দিন বদলের হাওয়ায় পর্ব-১২

0
218

#দিন_বদলের_হাওয়ায় [১২]
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)

কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশের কণ্ঠস্বর শুনে চোখ থেকে পানি বেরিয়ে এলো। পায়রা ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করতেই পায়রার আনন্দ ধ্বনির মিছিল শুনতে পেলাম। পায়রা খুশিতে আটখানা হয়ে বললো, আপা দেখেছিস দুলাভাইয়ের কোম্পানি খুলেছে। কত ভালো হয়েছে বল না আপা? ইস্ আমার যে কি খুশি লাগছে। তোদের জন্য যে দিনে কত দোয়া করি।

পায়রার পাশেই মনে হয় শিউলি ছিলো। সে ফোনের কাছে এসে বললো, বড় আপা মিষ্টি কবে খাওয়াচ্ছেন? ভাইয়ার তো কপাল খুলে গেলো।

ভীষণ হতবাক আমি। কি বলবো বুঝতে পারছি না। ওরা দুজনেই নানান কথা বলছে। কিন্তু এগুলো আমার কানে ভাসছে না। আমার কানে ভাসছে সেই এক মাস আগে ওদের বলা কথাগুলো। ওরা দুজন সেবার কত কথাই না আমায় শুনালো! কত্ত খোঁটা দিলো। আমার স্বামী ছোট একটা চাকরি পেয়েছিলো তাও করতে পারলো না! আর এখন এরা? এতো তাড়াতাড়ি বদলে গেলো। মানুষ তো গিরগিটি থেকেও জলদি রং বদলাতে পারে। এদের সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছেই আমার হচ্ছে না। এরা আমার মনে যে দাগ কেটেছে সে দাগ কোনভাবেই মুছে ফেলার নয়। কথা বলতে বেশ ঘৃ/ণা হচ্ছে। আমি ফোনটা কেটে দিলাম। এরপর বালিশের কাছে ফোনটা রেখে চুপচাপ বসে রইলাম কিছুক্ষণ। ভাবতে লাগলাম সেদিনের কথাগুলো। এই তো গত এক মাস আগে যে বাপের বাড়ি গেলাম তখনকার চিত্রগুলো কত ভয়ংকর ছিলো আমার জন্য। আমার বোনেরা আমাকে তখন মানুষ ভাবে নি। তারা তখন আমায় কি ভেবেছে আর কেমন ব্যবহার করেছে তা আমি আর আল্লাহই ভালো জানেন। আর এখন! সব বদলে গেছে।

আমার ভাবনার সমাপ্তি ঘটলো রান্নাঘরে পাতিল পড়ার শব্দে। বিস্মিত হয়ে জলদি উঠে চুলের খোঁপাটা বেঁধে রান্নাঘরে গেলাম। দেখলাম জুলির হাত থেকে ভাজির কড়াই পড়ে গেছে। জুলি বেসিনে গিয়ে হাতে পানি দিচ্ছে আর কাতর ধ্বনি আওরাচ্ছে। শান্তি পাশেই দাঁড়িয়ে বলছে, দেখে কাজ করবে তো ভাবি।

সমস্ত রান্নাঘরের নাজেহাল অবস্থা। আমি পাশ দিয়ে কোনমতে জুলির কাছে গেলাম। গিয়ে বললাম, দেখি তো পুড়ে গেছে নাকি? কে বললো তোমাকে এসব কাজ করতে? আমিই তো করতাম। দেখো এখন কি করলে হাতের? যাও ঘরে যাও হাতে একটু পেস্ট দাও।

জুলি কল বন্ধ করতে করতে বললো, বেশি লাগে নি ভাবি। ও ঠিক হয়ে যাবে। আমি পারবো। তুমি ঘরে যাও।

বলেই জুলি ফ্লোর পরিষ্কার করতে লাগলো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখছি। জুলির ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা একদম লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ফোস্কা পড়বে। এসব দেখছি আর ভাবছি। গত তিন চার মাস আগে হবে জুলি একদিন সকালে চা করতে রান্নাঘরে গিয়েছিলো। তখন সামান্য চা ছিটকে ওর হাতে পড়েছিলো। তাতে জুলির সে কি রাগ। আমায় কত কথা শুনালো। ওকে চা করে ঘরে দিয়ে আসতে পারি না কেন, চা এতো গরম রাখলাম কেন, এই পাতিলে চা করলাম কেন এমন আরো কত কি যে শুনলাম! আর আজ সেই জুলি হাত পুড়ে যাওয়ার পরও কিছু বলছে না। বাহ্ কত্ত সুন্দর দৃশ্য! আমি আর কিছু বললাম না চুপচাপ ঘরে চলে গেলাম। রেদোয়ান উঠে খাটের উপর বসে আছে। তার চোখে এখনো ঘুম। আমি ওর পাশে বসতে বসতে বললাম, আমি তো রাজরাণীর আসন পেলাম।

রেদোয়ান ঘুমের চোখেই বললো, কেন কি হয়েছে?

রান্নাঘরের ধারেকাছেও যেতে দিচ্ছে না।

রেদোয়ান হাসলো। বললো, সবে তো শুরু। আস্তে আস্তে কত কি দেখবে!

আমি কিছু বললাম না। রেদোয়ান উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

সকালের নাস্তা তৈরি হতেই শান্তি এসে ডেকে গেলো। সকালের খাবারটাও হলো রাতের মতোই রাজকীয়। আমি তো ভীষণ আশ্চর্য। এই বুঝি আমার হা/র্ট অ্যা/টাক হলো। কিছু বললাম না। গতকাল থেকেই সবার তামাশা দেখে যাচ্ছি। সকালের নাস্তার পর আর কোন কাজ নেই আপাতত। সবাই জোরদার পরিশ্রমে লেগেছে। আমাকে পেনশনি দেওয়া হয়েছে। ভাবলাম স্বর্ণা ভাবির সাথে কথা বলে আসি কিছুক্ষণ। রেদোয়ানও বাড়িতে নেই। ও অফিসে গেছে। সকালেই ওর বস ফোন করে ওকে ডেকেছে। আমি স্বর্ণা ভাবিদের বাসায় গেলাম। আমি দরজায় কলিং বেল বাজাতেই ভাবি দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, ভাবি ভিতরে আসেন।

আমি ভিতরে গেলাম। ভাবি আমাকে বললেন, তা ভাবি আপনাদের ঘরের অবস্থা কেমন? আপনার দুই জাকেই তো দেখলাম ভীষণ তড়িঘড়িতে আছে।

আমি হেসে ফেললাম। বললাম, হ্যাঁ ভাবি তা তো থাকবেই। গতকালই আমাকে রিটায়ার্ড দেওয়া হয়েছে। এখানের কুটাও ওখানে নিতে দেয় না।

তাহলে তো আপনার অবস্থা রাজকীয় হয়ে গেছে। বাব্বাহ্ খবর শুনেই এই অবস্থা। না জানি চাকরিতে জয়েন দিলে কি হয়!

তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। ওদের অবস্থা দেখলে কেউ বলবে কাল অব্দিও ওরা আমার সাথে জঘন্য আচরণ করেছে!

কি বলবো আর ভাবি। গিরগিটিও রং বদলাতে আপনার বাড়ির মানুষ থেকে বেশি সময় নেয়। সব কিছুকে হার মানাতে পারবে ওরা।

আমি হাসলাম। স্বর্ণা ভাবি বললো, আপনি বসেন আমি চা করে আনছি।

না ভাবি এখন আর কিছু খাবো না। সকালে যেই খাবার খেয়েছি!

ও মা কি বলেন?

ঠিকই বলেছি। স্বপ্ন দেখছি মনে হচ্ছে।

আমার কথার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠল। স্বর্ণা ভাবি গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। আমার চক্ষু চড়কগাছ। আমার শাশুড়ি এসেছে। আমার শাশুড়ি আমাকে বললেন, তুমি এনে কি করো বউ মা? আমি সারা বাড়িতে তোমারে খুঁইজা অস্থির হইয়া যাইতাছি। ঘরে চলো জলদি।

কি বলবো বুঝতে পারছি না। শাশুড়ি আমার পাশ ঘেঁষে বিড়বিড় করে বললেন, মাইনষের ঘরে কি করো? মাইনষের লগে বেশি মিশবা না। ঘরে চলো। এরা একদমই ভালো না।

আমি কিছু বললাম না। স্বর্ণা ভাবির দিকে তাকাতেই দেখলাম তিনি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমি ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বললাম। তিনি রেগে গেছেন দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমার বারণ করায় আর কিছু বললেন না।আমি শাশুড়ির সাথে ঘরে চলে আসলাম। শাশুড়ি আমার মাথায় তেল দিয়ে বেণুনী করে দিলেন। ভীষণ অবাক আমি। আমার মনে হয় না এভাবে তিনি আর কখনো আমার যত্ন করেছেন। ক্ষণে ক্ষণে মানুষগুলো আমাকে আশ্চর্য করে দিচ্ছে।

বিকেলে রেদোয়ান ফিরলো। ও আসার পর বাবাকে ফোন করে রেদোয়ানের কোম্পানি খুলেছে বললাম। বাবা খুশি হয়েছেন। কিছুক্ষণ বাবার সাথে কথা হলো। এরপর কেটে দিলাম। হঠাৎ মনে হলো রেদোয়ান কেমন যেনো অন্যমনস্ক হয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে তোমার? কি ভাবছো?

ভাবছি আমরা থাকবো কোথায়? এইদিকেই বাসা নেবো নাকি অন্য কোথাও?

আমি বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, মানে? কি বলছো তুমি?

না বোঝার কি আছে? বাসা নিতে হবে না?

কেন? তুমি কি আলাদা থাকার চিন্তা করছো?

রেদোয়ান আমার কথায় বিরক্ত হলো। বললো, আরে পা/গলি এতো তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলে? সেদিন না জুলি আর শান্তি বললো ওরা ওদের বাবার বাড়ি চলে যাবে আর মা গ্রামে। আমরা তো কোথাও যেতে পারবো না। আমরা কোথায় থাকবো? নতুন বাসা নিতে হবে তো নাকি? কোথায় বাসা নেবো?

এতোক্ষণে ওর কথা বুঝলাম। ঠিকই তো। এ বাড়ি তো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে গত মাসেই। এখান থেকে তো এবার যেতে হবে। নতুন বাসা দেখে সেখানে উঠতে হবে। কিন্তু ওদের যা আদর আপ্যায়ন দেখছি ওরা কি যাবে?

চলবে…….

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমা করবেন।)