দুই_হৃদয়ে_সন্ধি পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব

0
319

#দুই_হৃদয়ে_সন্ধি
#অন্তিম_পর্ব
#Nova_Rahman

#প্রথম_পরিচ্ছেদ

শেরওয়ানির বদলে শার্ট প্যান্ট পড়েছে রোদ। তরুর কথা মতো সাদা এপ্রোন, গলায় স্টেথোস্কোপ, চোখে গোল চশমা পড়ে একদম পারফেক্ট ডাক্তার জামাই সেজেছে রোদ।
রোদের মতো করে রোদের সকল মেডিকেল ফ্রেন্ডগুলো ও আজ তৈরি হয়েছে। উদ্দেশ্য তাদের, সবাই ডাক্তার সেজে ডাক্তারের বউ আনতে যাবে। বন্ধুদের কান্ড দেখে রোদ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। পরক্ষণেই উদয়ের কথা মনে করে ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। উদয়ের কত প্লানিং ছিলো রোদের বিয়ে নিয়ে। কত কি করবে ভেবে রেখেছিলো ছেলেটা। বন্ধুমহলে বিয়ের কথা উঠলেই সবার আগে উদয় লাফি উঠে বলতো__
রোদের বিয়ের সময় আমি সব কাজ করবো। এমন কি রোদের মতো সেইম ড্রেস পড়বো। উদয়ের এমন বাচ্চামো কথাবার্তা শুনে বন্ধুমহলে তখন হাসির রোল পড়ে যেতো। উদয় তখন কপাট রাগ দেখালে, থমথমে পরিবেশে সবাই ঠোট টিপ হাসতো। এতোকিছু নিয়ে লাফালাফি করা সেই ছেলেটাই আজ নেই।

কাল রাতে হঠাৎ করে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছিলো রোদের কাছে। রোদ কিছুক্ষণ নাম্বারটাতে চোখ বুলালো। এটা তো বাংলাদেশের নাম্বার না। রোদের ভ্রু কুঁচকে এলো। কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে, কিছুটা সংকোচ আর অবাক হয়ে কল রিসিভ করলো রোদ। পরপর তারবিহীন যান্ত্রিক যন্ত্রটাকে কানের পাশে ঠেকাতেই, কোনো এক চেনা পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো বাতাসের সাথে।

রোদ থমকালো। চোখ বন্ধ করে বার কয়েক শ্বাস নিলো। স্থুল কন্ঠ কাঁদে নামিয়ে ডাকলো__

উদয়!

উদয় হাসলো। রোদ যে তার কন্ঠস্বর শুনে চিনে ফেলেছে এটা আর বুঝতে বাকি রইল না। একেই মনে হয় বেস্টফ্রেন্ড বলে।

উদয় সময় নিলো। কিছুটা সময় পেরুনোর পর জিজ্ঞেস করলো__
তা বিয়ের তোরজোর কেমন চলছে ডাক্তার সাহেব। ব্যক্তিগত চাঁদকে কবে ঘরে তুলছেন?

রোদ হাসলো পরপরেই উত্তর দিলো। কালকেই ব্যক্তিগত চাঁদকে ঘরে তুলছি। আর তোকেও টাইম দিচ্ছি। মাত্র পাঁচ বছরের! যদি ইচ্ছে হয় দেশে আসিস। ব্যক্তিগত চাঁদকে ঘরে তুলে নিস। চিন্তা করিস না, তোর জিনিস যত্ন করে রেখে দিবো আমি। শুধু মাত্র পাঁচ বছর।

উদয় থমকালো। গলা শুকিয়ে আসলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজালো। পরপরেই শুঁকনো ঢোগ গিলে বিড়বিড় করে বলল,
রোদ জানলো কি করে আমার আর রোদসীর রিলেশনের ব্যাপারে!

রোদ ফের হাসলো। হাসতে হাসতে উদয়কে বলল,
এতো চাপ নিয়ো না মামা! কি করে জানতে পারলাম এসব জেনে তোমার লাভ নেই। তোমার লাভ যেটাতে হবে। তুমি সেটা নিয়ে ভাবো।

রোদের কথা শুনে উদয় কিছুটা থমথম খেয়ে গেলো।

রোদ এবার কিছুটা গম্ভীর হয়ে উদয়কে কঠিন কন্ঠে শুধালো _

শোন উদয়, রোদসী নিতান্তই একটা ইম্যাচিউর মেয়ে। বাচ্চা মেয়ে ও। যে বয়সে ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দেওয়ার কথা। সে বয়সে এসে বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে রোদসী বইয়ে মুখ গুঁজে রেখেছে। সবার মতো ভালো রেজাল্ট করতে হবে এটা তার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে গিয়েছে। যে বয়সে মেয়েরা পরিবারের ভালোবাসা কি বুঝে না। সেখানে এসে রোদসী ভালোবাসি বলে আবেগে গা ভাসিয়েছে। সেখানে রোদসীর থেকে ভালোবাসা চাওয়াটাও বোকামি।

তুই তো একটা ম্যাচিউর ছেলে। তারপরেও তুই কেনো ইম্যাচিউরের মতো কাজ করলি? কেনো গেলি রোদসীকে ছেড়ে? জানিস তুই চলে যাওয়ার পর আমার বোনটা কি করেছিল। তোকে খোঁজার জন্য তোর বাড়িতে গিয়েছিল। তোকে না পেয়ে আঁধার রাস্তায় হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে মেয়েটা। ঐদিন চিৎকার করে কান্না করেছিল রোদসী। জোছনার আলো হামাগুড়ি দিচ্ছিল মেয়েটা শরীরে। শুভ্র মুখশ্রী রক্তলাল হয়েছি। অশ্রু জলে গা ভিজে ছিলো। কান্না করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল মেয়েটা। বুঝতে পারছিস কতটা হৃদয় জখম হয়েছিলো রোদসীর। ঠিক তখন থেকেই রোদসী কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। কারো সাথে ঠিক করে কথা বলে না। দরজা লাগিয়ে বসে আছে ঘরে।

রোদের মুখে রোদসীর এমন আহাজারির কথা শোনে উদয়ের কন্ঠরোধ হলো। বুকের ভিতরে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। দমবন্ধ লাগছে। উদয় নিজেকে সামলালো। বার কয়েক শ্বাস নিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রোদকে বলল,
আমি আসবো। খুব তারাতাড়ি আসবো। আমার জিনিসটার প্রতি একটু যত্ন নিস। আমি এসে সব দায়িত্ব বুজে নিবো। প্লিজ!

উদয়ের এমন অস্তিরতা দেখে রোদ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। পরক্ষণেই মাথা দুলিয়ে উদয়ের হ্যাঁ তে হ্যা বলল। আরো কিছুক্ষণ কথা হলো দুই বন্ধুর। পরপরেই কল কেটে ঘুমাতে গেলো রোদ।

বাবার ডাকে হুঁশ ফিরল রোদের। ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে দ্রুত পা ফেলে নিচে আসলো রোদ। বন্ধুগন সবাই আগে আগে রেডি হয়ে দাড়িয়ে আছে। রোদ নিচে এসে অবাক হয়ে গেলো। রোদ কিছুক্ষণ অবাক নয়ন তাকিয়ে রইল তার বন্ধুদের দিকে। সবাই রোদের মতো করে সাজবে কথা ছিল। কিন্তু হুবহু রোদকে অনুকরণ করবে, এটা রোদের ভাবনার বাহিরে ছিলো। রোদ হা করে থাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। পরপরেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাক করে পর্যবেক্ষণ করলো সবাইকে।

রোদের কেমন হিংসা লাগলো। জেলাসির টেলাই নাক ফুলে উঠলো। রোদ ভয় পেলো! এতোগুলো এক কালার ডাক্তার দেখে, যদি তার বউ তাকে চিনতে না পারে, তখন কি হবে! রোদ ভড়কালো। রোদ কিছু একটা ভেবে নিজের মধ্যে চেইঞ্জ আনার চেষ্টা করলো। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে হতেই, গায়ের এপ্রোনটা খুলে হাতে নিয়ে নিলো। তখন রোদকে আরো ওভার সুইট লাগছিলো।

রোদ একটু ভাব নিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করে নিলো। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেলো। রোদের পিছন পিছন গেলো রোদের বাকি বন্ধুরাও। রোদ গিয়ে উঠলো নিজেদের গাড়িতে। আর তার বাকি বন্ধুরা তাদের নিজস্ব গাড়িতে।
শো শো শব্দ করে হাইওয়ে রাস্তা দিয়ে ছুটে চললো ২০ টা গাড়ি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে থামলো চৌধুরী বাড়ির সামনে। গাড়ির শব্দ শোনে তরু দৌড়ে গিয়ে বেলকনিতে দাড়ালো। পা উঁচু করে মাথা এলিয়ে রোদকে দেখার চেষ্টা করলো। রোদ আস্তেধীরে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। রোদকে দেখে তরুর চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো।
তরু আজকে হালকা গোলাপি রঙের একটা ভারি লেহেঙ্গা পড়েছে। সাথে মেচিং পিংক স্টোনের জুয়েলারি। তরুকে দেখতে অন্য দিনের তুলনায় আজকে মাত্রাধিক সুন্দর লাগছে। কথায় আছে বিয়ের দিন মেয়েদের সৌন্দর্য নাকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তরু যেনো এর একটি বাস্তব উদাহরণ।

তেজ তার বন্ধুদের নিয়ে গেইট আঁটকে দাঁড়ালো। তাদের ডিমান্ড অনুযায়ী ২০ হাজার টাকা না দিলে গেইট ছাড়া হবে না। অন্যথায় বউ ছাড়া বরকে বাড়ি ফিরতে হবে। সবকিছু দাঁতে দাঁত চিপে দেখে গেলো রোদ। নতুন জামাই বলে কিছু বলতেও পারলো না। রোদের এমন অসহায় ফেইস দেখে তেজ মিটমিট করে হাসছে। টাকা পেয়ে তেজের বন্ধুরা আর দাড়ালো না। চলে গেলো অন্য পাশে।
তেজ যাওয়ার আগে রোদের কানে ফিসফিস করে বলে গেলো __
জামাই বাবু! সুযোগের স্বত ব্যবহার করতে হয়, বুঝলেন। রোদও দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে বাঁকা হেসে বলল,
আমিও যদি তোমাকে সিজার করিয়ে টাকা উসুল করতে না পেরেছি। তাহলে আমার নামও ড. আহনাফ হাওলাদার রোদ না। রোদ দু’হাতে তেজের গালে আলতো হাতে চাপড় মেরে বলল,
সুযোগের স্বত ব্যবহার আমিও করবো শালাবাবু। মেহুর বাচ্চা ডেলিভারি টাইমটা শুধু আসুক! সব টাকা উসুল করে নিবো শালাবাববববুওও!
রোদের কথা শুনে তেজ একটা শুকনো ঢোক গিললো। বেচারা! পাঠ নিতে এসে নিজেই ফেসে গেলো।

সময় পেরুলো। রোদ আর তরুকে সামনাসামনি আনা হলো। রোদ অপলক তাকিয়ে রইল তরুর পানে। যেনো কত জন্মের তৃষ্ণা নিবারন করছে। তরু মাথা নত করে, আটপৌরের ঘোমটা টেনে বসে রইলো রোদের সামনে। রোদ ঠোঁট কামড়ে হাসলো তার লাজে রাঙা আদুরে বউকে দেখে।

কাজী এলো, রোদকে কবুল বলতে বলল। বউ পাগল রোদ কোনো বনিতা ছাড়াই কেমন ফটাস করে কবুল বলে দিলো। রোদের কান্ড দেখে সবাই মিটমিট করে হাসছে। কাজী সাহেবও কেমন ভড়কে গেলেন। এমন বউ পাগল ছেলে তিনি আজকেই দেখছে।

এবার এলো তরুর পালা। কাজী সাহেব মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে তরুকে কবুল বলতে বলল। তরুর কেমন জানি অস্থির লাগছে। হাসফাস করছে মন। অতিরিক্ত নার্ভাসে মেয়েটার কন্ঠরোধ হলো। মনে পড়ে গেলো সেই প্রথম দিনের কথা।
রোদের বলা সেই তিন শব্দের ভালোবাসার কীর্তনখানা।
I love you. এই তিন বাক্যের উচ্চারণে দুই হৃদয়ে সন্ধি হয়েছিলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত গোধূলির প্রথম প্রহরে। দ্বিতীয় বারের মতো তরু পুরোপুরি নিজেকে রোদের নামে করে দেওয়ার জন্য তিন শব্দের বাক্যখানা উচ্চারণ করলো।

“কবুল”

পরপরেই সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। আজকে যেনো আবারও গোধূলির প্রথম প্রহরে দুই হৃদয়ে হালাল সন্ধি হলো। রোদ স্বস্তির একটা নিশ্বাস নিলো।

এবার কন্যা বিদায়ের পালা। চৌধুরী বাড়িতে কন্যা বিদায়ে কান্নার রোল পড়ে গেছে। কি একটা বিচ্ছিরি সোরগোল সৃষ্টি হয়েছে। জাহানারা চৌধুরী আর মেহু কান্না করতে করতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। তাতান চৌধুরীর কেমন চুপ করে বসে আছেন। বাবাদের কাছে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টকর কাজ হলো কন্যা বিদায় করা।
রোদ এগিয়ে গেলো তাতান চৌধুরীর কাছে। হাঁটু মুড়ে বসলো তার পায়ের কাছে। রোদ এবার তাতান চৌধুরীর হাত দুটো নিজের হাতে দৃঢ় মুষ্টি করে ধরলো আর বলল,

চিন্তা করবেন না শ্বশুর মশাই। আমি আপনার মেয়েকে খুব যত্নকরে আগলে রাখবো। আপনারা শুধু দোয়া করবেন। রোদের কথায় তাতান সাহেবের শক্ত মন ভেঙে হুহু করে কান্না করে দিলেন। রোদ সামলালো থাকে। পরপরেই উঠে গেলো তরুর কাছে। তরু চোখ দিয়ে পানির আজ উপচিয়ে পড়ছে।

তেজকে দেখে তরু জড়িয়ে ধরলো গিয়ে। তেজও দু’হাতে ঝাপটে ধরলো বোনকে। তেজের ভিতরে আজ সবকিছু তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। বোনটা তার খেলার সাথী ছিল। হতে পারে তরু একটু উড়নচণ্ডী! তাতে কি বোন তো বোনেই হয়। বোনের শূন্যতা কি আর অন্য কিছুতে পুণ্য হয়!

তেজের চোখ বেয়ে একফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। কেউ দেখে ফেলার আগেই তেজ তা খুব সাবধানে মুছে ফেললো। তেজ এবার তরুকে বুঝাতে একটু সিরিয়াস হওয়ার ভান ধরলো। তেজ তরুকে বলল,
এই নাটক বাজ! নাটক রেখে তাত্তাড়ি শ্বশুরবাড়ি যা। বেশি দেরি হলে তোর জামাই আবার স্ট্রোক করবে। যা বউ পাগল তোর বর।
তরু শুধু দাত কিড়মিড় করে বলল,
আজকে যাচ্ছি কালকে ঠিকিই চলে আসবো। তখন তোকে বুঝাবো দেখিস। তরুর কথার বিপরীতে তেজ মুখ ভেঙচিয়ে বলল,

আরে যা যাহ!

তরু আর দাঁড়াল না। উঠে পড়লো গাড়িতে। গাড়িতে উঠার আগে একদলা থুতুর সাথে নাকে সর্দি মুছে দিয়ে এসেছে তেজের শার্টে। এখন একটু শান্তি লাগতেছে মনে।

#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ

গাড়ি এসে থামলো হাওলাদার বাড়ির সামনে। বউ এসেছে খবর যেনো মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলো হাওলাদার বাড়ির আনাচে কানাচে। চৈতালি হাওলাদার দ্রুত এলেন বউকে ঘরে তুলতে। সকল নিয়ম কানুন শেষ করে বউকে ঘরে তুলা হলো। সবকিছুর মধ্যে গ্রামের চাচিরা একজন আরেকজনকে কানাকানি করে বলতে লাগলো_
দেখেন আপা বউয়ের চুল কেমন বিদেশিদের মতো ছোট ছোট। মন্তব্যকারী চাচিদের কথা শোনে তরু থমকে দাড়ালো। পরক্ষণেই তাদের কথার বিপরীতে তরু হেসে বলল,
আসলে কি হয়েছে আন্টি। আমার বাবার না এতো টাকা নেই। তাই আমাকে তেল কিনে দিতে পারেনা। এইজন্য চুল কেটে ছোটো-ছোটো করে ফেলেছি। তরুর উত্তর শোনে মহিলা গুলোর মুখ চুপসে গেলো। নিরবে নিভৃতে অপমান যাকে বলে।

তরু আর দাঁড়ালো না আস্তেধীরে পা ফেলে সামনে এগুলো। কিছুক্ষণ পর রোদসী এসে তরুকে নিয়ে গেলো উপরে।

রাত তখন ১০ টা। রোদের রুমে খাটের মধ্যিখানে বসে আছে তরু। আর তার চারপাশে ঘিরে বসেছে অন্য মেয়েরা। রোদ এক পলক চোখ বুলিয়ে চলে গেলো রিক হাওলাদারের রুমে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রিক হাওলাদার একটু তারাতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কারো গলার শব্দ শুনে গভীর ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন তিনি। পরপরই চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল রোদের পানে। বিরক্ত হয়ে রোদকে কঠিন কন্ঠে শুধালো __
কি ব্যাপার রোদ। ডাকছো কেনো?

রিক হাওলাদারের কথার বিপরীতে রোদ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল_
আব্বু আমি আমার বউয়ের সাথে ঘুমাবো। রিক হাওলাদার কিছুটা অবাক হয়ে ছেলেকে বলল_________
কিহ! শুধুমাত্র এই কথাটা বলার জন্য তুমি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললে। পাগল হয়ে গেছো? আরে রোদ তোমার বউ তুমি ঘুমাবে, এতে পারমিশন নেওয়ার কি আছে। আজব!

রোদ মাথা চুলকে বলল,
আরে এসপি সাহেব, আমার বউয়ের পাশে অন্য মেয়েরা বসে আছে। এখন আমি কি ওদের সামনে গিয়ে বলতে পারবো, যে আমি বউয়ের সাথে ঘুমাবো। আমার লজ্জা করবে না বুঝি।

ছেলের কথার বিপরীতে রিক হাওলাদার বাঁকা হেঁসে বলল,
তোমার লজ্জা শরম আছে এটা আমাকে মানতে হবে রোদ। লাইক সিরিয়াসলি!

রোদ বিরক্ত হলো। বিরক্তবোধ নিয়েই বাবাকে বলল,
এসব কথা বাদ দিন। আগে আমাকে আইডিয়া দিন। কিভাবে বউয়ের কাছে যাবো। আমি আমার বউয়ের কাছে যেতে না পারলে আপনিও আপনার বউয়ের কাছে যেতে পারবেন না। দরকার হলে আপনার বউকে তার বাপের বাড়িতে রেখে আসবো। তখন বুঝবেন বউ ছাড়া কেমন লাগে।
ছেলের কথা শুনে রিক হাওলাদারের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে রিক হাওলাদার ছেলেকে বলল,
খাটের নিচে দেখো অনেক তেলাপোকা আছে। এখান থেকে দুইটা নিয়ে গিয়ে মেয়েদের মাঝে ছেড়ে দাও। মেয়েরা তেলাপোকা ভয় পায়। সবাই ভয় পেয়ে রুম থেকে পালিয়ে আসবে।
বাবার কথা শুনে রোদের চোখ খুশিতে জ্বলকে উঠলো। পরপর দ্রুত খাটের নিচে মাথা নিয়ে, দুইটা তেলাপোকা হাতে তুলে নিলো। এতো সুন্দর আইডিয়া দেওয়ার জন্য বাপের গালে দুইটা চুম্মা দিলো। উপহারস্বরূপ একটা তেলাপোকা রিক হাওলাদারের শার্টের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে চলে আসলো বাহিরে।

রিক হাওলাদার লাফাতে লাফাতে দাঁতে দাঁত চিপে বলল,
হত্যছাড়া বেয়াদব!

রোদ হাসতে হাসতে চলে এলো নিজের রুমে। রোদকে দেখে একটা মেয়ে দ্রুত রোদের সামনে এসে দাঁড়াল। আঙুল উঁচিয়ে রোদকে শাসিয়ে বলল,
রোদ ভাইয়া আজকে তুমি ভাবির সাথে থাকতে পারবে না। আমার থাকবো ভাবির সাথে। তুমি অন্য রুমে যাও। রোদ কিছু বলল না। বাঁকা হেঁসে পকেট থেকে তেলাপোকাটা বের করে ছেড়ে দিলো সবার মাঝে। তেলাপোকা উড়াল দেওয়ার আগেই মেয়েগুলো উড়াল দিয়ে চলে গেলো অন্য রুমে। এদের কান্ড দেখে রোদ শরীর দুলিয়ে হাসলো।

রোদ দ্রুত গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে তরুর কাছে আসলো। তরু বিছানা থেকে উঠে দাড়াল। দ্রুত পা ফেলে রোদের সামনে এসে দাড়াল। কপাট রাগ দেখিয়ে তরু রোদকে বলল,
কি ব্যাপার। আপনি এমন করলেন কেনো বাচ্চাগুলোর সাথে। এতোদিন অপেক্ষা করেছিলেন যেহেতু আর একটা দিন অপেক্ষা করতে পারলেন না।

তরুর কথা শুনে রোদের জমিয়ে রাখা রাগ গুলো দপ করে জ্বলে উঠে। রোদ দাঁতে দাঁত চিপে, কাঁধ হেলিয়ে বাঁকা হেঁসে, হাত দিয়ে তরুর মুখ চিপে ধরলো। পরপর আকস্মিক রোদের রূপ পাল্টানোতে তরু ভড়কে গেলো। রোদ নিজের রাগ তরুর কাছে প্রকাশ করতে চাইছে না। তারপরেও রেগে যাচ্ছে। রোদ এবার তরুকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তরু যেনো তার বেসামাল রাগ দেখতে না পারে।

রোদ এবার তরুর চুলের ভাঁজে নাক ঘসে বলতে লাগলো। আর কতশত বার তোমার জন্য অপেক্ষা করবো তরু। দু’টা বছর তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। বার বার তুমি বিয়ে ভেঙে দিয়েছো। আর কত? এতোদিন আমি এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। আমি জানতাম__

“একদিন আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে। সেদিন তুমি আমার হবে, শুধু আমার।”

ভয়ে তরুর মরণদশা। চৈত্রের খরার মতো গলার অবস্থা মৃত প্রায়। অতি ভয়ে তরুর কন্ঠরোধ। তারপরেও মনে সাহস নিয়ে,জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রোদকে জিজ্ঞেস করলো__
আপনি কি করে জানলেন! আমি যে এতোদিন বিয়ের ডেইট পিছিয়েছি।

রোদ বাঁকা হেঁসে তরুকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
চাপ নিয়ো না বউ। আহনাফ হাওলাদার রোদ সব জানে।

তরুর ভয় এবার দ্বিগুণ হলো। ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে মেয়েটা।

তরুর ভয়কে আর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য রোদ নিজের মুখ এগিয়ে নিলো তরুর কানের কাছে। রোদ নেশালো কন্ঠে তরুর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

তরু আই নিড ইউ। আই নিউ ইউ ফুললি। কেন আই। প্লিজ তরু। তুমি আমার অনেক প্রতিক্ষারফল।

তরু ভয় পেলো। এমনিতেই রোদ রেগে আছে তার উপর, এখন যদি তরু না করে তাহলে যদি আরো রেগে যায়। তখন কি হবে? তরু আর কথা বাড়ালো না। মাথা ঝাকিয়ে রোদের হ্যাঁ তে হ্যাঁ বলে দিলো।

রোদ বাঁকা হেঁসে তরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
আজকে তো তুমি শেষ সুন্দরী। তরুর কান্না পাচ্ছে ভীষন। এই লোক তো ভয় দেখিয়েই মেরে ফেলবে অর্ধেক। কি সাং’ঘা’তি’ক।
আচমকা রোদ কোলে তুলে নিলো তরুকে। আস্তে করে নিয়ে শুইয়ে দিলো খাটে। রোদ ঘরের সকল লাইট নিভিয়ে দিয়ে ড্রিম লাইট জালিয়ে দিলো। ড্রিম লাইটের আলোয় আবছা আবছা দেখা গেলো রোদকে। রোদ শার্টের বোতাম খুলে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো তরুর দিকে। তরু হাত দিয়ে থামানের চেষ্টা করলো রোদকে। কিন্তু বেসামাল রোদকে থামাতে গিয়ে আরো কাছে ঠেনে নিলো রোদ তরুকে।
রোদ নিজের পা দিয়ে তরুর দু’পা চেপে ধরলো শক্ত করে। একটু ঝুঁকে মুখ এগিয়ে নিলো তরুর কাছে। রোদ খুব গভীর ভাবে তরুর অধরে অধর মিলিয়ে চুমু খেলো। তরুর নিশ্বাস ভারী হলো। দুজনের নিশ্বাস এলোমেলো ভাবে ভারি খেয়ে আঁচড়ে পড়ছে মুখে। রোদ দুরত্ব গোছালো। তরু কাছে টেনে নিলো। যতোটা কাছে আসলে দুজন দুজনার নিশ্বাস পর্যন্ত গুনতে পারা যায়। ঠিক ততোটাই গভীর। রোদ উন্মাদ হলো প্রেয়সীর ভালোবাসায়।

নিস্তব্ধ রাত সাক্ষী হয়ে তাকলো দু’টি মানুষের পূর্ণ্য মিলনে। সব কিছু চাপা পড়ে সরে যাবে আড়ালে, আবারও নতুন একটা সকালের উজ্জ্বলতা।

#তৃতীয়_পরিচ্ছেদ

দেখতে দেখতে আরো বছর দেড়েক পেরিয়ে গেলো। তেজ টেনিং শেষ করে চাকরিতে জয়েন করেছে দু’মাস হলো। তেজের আর মেহুর একটা মেয়ে হয়েছে। নাম রেখেছে মানহা। রোদ তার কথা মতো মেহুর সিজার করিয়ে তেজের থেকে ডাবল বিল নিয়েছে। তখন তেজের অবস্থা ছিল, দিন আমারও আসবে।

জাহানারা চৌধুরীর শরীরটা ভালো নেই। তাই মেহু একাহাতে রান্না করছিলো। আর তেজ মেয়েকে নিয়ে বাগানে হাঁটতে গেলো। রোদের সাথে রাগ করে তরু ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছে। তেজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
এ আর জীবনেও মানুষ হবেনা। শুধু শুধু রাগ করে সিএনজির ভাড়া দিয়ে এ বাড়িতে আসে। রাগ কমে গেলে ঠিকি ব্যাগপত্র নিয়ে আবার শ্বশুর বাড়ি ছুটে চলে। মানহা কান্না করছে তেজ সেদিকটাই তাকিয়ে মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। ম

তরু ব্যাগপত্র রেখে মা আর মেহুর সাথে দেখা করে বাগানে আসলো তেজের কাছে। মানহাকে কান্না করতে দেখে তরু হাত বাড়িয়ে কোলে নিলো ভাইজিকে। তরু এবার তেজকে উদ্দেশ্য করে মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
দেখ তোর মেয়েকে আমি কেমনে তুড়ি মেরে শান্ত করে দিই।
আমি একটা গান গায়বো আর অমনি তোর মেয়ের কান্না বন্ধ হয়ে যাবে।
তরুর কথা শোনে তেজ আঙুল উঁচিয়ে তরুকে শাসিয়ে বলল,
এই তরু একদম আমার মেয়ের সামনে এমন উল্টো পাল্টা গান গায়বি না। কিন্তু কে শুনে কার কথা। তরু একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পুরনো দিনের মতো করে গায়তে লাগলো__

তো কিছ মেরে ফোটো
৷৷ তোর বাপে চালাই অটো
তোর মা চালাই সিএনজি
তুই পড়িস শুধু ছিঁড়া পিঁড়া গেঞ্জি

অদ্ভুতভাবে তরুর গান শুনে মানহার কান্না থেমে যায়। মানহা কান্না থামিয়ে, ফুম্মামে দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। তেজ অবাক নয়নে তাকিয়ে বলল,
আল্লাহ আমার মেয়েতো একদম তরুর কার্বন কপি। পরক্ষণেই তরুর গানের কথা মনে হতেই। তেজ আঙুল উঁচিয়ে তরুকে জিজ্ঞেস করলো__

আমি অটো চালাই আর মেহু সিএনজি! তরু বুঝতে পারলো আবহাওয়া খারাপ দিকে যাচ্ছে। তেজ কিছু বুঝে উঠার আগেই তরু মানহাকে নিয়ে দৌড় লাগায় সামনের দিকে। তেজ পায়ের জুতা খুলে তরুর দিকে ঢিল ছুড়ে মারে। এদিকে সেদিন তেজের সাথে দৌড়াদৌড়ি করে বাড়িতে আসলো তরু।

রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার ঘরে ঘুমাতে চলে গেছে। তরু বেলকনিতে বসে আছে মুখ গোমড়া করে। ঠিক সন্ধ্যা বেলায় রোদ এসেছে তাদের বাসায়। তরু পন করেছে। সে কিছুতেই রোদের সাথে কথা বলবে না। রোদ হাসলো, বউয়ের অভিমান যে বড্ড হয়েছে তা সে বুঝতে পারলো। রোদ তার গিটার টা নিয়ে বেলকনিতে গেলো। তেপায়া চেয়ার টেনে তরুর সামনে এসে বসলো। রোদকে দেখে তরু অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো__

রোদ এবার আলতো হেসে আদর মাখা কন্ঠে তরুকে ডাকলো__
, গান শুনবে বিবিজান।
রোদের এমন ডাকে তরু আর রাগ করে থাকতে পারলো না। তরু খিলখিলিয়ে হেসে মিহি কন্ঠে রোদকে বলল,
আপনি শুনালেই আমি শুনবো জামাইজান।

তরুর কথার বিপরীতে রোদ আলতো হেসে গান গায়তে লাগলো___

যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে
মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে।
বাকিটা সময় যেনো মরন আমার।
হৃদয় জুড়ে নামে অতই আদার

গান গাওয়া সময় রোদ অপলক তাকিয়ে ছিলো তরুর পানে। রোদকে নিজের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তরু তুড়ি বাজালো রোদের সামনে। তরু ভ্রু নাচিয়ে রোদকে জিজ্ঞেস করলো__

কি ডাক্তার সাহেব, এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?

তরুর কথার বিপরীতে রোদ তরুকে দোলনা থেকে তুলে নিজে বসে দোলনাতে। পরপরেই তরুকে বসালো নিজের কোলে। রোদ এবার ঘোর লাগা কন্ঠে তরুকে বলল,
“অসুখ করেছে।”

রোদের কথার বিপরীতে তরু আলতো হেসে বলল,
এতো অনিয়ম করেন কেনো? নিজের যত্ন নিতে পারেন না।

রোদ হেঁচকা টানে তরুকে নিজের সাথে আর একটু মিশিয়ে নিয়ে বলল,

“শোনো মেয়েঅলকানন্দা,”
“ তুমি আমার অসুখের ওষুধ হবে বলে। আমি বার বার অনিয়ম করে অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়ি।”

তরু শুঁকনো একটা ঢোক গিলে তাকিয়ে রইলো রোদের দিকে। রোদ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো। এভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখো মেয়ে? তরু প্রতিত্তোরে বলল,
আপনাকে দেখি।

রোদ ভ্রু কুঁচকে বলল। তাহলে তো অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছো। ইউ নিড টু পানিস্টমেন্ট রাইট নাউ। আমার মতো অবলা ছেলেকে একা পেয়ে চোখ দিয়ে ইভটিজিং করছো। ইউ নিড টু পে ফর দিজ।

তরু ভয় পেলো। উঠে যেতে চাইলে রোদ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রোদ এবার অধরজোড়া এগিয়ে নিলো তরুর দিকে। তরু আলতো হাতে ধাক্কা দিলো রোদের বুকে। রোদ সব বাঁধা তোয়াক্কা করে প্রেয়সীর অধরে অধর ডুবিয়ে দিলো। দু’জনের শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হলো। তরুও এবার রোদের সাথে তাল মিলালো। দুই হৃদয়ে সন্ধিতে জোছনার আলো হামাগুড়ি দিচ্ছে দুটি প্রেম পিপাসু যুগলের শরীরে। আবারও যেনো একবার #দুই_হৃদয়ে_সন্ধি হলো।
এবারের সাক্ষী রইলো আকাশের মস্ত বড়ো চাঁদ টা।

~~~সমাপ্ত ~~

[ দীর্ঘ অপেক্ষার পর আজকে দুই হৃদয়ে সন্ধি গল্পের সমাপ্তি টানলাম। এতো তাড়াতাড়ি গল্প শেষ করতে চাইছিলাম না। কিন্তু কি করবো। সামনে পরিক্ষা। এই জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে গল্পের ইতি টানলাম। যায় হোক, আজকে অতন্ত্য একটা ঘটনা মূলক মন্তব্য করবেন। আর সিজন টু চাইলে কমেন্ট করে জানাবেন]