#দুই_হৃদয়ের_সন্ধি
#পর্বঃ১৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি
মুসকান আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রান্নাঘরে চলে এসেছে। কিছুদিন পর তো সে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তাই এখন সে চায় সবাইকে রান্না করে খাওয়াতে। সেই উদ্দ্যেশ্যেই রান্নাঘরে আসা। বাড়ির রান্নার লোকও তাকে সাহায্য করছে।
খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসল মুসকান। স্যান্ডউইচ এবং বাটার দিয়েই সকালের নাশতাটা করার ব্যবস্থা করেছে সে। আতিকা চৌধুরী এসে খাবার টেবিলে বসলেন। আরিফ আগে থেকেই উপস্থিত ছিল৷ মুসকান তাদের দুজনকেই খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত ছিল এমন সময় আতিফা বেগম উপস্থিত হয়ে বলেন,
“আমি চলে এসেছি আপা।”
আতিকা চৌধুরী তাঁকে দেখে খুশি হয়ে বলেন,
“তুই এসে গেছিস! নকশি কোথায়?”
আতিফা বেগমের পেছন পেছন একটি ট্রলি ব্যাগ নিয়ে হাজির হলো নকশি। আরিফ ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“আরে নকশি তুই ট্রলি নিয়ে এলি যে!”
আতিকা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“তোদেরকে তো বলাই হয়নি, নকশি এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। ওদের বাড়ি তো সেই কোন অজপাড়াগাঁয়ে। ওখান থেকে যাতায়াত অসুবিধা হবে জন্যে আতিফা ওকে হোস্টেলে দিতে চেয়েছিল। তখন আমি আপত্তি জানিয়ে বলি, শহরে আমাদের এত বড় একটা বাড়ি থাকতে নকশি হোস্টেলে থাকতে যাবে কেন? আর তাছাড়া তুইও তো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস। তাই নকশি এখানে এসে থাকলে ওর সুবিধাই হবে৷ ভালো করিনি বল?”
“জ্বি, আম্মু। তুমি একদম ঠিক কাজ করেছ।”
নকশির আগমনে সবাই খুশি হলেও মুসকান খুশি হতে পারে না। তার মনে আতংকেরা দানা বাধে। নকশি যতই ভালো মেয়ে হোক সে তো আরিফকে ভালোবাসত। এখন যদি হঠাৎ এভাবে এই বাড়িতে এসে থাকায় তাদের পুরাতন ভালোবাসা জেগে ওঠে তাহলে কি হবে? সবেমাত্র তার আর আরিফের সম্পর্ক ভালোর দিকে যাচ্ছে। এই মুহুর্তে নকশির আগমন তার মনে ভয় ধরিয়ে দিলো যেন। মুসকানের এরূপ ভাবনার মাঝেই আচমকা নকশি এগিয়ে এলো তার দিকে। মুসকানের সম্মুখে এসে মৃদু হেসে বললো,
“কেমন আছ ভাবি?”
মুসকান জোরপূর্বক হেসে বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?”
” আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আজ থেকে আমি এই বাড়িতেই থাকব পড়াশোনার জন্য। তোমার কোন আপত্তি নেই তো?”
মুসকান কিছু বলার আগেই আরিফ খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,
“ওনার আবার আপত্তি থাকতে যাবে কেন নকশি? তোকে নিয়ে ওনার তো কোন সমস্যা নেই।”
নকশি ইতস্তত বোধ করে বলে,
“না মানে, যদি ভাবি আমাকে এই সংসারের বোঝা মনে করেন।”
“মুসকান এমন কিছু ভাববেন না। ওনার সাথে এতদিন থেকে আমি যা বুঝেছি তার ওনার ভাবনা চিন্তা এমন নয়।”
আরিফের মুখে নিজের এমন প্রশংসা শুনে মুসকানের ভীষণ ভালো লাগল। মনের অজান্তেই হেসে উঠলো সে।
★★★
আতিফা বেগম নকশিকে আরিফদের বাড়িতে রেখেই ফিরে গেছেন। নকশির বাবা কিছু বছর আগে এক দূর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যান। তারপর থেকে ঘরেই পড়ে আছেন। যার দরুণ তার খেয়াল রাখতে হয় সর্বক্ষণ। তাই আতিফা বেগমের তাকে বাড়িতে থেকে বাইরে বেশিক্ষণ থাকার জো নেই।
আতিফা বেগমের বিদায়ের পর নকশি গেস্ট রুমে চলে গেছে। এখন সে সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছে। এদিকে মুসকানের মন হঠাৎ করে অনেক বেশি অস্থির হয়ে ওঠায় সে রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। বারবার বিছানার এপাশ ওপাশ করছে তবুও তার শান্তি হচ্ছে না। মুসকান চাইলেও গতবার নকশির করা কান্ডটা ভুলতে পারছে না।
এছাড়া মুসকান মনে মনে নকশির সাথে তার তুলনাও করতে লাগল। নকশি এবং সে প্রায় সমবয়সী হলেও রূপে লাবণ্যে নকশির ধারের কাছে নেই মুসকান। মুসকানের গায়ের রংটা বেশ ফর্সা, নকশির একটু কম ফর্সা কিন্তু নকশি মুসকানের থেকে বেশি আকর্ষণীয়। নকশির সুন্দর মুখশ্রী, ফিগার সবই তার থেকে উত্তম। নকশির লম্বা কেশের সাথে নিজের ছোট ছোট চুলেরও পার্থক্য খুঁজে পেল মুসকান। এসব ভাবনা মনে আসতেই তার মনে যেই বিষয়টা আগে নাড়া দিলো সেটা হলো, নকশি প্রস্তাব দিলে তো যেকোনো পুরুষই তার প্রেমে মত্ত হবে। যদি আরিফও নকশির প্রেমে মত্ত হয়। তাহলে তার কি হবে? সে যে অনেক চেষ্টা করে অনেক কিছু বিসর্জন দিয়ে এই সম্পর্কটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে এসেছে। এই সম্পর্কে চিড় ধরলে যে তার ভীষণ কষ্ট হবে!
মুসকানের এসব ভাবনার মধ্যেই আরিফ রুমে এলো। মুসকানের গভীর ধ্যানে কিছু ভাবতে দেখে আরিফ বিছানার একেবারে সামনাসামনি এসে বললো,
“এত কি ভাবছেন আপনি?”
মুসকান আরিফকে দেখে প্রথমে খানিকটা হচকচিয়ে যায়৷ অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“তেমন কিছু না।”
আরিফ আর বেশি ঘাটাতে চায় না যে দোলনায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত রুহির দিকে একপলক তাকিয়ে বিদায় নিলো। আরিফ উঠে যেতেই হঠাৎ করে মুসকানের মনে হলো তার আরিফকে চোখে চোখে রাখা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ। মুসকান ত্বরিত উঠে পড়লো। আরিফের পিছন পিছন যেতে লাগল। আরিফকে গেস্টরুমের দিকে যেতে দেখে মুসকানের বুক কেপে উঠল। তার মনে আবার এই প্রশ্নটি জেগে উঠল যে তার ভাবনাই কি তাহলে সত্যি হতে চলেছে?
মুসকান কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। নিজেকে ধাতস্থ করে ধীরে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল গেস্টরুমের দিকে। গেস্টরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আড়িপেতে শুনতে লাগল আরিফ ও নকশি হেসে হেসে কিসব যেন কথা বলছে। এই দৃশ্য তার অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। মুসকান গেস্টরুমের পর্দা শক্ত করে আকড়ে ধরল। মনে মনে আতংক প্রকাশ করে বলল,
“নাহ, এটা হতে পারে না। আমি আরিফকে অন্য কারো হতে দিতে পারি না। আগুন আর ঘিকে কোন ভাবেই পাশাপাশি রাখা যাবে না। নিজের সংসার বাঁচানোর জন্য পদক্ষেপ এবার আমায় নিতে হবে।”
★★★
দুপুরে ডাইনিং টেবিলে সকলে উপস্থিত হয়েছে লাঞ্চ করার জন্য। আতিকা চৌধুরী কলেজে যাওয়ার কারণে তিনি অনুপস্থিত আছেন। তবে যথারীতি উপস্থিত আছে আতিক। তার কোলে ছোট্ট রুহিও আছে। নকশিও এসে বসে পড়েছে ঠিক আরিফের পাশের চেয়ারে। যা মুসকানের মোটেই ভালো লাগছে না। সে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে একবার নকশির দিকে তাকিয়ে খাবার পরিবেশন করতে লাগল। খেতে বসেও নকশি আরিফের সাথে নানারকম গল্প করছিল। এসব আর সহ্য হচ্ছিল না মুসকানের।
ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাওয়ার কারণে মুসকান হঠাৎ করে রেগে বলে ওঠে,
“খাওয়ার সময় এত কিসের কথা? চুপচাপ খান তো আরিফ।”
মুসকানের দিকে বিস্ময়ের সাথে তাকালো আরিফ৷ তার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করল কিন্তু ব্যর্থ হলো। নকশি বলল,
“সরি ভাবি। আসলে অনেকদিন পর আমরা একসাথে হয়েছি তো তাই অনেক গল্প জমে আছে। যাইহোক, তুমি ঠিকই বলেছ৷ আমার আম্মুও বলে খাওয়ার সময় কথা বলা ঠিক না। আমরা আর কথা বলবো না।”
নকশির দিকে কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রান্নাঘরে চলে গেল মুসকান।
★★★
মুসকান গল্পের বই নিয়ে বসেছে আজ অনেকদিন পর। ছোটবেলা থেকেই টুকটাক গল্প পড়ার সাধ তার। বর্তমানে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাস পড়ছে সে। মূলত নকশির আগমনে তার মনে যে চাঞ্চল্য এবং অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে তা কমানোর জন্যই বই নিয়ে বসা।
উপন্যাস পড়তে পড়তে তার মাঝেই হারিয়ে গেল মুসকান৷ এরমাঝে হঠাৎ করে তার কানে একটা বিকট শব্দ আসল। শুনে মনে হলো কারো পড়ে যাওয়ার শব্দ। মুসকান বইটি টেবিলের উপর রেখে ঘটনা কি তা জানার জন্য বের হলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে দেখলো নকশি মেঝেতে পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে সে। আরিফ তার সম্মুখেই অবস্থান করছে। নকশি ব্যথায় আর্তনাদ করে বলছিল,
“ভাইয়া আমার পা মনে হয় ভেঙেই গেছে।”
আরিফ কিছুক্ষণ নকশিকে বকাবকি করলো। এভাবে অসাবধান ভাবে চলাচল করায় অনেক ভালোমন্দ কথা বলল। অতঃপর নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে তাকে তুলে নিলো নিজের কোলে। তাকে গেস্টরুমের দিকে নিয়ে যেতে লাগল।
এই দৃশ্য দেখে মুসকানের হৃদয় কেপে উঠল। বুকের বা পাশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হলো। মুসকান দৌড়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে এসে দ্রুত কপাট লাগিয়ে দিলো। ক্ষিপ্ত বেগে বিছানায় শুয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। আর্তনাদ করে বলতে লাগল,
“কেমন আমার সাথে এমন হয় আল্লাহ? তুমি কি আমার ভাগ্যে একটুও সুখ লিখে রাখোনি? যখনই একটু সুখের দেখা পেলাম তখন কেন এভাবে সব এলোমেলো করে দিচ্ছ!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨