#দুই_হৃদয়ের_সন্ধি
#পর্বঃ৩১
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আরিফ, মুসকান ও কূজন পাশাপাশি বসে রয়েছে। মুসকান কূজনকে পুরোদমেই বিশ্বাস করছে। সে আরিফকেও নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে কূজন নির্দোষ। মুসকানের কথায় এবং কূজনের বারবার নিজেকে নিরপরাধ দাবি করায় আরিফও গলে গেল৷ তারও মনে হতে লাগল ঐ উর্মি নামের মেয়েটার চক্রান্ত সব। তাই তিন জনে মিলে এই পরিকল্পনা করতে লাগল যে কিভাবে ঐ উর্মির মুখোশ খুলে দেবে সবার সামনে। আরিফ বলল,
“এখন যদি উর্মির সব সত্যি সামনে এসেও যায় তাহলেই বা কি করার? উর্মির সাথে তো কূজনের বিয়ে হয়েই গেছে।”
কূজন সাথে সাথেই বলে ওঠে,
“আমি এই বিয়েটা মানি না। আমার সাথে প্রতারণা হয়েছে। সব সত্যি সামনে এলে আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেব।”
মুসকান সামান্য চিন্তা ভাবনা করে বলে,
‘আবেগ দিয়ে নয়, বিবেক দিয়ে ভাবো কূজন ভাইয়া। তোমার সাথে ঐ মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন চাইলেও তুমি ওকে ডিভোর্স দিতে পারবা না। কম করে হলেও ৬ মাস ওর সাথে সংসার করতে হবে..’
“৬ মাস তো দূর…৬ সেকেন্ডও ঐ ঠকবাজ মেয়ের সাথে থাকব না আমি।”
আরিফ ও মুসকান একে অপরের দিকে তাকালো। আরিফ কূজনের কাধে হাত রেখে বলল,
“তুই কি করবি সেটা তোর সিদ্ধান্ত। তবে আপাতত আমরা তোকে সব ধরনের সাহায্যই করব। যাতে তুই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করতে পারিস।”
কূজন অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়৷ এতক্ষণ নিজেকে যতোটা একা মনে হয়েছিল এখন নিজের উপর ঠিক ততোটাই ভরসা জন্ম নেয়। মনে হয় এখন সে নিজেকে নিরপরাধ সাব্যস্ত করতে পারবে। আর ঐ মিথ্যাবাদী, ঠকবাজ, উর্মিকেও উচিৎ শিক্ষা দেবে।
★★★
উর্মি নিজের রুমে বসে আছে শান্ত হয়ে। তার মন মেজাজ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। যা চেয়েছিল আজ তাই হাসিল করে নিয়েছে সে। তাই তার আনন্দের সীমা নেই। মনে মনে নিজের তারিফ করে বলল,
“বুদ্ধি থাকা দরকার তো আমার মতোই থাকুক। এমন বুদ্ধি যে কেউ তার কাঙখিত ব্যক্তিকে নিজের করে পাবে।”
উর্মি যখন নিজের জয় নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত তখনই রুমে চলে আসে কূজন৷ এসেই রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে উর্মির দিকে। উর্মি ভয়ের পাশাপাশি ভীষণ আনন্দও পায়। অবশেষে এতক্ষণ পর কূজনের দেখা পেল। কূজন এসেই সরাসরি উর্মিকে বলল,
“কেন আমাকে এভাবে ফাসালে তুমি? আমি তোমার কি ক্ষতি করছি?”
“আমি ফাসিয়েছি মানে? এসব কি বলছ তুমি কূজন। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।”
“জাস্ট শার্ট আপ। আর একটা নাটকও করবে না তুমি। এখানে তো বাইরের কেউ নেই। এখন অন্তত নিজের দোষটা স্বীকার করো।”
উর্মি মনে মনে হাসে। সে তো এতো বোকা নয়। উর্মি জানে এখন হয়তো কূজন কোনভাবে তার মুখ থেকে সত্য বের করতে চাইছে। হয়তো তার কথা রেকর্ড করতে চায়। এইজন্য তো নিজের নাটক বজায় রেখে বলল,
“গোটা দুনিয়ার সামনে যা বলেছি এখানেও তাই বলব কূজন। আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু তুমি সেটা স্বীকার করতে চাওনা। তবে সেদিন অনুষ্ঠানে আমার কাছে এসে তো এটা তুমি প্রমাণ করেই দিলে যে তুমি আমায়…”
উর্মির এহেন কথায় ভীষণ রেগে যায় কূজন। নিজের ফোনে উর্মির সব কথা রেকর্ড করার ফন্দি করেছিল সে। কিন্তু চালাক উর্মি সব বুঝে গিয়ে এমন পালটা চাল চালল। যার ফলে কূজন রেগে গিয়ে নিজের ফোন পকেট থেকে বের করে আছা’ড় দেয়। অতঃপর তেড়ে যায় উর্মির দিকে। উর্মির গলা টিপে ধরে বলে,
“শয়তান মেয়ে। তুই কি ভেবেছিস এরকম নাটক করে আমার জীবনে স্থান পাবি? কখনোই না। আমি তোকে কেবল আর কেবল ঘৃণাই করব।”
উর্মি চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে,
“এক সময় তুমি আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য হবে৷ দেখে নিও।”
“এমন হলে আমি নিজেই নিজেকে শে*ষ করে দেব। তবু তোর মতো বেহায়াকে নিজের লাইফে মেনে নেব না।”
বলেই কূজন রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে উর্মি কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ে। সে নিজে নিজেই বলতে থাকে,
“আমি কি কোন ভুল করেছি? না, আমি কোন ভুল করিনি। প্রেম ও যুদ্ধে সব কিছুই জায়েজ। Everything is fare in love and war. তাই আমি ঠিক করেছি। নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য যত নিচে নামতে হয় নামব। তবুও আমি কূজনের ভালোবাসা আদায় করে ছাড়ব। আর এটাই আমার প্রতিজ্ঞা।”
বলেই সংকল্পবদ্ধ হয় উর্মি। এক না এক সময় সে নিশ্চয়ই তার প্রেমিক পুরুষের মন জয় করবে। আর এটার জন্য তাকে যাই করতে হোক না কেন সে করবে। তবুও নিজের প্রেমিক পুরুষের মনে প্রেমের বীজ বপন করবেই। উর্মি নিজের চোখের জল মুছে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“এবার গোটা দুনিয়ার সবাই দেখবে একটা মেয়ে প্রেমে পাগল হয়ে গেলে কতোটা নিচে নামতে পারে। কতটা ডেস্পারেট হতে পারে কাউকে পাওয়ার জন্য।”
★★★
কূজন বেলকনিতে বসে সি*গারেটে ফু দিতে ব্যস্ত। ভীষণ বিরক্ত লাগছে আজ তার। হঠাৎ করে জীবন এভাবে বদলে যাওয়ার কারণে সে মোটেই ভালো নেই। বিশেষ করে এই উর্মি মেয়েটাকে নিজের চারপাশে একদম সহ্য হচ্ছে না। এজন্যই চেষ্টা করছে যথাসম্ভব দূরে থাকার।
হঠাৎ করে উর্মি বেলকনিতে এসে কূজনকে সিগা*রেট খেতে দেখে নাকে হাত দিয়ে বলে,
“ছি, ছি! তোমাকে আমি ভদ্র ছেলে ভেবেছিলাম কূজন। আর তুমি কিনা সিগা*রেট খাও..”
“চুপ কর। তোর জন্য আমাকে এই বদভ্যাস বেছে নিতে হলো। জীবনে যেই সিগা*রেট ছুইনি আজ তোর জন্য..ইচ্ছে করছে তোকে জানে মে*রে দেই। তবুও বোধহয় আমার রুহ শান্তি পাবে না।”
“তোমার আমাকে জানে মা*রতে হবে না কূজন। যখন সময় হবে দেখবে আল্লাহ ঠিকই আমার জান কবজ করে নিবে। তখন আবার তুমি আফসোস করো না।”
“আফসোস মাই ফুট। তুই মরে গেলে আমি আরো আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া আদায় করব।”
উর্মির বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো। তার ভালোবাসার মানুষ কিনা তার মৃত্যু কামনা করছে! ব্যাপারটা ভীষণই বেদনাদায়ক। উর্মির বুক চিড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরোলো। সেও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলল,
“আল্লাহ কূজনের এই দোয়া তুমি কবুল করে নাও। এতোটা ঘৃণা নিয়ে আমি সত্যিই বাঁচতে চাইনা। হ্যাঁ, আমার পন্থাটা হয়তো ভুল ছিল কিন্তু ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা মোটেই ভুল ছিল না। আমি সত্যি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। তাই তো নিজের আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে এত নিচে নামলাম শুধু ওকে পাওয়ার জন্য। আমি হয়তো অপরাধ করেছি কিন্তু যা করেছি শুধু আর শুধু নিজের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। তাই আমার কোন আফসোস নেই!”
এদিকে কূজনের উর্মিকে দেখে ভীষণ রাগ জমে মনে। তাই সে নিজের জ্বলন্ত সিগা*রেট তার পেটে জোরপূর্বক ধরে। উর্মি চেচিয়ে ওঠে। কূজন নিজের সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সরিয়ে নেয়। কিন্তু ততোক্ষণে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। উর্মির পেটের অনেকক্ষানি যায়গা পু*ড়ে গেছে। কূজনের একটু অপরাধবোধ হলেও উর্মির করা অন্যায়ের কথা মনে পড়তেই সে বলে,
“যা হয়েছে একদম ঠিক হয়েছে। ও আমাকে যে যন্ত্রণার মধ্যে ফেলেছে তার তুলনায় এটা কিছুই না।”
এদিকে উর্মি কাঁদতে কাঁদতে বেলকনি থেকে বিদায় নেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
#দুই_হৃদয়ের_সন্ধি
#পর্বঃ৩২
#লেখিকাঃদিশা_মনি
মেহরাবের সাথে দিন গুলো কিভাবে চলে যাচ্ছে নকশি বুঝতে পারছে না৷ টানা কয়েক দিন একসাথে থাকার পর নকশির মনে মেহরাবের জন্য যতোটা তিক্ততা ছিল তার কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। আর হবে না-ই বা কেন? প্রতি পদে পদে মেহরাব যেভাবে নকশিকে সাপোর্ট করে, নিজের মায়ের সব অপমানজনক কথার বিপক্ষে গিয়ে তার হয়ে কথা বলে এসব নকশির মনে একটা সুন্দর চিন্তা ভাবনার সৃষ্টি করেছে। যদিও বা এখনো সে মেহরাবকে মন থেকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারে নি কিন্তু তবুও আগের মতো এতটা ঘৃণাও করতে পারছে না।
নকশি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই দেখতে পায় মেহরাব তৈরি হয়ে কোথাও বের হচ্ছে। নকশি সেদিকে বিশেষ একটা খেয়াল না করে বিছানায় এসে বসল। বিছানায় বসতেই না চাইতেও তার নজর চলে গেল মেহরাবের দিকে। মেহরাব এমনিতেই যথেষ্ট সুদর্শন। উপরন্তু যখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজছিল তখন তাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছিল। নকশি বুঝতে পারছিল না এটা কি হচ্ছিল তার সাথে। মনে মনে নিজেই নিজেকে তিরস্কার করে বলে,
“এসব আমি কি ভাবছি? এই মাফিয়াকে নিয়ে এমন ভাবনা শোভা পায়না। আমার এমন ভাবলে চলবে না।”
মনে মনে এমন ভাবনা করলেও বাস্তবটা যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। নকশি চাইলেও আর আগের মতো মেহরাবকে ঘৃণা করতে পারছিল না। বরং অন্যরকম এক ভালো লাগার অনুভূতি খেলে যাচ্ছিল তার মনে।
অন্যদিকে মেহরাবও আড়চোখে দেখে যাচ্ছিল। তার চোখেও দেখতে পাওয়া যাবে নকশির প্রতি একরাশ মুগ্ধতা। তবে কি এই ভিন্ন দুই হৃদয়ের সন্ধি হতে আর বেশি দেরি নেই?
মেহরাব সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে নকশির সম্মুখে এসে বলে,
“আমি আজ একটা জরুরি কাজে শহরের বাইরে যাচ্ছি। দুই তিনদিন পর ফিরব। তুমি নিজের যত্ন নিও।”
নকশি ঘাড় ত্যাড়ামো করে বলে,
“আমি কোন ছোট বাচ্চা নই। নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারব। আপনাকে আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। বুঝলেন?”
মেহরাবের কেন জানি নকশির মুখ থেকে এমন তিক্ত কথা শুনে রাগের বদলে তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভূত হয়৷ সে জানে না এমন হচ্ছে কেন। কিছুদিন আগেও তো নকশির এমন তেজালো কথা তার গায়ে আগু*ন জ্বালিয়ে দিত। অথচ এখন এসব কথা তার মনে বিষাদসিন্ধুর জন্ম দেয়। এখন কেন জানি মেহরাব ধীরে ধীরে তার মনের অনুভূতি গুলো উপলব্ধি করতে পারছে। তার মনে নকশির প্রতি যে ভাবনা তার যে পরিবর্তন ঘটছে ধীরে ধীরে সেটা এখন সুপষ্ট হয়ে উঠছে তার কাছে। যেই মেয়েটাকে এক সময় উপযুক্ত শা*স্তি দেওয়ার জন্য বিয়ে করেছিল এখন কিনা তারই প্রেমে পড়ে গেছে! ব্যাপারটা বেশ দারুণ লাগল মেহরাবের কাছে। সাথে সাথে সে নিজের মনে সব পরিকল্পনাও করে নিলো। মেহরাব নকশির রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে মনে মনে বলল,
“এই মেহরাব হারতে শেখে নি নকশি। কিন্তু তোমার প্রেমে হেরে গেছে। তবে না, আমি হার স্বীকার করবো না। বরঞ্চ তোমাকে নিজের করে নেব। এর জন্য যা করা দরকার আমি করব। আমাকে শুধু একবার ফিরে আসতে দাও। তারপর আমি তোমার মন জয়ের মিশনে নেমে পড়ব।”
এমন ভাবনা ভেবেই মেহরাব নীরবে প্রস্থান করলো। মেহরাব বেরিয়ে যাবার পরই নকশি করুণ দৃষ্টিতে তাকায় দরজার দিকে। তখন মেহরাবকে ওভাবে কঠিন করে কথা বললেও এখন তার মোটেই ভালো লাগছে না। বারবার মনে হচ্ছে যাওয়ার সময় এমন কঠিন কথা না বললেই ভালো হতো৷ এমন ভাবনা মনে আসতেই সে নিজেকে বুঝ দিলো,
“নাহ, আমি যা করেছি একদম ঠিক করেছি। ঐ মাফিয়া এমন ব্যবহারই ডিজার্ভ করে। বরঞ্চ আমার উচিৎ ছিল আরো খারাপ ভাষা প্রয়োগ করা।”
★★★
উর্মির মন আজ ভীষণ অস্থির হয়ে রয়েছে। আজ সকাল থেকেই এমন হচ্ছে তার সাথে। বারবার মনে হচ্ছে কোন বিপদ হতে চলেছে।
এমন ভাবনা পাশে রেখেই উর্মি কূজনদের বাড়ির রান্নাঘরে গেল। কাবেরি বেগম রান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। উর্মিকে দেখেই তিনি মৃদু হাসলেন। আসলে এই ক’দিনে উর্মির সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। প্রথমদিকে যদিও বা তিনি উর্মিকে একদম সহ্য করতে পারতেন না। বারবার মনে হতো এই মেয়ে তার ছেলের সাথে ছলনা করেছে কিন্তু তারপরেও এই মেয়েটির মিষ্টি ব্যবহার আর আচরণ দেখে বেশিদিন দূরে ঠেলে রাখতে পারেন নি। এখন তিনিও চান কূজনের সাথে উর্মির সম্পর্ক ভালো হয়ে যাক।
উর্মি রান্নাঘরে আসতেই তিনি হেসে বললেন,
“এসো উর্মি।”
উর্মি এসেই কাবেরি বেগমের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“আচ্ছা আন্টি, এই পৃথিবীতে কেউ কোন খা*রাপ কাজ করলে তার শাস্তি এই দুনিয়াতেই পেতে হয় তাই না?”
কাবেরি বেগম রান্নার দিক থেকে মনযোগ সরিয়ে উর্মির দিকে তাকিয়ে বলেন,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন করছ যে?!”
উর্মি একট দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“ভালোবাসায় আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম আন্টি। ভালো খারাপ সবকিছুর পার্থক্য ভুলে গেছিলাম। কূজনকে নিজের করে পাওয়ার জন্য….আমার উপায় ভুল ছিল। আমার উচিৎ ছিল ভালোবেসে ওর মন জয় করার চেষ্টা করা। কিন্তু আমি সেটা করিনি। আমি ভুল পথ বেছে নিয়েছি। আর তার ফলও এই পাঁচ মাস ধরে ভোগ করে চলেছি। এই পাঁচ মাসে কূজন একবারও আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে নি। সবসময় আমার উপর খারাপ ব্যবহার করেছে। অনেক সময় তো গায়ে হাতও দিয়েছে৷ আমি বুঝি এসবই ডিজার্ভ করি। কিন্তু ও যে একটা কথা বারবার জোর দিয়ে বলছে যে আর ১ মাস পর আমায় ডিভোর্স দেবে। এমনটা আমি হতে দিতে চাই না আন্টি। আমি ওর থেকে আলাদা হতে চাই না। আমি কূজনের স্ত্রী হয়ে থাকতে চাই। যদি ওর স্ত্রী হয়ে বাঁচতে না পারি তাহলে ওর স্ত্রী হয়ে মরতে চাই।”
“চুপ করো উর্মি। এমন কথা বলতে নেই। তুমি যা করেছ তা কোন ভুল নয় অন্যায়। এইজন্য আমিও প্রথমদিকে তোমায় মেনে নিতে পারিনি। তবে এখন দেখো আমি তোমার উপর নরম হয়েছি। তুমি আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। দেখবা একদিন কূজনও তোমার উপর নরম হবে। কূজনকেই তো এই বিষয়টা নিয়ে বেশি সাফার করতে হয়েছে তাই ও সবটা স্বাভাবিক ভাবে মানতে পারছে না। তবে দেখে নিও একসময় ও তোমাকে ঠিক নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে।”
“আমার মনে হয়না এই সৌভাগ্যটা হবে।”
বলেই উর্মি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এমন সময় কূজন রান্নাঘরে প্রবেশ করছিল। উর্মিকে দেখেই বিরক্তির দৃষ্টি ফেলে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। উর্মি মাথা নিচু করে নেয়। কূজনের চোখের দিকে তাকালে যে সে নিজের জন্য ঘৃণা ছাড়া কিছুই দেখতে পায়না।
ভীষণ কষ্ট হয় তার। কূজন রান্নাঘরে গিয়ে কাবেরি বেগমকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“আম্মু আমি একটু শাহবাগের ঐদিকে যাচ্ছি।”
“ওখানে কেন? শুনলাম তো শাহবাগে নাকি কিসব আন্দোলন টান্দোলন হচ্ছে।”
“আমি সেই আন্দোলনেই যোগ দিতে যাচ্ছি।”
“তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি কূজন? ওখানে গেলে কত বিপদ হতে পারে জানিস না?”
“আমি একদম ঠিক আছি আম্মু। বিপদের ভয়ে পিছিয়ে থাকে কাপুরুষেরা। আমি তেমন নই।”
কাবেরি বেগম এরপর কূজনকে আটকানোর আরো অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু কূজন তার কোন কথা না শুনে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় উর্মি পিছন থেকে বলে ওঠে,
“না গেলে হয়না?”
“তোর পরামর্শ চেয়েছি আমি?”
উর্মি দমে যায়।
★★★
বিকেল ৪ঃ৪৬ মিনিট। টিভি খুলে বসতেই উর্মি ব্রেকিং নিউজে দেখল শাহবাগে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের হা*মলা। এমনকি উপরমহল থেকে নাকি গু*লি করারও আদেশ দেওয়া হয়েছে। এই নিউজটা দেখেই উর্মির প্রাণ কেপে উঠল। মনে পড়ে গেল কূজনের কথা। কূজনের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা হলো খুব। উর্মি আর থাকতে পারল না। নিউজটা দেখেই ছুটে বাড়ি থেকে বের হলো।
বিভিন্ন অটোরিকশা সিএনজি করে শাহবাগ যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কেউ ওদিকে যেতে চাইল না। শেষে একজন সিএনজি চালক বেশি টাকার বিনিময়ে শাহবাগ থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে যেতে রাজি হলো।
উর্মি সেই সিএনজিতে উঠল। শাহবাগের কাছাকাছি এসেই ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লো। অতঃপর জোরে ছুট লাগালো। ছুটতে ছুটতে বারকয়েক হোচট খেয়ে পড়ল তবু থামল না। একটু এগিয়ে শাহবাগের কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিচার্জ করছে, টিয়ার গ্যাস ছু*ড়ছে।
এরমধ্যে হঠাৎ তার নজর যায় একজন পুলিশ অফিসারের দিকে। যিনি ব*ন্দুক তাক করে আছেন। ব*ন্দুকের নিশানা বরাবর তাকাতেই উর্মির চোখ কপালে ওঠে। আন্দোলনকারীদের মিছিলে একদম সম্মুখ সাড়িতে দাঁড়িয়ে কূজন। দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বিপদ আঁচ করতে পেরেই উর্মি ছুটে গেল সেদিকে। পুলিশ কর্মকর্তা বন্দু*ক দিয়ে কূজনকে নিশানা করে গু*লি ছুড়েন। উর্মি একদম সঠিক সময় এসে কূজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। যার ফলে গু*লি তার বুক ভেদ করে যায়। উর্মি লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। কূজন উর্মির নাম ধরে চিৎকার করে এগিয়ে আসে। তার মাথা তুলে নিজের কোলে রাখে। উর্মিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“এখানে কেন..আর এসব কি..”
উর্মি ধরে আসা কন্ঠে বলল,
“আমি..আজ ভীষণ খুশি কূজন। তোমার জন্য নিজের জীবন দিতে পারলাম। তুমি বলেছিলে না আমাকে আমি যেন তোমার জীবন থেকে চলে যাই। আজ আমি তোমার ইচ্ছাটা পূরণ করলাম।”
“চুপ। একদম চুপ। কিছু হবে না তোর। আমি এক্ষুনি তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।”
“আমার হাতে আর সময় নেই কূজন। আমার একটা শেষ ইচ্ছা পূরণ করবে? আমাকে নিজের স্ত্রীর স্বীকৃতি দিবে।”
“হ্যাঁ, তুই আমার স্ত্রী উর্মি।”
” এবার মরে গেলেও আমার ক্ষতি নেই। ইহকালে হয়তো আমাদের দুই হৃদয়ের সন্ধি হয়নি। কিন্তু পরকালে নিশ্চয়ই হবে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”
বলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে উর্মি। উর্মি মারা গেছে এটা উপলব্ধি করতে পেরেই কূজন উর্মির নাম নিয়ে জোরে চিৎকার করে ওঠে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨