দুই হৃদয়ের সন্ধি পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
344

#দুই_হৃদয়ের_সন্ধি
#অন্তিম_পর্ব
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মেহরাব নকশির দিকে ডিভোর্স পেপারটা এগিয়ে দিলে সে নিজের বুকে পাথর চেপে ডিভোর্স পেপারটা হাতে তুলে নেয়। চাপা আর্তনাদ আড়ালে রেখে সামান্য হাসার চেষ্টা করে। মিলিয়ে আসা কন্ঠে বলে,
“আমি আপনাকে ডিভোর্স দিতে চাই না৷ কিন্তু বে*হায়ার মতো জোর করে আপনার জীবনে পড়ে থাকতেও আমি পারবো না। আজ আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আর কখনো আপনার কাছে ফিরব না। চলে যাব এখান থেকে। কিন্তু প্লিজ আপনি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইবেন না। আমি আজীবন আপনার স্ত্রী হয়ে থাকতে চাই।”

মেহরাব হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল। শক্ত সামর্থ্য পুরুষটির বুকে উথাল পাথাল ঝড় উঠল। নকশির প্রতি তৈরি হওয়া অনুভূতি গুলো তাকে করে দিলো দূর্বল। তবে সে নিজের গাম্ভীর্য বজায় রাখল। ভেঙে যেতে দিলো না নিজেকে। বরঞ্চ কিছু কঠিন কথা ছুড়ে দিলো নকশির দিকে। বেশ ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল,
“তুমি তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলে আমাকে তোমার সহ্য হয়না। আমার সাথে থাকতে চাও না। আমাকে নাকি ডিভোর্স দিতে বাধ্য করবে এই চ্যালেঞ্জও দিয়েছিলে। তাহলে এখন যখন আমি তোমায় জিতিয়ে দিতে চাইছি তখন পিছুপা হচ্ছ কেন?”

নকশি পুনরায় হাসল৷ মলিন সেই হাসি। এই মলিন হাসি দিয়েই সে৷ বলল,
“সবসময় কেন জিততে হবে? ধরুন এইবার আমি হেরে গেলাম৷ হেরে গিয়েও জিতে গেলাম।”

বলেই মেহরাবের সামনে থেকে চলে আসতে নেয়। নিজের চোখের কোণে জমা থাকা জলগুলো মুছে নেয় সন্তপর্ণে। নিজের কিছু জামাকাপড় আর জরুরি জিনিস গুছিয়ে নেয়। বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। যাওয়ার পূর্বে দেখা করে মেহরাবের দিকে। মেহরাবের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপনার কাছে একটা অনুরোধ করব?”

নির্লিপ্ত আবেদন। ফেরাতে পারলো না মেহরাব। শান্তভাবে বলল,
“যা বলার বলো।”

“আপনি তো নিজেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। আজ আমাকে আবার আমার বাসায় রেখে আসবেন প্লিজ?”

“আমি পারবো না।”

“ধরে নিন, এটা আমার আপনার কাছে চাওয়া শেষ ইচ্ছা।”

আর ফেরাতে পারল না মেহরাব। বলল,
“ঠিক আছে, চলো।”

মেহরাব ও নকশি বেরোতে যাবে এমন সময় মোনালিসা দৌড়ে সেখানে চলে এলো৷ নকশিকে এভাবে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরুতে দেখে প্রশ্ন করল,
“তোমরা কি কোথাও যাচ্ছ?”

নকশি বলে দিলো,
“হ্যাঁ, আমি আজ চিরকালের মতো বিদায় নিচ্ছি। ভালো থেকো মোনালিসা।”

মোনালিসা হতবাক হয়ে গেল। মেহরাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাবি এসব কি বলছে ভাইয়া? তুমি কোথায় রেখে আসছ ভাবিকে?”

“ও একদম ঠিক বলছে। আমি ওকে ওর বাসায় রেখে আসতে যাচ্ছি।”

“তুমি এটা কিভাবে করতে পারো ভাইয়া?”

“আমি এমনটাই করবো। আমি ওকে কখনো পছন্দ করতাম না। এতদিন ওকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য রেখেছিলাম৷ আমি ঠিক এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম যেদিন ও আমাকে ভালোবাসবে। আজ সেই দিন এসে গেছে। আমার সংকল্প পূরণ হয়েছে। তাই আমার আর প্রয়োজন নেই ওকে।”

মোনালিসা হতবাক হলো। নকশির মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। বরং সে মোনালিসাকে বলল,
“তুমি আর এই নিয়ে কথা বাড়িও না মোনালিসা। নিজের খেয়াল রেখো।”

বলেই সে বাইরের দিকে পা বাড়ালো৷ মোনালিসা ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আই হেট ইউ ভাইয়া, আই হেট ইউ। মম আমাদের ছেড়ে চলে গেল, আজ তুমি ভাবিকেও দূরে ঠেলে দিলে। দেখবে কিছুদিন পর আমিও তোমাকে ছেড়ে চলে যাব। তারপর তুমি একা তোমার এই সাম্রাজ্য ভোগ করো। এটাই ডিজার্ভ করো তুমি। কারো ভালোবাসা তুমি ডিজার্ভ করো না।”

বলেই হনহন করে নিজের রুমের দিকে ছুটে যায় মোনলিসা। মেহরাব হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে।

★★★
নকশিদের গ্রামের বাড়িতে এসে গাড়ি থামায় মেহরাব। অতঃপর নকশিকে উদ্দ্যেশ করে বলে,
“এসে গেছে তোমার বাড়ি। নেমে পড়ো।”

নকশি গাড়ি থেকে নামে। মেহরাব নকশিকে আবারো বলে,
“এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের বাড়িতে যাও। গো এহেড।”

“আপনাকে একটা লাস্ট রিকোয়েস্ট করব?”

“কি রিকোয়েস্ট?”

“আপনি আগে থেকে নামুন।”

মেহরাব বিনাবাক্য ব্যয়ে গাড়ি থেকে নামে। নকশি কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তাকে গভীর আলিঙ্গনে সিক্ত করে তোলে। এই পর্যায়ে আর শক্ত থাকতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে যায় বেচারি মেয়েটার। নকশি শেষবারের মতো অনুরোধ করে বলে,
“প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমাকে নিজের লাইফে সামান্য একটু যায়গা দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?”

মেহরাব দ্রুত নকশিকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলে,
“অনেক সমস্যা। আমি কখনোই তোমাকে চাই নি।”

বলেই নিজের গাড়িতে উঠে বসে সে। গাড়ি স্টার্ট করার আগে পুনরায় একবার তাকায় নকশির দিকে। নকশি তো তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বিদায় নেয়।
………………..
Dil bharta nahi
Aankhen rajjti nahi
Chaahe kitna bhi dekhti jaaun
Waqt jaaye main rok na paaun

Tu thodi der aur thehar ja sohneya
Tu thodi der aur thehar ja
Tu thodi der aur thehar ja zaalima
Tu thodi der aur thehar ja…

★★★
মুসকান দফায় দফায় আরিফের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু আরিফ সমানে তাকে এড়িয়ে চলছে। অবশেষে মুসকান আরিফকে আটকে দিয়ে বলে,
“আমার কিছু কথা শোনো প্লিজ।”

“হ্যাঁ, বলো তোমার কি বলার আছে!”

“আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।”

“ক্ষমা আর তুমি?! কিন্তু কেন?”

“আমি সত্যি অনেক ভুল করে ফেলেছি। আমার চিন্তাভাবনা এত নিচ ছিল যার জন্য আমি সত্যিই লজ্জিত। আমি এই বাচ্চাটা চাই আরিফ। আমি একটা সুখী ফ্যামিলি চাই।”

আরিফ আচমকা জড়িয়ে ধরে মুসকানকে। সে বলে,
“আমি তোমার থেকে এটা শোনারই অপেক্ষায় ছিলাম মুসকান। আমি জানতাম তুমি এক না এক সময় ঠিকই নিজের ভুলটা অনুধাবন করবে।”

“এই ত্রুটিপূর্ণ মুসকানকে যে তুমি নিজের লাইফে সুযোগ দিয়েছ এতেই আমি কৃতজ্ঞ আরিফ।”

“ভুল সবাই করে। পারফেক্ট তো এই দুনিয়ায় কেউ নয় মুসকান। এরমধ্যে যারা নিজেদের ভুলগুলোকে ফুল বানিয়ে নিজের জীবনকে সুন্দর বানাতে পারে তারাই তো সফল। তুমিও সেরকম একজন। তাছাড়া তুমি তো আমার হৃদয়ে জায়গা নিয়েছ। তোমাকে সেই হৃদয় থেকে বের করা যে সম্ভব নয়।”

মুসকান লাজুক হাসে। এরমধ্যে রুহি কেঁদে উঠলে তাকে কোলে তুলে নেয়। আরিফ, মুসকানের সুখী পরিবার পূর্ণতা পায়।

❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️
কয়েক মাস পর,
নকশি নিজের বাড়িতে বসে নিজের মায়ের সাথে পিঠা বানাচ্ছিল। শীতের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। শীতল হাওয়ায় মুগ্ধ চারপাশের সবকিছু।

নকশি পিঠা বানিয়ে নিজের বাবার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় হঠাৎ বলিষ্ঠ এক দেহের সাথে ধাক্কা খায় সে। চোখ তুলে তাকাতেই মেহরাবের হাস্যজ্বল মুখ দেখতে পায়। নকশি তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে ধরে। মেহরাব নকশির হাতটা ধরে ফেলে। আচমকা কাছে টেনে নেয়। নকশি নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বলে,
“কি হচ্ছেটা কি? আপনি কেন এসেছেন?”

“যেই রমণী আমার হৃদয়ে স্থান নিয়েছে। যার সাথে আমার হৃদয়ের সন্ধি ঘটেছে তাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি।”

“আমি যাবো না। আমার একটা আত্মসম্মান আছে। যখন ইচ্ছে আমাকে দূরে ছুড়ে ফেলবেন আবার যখন খুশি কাছে টেনে নেবেন এমন তো হতে পারে না।”

“আমার কথাটা শোনো। আমার কিছু সময়ের দরকার ছিল। তুমি আমার কাছে কতটা দামী, কতটা অমূল্য তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। চোখের সামনে নিজের মাকে ম*রতে দেখে তোমাকে হারানোর ভয় জন্ম নেয় আমার বুকে। সেই কারণেই তো তোমাকে সব বিপদ থেকে দূরে রাখতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তোমাকে প্রবল ভালোবাসার পরেও তোমার থেকে দূরে থেকেছি। আমার এই আত্মত্যাগের সামান্য প্রতিদান দাও।চলো আমার সাথে। জানো এই কয়েক মাসে আমি দূরে সরে এসেছি সব রকম অপকর্ম থেকে। এটা এতটাও সহজ ছিল না। কিন্তু আমি পেরেছি। এখন তোমাকে আর মোনালিসাকে নিয়ে ঢাকা শহরে যেতে চাই৷ সেখানে গিয়ে নতুন করে সংসার সাজাতে চাই। যাবে তো?”

নকশি মেহরাবকে আলিঙ্গন করে বলে,
“অবশ্যই।”

দুজনের মুখে তৃপ্তির হাসি। ভালোবাসা পরিপূর্ণতা পাওয়ার হাসি। দুই হৃদয়ের সন্ধির হাসি।

✨✨✨✨শুভ সমাপ্তি✨✨✨✨
✨✨✨✨Happy Ending✨✨✨