#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ১৮
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
মধ্যবয়সী বকুলের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে নাযীফাহ। মায়ের পরে এই কোল তার বেশি প্রিয়। কেমন অন্যরকম এক শান্তি বিরাজ করে। বকুল অভিমানের স্বর টেনে বললেন,
‘এখন আহ্লাদ দেখানো হচ্ছে। কই যখন ঢাকা থাকিস একবারও তো ফোন করে আমার কথা জিজ্ঞেস করিস না। তোর আসার খবর শুনে দৌড়ে আসলাম।’
‘চাঁদ কোনদিকে উঠলো? তুমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছো? আগে তো বলেও ছাড়াতে পারিনি।’
চুপ করে রইলেন বকুল। ক্ষানিকটা নুয়ে নাযীফাহ’র কপালে চুমু আকঁলেন তিনি।
‘সংসার পাতলে হয়তো তোর মতো আমারও একটা মেয়ে থাকতো। তাই তো তোকেই আমি আমার মেয়ে মনে করি। তোর কপাল আর আমার কপাল একরকম। মানুষের কটু কথা শুনতে শুনতে দিন পার করি।’
বকুলের একটা কোল বালিশের ন্যায় জড়িয়ে ধরে নাযীফাহ।
‘মানুষ তার চামড়ার মুখ দিয়ে কত কথাই বলবে। এসব গায়ে মাখতে নেই। আগে শুনলে খারাপ লাগতো কিন্তু এখন আর লাগে না। আমি তো আমি কতটা শুদ্ধ। মানুষ বললেই তো আর আমি চরিত্রহীন হয়ে যাবো না।’
বকুল ধরা গলায় বললেন,
‘মানুষ কেন যে রত্ন চিনে না?’
‘চাচি কেমন আছে ফুফু? চাচা কি আগের মতো চাচির সাথে দূর্ব্যবহার করে, গা’য়ে হাত তু’লে?’
হতাশাজনক শ্বাস ফেলে বকুল। তীব্র আক্ষেপ এই শ্বাসে।
‘কথায় আছে না কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না। আমার ভাইয়ের স্বভাবও তেমন। বয়স হচ্ছে কিন্তু স্বভাব পরিবর্তন হচ্ছে না। আমার ভাইয়ের বউয়ের ধৈর্য্য আছে। এতকিছু সহ্য করেও সংসার করে যাচ্ছে।’
নাযীফাহ দু’চোখ বন্ধ করে কাতর স্বরে ডাকল,
‘ফুফু? বাবা আর সালাম চাচার সম্পর্কটা কি আর ভালো হবে না? ছোটবেলায় দেখতাম দু’জনের গলায় গলায় ভাব। হুট করে কি হয়ে গেল। চাচা বাবার ছায়াটাও সহ্য করতে পারে না। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ কিন্তু বাবা উত্তর দেয়নি।’
‘ওদের দুই বন্ধুর সম্পর্ক পুনরায় আগের মতো হবে কিনা জানা নেই আমার। ছোটবেলার দিনগুলো খুব মনে পড়ে আমার।’
স্তব্ধতায় আচ্ছাদিত হয়ে গেল চারপাশ। কারো মুখে কোনো রা নেই। শুধু কর্ণগোচর হচ্ছে শ্বাস প্রশ্বাসের নিনাদ। আনমনে নাযীফাহ’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বকুল। চারপাশে শুধু দুঃখ, কষ্ট আর বিষাদ।
কথার মোড় ঘুরায় নাযীফাহ। দুঃখের কথা বলতে তার একটুও ইচ্ছে করছে না।
‘তোমাকে আমার এতো বেশি ভালো কেন লাগে জানো?’
মৃদুস্বরে হেসে বকুল জিজ্ঞেস করে,
‘কেন?’
‘কারন তোমার নাম ‘বকুল’। আর বকুল আমার প্রিয় ফুল। বকুলের মা’তা’ল করা সুগন্ধি আমার বেশ লাগে। আর তোমার গায়ের গন্ধটাও।’
দুজনের মাঝে আলাপচারিতা চলতেই থাকল।
_____________________
পরিশ্রান্ত বিকেল!কাল রাতে পুরো বাসা জমাট থাকলেও এখন একেবারেই নীরব, জনশূন্য। সোহেল,ফয়সাল আর তাহমিদ নাস্তা করে একসাথেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। তামান্না মেয়েকে নিয়ে তূবার সাথে হাসপাতাল গিয়ে এরপর সোজা নিজের বাসায় চলে গেলো।
‘ভাইকে দিয়েছিস খবরটা?’
তূবা রাশভারী গলায় বলল,
‘দেইনি, দিবোও না।এটাও তোর ভাইয়ের শাস্তি।’
‘বেচারাকে আর জ্বালাতন করিস না। মা কোথায়? সুখবর শুনে মায়ের প্রতিক্রিয়া কি?’
‘আমাকে পা’গল করে ফেলছে। আমি এতো বেখেয়ালি কেন? প্রায় তিন মাস হতে চলল তারপরও আমার খবর নাই আমি প্রেগন্যান্ট। যদি কোনো অঘটন ঘটতো? এসব বলে বলে দু’জন আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। এতোসব ভেজালের মাঝে পিরিয়ডের কথা তো আমার মনেই ছিলো না। আর ফারিয়া পেটে থাকা কালীন যে লক্ষণ গুলো ছিলো এর ছিটেফোঁটাও এবার নেই। শরীর দূর্বল লাগতো তবে খাবারে কোনো প্রকার অরুচি নেই। লজ্জায় বলতে পারি না। আমার সারাদিন শুধু খেতেই ইচ্ছে করে। আর বমি বলতে কাল রাতে একটু হলো।’
‘জানিস আমার ভাইয়ের কথা ভাবতেই মায়া হচ্ছে। এতোকিছু থাকতে তুই ভাইয়ের সংস্পর্শে গেলেই বমি হয়। আহারে বেচারা। মায়ের সাথে কথা বলতে পারবো?’
‘দু’বেয়াইন বাজারে গেল। তেঁতুল আর আমড়া কিনতে।’
‘আর ফারিয়া?’
‘তোর র’ক্ত তো একেবারে তোর মতো।কোথাও কাউকে যেতে দেখলে পা’গল হয়ে যা যাওয়ার জন্য।’
‘উনারা কখন আসবে?’
‘মাত্রই তো গেল। কখন আসে আল্লাহ জানে।’
‘রাখছি তাহলে পরে কথা হবে।’
তামান্নার সাথে কথা বলা শেষ করে তূবার ভীষণ ক্ষুধা অনুভব করলো। কিন্তু ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না। রান্নাঘরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চিন্তা করলো পুডিং বানাবে। পরে ভাবলো না নুডলস করা যাক।
প্রায় মিনিট বিশেক পরে একটা বাটিতে নুডলস খেতে বসেছে সে। অর্ধেক খাওয়া শেষ হতেই বিকট শব্দে কলিংবেল বেজে উঠলো। বেশ বিরক্ত হলো তূবা।বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ স্ফুরিত হয় তার কণ্ঠনালী দিয়ে। হাতে থাকা বাটিটা রেখে পা বাড়ায় দরজার দিকে। দরজা খুলতেই কেউ একজন তূবাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।
_____________________
‘তুমি এমন করছো দাও না ওগুলো। আগে তো তুমিই দিতে। তাহলে এখন এমন করছো কেন?’
ফাহিমের কথায় তার পাশের মানুষটা অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো। চক্ষু জোড়ায় তার অপরাধবোধ। তার মন সায় দেয় না এই ছেলেটাকে এভাবে ন’ষ্ট করতে। তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার করতে। কিন্তু সে অপারগ। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এসব করতে হচ্ছে।
‘নে’শা করা ভালো না। নিজের চেহারা দেখেছিস? সামনে না তোর এইচএসসি পরীক্ষা। যা গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা কর।’
‘অভ্যাস তো তুমিই করিয়েছো এখন বলছো কেন নে’শা করা খা’রাপ।তুমিই তো বলেছিলে নে’শা করলে হাফসাকে ভুলতে পারবো।ও যে আমাকে ধোঁকা দিয়ে ওর বাবার পছন্দ মতো ছেলেকে বিয়ে করেছে সেগুলো ভুলে থাকতে পারবো। তুমি আমার দু-হাত দেখ। দুইদিন ই’য়া’বা না নিতে পেরে দু-হাত কি করেছি।দাও না কয়েকটা। নিজেকে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগে। ব্লে’ড দিয়ে নিজের শরীরটাকে ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত করে ফেলতে ইচ্ছে করে।’
‘তোর বাবা যখন জানবে তুই নে’শা করিস তখন কি হবে?’
চেহেরা জুড়ে আঁধার ঘনীভূত হলো ফাহিমের।বিষন্ন স্বরে বলল,
‘বাবা বেঁচে থেকেও ম’রে যাবে।’
‘সব বুঝিস তাহলে নে’শা করিস কেন? আমি বললেই তুই নে’শা করবি? আর এই বয়সে কিসের প্রেম ভালোবাসা? এখনো ইন্টার শেষ করলি না। কোনো কাজ করিস না। তাহলে কোন বাপ তোর কাছে মেয়ে দিবে? শুনেছি তোর বোন নাকি বাড়ি এসেছে। যা গিয়ে দেখা কর।’
চোখেমুখে ক্রোধ দেখা দিল ফাহিমের। চোখ দু’টো অগ্নি শিখার ন্যায় লাল হয়ে গেলো।
‘ওর কথা বলবে না। ওর জন্য আজ সবকিছু। ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমি বাবার কাছে হাফসার কথা বলতে পারতাম। ওর জন্যই আমি হাফসাকে হারিয়েছি।’
‘বুকে হাত দিয়ে বল তো তোর বোনের বিয়ে হয়ে গেলে তুই হাফসার কথা তোর বাবাকে বলতে পারতি?’
মাথা নুইয়ে ফেলে ফাহিম।
‘শুন ফাহিম, মানুষের কথা বিশ্বাস করবি না কখনো। আজকাল কেউ কারো ভালো চায় না।’
ফাহিম শান্ত, নিস্তেজ স্বরে শুধায়,
‘তুমি কেন আপুকে বিয়ে করলে না?’
স্তব্ধ হয়ে গেলো মানুষটা। ফাহিমের কাছে এমন প্রশ্ন সে আশা করেনি। স্তিমিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ফাহিমের দিকে।
‘উত্তর দিলে না যে?’
মলিন হাসলো মানুষটা।
‘বাড়ি যা গিয়ে বোনের সাথে দেখা কর। আর নে’শা করিস না। নিজের পড়াশোনায় মন দে।’
_____________________
‘মা, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে এখনো তোমার ছেলে এলো না?’
ফাহমিদা বেগম রান্নাঘর থেকে জবাব দিলেন,
‘চলে তো আসার কথা।’
কথা শেষ করতে পারলো না সে এর আগেই ফাহিম এসে উপস্থিত হয়। নাযীফাহ ভাইকে দেখা মাত্র দৌড়ে গেল তার কাছে। দু’গালে হাত রেখে বলল,
‘কেমন আছিস? এভাবে শুকিয়ে গেছিস কেন? ঠিকমতো খাস না?’
কোনো জবাব দিলো ফাহিম। বোনের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে হাত দু’টো ঝাড়া দিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে। ভাইয়ের এহেম আচরণে মনঃক্ষুণ্ন হয় নাযীফাহ’র। যে ভাই বোন বলতে অজ্ঞান ছিলো কি হলো তার? সেভাবেই সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
________________________
আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় হতবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় তূবা।
‘ভালোবাসি তূবা।খুব ভালোবাসি। আমাকে আবারও বাবা হওয়ার খবর দিয়েছো। আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে আমার বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখি।’
ফয়সালের মুখে যতবার সে ভালোবাসি কথাটা তূবার অন্তঃস্থলে ঠিক ততবারই শিহরণ বয়ে যায়।অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার হয়।
‘ফয়সাল ছাড়ো আমাকে। তোমাকে না বলেছি আর এই বাড়িতে পা রাখবে না।এসেছো কেন?’
‘তুমি বললেই আমি শুনবো? তুমি এতো খা’রাপ কেন? একটাবার নিজের মুখে বলতে পারলে না?’
‘আমার অসহ্য লাগছে।বমি করে দিবো কিন্তু।’
‘করে দাও আমার কিছু যায় আসে না। আগে আমি কলিজা ঠান্ডা করে নেই।’
বিলম্ব করলো না তূবা সাথে সাথেই বমি করে ভাসিয়ে দিলো।
তূবা ভাঙা গলায় বলল,
‘নোংরা হয়ে যাচ্ছো ফয়সাল। ছাড় আমাকে আমার নাড়িভুড়ি উল্টে আসছে।’
কোনো রকমে নিজেকে ছাড়িয়ে সেখানেই বসে পড়ল সে। হড়হড় করে বমি করছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ফয়সাল আগে তুমি এসব পোশাক ছেড়ে আসো।’
ফয়সাল মিনিট দশের মাথায় এসে আবার হাজির হলো। তূবা ক্লান্ত হয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। ক্লান্তিতে দু-চোখ নিভু নিভু করছে। ফয়সাল বিনা শব্দে ওয়াশরুম থেকে বালতি এনে জায়গাটা পরিষ্কার করতে লাগল। হালকা শব্দে চোখ মেলে তাকায় সে। সামনের চিত্র দেখে একেবারে স্থির হয়ে যায়। অপলক,অনিমেষ চেয়ে রইলো সেইদিকে।
‘তোমাকে এসব কে করতে বলেছে? একটু পরে আমিই পরিষ্কার করে নিতাম।’
তূবার দিকে তাকিয়ে প্রশস্ত হাসল ফয়সাল। তবে কোনো জবাব দিলো না। জায়গাটা পরিষ্কার করে তূবার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসল। তূবার উদরে হাত রেখে তূবার চোখের দিকে চেয়ে রইলো কিয়ৎকাল। উদরে ঠোঁট ছুঁয়াল সে। ফয়সালের সেই স্পর্শে কেঁপে উঠলো তূবা।
‘আমার আরেকটা পাখির জন্য এসব কাজ করতেই পারি। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি যে আসছে সে নিশ্চয়ই ছেলে। না হলে এতো হিংসুটে হওয়ার কথা না। তোমার সব ঠিকঠাক। শুধু আমি কাছে গেলেই তোমার বমি হয়, কেন? এই ছেলে এখনই আমাকে তোমার কাছ থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছে। দুনিয়ায় আসলে তো তোমার ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিবে না। সর্বনাশ।’
ফয়সালের কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল তূবা।
‘তুমি পারফিউম ব্যবহার করা ছেড়ে দাও। তাহলেই হবে।’
‘আজব পারফিউম তো তাহমিদও ব্যবহার করে।’
ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলে,
‘আমি নিশ্চয়ই তাহমিদকে আলিঙ্গন করি না।’
মুচকি হেসে দু’টো চিকন চুড়ি তূবার হাতে পড়িয়ে দিলো।
‘আমাকে সুখবর দেওয়ার উপহার।’
____________________
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে নাযীফাহ তার মায়ের হাতে একটা শাড়ি, বাবার হাতে পাঞ্জাবি আর ফাহিমের হাতে শার্ট প্যান্টের শপিং ব্যাগ দিলো। ফাহিম এখনো অবদি কথা বলেনি নাযীফাহ’র সাথে। ভাইয়ের পরিবর্তন বেশ ভাবাচ্ছে নাযীফাহকে। সে তো আগে এমন ছিলো না।
কিছু টাকা খালেদ মোশাররফের হাতে দিয়ে বলল,
‘অফিশিয়ালি আমার প্রথম মাসের ইনকামের টাকা বাবা। আমি চাইলেই পারতাম কোনো মাধ্যমে টাকাটা পাঠাতে। আমি নিজ হাতে তোমাকে এই টাকা টা দিতে চেয়েছিলাম। আমি স্বচক্ষে তোমার চোখমুখের উপচে পড়া আনন্দ দেখতে চেয়েছিলাম।’
খালেদ মোশাররফ টাকাগুলো হাতে নিয়ে স্থবির দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই ব্যপারটা পুরো অপ্রত্যাশিত ছিলো। কোনো সন্তান যখন তার ইনকামের টাকা বাবার হাতে তুলে দেয় একজন বাবার জন্য অনেক বড় পাওয়া এটা। অশ্রুসিক্ত নয়নে খালেদ মোশাররফ একহাতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। বাবার সাথে পাল্লা দিয়ে নাযীফাহও কাঁদছে। ফাহমিদা বেগম এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
‘আমার বিয়ে করা লাগবে না বাবা। বিয়ে হয়ে গেলে এই দৃশ্যটা আমি কখনো দেখতে পেতাম বলো? তোমার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটাতে পারতাম?’
অকস্মাৎ ফাহিম বলে উঠলো,
‘বিয়ে করবে কেন? বিয়ে করলে তো এইসব সম্পত্তি ভো’গ করতে পারবে না। স্বামীর বাড়ি চলে যাবে। তাই বিয়ে না করে সবকিছু ভোগ করার ধান্ধায় আছো।’
#চলবে
#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ১৯
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
প্রতিটা কথার নিনাদ শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই চমকিত, বিস্মিত হয় নাযীফাহ। একেকটা বাচ্য যেন তীরের চেয়েও ধারালো ছিলো। যা সোজা কলিজার মাঝ বরাবর আ’ঘা’ত হেনেছে।বি’স্ফো’রি’ত চোখে ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলো অনিমেষ। জলকপাট একেবারে স্থির নাযীফাহ’র। সমস্ত কায়া অসাড়, জড় বস্তুর ন্যায় হয়ে গেল। অত্যধিক রাগে ফুঁসছে ফাহিম। সেই রাগের ভাড় সামলাতে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। ফাহমিদা বেগমও তার অতি আদরের ছেলের আনন পানে চেয়ে রইলেন। সেদিনই তো সবকিছুর জন্য মাফ চাইলো।
নিজের শরীরের স’র্বস্ব শ’ক্তি দিয়ে ফাহিমের গা’লে চ’ড় বসালেন খালেদ মোশাররফ। রাগের প্রকোপে পুরো শরীর কাঁপছে উনার। দাঁত কিড়মিড় করছেন তিনি। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। রাগে, ক্রোধে পুরো চেহেরা র’ক্তি’ম বর্ণ ধারণ করেছে। ফাহিম তার বাবার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নাযীফাহ দেওয়া শার্ট প্যান্ট মেঝেতে ছুড়ে মা’রে। হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
নাযীফাহ’র উদাসীন, নিরাবেগ, নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর।
‘বাবা? তোমার ছেলে এগুলো কি বলে গেল? আমি কি বাবা এখনি ওর বোঝা হয়ে গেলাম? আমার কি করা উচিৎ বাবা? আজ কেন জানি মনে হচ্ছে আমার মৃ’ত্যু’ই সবকিছুর সমাধান। তোমরা একটু শান্তি পাবে আমি ম’রে গেলে।’
তৎক্ষনাৎ মেয়েকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন ফাহমিদা বেগম। সন্তানের মুখে এমন কথা কোনো বাবা মা’ই সহ্য করতে পারবে না। ফাহমিদা বেগম ধরা গলায় বললেন,
‘দশ মাস পেটে ধরে ম’র’ণ যন্ত্রণা ভোগ করে জন্ম দিলাম এই কথা শোনার জন্য?’
কোনো জবাব দিলো না নাযীফাহ। তার কানে শুধু বাজছে ছোট ভাইয়ের কথাগুলো। এইতো সেদিনও সে হ্যাফ প্যান্ট পড়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে বিচার দিলো তাকে নাকি কে মে’রে’ছে। আর আজ সেই ভাই এতোটা বড় হয়ে গেলো?
মাথায় হাত দিয়ে এক পথহারা পথিকের মতো বসে আছেন খালেদ মোশাররফ। উনার মস্তিষ্কে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে ছেলেকে তিনি মানুষ করতে পারেননি। বাবা হিসেবে তিনি ব্যর্থ।
সভাতলে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে ফাহিম। তার একবার মনে হচ্ছে এসব বলা ঠিক হয়নি। ছোটবেলায় দিনের বেশির ভাগ সময় সে বোনের ছায়াতলে কাটিয়েছে। নিজের মুখের খাবার তার মুখে তুলে দিয়েছে। ছোটবেলায় কারো সাথে ঝগড়া করে বাড়ি এলে তার মা তাকে আরেক দফা মা’র’তো। তখন আশ্রয় নিতো বোনের কাছে। আজ সেই মায়ের মতো বোনকে কথার বানে জর্জরিত করেছে। আরেকবার মনে হচ্ছে বেশ করেছে বলেছে। এই বয়সে এসে কেন বিয়ে করছে না? সম্পত্তি ভোগ করার জন্যই তো। ওর বয়সী সবারই তো বাচ্চা আছে।
দরজার ঠকঠক শব্দে ধ্যানভঙ্গ হয় ফাহিমের। আরো একবার ঠকঠক শব্দ কানে এলো তার। নিরুত্তর রইলো সে। আবারও কড়া নাড়ার শব্দ কানে পৌছাতেই চেঁচিয়ে উঠে ফাহিম।
‘দেখছো না দরজা খুলছি না আবার কড়া নাড়ছো কেন? আমাকে বিরক্ত করবে না বলে দিলাম। তোমাদেরকে দেখলে অসহ্য লাগে।’
এবার অনবরত ঠকঠক শব্দ হতেই লাগল। ফাহিম এক প্রকার বিরক্ত হয়ে দরজা খোলে। নাযীফাহ বিষন্ন, অপ্রফুল্ল, বিষাদভারাতুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফাহিম দরজা খোলায় মলিন হাসলো সে। ফাহিমের চোখের দিকে তাকিয়ে কান্না পেয়ে গেলো নাযীফাহ’র।কিন্তু কান্না করলে চলবে না। ছুঁড়ে ফেলা সেই শার্ট প্যান্ট ফাহিমের হাতে দিলো। জড়িয়ে যাওয়া স্বরে তার মুখ থেকে নিঃসৃত হলো,
‘আমার ইনকামের টাকা দিয়ে কিনেছে এটা। চোখেই সামনে অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখলে কষ্ট লাগবে। আপাতত রেখে দে। আমার অগোচরে না ফেলে দিস। তখন তো আর আমি জানবো না।আমার কষ্টও লাগবে না।’
এক সেকেন্ডও সময় বের করলো না নাযীফাহ। দ্রুত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।
নাযীফাহ চলে যেতেই একেবারে স্থির, নিশ্চল হয়ে গেলে ফাহিম। বোনের সাধারণ কয়েকটা কথা মমার্থ ছিলো বিশাল। বিমূঢ়, অচৈতন্য হয়ে দরজা আঁটকে এগুলো খাটের ওপর রাখলো সে। সম্মুখের চুল গুলো টেনে ধরলো। সে অনুভব করলো নিজেকে আর সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার কখন রাগ হচ্ছে আর কখন শান্ত হচ্ছে কিছুই সে উপলব্ধি করতে পারছে না। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো, ‘এসব কি তার নে’শা করার ফল?’
________________________
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তূবাদের বাসা থেকে ফয়সাল চলে গিয়েছিল। কয়েক ঘন্টার জন্যে এসেছিল সে। তামান্না মুখ থেকে যখন সুখবর টা শুনেছিল কয়েক মুহুর্তের জন্য সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তূবাকে একটা পলক দেখার জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিল সে। তাইতো এমডি কে কোনোরকম বুঝিয়ে এসেছিল। শেষ মুহুর্তে তূবার কপালে সুদীর্ঘ চুমু এঁকে বলেছে,
‘আমি কিন্তু রাতে আসবো।’
প্রতিত্তোরে তূবা ভেঙচিয়ে বলেছিল,
‘এখন কাছে ঘেঁষতে দিয়েছি বলে কি রাতেও দিবো নাকি? বাসায় ঢুকতে দিবো না।’
উচ্চশব্দে হেসে প্রস্থান করেছিল ফয়সাল।
অফিস থেকে ফিরে টেবিলের উপর দু’টো মিষ্টির প্যাকেট রেখেই তাহমিদ নিজের রুমে দৌড়ে গেল। নতুন সিমটা খুঁজে বের করতে হবে। তার মন বলছে নাযীফাহ তার খোঁজ করেছে। তার মনটা কু ডাকছে। বার বার মনে হচ্ছে নাযীফাহ’র বিয়ে হয়ে যাবে।
রুমে এসেই পুরো রুম এলোমেলো করে ফেলল সে। কোথাও নেই। রুমের প্রতিটা কোণা খুঁজেছে। কেথায় রেখে মনে পড়ছে না তার। চিন্তামগ্ন হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো।
দরজায় ঠেস দিয়ে তূবা বিদ্রুপের স্বর টানে,
‘আমাকে একটা বার অভিনন্দন জানালি না? তোকে আবার মামা হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। আমার পছন্দের ছানার মিষ্টি নিয়ে এসেই বুঝি দায়িত্ব শেষ?’
মাথা উঁচিয়ে বোনের দিকে অসহায় চাহনি নিক্ষেপ করলো তাহমিদ। ভাইয়ের বিষাদময় আদল দর্শিত হতেই বড় বড় পা ফেলে আসল কাছে। ব্যতিব্যস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’
‘তোকে নাযীফাহ’র কথা বলেছিলাম না? একটা নতুন সিম কিনে ওর সাথে অচেনা প্রমিক হয়ে বিভিন্ন বার্তা পাঠাতাম। তোর আর ফয়সাল ভাইয়ের ঝামেলার কারনে কয়েকদিন প্রেমিক পুরুষ রূপে আর কোনো খোঁজ খবর নেইনি। ও তো সারাক্ষণ আমার চোখের সামনেই থাকে তাই। কাল অফিস যায়নি আজ গিয়ে শুনি ও ছুটি নিয়েছে। তনয়ার কাছে শুনলাম বাড়ি গিয়েছে। আমার না কিছু ভালো লাগছে না। বার বার মনে হচ্ছে বিয়ে সংক্রান্ত ব্যপারে ও বাড়ি গিয়েছে। আমি কি আবারও ওকে হারিয়ে ফেলবো?’
তূবা সান্ত্বনার স্বরে বলল,
‘আরে এতো টেনশন করার কি আছে? এই নাম্বার থেকে না কল কর।’
তাহমিদ বোনকে বুঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
‘এই নাম্বার থেকে কল করলে আমি শুধু অফিশিয়াল কথা বলতে পারবো। আর ওই নাম্বার থেকে মেসেজ করলে খুটিনাটি সব তথ্য জানতে পারতাম।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে তুই আমার নাম্বার থেকে কল করে স্বরে ভিন্নতা এনে কথা বল।’
বোনের এই কথাটা মনে ধরলো তাহমিদের। তূবার নাম্বার থেকে বার কয়েক কল করলো নাযীফাহ’র নাম্বারে।প্রতিবারই রিং হতে হতে কে’টে গেলো। তাহমিদের টেনশনের মাত্রা যেন কয়েক গুন বেড়ে গেল।
________________________
ঘুটঘুটে, প্রগাড় অন্ধকার কক্ষে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই জ্বলন্ত মোমবাতির দিকে তাকিয়ে আছে একজন। জলকপাট স্থির রেখে একটু একটু করে মোমের গলে যাওয়া অবলোকন করছে সে। মোমের সেই ক্ষুদ্র অ’গ্নি’শিখায় একটা আঙুল নাড়াচাড়া করতে করতে মিটিমিটি হাসতে লাগল।
‘আমি ঠিক যেমনটা চাই তেমনটাই হয়। আমি চেয়েছি তোমার মেয়ে গ্রামে আসুক, এসেছে। আমি চেয়েছি তোমার ছেলে বেপথে যাক, গিয়েছে। ‘
হুট করে তার চোখ দুটো মোমের অ’গ্নি’শি’খা’র ন্যায় লালাভ হয়ে গেলো। ক্রোধ,রোষ তার দুই চক্ষে ভাসমান।
‘আর আমি এইবার চাই কেউ তোমাকে সামনাসামনি অপদস্ত করুক। আমি সেই দৃশ্য স্বচক্ষে অবলোকন করবো। তোমার মেয়েটার জন্য আমার বেশ মায়া হয়। তোমার জন্য তাকেও ফাঁসতে হচ্ছে।’
____________________________
নিস্তব্ধ, নিঝুম,স্তিমিত এই আঁধারিতে পুকুর পাড়ে বসে আছে নাযীফাহ। ঘুম আসছে না তার। মাঝে মাঝে একাকী নিজের সাথে সময় কাটানো উচিৎ। পুকুর পাড়ের হিমশীতল পবন গাত্র ছুঁয়ে দিচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে। শরীর শীতল হচ্ছে কিন্তু মন? সে তো উত্তপ্ত অনলের ন্যায়। প্রগাঢ় রজনীর গা ছমছম পরিবেশে সে ব্যস্ত পানির কলকল ধ্বনি শুনতে। শুকনো পাতার মড়মড় আওয়াজে নাযীফাহ’র মনে হলো ওখানটায় কেউ আছে। ক্ষনিকালয়ে গোচরীভূত হলো না কিছুই। পাত্তা দিলো না তেমন একটা। যার আপাদমস্তক যে দুঃখ দিয়ে ঘেরা তাকে কি আর ভয়, সংঙ্কা গ্রাস করতে পারে? পাশেই উল্টে রাখা মোবাইল টা হাতে নিলো। পাওয়ার বাটন করতেই দেখল একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে বেশ কয়েকটা কল এসেছে। সাইলেন্ট মুডে থাকায় হয়তো শুনতে পায়নি। একবার ভাবলো কলব্যাক করবে। সময়ের দিকে তাকিয়ে সেই ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখলো সে। অতঃপর সেই অচেনা পুরুষের চেনা নাম্বারটায় ডায়াল করলো। ফলাফল জিরো। তার মনে আবারও স্পৃহা জাগলো বার্তা পাঠানোর।
‘ভীতিগ্রস্ত মন পুনরায় স্বপ্ন বুনার দুঃসাহস করেনি। অন্তঃস্থলে থাকা হৃৎ এর খবর নেওয়া হয়নি বহুকাল। অবহেলা, অনাদরে থাকা বস্তুটা খবর নেওয়া শুরু করলেন আপনি। আর আমার সুখ লো’ভী মন একটু খানি সুখের আশায় স্বপ্ন বুনতে লাগল। একটু একটু করে আমার স্বপ্নগুলে যখন বিশাল আকার ধারন করলো, হারিয়ে গেলেন। একটু খানি সুখের আশায় আমিও অপেক্ষায় রইলাম পরে দেখি সে সুখ না মরীচিকা। আমি বরাবরই আনাড়ি, সুখ না চিনে মরীচিকার পিছনে ঘুরাঘুরি করি। ভেবেছিলাম কোনো একদিন আপনার সাক্ষাৎ পাবো। তা বোধহয় আর হবে না। আমি যে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মেসেজ সেন্ট করে হিমশীতল হাওয়া নিঃশ্বাসের সাথে টেনে ভেতরে নিতে লাগল। যদি ভেতরের উত্তপ্ত অনল একটু প্রশমিত হয় সেই আশায়।
#চলবে
বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।