দিন বদলের হাওয়ায় পর্ব-০৫

0
238

#দিন_বদলের_হাওয়ায় [৫]
#তানজিলা_তিহা

রেদোয়ান চাকরি পেয়েছে! কত্ত খুশির খবর আমার জন্য। খুশি হয়ে ব্যাপারটা বাবাকে জানাতে গেলাম। বাবা বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন নামাযের জন্য। আসরের আজান দিয়েছে। বাবা বাড়ির মেইন ফটকের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। দেখলাম পায়রা, শিউলি, মাহবুব, নাহিদ বাড়িতে আসছে। হয়তো কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলো।আমি খুশিতে বাবার কাছে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, বাবা রেদোয়ানের চাকরি হয়েছে!

বাবাও খুশি হলেন। হাসলেন উৎসুক হয়ে বললেন, কবে? কই হইছে?

আজই বাবা। আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে।

তাইলে তো ভালাই। জয়েন দিবো কবে? এনে চাকরি হইলে তোরা থাকবি কনে?

ও বলেছে বাসা ভাড়া করবে।

পায়রাও আমাদের কথা শুনছিলো বোধহয়। আমার কথা শেষ হতেই পায়রা বললো, বাসা ভাড়া করবি কেন রে আপা? তুই তো এখানেই থাকবি। বাসা ভাড়া করবি কি লোক দেখাতে? বাবার সব শেষ করতেই তো দুলাভাইকে দিয়ে এখানে চাকরি নেওয়ালি। এখন আর লোক দেখাতে দূরে থাকার দরকার কি?

পায়রার ওমন কথায় আমি তাজ্জব বনে গেলাম। কি বলছে ও এগুলো? এসব চিন্তা তো কখনোই মাথায় আনি নি আমি। এতোটা আ/ঘা/ত দিয়ে ও কথা বলবে চিন্তা করি নি। ভেবেছিলাম আমার স্বামীর চাকরি হলে সবাই খুশি হবে। কেউ আর আমাকে কিছু বলতে পারবে না। এখন দেখছি জ্বা/লা আরো বেরে গেলো। চাকরি না থাকায় যা শুনতে হয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ শুনতে হবে এই চাকরি যদি ও করে তবে।

শিউলি মুখ বাঁকিয়ে বললো, এগুলো তো বোঝাই যায়। এগুলো কি আর বলা লাগে ভাবি? ওনার স্বামী আর উনি প্ল্যান করেই বোধহয় এখানে এসেছে তারা। থাক ভাবি তুমি আর কিছু বলো না এরপর তোমাকে আবার কি কি বলে দেয়! কাল দেখলে না তোমার মেজ বোন কি বললো!

আমার চোখের নোনাজল গড়ানো শুরু করলো। এখানে চাকরি হাওয়াটা যে মস্ত ভু,ল এটা বুঝতে বাকি রইলো না। চাকরি পেতেই এ কথা শুনতে হচ্ছে। যখন চাকরি করবে তখন কি বলবে? তখন তো আরো বেশি শুনতে হবে! আমি না খেয়ে থাকতে পারবো কিন্তু আমার স্বামীর অ,প,মা,ন আমি সহ্য করবো না। না খেয়ে থাকলে কেউ দেখবে না কিন্তু কথার বেলায় কেউ ছাড় দেবে না। রেদোয়ান এখানে চাকরির দরখাস্ত করে মস্ত ভু,ল করেছে।

বাবা পায়রাকে ধমকে বললেন, পায়রা দিন দিন তো তুই অনেক বে/য়া/দ/ব হইয়া যাইতাছোছ। আর শিউলি তুমি আমগো পরিবারের মইধ্যে কথা কও কেন? এডা তো তোমার উচিত না।

পায়রা বাবাকে তৎক্ষণাৎ বললো, তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারলা বাবা? উচিত কথা বললেই বে/য়া/দ/ব হয়ে যায় মানুষ তাই না? জামাইয়ের চাকরি নেই অন্যের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে এটা কি মিথ্যে কথা? এটা বললেই বে/য়া/দ/ব? আবার এখন নাকি চাকরি হয়েছে তাও একটা প্রাইমারি স্কুলে কত বেতন পাবে শুনি? এই বেতনে কি তার সংসার চলবে? তোমার কাছে আছে আর ঠিকই তখন তোমাকে ভে/ঙে খাবে। এটা তো আর মিথ্যা নয়। আমি এগুলো বলতে গেলেই দো/ষ। আমরা তো নিজের পয়সায় খাই। এগুলো বললেই তোমাদের কাছে ভালো না।

শিউলি বললো, আপনি আমাকে এভাবে বলতে পারলেন তালই সাহেব? ভাবি তোমাদের বাড়িতে প্রত্যেক পদে পদে আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে আমাকে অ/প/মা/ন করা হচ্ছে আমি এই জন্যই এই বাড়িতে আসতে চাই নি। আমাকে এভাবে অ/প/মা/ন করানোর জন্য তোমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছো?

ওর কথায় পায়রা রেগে বললো, বাবা আমার ননদকে তুমি এ কথা বলতে পারো না। ও তোমাদের এখানে খাওয়ার জন্য আসে নি। বেড়াতে এসেছে। এভাবে অ/প/মা/ন করতে পারো না তুমি।

পায়রার কথায় খুব অবাক হলাম। তার মানে আমি কি এখানে খাবারের জন্য এসেছি? ওরা আমাকে কি পেয়েছে? ওদের নজরে আমি এতোটাই তু/চ্ছ? বললাম, পায়রা আমি কি এখানে খাওয়ার জন্য এসেছি?

সে তোরটা তুই জানিস তুই কেন এসেছিস। সবার মধ্যে ঝ/গ/ড়া লাগাতে এসেছিস তুই। একের পর এক সমস্যা লেগেই আছে এ বাড়িতে। শুধু তোর জন্য। তোর জন্য বাবাও দেখতে পারে না আমাদের।

ভীষণ আশ্চর্য হলাম। পায়রা চলে গেলো। কি বলে গেলো ও এগুলো? বাবা নিশ্চুপ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলতে পারছেন না। আমি বাবাকে নামাজ পড়তে যেতে বলে ঘরে চলে আসলাম। এটা খুব বুঝতে পেরেছি রেদোয়ান এখানে চাকরি করতে পারবে না। তাহলে মানুষের কথা শুনে শুনেই আমাকে ম/র/তে হবে। ও বাড়িতে না খেয়ে থাকলে শাশুড়ি আর জা দের কথা শুনবো। কিন্তু এখানে নিজের পরিবারের লোকজন, নিজের আপনজনদের নানান কথা শুনতে হবে। যা আমি স/হ্য করতে পারবো না।

রেদোয়ান বিছানায় শুয়ে আছে। আমাকে মন খারাপ করে ঘরে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, আয়ু তোমার চোখ মুখ ফুলে আছে কেন? তোমার মন খারাপ কেন?

কি বলবো তাকে? তাকে চাকরি করতে কি করে বারণ করি আমি? বেকার থাকাটা কত কষ্টের সেটা যে থাকে সে ভালো বোঝে। এখন যদি তাকে আমি এগুলো বলি তবে সে কি সহ্য করতে পারবে? আমি কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে বললাম, রেদোয়ান তোমাকে এখানে চাকরি করতে হবে না।

রেদোয়ান ভীষণ অবাক হলো। আমাকে প্রতিউত্তরে প্রশ্ন করলো, কেন আয়ু?

না বলেছি তো নাই। না খেয়ে আমি থাকতে পারবো কিন্তু মানুষের কথা শুনতে পারবো না। এখানে তোমার চাকরি করা লাগবে না।

রেদোয়ান হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে কেন আমি চাকরি করতে বারণ করেছি। তাই সে আর কথা বাড়ালো না। আমি নিশ্চুপ বসে রইলাম। পায়রার সাথে আমার কি শ/ত্রু/তা আছে তা ভাবতে লাগলাম। মানুষ হয়তো বা শ/ত্রু/র সাথেও এমন ব্যবহার করে না যেমন ও আমার সাথে করছে। আজ ওরা ভালো অবস্থানে আছে তাই আমার সাথে এমন করতে পারছে। আচ্ছা ভবিষ্যতে যদি ও আমার অবস্থানে আসে তখন? ও কি এসব একটুও ভাবছে না? মানুষ কি সব সময় এক অবস্থায় থাকে নাকি? সব তো বিধাতার হাতে। কখন কাকে কোন অবস্থায় রাখবেন তা তিনিই ভালো জানেন। আমিও তো একদিন ওর মতো অবস্থায় ছিলাম। বরং ওর থেকে ভালো অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু আমার সাথে কি হলো! নিয়তি আমার বড্ড ক/রু/ণ!

রেদোয়ান আর বাড়ি থেকে বের হলো না আজ। তখন থেকেই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। আমিও কোন কথা বলি নি। কি বা বলবো আমি? আমি তার থেকে তার একটু ভালো থাকার চেষ্টাটাকে কেড়ে নিতে চাচ্ছি!

সন্ধ্যায় বড় খালা আমাদের বাড়িতে আসলেন। মা তার সাথে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত। পায়রা, শিউলি একপাশে বসে তাদের কথা শুনছে। আমি খালার জন্য পান বানিয়ে দিচ্ছি। কথা বলার এক পর্যায়ে আমাকে নিয়ে কথা উঠলে মা বললেন রেদোয়ানের চাকরি হয়েছে। খালাও খুশি হয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললেন। কিন্তু মাঝে ফোড়ন কাটলো পায়রা। বললো, ‘বুঝেছো খালা আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেই চাকরি হয়েছে। এখন ঘরজামাই থেকে এখানে চাকরি করবে। তুমিই বলো খালা প্রাইমারি স্কুলের সামান্য বেতনে কারো সংসার চলে?’

পায়রার কথায় লজ্জায় আমার মাথা কা/টা যাচ্ছে। আমি লজ্জায় কোন কথা বলতে পারলাম না। খালাও কেমন যেন করে তাকিয়ে আমার দিকে। ও যেভাবে কথাটা বলেছে এর জন্য এভাবে তাকিয়ে থাকাটা স্বাভাবিক। আমি খালাকে পান দিয়ে ঘরে চলে আসলাম। রেদোয়ান শুয়ে ছিলো। আমি রেদোয়ানকে এসেই বললাম, ‘রেদোয়ান আমি আর এ বাড়িতে থাকবো না। ম/রে গেলেও আর এ বাড়িতে আসতে চাইবো না। আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি এখানে থাকলে আমি ম/রে/ই যাবো! আর সহ্য করতে পারছি না এসব!’

চলবে…..