্রু কুঁচকে বলল,
—” ঐ মেয়েটা তোর ভাবীমণি হলো কবে থেকে?
রাহা খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। কিন্তু রাদ জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল। রাহা মৃদুস্বরে বলল,
—” এমনি বলে ফেলেছি। আচ্ছা তুমি রুমে যাও।
রাহা রুমে চলে গেল। রাদ খানিকক্ষণ নির্নিশেষ চোখে চেয়ে থেকে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
_______

রোজকার মতন রাতের শেষ তৃতীয়াংশে ঘুম ভেঙ্গে গেল নজরাত এর। উঠে বসে সে। চারিদিকে এক পলক তাকিয়ে গা কেমন শিহরিত হয়ে উঠল।বিরাট বড় জায়গা দখল করে ড্রয়িং রুমটা করা হয়েছে। বিভিন্ন ডিজাইনের ফার্নিচারে ভরপুর। কিন্তু জনশূন্য হয়ে আছে এই মুহূর্তে। তাই একটু ভ’য় ভ’য় লাগলো নজরাত এর।বুঝলো রাদ আসেনি।মন খারাপ করে উপরে নিজের রুমে এসে বাথরুম থেকে অযু করে নামাযে দাঁড়ায় সে।

সকালে নাস্তা করছে তখন আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। প্রথমে ইগনোর করলেও পরে রিসিভ করে নজরাত। কথা শুনে বুঝতে পারে রাহা কল করেছে! বেশ অবাক হয় নজরাত। ওপাশ থেকে রাহা বলেছে নজরাত এর সাথে কথা বলতে চায় সে! নজরাত বাসায় আসতে বললে নিষেধ করে, রেস্তোরাঁয় দেখা করতে বলে! নজরাত খাওয়া বাদ দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বসে থাকে কি কথা বলতে চায় রাহা?এই ভেবে….

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।