দুই_হৃদয়ে_সন্ধি পর্ব-২২

0
160

#দুই_হৃদয়ে_সন্ধি
#পর্বঃ২২
#Nova_Rahman

রংবেরঙের লাইটিং দিয়ে মনোমুগ্ধকর ভাবে সজ্জিত হয়েছে আজ চৌধুরী ও হাওলাদার বাড়ি উভয়েই। আত্মীয়স্বজনের ভীড় জমেছে বাড়িগুলোতে। ছোট ছোট বাচ্চারা এদিক থেকে ওদিক ছুটাছুটি করছে। তাদের আনন্দের রেশ যেনো পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে তুলছে।

দীর্ঘপথ অতিক্রম করে হাওলাদার বাড়িতে এসে পৌছালেন রিক হাওলাদারের ছোট চাচাতো ভাই রনি হাওলাদার ও তার বউ বাচ্চা, সাথে তার শ্বাশুড়ি আর ছোট দুইটা শালিকা।
গ্রামের বাড়ি থেকে আরো কয়টা চাচি, ফুপিরাও এসেছে হাওলাদার বাড়িতে।
রিক হাওলাদারের বাবা মা মা/রা গেছেন পাঁচ বছর হলো। আপন বলতে তার বন্ধুবান্ধ ছাড়া একুলে আর কেউ নেই। তার নিজের কোনো ভাই বোনও নেই। তাই গ্রাম থেকে পাড়াপ্রতিবেশিদের দাওয়াত করলেন। একমাত্র ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য।

রনি সাহেবের শ্বাশুড়ি হাওলাদার বাড়িতে পা রেখেই চোখগুলো গোল গোল করে বের করে দিলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাক করে পুরো বাড়িটা পর্যবেক্ষণ করলো। এতো সুন্দর বাড়ি তিনি কোনোদিনও দেখেননি। অবাক হওয়ার পাশাপাশি চোখদুটোও জ্বলজ্বল করছে।

মহিলা চোখ বের করা অবস্থায় মেয়ের জামাই রনিকে দুই তিনবার মুখ ঝামটি মেরে জিজ্ঞেস করলো __
কি জামাই! তোমার চাচাতো ভাইয়ের এতো বড় বাড়ি। এতো সুন্দর গাড়ি। আর তুমি কি করলে জীবনে। তোমার কিছু নেই কেনো? সারাজীবন কি ঘোড়ার ঘাস কেটেছিলে নাকি? যে আতা নসিবে কিছুই নেই। গোটা নসিবও খালি, সম্পদের ঘটও খালি। আমার মেয়েটাকে তোমার কাছে বিয়ে দেওয়ায় ভুল হয়ছে বাপু। তার থেকে পাশের বাড়ির রহিমের কাছে বিয়ে দিলেও ভালো হতো। হুহ!

রনি বিরক্ত হলো। বিরক্ত হয়ে শ্বাশুড়ির মুখের উপর জবাব দিয়ে বলল__
শুনুন শ্বাশুড়ি মা। আল্লাহ সবাইকে সব কিছু দেয় না। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছে আমি তাই নিয়ে সন্তুষ্ট আছি। আমার পরিবার চালানোর পাশাপাশি আপনার পরিবারকেও চালাচ্ছি। তারপরেও আপনার শুকরিয়া হয় না। এতোই যখন পাশের বাড়ির রহিম ভালো। তাহলে আপনার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে তার কাছেই বিয়ে দিয়ে দিন। আমার আর লাগবে না। দরকার হলে আরেকটা বিয়া করমু। তারপরেও এতো কথা শুনতে পারুম না।
আর শুনুন বেশি লোভ ভালো না। বেশি লোভে জ্বিভ পোড়ে যায়। বুঝলেন।

রনির কথায় শ্বাশুড়ি মুখ কালো হলো। কালো মুখ করেই তার শ্বাশুড়ি কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিক হাওলাদার তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভাইকে দেখে রনি দ্রুত গিয়ে জড়িয়ে ধরে কুশলাদি বিনিময় করলো।
কুশলাদি বিনিময়ের পর্ব গুছিয়ে, সবাই গিয়ে বসলো ডয়িং রুমের সোফাতে।

ছেলের বিয়ে উপলক্ষে চৈতালি হাওলাদার ভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করাতে, গ্রামের লোকদের আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি।

কিছুক্ষণ সময় পেরুনোর পর, গ্রামের ফুপি চাচিরা একজন আরেকজনকে মুখ ভেঙচিয়ে কানাকানি করে বলতে থাকে__
কি বাড়িতে আসলাম গো আফা। আসার পর চৈতালি একবারও দেখা করতে এলো না। আর নাই বা দিলো এক গ্লাস শরবত।
এতো দূর থেকে এসেছি। এক গ্লাস শরবত কি দেওয়ার জরুরি ছিল না। বাড়িতে মেহমান এলেই মামুষ আগে এক গ্লাস শরবত এনে দেয়। আর এদের দেখো, এরা তো একটু খবরও নিলো না পর্যন্ত । এই নাকি বড়লোক। হুহ!
কিছুটা ব্যঙ্গ করে কথাগুলো বলল গ্রামের চাচিরা।

রোদ দূর থেকে দাড়িয়ে সবকিছু শুনলো। তার মা একা হাতে সবকিছু সামলাতে গিয়ে, এদিক টায় আর আসতে পারিনি। এতেই ভদ্রমহিলাদের মুখে কথার ফুলঝুরি ছুটছে। রোদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কি মানুষরে বাবা। মন্তব্যের কি বাহার!

রোদ আর দাড়ালো না। পরক্ষণেই দ্রুত পা ফেলে রান্নাঘরে গেলো। বড় একটা জগে পানি নিয়ে এতে ওরস্যালাইন মিশিয়ে দিলো। পরপর কয়টা কাঁচের গ্লাসে স্যালাইন পানি ঢেলে নিলো। একটা ট্রেতে করে গ্লাস গুলো সাজিয়ে হাজির হলো গ্রামের মন্তব্যকারী চাচিদের সামনে।

রোদ গ্লাস উঠিয়ে একে একে সবাইকে স্যালাইন পানি দিলো। সবাই হাসি মুখে রোদে থেকে স্যালাইন পানির গ্লাসগুলো নিলো। স্যালাইন পানি খাওয়ার পর,গ্রামের চাচিরা একজন আরেকজনের দিকে চোখ চওয়া চাওয়ি করে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করতে লাগলো।

একজন তো রোদকে ব্যঙ্গ করে বলল,

কি বাবা রোদ ! আমরা গ্রামের মানুষদের জুসের শরবত নাই বা দিলে। তোমাদের ঘরে কি লেবুও ছিলো না? একটু লেবুর শরবতেই দিতে। তাই বলে ওরস্যালাইন দিলে খাওয়ার জন্য। হুহ!

চাচির কথায় রোদ আলতো হেসে জবাব দিলো__

কাকিমা, লেবু ছিলো আমাদের ঘরে। কিন্তু আমি লেবুর শরবত বানাতে পারি না। আর রইল জুসের কথা। জুস কোনো ভালো জিনিস না। এটা আমাদের শরীরে জন্য খুবিই অস্বাস্থ্যকর। জুস তৈরি হয় পঁচা কুমড়ো আর বিভিন্ন ক্যামিকেল দিয়ে। আমি একজন ডাক্তার হয়ে আপনাদের কোনো অস্বাস্থ্যকর জিনিস খাওয়াতে পারিনা। তাই ওরস্যালাইন দিলাম। এটা খুব ভালো। এটা খেলে এনার্জি পাবেন শরীরে।
শরীরে এনার্জি থাকলে ভালো ভালো মন্তব্য করতে পারবেন অন্যদের নিয়ে। অন্যদের নিয়ে মন্তব্য করতে হলেও আপনাদের শরীরে এনার্জি দরকার। কি বলেন।

রোদের কথায় হতভম্ব হয়ে কথা বলতে ভুলে গেছে সবাই। রোদ যে সব শুনে ফেলেছে, তা বুঝতে আর বাকি রইল না কারোরেই। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে সবার। রোদ আর দাড়াল না। চলে গেলো বাড়ির অন্য পাশটায়।
ততক্ষণে চৈতালি হাওলাদার এসে সবাইকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন। কুশলাদি বিনিময় করে, আবারও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।

__________

তরু একের পর এক লেহেঙ্গা দেখেই যাচ্ছে। কিন্তু তার পছন্দের তালিকায় কোনো রংয়েই ম্যাচিং করছে না। তরু হতাশ হলো।
হতাশ হয়ে মেহুকে শুধালো __
এই মেহু! গায়ে হলুদে কি পড়বো আমি। আমার তো কোনো লেহেঙ্গায় পছন্দ হচ্ছে না।
মেহু আঙ্গুলে নেইলপলিশ লাগাতে লাগাতে তরুকে বলল__
রোদ ভাইয়াকে কিভাবে পছন্দ করেছিলি?
মেহুর কথার বিপরীতে তরু কন্ঠ কাঁদে নামিয়ে জবাব দিলো__
প্রথম দেখাতেই।

মেহু চোখ তুললো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাক করে তরুকে একনজর পর্যবেক্ষণ করলো। পরক্ষণেই নকে বাতাস করতে করতে মেহু উত্তর দিলো_
যেভাবে রোদ ভাইয়াকে পছন্দ করেছিস। ঠিক সেভাবেই চোখ বন্ধ করে একটা লেহেঙ্গা সিলেক্ট করে ফেল।
আর যদি বেশি কনফিউশন হয়ে পড়িস। তাহলে তোকে একটা আইডিয়া দিচ্ছি।
শোন!
তুই তোর ভাইয়ের একটা লুঙ্গি আর একটা সেন্টু গেঞ্জি পড়ে বসে তাক। হেব্বি জোস লাগবে দেখতে। হলুদ মাখাতেও সুবিধা হবে। আর লেহেঙ্গা কেনার টাকা টাও বেচে যাবে। ভবিষ্যতে বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে তোর বাচ্চা খাচ্চার জন্য ভালো ডাইপার কিনতে পারবি। বল আইডিয়াটা জোস না।

মেহুর কথার বিপরীতে তরু দাঁত কিড়মিড় করে উত্তর দিলো __
নিকুচি করেছে তোর ফালতু আইডিয়ার। বা**ল! তোর আইডিয়া তোর কাছেই রাখ। দরকার হলে তোর আইডিয়া একটা বালতির মধ্যে জমিয়ে রাখ। যখন তোর মতো কোনো ফালতু মানুষ পাবি। তখন তার কাছে তোর এই ফালতু আইডিয়া বিক্রি করে দিস। আর হ্যাঁ একটা আরএফএল বালতি কিনে নিস। তোর এই ফালতু আইডিয়া জমিয়ে রাখার জন্য। একদম টেঁকসই, ভাঙ্গা-ভাঙ্গির কোনো চান্স নেই।

না হলে দেখা যাবে, তোর এই ডে/ঞ্জা/রা/স আইডিয়ার ভাইরাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তখন দেখা যাবে, এই ভাইরাসের জন্য কোনো ভালো মানুষের মাথায় ব্রেন ইস্টুমার হয়ে গেছে। তখন সেই বেচারাকে অয়েনমেন্ট টেবলেট খাইয়ে দেন হচ্ছে OT করাইতে হবে।

তরু কথাগুলো বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল। মেহুর জায়গায় অন্য কেউ হলে। এতোক্ষণে হেঁসে কুটিকুটি হয়ে যেতো।
তরু আর কথা বাড়ালো না। নিজের মতো করে সাজতে লাগলো নিজে।

মেহুও মুখ ভেঙচিয়ে নেলপলিশ লাগাতে শুরু করলো নকে।
____

রোদসী একটা হলুদ পাঞ্জাবি নিয়ে রোদে পাশে ঘুরঘুর করছে। আর বলছে__
ভাইয়া প্লিজ এটা পড়েনে। গায়ে হলুদের দিন ছেলেরা হলুদ পাঞ্জাবিই পড়ে।
রোদসীর কথার বিপরীতে রোদ হাত উঁচিয়ে রোদসীকে শাসিয়ে বলল,
রোদসী একদম কানে পাশে ঘ্যান ঘ্যান করবি না। আমি এইসব পড়বো না। আমার এইসব নিয়ম কানুন ভালো লাগে না। শুধুমাত্র আম্মুর খুশির জন্য গায়ে একটুখানি হলুদ ছুঁয়াবো। ব্যস এটুকুই।

রোদসী হতাশ হলো। হতাশীত মন নিয়ে রোদকে ফের জিজ্ঞেস করলো_
সত্যি পড়বি না ভাইয়া? রোদ এবারও না বলল। রোদসী আর কিছু বলল না। মুখ গোমড়া করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল রোদের পাশে।
রোদ বিছানা থেকে পাঞ্জাবিটা নিয়ে রোদসীর হাতে দিলো। আর বলল,
তোর যখন এতোই শখ গায়ে হলুদে, হলুদ পাঞ্জাবি পড়ার।
তাহলে শোন!
এই নে, এই পাঞ্জাবিটা যত্ন করে রেখে দে। তোর বিয়ের সময় তোর বরকে পড়তে দিস। শুধু গায়ে হলুদে না, বিয়ের দিনও তোর বরকে হলুদ পাঞ্জাবি পড়িয়ে রাখিস। তাখন তোর মনেরও শান্তি চোখেরও শান্তি। নিজের মনের আশা নিজের জামাইকে দিয়ে মিটাস। আমার উপর এমন অত্যাচার করা বন্ধ কর।
যা এবার বের হো আমার ঘর থেকে। সাথে তোর ভালোবাসার পাঞ্জাবিটাও নিয়ে যা।

রোদসী আর দাঁড়াল না। রোদের কথার বিপরীতে রোদসী দাঁত কটকম করে বেরিয়ে এলো রোদের ঘর থেকে।

রোদসী বেরিয়ে যেতেই কর্কশ শব্দ করে বেজে উঠলো রোদের মুঠোফোন টা। রোদ বিছানা হাতরে হাতে নিলো সেটা। ফোনের স্কিনে জ্বলজ্বল করা অনাকাঙ্খিত নাম দেখে, রোদ মুচকি হেসে কল রিসিভ করলো।

রোদ সময় নিলো, পরক্ষণেই আদর মাখা কন্ঠে তরুকে ডাকলো__
বিবিজান! কি অবস্থা। অসময়ে এই অসভ্য জামাইকে মনে পড়লো যে। আবেশিত মন কি অসভ্য জামায়ের কাছে আসতে চাচ্ছে। আসলে আসতে পারো। আমি সব সময় রেডি থাকি তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য।
আমার কোনো সমস্যা নেই। তোমার যা লাগবে,আমাকে তা নিরদ্বিধায় বলতে পারো। একদম লজ্জা পেয়ো না। লজ্জা পেলেই ঠকে যাবে। মারাত্মক চুমু খাওয়ার ইচ্ছে হলেও আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবে। আমি দৌড়ে যাবো তোমাকে চুমু খেতে।

রোদের কথা শুনে তরু হতভম্ব হয়ে কথা বলতে ভুলে গেছে। তরু কান থেকে ফোন নামিয়ে আবার কানে টেকালো।
তরু দাঁত কটমট করতে করতে বলল,
আল্লাহ এই খবিশটাকে কোত্থেকে আমার ভাগ্যে জুটালে। এর মুখ দিয়ে কি কোনোদিনও ভালো কথা বের হবে না। সবসময় এমন খবিশ মার্কা কথাবার্তা। তরু কয়েক কোটি বার পন করলো, এই লোকের সাথে আর কথা বলবে না। কি সাং/ঘা/তি/ক লোক। যখনেই কথা বলে তখনই বোমা বিস্ফোরণ হয়। ছিহ!

তরুকে চুপ থাকতে দেখে রোদ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে তরুকে বলল,
কিছু বলবে? বলো। আমি শোনছি।

তরু কিটকিটে মেজাজ দেখিয়ে বলল,

আপনাকে বলে কোনো লাভ আছে। আপনি তো সেই অসভ্যতামি শুরু করবেন।

রোদ মিটমিট করে হেঁসে, নেশালো কন্ঠে তরুকে বলল,

অসভ্যতামি করলে আমি আমার বউয়ের সাথেই করছি। পাশের বাসার ভাবির সাথে না। বউয়ের সাথে অসভ্যতামি করলে কেউ মামলা দিবে না। আর কি করবো বলো বউ। তোমাকে দেখলেই মনটা আমার গেয়ে উঠে,

“অভদ্র হয়েছি আমি তোমারি প্রেমে তাই”

প্লিজ কাছে আসো না। তুমি না আসতে চাইলে আমাকে বলো। আমি যাবো তোমার কাছে। দরকার হলে আজকেই বাসর রাত সেরে ফেলবো। তুমি চাইলে বিয়ে আগেরদিন থেকে বাচ্চা নেওয়ার প্রসেসিং ট্রাই করবো। কি বলো বউ।

তরু হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। হাত দিয়ে কান চেপে ধরে, দাঁত কটমট করে রোদকে বলল,
চুপ করুন অসভ্য লোক। মুখে লাগাম টেনে কথা বলুন।

রোদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,

মুখে লাগাম টেনে কথা বলবো কেনো। এখন থেকে আরো বেশি বউ বউ করবো। আমার বউ আমি রোমান্স করবো। সে মোবাইলে রোমান্স করি নয়তো সামনাসামনি। তাতে কার বাবার কি।

তরু ফোনের ওপাশ থেকে চেচিয়ে বলল,

চুপ করুন অসভ্য লোক। আপনার কথা শুনে আমার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। গা গরম হয়ে গেছে।

তরুর কথায় রোদ চিন্তিত গলায় বলল,

কি বলছো তরু। আমি তো এখনও কিছু করিনি। তার আগেই তোমার শরীর গরম হয়ে গেছে। বুঝতে পারছি না, বিয়ের পর তুমি এতো ধকল নিতে পারবে কিনা। আমার তো কোনো সমস্যা হবে না। আফটার অল আ’ম আলসো আ স্ট্রং ম্যান। তুমি চাইলে আমি বিয়ের আগেও ট্রাই করতে পারি। আসবো!

তরু আর কিছু বলতে পারলো না। শরীর কেমন অসাড় হয়ে আসছে। তরু দ্রুত কল কেটে দিলো। তরু বার কয়েক লম্বা শ্বাস টেনে, বিড়বিড় করে বলল,

আস্তো খবিশ একটা।

তরু এবার কল না দিয়ে মেসেজ দিলো রোদকে। মেসেজ দিয়ে বলল,

শুনুন ডাক্তার সাহেব,
যে কারনে আমি ফোন করেছিলাম। ঐ কারনটা তো আমাকে বলতেই দিলেন না। অসভ্যতামি শুরু করে দিয়েছেন। এখন শুনুন,

কালকে আমাকে নিজের করে নিয়ে যেতে চাইলে। আমি যা বলবো তাই করবেন। কালকে পাঞ্জাবির বদলে শার্ট প্যান্ট পড়বেন। সাদা এপ্রোন, গলায় স্টেথোস্কোপ, চোখে গোল চশমা পড়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে আসবেন। একদম আমার ডাক্তার জামাই হয়ে। ঠিকাছে!

তরুর মেসেজ দেখে রোদ ভ্রু কুঁচকালো। কুঁচকানো ভ্রু নিয়ে রোদ মেসেজ টাইপ করে বলল,

পাগল, বিয়ের দিন কেউ ডাক্তারি পোশাক পড়ে অ্যাম্বুলেন্সে আসে নাকি?

রোদের মেসেজ দেখে তরু কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,

কেউ আসলে আসুক না আসলে নাই। আপনি আসবেন। কারণ আপনি ডাক্তারকে দেখেই আমার মনে অসুখ করেছিলো। এখন ডাক্তার বুঝুক। ডাক্তার কি করবে। রোগীকে ভালো করবে নাকি মেরে ফেলবে।

তরুর কথায় রোদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,

আমি প্রেমে মারবো না, প্রেমে মরবো। জাস্ট ওয়েট খুব শিগগিরই আসবো। আমি ডাক্তার হলে তোমাকেও রোগী হতে হবে। একদম রোগীদের ফতুয়া পাজামা পড়ে বসে থাকতে হবে। ইট’স রোগী নববধূ!
ওখেইইই!

রোদ আর কথা বাড়ালো না। তরুর থেকে বিদায় নিয়ে। বেলকনিতে চলে গেলো গিটার নিয়ে।
______

রোদসী আজকে উদয়কে খুব মিস করছে। হঠাৎ করে কয়েকদিন ধরে উদয় রোদসীকে কল দেয় না। রোদসী কল দিয়েছিল। কিন্তু উদয়নে ফোন বন্ধ বলছে। রোদসীর কেমন খটকা লাগছে। ভাইয়ের বিয়েতেও উদয়কে আসতে না দেখে, রোদসীর চিন্তা আরো গাঢ় হলো।

কিছু একটা মনে পরতেই। রোদসী দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে এলো। ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সাদা কালো খাম বের করে আনলো। ঐ দিন দারোয়ান চাচা দিয়েছিল খামটা। খামটা দিয়ে বলেছিলো,
মা রোদসী, রোদ বাবার বন্ধু উদয় বাবা দিয়ে গেছে এই খামটা। তোমাকে দেওয়ার জন্য।
সময়ে জন্য আর পড়া হয়ে ওঠেনি। সাদা কালো খামটা ছিঁড়ে। রোদসী ভেতর থেকে বের করে আনলো একটা রঙিন কাগজের হাতের লেখা চিঠি।

চিঠির ভাজ খুলতেই রোসীর চোখের সামনে ভেসে উঠে শুরুর সেই কথাখানি,

প্রিয় ভৃঙ্গরাজের রুদ্রাণী,
_______________________________

রোদসী সময় নিলো। সময় নিয়ে আস্তেধীরে পড়লো সমস্ত চিঠিখানি। পরক্ষণেই রোদসীর হাত কাঁপতে লাগলো। হাত কেঁপে সযত্নে তুলে রাখা চিঠিখান পরে গেলো মাটিতে। রোদসীর কন্ঠরোধ। রোদসী কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, উদয় থাকে ছেড়ে চলে গেছে সিঙ্গাপুরে।
রোদসীর চিন্তার মাত্রা বাড়তে লাগলো। রোদসী দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। উদ্দেশ্য এখন উদয়ের বাড়ি যাবে। রোদ বেলকনিতে বসে গান গায়ছিলো। হঠাৎ রোদসীকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে, রোদের আর বুঝতে বাকি রইল না রোদসী কোথায় যাচ্ছে। রোদ গিটার রেখে নিজেও বেরিয়ে আসলো বাড়ি থেকে। রোদও গেলো বোনের পিছন পিছন।

রোদসী অনবরত উদয়ের নাম্বারে কল করে যাচ্ছে। কিন্তু ওপর পাশ থেকে বার বার একটা কথায় শোনা যাচ্ছে। ফোন বন্ধ আছে। তরু হোয়াটসঅ্যাপ গেলো মেসেনজারে গেলো। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। সব আইডি ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে।
রোদসী এবার উদয়ের বাড়ির দরজার দিকে দৃষ্টি তাক করলো। মেইন গেইটে মস্ত বড়ো এক তালা ঝুলছে। রোদসী বার কয়েক দরজায় ধাক্কা দিয়ে, উদয় উদয় করে ডাকলো। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না।

এই মূহুর্তে রোদসীর নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে। রোদসী কি করবে ভেবে না পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। দিশেহারাহীন মানবী চিৎকার করে আঁধার রাস্তায় বসে পড়ে। নিশুতি রাতে খ্যাঁক শিয়ালে হুঁকারের সাথে সাথে রোদসীর কান্নার বেগও বাড়তে লাগলো।

নিস্তব্ধ রাতে রোদসীর কান্নার আওয়াজ বাতাসে প্রতিধ্বনি হয়ে, গোমট বাধা পরিবেশটাকে আরো ভ’য়ংক’র করে তুললো। রোদসী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
উদয় চলে আসো প্লিজ। এমনটা কি করে করতে পারলে আমার সাথে। আমাকে না বলে কি করে চলে গেলে। তোমাকে অনেক কথা বলা বাকি আছে। তোমার সাথে আমার সংসার করা বাকি আছে। প্লিজ চলে আসো উদয়। তুমি না আসলে মরে যাবো যে। আমার অন্তরটা সত্যি পুড়ে যাচ্ছে। তুমি আমার সাথে এমনটা করতে পারো না। এইভাবে কিভাবে পারলে আমাকে মেরে ফেলতে?

নিস্তব্ধ রাত যেনো সাক্ষী হয়ে রইলো রোদসীর এই আহাজারির। মেয়েটা কেমন চুপ হয়ে গেছে। কথা বলছে না। না বলা বিচ্ছেদ যেনো অন্তর পুড়িয়ে দিচ্ছে। মানতে কষ্ট হচ্ছে।

রোদ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো বোনকে। কিন্তু কাছে গেলো না। কাছে গিয়ে শান্তনা দেওয়ার মতো মন মানসিকতা রোদের কাজ করছে না।

রোদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

এই কষ্টটা তোর প্রাপ্য রোদসী। কাছের মানুষ দূরে গেলে আমরা তার মূল্যটা বুঝতে পারি। অথচ কাছে থাকলে, তার জন্য আমদের কাছে এ আনা মূল্যও থাকে না। কি অদ্ভুত না!

উদয়কে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। প্রতিটি রাতে ছেলেটা ছটফট করছে ভালোবাসার মানুষটার জন্য। এক আকাশ সমপরিমাণ ভয় আর অবহেলা নিয়ে প্রতিদিন রাতে আমার পাশে ঘুমাতে যেতো। চুপচাপ একপাশ হয়ে শুয়ে থাকতো।
ভয় হতো যদি আমি মেনে না নেই। যদি ভালোবাসার জন্য বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। তখন কি হবে।

উদয়কে কষ্ট পেতে দেখে, আমি শুধু বলতাম। কে সেই ভাগ্যবতী মেয়েটা। যাকে উদয় এতো ভালোবাসে। অথচ মেয়েটা দিন শেষে প্রাপ্তির খাতায় অবহেলা জুড়ে দিচ্ছে।
তখন তো জানতাম না। এই কাল সাপটা তুই রোদসী। যাকগে! ব্যাপার না। উদয় এখন তার জীবনে ভালো আছে। আশাকরি তোর থেকে হাজারগুন ভালো মেয়ে উদয়ের অর্ধাঙ্গিনী হবে।

তোকেও ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিবো। যতোই হোক তুই আমার বোন। তোর কষ্ট আমার সহ্য হবে না।

ঐদিকে রোদসী কান্না করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। রোদ দ্রুত গিয়ে রোদসীকে পাজ কোলে নিয়ে বাড়িতে আসলো। পিছনে রেখে এলো এক বিচ্ছেদের প্রতিচ্ছবি।

#চলবে___ইনশাআল্লাহ