#তোর_আসক্তি_পাগল_করেছে_আমায়
#সিজন_০২
#সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
৪৩.
সকাল সকাল রওশন বাড়ির লিভিং রুমে এক প্রকার চাঁদের হাট বসেছে ওম বেদ নিশান শান্তা সারা জাকিয়া রুহি সারিফ সবাই একসাথে আছে তবে সারিফ ছাড়া বাকি সাতজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হেসে যাচ্ছে, সামাদ সাহেব ওদের সাথে বসেছেন তাই কোনো কথা বলতে পারছেন না। ওদের থেকে একটু দূরে বসে আছে দিশা মুখ হাড়ি করে তার মুখ দেখে যে কেউ বলতে পারবে কেউ তার মুখে কালি মেখে দিয়েছে। তবে উপস্থিত সবাই ওখানে থাকলেও দোলা মির্জা অনুপস্থিত তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা।
লিভিং রুমে যখন সবাই নিজেদের মধ্যে মজা করতে ব্যস্ত তখনই টাইজার আর টি-শার্ট পরে নিচে নামে সাঁঝ। ওখানে উপস্থিত সকলে একবার করে সাঁঝের দিকে মুখ তুলে তাকায় সামাদ সাহেব আবারো নিজের ম্যাগাজিন পড়তে মনোযোগ দেয় আর বাকি দস্যু গুলো সাঁঝকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। সাঁঝ একবার চোখ ঘুরিয়ে চারদিকে দেখে নেয়। তবে এক জায়গা গিয়ে তার চোখ আটকে যায় চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে ওঠে মুখে ফুটে বাঁকা হাসি। মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে বাঁকা হেসে পকেটে হাত গুঁজে নিচে নেমে সিঙ্গেল সোফায় বসে গালে হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ নজর ঘোরায়।
এদিকে সাঁঝ এসে সব দস্যু গুলোর সামনে বসতে সারিফ উঠে এসে সাঁঝের বসা সোফার হাতলে বসে পড়ে, তবে এতে সাঁঝের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই সে একবার শুধু ভ্রু কুঁচকে সারিফের মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আবারও তার নজর অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়। বাকিরাও সবাই একবার করে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আবার নিজেদের মধ্যে মিট মিট করে হেসে ওঠে। সামাদ সাহেব বসে আছে বলে বেশী কিছু বলতে পারছেনা, আর ওদের থেকে দূরে বসে থাকা দিশা একভাবে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে আছে । কিছুক্ষণের মধ্যে সবার মাঝে হঠাৎ করেই উদয় হয় দোলা মির্জা। মুখে ক্রূর হাসি নিয়ে সামাদ সাহেবের পাশে বসে পড়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নেয় ।
-“এখানে তো দেখছি সবাই আছে, তা আমাদের নতুন বউ কোথায়? দোলা মির্জা চোখ ঘুরিয়ে বলে ওঠে।
-” ওহ এখনও ঘুম ভাঙেনি বুঝি নতুন বউয়ের বাহ ভালো ভালো। বিদ্রুপ করে বলে ওঠে।
এদিকে সবাইর মুখে রাগ আর বিরক্তি থাকলেও একমাত্র সাঁঝ শান্ত হয়ে বসে আছে যেনো এখানে এইমাত্র কি কথা হয়েছে তার কিছুই সে শুনতে পাইনি তবে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখনও দোলা মির্জার উপরে যেটা এমনিতে দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। কেউ কিছু বলছেনা দেখে দোলা মির্জা আবারো বলে ওঠে ঘি ঢালার জন্যে ,
-“ব্রেকফাস্ট করার সময় হয়ে গেলো আর এখনও নতুন বউ নিচে নামেনি তাহলে আজকে কি আর আমাদের পেটে খাবার পড়বে না। নতুন বউয়ের তো উচিত ছিল সবার আগেই ঘুম ভেঙ্গে সবার জন্যে খাবার তৈরী করা। কিন্তু দেখো সেই এখনও ঘুমিয়ে আছে। দোলা মির্জা ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে।
-” আন্টি আপনি একটু বেশি কথা বলছেন না? সারা কঠিন ভাবে বলে ওঠে।
-” কি আর বেশি বললাম আমি কি কিছু ভুল বলেছি আমরা সবাই এখানে আছি কিন্তু দেখো সেই নেই কেনো? তোমার ড্যাড বসে আছেন সেই কখন থেকে তাকেও খেতে দেয়নি। দোলা মির্জা মুখ ঘুরিয়ে বলে ওঠে।
-“তা আপনার যখন এত কষ্ট হচ্ছে না মানে এতই চিন্তা তা নিজেই করে দিতেন কিছু, সেই তো এই বাড়িতে বসে বসে খান। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে বলে ওঠে।
হঠাৎ করেই এমন কাঠ কাঠ কথা শুনেই সবাই চোখ ঘুরিয়ে তাকায় দেখে বেলা নিচে নেমে ইতি মধ্যে সারার পাশে বসে পড়েছে। দোলা মির্জা তেরছা চোখে তাকালে বরফশীতল কঠিন চোখে তাকায় তাঁর দিকে। এতক্ষণ সবাই বিরক্ত থাকলেও বেলার উত্তর শোনার পর সবার মুখের কোনায় হাসি ফোটে সামাদ সাহেব হাত বাড়িয়ে বেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর তার এই কাজে দোলা মির্জার চোখ যেনো এখুনি বিস্ফোরণ ঘটে যাবে।
-“বাহ রাত কাটতে না কাটতে দেখি মুখ দিয়ে বুলি ফুটে গেছে। দোলা মির্জা বলে ওঠে।
-” আমি কোনো পাখি নই যে আমাকে পোষ মানিয়ে বুলি পড়াবেন ছোটো থেকেই আমি কথা বলতে পারি শিখেছি। বেলা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে ওঠে।
-“তা মুখে যে এত কিছু বলে যাচ্ছ তা তুমি কি এটা জাননা সকাল সকাল উঠে সবাইয়ের খাবার তৈরী করা উচিত ছিল এইযে দাদা তিনি কখন থেকে বসে আছেন। তা শিখবে কোথায় তোমার তো মা নেই। বিদ্রুপ হেসে বলে ওঠে।
-” আমার মা আছে কি নেই সেটা আপনাকে জানতে হবে না আর আমি কি জানি কি জানিনা সেটাও। আর আমি সবার জন্যে খাবার তৈরী করেছি কি সেটা পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে থাকলে তো আর জানা যাবেনা তাইনা। বেলা মুখে হাসি টেনে কাঠ কাট ভাবে বলে ওঠে।
দোলা মির্জা বেলার এমন কাঠ কাঠ কথা শুনে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সামাদ সাহেব বলে ওঠেন,
-“বেলামা অনেক আগেই আমাকে কফি দিয়ে দিয়েছে শুধু তাইনা বাকিদেরও দিয়েছে তুমি তখন এখানে উপস্থিত ছিলেনা তাই না জেনে কোনো কথা বলো না দোলা। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠেন সামাদ সাহেব।
সামাদ সাহেবের কথা শুনেই এমন অবস্থা দোলা মির্জা যে এখনই হয়তো চোখ গুলো সব বাইরে বেরিয়ে আসবে মুহূর্তেই। নিজেকে সামলে নিতেই তার মুখে ফুটে ওঠে আগের সেই ক্রূর হাসি।
-“আচ্ছা আমি জানতাম না ঠিক আছে তাহলে সাঁঝতো মনে হয় সবে উঠেছে যাও বেলা ওকে কফি বানিয়ে দাও আর সারভেন্ট কে বলো টেবিলে খাবার দিতে। এটা করতে পারবে তো?মুখে হাসি টেনে মিষ্টি করে বলে ওঠেন দোলা মির্জা ।
দোলা মির্জার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় সবার এই না তিনি বেলাকে ছোটো দেখানোর চেষ্টা করছিলো আর মুহূর্তেই গিরগিটির মত ভোল পাল্টে নিয়েছে বাহ ভাই বাহ তবে এর মধ্যে সাঁঝের মুখের বাঁকা হাসি আরও বিস্তৃত হয়ে ওঠে। তবে বেলা কিছু বলার আগেই সাঁঝ বলে ওঠে,
-“উম বেলার যাওয়ার দরকার নেই, দিশা যাওতো আমার জন্যে এক কাপ কফি বানিয়ে দাও কি পারবে না?
সাঁঝের কথা শুনে সবার চোখ বাইরে বেরিয়ে আসার উপক্রম তবে বেলা ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায় সাঁঝের দিকে বুঝার চেষ্টা করে এই মুহূর্তে সাঁঝের মাথায় কি প্ল্যান চলছে বেলা তাকাতেই সাঁঝ বেলার দিকে তাকায়, চোখে চোখে দুজনের কথা হয়ে যায় বেলা চুপ করে বসে তামাশা দেখতে থাকে এখন এটাই ওর কাজ। তবে এর মধ্যে যে বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন তিনি হলেন দোলা মির্জা।
-“আরে দিশা কেনো? তিনি উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন।
-” দিশা ভালো কফি বানায় আর তাছাড়া অনেকদিন হয়ে গেলো দিশার কফি ট্রাই করিনি ।সাঁঝ বলে ওঠে।
-“অবশ্যই সাঁঝ আমি এখুনি বানিয়ে আনছি। দিশা খুশি হয়ে বলে ওঠে।
-” আরে দিশা তুই পারবিনা দাঁড়া। দোলা মির্জা দিশাকে থামানোর জন্যে বলে ওঠে।
দোলা মির্জার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে সবাই ভ্রু কুঁচকে একবার দিশাকে দেখে আর একবার মিসেস দোলাকে যিনি এই মুহূর্তে ভীতস্ত্র হয়ে বসে আছেন আর অন্য দিকে সাঁঝ মুখে হাসি টেনে বসে আছে। ততক্ষণে দিশা কিচেনে চলে গিয়েছে। সবাই নিজের নিজের মত করে চোখ চাওয়া করছে ব্যাপার কি হচ্ছে সেটা জানার জন্যে এরই মধ্যে কিচেন থেকে চিৎকার শব্দ ভেসে আছে, হঠাৎ করে চিৎকারে শব্দে সবাই এবার সাঁঝের মুখের দিকে তাকায় দেখে সেই একই ভাবে তার মুখে হাসি ফুটে আছে আর দোলা মির্জা আতকে উঠেছে যেনো তিনি এই মুহূর্তের অপেক্ষা করছিলেন। বেলা ভ্রু কুঁচকে একবার দোলা মির্জা আর কিচেনের দিশার ভেসে আসা চিৎকারে আওয়াজ শুনে বুঝতে পারে ঘটনা কি ঘটেছে। ততক্ষণে দোলা মির্জা উঠে দৌড়ে গেছেন কিচেনের দিকে আর সাথে বাকিরাও।
কিচেনের ফ্লোরে উল্টে পড়ে আছে দিশা হাত মুখ ইতি মধ্যে পুড়ে গিয়ে চামড়া উঠে উঠে ফোসকা পড়ে গেছে আর তার থেকে কিছু দূরে পড়ে আছে সসপ্যান হাত মুখ গলা গরম ফুটন্ত পানি পড়ে জ্বলে গিয়ে চামড়া উঠে বিভৎস অবস্থা। সবাই দিশাকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে যায় কিচেনে এসেছে দুই তিন মিনিট তাও হয়নি আর তার মধ্যে এমন ভয়ংকর কান্ড কি করে হলো বেলা এগিয়ে গিয়ে ইন্ডাকশনের সুইচ অফ করে দেয় যেটা এখনও অন আছে। তবে বিস্ময়ের বিষয় ইন্ডাকশনের সিস্টেম এমন ভাবে রাখা আছে যাতে প্রথমেই কেউ বুঝতেও পারবেনা সেটা অন আছে কিনা যদি সেটা কেউ ঠিক ভাবে খেয়াল না করে বুঝতে পারবে না। এখানে যে কি হয়েছে সেটা আর বুঝতে বাকি থাকে না বেলার আর সাঁঝের দিশাকে কিচেনে পাঠানোর কারণটাও বুঝতে পারে। দিশা কে ধরে বসে দোলা মির্জাও আহাজারি করে যাচ্ছে বেলা সেই দিকে একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়। কথায় আছে,
-“যেমন কর্ম তেমন ফল।
চলবে….?
#তোর_আসক্তি_পাগল_করেছে_আমায়
#সিজন_০২
#সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
৪৪.
-“অন্যের জন্যে গর্ত খুললে সেই গর্তে নিজেকেই পড়তে হয় প্রবাদ টা নিশ্চয়ই শুনেছেন মিসেস দোলা মেহতা ওরফ দোলা মির্জা? সাঁঝ বরফশীতল কন্ঠে বলে ওঠে।
সাঁঝের বলা কথাটা পুরো লিভিং রুমে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে উপস্থিত সবাই চমকে উঠে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে আছে যেনো সাঁঝ তাদের সামনে কোনও রহস্য খুলে দিয়েছে সামাদ সাহেবও চমকে উঠে সোজা হয়ে বসেছেন। সবাই একবার সাঁঝের দিকে তাকিয়ে নিয়ে ওখানে বসে থাকা দোলা মির্জার দিকে তাকায় যিনি এখন ভূত দেখার মত চমকে তাকিয়ে আছে সাঁঝের মুখের দিকে এখানে যদি এখন কোনো বোমা পড়তো তাও বোধহয় এত চমকাতেননা তিনি যতোটা সাঁঝের কথা শুনে চমকে গেছে সাথে সাথে তার হাতও থেমে গেছে দিশার উপরে। তার মুখ দিয়ে আর একটা কথাও সরছে না দিশাও কম অবাক হয়নি সেও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ একবার উপস্থিত সবার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে নেয় বুঝতে পারে সবাই জানার জন্যে উৎসুক হয়ে আছে।
-“ম্ মা মানে! কোনোরকম বলে ওঠে দোলা মির্জা।
-” মানে এটাই আপনি যে গর্তটা বেলার জন্যে খুঁড়ে ছিলেন সেটাতে পড়লো আপনার মেয়ে সিম্পল তাইনা। সাঁঝ শান্ত ভাবে বলে ওঠে।
-“বেলার জন্যে গর্ত খুঁড়েছে মানে কি বলতে চাইছো সাঁঝ? আর দোলা মেহতা মানে? সামাদ সাহেব বলে ওঠেন।
-” এইযে দিশা এখন যেমন অবস্থায় বসে আছে দিশার জায়গায় বেলা থাকতো যদি আমি দিশাকে কিচেনে না পাঠাতাম। আর দোলা মেহতা মানে সেটার অর্থ দোলা মির্জা ভালো জানেন আর বলতে পারবেন তাইনা? সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে।
-” দিশার জায়গা বেলা? সারা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
-“তার মানে এটা কোনো অ্যাক্সিডেন্ট নয় প্রি-প্ল্যান ছিলো তাও বেলার জন্যে? ওম আতকে উঠে বলে ওঠে।
-“হুম একদমই তাই এই ফাঁদ বেলার জন্যে করা হয়েছিলো। সাঁঝ বলে ওঠে।
-” মিসেস মেহতা ওরফে মির্জা আপনি বলবেন নাকি আমি বলবো? আচ্ছা ছাড়ুন আমিই বলছি। মিসেস মির্জা সবার অলক্ষে কিচেনে গিয়ে ইন্ডাকশন অন করে গরম পানির সসপ্যান বসিয়ে রেখেছেন শুধু তাই নয় সেটাও তিনি ঢাকা দিয়ে রেখেছিলেন যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে পানিটা ফুটছে, সাথে ইন্ডাকশন সিস্টেম টাও এমন ভাবে রেখেছিলেন যাতে ওটা বোঝা না যায় যে ওটা অন আছে যেহেতু স্মার্ট ইন্ডাকশন ছিল তাই সহজে কেউ ধরতে পারবে না যদি সেইভাবে কেউ খেয়াল না করে। আর এখানে এসে উনি একের পর এক বেলার নামে কথা বলে যাচ্ছিলেন যখন দেখলেন কথা গুলো ঠিক বেলার লাগছে না আর এতে বেলার কিচেনে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই তখনই উনি আমার কফির নাম করে বেলাকে কিচেনে পাঠানোর চেষ্টা করে তবে সেটা সফল হয়না দিশার জন্যে। যেটা বেলার জন্যে খুঁড়ে রাখা হয়েছিলো সেটাতে বেলা না দিশা পড়েছে ।সাঁঝ ঠান্ডা শীতল কন্ঠে বলে ওঠে।
আসলে সাঁঝ যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে লিভিং রুমের চারিদিকে দেখছিল তখনই তার চোখ যায় কিচেনের দিকে যেখানে দোলা মির্জা তখন প্ল্যান সাজাচ্ছিল আর তখনই ফুটে উঠেছিলো সাঁঝের মুখে বাঁকা হাসি।
এদিকে সাঁঝের কথা শেষ হতে সবাই রাগে চোখ লাল করে দোলা মির্জার দিকে তাকায় যিনি এখন ভীতগ্রস্থ হয়ে চুপ করে বসে আছেন তার প্ল্যান যে এত সহজে ফেল হয়ে যাবে সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। উপরে উপরে ভীতু হয়ে থাকলেও ভিতরে ভিতরে তিনি নিজেও রাগে ফেটে যাচ্ছেন একতো তার মেয়ের অবস্থা আর দুই সে ধরা পড়ে গেছে।
-“কি মিসেস, আপনি কি ভাবছেন রাগ হচ্ছে তাইনা ভাবছেন এত সহজে আপনি কি করে ধরা পড়ে গেলেন? আর তাছাড়া আমি আপনার নাম কি করে জানলাম? সাঁঝ বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করে ওঠে।
-” হ্যাঁ এটা আমারও প্রশ্ন এর ঘটনার সাথে দোলার মেহতা হওয়ার কি কানেকশন? আর দোলা বা কেনো বেলার জন্যে এমন একটা প্ল্যান করলো? সামাদ সাহেব অধৈর্য্য হয়ে বলে ওঠেন ।
সাঁঝ একবার উপস্থিত সবার দিকে তাকায় দেখে তারাও তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে আর সামাদ সাহেব তো রীতিমতো অধৈর্য্য হয়ে ওঠেন। সবার দিকে তাকিয়ে থেকে সাঁঝ তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা রেকর্ডিং চালিয়ে দেন সাথে সাথে ভেসে আসে একটা মহিলা কন্ঠ ও পুরুষ কন্ঠ।
-“সাঁঝের সাথে বেলার কি করে বিয়ে হয়েছে আর কবে হলো? দোলা মির্জা বলে ওঠে।
-” মানে বিয়ে ওদের বিয়ে হয়েছে নাকি? ফোনের ওপারের ব্যাক্তি বলে ওঠে।
-“আজকে পার্টিতে নিজের বিয়ে অ্যানাউন্স করেছে সাঁঝ তাও আবার বেলার সাথে। দোলা মির্জা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে।
-” বেলার সাথে সাঁঝের বিয়ে কিভাবে হতে পারে বেলাকেতো আমরা সরিয়ে দিয়েছিলাম তাহলে বেলা আবার আসবে কোথায় থেকে? ফোনের ওপারে ব্যাক্তি বলে ওঠে।
-“আমি কিছুই জানি নয় বেলাকে সরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার ছিল তাহলে বেলা সাঁঝের জীবনে এলো কিভাবে? দোলা মির্জা রেগে বলে ওঠেন।
-” আরে আমি ম্যাডিকে তো বেলার জন্যে কাজে লাগিয়ে ছিলাম ম্যাডিই তো বললো বেলাকে নাকি সে নিজের শিকার বানিয়ে নিয়েছে। ফোনের ওপারে ব্যাক্তিও রেগে বলে ওঠে।
-” এই বেলাকে আমি কিছুতেই বাঁচিয়ে রাখবো না আমার এত বছরের সব প্ল্যানে পানি ঢেলে দিয়েছে ওকেতো এবার মরতেই হবে এবার আমিও দেখি আমার হাতে থেকে কিভাবে পালিয়ে বাঁচে। দোলা মির্জা রেগে বলে ওঠে।
এটা আগের দিনের রেকর্ড ছিল যখন মিসেস দোলা মির্জা ফোনে কারোর সাথে প্ল্যান করেছিলেন। দোলা মির্জার অগোচরে ওনার রুমে হিডেন ক্যামেরা আর ভয়েস রেকর্ডার রাখা আছে যার মাধ্যমে প্রত্যেকটা গতিবিধি সাঁঝের হাতের মুঠোতে।
রেকর্ডিংটা অফ হতে সবাই বিস্ফোরিত ভাবে দোলা মির্জার দিকে তাকায় এতক্ষণ চেহারায় ভীতু ভাব দেখালেও এখন স্পষ্ট তার মুখে ভয়ের ছাপ। সাঁঝ যে সব কিছুই ধরে ফেলেছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই তাঁর। দিশা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তার মা যে এত কিছু করেছে সে যেনো বিশ্বাস করতেই পারছেনা তার এত বড় ভয়ংকর ঘটনার পিছনে যে তার মা সেটা ভাবতেই পারছেনা আর তাছাড়া তার মা কি করেছে এইসব?
-“ওহ হ্যাঁ মিসেস দোলা আরো একটা জিনিষ দেখানোর আছে আপনাকে, এই যে আপনার প্রিয় ভাইপোর অবস্থাটা ও একবার দেখে নিন।
সাঁঝ বলে ওঠে ফোন আরো একটা ভিডিও চালিয়ে সামনে ধরে যেখানে দেখা যাচ্ছে হাত পা বাঁধা অবস্থায় একটা ছেলে ফ্লোরে পড়ে আছে একটু একটু করে মুখ স্পষ্ট হতে ওখানে উপস্থিত সবাই আচম্বিত হয়ে ওঠে আরো একটা ঝটকা। আর মিসেস দোলার তো অবস্থা আরও শোচনীয়। ভিডিওতে থাকা ছেলেটা অন্য কেউ বরং আর. এম। ভিডিও টা দেখতে দেখতে দোলা মির্জার মুখ থেকে অস্পষ্ট ভাবে বেরিয়ে আসে একটা নাম,
-“রনি..
নামটা শুনতে সবাই চমকে উঠে একে একে সবাই দেখতে থাকে দোলা মির্জার মুখের দিকে আর এদিকে সাঁঝের ঠোঁটের কোণে হাসিটা আরো একটু বিস্তৃত করে বলে ওঠে,
-” রনি মেহতা ওরফে আর. এম মিসেস দোলা মির্জার ভাইয়ের ছেলে। কি ঠিক বললাম তো?
-“কি? এটা কিভাবে সম্ভব? সামাদ সাহেব চমকে উঠে বলে ওঠে।
-“মিস্টার রাকিব মেহতা নাম মনে আছেতো আপনার? ক্লাসমেট ছিলেন আপনারা বলতে গেলে বন্ধুও বলা চলে। মিসেস দোলা হলেন রাকিব মেহতার বোন দোলা মেহতা। যার জন্যে রাকিব মেহতা আপনার কাছে সম্পর্ক নিয়ে এসেছিলো আর আমার মম কে পছন্দ করতেন মিস্টার রাকিব। কিন্তু আপনার মম কে বিয়ে করে নেওয়ার পর সব হিসেব গুলিয়ে যায় ওদের। কারণ রাকিব ঠিক করেছিলেন তার বোনকে আপনার হাতে গুছিয়ে দিয়ে মম কে তিনি বিয়ে করবেন কিন্তু আপনাদের বিয়ের জন্যে সেটা হতে পারেনি যদিও এতে মিসেস দোলা জানতেন না পুরো ব্যাপার শুধু জানতেন আপনার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলেন তার ভাই কিন্তু আপনি তাকে রিজেক্ট করেছেন। তারপরেই তিনি তার ভাইয়ের অপমান এর প্রতিশোধ নিতেই মেহতাব মির্জা আংকেল এর সাথে বিয়ে করেন যাতে আমাদের কাছাকাছি থাকতে পারেন মিসেস দোলা তার বিয়ের পরেই জানতে পারেন তার ভাই আমার মমকে পছন্দ করতেন কিন্তু আপনার জন্যে পারেনি আর আপনিও তাকে বিয়ে করেননি এতে তিনি আরও বেশি প্রতিশোধস্পৃহা হয়ে পড়েন তারপরেই থেকেই প্ল্যান করতে থাকেন কিভাবে আপনার থেকে মমকে সরিয়ে দেবে যেমন তার ভাই মম কে পাইনি সেইভাবে মমকে আপনার জীবনে থেকে সরিয়ে দেবে। এরপর সময়ে কাটতে কাটতে একসময় সেই সময় ও সুযোগ ও এসে যায় সেটা আপনিই করে দিয়েছিলেন মিসেস দোলাকে আমাদের পরিবারের নিয়ে এসে। সাঁঝ এটুকু বলেই থেমে যায়।
বাকিদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে বিস্ময় আর অবাক এর ছাপ তবে সারা আর সারিফের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে শুধু তাই নয় সামাদ সাহেবের ও একই অবস্থা। সাঁঝ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বলতে শুরু করে,
-“মেহতাব আংকেল এর মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক ছিলোনা তার পিছনেও মিসেস দোলার হাত ছিল আংকেল মিসেস মির্জার আসল কুৎসিত চেহারা টা ধরে ফেলেছিলেন যেটা তিনি সহ্য করতে পারেননি তাই তিনি আপনাকে জানানোর জন্যে উদ্বেগ নিলেই মিসেস দোলা তাকে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দেন ওটা কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ছিলোনা ।আংকেল কে বিয়ে করেছিলেন শুধু টোপ হিসাবে। আংকেলের মৃত্যুর পর আপনিই ওদের নিয়ে আসেন বাড়িতে এখানে দিশাকে নিয়ে উনি ওঠেন তারপর থেকেই শুরু করেন ওনার প্ল্যান একটু একটু করে মম কে কিভাবে শেষ করবেন। তবে এটাতেও ওনাকে বেশি সময় নিতে হয়নি সেদিন আমাদের ড্রাইভার আসেননি তাই মমকে নিজে ড্রাইভ করে সারাকে স্কুলের থেকে আনতে বেরিয়ে পড়েন তবে মম জানতো না গাড়ির ব্রেক কাটিয়ে রেখে ছিল আর রাস্তায় কন্ট্রোল করতে না পেরেই মমের অ্যাক্সিডেন্ট আর তারপরেই সব শেষ। বলেই সাঁঝ চুপ যায়।
এদিকে সাঁঝের কথা শেষ হতে না হতে সারা কান্নায় ভেঙে পড়ে। বেলা সারাকে জড়িয়ে রেখে শান্ত করতে থাকে সারিফের ও চোখ ছলছল করে ওঠে তাদের মুখ সব ফ্যাকাশে সামাদ সাহেব মুখে হাত ঢেকে বসে পড়ে সবার চোখের সামনেই যেনো দৃশ্য গুলো ভেসে উঠেছে। এদিকে সবাই কথার রেসে হারিয়ে গেলেও দোলা মির্জা সতর্ক ভাবে ওখান থেকে উঠে চলে যেতে নিলেই দিশা হাত আটকে ধরে সাথে সবাই ও তাকিয়ে দেখে দিশা চোখে পানি নিয়ে রাগে তাকিয়ে আছে।
-“আপনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন বুঝি? তা কি করে পালাবেন? আকাশ। সাঁঝ জোরে চিৎকার করে ডেকে ওঠে।
সাথে সাথে কয়েকজন বডি গার্ড নিয়েই আকাশ বাড়ির ভিতরে ঢুকে দোলা মির্জাকে ঘিরে ধরে।
-” আপনি শুধু আমার মমের ক্ষতি করে শান্ত হননি আপনি আপনার মেয়েকেও আমার সাথে গুছিয়ে দিতে চেয়েছেন যাতে এই বাড়ির দখল নিতে পারেন আপনার মেয়ের থেকে। আমার বোনের পিছনেও রনিকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু যখন জানতে পারলেন আমার জীবনে কেউ আছে তখন আমার বোনের কথা বাদ দিয়ে আমার জীবনে কে আছে সেটা নিয়ে পড়ে গেলেন আর আপনাকে অবশ্যই বাহবা দিতেই হয় আপনি খোঁজ ও পেয়ে গেলেন বেলার আর সেখানেও আপনি আপনার চাল চাললেন। পার্টিতে বেলাকে আমার সাথে দেখে সুযোগ খুঁজছিলেন কিভাবে বেলাকে একা পাবেন আর উদ্দেশ্য হাসিল করবেন আর দেখতে দেখতে আপনি সেই সুযোগও পেয়ে গেলেন। আমি যখন বেলাকে একা রেখে পাশে ফোন কথা বলার জন্যে গিয়েছিলাম তখনই দিশাকে আমার পিছনে পাঠিয়ে দিলেন আর বেলার পাশে দাঁড়িয়ে ওকে উল্টো পাল্টা বলতে লাগলেন আমার নামে আর বেলা কেও অপমান করলেন শুধু তাই নয় আমি যখন কথা বলছিলাম সেই সুযোগ নিয়ে দিশা পড়ে যাওয়ার ভান করে আর তাকে আমি ধরে নেই আর সেই দৃশ্য আপনি তুলে ধরেন বেলার সামনে যাতে বেলা ভুল বুঝে আমার থেকে দূরে সরে যায় আপনার রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায় তবে আপনি বোধ হয় জানতেন না তখন বেলা আমার বিয়ে করা বউ ছিলো। সাঁঝ বলেই থেমে যায় বেলার মুখের দিকে তাকিয়ে।
বেলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাঁঝের মুখের দিকে বাকিরাও অবাক হয়ে সাঁঝ ও বেলার দিকে দেখে যাচ্ছে তাদের মধ্যে এত কিছু হয়ে গেছে শুধু তাই নয় দোলা মির্জা সারার জীবনের পিছনেও উঠে পড়ে লেগে ছিলো।
-“বেলাকে দেখেই আপনার ভাইয়ের ছেলে রনির চোখ আটকে যায় তাই সে আপনার কথা মত বেলা কে মেরে না ফেলার প্ল্যান করে বরং তার পিছনে একজন কে পাঠিয়ে রেখেছিলো যাতে সে প্রতিটা মুহূর্ত বেলাকে চোখে রাখতে পারে কিন্তু আপনি তাতে সন্তুষ্ট হননি রনিকে বলে ম্যাডিকে দিয়ে আপনি বেলাকে উত্যক্ত করাতে লাগলেন যাতে সে ফিরে আসে আর রনি তাকে নিজের করে নিতে পারে কিন্তু এর পিছনে আপনার আসল উদ্দেশ্য ছিল বেলা কে যেকোনো ভাবে মেরে ফেলার যেটা রনি পর্যন্ত জানতো না। সত্যি আপনাকে বাহবা দিতেই হয় এত সুন্দর প্ল্যান করার জন্যে। সাঁঝ বলে উঠে হাততালি দিতে থাকে।
-“আর আপনি নিশ্চিন্ত ছিলেন যে বেলা মারা গেছে কারণ ঠিক সাড়ে চার বছর ধরে বেলাকে উত্যক্ত করার পর আপনার হাতে সুযোগ আসে সাথে সময়ও কমে এসেছিলো কারণ তখন রনি ম্যাডির উপরে নজর রাখতনা তাই আপনি বেলার বাইকের ব্রেক কাটিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছিলেন যাতে বেলা প্রতিযোগিতা অংশ নেওয়ার সাথে বাইকে নিয়ে খাদে পড়ে আপনার পথের থেকে সারাজীবনের মত সরে যায় আর এতে কোনো সন্দেহ ও থাকবে না কারণ সে প্রতিযোগিতার দরুণ মারা গেছে। প্ল্যান টা আপনি ভালোই করেছিলেন। কিন্তু আফসোস সফল হয়নি কিন্তু আপনার কাছে খবর এসেছিলো বেলা মারা গেছে তাইনা? বলেই সাঁঝ হেসে ফেলে শব্দ করে।
সাঁঝের হাসি শুনেই সবাই চমকে ওঠে। শুধু তাই নয় আজকে তাদের মনে থাকা সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায় সব ঘটনার পিছনে যে এই মহিলা ছিল ভেবেই সব বিস্ময় হয়ে ওঠে এমন ভয়ংকর ভাবে প্ল্যান করেছে যে কেউ ধরতেই পারবে না। বেলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাঁঝের দিকে যে এই মুহূর্তে নিষ্ঠুর মানুষে পরিনত হয়েছে আর তার সব প্রশ্নের উত্তর ও সে পেয়ে গেছে যা সাঁঝ বলেছিলো আজ সকালের পর থেকেই দেখতে পাবে একটু একটু করে এবার বুঝতে পারছে সাঁঝের তখনকার কথার মানে। সব থেকে আশ্চর্য হয়েছে বেদ নিশান শান্তা সারা ওম জাকিয়া আর রুহি সারিফ যারা এই মুহূর্তে বিস্ফোরক চোখে তাকিয়ে আছে দোলা মির্জার দিকে, আর সাঁঝের বলা এক একটা সত্যি কথা গুলো সামনে আসতে দোলা মির্জা আরো বেশি ফুসে ওঠে তার মুখে কয়েক মুহূর্ত আগের ভয় আর নেই। সেদিকে তাকিয়ে দিশা মুখ ঘুরিয়ে নেয় তার মায়ের এই রূপ সে দেখতে পারছেনা যখন থেকে জানতে পেরেছে তার বাবার মৃত্যুর পিছনে তার এই মায়ের হাত তার মা তার বাবাকে মেরে ফেলেছে। ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেয় দিশা, সে সাঁঝকে পছন্দ করলেও কখনই কোনো খারাপ চাল চলেনি হতে পারে সে একটু গায়ে পড়া কিন্তু তারপরেও সে তার মায়ের মত কোনো ঘৃণ্য কাজ করেনি ভেবেই যেনো সে স্বস্তি পাচ্ছে।
চলবে….?
ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন…। নিজেদের মতামত জানাবেন ।