তোর রঙে রাঙাবো পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
4258

#তোর_রঙে_রাঙাবো
#Last_Part
#Writer_NOVA

চোখ খুলে আশেপাশে অনেক মানুষ আবিষ্কার করলাম।দুটো ছেলে সমান তালে মারামারি করে যাচ্ছে। চোখ ডলে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম ছেলে দুটো রনি ভাই ও তীব্র। তারা এখানে কি করছে?আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখতে পেয়ে দৌড়ে শরীফ ভাইয়া এগিয়ে এসে আমার মাথায় রিভেলবার ঠেকিয়ে বললো।

শরীফঃ তীব্র, রনি যদি রাইকে বাঁচাতে চাস তাহলে হাতের গান ফেলে দে।নয়তো ওর মাথার খুলি উড়িয়ে দিবো।

শরীফ ভাইয়ার কথায় আমার আত্মা কেঁপে উঠলো। বলে কি তিনি?সে না আমাকে বোনের মতো ভালোবাসে।তাহলে আজ তার মুখে কেমন কথা শুনছি।

আমিঃ কি কি কি বলছেন শরীফ ভাইয়া?আপনার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? আমি আপনার বন্ধু তাসিনের বোন।আপনি না আমাকে নিজের বোন মনে করেন।তাহলে এগুলো কি বলছেন?

শরীফঃ শত্রুর বোনকে নিজের বোন ভাববো।পাগল হয়ে গেছি নাকি আমি?মাথার তার দু-চারটা ছিঁড়লে আমি এসব মনে করতাম।

বা পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ভাইয়ুকে আটকে রেখেছে। আর সামনের দিকে ভাবীর চুলের মুঠি ধরে তার মাথায় গান তাক করে রেখেছে সোহানের ভাই সোহাগ।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তীব্র ও রনি ভাই হাতের গান ফেলে দিলো।

তীব্রঃ আমি গান ফেলে দিয়েছি।তুই আমার রাইয়ের কিছু করিস না।তুই যা বলবি তাই করবো। তাও আমার রাইকে ছেড়ে দে।

শরীফঃ গুড বয়।নিজের ভালোবাসাকে জয় করতে একজন সিবিআই অফিসার হয়ে সমোন্ধীকে সাহায্য করতে চলে এসেছিস।এতো দারূণ দারূণ আইডিয়া তোরা পাস কোথায়?ওফস সরি।তোরা তো সিবিআই অফিসার। তোদের মাথায় যদি এসব বুদ্ধি না থাকে তাহলে কার থাকবে?

হাসিবঃ শরীফ,সোহাগ যদি নিজেদের ভালো চাস তাহলে ভাবী আর বোনকে ছেড়ে দে।

শরীফ ভাইয়ার দুটো লোক এসে রনি ভাই কে ধরে ফেললো।তীব্রকে ধরতে গেলে শরীফ মানা করলো।

শরীফঃ ওকে ধরিস না।ওকে ধরলে তাসিনকে মারবে কে?তীব্র তুই তো বললি যে আমি যা করতে বলবো তাই করবি।নয়তো রাই ছাড়া পাবে না। তাই তুই এখন নিজ হাতে তাসিনকে গুলি করবি।

তীব্রঃ আমি পারবো না।

শরীফঃ না পারলে তোর রাইকে ওপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।

আমিঃ তীব্র, আপনি আমার চিন্তা করেন না।আমার যা খুশি হোক।কিন্তু আপনি ভাইয়ুকে গুলি করবেন না।আপনার পায়ে পরি।এমন কাজটা আপনি করেন না।(কাঁদতে কাঁদতে)

তাসিনঃ তীব্র, তুমি রাইপরীর কথা শুনো না।আমাকে শুট করো।কামোন শুট মি।আমি বলছি কামোন শুট মি।আমি মরে গেলে কিছু হবে না। কিন্তু আমার পুষ্প ও রাইপরীর মৃত্যু আমি সহ্য করতে পারবো না।

তীব্রঃ আমি এখন কি করবো?রাই আমার দুনিয়া।আর রাইয়ের দুনিয়া হলো তাসিন। এখন কি আমি নিজের দুনিয়া পাওয়ার জন্য রাইয়ের দুনিয়া শেষ করে দিবো।না না আমি এ পারবো না।

সোহাগঃ ওকে তোমার পারতে হবে না। আমিই আসান করে দিচ্ছি।আল বিদায় তাসিন।

একটা গুলির শব্দে পুরো গোডাউন কেঁপে উঠলো। আমি ও পুষ্প ভাবী চিৎকার করে উঠলাম।কিন্তু চোখ খুলে যা দেখলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে রনি ভাই পরে গেল।

আমিঃ রনি ভাইয়া——–
তাসিনঃ হাসিব——
তীব্রঃ রনি——

সোহাগ যখন গানটা তাসিনের দিকে তাক করলো তখনি রনি ঝাড়া মেরে লোকদের কে ফেলে তাসিনকে আগলে দাঁড়িয়ে ছিলো।কিন্তু একটা ইটের টুকরোর সাথে বেজে পরে যেতে নিলে গুলিটা রনির মাথায় লাগে।মুখ থুবড়ে পরে যায় রনি।আজ তার জীবন স্বার্থক হয়েছে। কিছু একটা বলতে চাইছিলো তাসিনকে। কিন্তু তার আর বলা হলো না। পুরো স্পট ডেড হলো হাসিবুর রহমান রনি। তাসিন চোখ বন্ধ করে কান্না করছে।রাই চিৎকার করে মাটিতে বসে পরেছে।আর পুষ্পর মাথা ঘুরাচ্ছে। এই ফাঁকে তীব্র খুব জলদী সামনের দিক থেকে সরে এসে তাসিনের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলো।তাসিন দৌড়ে হাসিবকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।

তাসিনঃ হাসিব কি করলি তুই এটা?আমাকে বাঁচাতে নিজের জীবনটা দিয়ে দিলি।কে বলেছিলো তোকে আমার জন্য মরতে।তুইও আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলি।আমি তোকে ছাড়বো না।নিজে মরে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে মহান হয়ে গেলি তুই। সবসময়ের মতো এবারো আমায় রক্ষা করলি।

ঘটনার আকস্মিকতায় শরীফ ও সোহাগ দুজনেই বোকা হয়ে গেলো।তাসিন কিছু সময় কান্না করে সামনে থাকা গানটা তুলে নিলো।পরপর কতগুলো গুলিতে সোহাগের দেহটা ঝাঁঝড়া করে দিলো।পুষ্প একটা চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।সোহাগ নিচে পরে গেলো।এরপর শুরু হলো ইচ্ছে মতো ফাইটিং।

ভাইয়ু শরীফের সাথে ফাইটিং করছে।তীব্র ওদের লোকের সাথে লড়ছে।আর নিথর হয়ে পরে আছে রনি ভাইয়ের লাশটা।মাত্র ৫ মিনিট আগেও এর মধ্যে প্রাণ ছিলো।মাথার পাশ দিয়ে রক্তের সরু লাইন বয়ে গেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাবীকে ধরে বসলাম।কারণ তার মাথা ঘুরাচ্ছে। ভাবীকে নিচে বসিয়ে আমিও পাশে বসে পরলাম।রনি ভাইয়ের লাশটার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। এই মানুষটা আমাকে নিজের আপন বোন ভাবতো।আজ আমার ভাইকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজের জীবন দিয়ে দিলো।

🌺🌺🌺

তাসিন দেখতে পেলো ওর বোন ও বউয়ের দিকে শরীফের দুটো লোক এগিয়ে আসছে।হাতে থাকা গানটা নিয়ে যেই এগিয়ে আসতে যাবে তখনি পেছন থেকে ওকে শরীফ গুলি ছুঁড়লো।একটা গুলি পুরো হার্ট ফুটো করে বের হলো,আরেকটা তার হার্টের ডান পাশ দিয়ে ।তাসিন কিছুটা ঘাড় বাঁকিয়ে হাতে থাকা গান দিয়ে শরীফকে কয়েকটা গুলি করলো।তাতে শরীফ মুখ থুবড়ে নিচে পরে গেল।আর তাসিনের হাত থেকে গানটা পরে গেল।নিজের বোন ও বউয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে মাটিতে পরে গেল।এই দৃশ্যটা রাই কিংবা পুষ্প কখনি ভাবেনি।দৌড়ে ওর কাছে চলে এলো।পুষ্প মাটি থেকে তাসিনের মাথাটা তুলে নিজের কোলে রাখলো।

পুষ্পঃ তাসিন এই তাসিন? কি হয়েছে তোমার?তুমি পরে গেলে কেন?তোমাকে ওরা গুলি করলো কিভাবে?

আমিঃ ভাইয়ু,কি হয়েছে তোমার?তুই হঠাৎ পরে গেলি কেন?তোর কিচ্ছু হবে না। আমরা কিছু হতে দিবো না। তীব্র, তীব্র জলদী এম্বুলেন্স কল করো।আমার ভাইয়ুর কিছু হতে দিবে না।

তীব্রঃ তাসিন তোমার কিছু হবে না। তুমি একটু অপেক্ষা করো।আমি এখুনি গাড়ি নিয়ে আসছি।

তীব্র উঠে যেতে নিলে তাসিন ওর হাতটা ধরে ফেললো।তারপর ইশারায় ওর পাশে বসতে বললো।কাঁপা কাঁপা গলায় বললো।

তাসিনঃ তীব্র, তুমি ব্যস্ত হয়ো না। আমার সময় শেষ। আমি তোমার হাতে আমার রাইপরীকে তুলে দিচ্ছি। ওর যত্ন করো।তুমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই।

আমিঃ তুমি কি বলছো এসব ভাইয়া।তোমার কিছু হবে না। আমরা কিছু হতে দিবো না। (কাঁদতে কাঁদতে)

তাসিনঃ কাঁদিস না রাইপরী, তুই কাঁদলে আমার অনেক কষ্ট হয়।আমায় মাফ করে দিস।আমি তোকে সারাজীবন দেখে রাখতে পারলাম না।কিন্তু তীব্র তোকে দেখে রাখবে।ও অনেক ভালো ছেলে।

আমার হাতটা তীব্রর হাতের ওপর রাখলো।তারপর পুষ্প ভাবীর দিকে তাকালো।

তাসিনঃ প্লিজ পুষ্প কেঁদো না।তুমি কাঁদলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।

পুষ্প তাসিনের হাতটা নিয়ে নিজের পেটে রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললো।

পুষ্পঃ তাসিন তুমি বাবা হতে চলেছে।তুমি চলে গেলে আমাদের সন্তানের কি হবে বলো?ওকে তুমি এতিম করে দিয়ে কোথায় যাচ্ছো?ও যদি জিজ্ঞেস করে আমার বাবা কোথায়? আমি কি উত্তর দিবো।

তাসিন কথাটা শুনে খুশিতে কান্না করে দিলো।এখন যে তার মরেও শান্তি। অথচ সে এমন একটা পরিস্থিতিতে এই খুশির খবরটা পেলো যে তার হাতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় বাকি আছে।তাসিন নিজের ডান হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে ছিলো।সেই হাত রক্তে ভিজে গেছে। সেই রক্ত মাখা হাত পুষ্পর দুই গালে স্পর্শ করে বললো।

তাসিনঃ আজকে সত্যিই আমি অনেক খুশি।আমরা সবসময় বলতাম তোর_রঙে_রাঙাবো। আজ সত্যি সত্যি তোমাকে আমার রঙে রাঙিয়ে দিলাম।আমার সন্তানকে নিয়ে ভালো থেকো।ওর মাঝে তুমি আমাকে খুঁজে পাবে।আমি তোমার ভাগ আর কাউকে দিতে পারবো না। তাই কখনও বিয়ে করো না পুষ্প।তাহলে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না।

তাসিন ঠোঁট চেপে নিজের কান্না কন্ট্রোল করছে।মাথাটা সামান্য উঁচু করে পুষ্পর পেটে ঠোঁট ছোঁয়ালো।কিন্তু মাথাটা আর উঠালো না।পুষ্প তাসিনের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে মাথাটা উঠাতেই দেখতে পেলো সে আর নেই। তাসিনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো পুষ্প।রাই ও জোরে কাঁদছে। তীব্রর চোখ থেকে টপটপ করে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো।

পুষ্পঃ কেন চলে গেলে আমাকে ছেড়ে? তুমি তো বলেছিলে আমার সাথে বাকি জীবন কাটাবো।কেন চলে গেলি আমাকে ছেড়ে? আমি এখন কি নিয়ে থাকবো?তুই স্বার্থপরের মতো আমাকে ছেড়েই পাড়ি দিলি পরপারে।আমি এখন কিভাবে তোর_রঙে_রাঙাবো নিজেকে? চুপ করে আছিস কেন কথা বল?

আমিঃ ভাবী, ভাইয়া আর নেই। আমি কাকে ভাইয়ু বলে ডাকবো?ও আমাকে ছেড়ে এভাবে কেন চলে গেল?আজ ওকে আমরা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম না?তাই আমরা নিজেরাই অনেক বড় সারপ্রাইজ পেয়ে গেলাম।

পুষ্পঃ তাহা,ওকে উঠতে বলো না।আমি ওর সব কথা শুনবো।ওকে আর কখনো ভুল বুঝবো না।ও যা বলবে তাই করবো। আমি জানি ও আমার সাথে দুষ্টুমী করছে।একটু পরেই ও উঠে যাবে।কিন্তু তুমি ওকে এখুনি উঠতে বলো।আমাদের বাড়ি যেতে হবে তো।ও তীব্র ভাই,আপনি বলুন না ওকে উঠতে। আমি ওর কথার অবাধ্য হবো না।কিন্তু ওকে উঠতে বলুন।বাসায় গিয়ে আমাদের সন্তানের জন্য সবকিছু রেডি করতে হবে তো।কিন্তু ও আমার সাথে রাগ করে এখানে শুয়ে থাকলে কি হবে।

পুষ্পর কান্না করতে করতে পাগলের মতো বিলাপ করছে।ওর কান্নার শব্দে পুরো গোডাউনে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো।রাই ওকে ধরে কান্না করছে।আবির দৌড়ে ওদের দিকে আসছে।চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে পেলো সব লোক চিৎ কাত হয়ে পরে আছে। একটু সামনে যেতেই নিজের দুই বন্ধুর লাশ দেখতে পেলো সে।হাঁটু গেড়ে ধপ করে বসে পরলো আবির।এতকিছু ঘটে গেছে। আর কিছু সময় আগে সে খবর পেয়েছে। তাই ছুটে চলে এসেছে। কিন্তু এসে যে এমন কিছু দেখবে তা সে ভাবেনি।

🌺🌺🌺

৮ বছর পর……….

তাসিনের বিশাল বড় ফটো ফ্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্প। গায়ে তার সাদা শাড়ি।ঠিক তখুনি বাইরে থেকে বছর সাতেকের একটা ফুটফুটে ছেলে দৌড়ে রুমে ঢুকলো।

আজানঃ আম্মু দেখো না তীর্য আমার সাথে খেলবে না বলছে।বল তো ও ছাড়া কি আমি কারো সাথে খেলি?কিন্তু তীর্য সেটা বুঝতেই চায় না।

পুষ্প ছেলের দিকে তাকালো। একদম হুবাহু বাবার কার্বন কপি।একবার ওপরের তাসিনের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আবার আজানের দিকে তাকালো।

পুষ্পঃ তীর্যর হয়তো ভালো লাগছে না। তাই খেলছে না বাবা।ওর যখন ভালো লাগবে ও খেলবে।সবসময় খেলতে কি ওর ভালো লাগে বলো।

আজানঃ আম্মু তুমি কাঁদছো কেন? তুমি আব্বুর ছবির সামনে এলেই কান্না করো।এটা কিন্তু ঠিক নয়।আচ্ছা আম্মু,আব্বু কি আর আসবে না? আমাদের সাথে এত রাগ করে আছে কেন?ঐ আকাশের তারা থেকে কি মানুষ হবে না?

ছেলের কথা শুনে পুষ্প আর কান্না আটকে রাখতে পারলো না। দুই হাত জড়িয়ে আজানকে ধরে কাঁদতে লাগলো।

পুষ্পঃ নাহ্ বাবা।তোমার আব্বু আর আসবে না। ঐ আকাশের তারা হয়েই আমাদের দেখবে।

আজানঃ তুমি প্লিজ আর কান্না করো না। তোমার চোখের পানি আমার ভালো লাগে না। আব্বু যদি ওপর থেকে আমাদের এভাবে কাঁদতে দেখে তাহলে কি রাগ করবে না বলো?আমি জানি অবশ্যই রাগ করবে।তুমি চোখের পানি মুছো।

আজান তার ছোট ছোট হাত দিয়ে পুষ্পর চোখের পানি মুছে দিলো।তখনি রুমে ঢুকলো পাঁচ বছরের আরেকটা ছেলে।

তীর্যঃ আজান ভাইয়া,আজান ভাইয়া।আমার সাথে খেলবে না?আমি সত্যি তোমার সাথে আর রাগ করবো না।চলো আমরা একসাথে খেলবো।

আজানঃ তোর সাথে কথা নেই তীর্য।তুই তখন আমার সাথে খেলবি না বলে মানা করে দিলি কেন?এখন আমি তোর সাথে খেলবো না।

তীর্যঃ আমি আর মানা করবো না। চলো আমরা খেলতে যাই। আমার সব খেলনা তোমাকে দিয়ে দিবো।তাও তুমি আমার সাথে খেলো।মামী-মা তুমি আজান ভাইয়াকে আমার সাথে খেলতে বলো না প্লিজ।আমি ভাইয়ার সব কথা শুনবো।

পুষ্পঃ আজান বাবা তীর্য যখন এতো করে বলছে যাও খেলতে যাও।দুজন মিলেমিশে থাকবে।

রাই রুমে ঢুকতে ঢুকতে তাদের কথা শুনতে পেলো।সে এসেছে সবাইকে খেতে ডাকতে।

আমি রুমে ঢুকতেই দুই ছেলের কথপোকথন শুনতে পেলাম।কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম।

আমিঃ কি হয়েছে ভাইদের মধ্যে। তীর্য, আজান বাবা তোমরা কি নিয়ে কথা বলছো?

পুষ্পঃ তাদের কথা তো তুমি জানোই।এই কথা কাটাকাটি করবে আবার এই দুজনের মধ্যে ভাব জমবে।তাদের মাঝে আমরা কথা বললেই বিপদে পরবো।দুই ভাই যেনো দুজনের কলিজার টুকরো।

আমিঃ আজান, তীর্য। খাবার খেতে চলো।

তীর্য ও আজান গলা ধরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কে বলবে একটু আগে তাদের মধ্যে মনমালিন্য হয়েছে। পুষ্প ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

পুষ্পঃ তীব্র চলে এসেছে?

আমিঃ হ্যাঁ, আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। তুমি আবারো ভাইয়ুর ছবির সামনে এসে কান্না করছো।ভাইয়ু নিশ্চয়ই ওপর থেকে দেখে কষ্ট পাচ্ছে। তুমি নিজের শরীরের যত্ন কেন নেও না? তোমার একটা সাত বছরের ছেলে আছে।ওর জন্য তোমাকে ভালো থাকতে হবে। সেটা কেন বুঝো না।

পুষ্পঃ তোমরা না থাকলে এতদিন হয়তো আমি ও আজান শেষ হয়ে যেতাম।তোমাদের যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো তা আমার জানা নেই। নিজের সংসার ছেরে আমার সংসার গুছিয়ে দিয়েছো।আমার আজানকে তো তুমি বড় করলে।তোমাদের ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না।

আমিঃ ছি, ছি। কি বলছো তুমি? এটা তোমার প্রতি আমাদের দায়িত্ব। এসব কথা আর কখনো বলবে না। তাহলে কিন্তু রাগ করে এখান থেকে চলে যাবো।

পুষ্পঃ আচ্ছা, আর বলবো না। নিচে চলো।ওরা তিনজন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

পুষ্প ভাবীকে সাথে নিয়ে নিচে নেমে এলাম।এসে দেখি তীর্য,আজান ও তীব্র আগের থেকে টেবিলে বসে আছে।

তীব্রঃ এই তোমাদের আসার সময় হলো??সেই কখন থেকে খালি প্লেট নিয়ে বসে আছি।খুদায় আমার পেটে ইঁদুরে ড্রাম বাজাচ্ছে।

আজানঃ আমারো।
তীর্যঃ আমারো।

আমিঃনিজেরা নিয়েও তো খেতে পারতে।আমাদের জন্য বসে আছো কেন?

পুষ্পঃ তাহা,ছাড়ো তো।খেতে বসো।কথা বললেই কথা বাড়বে।

🌺🌺🌺

আমরা খাবার বেড়ে নিজেরাও বসে পরলাম।খাওয়া শেষ করে পুষ্প ভাবীর সাথে কিছু কথা বলে রুমে গিয়ে দেখি তীব্র নেই। তীর্য ঘুমিয়ে আছে। তীর্যর মাথায় হাত বুলিয়ে পা বাড়ালাম ছাদের দিকে।আমি জানি এখন আমার স্বামী মহাদোয় কে ছাদেই পাওয়া যাবে।ছাদে গিয়ে দেখি দুই হাত ছাদের রেলিঙের মধ্যে রেখে সামনেরর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

আমিঃ কি ভাবছো?

তীব্রঃ তুমি এখানে কি করছো?ঘুমাওনি??

আমিঃ প্রশ্নটা আমার, তোমার কাছে?ছেলেকে ঘুম পারিয়ে এখানে কি করছো?

তীব্রঃ রাতের আকাশ দেখছি।যাও ঘুমিয়ে পরো।

আমিঃ তুমি কি করবে?

তীব্রঃ তোর_রঙে_রাঙাবো নিজেকে।

আমিঃ ধ্যাত!! কি যে বলো না।বুড়ো বয়সে ভিমরুতিতে ধরেছে।ঘুমাতে চলো।

তীব্রঃ চলো আজকে রাতের আকাশ দেখি।হাজার তারার মেলা আর উজ্জ্বল জোস্না উপভোগ করি।

আমিঃ আচ্ছা চলো।আইডিয়াটা খারাপ নয়।

আমি দুই হাত দিয়ে তীব্রর এক বাহু জড়িয়ে নিজের মাথাটা ওর কাঁধে রাখলাম।নিজেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের মধ্যে একজন মনে হচ্ছে।আমি না চাইতেও এই মানুষটার প্রেমে বারবার পরি।এখন আমার সবকিছু এই মানুষটাকে ঘিরে।তার রঙে নিজেকে রাঙাতে পেরে আমি ধন্য মনে করি নিজেকে।

কুলসুমা মিজি পুষ্প ও আহনাফ আবেদিন তাসিনের শেষ স্মৃতি আজান।তাসিন মারা যাওয়ার নয় মাস পর আজানের জন্ম।পুরো নাম আরনাফ আবেদীন আজান।একদম বাবার মতো হয়েছে। খুব ভদ্র ছেলে।আর রাইজা আবেদীন তাহা ও ইমতিয়াজ আহমাদ তীব্রর একমাত্র ছেলে রাইয়্যান আহমাদ তীর্য।তীর্য দেখতে অনেকটা ওর বাবার মতো হলেও রাইয়ের কিছু কিছু জিনিস পেয়েছে। পুষ্প ও আজানের সাথেই রাই,তীব্র ও তীর্য থাকে।তাসিন মারা যাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে রাই ও তীব্রর বিয়ে হয়ে যায়।তীর্যর জন্ম রাইয়ের বিয়ের তিন বছরের মাথায়।তাসিন মারা যাওয়ার পর পুষ্প এতটা শক পেয়েছিলো যে অনেকটা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্ট করে রাই ও তীব্র তাকে সামলিয়েছি।আলহামদুলিল্লাহ,তারা এখন অনেক ভালো আছে।এবং নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়েছে।পুষ্পও আজানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত করে বেঁচে আছে।পুষ্প তাসিনের কথা রেখেছে। অন্য কাউকে নিজের জীবন সঙ্গী করে নি।বরং এখনো নিজেকে তাসিনের রঙে রাঙিয়ে রেখেছে। সবশেষে তো তাকে দেখে এটাই বলা যায়,আজও তোর_রঙে_রাঙাবো আমার ভুবন।
হ্যাঁ,পুষ্প পেরেছে তার কথা রাখতে।কয়জন বা পারে সকল বাঁধা পেরিয়ে নিজের প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে তার রঙে নিজেকে রাঙাতে?

তোর রঙে রাঙাবো বলে,
সাজিয়ে রেখেছি আমার উঠোনে।
তোর রঙে রাঙাবো বলে,
তোর স্মৃতি আঁকড়ে ধরেছি পরম যতনে।
তোর রঙে রাঙাবো বলে,
পুরোনো সব স্মৃতি ভাসে আজও দুই নয়নে।
তোর রঙে রাঙাবো বলে,
বেঁচে আছি আজও কারণে-অকারণে।

__________________(সমাপ্ত)__________________