তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব-০৯

0
332

#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(০৯)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

উদ্দেশ্যহীন ভাবে গাড়ি চালাচ্ছে রূপক। ইচ্ছে করছে সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে। গতকাল বোনের অনুরোধে আবারো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। সেই আবারো ফিরিয়ে দিল রাহা। মেয়েটার কিসের এতো দেমাগ বুঝতে পারছে না রূপক। কি নেই তার মধ্যে? টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি আভিজাত্যের ছোঁয়ায় বড় হয়েছে সে। তারপরও ঐ মেয়ে কিভাবে পারে? না আর নয়, অনেক হয়েছে।

গতকাল বিকাল বেলা নজরাত যখন জিজ্ঞাসা করে রূপক আগে থেকেই রাহা কে চিনতো কিনা তখন রূপক বোনের কাছে কিচ্ছু লুকায় না বলে দেয়।

ভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে শুধুমাত্র রাহা কে একপলক দেখার জন্য রূপক ভার্সিটিতে যেত। রাহা কে তাদের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে প্রথম দিন দেখে। সেই থেকেই পছন্দ করে রাহা কে। বিদেশে যাওয়া নিয়ে কিছু দিন ভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি তার। বিদেশে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত করে, যেদিন ভার্সিটিতে যায় সেদিন রাহা নিজ থেকেই রূপক কে প্রপোজ করে। রাহা ও যেহেতু রূপক কে পছন্দ করে তাই রূপক চেয়েছিল রাহা কে বিয়ে করে তবে বিদেশে যেতে। তারপর না হয় সব কিছু ঠিক করে রাহা কে ও তার কাছে ইতালি নিয়ে যাবে। কিন্তু রাহা সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছিল সেদিন। রূপক সেদিন সারারাত জেগে রাস্তায় হেঁটেছিল। মাঝে মাঝে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসতো। তারপর রাহার সাথে একপ্রকার রা’গ নিয়েই বিদেশে চলে যায় রূপক।
_______

সাজ্জাদ হোসেন বিদায় নিয়ে চলে গেলে নজরাত থেকে যায় এ বাসায়।
দুপুরে খাবার খাওয়ার সময় নজরাত রাহা কে ডাকতে গেলে তার রুমের দরজা বন্ধ দেখতে পায়। বার কয়েক করাঘাত করেও রাহার কোন সাড়া শব্দ পায়নি।
সাজেদা চৌধুরী মেডিসিন নেওয়ার তাগিদে খেতে বসেন ঠিকই কিন্তু খাবার তার গলা দিয়ে নামে না। খাবার টেবিলে বসেও চোখের পানি ফেলে বলেন,
—” ছেলে মেয়ে দুটোকে মানুষের মত মানুষ গড়ে তুলতে পারলাম না আমি, হায় আফসোস।
নজরাত কি বলে শান্তনা দিবে ভাষা খুঁজে পায় না।

রাতের বেলা রাদ শাহমাত অফিস থেকে ফিরলে মণি সব কিছু খুলে বলে কি কি হয়েছে। সব কিছু শুনে থম মেরে বসে থাকে রাদ। রাদ জানতো রাহা কাউকে পছন্দ করে, কিন্তু নজরাত এর ভাই যে সে ব্যক্তি তা জানতো না। রাদ বোনের রুমের দরজায় কড়াঘাত করে বিকারগ্রস্তের মতো ডাকল,
—” বোন দরজা খুল প্লিজ? বোন আমার ভাইয়ার কথা শুনবি না? জানিস অফিসে আজকে প্রচুর পরিমাণে কাজ ছিল। খুব ক্লান্ত লাগছে, দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছি না। তুই যদি দরজা না খুলিস তবে এমনি করে দাঁড়িয়ে থাকবো আমি। সে যত‌ই কষ্ট হোক না কেন।

প্রায় পনেরো মিনিট এভাবেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে রাদ। আবার একটু চেষ্টা চালিয়ে বলে,
—” আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বোন। কখন যেন পরে যাই আমি। তখন কিন্তু কেঁদে কেটে ভাসাতে পারবি না।
বলতে বলতে রাহা দরজা খুলে দিল।
রাদ বোনকে দেখতে পেয়ে আহত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। একদিনে মেয়েটাকে কেমন দেখতে লাগছে। এলোচুলে, মুখ ফুলে আছে। চোখের কোলে জলের সুস্পষ্ট গাদ।কাজল লেপটে আছে মুখময়। স্তব্ধ ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করেছে বেশ বুঝা যাচ্ছে। রাদ আহত কন্ঠে বলল,
—” বোন কি হয়েছে ভাইয়া কে বলবি না?
রাহা ভাঙা গলায় বলল,
—” ভিতরে এসো?
রাদ কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে বিছানায় গিয়ে ধপ করে বসে। রাহা ফ্লোরে বসে রাদ এর হাঁটুতে মাথা রেখে বলে,
—” আমার আর বাঁচ’তে ইচ্ছে করছে না ভাইয়া! এতো কষ্ট আমি আর নিতে পারছি না। প্রায় চার বছরের মতো এই কষ্ট ভয়ে বেরাতে হচ্ছে আমাকে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না ভাইয়া। আমি মুক্তি চাই ভাইয়া, আমাকে মুক্তি দাও প্লিজ।

বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো রাহা। ঘর জুড়ে সেই কান্নার প্রতিধ্বনি হতে থাকলো। বোনের কষ্ট সহ্য করতে পারে না রাদ। চোখ দুটো রক্তিম হয়ে উঠে। বোনের গাল দুটো আঁকড়ে ধরে বলল,
—” বল না কি হয়েছে? তোর কান্না গুলো আমি সহ্য করতে পারছি না বোন।
—” যাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি সে নজরাত ভাবীমণির ভাই রূপক হোসাইন।
ভীষণ চমকায় রাদ। বোনের বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ কিছু টা হলেও আন্দাজ করতে পারছে যেন।রাহা আবারো বলে,
—” সেদিন আমার অবুঝ, বিবেক বুদ্ধি ছিল না বলে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, বিয়ে করবো না বলেছিলেন। কিন্তু আজকেও যে আমি ভাগ্য দোষে তাকে আপন করে নিতে পারলাম না ভাইয়া।
এই বলে আবারো হুহু করে কেঁদে উঠলো রাহা। রাদ নির্বিকার মুখে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। রাহা আবারো হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,
—” যার বোন আমার ভাইয়ার সাথে ভালো নেই, তার সাথে আমি কি করে সুখী হওয়ার স্বপ্ন দেখবো ভাইয়া? যদি সে জানতে পারে তার বোনের সাথে আমি খারাপ ব্যবহার করেছি তখন কি সে আমাকে মাফ করবে? করবে না ভাইয়া, হয়তো তুমি হলেও করতে না। আমি আর সহ্য করতে পারছি না ভাইয়া। আর পারছিনা না। আমি মর’তে চাই, মর’তে চাই।
_________

সকাল বেলা রাদ তখন অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল তখন নজরাত বিছানা গুছাতে গুছাতে বলল,
—” আপনি একটু রাহা কে বোঝাবেন? ও কেন ভাইয়া কে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না? অথচ ওরা কিন্তু দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে।
শেষের কথাটায় আশ্চার্যো হলো রাদ। জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বলল,
—” আপনার ভাই রাহা কে চিনতো আগে থেকেই?
—” হুম। তাই তো আমিই মায়ের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলাম। কিন্তু রাহা..
—” আমি তো আপনাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেইনি। তবুও কেন চাইছেন বিয়েটা হোক?
নজরাত ক্ষীণ একটু হেসে বলল,
—” ভাগ্য আমার সহায় নয় তাই আমি সুখী হতে পারিনি। তাই বলে কি অন্য কারো সুখ চাইবো না? নাকি অন্য কারো সুখী হ‌ওয়াতে আমি জেলাস হবো? জানেন তো নিজে সুখী হতে না পারলেও অন্যকে সুখী দেখতেও শান্তি। তাছাড়া ভাইয়া যেমন আমার ভাইয়া তেমনি রাহা ও আমার বোনের মতো। তাই দুজনে ভালো থাকলে আমি শান্তি।
—” আপনার ভাই যখন আমাদের কথা জানতে পারবে তখন আমার বোনকে মেনে নিবে?
—” আমাদের কথা জানাতে যাচ্ছে কে?
—” হাহ হাসালেন আপনি। এমন একটা ব্যাপার জানবে না বলছেন?

নজরাত কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করছে রাদ কথায় কথায় অন্যমনস্ক হ‌ওয়ার কারণে টাই টা সেট করতে পারছে না। যা দেখে নজরাত এগিয়ে এসে টাই বেঁধে দিতে দিতে একটু দাপটের সঙ্গেই বলল,
—” ও আমার ভাইয়া। অন্য কারো ক্ষোভ প্রকাশ করতে নিজের স্ত্রীর উপর অত্যাচার করবে তেমন ছেলে আমার ভাইয়া নয়। আমরা সেই শিক্ষা পেয়ে বড় হয়নি।এটা মাথায় রাখবেন।
টাই বাঁধা হয়ে গেলে নজরাত রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়। রাদ কে কিছু বলার সুযোগ দেয় না। রাদ সেই দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিচে নেমে এলো। মণি ব্রেকফাস্ট করে যেতে বললে রাদ খাবে না বলে চলে গেল। এমন ঘুমট পরিবেশে তার খেতে ইচ্ছে করছে না কিছুতেই। তাছাড়া তার আদরের বোনটা গতকাল থেকে না খেয়ে আছে। এর পরেও সে একা খেতে পারবে না।
নজরাত তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেও না খেয়ে লাইব্রেরী কক্ষে চলে যায়। ঘন্টা খানেক পর মনে হলো রাহার কাছে যাওয়া উচিৎ মেয়েটা গতকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি। যেই কথা, সেই কাজ, রাহা রুমের দরজায় কড়াঘাত করতে দেখলো দরজা বেজিয়ে রাখা। তাই খুলে ভিতরে গেল। রাহা বিছানার মাঝখানে গুটিয়ে বসে আছে। নজরাত পাশে ছোট কেবিনেটের উপর খাবার প্লেট রেখে রাহার পাশে বসে ডাকল,
—” রাহা খিদে পেয়েছে নিশ্চ‌ই ? খাবার টা খেয়ে নাও।
রাহা ক্লান্ত, তবু শান্ত স্বরেই বলল,
—” আমি আর বাঁচ’তে চাই না ভাবীমণি!….

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।