#দুই_হৃদয়ের_সন্ধি
#পর্বঃ২১
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আরিফ একপ্রকার দৌড়ে চলে এলো মুসকান ও দোলার সামনে। আরিফকে দেখে তো দুজনেই থমকে তাকিয়ে রইল। আরিফ হাফাতে হাফাতে বলল,
“আর আমার থেকে আপনি লুকিয়ে বেরাতে পারবেন না মুসকান। আমি আপনাকে ধরে ফেলেছি।”
মুসকান একবার দোলার দিকে তাকিয়ে অতঃপর তাকালো আরিফের দিকে। কিছুক্ষণ শান্ত থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“কে আপনি? আমি তো আপনাকে চিনি না।”
আরিফ হতাশা মিশ্রিত সুরে বলল,
“এমন করে বলছ কেন মুসকান? হ্যাঁ, জানি আমি রাগের মাথায় তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি কিন্তু…”
দোলা আরিফকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“শুনুন মিস্টার কোন অজুহাত দেখাতে আসবেন না। আপনার পুরুষ মানুষদের আমার ভালো করে চেনা আছে। প্রথমে খারাপ ব্যবহার করবেন, কষ্ট দেব তারপর হুট করে এসে বলবেন সরি আর সব ঠিক হয়ে যাবে! সবটা কি এতই সহজ?”
আরিফ দোলার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি ফেলে। খানিকটা রাগী স্বরে বলে,
“আপনি প্লিজ আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঢুকতে আসবেন না। এটা আমাদের পার্সোনাল ম্যাটার।”
মুসকান আরিফের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠল,
“আমার বান্ধবীর সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না।”
“আমি কোথায় খারাপ ব্যবহার করলাম মুসকান? আমি তো শুধু…”
“থাক, আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। আমার আপনার কথা শোনার টাইম নেই।”
বলেই মুসকান সামনের দিকে হাঁটা দিলো। আরিফ তার পেছনে যেতে যাবে এমন সময় দোলা তাকে আটকে বলল,
“এই যে মিস্টার শুনুন।”
আরিফ পিছন ফিরে দোলার দিকে তাকালো। মেয়েটাকে ভীষণ বিরক্ত লাগে তার। একদম সহ্য করতে পারছে না এই মেয়েটাকে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে এই মেয়েটাই মুসকানের মাথা বিগড়ে দিয়েছে।
আরিফ দোলার দিকে তাকাতেই সে বলে,
“আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। শুনুন, মেয়েরা না কোন ফেলনা নয়। তাদের যখন ইচ্ছা কষ্ট দেবেন আবার কাছে টেনে নেবেন সবটা এতটাও সহজ নয়। মুসকানের কাছে আপনাদের ব্যাপারে অনেক কিছুই শুনেছি। আপনার বাবা আর দুলাভাইয়ের জন্য নাকি আপনি বিয়ের সম্পর্কে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু আমার তো মনে হয়, আপনিও তাদেরই দলে।”
দোলার কথা শুনে ভীষণ রাগ হলো। আরিফের। সে শুধাল,
“কি বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন।”
“আপনার বাবা আর দুলাভাই সম্পর্কের মূল্য বোঝেনি, তাদের ভালোবাসার মানুষকে গুরুত্ব দেয়নি। আপনিও তো সেই একই দলে পড়ে গেলেন। মুসকান নিজের অতীত ভুলে আপনার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আর আপনি কি করলেন? মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিলেন।”
আরিফ কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“মুসকান একটু বেশি সন্দেহবাতিক।”
“ব্যাপারটা স্বাভাবিক। আপনি একবার নিজেকে দিয়ে বিচার করে দেখুন তো যদি আপনি মুসকানের যায়গায় থাকতেন তাহলে কি ওর মতো রিয়্যাক্ট করতেন না? মুসকান আমায় সব বলেছে যে আপনি নিজের কাজিনকে…”
“ওকে আমি বোনের মতো দেখি।”
“বাট সে তো আপনার নিজের মায়ের পেটের বোন নয়। তাই না? আপনার মনে যাই থাকুক, আপনার মন তো কেউ পড়তে যাবে না। সবাই আপনার বাহিরের কাজগুলোই দেখবে।”
আরিফ দোলার যুক্তিযুক্ত কথা গুলোকে উড়িয়ে দিতে পারল না। সত্যিই তো, মেয়েটার বলা একটা কথাও যুক্তিহীন নয়। সবশেষে দোলা আরিফকে শুধালো,
“আচ্ছা, আপনি আমাকে এটা বলুন যে সেদিন সারারাত আপনি কোথায় ছিলেন। আর সকালে বাড়িতে মুসকানের সাথে এত খারাপ ব্যবহারই বা করলেন কেন?”
“আমি অনেক বড় একটা সমস্যায় ফেসে গিয়েছিলাম। ইন ফ্যাক্ট এখনো সেই নিয়ে চিন্তায় আছি। আমার মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না।”
দোলা আরিফকে পরখ করে নিলো কিছুক্ষণ। সত্যিই আরিফকে বেশ বিচলিত লাগছে। দোলা আরিফকে পরামর্শ দিয়ে বলল,
“আপনার মানসিক অবস্থা যাই হোক না কেন মুসকানের সাথে করা খারাপ ব্যবহারটা কিছুতেই জাস্টিফাইড নয়। কারণ আপনার এই সমস্যার কারণ তো মুসকান নয়। পুরুষদের এই এক সমস্যা বাইরে ঝামেলা করে এসে নিজের নিরীহ বউদের উপর সেই রাগ ঝাড়ে। যাক গে সেসব কথা। আপনার শুধু শুকনো মুখে ক্ষমা চাইলে হবে না। আপনার জন্য মুসকান যতটা কষ্ট পেয়েছে যতটা অপমানিত বোধ করেছে তার থেকে দ্বিগুণ সম্মান দিয়ে তাকে মানাতে হবে। আমি নিশ্চিন্ত যদি আপনি এমনটা করতে পারেন তাহলে ও আপনার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না।”
আরিফ দোলার কথা উপলব্ধি করতে পারে। কৃতজ্ঞতার সাথে তাকায় দোলার দিকে। দোলাকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলে দোলা বলে,
“আমি আপনার জন্য কিছু করিনি। আমি যা করেছি নিজের বান্ধবী মুসকানের জন্য করেছি। ও আপনাদের সবাইকে খুব মিস করবে। মুখে যাই বলুক ওর মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। মুসকানের কিন্তু আত্মসম্মান বোধ প্রখর। আপনার জন্য সে এটা সেক্রিফাইজ করেছিল কিন্তু বারবার তো করবে না। তাই আপনাকে কিছু করতে হবে। এমনি হলে আমি তো মুসকানের যায়গায় থাকলে এত সহজে আপনাকে ক্ষমা করতাম না। অনেক দিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাতাম। তবে মুসকান আলাদা। ওকে বাইরে থেকে শক্ত লাগলেও ও অনেক নরম মনের মেয়ে। তাই আপনি একটু এফোর্ড দিলেই ওকে মানাতে পারবেন। বাকিটা আপনার ইচ্ছা।”
★★★
মুসকান ও দোলা দুজনেই দোলার রুমে বসে আছে। দোলা মোবাইল ঘাটতে ব্যস্ত। আর মুসকান উদাস মনে বিছানায় বসে আছে। মুসকানকে এভাবে উদাস দেখে দোলা ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে,
“Phir Agar Mujhe Tu kabhi na mile
Ham safar mera tu bane na bane
Faslo se mera pyar hoga na kam
Tu na hogi kavbi ab juda…
maine tera nam dil rakh diya
maine tera nam dil rakh diya
Dharkega tu mujme sada
maine tera nam dil rakh diya.”
এই গানটা চালিয়ে দিলো৷ মুসকান নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে দোলার দিকে তাকাতেই সে বলে উঠল,
“তোর বর্তমান অবস্থা দেখে আমার এই গানটার কথাই মনে পড়লো।”
মুসকান কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলিং বেল বাজতে লাগল। দোলা ফোনে মনোযোগ দিয়ে পা দোলাতে লাগল। মুসকানের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“যা গিয়ে দেখে আয় তো, কার আগমন হলো এইসময়।”
মুসকান উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেল আরিফকে। তবে আরিফ এবার খালি হাতে আসে নি। তার হাতে চকলেট, ফুলের বুকে। আরো অনেক কিছু। এসব দেখে মুসকান বলল,
“আপনি আবার কেন এসেছেন এখানে?”
“আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি মুসকান।”
“আমি যাবো না।”
কথাটা বলেই মুসকান দরজা লাগাতে যাবে এমন সময় আরিফ হাত দিয়ে দরজা আটকে দেয়। অতঃপর হাটু গড়ে বসে পড়ে মুসকানের সামনে। ফুলের বুকেটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি আপনাকে নিজের রাণী করে নিয়ে যেতে এসেছি মুসকান। আপনি অতীতের সবকিছু ভুলে চলে আসুন আমার কাছে। আমি কথা দিচ্ছি এবার আমি আপনাকে মাথায় তুলে রাখবো।”
মুসকান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আরিফের কাছে। এমন কিছু সে মোটেও আশা করে নি। সবটাই স্বপ্নেএ মতো লাগছে। সাথে একরাশ ভালো লাগার অনুভূতি এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার মনকে। মুসকান সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে আরিফের দিকে তাকিয়ে রইল। দুজনের চোখাচোখি হলো। কিছুক্ষণ একে অপরের চোখের মাঝেই ডুবে রইল তারা দুজনে। অতঃপর আরিফ মুসকানকে আবার শুধালো,
“আমাকে কি ক্ষমা করা যায়না?”
মুসকান এবার আবেগাপ্লুত হয়ে আরিফের হাত থেকে ফুলের বুকেটা নিয়ে বলে,
“আপনি এমনভাবে আমাকে মুগ্ধ করলেন যে আমি আর না বলে থাকতেই পারব না।”
আরিফ এবার ভীষণ খুশি হয়। উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে মুসকানকে। একটু দূর দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছিল দোলা। সে এবার হালকা কেশে উঠল। দোলার উপস্থিত বুঝতে পেরে দুজনে দূরে সরে এসে নরমাল হওয়ার চেষ্টা করে। দোলা তাদের দুজনের সামনে আসে। মুসকানের হাতটা নিয়ে আরিফের হাতে রেখে বলল,
“এই নিন, আমার বান্ধবীকে আপনার হাতে তুলে দিলাম। তবে এটাই কিন্তু আপনার শেষ সুযোগ। ফারদার, যদি আমার বান্ধবীর সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেন তাহলে কিন্তু আমি ওকে চিরদিনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে আসব।”
“এই ভুল আর করব না বাবা। একবারেই শিক্ষা হয়ে গেছে।”
সবাই সমস্বরে হেসে ওঠে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
#দুই_হৃদয়ের_সন্ধি
#পর্বঃ২২
#লেখিকাঃদিশা_মনি
মুসকানকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরল আরিফ। মুসকান পুনরায় বাড়িতে ফিরে এসে খুব খুশি হলো। তবে মুসকানের প্রত্যাবর্তনে সবথেকে বেশি খুশি হয়েছেন আতিকা চৌধুরী। মুসকানকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত অবস্থায় ফিরে আসতে দেখে তিনি আল্লাহর কাছে লাখ শুকরিয়া আদায় করলেন। এগিয়ে এসে মুসকানকে মিহি ধমক দিলেন। সাথে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,
“খুব সাহস বেড়ে গেছে তাইনা? কোথায় গিয়েছিলে তুমি? জানো কত চিন্তায় ছিলাম!”
মুসকান মাথা নামিয়ে নমনীয় স্বরে বলল,
“ক্ষমা করে দিন ম্যাডাম। আমার আপনাকে অন্তত বলে যাওয়া উচিৎ ছিল। আপনার ছেলের উপর রাগ থেকে শুধু শুধু আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আর ক্ষমা চাইতে হবে না। বারবার তুমি এভাবে বাড়ি থেকে চলে যাবে আর ফিরে এসে বলবে সরি। এসব কিন্তু ঠিক নয় মুসকান। তুমি তো ছোট বাচ্চা নও। এমন বাচ্চামো করা তোমার শোভা পায় না। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোন সমস্যা হলে নিজেরা নিজেরা মিটিয়ে নাও। এভাবে বারবার বাড়ি থেকে চলে গেলে কি সমস্যার সমাধান সম্ভব বলো? তোমাকে তো একটু বুঝতে হবে।”
আরিফ এগিয়ে এসে মুসকানের সামনে দাঁড়ালো। সব ইগো সাইডে রেখে সে বলে,
“দোষটা আমারই ছিল। তাই আমি আবারও সবার সামনে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি মুসকান।”
আতিকা চৌধুরী এবার নিজের ছেলেকে একহাত নিয়ে বললেন,
“তুই তো হয়েছিস আরেকজন। প্রথমে কষ্ট দিবি তারপর এসে ক্ষমা চেয়ে নিবি। ব্যস, তারপর আবার সেই এক কাহিনি চলতেই থাকবে। এসবে আমি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। শোন, এরপর যেন তোদের দুজনের মধ্যে আমি কোন ঝামেলা না দেখি। এরপর এমন দেখলে কিন্তু আমি সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”
মুসকান ও আরিফ সমস্বরে বলে ওঠে,
“আমরা আর এমন কিছু হওয়ার সুযোগই দেব না।”
আতিকা চৌধুরী বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তাই যেন হয়। আর মুসকান তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। বাইরে থেকে এসেছ নিশ্চয়ই অনেক ধকল গেছে। ক্ষিধে লাগলে আমায় বলবে। আমি তোমার ঘরে খাবার পাঠিয়ে দেব।”
মুসকান মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।
★★★
নকশি ফোনে তার মায়ের সাথে কথা বলছিল। আতিফা বেগম প্রথমে নকশির থেকে তার ভালো মন্দের খোঁজ নিচ্ছিল। অতঃপর মুসকানের বিষয়ে জানতে চেয়ে বলেন,
“মুসকান কি ফিরে এসেছে?”
“হুম। ভাইয়া ভাবিকে গিয়ে নিয়ে এসেছে আজ দুপুরে।”
“যাক, নিশ্চিত হলাম। আচ্ছা আমায় একটা কথা বল তো, মুসকান কি তোর জন্য বাড়ি থেকে চলে গেছে?”
আচমকা নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে চমকে উঠল নকশি। তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। কান্না পেল খুব। নকশি ভারাক্রান্ত গলায় বলল,
“তোমার কি আমাকে এতটাই খারাপ মনে হয় আম্মু? হ্যাঁ, আমি মানছি শুরুর দিকে একটা ভুল করেছিলাম। কিন্তু তুমি তো জানো আমি খারাপ মেয়ে নই। আমি কখনোই আর যাইহোক একটা মেয়ের সংসার ভাঙতে চাইবো না। আমি আজও আল্লাহর কাছে সিজদায় লুটিয়ে এই প্রার্থনাই করি যেন তিনি আরিফ ভাইকে আমার মন থেকে মুছে দেন।”
আতিফা বেগম এবার বেশ কঠিন ভাবে বললেন,
“ওখানে যাওয়ার আগে আমাকে কি কসম দিয়ে গেছলি সেটা মনে রাখবি। তুই কিন্তু বলেছিলি তুই আরিফ আর মুসকানের মধ্যে ঢুকবি না। নেহাৎ, আমি তোকে একা শহরে রাখার ভরসা পাচ্ছিলাম না। তোর আব্বুর এই অবস্থা এখন তুই তো আমার সব। শহরে তো আমাদের চেনাজানা আর কেউ নেই। তাই তোর খালার বাড়িতে পাঠিয়েছি। তবে মনে রাখিস যদি তুই ওদের সংসারে কোন অশান্তির কারণ হোস তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। তোকে নিজের হাতে শাস্তি দেব আমি।”
নকশির মন খারাপের পরিমাণ বাড়তে লাগল। নিজের মায়ের এই কঠিন কথাগুলো তাকে ভীষণ পীড়া দিতে লাগল। নকশির মনে তো কোন খারাপ উদ্দ্যেশ্য নেই। এখানে আসার পর সে আরিফের সাথে যতটুকু মিশেছে তা তো কাজিন হিসেবেই। তার থেকে বেশি কিছু তো সে ভাবেনি। যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বাস্তবতাটাকে মানিয়ে নিয়ে মুভ অন করার। মুসকানের সাথেও তো সে আর কোন খারাপ কিছু করেনি। তাও তাকে এভাবে সন্দেহ করছে তার আপন জন্মদাত্রী মা। নকশি আর সহ্য করতে না পেরে কেঁদেই দিলো। কাঁদতে কাঁদতেই তার মাকে বলল,
“তুমি চিন্তা করো না আম্মু। আমি এখন থেকে আরিফ ভাইয়ের থেকে যোজন যোজন দূরে থাকব। যদিও আমার মনে খারাপ কিছু নেই। তবুও এখন থেকে আমি ওর ত্রিসীমানায় যাবো না। প্রয়োজনে ২৪ ঘন্টা নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখব।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলেই ফোনটা রেখে দিলো নকশি। রুমের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দুঃখের সাথে তাকিয়ে রইল বাইরের পানে। দেখতে লাগল রাতের চট্টগ্রাম শহরকে। হঠাৎ করেই তার মনে একটা প্রশ্ন জাগলো। যাকে কখনো পাবোই না তার প্রতি আমাদের অনুভূতি কেন জন্ম নেয়? আচ্ছা পৃথিবীর এমন সব অনুভূতি গুলোকে কি বন্দি করে রাখা যায়না? যা মানুষকে দুঃখে কষ্টে ভড়িয়ে দেয়। প্রতি মুহুর্তে আমাদের দুমড়ে মুচড়ে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়।
★★★
মুসকান রাতে রুমে শুতে এসে আরিফকে উদ্বিগ্নতার সাথে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। মুসকানের মনে আবারো কৌতুহল বাসা বাধে। সে আরিফের কাছে এসে তাকে জিজ্ঞেস করে,
“আপনাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন? কোন সমস্যা?”
আরিফ প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য বলে,
“সেরকম কিছু না। সামনে এক্সাম তো, তাই নিয়ে টেন্সড আছি।”
আরিফের বলা মিথ্যাটা সহজেই ধরে ফেলল মুসকান। কারণ আরিফের মুখ থেকেই বোঝা যাচ্ছে সে কোন বড় বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে। মুসকান ভরসার হাত রাখে আরিফের কাঁধে। তাকে অভয় দিয়ে বলে,
“আমি বুঝতে পারছি আপনি কোন বড় সমস্যায় জর্জরিত। সেদিন সারারাত আপনি বাইরে কা’টিয়ে ফিরলেন। একদম উদ্ভ্রান্তের মতো অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন। রেগেমেগে আমার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করলেন। এসব কিছু কোন ছাড়া নিশ্চয়ই হয়নি। আমার এখন মনে হচ্ছে ঐ রাতে এমন কিছু হয়েছিল যা আপনাকে অনেক বড় সমস্যায় ফেলেছেন। আপনার কাছে রিকোয়েস্ট করছি আমার থেকে কিছু লুকাবেন না। বরং আমার সাথে নিজের সমস্যাটা শেয়ার করতে পারেন। হতেও তো পারে আমি আপনাকে কোন সমাধান বলতে পারব।”
আরিফ হতাশার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“আমি নিজের একটা বিজনেস করতে চেয়েছিলাম মুসকান। আম্মুর তো বয়স হয়ে যাচ্ছে। আর কতদিন করবেন আমাদের জন্য? আমার পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেতেও এখনো অনেক সময় লাগবে। তাই আমি একটা যৌথ বিজনেসে জয়েন করার চেষ্টা করি। যার জন্য প্রত্যেককেই ১০ লাখ করে টাকা দিতে হতো। আম্মুর কাছে এত টাকা ছিল না। তাই আমিও আর চাই নি। বিভিন্ন ব্যাংকেও যোগাযোগ করেছিলাম কিন্তু তারা কোন আমানত ছাড়া এত টাকা দিতে রাজি হয়নি। তখন আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। এমন সময় আবির আমাকে একজনের সন্ধান দেয়। ওনার নাম হলো মেহরাব হোসেন। একজন কুখ্যাত মাফিয়া। উনি নাকি অনেককেই মোটা সুদে টাকা দেন। আমি তো প্রথমে সেখান থেকে টাকা নিতে চাইনি। কিন্তু এই যৌথ বিজনেসে আমার সাথে আরো যারা ছিলো তারা আমাকে ভরসা দিয়ে বলে এখান থেকে যা প্রফিট হবে তা দিয়ে খুব সহজেই টাকা মেটানো যাবে। তখন আমি ভরসা পেয়ে মেহরাব হোসেনের থেকে টাকা ধার নেই। এরপর টাকাটা দিয়ে দেই। প্রথমদিকে বিজনেস ভালোই চলছিল। আমিও আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে মাঝপথে বিজনেসটা একদম ডুবে যায়। এদিকে মেহরাব হোসেন টাকার জন্য তারা দিতে থাকেন। এই মাসের মধ্যে আমাকে দ্বিগুণ সুদে ২০ লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে। ওনার লোকেরাই সেদিন রাতে আমায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সারারাত আমায় অনেক হুমকি ধমকি দিয়েছে। বলেছে এই মাসের শেষ তারিখের আগেই যদি আমি টাকাটা ফেরত দিতে না পারি তাহলে খুব খারাপ হবে। ওরা অনেক ডেঞ্জারাস মুসকান। হয়তো আমাকে প্রাণেই মে’রে ফেলবে।”
আরিফের মুখে সব কথা শুনে মুসকানের বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। সে বলে ওঠে,
“নাহ, এমন কিছু হবে না। দেখবেন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
“কিভাবে ঠিক হবে মুসকান? আমি এতগুলো টাকা কোথায় পাবো?”
মুসকান ভেবে পায়না আরিফের এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨