#দুই_হৃদয়ের_সন্ধি
#পর্বঃ১৮
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আরিফ নকশিকে গেস্ট রুমে রেখে এসেই প্রবেশ করলো। রুমে এসে মুসকানকে কাঁদতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়লো সে। মুসকানের এই দশার কারণ সে কিছুতেই আন্দাজ করতে পারল না। মুসকানের একাবারে কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে শুধালো,
“মুসকান আপনি কাঁদছেন কেন?”
সহসা সজাগ হয়ে ওঠে মুসকান। উঠে বসে নিজের চোখের অশ্রু লুকানোর বৃথা চেষ্টা চালায়। আরিফের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমি কাঁদছিলাম না! জীবনে এত সুখ থাকতে আমি কাঁদব কেন?”
মুসকানের অভিমান মিশ্রিত এই কথার অর্থ বুঝতে পারল না আরিফ। তাই সে মুসকানের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরখ করে বলল,
“ওহ বুঝেছি। আবার আপনার বাবার কথা মনে পড়েছিল তাই না? এইজন্যই বুঝি কাঁদছিলেন?”
আরিফের কথা শোনামাত্রই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে মুসকানের মনে। সে মনে মনে বলে,
“ওহে পুরুষ জাতি! তোমরা মেয়েদের অন্তর কখনো বুঝতে পারবে না।”
তবে মুখে বলল,
“নাহ, আসলে অন্য ব্যাপার।”
আরিফ বিছানায় মুসকানের পাশে বসে বলতে শুরু করল,
“জানেন নকশি না সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল। উফ, বেচারি মেয়েটার কি অবস্থা হলো। দুদিন পর ওর ভার্সিটি প্রথম দিন। এখনই এমনটা হওয়ার ছিল!”
আর সহ্য করতে পারলো না মুসকান। এবার তার অন্তরাত্মা তাকে আহ্বান জানালো প্রতিবাদ জানানোর জন্য। মুসকান নিগূঢ় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আরিফের দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,
“আপনার কি খুব প্রয়োজন ছিল মুসকানকে কোলে করে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার?”
মুসকানের মুখে এমন কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় আরিফ। সে আশ্চর্য হয়ে বলে,
“এসব আপনি কেমন কথা বলছেন মুসকান? নকশি আমার খালাতো বোন হয়। দূরের গ্রাম থেকে ও এখানে থাকতে এসেছে। ও আমাদের দায়িত্ব এখন। ও এভাবে সিঁড়িতে পড়েছিল আর আমি ওকে তুলব না?”
“আমাকে তো ডাকতে পারতেন। আমি সাহায্য করতাম।”
“আপনাকে আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম মুসকান। আপনি যে এত সামান্য একটা ইস্যু নিয়ে এমন কথা ভাববেন সেটা আমার কল্পনার বাহিরে।”
মুসকান বেশ জোরেশোরে বলে উঠল,
“সামান্য ইস্যু? আপনার কাছে এটাকে সামান্য মনে হয়! শুনুন নকশি আপনার কাজিন হলেও ওর প্রথম পরিচয় ও একজন নারী, আপনি একজন বিবাহিত পুরুষ হয়ে কিভাবে এমন করলেন বলুন তো আমায়?”
এবার আরিফেরও বেশ রাগ হলো। আরিফ বলল,
“গলা নামিয়ে কথা বলুন মুসকান। রুহি ঘুমিয়েছে। ও জেগে যাবে। আর আপনার এসব নিচু মানসিকতা আমাকে দেখাতে আসবেন না। আমি আপনার মতো নই যে নিজের কাজিনের…”
কিছু বলতে গিয়ে মুসকানের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল আরিফ। মুসকান সাথে সাথেই বলে উঠল,
“কি হলো থামলেন কেন? নিজের কথা শেষ করুন। যা বললে আপনার মনে শান্তি আসবে সেটা বলুন আমায়।”
আরিফ পাশ থেকে একটি ফুলদানি নিয়ে মেঝেতে ছু’ড়ে মে’রে বলে,
“আপনি আসলেই একটা অসহ্য মুসকান। এই ক’দিনে আপনার প্রতি আমার একটা পজেটিভ ধারণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আপনি নিজের জাত চিনিয়েই দিলেন।”
সহসা ভাঙা ফুলদানির টুকরা হাতে তুলে নিলো মুসকান। অতঃপর আরিফের গলার কাছে ধরে বলল,
“শুনুন, আমার সম্পর্কে আপনি যাই ভাবুন আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আমি স্পষ্ট ভাবে বলে দিচ্ছি যা আমার সেটার অধিকার আমি আর কাউকে দেব না। আপনি আমার স্বামী। শুধুই আমার। অন্য কোন মেয়েকে আমি আপনার পাশে সহ্য করবো না। ভালো হয় যদি আপনি নকশির থেকে দূরে থাকেন।”
মুসকানের এই ভয়াবহ রূপ দেখে তাজ্জব বনে যায় আরিফ। সে কখনো কল্পনাও করতে পারে নি মুসকান এতটা ভয়ানক রূপ দেখাতে পারে। এরমধ্যে ফুলদানির ভাঙা অংশের চাপের কারণে মুসকানের হাত দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। ব্যাপারটা দৃষ্টিগোচর হতেই ত্বরিত হাতটা টেনে ভাঙা অংশটা ফেলে দিলো আরিফ। অতঃপর দ্রুত গতিতে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। মুসকানের হাত টেনে নিয়ে ফাস্ট এইড করতে চাইলে মুসকান হাত সরিয়ে নিয়ে বলে,
“আমাদের হাতের এই রক্তক্ষরণ আপনাকে এত ভাবাচ্ছে অথচ আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিয়ে আপনি ভাবছেন না!”
আরিফ জোরপূর্বক মুসকানের হাত টেনে নিয়ে ফাস্ট এইড করতে করতে নরম স্বরে বলে,
“আপনি আমার প্রতি যতোই অভিযোগ রাখুন না কেন আমি একটা ব্যাপারে আপনাকে নিশ্চিত করে দিচ্ছি, আমি আপনাকে কখনোই ঠকাবো। হ্যাঁ, আমি আপনার স্বামী এবং শুধু আপনারই থাকব। অন্য কোন মেয়ের দিকে কখনো চোখ তুলে তাকাবো না। আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।”
মুসকান কিছুটা আশ্বস্ত হয়। অতঃপর আরিফের কাঁধে মাথা রেখে বলে,
“আর কতদিন আরিফ? আমরা কি নিজেদের সম্পর্কের এই দূরত্ব ঘোচাবো না? আমার যে ভীষণ ইচ্ছা করে আপনাকে নিজের করে পাওয়ার।”
আরিফ হঠাৎ করে মুসকানের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ মনে মনে কিছু ভাবল। অতঃপর হেসে উঠে বলল,
“বেশ, আমি আপনার কথা রাখব। আজ রাতেই আমরা এক হবো।”
আরিফের কথা শীতল আবহে ঢেকে দেয় মুসকানকে। সাথে সাথে ভীষণ লজ্জাও অনুভব করে সে। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়। আরিফ মুসকানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।
★★★
আজ রাতে খুব সুন্দর ভাবে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে মুসকান। আজ যে তার জীবনে সবথেকে বিশেষ রাত হতে চলেছে। আজ যে তার জীবনের দ্বিতীয় বাসর রাত!! হ্যাঁ, প্রথম বাসর রাতে তাদের দুই আত্মা বা শরীর কোন কিছুরই মিলন ঘটে নি। তবে আজ মুসকান চায় তাদের শরীর এবং আত্মা মিলে মিশে একাকার হয়ে যাক।
লাল রঙের একটি জর্জেটের শাড়ি, মুখে হালকা লিপস্টিক, চোখে সামান্য কাজল, আইশেডো, আই লাইনার আরো কত কি! নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছে মুসকান। ও কল্পনা করতে থাকে সেই মুহুর্তকে যখন আরিফ এই রূপে তাকে দেখবে। নিশ্চয়ই আজ আরিফের মাথা ঘুরে যাবে মুসকানকে এভাবে দেখে। এই ব্যাপার নিয়ে ভাবতেই মুসকানের মুখশ্রী হাসিতে ভড়ে উঠল। মুসকান আয়নার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করল তার ফর্সা গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। হঠাৎ করে রুহির কান্নার আওয়াজে ধ্যানভঙ্গ হয় মুসকানের। ত্বরিত দোলনার কাছে গিয়ে ক্রন্দনরত রুহিকে নিজের কোলে তুলে নেয়। আদর-মমতার পরশে ভড়িয়ে দেয় ছোট্ট মেয়েটিকে। রুহিও মুসকানের এই মমতার পরশে একদম চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
সময় এগিয়ে যেতে থাকে আপন বেগে। মুসকানের অপেক্ষার পালা আর শেষ হয়না। ঘড়ির দিকে অবিরত তাকিয়ে রইল মুসকান। রাত যত বেড়েই চলেছে মুসকানের মনের চঞ্চলতাও ততই বাড়ছে।
আরিফকে একের পর এক ফোনও করতে লাগল মুসকান। কিন্তু ফলাফল শূন্য। অবশেষে মুসকান রাত জেগে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু রাতের আঁধার বাড়লেও তার অপেক্ষা আর কমলো না। হঠাৎ করেই খুব কান্না পেতে লাগল মুসকানের৷ তার মনে হতে লাগল কেন এত অভাগী সে? তার ভাগ্যে সুখ কি সবসময় এভাবেই অধরা থেকে যাবে! আরিফ কেন আজ তাকে কথা দিয়েও এলো না।
অপেক্ষা করতে করতে শোফার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো মুসকান।
★★★
প্রভাতের কিরণ চোখে এসে পড়তেই মুসকানের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। ঘুম ভেঙে যেতেই ত্বরিত উঠে বসলো মুসকান। আশেপাশে তাকিয়ে আরিফকে খুঁজল। কিন্তু পেলো না! হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মুসকানের। সে উঠে গিয়ে ওয়াশরুমে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখল। কাল তাকে যতোটা সুন্দর লাগছিল আজ ততোটাই বিশ্রী লাগছে। চোখের জলে লেপ্টে গেছে কাজল। সাজও মলিনতায় ছেয়ে গেছে। মুসকান চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে নিজের সাজ তুলে ফেলল।
লম্বা সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে তারপর বাইরে এলো। ঘড়িতে সময় দেখল সকাল আটটা বাজে। এখন তার মধ্যে দুশ্চিন্তা বাধা বাধতে লাগলো। সারারাত আরিফ কোথায় এই প্রশ্ন জেগে উঠল তার মনে।
মুসকানের ভাবনার মধ্যেই রুমে প্রবেশ করলো আরিফ। মুসকান আরিফের দিকে তাকিয়ে তার উসকোখুসকো চুল, মলিন চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেল। ত্বরিত ছুটে গিয়ে তার সম্মুখে অবস্থান নিয়ে বলল,
“আপনি সারারাত কোথায় ছিলেন? আর আপনাকে এমন লাগছে কেন?”
সহসা মুসকানকে ধাক্কা দিয়ে নিজের সামনে থেকে সরিয়ে দিলো আরিফ। গর্জে উঠে বলল,
“চলে যান আমার সামনে থেকে।”
মুসকান আরিফের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨