তোমার প্রেমের ছোঁয়ায় পর্ব-১৬+১৭

0
598

#তোমার_প্রেমের_ছোঁয়ায়💜
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি💜
#পার্টঃ১৬
প্রিয়জনকে হারানোর ব্যাথা যে কতোটা যন্ত্রনা কাতর তা শুধু যে এই ব্যাথায় ব্যাথিত সেই বুজতে পারে।তীব্র একটা ভোঁতা যন্ত্রনা হৃদয়টাকে ক্রমাগত ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়।মনে হয় ইসস,মরে কেন যাচ্ছি না।এতো কষ্ট তো সইবার নয়।
ওপারেশন থিয়াটারের সামনে বসে আছে আদিয়াত।বিধস্ত্ব দেখাচ্ছে তাকে।ভীতরে আহি’র চিকিৎসা চলছে।সোহেবই চিকিৎসা করছে আহি’র।সোহেব বলেছে অবস্থা অনেক খারাপ।
এরই মাঝে উপস্থিত হলো এশা,রোজা,জিহাদ। সোহেবই তাদের ফোন করে আসতে বলেছে।কারন আদিয়াতের অবস্থা ভালো না ওকে সামলানোর জন্যে কাউকে প্রয়োজন।এশা আবার ফোন করে সেহরা জাহান,হাসান আহমেদ আর সিয়াকেও জানিয়ে দিয়েছেন তারাও আসছেন।এশা এসেই আদিয়াতের কাধে হাত রাখলো।ধীর গলায় বলে,

” আদি টেন্সন করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আদিয়াত কিছুই বললো না।একধ্যানে শুধু ও.টির দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।
সবাই এটা ওটা বলছে আদিয়াতকে কিন্তু তার কোন নড়াচড়া নেই।এরই মাঝে উপস্থিত হলো সেহরা জাহান,হাসান আহমেদ,আর সিয়া।সেহরা জাহান এসেই কান্না জড়িত গলায় বলেন,

” আমার ছেলে কোথায়?ও ঠিক আছে তো?”

সিয়া কান্নাচোখেও বিরক্তি নিয়ে তাকায় মায়ের দিক।শুনেছে আহি আপু’র চিকিৎসা চলছে।তার কথাটা অন্তত আগে জিজ্ঞেস করার দরকার ছিলো।আহি মাঝে মাঝে নিজের মা’কে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়।
আদিয়াতের পাশে রাখা বেঞ্চে আহি’র ব্যাগ থেকে ক্রমাগত ফোনের রিংটোনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।কিন্তু আদিয়াতের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই।
সিয়া নিজেই এগিয়ে গিয়ে ব্যাগ খুলে ফোন বের করে দেখে নিহান নামের কারো কাছ থেকে ছাব্বিশটা কল এসেছে।মুহূর্তেই আবারো ফোন বেজে উঠলো।সিয়া কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করলো।ফোন রিসিভ করতেই নিহানের অস্থির গলা শোনা গেলো,

” আহি! বোন আমার! তুই ঠিক আছিস? এতো করে কল দিলাম।তুই রিসিভ করছিস না কেন?”

সিয়া এক ঢোক গিললো।কাঁপা গলায় বললো,

” আমি আহি আপু না।”

নিহান বললো,

” তাহলে তুমি কে?”

সিয়া নিজেকে শান্ত করলো।নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে উত্তর দিলো,

” আমি আহি আপুর মামাতো বোন।”

মুহূর্তেই কথাটা শুনে নিহান থমকে গেলো।আহি’র মামাতো বোন মানে?মানে আদিয়াতের বোন?কিন্তু তার কাছে আহি’র ফোন কি করছে?আবার! আবারও তারা আহি’র সাথে কিছু উলটা পালটা করবে না তো?নিহানের রাগে চোখ লাল হয়ে এলো।শক্ত কন্ঠে বললো,

” তোমার কাছে আহি’র ফোন কি করে এলো?আর! আর আমার বোন কোথায়?”

সিয়া এইবার আর কান্না আটকাতে পারলো না শুধু বললো,

” আহি আপুর অবস্থা ভালো না।আপনি জলদি ****** হাস্পাতালে এসে পরেন।”

সিয়া তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিলো।
তারপর ভাইয়ের দিকে তাকালো।আদিয়াতকে এরকম সে কখনো দেখেনি।কেমন শান্ত হয়ে আছে।কিন্তু চোখ মুখ লাল তার।সেহরা জাহান ছেলেকে নানান কথা জিজ্ঞেস করছেন,

” বাবা! তোর কি হয়েছে?কথা বল বাবা।তুই ঠিক আছিস বলছিস না কেন?”

হাসান আহমেদ স্ত্রী’র কান্ডে বিরক্ত।যেখানে একটা মেয়ে বাঁচা মরা নিয়ে লড়াই করছে।সেখানে তিনি দেখছেন আদিয়াত সুস্থ্য আছে তাও এরকম শুরু করেছেন।হাসান আহমেদ ধমকে উঠেন,

” সেহরা! কি শুরু করলে তুমি?যে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে তার খোঁজ না নিয়ে।তুমি দেখছো আদিয়াত ঠিক আছে।তাও এই কথা জিজ্ঞেস করছো?একটু তো দয়া মায়া রাখো। এতোটা স্বার্থপর কি করে হয়ে গেলে তুমি?”

সেহরা জাহান আর হাসান আহমেদের কথার পরিপেক্ষিতে কিছু বলতে পারলেন না।মাথা নিচু করে বসে আছেন।
কিছুক্ষনের মাঝে এসে হাজির হয় আদিয়াত।এসেই পাগলের মতো জিজ্ঞেস করে,

” আমার বোন কোথায়?কেমন আছে ও?”

সিয়া তাকাতেই থমকে গেলো এটা তো সেদিনের সেই লোকটা।তবে এটাই কি আহি আপুর ভাই।সিয়া এগিয়ে গেলো নিহানের দিকে।বললো,

” আহি আপুর চিকিৎসা চলছে আপনি প্লিজ শান্ত হয়ে বসুন।কিচ্ছু হবে না আহি আপুর।সে একদম ঠিক হয়ে ফিরে আসবে।”

নিহান চোখ তুলে তাকালো।আরে এটা তো সেদিনের সেই মেয়েটা।যে দিনরাত নিহানকে ঘুমোতে দেয় না।দেখা হওয়ার পর থেকে নিহানের সর্বস্ব জুড়ে বিচরণ করছে।
নিহান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো সিয়ার দিকে।তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে,

” আহি কোথায়?ওর কি হয়েছে?ডাক্তার কি বলেছে?”

সিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,

” ডাক্তার এখনো বের হয়নি।কিন্তু বলেছেন আহি আপুর অবস্থা বেশি ভালো না।”

দেখা গেলো ও.টি থেকে সোহেব বের হয়েছে।আদিয়াত দ্রুত উঠে দাড়ালো।সোহেবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” আহিয়ানা?আহিয়ানা ক..কেমন আছে? আ..আমার আ..আহিয়ানা?”

সোহেব মাথা নিচু করে নিলো।তা দেখে আদিয়াত এইবার রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললো,

” বলছিস না কেন?আমার আহি কেমন আছে?”

নিহানও এগিয়ে আসলো।আদিয়াতের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিহান নিজেই সোহেবকে জিজ্ঞেস করে,

” আহি’র কি হয়েছে?আমার বোনটা ঠিক আছে তো?”

সোহেব শ্বাস নিলো লম্বা করে। তারপর বলে,

” আহি’র অবস্থা খুব একটা ভালো না।ওর মাথায় অতিরিক্ত প্রেসার পরার কারনে এই অবস্থা।আর ও মনে হয় খালি পেটে ওভার ডোজের মেডিসিন খেয়ে নিয়েছিলো।যার কারনে তা উলটো একশন করে। হয়েছে কি?আহি মাত্রা অতিরিক্ত মানসিক চাপের মাঝে ছিলো।মানসিক চাপের কারণে মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক বস্তু বা নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য নষ্ট হয়, অন্তঃক্ষরা বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হরমোনের ঘাটতি-বাড়তি হয় এবং এসবের প্রভাবে হৃদ্যন্ত্রের সংকোচন-প্রসারণের হার পরিবর্তিত হয়, নিশ্বাস-প্রশ্বাস হয় অস্বাভাবিক।আর ভুলভাবে মেডিসিন নেওয়ার কারনে ওর নাক মুখ দিয়ে রক্তও বের হয়েছে।”

আদিয়াত সবকিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়।নিজের কানকে সে এইসব কথাগুলো কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না সে।তার আহিটা এতোটা কষ্ট কেন পাচ্ছে?কি দোষ তার ভালোবাসার?আদিয়াত তো এইসব চায়নি।আদিয়াত কাঁপা গলায় বললো,

” আমার আহিয়ানা ঠিক হয়ে যাবে তো সোহেব?”

সোহেব কি বলবে।কি বলে নিজের বন্ধুকে শান্তনা দিবে তা জানা নেই ওর।আরো একটা কথা বলার আছে কিন্তু কিভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছে না ও।এদিকে আদিয়াত পাগলের মতো ছটফট করছে।বার বার জিজ্ঞেস করছে তার আহিয়ানা ঠিক হয়ে যাবে তো?নিহানের চোখ দিয়ে পানি পরছে।নিজের ছোট্ট বোনটার এতো কষ্ট ও কিছুতেই সয্য করতে পারছে না।এদিকে এশা শুধু দেখে চলেছে আদিয়াতকে। আদিয়াত ঠিক কতোটা ভালোবাসে আহি’কে।যার কারনে সে এমন পাগলামি করছে।এশা ধুকড়ে কেঁদে উঠে।নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য একজনকে ভালোবেসে এতোটা ছটফট করতে দেখা যে বড্ড যন্ত্রনার।এশা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।সে সরে যাবে আদিয়াত আর আহি’র মাঝ থেকে।তার অব্যক্ত কথাগুলো নাহয় লুকিয়েই থাকুক।তার ভালোবাসাটা আদিয়াতের অজানাই থাকুক।সে নাহয় দূর থেকেই আদিয়াতকে ভালোবেসে যাবে চিরকাল।
নিহান চিৎকার করে বললো,

” আমার বোনকে যে করেই হোক ঠিক করে দিতে হবে ডাক্তার।নাহলে সব শেষ করে দিবো।”

সোহেব বিষন্ন গলায় বলে,

” দেখুন। আহি’র অবস্থা অনেকটা ক্রিটিকাল।আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছি।
আর আহি’র সমস্যা মারাত্মক হওয়ার কারন আহি প্রচুর পরিমানে মদ্যপান করতো।যার কারনে সমস্যাটা এতোটা জটিল।
এ্যালকোহল পান করলে মানুষের রক্তচাপ ও রক্তের কোলেস্টেরল বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করে যে রক্তনালী – সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যার ফলে স্মৃতি লোপ পেতে পারে।
এতে ডেমেনশিয়ার ঝুঁকি তিন গুণ বেড়ে যায় বলে ফ্রান্সের একটি সাম্প্রতিক জরিপে বলা হয়। আরেকটি জরিপে বলা হয়, প্রতি সপ্তাহে ১৮ ইউনিটের বেশি যারা পান করেন তাদের আয়ু চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
আহি’র সমস্যাটা এই কারনেই এতোটা কঠিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ”

আদিয়াত সবটা শুনে উঠে দাড়ালো।সোহেবের দুহাত আকড়ে ধরে বলে,

” ভাই। আমার আহিকে ঠিক করে দে না।আমি বাঁচবো না ওকে ছাড়া।পাঁচটা বছর ওকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি।যাতে ও ভালো থাকে।কিন্তু আমার আহিয়ানা যে ভালো ছিলো না।এইসব জানলে আমি কখনই ওকে রেখে যেতাম না।প্লিজ আমার হৃদয়টাকে ঠিক করে দে।
দেখনা আমার না কষ্ট হচ্ছে। ভীষন কষ্ট।এই বুকটায় জ্বালা পোড়া করছে।দেখ আমি ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছি না।ঠিক করে দে না আমার আহিয়ানাকে।ফিরিয়ে দে ওকে।”

সোহেব নিজের বন্ধুর এমন করূন দশা দেখে ওর কান্না পাচ্ছে।তাও নিজেকে সামলে নিলো।এখন ওকে ভেংগে পড়লে চলবে না।আহিকে সুস্থ্য করতে হবে। যে করেই হোক।সোহেব নিহানকে জিজ্ঞেস করলো,

” আহি’র কি আগে কোন বড় ধরনের এক্সিডেন্ট হয়েছিলো?”

নিহান ধরা গলায় জবাব দিলো,

” হ্যা! পাঁচবছর আগে ওর অনেক বড় একটা রোড এক্সিডেন্ট হয়।এতে ও মাথায় প্রচুর আঘাত পায়।ডাক্তার এর পর থেকে বার বার সতর্ক করে দেয় যাতে ওকে বেশি প্রেসার না দেওয়া হয়।এতে ওর মাথায় রক্তজমাট বেধে ও মারা যেতে পারে।”

আদিয়াত একের পর এক ঘটনা শুনে যাচ্ছে।ওর আগোচড়ে কতো কি হলো। অথচ আদিয়াত কিছু জানে না৷ কিচ্ছুটি না।আদিয়াত ভেবে নিলো।আজকেই নিহানের মুখ থেকে সব সত্য জানবে সে।ঠিক কি কি হয়েছিলো পাঁচ বছর আগে।আদিয়াত কান্না করতে করতে দেয়াল ঘেসে বসে পড়লো।ওর মন বলছে,

” আগে যদি জানতাম কোন একদিন তোর পথের কাটা হবো,, আমার জন্য তোর অনেক ক্ষতি হবে,, আসতাম না কখনও তোর জীবনে.. ভালবাসতাম না কখনও তোকে,, জড়াতাম না তোর জীবনে নিজেকে.. কি করবো..?? ভূল যখন করেছি মাশূল তো দিতে হবে,, চলে যাবো নীরবে তোর জীবন থেকে,, ভালো থাকিস তুই অন্য কাউকে নিয়ে।”

#চলবে______
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।

#তোমার_প্রেমের_ছোঁয়ায়💜
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি💜
#পার্টঃ১৭
আজ আদিয়াত এক এলোমেলো,বিধস্ত্ব প্রেমিকে রূপান্তরিত হয়েছে।মনের মাঝে শতো কষ্টগুলো চেপে ধরে আছে হৃদপিন্ডটা।নিজের প্রাণপাখিটার এরকম অবস্থা আজ আদিয়াত কিছুতেই সয্য করতে পারছে না।তবুও নিজেকে সামলাতে হবে আজ তার।সব সত্য জানতে হবে।ঠিক কি কি কারনে তার আহিয়ানার আজ এই অবস্থা।
আদিয়াত টলতে টলতে নিজের মায়ের কাছে আসলো।সেহরা জাহান তাকালেন ছেলের দিকে।নিজের ছেলের এই অবস্থা আজ তিনি মেনে নিতে পারছেন না।আদিয়াত বলে উঠে,

” মা! দ..দেখো না।সোহেব কিসব ব..বলছে।তুমিই বলো না। আমার আ..আহিয়ানার কিছু কি হতে পারে?আহিয়ানা তো জানে তাকে ছাড়া তার আ..আদিয়াতের কোন অস্থিত্ব নেই।তাহলে কেন সে এরকম করছে।”

সেহরা জাহান ঠুকড়ে কেঁদে উঠলেন।তার যা বুজার তিনি বুজে ফেলেছেন।আহিয়ানার কিছু হলে যে তার ছেলেকেও বাঁচানো সম্ভব না তা বেশ ভালোই বুজতে পেরেছেন তিনি।সেহরা জাহান ছেলের মাথায় হাত রাখলেন।বললেন,

” চিন্তা করিস না বাবা।আহি’র কিচ্ছু হবে না।ও ঠিক হয়ে যাবে।”

আদিয়াত হু হা করে হেসে উঠলো।সবাই অবাক দৃষ্টিতে এই পাগলাটে আদিয়াতকে দেখছে।আদিয়াত হাসি থামিয়ে এক ঝটকায় সেহরা জাহানের হাত সরিয়ে দিলো।উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বললো,

” তুমি সব মিথ্যে কথা বলো মা।সেদিন তুমি যদি আমায় মিথ্যে না বলতে তাহলে আজ আমার আহিয়ানার এই অবস্থা হতো না।কেন করলে মা?কেন করলে?”

সিয়া কাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

” কি?মিথ্যে বলেছিলো ভাইয়া?”

আদিয়াত দুহাতে মাথা চেপে ধরলো।নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা চালাতে লাগলো।রাগে থর থর করে কাঁপছে সে।যথসম্ভব স্বাভাবিক হয়ে বলে,

” আহিয়ানা আমাকে ছোট থেকেই ভালোবাসে।এটা তো সবাই জানিস তাই না?”

সিয়া মাথা দোলালো।অর্থাৎ সে জানে।আগে না বুজলেও এখন সব বুজে সিয়া।আদিয়াত আবারো বলে,

” আহিয়ানার পাগলামি গুলো দিন দিন বেড়ে চলেছিলো।ও লেখাপড়ার দিকে অমনোযোগী হয়ে পড়েছিলো।অবশ্য আমার সামনে বেশি আসতো না।কিন্তু আমার জন্যে নানান ধরনের খাবার বানিয়ে এশা বা রোজার হাতে আমাকে ক্যাম্পাসে দিয়ে আসতে বলা।আমার রুমে নানান রকম ভালোবাসা মাখানো চিঠি।আরো কতো কি?অবশ্য আমার ভালোই লাগতো ওর এই ছোট্ট মনে আমাকে নিয়ে টুকরো টুকরো ভালোবাসা।কিন্তু ও যতো বড় হতে লাগলো এইগুলোর মাত্রা আরো বেড়ে গেলো।ওর এইচ.এস.সি রেজাল্ট অনেক খারাপ হলো।তো সেদিন মা সেই সুযোগটা কাজে লাগায়।আমাকে বলে যে আমি যদি এখানে থাকি তাহলে আহিয়ানার স্টাডি আরো খারাপ হয়ে যাবে।রেজাল্ট ভালো না আসলে ওর ক্যারিয়ার ভালোভাবে গড়বে কি করে?আমিও ভাবলাম। আসলেই আমি এখানে থাকলে ও আরো পাগলামি করবে।ওর লেখাপড়া দিন দিন আরো খারাপ হবে।মা আমাকে বললো যেহেতু তখন আমার মাস্টার্স এক্সাম দেওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো। রেজাল্ট টাও বেশ ভালো এসেছিলো।মা আমাকে বললো এব্রোড চলে যেতে।আমিও ভাবলাম অনেক ভাবলাম।মনকে শক্ত করলাম।মা বলেছিলো আমি আসা পর্যন্ত সে আমার আহিয়ানার খেয়াল রাখবে।আমি আসলেই তার কিছুদিন পরেই না-কি আমার আর আহিয়ানার বিয়ে দিবেন।আমিও আমার মায়ের কথায় রাজি হয়ে গেলাম।বিশ্বাস করলাম নিজের মা’কে।সিদ্ধান্ত নিলাম চলে যাবো।পাঁচটা বছর কষ্ট করে যদি আমার আহিয়ানা’র ভবিষ্যত উজ্জ্বল হয়।আমরা সারাজীবনের জন্যে একে-অপরকে পেয়ে যাবো তাতে ক্ষতি কি?জানি অনেক কষ্ট হবে।কিন্তু কষ্ট করলেই তো মিষ্টি মিলবে।জানিস যেদিন আমি চলে যাবো।আমার কলিজাটা ছিরে যাচ্ছিলো।আহিয়ানা আমাকে ভালোবাসতো ঠিকই কিন্তু আমার সামনে আসতো না।এইযা এক বাড়িতে থাকলে হুট হাট একটু দেখা পাওয়া।নাহলে যেচে কখনোই আসতো না।সেই আহিয়ানা সেদিন আমার কাছে হাত জোড় করেছিলো। বার বার চিৎকার করে বলেছিলো ওকে ফেলে না যেতে।আমার পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলো।আমি শুনি নি সেদিন ওর হৃদয় ভাঙ্গা আর্তনাদ।মনের মাজে শক্ত পাথর রেখে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূরে।কিন্তু জানতাম না আমার মা আমার বিশ্বাস এভাবে ভেঙে দিবে।আমার আহিয়ানাকে আমার থেকে চিরতরে দূরে সরাবার জন্যে নিকৃষ্ট পরিকল্পনা করবে।”

আদিয়াতের চোখ দিয়ে অঝোড়ে অস্রু ঝড়ছে।নিহান নিজেও কাঁদছে।তাহলে আদিয়াতের কোন দোষ ছিলো না।সে তো আহির ভালোই চেয়েছিলো।মাঝথেকে এদের নিকৃষ্ট পরিকল্পনার স্বিকার হয়েছিলো।যার কারনে আজ কষ্ট পাচ্ছে আহিয়ানা। কষ্ট পাচ্ছে আদিয়াত।এদের এসব নিচু মনমানষিকতার জন্যে আহি’র মনে তৈরি হয়েছে আদিয়াতের জন্যে ঘৃনা।আদিয়াত ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো নিহানের দিকে।দুহাত জোড় করে বলে,

” তুমি আর আমি সববয়সই হবো।তাও আমি হাত জোর করে বলছি।প্লিজ বলো আহিয়ানার সাথে ঠিক কি কি হয়েছিলো।আমি জানতে চাই সব জানতে চাই।দয়া করে বলো।”

নিহান আদিয়াতের দুহাত ধরলো বললো,

” আমি বলবো সব বলবো।আমার আহিয়ানার ভালোর জন্যে আমাকে বলতেই হবে।আহিয়ানা আমাকে সব বলেছে।আমি তা সব আজ বলবো।”

নিহান শ্বাস ফেললো।আবার লম্বা করে শ্বাস টেনে নিয়ে বলতে শুরু করলো,

” তুমি চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই না-কি তোমার মা আমার বাবা মাকে ডেকে নিয়ে যায় তোমাদের বাড়ি।আহিকে আমার বাবা মার সাথে পাঠিয়ে দিবে তাই।আহি যেতে চায়নি।তোমার মা আহিকে নানান ভাবে অপমান করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।ওকে দুশ্চরিত্রা,চরিত্রহীন মেয়ে নানান কথা বলেছিলো।ওর বাবা, মা মানে আমার কাকাই আর কাকিমার নামেও বাজে বাজে কথা বলেছিলো।তাই আহি সহ্য করতে না পেরে আমার বাবা মার সাথে এসে পরে আমাদের বাসায়।বাট ওরা ওরই বাসা।ওর ঢাকাতে মোট তিনটা বাড়ি আছে,বিশাল বড় বড় দুটো কোম্পানির মালিক ও।কিন্তু ও জানতো না।কাকাই আর কাকিমা মারা যাবার পর সব ওর নামে হয়ে যায়।আমার বাবা মা তা জানতে পেরেই আহিকে নেওয়ার জন্যে আসে।কারন যদি আহিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সব সম্পত্তি তারা হাতিয়ে নিতে পারে সেই লোভে।আমি তো জানতামই না আমার কাকাই কাকিমা আছে।কারন তারা না-কি সিলেট থাকতেন। ওখানেও আহি’র বাড়ি আছে,ব্যবসা আছে।ঢাকারগুলো আমার বাবাকে দেখাশোনা করতে দিয়েছিলেন কাকাই।তো আহিয়ানাকে আমাদের বাড়িতে আনার পর তাকে মা নানানভাবে মানষিক অত্যাচার শুরু করে।কতোদিন আর এই বাড়িতে বসে খাবি,মামা মামির ঘাড়ে বসে খেতে খেতে এখন আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছিস।নানান কথা শোনাতো।কারন আহি তখন জানতো না যে এইসব কিছুর মালিক ও।আমার বাবা মা আহি’র বিয়ে ঠিক করে।যার সাথে বিয়ে ঠিক করে তার সাথে আমার বাবা মা প্লান করে যে আহিকে বিয়ে করলে এই সম্পত্তি আহিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে লিখে নিবে।যার ফোরটি পার্সেন্ট ওই লোকটা পাবে আর সিক্সটি পার্সেন্ট আমার বাবা, মা।আহিকে দিনরাত মানষিক অত্যাচার করতে শুরু করলো বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্যে।অবশেষে আহি এতো এতো অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রাজি হয়ে যায়।এমনিতেও ওর তোমার প্রতি অনেক অভিমান জমা ছিলো।সেই অভিমানের কারনে ও রাজি হয়ে যায়।ওর বিয়ের একদিন আগে আমি দেশে ফিরে আসি।আমি তো আর জানতাম না ওকে জোড় করে এখানে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।তাহলে সত্যি আমি সব আটকাতাম।ওকে এতোটা কষ্ট পেতে দিতাম না।আহি বিয়ে হয়ে যায়।জানো আহি সেদিন একটুও কাঁদিনি। শুরু রোবটের মতো ওকে যা যা বলে হয়েছিলো সব করে গেছে। ওকে বিদায় জানানো হয়।কিন্তু তার ঘন্টা দেড়েক পরেই খবর আসে আহি এক্সিডেন্ট হয়েছে।বিশাল বড় এক্সিডেন্ট।সেই এক্সিডেন্টে আহির হাজবেন্ট মারা যায়।আর আহি গুরুতর আহত হয়।ওর মাথায় অনেক আঘাত লাগে।ওকে আমি এব্রোডে নিয়ে যাই চিকিৎসা করতে।অবশেষে অনেক কষ্টে আমি আহিকে বাঁচাতে পারি।কিন্তু ডাক্তার বলে আহিকে যেন কোন কিছু নিয়ে প্রেসার না দেওয়া হয়।ওর যা মন চায় তাই যেন করতে দেওয়া হয়।যদি মাথায় বেশি প্রেসার পরে হয়তো ও সব ভুলে যাবে নাহয় ও আর বাঁচবে না।আমিও তাই আর জোড় করিনি।আহি অনেক চুপচাপ হয়ে যায়।সারাদিন নিজেকে ঘরবন্দি রাখতো।আমি ওকে জোড় করে খাওয়াতাম।ওর মনের কথা সব আমাকে বলতো।বলতে গেলে ও তখন শুধু আমার কাছেই আসতো।নাহলে আর কাউকে সহ্য করতে পারতো না।একদিন আহি ছাদে যাচ্ছিলো।সে সময় আবার বাবা আর মা তাদের ঘরে কথা বলছিলেন।তারা আহি আবারও বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন।সাথে সেই জঘন্য প্লানিং।আহি সব শুনে ফেলে।তারপর আমাকে সব বলে।আমি সেদিন রেগে গিয়ে তাদের কিছু বলতে গেলে আহি আমাকে থামিয়ে দেয়।বারন করে তাদের কিছু বলতে।আমিও আমার বোনটার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়ে যাই।কারন আমি কখনই ওকে কোন কিছু নিয়ে জোড় করি না।কি করবো বল বাবা মা যতোই খারাপ হোক। বাবা মা তো কি করে তাদের ফেলে দেই।তবুও আমি পুলিশে দিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আহি আমাকে না করে।এইভাবেই কেটে যায় একবছর আহি নিজেকে সম্পূর্ণ পালটে নেয়।ওকে ভার্সিটিতে ভর্তি করাই আমি।তারপর থেকেই সে উড়নচণ্ডী স্বভাবের হয়ে যায়।আমি জোরও করতে পারি না।বেশি কিছু বললেই ওর মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়।তাই আর জোড় করতাম না।ওর একটাই কথা অনেক ভালো হয়েই তো চলতো কিন্তু জীবন তাকে কষ্ট ছাড়া কিছুই দেয়নি।তাই এখন আর ভালো হয়ে কি করবে?খারাপ হয়েই চলবে সে।এইভাবেই চলতে থাকে ওর। ড্রিংক্স,মদ পান করা,ক্লাবে যাওয়া,পোষাকের পরিবর্তন,অশৃঙ্গখল চলাফেরা। এইভাবেই কেটে যায় চারটি বছর। আহি এখন মাস্টার্স ১ম বর্ষে।
ওদের এতো এতো অত্যাচারে আজ আহি এমন হয়ে গিয়েছে।আমি ওর জীবনে আগে আসলে এমনটা হতে দিতাম না আমার বোনটার সাথে।আমি কেন আগে আসলাম না ওর জীবনে।কেন আসলাম না?আমার বোনটা আজ মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।আর আমি ভাই হয়েও কিছু করতে পারছি না।ব্যর্থ আজ আমি।”

নিহান চিৎকার করে কাঁদছে।ওর কান্নায় শুধু বোনের জন্যে হাহাকার। আর আদিয়াতের কথা নাহয় পরেই বলি।

#চলবে__________

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।