#তোর_রঙে_রাঙাবো
#Part_17
#Writer_NOVA
দুপুর গড়িয়ে বিকালের জোগাড় হচ্ছে। রোদের তেজ ধীরে ধীরে কমছে।আমি ও পুষ্প ভাবী মুখোমুখি বসে আছি। হুট করে কিছু সময় আগে সে বাসায় এসে হাজির।আমার সাথে কি দরকারী কথা নাকি আছে তার।তাকে দেখে খুব চিন্তিত ও নার্ভাস লাগছে।গত রাত থেকে ভাইয়ুর কোন খোঁজ নেই। এতবার কল করছি।কিন্তু মোবাইল বন্ধ বলছে।দুজন নীরবতা পালন করছি।নীরবতা ভেঙে কাঁপা কাঁপা গলায় পুষ্প ভাবী বলে উঠলো।
পুষ্পঃ তাহা তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।আমি জানি না কিভাবে শুরু করবো।তবে আমাকে তোমায় বিষয়টা জানাতেই হবে। কারণ আমার মতো তোমাকেও ঠকানো হচ্ছে। তুমিও নিশ্চয়ই কিছু জানো না।আমি তাই তোমাকে সবকিছু বলতে এসেছি।
আমিঃ তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন?কি এমন কথা?আমাকে কেই বা ঠকাবে?এমন তো নয় আমার কোন ছেলের সাথে রিলেশন আছে।কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো তো?তোমার অর্ধেক কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছি না।
পুষ্পঃ তোমার ভাইয়া তোমাকে ঠকাচ্ছে।
আমিঃ মানে🙄🙄??কি বলছো এসব?আমার ভাই আমাকে ঠকাবে কেন?
পুষ্পঃ তোমার ভাইয়া এতো টাকা কোথা থেকে পায়? তা কি কখনো তোমাকে বলেছে।সে অনেক বড় সত্য তোমার থেকে লুকিয়েছে।
আমিঃ ভাইয়ুর রাজনৈতিক দল থেকে এই টাকাগুলো ভাইয়ুর কাছে আমানত রাখতে দেয়।এটা আবার না জানার কি আছে।তুমি যে কি বলো না।বিয়ের টেনশনে টেনশনে তোমার মাথা গেছে। যাও বাসায় গিয়ে বিয়ের প্লানিং করো।বিয়ের আগে স্বামীর বাড়ি চলে এসেছো।মানুষ জানলে খারাপ বলবে।
পুষ্পঃ তোমাকে আমি একটা সত্য জানাতে এসেছি।তোমার ভাইয়ু—-
আমিঃ মাফিয়া কিং। (শান্ত ভঙ্গিতে)
পুষ্পঃ তুমি জানো😳।(অবাক হয়ে)
আমিঃ আমি বহু আগের থেকে জানি।আমি যে জানি তা ভাইয়ু জানে না।আমার ভাইয়ু কোথায় যায়, কি করে তার সবকিছু আমি জানি।আর এটাও জানি আমার ভাইয়ু কোন নিরপরাধ মানুষকে মারে না।
পুষ্পঃ কিন্তু তুমি যা জানো তা ভুল।
আমিঃ নাহ্। আমি যা জানি তা ভুল নয়।বরং তুমি যা জানো তা ভুল।আমি নিশ্চিত তোমাকে কেউ আমার ভাইয়ুর নামে ভুল বুঝিয়েছে। আমার ভাইয়ু আমার ওয়াইল্ডের বেস্ট ভাইয়ু।সে কখনো খারাপ কাজ করতেই পারে না।তুমি আমাদের অতীত জানো না। তাই এসব কথা বলছো।
পুষ্পঃ অতীত!!!!!
আমিঃ হ্যাঁ অতীত।অন্য দশজনের মতো আমাদেরও একটা সুখী পরিবার ছিলো।বাবা-মা, ভাইয়ু, আমি।আমার বয়স তখন ৫ বছর আর ভাইয়ুর ১০ বছরের কাছাকাছি। আমাদের গ্রামের সবচেয়ে খানদানী সৈয়দ বংশের ছেলে-মেয়ে আমরা। আমার বাবা সৈয়দ জয়নাল আবেদীন ছিলো গ্রামের সবার প্রিয় একজন মানুষ। আমাদের অনেক জমি-জমা,সম্পত্তি ছিলো।আমার বাবা সবসময় গরীব, অসহায়দের সাহায্য করতো।তার বন্ধু ছিলো সোবহান চৌধুরী।সে ছিলো বাবার বিজনেস পার্টনার।তার অনেক আগের থেকে কুদৃষ্টি ছিলো আমাদের সম্পত্তির দিকে।নানা বাহানায় আমার বাবার থেকে লাখ লাখ টাকা নিতো।বাবাও ভালো মনে দিয়ে দিতো।দিনকে দিন তার লোভ বেড়েই গেলো।শেষে আমাদের পুরো পরিবারকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করলো।এক রাতে আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম।আমি ছোট বেলায় ভাইয়ুর সাথে ঘুমাতে পছন্দ করতাম।হঠাৎ গুলির শব্দে আমরা চমকে উঠি।দৌড়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি বাবা রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে পরে আছে।আমাদের চোখের সামনে মাকেও মেরে ফেলে। বাবা আমাদের পালিয়ে যেতে বলে।যখন আমাকে গুলি করবে।তখনি ভাইয়ু আমাকে নিয়ে পেছনের দরজা খুলে পালায়।
পুষ্পঃ তারপর?? থামলে কেন বলো?
আমিঃ সেসব কোন কথা আমার মনে নেই। সব ভাইয়ুর মুখের কথা। তারপর শুরু হয় বেঁচে থাকার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে ভাইয়ু টের পায় গরীব, অসহায়দের অত্যাচার।তার মনে এসব দেখে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। স্থানীয় এক ছোট খাটো মাফিয়ার দলে নাম লেখায়।যাদের কাজ ছিলো গরীবদের সাহায্য করা।ধীরে ধীরে ভাইয়ু নিজের একটা গ্যাং করে।আজ সে বড় মাফিয়া কিং। কখনো কোন খারাপ কাজের টাকা সে আমার কিংবা তার জন্য ব্যয় করে না।ওগুলো গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেয়।আমার ভাইয়ু অনেক ভালো।সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে।কিন্তু আফসোস তুমি তাকে এতদিনেও চিনতে পারলে না।আমার বাবার ইচ্ছে ছিলো সবসময় গরীব, অসহায়দের সাহায্য করার।কিন্তু সে তো করতে পারেনি।তাই আমার ভাইয়ু সেটা পূরণ করছে।আমার ভাইয়ু যাদের মারে তারা ভালো মানুষ নয়।আমাদের জীবন কাহিনিটা নিশ্চয়ই তোমার কাছে মুভির মতো লাগছে?কিন্তু মনে রেখো বাস্তবতাটা মুভির থেকেও অনেক কঠিন।
পুষ্পঃ কিন্তু আমি যা শুনেছি??
আমিঃ সব ভুল।আমি তোমাকে মিথ্যে বলছি না।তোমায় মিথ্যা বলে আমার লাভ কি বলো?মনে রেখো পরিস্থিতি নামক শব্দটা সর্বদা পরিবর্তনশীল।কেউ কখনো ইচ্ছে করে খারাপ হয় না।তার পেছনে লুকিয়ে থাকে অনেক বড় একটা দীর্ঘ কাহিনি। যেটার মাঝে অনেক কষ্ট,বিসর্জন ও কঠিন বাস্তবতা থাকে।কাউকে খারাপ বলার আগে তার অতীত সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে বলো।তাহলে হয়তো তুমি আর তাকে খারাপ বলতে পারবে না। তার জন্য তোমার মায়া হবে।সেই জন্যই তো বলে পাপকে ঘৃণা করো,পাপীকে নয়।
পুষ্পঃ আমার সত্যি অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। আমি অন্যের কথায় তাসিনকে ভুল বুঝে বসে আছি। একবার ওর অতীতের কালো অধ্যায়ের কথা জানতে চাই নি।আমার বোঝা উচিত ছিলো যে ওর ও একটা বিষাক্ত মুহুর্ত থাকতে পারে। কিন্তু তা করিনি।তোমাকে অনেক ধন্যবাদ তাহা।আমি আজ তোমায় না বলতে এলে এসব কথা জানতে পারতাম না।কিন্তু আমি তো তাসিনের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি।ও কি আমাকে মাফ করবে?
আমিঃ নিশ্চয়ই করবে।কারণ সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে।আর ভালোবাসার মানুষটাকে কেউ কি কখনো মাফ না করে থাকতে পারে। তুমি যে তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো এটা বড় কথা।তবে ভাইয়ু তোমার ওপর অভিমান করে থাকবে।তোমাকে সেই মান ভাঙাতে বেশ নাকানিচুবানি খেতে হবে।
পুষ্পঃ আমি তা খেতে রাজি আছি।কিন্তু তাসিন সব ভুলে আমাকে আপন করে নিলেই হলো।
আমিঃ এবার চোখের পানি মুছে অন্যের সেই শোনা কথা ভুলে যাও।আর মনে রেখো সবসময় আমরা যা নিজের চোখে দেখি তাতেও কিন্তু ভুল থাকে।এবার নিজেকে পার্ফেক্টভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করো।আর ভাইয়ুর অভিমান ভাঙার জন্য আমি কতগুলো আইডিয়া দিচ্ছি সেগুলো মনোযোগ সহকারে শোনো।তাহলে কাজে দিবে।
পুষ্পঃ হ্যাঁ,বলো।
তাসিন আর কিছুতেই মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারলো না। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বন্যা বইছে।অনেক সময় আগে বাসায় এসেছে সে।পুষ্পকে রাইয়ের সাথে কথা বলতে দেখে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো সে এতক্ষণ।বোনের কথা শুনে সে নিজেও অবাক।তার বোন আরো আগের থেকে তার ভাইয়ের কাজের কথা জানতো।কিন্তু কখনো তাকে বুঝতে দেয়নি।খুশিতে চোখের পানি চিকচিক করে উঠছে।আজ নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষের মধ্যে একজন মনে হচ্ছে। কারণ তার বোন তাকে বিশ্বাস করতো।যেখানে তার বোন তাকে বিশ্বাস করতো সেখানে সারা পৃথিবী অবিশ্বাস করলেই বা তার কি।তাছাড়া পুষ্পকেও রাই মানিয়ে নিয়েছে। খুশিমনে ফ্রেশ হতে চলে গেল তাসিন।
🌺🌺🌺
চেয়ারে বসে দুই পা টেবিলের ওপর তুলে বসে আছে তীব্র।এক হাতে ওয়ালমেট ঘুরাচ্ছে। আরেকহাতে কপালে স্লাইড করছে। আরেকটুর জন্য তার হাত ফঁসকে তাসিন চলে গেল। কিন্তু এখন সে তাকে এরেস্ট করতে পারবে না। কারণ তাসিনের বিরুদ্ধের প্রমাণগুলো সব মিথ্যা। আর সে একজন আদর্শবান অফিসার হয়ে মিথ্যা অভিযোগে তাকে ধরতে পারে না।নিজের বিবেকের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হাঁপিয়ে পড়েছে সে।মন বলে তাসিনকে ধরতে না।আর মাথা বলে তোর ডিউটি কর।দোটানায় এখন তীব্রর মাথা ধরে গেছে।
তীব্রঃ আমি কি করবো এখন?আমার কাছে আমার ডিউটি সবার আগে। আমি চাইলেও এখন এই কেস ছেড়ে দিতে পারবো না। তাছাড়া মিথ্যে অভিযোগে কাউকে এরেস্ট করতে পারি না।আমি তার পুরো অতীতটা জেনেছি। আমিও একজন এতিম ছেলে।তাই আমি জানি বাস্তবতা কি?বাবা মারা যাওয়ার পর মা খুব কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে। কিন্তু ভেবেছিলাম চাকরী করে মায়ের কষ্ট দূর করবো।কিন্তু একদিন হঠাৎ করে স্ট্রোক করে আমাকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে গেল।আমি জানি বাবা-মা ছাড়া কি কষ্ট এই স্বার্থপর পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে।তাসিনকেও পরিস্থিতি এমন করেছে।
একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে কফির মগ নিয়ে ছাদে চলে গেল।বেশ নির্জন এক তালার এক পুরনো কোয়ার্টারে উঠেছে সে।বাড়িতে তীব্র আর কাজের একটা ছেলে।দারোয়ান ও মালীও আছে।বাসায় খুব কম সময় থাকে তীব্র। খুব রাতে ডিউটি থেকে বাসায় ফিরে। আবার ভোর সকালে বাসায় চলে আসে।যেদিন বাসায় থাকা হয় সেদিন একাকিত্ব ঘিরে ধরে।নিজের জীবনের প্রতি কোন অভিযোগ নেই তীব্রর।বরং বেশ ভালো আছে সে।
তার ভাবনার মাঝেই তার টাউজারের পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠলো। ধ্যান ভেঙে মোবাইল টা বের করে দেখলো তার উর্ধ্বতন কর্মকতা স্বপন সাহেবের কল।জলদী করে কল রিসিভ করলো তীব্র।
তীব্রঃ আসসালামু আলাইকুম স্যার।কেমন আছেন?
স্বপনঃ ওয়ালাইকুম আস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো তীব্র?
তীব্রঃ জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। হঠাৎ করে কল করলেন যে?কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন কি?
স্বপনঃ তেমন কোন প্রয়োজন নেই। ভাবলাম কেসের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া দরকার।তাই কল করলাম।আজ ডিউটিতে যাওনি??
তীব্রঃ না স্যার।দুপুর থেকে প্রচুর মাথাব্যথা করছে।তাছাড়া এমনিতেও কোন জরুরি কাজ নেই। তাই ভাবলাম বাসায় রেস্ট নেই। আর কেসের বিষয়টা স্যার একটু জটিল।কারণ যার নামে কেসগুলো করা আছে তার বেশিরভাগ মিথ্যে কেস স্যার।আমি খোঁজ নিয়েই জানতে পেরেছি।
স্বপনঃ মিথ্যে মানে বুঝলাম না।
তীব্রঃ স্যার,ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো যাচাই করতে গিয়ে আমি সত্যি অবাক হয়ে গেছি।কারণ তার কাজগুলো সব ভালো উদ্দেশ্য। আমি যদি আইনের সদস্য না হতাম তাহলে তাকে অবশ্যই সাহায্য করতাম।এরকম মানুষের খুব প্রয়োজন আমাদের সমাজে।কিন্তু ভালো মানুষের তো শত্রুর অভাব নেই। তেমনি ঐ ছেলেটারও অভাব নেই। তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। আমাদের উচিত তাকে বাঁচানোর।
স্বপনঃ মাথা ব্যাথায় কি তুমি সব ভুলে খেয়ে বসে আছো নাকি তীব্র। তুমি একজন সিনিয়র সিবিআই অফিসার। তোমাকে সাধারণ মানুষের মতো করে ভাবলে চলবে না। তোমার মনকে শক্ত করো এতো ইমোশনাল হয়ো না।মন লাগিয়ে আইনের কাজ করো।তোমার কাজ অপরাধী ধরা।তাদের নিয়ে বিচার বিবেচনা করা নয়।তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।আমি তোমার ভালোর জন্যই তোমাকে বললাম।কাজের ক্ষেত্রে আমাদের ইমোশন দমিয়ে রাখা উচিত। কারণ আমাদের ইমোশনের কোন দাম নেই তীব্র।
শেষের কথাটা স্বপন সাহেব অনেক আক্ষেপ ও বিষন্নতা নিয়ে বললো।তার কথা শুনে তীব্রও অনেকটা দমে গেল।সত্যিই তো তাদের ইমোশনের কোন দাম নেই। চাইলেও তাদের মন মতো চলতে পারে না। কারণ আইনের কাছে তাদের হাত-পা যে বাঁধা। কিন্তু মনে মনে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করছে তাসিনকে সে সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করবে।
#চলবে