#তোমার_মাদকতায়_আচ্ছন্ন
#তানজিলা_খাতুন_তানু
(পর্ব_৩৩) ( অন্তিম পর্ব )
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে সকলেই চমকে উঠলো।
– তুই এখানে কেন?
রাগী কন্ঠে বললো ফারাবি। সকলের দৃষ্টি মনিকার দিকেই।
– আমার কিছু কথা বলার ছিলো তোমাদের সাথে।( মনিকা)
– আমার কোনো কিছু শোনার নেয় তুই এখান থেকে চলে যা।
– দাঁড়াও।
তুহা এগিয়ে এসে মনিকা আর ফারাবির মাঝে দাঁড়ালো।
– আজকে একটা ভালো দিনে এসেছো। বলো মনিকা দি কি বলতে চাও।
– আমি জানি আমি অনেক অপরাধ করেছি তার জন্য আমি মাফ চাইবো না আমি জানি আমি যেটা করেছি সেটা ক্ষমার যোগ্য নয়। আজকে যেটা বলতে এসেছি সেটা হলো, আমি আমার কাজের শা**স্তি পেয়েছি আমি আর এই পৃথিবীতে বেশিদিন নে**য়।
– মানে?
মনিকা তুহার কথার জবাবে একটা রিপোর্ট এগিয়ে দিলো। তুহা সেটা দেখে চমকে উঠলো মনিকার ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে। তুহা রিপোর্টটা মনিকাকে ফেরত দিয়ে বললো..
– আমি ছাড় দিলেও উপর ওয়ালা ছাড় দেননি ,তুমি তোমার কাজের শাস্তি পাচ্ছো তবে আমার কোনো রাগ নেয় তোমার প্রতি এই কথাটা আজকে মন থেকে বলছি। সেইদিন এইসব না হলে আমি হয়তো কখনোই ফিহাকে পেতাম না।
– ফিহা কে?
– ফিহা মামনি এইদিকে আসো।
মায়ের ডাক শুনে ফিহা এগিয়ে যেতেই ফারাবি আটকে দেয়।
– না তুহা আমি কিছুতেই আমার মেয়েকে ওর সামনে যেতে দেবো না।
– তোমার মেয়ে মানে?
– হ্যা মনিকা দি ফিহা আমাদের মেয়ে। দোয়া করবে যাতে একজন মানুষের মতো মানুষ হতে পারে।
মনিকার চোখে অবাক চাহনি। কিভাবে এতকিছুর পরও হলো সেটা মনিকার বোধগম্য হলো না। তবে মনে মনে দোয়া করলো যাতে সুখী হয় ওরা।
– আমি আসছি।
মনিকা সকলকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। তুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিহাকে নিয়ে কেক কা*ট*তে গেলো।
তুহা আর ফারাবির বিবাহবার্ষিকী খুব সুন্দর ভাবেই শেষ হয়ে যায়। ওদের কাউকেই বাড়ি যেতে দেয়নি সকলেই চৌধুরী বাড়িতেই আছে।
• তিশা ছেলের পাশে শুয়ে আছে,অয়ন শুতে শুতে বললো…
– দেখতে দেখতে কতগুলো দিন কেটে গেলো একসাথে বলো।
– হুম,সময় কীভাবে যে কেটে যায় বোঝায় যায় না। কিছুদিন পর ছেলে বড়ো হবে বিয়ে হবে সংসার হবে আর আমরা বৃদ্ধ হয়ে যাবো।
– তবুও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা একটুও কমবে না।
– হুম।
• কুহু আর আতিফের ছেলেটা প্রচন্ড রকমের কান্নাকাটি করছে,কুহু একা সামলাতে পারছে না। আতিফ কোথা থেকে এসে বললো..
– আমাকে দাও আমি দেখছি।
– আমিই সামলাতে পারছি না আর তুমি।
– বেশি না বকে দাও তো।
আতিফ ওদের ছেলেকে কোলে তুলে নিতেই সে চুপ করে গেলো।কুহু চোখ ছোট ছোট করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে,বোঝার চেষ্টা করছে কি হলো আসলে। আতিফ ঠোঁট চেপে বললো…
– এই তুমি কি ওকে চিমটি কাটছিলে নাকি কাঁদছিল কেন আমার ছেলে।
– কি বললে তুমি।
– ঠিক বলেছি, আর্ কি যেন বলেছিলে আমি সামলাতে পারছি না আর তুমি,আচ্ছা তুমি কি ভুলে যাচ্ছো ছেলেরা মাকে সামলে নিলাম আর ওহ তো বাচ্চা ছেলে।
– অ**স**ভ্য একটা।
– শুধু তোমার জন্য কোকিল কন্ঠী।
– হুঁ।
কুহুকে একহাতে জড়িয়ে নিলো আতিফ। কুহু আতিফের বুকের এক সাইডে মাথা রাখলো এটাই তার আশ্রয়স্থল, শান্তির জায়গা।
• খুশি ওদের ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। কাব্য এসে বললো…
– কি করছো।
– ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
খুশি কাব্যের দিকে তাকিয়ে বললো…
– ঘুমাবে না।
– ঘুম আসছে না, শান্তি লাগছে খুব।
– কেন?
– তুহা আর দাভাই- এর ভালোবাসা আমাকে বারবার মুগ্ধ করে জানো। ওদের বন্ডিংটা অসাধারণ।
– সত্যি পারফেক্ট জুটি ওদের।
– আমরাও কিন্তু কম নয়।
– তবে ওদের মতোই নয়।
দুজনেই হেসে দিলো নিজেদেরই কথা শুনে। খুশিকে জড়িয়ে ধরলো কাব্য।
– আমি আমার বউটাকে ভালোবাসি।
– আমিও আমার বরটাকে ভালোবাসি খুব।
• মিহা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে,চোখ দিয়ে পানি পড়ছে চেষ্টা করেও আটকাতে পারছে না। এতদিন দূরে থেকে নিজেকে সামলে রেখেছিলো কিন্তু এখন কিভাবে সামলে রাখবে নিজেকে। মিহার কানে একটা মৃদু কন্ঠ স্বর ভেসে আসলো…
– মিহা।
মিহা নিজের চোখের পানিটা মুছে সামনে ঘুরতেই কারোর বুকের সাথে ধাক্কা লাগলো,মিহা মৃদু চিৎকার করে উঠলো আহ।
– কোথায় লাগলো দেখি,খুব জোরে কি লেগেছে।
মিহ সামনে তাকিয়ে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। মেহতাব ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই হাত পা কাপতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। মেহতাব ওকে ধাক্কা দিয়ে বললো..
– এই মিহা কি হয়েছে বলো।
– কিছু না। আপনি এখানে কেন?
– আপনি!
– অচেনা কাউকে তো আপনিই বলতে হয় তাই না।
– আমি তোমার অচেনা।
– জ্বি।
মিহা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গেলেই মেহতাব ওর হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো।
– কোথায় যাচ্ছো।
– ছাড়ুন আমাকে আমি নীচে যাবো।
– আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
– কি বলুন।
– আমি তোমার অচেনা মিহা (করুন কন্ঠ)
– অচেনা নয় তো কি নাহলে কি এতগুলো দিন এইভাবে আড়ালে থাকতেন, কষ্ট দিতেন।
নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো মিহা।
– আমাকে কি মাফ করা যায় না।
মিহা আকাশ থেকে পড়লো।
– কি বলছেন এসব।
– ঠিক বলছি আমি আমি তোমাকে চাই মিহা আমার কিছু লাগবে না। আমাকে মাফ করে দাও আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না এই তিন বছরে আমি বুঝেছি তুমি আমার জন্য ঠিক কতটা দামী।
মিহার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মেহতাব ওর চোখের পানিটা মুছে দিয়ে বললো…
– কেঁদে না আর,এতদিন আমার জন্য অনেক চোখের পানি ফেলেছো,এখন থেকে আর নয়। তোমাকে আগলে রাখার দায়িত্ব নেবো আমি। তোমার ভালো থাকার কারন হতে চাই খারাপ থাকার নয়।
মিহা কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলো মেহতাব কে। মেহতাবের চোখেও পানি চিকচিক করছে।
– ভালোবাসি মিহা।
– আমিও। কখনো ছেড়ে যাবে না তো।
– কখনোই না।
মিহা আর মেহতাবের ভালোবাসা পূর্নতা পেলো। কষ্টের অবসান ঘটলো মিহার। ভালো থাকুক ভালোবাসারা।
• মেধা আর আশিক ছাদে আসছিলো তখনি মিহা আর মেহতাবের সমস্ত কথা শুনেছে। মেধার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। ওরা আর ছাদে না গিয়ে ঘরে ফিরে গেলো।
– ওই শোনো না তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে।
– কী বলো।
মেধা কিছু না বলে আশিকের হাতটা নিয়ে নিজের পেটে রাখলো। আশিক প্রথমে কিছু না বুঝলেও পরে বুঝতে পেরে বলল…
– এটা কী সত্যি।
– হুম।
– আমি আজকে কি খুশি আমি বোঝাতে পারবো না তোমাকে।
– আমিও।
মেধা আশিকের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।
• তুহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে,কারনটা নিজেরই অজানা। ফারাবি ওর কাঁধে হাত রাখতেই চোখের পানিটা মোছার চেষ্টা করলো।
– পানি মুছে দিলেই কী আমার চোখ এড়িয়ে যেতে পারবে তাহু পাখি।
তুহা কিছু বললো না। ফারাবি নিজের দিকে ওকে ঘুরিয়ে বললো…
– কি হয়েছে কাঁদছো কেন?
– আজকে আমার না অনেকটাই হালকা লাগছে জানো,সবকিছু কিরকম একটা পরিপূর্ণ লাগছে।
– কেন?
– আমার জন্যই মিহার জীবনটা থেমে ছিলো ..
– না তুহা তুমি ভুল ভাবছো মিহার জীবনটা তোমার জন্য থেমে ছিলো না বরং তোমার জন্যই মিহা নিজেকে সামলাতে পেরেছে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে।
– কিন্তু এটা তো অস্বীকার করতে পারবো না, মেহতাব দা মিহাকে একসেপ্ট করেনি আমার জন্যই।
– দ্যাখো ভালোবাসার উপরে তো কারোরই হাত থাকে না,এইগুলো তো মন থেকে আসে। মিহাকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিতে মেহতাবের সময় লেগেছে এটাতে তোমার কোনো দোষ নেয় তাই নিজেকে দোষারোপ করা বন্ধ করো।
– হুম। মনিকাও ওর পাপের শা**স্তি পেয়েছে।(বলেই তাচ্ছিল্যের হাসলো তুহা)
ফারাবি নিজের দিকে ওকে ঘুরিয়ে বললো..
– তুহা তুমি কি ফিহাকে নিয়ে খুশি নয়!
তুহা অবাক হয়ে গেলো ফারাবির কথা শুনে..
– পাগল হয়ে গেছো তুমি কি সব বলছো, ফিহা আমার প্রান। ওকে নিয়েই তো বে**চে আছি আর তুমি এসব কি করে বললে।
– আমি জানি তুহা ফিহা তোমার জন্য কী। তবুও আমি চাই না ফিহাকে নিয়ে তোমার মনে কোনো দোটানা থাকুক। ফিহা আমার কাছে একজনের আমানত,সেই আমানত রক্ষা করা আমার কর্তব্য আমি ডক্টরকে কথা দিয়েছিলাম…
ফারাবি অতীতে ফিরে গেলো..
– আপনার ওয়াইফ কোথায় ডক্টর।
– সন্তান না থাকার কারনে অনেকের ঘর ভাঙে আর এই সন্তানকেই পৃথিবীতে আনতে গিয়েই আমার পৃথা আমাকে ছেড়ে চলে যায়।
ফারাবি ডক্টরের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। কিন্তু ওকে এসব বলার মানে কী সেটাই বুঝতে পারছে না।
– আমি জানি আপনার মনে প্রশ্ন আছে, কেন আমি এসব বলছি। আসল কারনটা হলো,, আমি একজন ডক্টর আমি জানি আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে তাই আমি আমার অনাথ মেয়েটাকে আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। আমি চাই আমার মেয়েটা একটা পরিবার পাক, একটা সুন্দর জীবন পাক আপনি কি আমার মেয়ের দায়িত্ব নেবেন।
ফারাবি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তখনি দরজা ঠেলে একজন নার্স একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে আসলো। ধবধবে ফর্সা মেয়ে,জানো একটা পুতুল।
– আমার মেয়ের দায়িত্ব কী নেবেন মিস্টার চৌধুরী (আকুতি ভরা কন্ঠে)
ফারাবি ওই নিস্পাপ শিশুটাকে উপেক্ষা করতে পারলো না। আদরে জড়িয়ে নিলো বাচ্চাটিকে।
– আজ থেকে ওহ আপনাদের মেয়ে। কখনোই কষ্ট দেবেন না মেয়েটাকে।
ফারাবি ডক্টরকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওনার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। ডক্টর ডাকার আগেই উনি ফাঁকি দিয়ে চলে যান।
বর্তমান…
ফারাবি আর তুহার চোখে পানি। সেদিন ডক্টরকে কিছুই বলতে পারেনি ফারাবি কিন্তু মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলো আগলে রাখবে ফিহাকে। যখন ওই ছোট শিশুটাকে তুহার কোলে দিয়েছিলো তুহা আনন্দে কেঁদে দিয়েছিলো সকলেই নতুন সদস্য কে পেয়ে খুশি ছিলো কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি।
– উপর ওয়ালা আমার মাতৃত্ব হবার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলো কিন্তু তার বদলে ফিহাকে দিয়েছে। ফিহাই আমার প্রানভোমড়া।
তখনি ফিহা বিছানা ছেড়ে উঠে এসে ওদের কাছে দাঁড়ালো।
– কি হয়েছে পাপা,মা তোমরা কাঁদছো কেন?
– কিছুই হয়নি মা, তুমি উঠে পড়লে কেন?(তুহা)
– তোমাদের ছাড়া আমার ঘুম আসছে না। চলো আমার সাথে ঘুমাবে।
ফারাবি আর তুহা ফিহার কথামতো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো,ফিহা মাঝখানে আর দুইদিকে দূইজন। ফিহা ফারাবির একটা আঙুল আর তুহার একটু আঙুল ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে। এটা দেখে ফারাবি মুচকি হাসলো,তুহাও ঘুমিয়ে পড়েছে। ফারাবি উঠে মা-মেয়ের মাথায় ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো। আর বিরবির করে বললো…
– আমি **তোমার মাদকতায় আচ্ছন্ন**তাহু পাখি,আর ফিহা মামনির মায়ায় আবদ্ধ তাই তোমাদের ছাড়া আমি অপূর্ন।
✿__#সমাপ্ত __✿