#দিন_বদলের_হাওয়ায় [১৬]
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
রুশা আপার কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইলাম। ওনার কথাগুলোকে গভীর ভাবে ভেবে চলেছি। আসলে কি বোঝাতে চাইছেন উনি? আপা আমাকে সবটা পরিষ্কার করে বলছেন না কেন? নানান ভাবনা মাথায় উঁকি দিচ্ছে। আমাকে এমন ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে রুশা আপা আবার বললেন, কি ভাবছো আয়রা?
কিছু না আপা। আমাকে একটু বলেন না কি হয়েছে। না বললে টেনশনে আজ আর আমার ঘুম হবে না।
রুশা আপা হাসলেন। বললেন, তাহলে তোমাকে আর টেনশন দিবো না। মা তো গ্রামে চলে গেছে সেই কবেই তা তো জানো?
জ্বি আপা।
আমার মা কেমন মানুষ সেটাও তো বেশ ভালো জানো। গ্রামে তো মা একা আছেন। একাই ঘরের সব কাজকর্ম করতে হচ্ছে তাকে। সেটা তার ভালো লাগছে না। মা গ্রামে থাকতে চাইছেন না। সেইজন্য আরকি ছোট মেয়েকে ফোন করে ডেকে আনছেন।
আমি ভীষণ অবাক হলাম। আমরা কি তাকে গ্রামে পাঠিয়েছি? তার মেজ বউয়ের জন্যই তো সে গ্রামে গেছে! সেই তো শাশুড়িকে গ্রামে পাঠাবে বলেছে। আমি শান্ত ভাবেই বললাম, আমি তো আম্মাকে গ্রামে যেতে বলি নি। ডিসিশন তো জুলি দিয়েছিলো।
হুম। কিন্তু সবটা দেখো তোমার ঘাড়ে পড়বে আয়রা। সাবধানে থেকো। কেউ কিছু বললে ছেড়ে দিয়ো না। তাহলে কিন্তু তোমায় দুর্বল ভেবে বসবে।
আমি নিরব রইলাম।
রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে জহির ভাইয়া রুশা আপাকে নিয়ে গেলেন। রেদোয়ান কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে এসেছে। আমি বাবাকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলাম। রেদোয়ান বললো কাল বাবাকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু সন্ধ্যায় তো শাশুড়ি ফোন করে বললো তারা কাল আসবে। ছোট ননদ ও আসবে। শুনেই তো মনে কু ডাকছিলো। যদি বাবাকে ডাক্তারের কাছে নেই আর ওনারা চলে আসেন তখন কি হবে? তাদের তো কিছু বলতে মুখে আটকায় না। যদি মা বাবাকে কিছু বলে দেয়? এখন কি করবো আমি? টেনশনে পড়ে গেলাম। রেদোয়ান হঠাৎ আমায় জিজ্ঞেস করলো, কি ভাবছো?
কাল তো আম্মা আসবেন। বাবাকে ডাক্তারের কাছে নেই কি করে বলো তো?
মা আসবে দেখে ওনাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া যাবে না? ডাক্তারের কাছে কি সারাজীবন থাকবে নাকি? ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়েই তো চলে আসবে।
তবুও যদি চলে আসে?
আসলে আসবে তাতে কি? চুপচাপ ঘুমাও তো। সকালে আমার অফিস আছে।
ওর কথার পর আর কিছু বললাম না। চুপচাপ শুয়ে পড়লাম।
সকাল বেলা নাস্তা সেরে দশটার দিকে আমি আর মা বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তারের এখানে লম্বা সিরিয়াল লেগেছে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাবাকে ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা দিলেন। সেগুলো করলাম। রিপোর্ট দেখে উনি আরো নতুন কিছু ঔষধ লিখে দিলেন আগের কয়েকটা বাতিল করে দিলেন। বললেন বাবা ভালো আছেন। শান্তি পেলাম শুনে। বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেড়টা বেজে গেলো। বাড়িতে এসে আমার চোখ আপনাআপনিই বড় হয়ে গেলো। যা ভেবেছিলাম গতকাল তাই হলো আমার ছোট ননদ আর শাশুড়ি এসেছেন সাথে রুশা আপাও আছেন। রুশা আপা মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট ননদের চেহারা রাগে লাল হয়ে আছে। শাশুড়ি আমার শান্ত ভাবেই বসে আছেন। আমাকে দেখে আমার শাশুড়ি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন, কেমন আছো মা? কই গেছিলা এতো দেরি হইলো?
আমি স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললাম, ভালো আছি আম্মা। আপনি কেমন আছেন?
আমার শাশুড়িকে কথা বলতে না দিয়ে আমার ননদ বললো, দুই ঘন্টা বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করো কেমন আছে? তুমি কি মানুষ?
তার কথায় তাজ্জব বনে গেলাম। দুই ঘন্টা যাবৎ তারা এখানে এসেছেন তাহলে আমাকে ফোন করলেন না কেন? আমি শান্ত ভাবেই বললাম, আমার বাবাকে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম আপা। আপনারা একটা ফোন করতেন?
আমার ননদ তেজ দেখিয়ে বললো, কেন ফোন করবো কেন? তুমি জানো না আমরা আজকে আসবো তাহলে কোন আক্কেলে বাড়ি থেকে বের হও তুমি? তোমার বাবাকে আজকেই ডাক্তার দেখাতে হলো? বছরেও তো তোমাদের বাড়ি আসি নি। যখন আসি তখন তোমরা দুই ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখো বাড়ির সামনে। এসব মানুষের কাজ?
রুশা আপা ওনাকে বললেন, রুনা তুই থাম এবার। অসুখ কি বলে কয়ে আসে নাকি?
সেটা কিভাবে বলবো আমি? আমার তো তাই মনে হচ্ছে। বলে কয়ে না হলে আজই কেন আসতে হবে? গতকাল সন্ধ্যায় ফোন করে বলেছিলাম না আসবো? যদি অসুখ থাকতো তবে তো ও কালই বলতে পারতো। আজ হঠাৎ অসুখের উদয় হলো কোথা থেকে?
আমি নিরব দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার শাশুড়িও নিরব। মা বাবার দিকে তাকাচ্ছি বার বার। কতটা বাজে পরিস্থিতিতে পড়েছেন তারা। কেউ এভাবে বলে? বাবা তো অসুস্থ তার কেমন লাগছে? আমার চোখ পানিতে টইটুম্বর। সে আবার বললো, এখন কি দরজা খুলবে নাকি আরো দুই তিন ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখবে?
আস্তে করে দরজার সামনে গিয়ে দরজার তালাটা খুললাম। দরজা খোলার সাথে সাথে রুনা আপা দ্রুত ঘরে প্রবেশ করলেন। আর বললেন, ব্যাগগুলো ঘরে নিয়ে এসো।
আমি আর মা বাবাকে ঘরে এনে শুইয়ে দিলাম। এরপর ব্যাগপত্র গুলো বাহির থেকে অনলাম। মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি মাথা নিচু করে নিলাম। মা বললেন, আমরা আমগো বাইত্তে যাই গা রে মা। ডাক্তার দেহানের দিন দিন আইসা ডাক্তার দেখায়া যামু।
না মা। এতো জার্নি বাবার জন্য ঠিক হবে না। তোমরা এখানেই থাকো। ওনারা আর কয়দিন থাকবে? দুই একদিন পরই চলে যাবে।
মা আর কিছু বললেন না। আমি ভিতরের রুমে গেলাম। খাটের উপর রুনা আপা আর শাশুড়ি বসে আছেন। রুশা আপা পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি গায়ের বোরখাটা খুললাম। রুনা আপা আমাকে বললেন, কত দূর থেকে আসলাম। একজন মানুষ বাড়িতে আসলে যে একটু পানি টানি দিতে হয় জানো না? সব খেয়ে ফেলেছো? ফেলবেই তো যে ছেলের বউ শাশুড়িকে দূরে পাঠিয়ে টই টই করে ঘুরে তার আবার এসব সম্পর্কে জ্ঞান থাকে নাকি? মুরুব্বি বাড়িতে না থাকলে এসব মনে থাকে নাকি? এসেই মা বাবার সাথে বিড়বিড় শুরু করে দিলে?
আমি যেন বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। হা করে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এরপর ঘরে থাকা ট্যাং দিয়ে তাদের শরবত গুলিয়ে দিলাম। আমার শাশুড়িকে দেখছি আসার পর থেকেই চুপ আছেন। তিনি আর কি বলবেন সব তো মেয়েকে দিয়ে বলাচ্ছেন। রুনা আপা এক ঢোকে সবটা শরবত খেয়ে নিলেন। এরপর বললেন, তোমার বাবা মা এখানে কতদিন ধরে আছে?
আমি আস্তে করে বললাম, দশ দিন এসেছেন। বাবার টাইফয়েড হয়েছে।
বাব্বাহ্ নিজের মা বাবাকে দশ দিন বাড়িতে রাখতে পারো। আর শাশুড়িকে গ্রামে পাঠিয়ে দাও? ভালো নীতিই তো আবিষ্কার করেছো।
আমরা তো আম্মাকে গ্রামে পাঠাই নি আপা।
তাহলে কি বলতে চাচ্ছো মা নিজের ইচ্ছেয় গেছে? এই বয়সে বুড়ো মানুষটা নিজের কাজ নিজে করতে পারে? কিভাবে পারলে তাকে একা রাখতে?
ওনার কথার মাঝেই আমার মা এলেন। উনি মাকে দেখে বললেন, নিজের বাবা মাকে ঠিকই সাথে রাখছো আর ফূর্তি করছো।
রুশা আপা এগিয়ে এসে রুনা আপাকে বললেন, রুনা চুপ কর তুই। কি বলছিস? ওনারা কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন আর তুই! চুপ থাক।
রুনা আপা তেজ দেখিয়ে বললেন, তুই চুপ থাকলে থাক আপা আমাকে কথা বলতে দে। নিজের মা বাবাকে সাথে রেখে আমার মাকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে কিছু বলবো না আমি? তুই মাকে পর করে দিলে কি আমিও পর করে দিবো? অন্যদের সাথে মিলে দেখছি তো মায়ের সাথে কি ব্যবহার করছিস।
রুশা আপা চুপ হয়ে গেলেন। ভীষণ রকমের অবাক আমি। আমার মায়ের সামনে এসব কি বললেন উনি? মা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে তার কথা শুনে। আমি মায়ের মুখের দিকে তাকানোরও সাহস পাচ্ছি না!
চলবে…..