দুই দুয়ারী
পর্ব ১০
জালাল এমনই ছাত্র, এক টুকরো কাগজ আর পেন্সিলের কথা বলায় তার মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। ইমাম সাহেব সুযোগ পেয়ে ছেলেকে আচ্ছামত বকে মনের সুখ করে নিলেন কিছুখন। অবশেষে আমি হারিকেনের আলোয় চিঠি লিখতে বসলাম।
মিলি,
তুমি যত সুন্দর করে চিঠি লিখেছো, ততো সুন্দর করে আমি লিখতে পারিনা। কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে তোমার চিঠির উত্তর দেই। তাই লিখছি।
জানি তুমি বিশ্বাস করবেনা, আমার জন্ম ২০০১ সনে। সত্যিই, ২০০১। ভাবতে পারো? আর তোমার সাথে আমার দেখা ২০২৩ সনে, এপ্রিল মাসের একুশ তারিখে। সেদিন আমাদের ঈদ ছিল, এক মুহূর্তে স্কুল ঘরের সামনে বট গাছের নিচে আমি দাঁড়িয়েছিলাম, পরের মুহূর্তে কেমন করে জানিনা, পৌঁছে গেলাম এই ১৯৭৩ সনে, তোমার কাছে।
সেই যে তুমি জালালের হাত ধরে স্কুলঘর থেকে বের হয়ে এলে, মনে আছে তোমার? তোমাকে দেখেই আমার মনে হলো, এত সুন্দর মানুষ আমি কোনোদিন দেখিনি! তুমি কি কথায় যেন খিলখিল করে হেসে উঠলে, আর আমি বাঁধা পরে গেলাম।
জানি খুব জরুরী না, তবু ইচ্ছে করে তুমি আমাকে পুরোপুরি জানো, বিশ্বাস করো। এক কাজ করি তোমাকে কিছু ঘটনার কথা বলি, যা এখনো ঘটেনি। যখন সেগুলি ঘটবে, প্রতিবার তুমি হেরে গিয়ে আমাকে পুরুস্কার দেবে।
১. …. সনের…. তারিখে বিশাল একটা ঘূর্ণিঝড় হবে ২. …. সনের…. তারিখে…. মারা যাবেন
৩ …. বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হবেন
৩. অথবা তোমার বাড়ির কাছের কথাই বলিনা কেন?….. নামের একটা কলেজ হবে, প্রতিবার এখানে এলে কলেজের গায়ে প্রতিষ্ঠিত…. সন দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে।
তোমাকে এগুলি বিশ্বাস করাতে চাইছি আরেকটা কারণে, আমি চাচ্ছি তুমি জানো তোমার জন্য আমার ভীষণ আধুনিক সভ্য জীবন ফিরে পাবার ইচ্ছে আমি পুরোপুরি ত্যাগ করেছি। এখন আমি শুধু তোমার কাছে, তোমার পাশে থাকতে চাই। তোমাকে অনেক বড় হতে দেখতে চাই।
তোমাকে একদিন জালাল মিয়ার ভাতের হোটেলের কথা বলেছিলাম না? আমি ওটা হতে দেবোনা। ভাতের হোটেল তোমার ভবিষ্যত হতেই পারেনা। আমরা দুজন একসাথে বড় হবো, একসাথেই আরো ভালো কিছু করবো, দেখো তুমি!
ইমাম সাহেব কালই যাবেন তোমাদের বাড়ি। পরশু আমরা বিয়ে করবো। তারপর তুমি আমাকে আঁচল দিয়ে বেঁধে রেখে দিতে পারবে? আমাকে হারিয়ে যেতে দিওনা। তোমার পায়ে ধরি, আমাকে কোথাও যেতে দিবেনা, কেমন?
পায়ে ধরার কথায় মনে পড়লো, আমি কিন্তু সত্যিই এক জোড়া নুপুর কিনেছি। খুব সস্তা, তবে এটা শুরু। বিয়ের রাতে আমি তোমাকে নিজের হাতে পরিয়ে দেব।
ইতি
তোমার পাগল…
পাগল প্রেমিক লিখবো না স্বামী , অনেকক্ষন ভেবেও ঠিক করতে পারলাম না। প্রেমিক লিখলে মিলি বুঝতে পারবে কিনা জানিনা, আবার বিয়ে করার শখ ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা হওয়া সত্বএও স্বামী লিখতে বেশ লজ্জা করছে।
***
আমাকে ভোরের আলো ফোটার আগেই উঠে পড়তে দেখে ইমাম সাহেব অবাক হলেন না, বরং পা ধোয়ার পানি এগিয়ে দিয়ে দরাজ গলায় হাসতে লাগলেন। আমি কথা বাড়াই না, মাথা নিচু করে পা ধুই।
” আমারে খুশি করতে নামাজে যাইতে হবেনা” প্রায় অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন,উপরে হাত তুলে দেখিয়ে বললেন, ” উনারে খুশি করতে চাইলে ভিন্ন কথা “।
আমি একটু লজ্জা পেলাম, আমার ফাঁকিটা উনি ধরে ফেলেছেন। কথা বলছিনা দেখে নিজেই আবার বললেন, ” আমার কথা হইসে ওর বাপের সাথে। তবু তুমি বললে আজকে আবার যাবো। দিন তারিখ ঠিক করলে…
” কাল ” আমি বলে উঠলাম, ” আগামীকাল করি? ” ভাবছি মিলি যদিও বিয়ের আগে আমার সাথে আর দেখা না করে? সেটা বেশিদিন চালিয়ে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবেনা, আমার ইতিমধ্যেই অস্থির লাগছে।
উনি আবারো হাসছেন, ” তাইলে আজকে কি দোষ করলো? ”
” আজকে দুপুরে কলিম ভাইয়ের বিয়ে। আমার দাওয়াত। ”
***
কলিম ভাই বিয়ে করতে যাচ্ছেন বিশজন লোক নিয়ে, আমি তাদের একজন। কলিম ভাই নিজে,তার বাবা, ছোট ভাই, চেয়ারম্যান সাহেব, নাইমুল একটি গরুর গাড়িতে চড়েছেন। অন্য একটি গরুর গাড়িতে তার ছোট বোন, এক চাচা চাচী, এক ফুপার সাথে আমাকে জোর করে বসিয়ে দিল। কি অদ্ভুত, নিজামুদ্দিন সাহেব ও আছেন বর যাত্রায়, তার নিজস্ব গাড়িতে, সঙ্গে তার আপনার কিছু লোক।
গ্রামের বিয়ে কখনো এভাবে চাক্ষুস করা হয়নি আগে, আমি বেশ কৌতূহল আর আনন্দ নিয়ে সবকিছু অবলোকন করতে লাগলাম। বাকি লোকজন হেঁটেই রওয়ানা করেছে দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলাম।
কলিম ভাইয়ের ফুপা বয়স্ক মানুষ, অজানা কারণে তিনি আমাকে ক্রমাগত ভাইজান বলে ডেকে যাচ্ছেন। ছোট বোনদুটির একজন বিবাহিত, স্বামীর না আসার কারণ ব্যাখ্যা করছে বারবার। আরেকটি বোন আমাকে দেখে লজ্জায় বড় বোনের শরীরের সাথে মিশে যাচ্ছে কেন সেই জানে। আমি বাইরে তাকিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলিকে দেখছি। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছেলে নেচে নেচে বেসুরো গলায় গান গাইবার চেষ্টা করছে।
আমাকে বসিয়ে দিয়েছে কলিম ভাইয়ের পাশে, মুখে রুমাল চেপে রাখা লোকটাকে দেখে আমি হাসি চাপতে পারছিনা। হঠাৎ সে আমার হাত ধরলো, ” ভাই, অস্থির লাগতেসে”
অন্য সময় হলে আমি এই কথায় ও হাসতাম, আজকে পারলাম না। আমি বরং আরেকটা হাত বাড়িয়ে দিলাম, ” বুঝতে পারছি। এইতো আর কিছুক্ষন”।
ভরসা পেয়ে সে ও হাসলো, ” একবার কবুল বইলা ফেলতে পারলে মনে করেন শান্তি। ”
আমি মনে মনে বললাম, আমারও তাই। বিয়ে নিয়ে এই কয়েকটা মাস আগেও আমার চিন্তা ভাবনা খুব সীমিত ছিল, যদি কখনো কিছু ভেবেও থাকি হয়তো অন্য কারো বিয়ে নিয়ে, অথবা বই পড়া জ্ঞান ছিল। অথচ গত কয়েকদিন ধরে এই বন্ধনটাকে কি প্রচন্ড ভালোবাসতে আর সম্মান করতে শিখে গিয়েছি।
আমার মনে হচ্ছে এই একটা বন্ধনের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ অনাত্মীয় একজন মানুষ শুধু আমার হয়ে যেতে পারে। ঠিক সেরকম আমার উপর আরেকজনের পরিপূর্ণ অধিকার জন্মে যেতে পারে। কারো কাছে আসতে চাইলে, কাউকে খুব সুখে রাখতে চাইলে এর উপরে আর কোন উপায় হয়না সত্যি। তবে আমার সন্দেহ হয়, কলিম ভাই এতো কিছু ভাবছে কিনা। হয়তো শুধু আমিই এমন।
ভিতরের ঘর থেকে কান্নার রোল শুনে বুঝি মেয়ের কবুল বলার সময় হয়েছে। একটু পরে ক্রন্দসী মেয়েটাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসা হলে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। স্বল্প প্রসাধনে কি সুন্দর এক তরুণী! তার উপর কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে বলে অন্যরকম একটা সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে তার মুখে।
সেই সময় নজরুলের আগমন ঘটলো বিয়ে বাড়িতে। অনেক লোক মাটিতে পাটি পেতে বসলেও চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য চেয়ার নির্ধারিত ছিল, তিনিও আমার মতোই উঠে দাঁড়ালেন ছেলেকে দেখে।
” কলিম ” নজরুল এসে দাঁড়িয়েছে বরকনের সামনে, ” ছোটবেলা থেকে আমার জামা কাপড় পইড়া ন্যাংটা ঢাকলা, আমি খাইয়া থুইয়া দিলে সেই ঝুটাটা খাইয়া মানুষ হইলা, আমার বাপ তোমার চোদ্দ গুষ্টিরে পাললো আর বিয়ার বেলায় আমি দাওয়াত পাইলাম না? ”
কলিম ভাই উঠে দাঁড়িয়েছে, ” ভাই গরিব ঘরে বিয়া। আপনার সম্মান যদি এরা দিতে না পারে তাই বলিনাই। ”
বধূর বেশে থাকা রাবেয়া চট করে তাকালো তার দিকে, চোখে কি সামান্য বেদনা খেলা করে গেল? আমার চোখের ভুল ও হতে পারে, এত আত্মসম্মানবোধ কি ওর আছে?
ওরা বেশ তান্ডব করলো এরপর, খাওয়া দাওয়া শেষ কেন এই নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি। রঙিন কাগজ দিয়ে বিয়ে বাড়ি সাজানোর চেষ্টা হয়েছিল, নজরুল আর তার সাথীরা সেগুলি ছিঁড়ে ফেলতে লাগলো অকারণে।
মেয়ের বাবা হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শুধু, হঠাৎ শুনি নিজামুদ্দিন সাহেব গলা উঁচু করে বলছেন , ” এখুনি চলে যাও এখান থেকে, নাইলে ঝামেলা হবে”।
একটু সাহস পেয়ে কলিম ও আগে বাড়লো, সে অবশ্য তাকালো চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে, ” চাচা, আপনি কিছু বলবেন না? ”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, উনি নিজের অবস্থান থেকে নড়লেন না, বরং হাসির মুখভঙ্গি করে বললেন, ” জোয়ান মানুষ, রক্ত গরম। চইলা যাবে এখুনি। আর রুস্তম মিয়া, তুমিই বা এদের জন্য খাবার বাঁচায় রাখলানা কেন? ”
একটু পরে ওরা চলে গেলো। এবারে গরুর গাড়িতে আমার জায়গা হলোনা, নতুন বৌকে সাথে নিয়ে যখন কলিম ভাই বের হলো, আমি আমার গন্তব্যে হাঁটতে শুরু করলাম। অনেকখানি পথ, তবু একা একা হাঁটতে আমার খারাপ লাগছেনা।
***
আমি ভাবিনি আজ মিলি আসবে, একা বসে থাকবো বলেই পুকুর পাড়ে আসা। আমাকে অবাক করে দিয়ে ও এলো। ও সবসময় ঠিক মুখের কাছে হারিকেন ধরে রাখে, এটা হয়তো ওর অভ্যাস। অথবা হয়তো ও জানে ওই স্বল্প আলোয় ওর মুখ স্বর্গের যেকোন অপ্সরীকে অনায়াসে হার মানায়।
” বিয়া কেমন খাইলেন? ” ও বসেছে আমার পাশে।
আমি কথা বলতে পারিনা, আবারো ওকে আমার স্বপ্ন বলে ভ্রম হতে থাকে। সেই আবার বললো, ” মেন্দি দেখাইতে আসছি। কালকে আমার বিয়া, তাই শখ কইরা দিলাম। আমার তো সই ফই নাই, কেউ আসেওনা আমাদের বাড়িতে যে দিয়া দিবো। একাই দিলাম ”
ও আমার সামনে হাতের তালু মেলে ধরেছে, দুই হাতে গোল গোল করে দেয়া মেহেদী আমি প্রাণ ভরে দেখছি, ” গন্ধ শুইকা দেখেন। মাত্রই তুলছি।পানি দেইনাই, পানি দিলে রঙ যায় গা।”
আমি দুই হাতে ওর দুই হাত নিয়ে কাঙালের মত নাকের সাথে চেপে ধরি, কি মায়াময় গন্ধ! আমার শখ মেটেনা, জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে যতটা পারি গন্ধ নিতেই থাকি। মিলি হেসে ওঠে, ” বলছিলাম না সুন্দর গন্ধ!”
এবার সে জাদুকরীর মত কোত্থেকে ছোট একটা মাটির পাত্র বের করল, ” এই দই কতদিন ধইরা যে বানানোর চেষ্টা করসি, জমেইনা। আজকে আপনার ভাগ্যে জমসে। চিনি নাই একফোঁটা, সুন্দরবনের মধু ছিল একটু খানি, ওইটা দিয়া বানাইসি। খেয়ে দেখেন “।
আমি খেলাম। অমৃতের মত স্বাদ, অথবা তার চেয়েও ভালো, অমৃত তো খাইনি কখনো।
” এটাও কি তোমার বিয়ের দই? ”
” হ্যাঁ। আপনি এইভাবে খান, খুব মায়া লাগে দেখতে। মায়ের কথা মনে পড়ে অনেক, তাই না? ”
” খুব। মা থাকলে তোমাকে স্বর্ণে মুড়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেত। আর আমি কিছুই কিনতে পারলাম না…
আমার মুখ চেপে ধরে সে বললো, ” স্বর্ন চাইসি আপনার কাছে? ”
ও চলে যাবার আগে ডাকলাম পিছন থেকে, ” আমার চিঠি পেয়েছিলে? ”
খিলখিল শব্দে হেসে উঠলো, ” পাগল কি আর গাছে ধরে? একবার বিয়া হোক, আপনার পাগলামি সব ছুটাইতেসি আমি ”
***
পাখির কিচিরমিচির ডাকের শব্দে আমার ঘুম ভাঙলো। এত পাখি যেখানে, সেখানে সকালে জাগতে এলার্ম ঘড়ির প্রয়োজন হয়না। আমি অলস হয়ে শুয়েছিলাম, ইমাম সাহেব বললেন, ” আজকের দিনটা নামাজ পড় ভাইটি।”
এই কথা একবার কেউ বলে ফেললে অগ্রাহ্য করা যায়না, আমি উঠে পড়লাম। আধো অন্ধকার আধো আলোয় ইমাম সাহেবের পিছে পিছে হাঁটতে আমার খারাপ ও লাগছিলোনা। একসময় দ্বিধা কাটিয়ে বললাম, ” আমরা কখন যাব? ”
” হাহাহা। তোমার কথা শুনলে আমার হাসি পায় ছোট ভাই, মনে হয় পোলাপান মানুষ…. বাদ আসর বলা আছে। চলবে না? আমি জোহর বলছিলাম, দুপুরের খানা একসাথে খাইতাম, কিন্তু মজনু বাড়ি আসতেছে, আসতে আসতে আসর হবে ”
নামাজ পড়তে আসা পাঁচ দশ জন লোক চলে যাবার পরেও আমরা দুজন বসে রইলাম অনেকটা সময়।
” বড় আফসোস হয় বুঝলা? মিলি যেমন মেয়ে, তার বিয়াতে হৈচৈ হবে, গান হবে, হে সাজাগোজা করবো, বাড়ি ভর্তি মানুষ হবে তা না, এইভাবে দুইজন মানুষ নিয়া…
” একদিন সব হবে ওর। চিন্তা করবেন না…
” না না। তুমি মন খারাপ কইরোনা। তোমারে কিছু বলিনা। তুমিতো আসছো ফেরেশতা হইয়া। ওই গন্ডগোলের কথাই বলি। কতগুলা দিন কেউ তাগো সাথে কথাই বলেনাই। ওই ঘটনা না হইলে কি আজকে…
আমার অস্থির লাগে, মনেই রইলোনা রাতেই আমি মিলিকে দেখেছি। মনে হচ্ছে এখুনি ওকে দেখতে হবে, জড়িয়ে ধরে বলতে হবে, ” সব ঠিক হয়ে যাবে”।
***
প্রথমবারের মত আজকে বাড়িটার সামনে কেউ বসে নেই। স্বাভাবিক, আমি ভাবলাম, কলিম ভাই নতুন বৌ ফেলে আজ নিশ্চই চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য হাতপাখা নাড়াতে আসবে না! আমি ঘরে প্রবেশ না করে ঘুরে পিছনে গেলাম, সাথে সাথে পুরো শরীরে কাঁপুনি অনুভব করলাম।
আজও আমার দাদি কুয়ার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে, এত কাছে যে যেকোন মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমি নিজেকে শান্ত করে শব্দ না করে ওর পেছনে গিয়ে দাড়াই, তারপর খুব আস্তে ওকে টেনে সরিয়ে আনি।
” আবার? ” বলতে গিয়ে থমকে গেলাম, কি গভীর কান্নার ছোঁয়া ওর চোখে মুখে, ” কি হয়েছে? ”
” কিছু না গো ভাই ” হাসার ভঙ্গি করলেন, ” একটা সত্যি কথা বলি? এই নিয়া আপনি আমারে দুইবার বাচাইলেন। লাফ দেওয়ার চিন্তাই করতেসিলাম। হিহি।”
বুঁকের ভিতর শীতল হাওয়া বয়ে গেলো আমার, ” কি হয়েছে বলেন আমাকে? ”
” উনি রাতে বাড়ি আসেন্নাই।… বাদ দেন, আপনের জামা কাপড় বাইর কইরা রাখসি। লাগবে এখন? ”
আমার আজকে বেশি চিন্তা করতে ভালো লাগছেনা, আমি আজকে শুধু মিলির কথা ভাবতে চাই। খুব বেশি হলে মধ্যদুপুর এখন, আমার শুভক্ষন বিকেলে। তবু আমার তর সইছেনা, বললাম, ” হ্যাঁ। ”
কাপড় বদলে বের হব, তখন উনি বললেন, ” মাথা নিচা করেন, ভাইরে দুয়া করি একটু ”
আমার চোখ জ্বালা করে ওঠে, মা বাবার কথাও মনে পড়ে প্রচন্ডভাবে, ” আপনে যেই টাকা দিসিলেন, ওইটা ছাড়া আমার নিজের আর কোন কিছু নাই। ওইটাই আপ্নেরে দিতেসি, বউরে কিছু কিনা দিয়েন। ”
এরপর আমি গেলাম নাপিতের কাছে, গত ছয়মাসে চুল কাটিনি বড় হয়েছে বেশ। দাঁড়ি গোঁফ ও এতদিন ছেটেছি শুধু, কামাইনি। দীর্ঘ সময় নিয়ে নাপিত কাজ করলেন, আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। আমাকে ঠিক আগের মত দেখাচ্ছে। সেই শখ করে কেনা আড়ং এর পাজামা পাঞ্জাবী, ছোট করে ছাটা চুল। আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে হেসে ফেললাম।
***
সময় কাটানোর জন্য চায়ের দোকানে গেলাম এরপর । আজকে লোক সমাগম ভালো, জনা দশেক লোকের মধ্যে আমার বন্ধু আমিরুল আর জামরুলকেও দেখতে পেলাম।
দোকানি বলল, ” ভাই দেখি চকচক করতেসেন আজকে”।
আমি হাসলাম, বসার জায়গা নেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা চা খাচ্ছি, তখন আমিরুল ফিসফিস করে বলল, ” খবর শুনছো নাকি? ”
আমি মোহগ্রস্ত হয়ে আছি, সারা শরীর, সারা মন জুড়ে একটাই চিন্তা, বিকাল কখন হবে। অন্য কোন খবর আপাতত আমার কাছে নেই, বললাম, ” কিসের খবর?”
” কলিম ভাইয়ের বউরে কালকে রাতে তুইলা নিয়া গেসে নজরুলে। বইলা নাকি গেসিলো, খাইয়া ফেরৎ দিব।”
আমার হাত থেকে চা পড়ে গেল মাটিতে, মাথা ঝিমঝিম করছে, ” কি বললা? ”
” তাইতো শুনলাম। হালায় মাল একটা”
একথা শোনার পরেও আমার শুধু ইচ্ছে করলো মিলিকে দেখতে। বিকেল হতে অনেক দেরি, আমি এখনই যাবো , গিয়ে বলব, মিলি, এক্ষুনি আমার সাথে চলো। চলো অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। এখানে থাকতে আমার আর একটুও ভালো লাগছে না।
(চলবে)