দৃষ্টির অলক্ষ্যে পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
536

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#অন্তিম_পর্ব
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

‘তাহমিদ নাযীফাহ কে ধর। আমি পেটের জন্য ধরতে পারছি না।’

তৎক্ষনাৎ তাহমিদ দৌড়ে এসে নাযীফাহ কে বুকে আগলে নেয়। এরপর এক এক করে সবাই কাছে আসে। জ্ঞান হারিয়েছে নাযীফাহ। হয়তো এতো বড় সত্যিটা মেনে নিতে পারছে না। মানসিক চাপ টা বেশিই হয়ে গিয়েছে।

‘ওর চোখেমুখে পানির ছিটিয়ে দে।’

‘তাহমিদ ভাই আমি কি মাকে ডাকবো?’

ফাহিমের কথা তাহমিদ তড়িৎ গতিতে বলে,

‘না না ডাকার দরকার নেই। আমি সামলে নিবো। ফয়সাল ভাই তূবাকে নিয়ে ঘুমোতে যান অনেক রাত হয়েছে। ফারিয়া কে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন। মা তুমিও মাউই মা কে নিয়ে ঘুমোতে যাও তোমরা আবার অসুস্থ হয়ে যাবে। আমি চাইলেই পারতাম এসব বিষয় আমার শ্বশুরের সাথে আড়ালে খোলাসা করতে। নাযীফাহ’র নেগেটিভ খবর তোমার কানেও গিয়েছে। আমি চাইনি নাযীফাহ সম্পর্কে তোমার মনে কোনো সন্দেহ থাকুক। কখনো মনে হউক মেয়েটা বোধ হয় আসলেই খারাপ ছিল। তাই আজ সবকিছু তোমাদের সামনে উন্মোচন করলাম। ফাহিম ওনাদের কি করবা করো। আমি নাযীফাহ কে নিয়ে রুমে যাচ্ছি। চিন্তা করো না।’

নাযীফাহকে পাঁজা কোলে করে উঠে দাঁড়ায় তাহমিদ।

‘দাঁড়াও জামাই বাবা।’

আচমকা ডাকে থমকে দাঁড়ায় তাহমিদ। হালিমা এলোমেলো পায়ে এগিয়ে এসে তাহমিদের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। অচেতন নাযীফাহ’র সারা মুখে হাত বুলিয়ে বলেন,

‘ওকে বলে দিও সব মা খারাপ হয় না। এই মায়ের দোয়া ওর সাথে সারাজীবন থাকবে। এই কপাল পোড়া স্ত্রী আর অভাগী মায়ের সকল সুখ যেন আল্লাহ ওর ভাগ্যে জুড়ে দেয়। আমি এই দোয়া সব সময় করবো।’

অতঃপর তাহমিদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

‘জীবনে আরো বড় হও বাবা। আরো সুখী হও। তোমার মতো সন্তান যিনি জন্ম দিয়েছেন তিনি ধন্য।’

_____________________

রুমে নিয়ে নাযীফাহ’র মুখে পানির ছিটিয়ে দিতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় নাযীফাহ। নাযীফাহ তাহমিদের শার্ট আঁকড়ে ধরে বলে,

‘আমাকে আপনার বুকের সাথে মিশিয়ে নিন। আমি ঘুমাবো। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আপনার বুক থেকে আমাকে সরাবেন না প্লিজ।’

বলতে বলতে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল।

মুয়াজ্জিনের কন্ঠে সুমধুর আজানের ধ্বনি শ্রবণগ্রন্থি কোমলভাবে স্পর্শ করতেই পিটপিট করে তাকায় তাহমিদ। তার বুকে মাথা রেখে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে নাযীফাহ। মাত্রই আজান পড়ল। আলো ফুটতে বহু দেরি। নাযীফাহ’র চুলে ঠোঁট ছুঁয়াল সে। নরম স্বরে কয়েকবার ডাকতেই উন্মুক্ত হয় নাযীফাহ’র চোখের পাতা। হুট করে ঘুম ভাঙায় মস্তিষ্ক কাজ করছে না। আহাম্মকের মতো তাহমিদের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সবকিছু স্বাভাবিক হতেই রাতের কথা তার মস্তিষ্ক জানান দেয়। আবারও তাহমিদ কে আঁকড়ে ধরে কেঁদে দেয় সে। তাহমিদ তার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,

‘তুমিই তো বলো তুমি খুব স্ট্রং তাহলে এভাবে কাঁদছ কেন? তোমার কান্না দেখে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। সবকিছু খোলাসা না করলে হয়তো এভাবে কান্না করতে না।’

ধীরে ধীরে নিজের কান্না থামায়। কিন্তু হেঁচকির কারনে মৃদু শরীর কাঁপছে তার।

‘মেঠোপথে হাঁটতে যাবে? তোমার দুঃখগুলো না হয় রাস্তায় আমরা একটু করে বিলিয়ে দিবো। স্নিগ্ধ সকালের নির্মল হাওয়া মনকে সতেজ করবে। আমার বহু দিনের শখ বউয়ের পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটবো।’

নাযীফাহ সম্মতি দিতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তাহমিদ।

‘তাহলে তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।আমি ফয়সাল ভাই আর তূবাকে ডেকে তুলছি। কাক ডাকা ভোরে হাঁটলে ওদেরও মন ভালো হবে।’

____________________

দুই জোড়া দম্পতি হাঁটতে বের হয়েছে। নাযীফাহ ধীর পায়ে হাঁটছে। চেহেরায় মলিনতার ছাপ। তাহমিদ একটু পর পর নাযীফাহ’র দিকে তাকাচ্ছে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। আপনজনের একটুখানি আ’ঘা’ত আমাদের কতটা নির্জীব করে দেয়।

পিছনে হাঁটছে ফয়সাল আর তূবা। আট মাসের উঁচু পেট তার। ফয়সাল তাকে একহাতে আগলে রেখে হাঁটছে পায়ে পা মিলিয়ে সমান তালে।

মাটির রাস্তার দুই পাশে সদ্য রোপণ করা ধানের জমি। রাস্তার দুই ধারে বড় বড় তাল গাছ। কালো পাকা তাল ঝুলছে। সতেজ পবন গা ছুঁয়ে দিলো। বড় প্রশান্তির সে হাওয়া। ক্ষি’প্ত মনমেজাজও মুহূর্তে ফুরফুরা হয়ে যাবে। হাওয়ার তালে তালে ছোট ছোট ধান গাছগুলো নাচানাচি করছে।

‘দাঁড়াও দাঁড়াও লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে নেই। এই নির্মল হাওয়া ভেতরে টেনে না নিলে বড্ড অন্যায় হয়ে যাবে। ঢাকা শহরের বাতাসে তো শুধু ধুলোবালি আর যানবাহনের কালো ধোঁয়া। এখানে এসে মনটা কেমন প্রফুল্ল হয়ে গেল। বুকের ভেতরেও যেন শীতলতা বইছে।’

তূবার কথায় পিছু ফিরে তাকায় নাযীফাহ আর তাহমিদ। তারপর তাহমিদ তালগাছের গোড়াকে পেঁচিয়ে রাখা লতানো এক গাছ থেকে বেগুনি রঙের একটা ফুল ছিঁড়ে নাযীফাহ কানে গুঁজে দিতেই ফয়সাল বলল,

‘একেবারে পারফেক্ট। হালাল ক্যান্ডিড। তবে নাযীফাহ হাসলে আরো সুন্দর হতো।’

সামনে মোবাইল দেখে দুজনের আর বুঝতে বাকি রইল না ফয়সাল সেই অপ্রত্যাশিত মিষ্টি মুহুর্তকে ক্যামেরা বন্দি করেছে।

নাযীফাহ’র এমন বিবশ চেহেরা দেখে হঠাৎ তাহমিদের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি উদয় হলো।

‘ফয়সাল ভাই আমি আমার বউয়ের কপালে চুমু দিচ্ছি। একটা ছবি উঠান তো।’

চমৎকৃত হয় নাযীফাহ। এই খোলা রাস্তায় কেমনে কি? ভুলক্রমে কেউ দেখে ফেললে বেহায়া আর বেশরম বলতে দুইবার ভাববে না। শহরে এসব মানুষ পাত্তা না দিলেও গ্রামে এসবের চর্চা করে মানুষ।

‘আসতাগফিরুল্লাহ্, আপনি এসব কি বলছেন?’

তাহমিদ কোনো বাক্যব্যয় তার উষ্ণ ঠোঁট যুগল ছুঁইয়ে দিল নাযীফাহ’র কপালে। প্রগাঢ় ত্রপায় চোখ বন্ধ করে নিল নাযীফাহ। ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি। আর একের পর এক ক্লিক করে গেল ফয়সাল।

___________________________

সকাল হতে নিজের ব্যাগ গোছাচ্ছেন হালিমা। শিহাব মায়ের পিছনে পিছনে হাঁটছে আর অনুনয় করছে। বসার ঘরে নতজানু হয়ে বসে আছেন সালাম সাহেব। স্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে হাতটা ধরে যে বলবে, ‘থেকে যাও। এই বুড়ো বয়সে আমাকে ফেলে কই যাও তুমি ? এতটুকু বলার সাহস হচ্ছে না উনার। সেই রাস্তা তিনি নিজেই বন্ধ করেছে।

পুরো দেহ কালো বোরখায় আবৃত করে বসার ঘরে এলেন হালিমা। একটা পলক তাকালেন সালাম সাহেবের দিকে। এই মানুষটার দিকে তাকাতেও উনার ঘৃ/না হচ্ছে। সদর দরজার দিকে পা বাড়াতেই শিহাব বলে,

‘এই বাড়িটা মরুভূমি করে কোথাও যাচ্ছ মা? আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।’

‘চরিত্রহী/ন মায়ের সাথে থাকার চেয়ে মরুভূমিতে থাকা ঢের ভালো। এই বাড়িতে থাকা আমার জন্য মৃ/ত্যু/সম। তবুও বহু কষ্টে থেকেছি রাতটা। যে পুরুষ মানুষ এতোগুলা বছর একসাথে থাকার নিজের স্ত্রীকে চিনতে পারে না। তার সাথে এক ছাঁদের নিচে থাকা আমার সম্ভব না। আর ভেবেছিলাম তোকে মানুষ করতে পেরেছি। আমি সেখানেও ব্যর্থ। একটা কা/পুরুষের জন্ম দিলাম। যে কিনা অন্যের কথায় নেচে একটা পরিবারকে শে/ষ করতে চেয়েছে।’

‘মা আমার,,, ‘

‘খবরদার শিহাব আমার পিছু পিছু আসবি না। আমার পিছনে আসলে গাড়ির নি/চে মাথা দিবো আমি।’

‘তোমরা সবাই নিজের চিন্তাটাই করে গেলে। আমার কথা ভাবছো না কেউ। তুমি তোমার সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছো। ফুফু আমার সাহায্যে নিজের চাওয়া পাওয়া গুলো পূরণ করে নিলো। আমার প্রাপ্তির খাতা শূন্য। আমি অপূর্ণ। কাউকে প্রবল ভাবে ভালোবেসে নিজের করে চাইতে পারিনি। সারাক্ষণ আতংকে থেকেছি ফুফু যদি তোমার ক্ষতি করে বসে?’

‘নিজের কষ্টের কারন তুই নিজেই। আরেকজন বললেই শুনতে হবে কেন? একমাত্র তুই যদি চাইতিস তাহলে এসব আরো আগেই বন্ধ করতে পারতি। আজকের পরিস্থিতি কখনোই আসতো না।’

_____________________

অনেকগুলো দিন গত হয়েছে। কেউ রাখেনি তার হিসাব। শুধু একের পর এক ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেছে সবাই। তূবার ছেলে হয়েছে। হাঁটতে শিখেছে সে। সেদিনের পর বকুল কে আর কেউ খুঁজে পায়নি। সালাম সাহেবও রা/গে ক্ষো/ভে বোনের খোঁজ করেনি। শিহাব কে জোর করে বিয়ে করিয়েছে। তবে আজও সংসারে ফিরেনি হালিমা। সালাম সাহেব আর শিহাব বহু বার গিয়েছে ফিরিয়ে আনতে তবে উনি আসেন নি। সালাম সাহেবও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। খালেদ সাহেব সেই দিনের বেড়াজাল থেকে সহজে বের হলেও সহজে বের হতে পারেনি নাযীফাহ। তাই তাহমিদ বাধ্য হয় বেবি নেওয়ার জন্য। যেন ঘটনাগুলো সহজে সে ভুলতে পারে।

কমিউনিটি সেন্টারে কনের জন্য বরাদ্দ করা আসনে বধূ বেশে বসে আছে নাযীফাহ। আর তার পাশে তাহমিদ। ওহ আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী না। আজ নাযীফাহ’র সাতশা। সাত মাসের গর্ভবতী সে। বিয়ের পর বড় করে অনুষ্ঠান করার কথা থাকলেও বিভিন্ন ঝামেলায় আর করা হয়নি। তাই এই সুযোগে দুই পরিবার বড় করে রিসিপশনের আয়োজন করেছে। গাঢ় লাল জামদানি শাড়িতে বেশ লাগছে নাযীফাহকে। নাযীফাহ সামান্য হাসফাস করতেই তাহমিদ ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,

‘এসব পোশাকে অস্বস্তি হচ্ছে? শাড়ি বদলে কম্ফোর্টেবল কিছু পড়বে?’

বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করে নাযীফাহ।

‘আপনি বকবক বন্ধ করেন তো অসহ্য লাগে আপনার কথাবার্তা।’

‘আমি দেখেছি প্রেগন্যান্সির পর থেকে তুমি আমার সাথে কেমন করে যেন কথা বলো। তুমি আমাকে ভালোবাসো না তাই না?’

বিরক্তি সূচক চাহনি নিক্ষেপ করে নাযীফাহ।

‘আমি কখনো বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি?’

উত্তরটা যেন পছন্দ হলো না তাহমিদের। মুখ কালো করে দূরে চলে যায় সে। তাহমিদের এমন চেহারা দেখে মুখ টি/পে হাসল নাযীফাহ। বাবু পেটে আসার পর থেকে তাহমিদ কে এভাবেই জ্বালায় নাযীফাহ। মানুষটাকে বিরক্ত করে যেন এক অনন্য সুখ মিলে।

‘এভাবে মেয়েদের মতো মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে না থেকে দেখেন গিয়ে ফাহিম এলো কিনা। সেই সকালে গেল এখনো আসছে না।’

তাহমিদ চলে যেতেই মনোয়ারা বেগম উনার বয়সী একজনের সাথে কথা বলতে বলতো এগিয়ে এলেন নাযীফাহ’র কাছে। তৃপ্ত হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

‘খিদে পেয়েছে তোর? খাবি কিছু, নিয়ে আসবো আমি?’

নাযীফাহও ফিরতি হেসে বলে,

‘এখন আর কিছু খাবো না। মা একটু আগে খাইয়ে গেল।’

মনোয়ারা বেগম আবারও কথা বলতে বলতে চলে গেলেন।

‘জানেন ভাবি আমার সংসার আজ পূর্ণ। নাতি নাতনি যাইহোক আমার সমস্যা নেই। কবে সে দুনিয়ায় আসবে আমার তর সইছে না।’

শ্বাশুড়ির কথাগুলো কানে আসতেই সুখকর হাসলো নাযীফাহ।

মেহমান আপ্যায়নে ব্যস্ত সবাই। নাযীফাহ চিন্তিত ভঙ্গিতে বার বার মেইন গেটের দিকে তাকাচ্ছে। অপেক্ষা ফাহিম আসার। প্রায় মিনিট ত্রিশ বাদে ফাহিম এলো। এবং তার পিছনের মানুষটাকে দেখে অধর যুগল প্রসারিত করে সে। এই মানুষটার অপেক্ষায় সেই কখন থেকে আছে। মানুষটা নাযীফাহ’র কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে নাযীফাহ চাচি বলে জড়িয়ে ধরলো।

‘আমাকে এখানে আনিয়েই ছাড়লি।’

নিঃশব্দে হাসলো নাযীফাহ। ফাহিমকে চোখে ইশারা করতেই সে কোথাও গেল।

‘এখন আমার পুচকোর জন্য কি এনেছো?’

‘দোয়া আর ভালোবাসা। আর যেদিন পৃথিবীতে আসবে সেদিন দিবো অন্যকিছু।’

‘হালিমা?’

চিরপরিচিত সেই কন্ঠে নিজের নাম শুনে চকিত হন হালিমা। মৃদু কেঁপে ওঠে উনার শরীর। সেই প্রথম দিনের মতো আবারও অনুভূতি সাড়া জাগায়। হালিমা স্থির হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন।পিছন ফিরে তাকালেন না একবারও।

‘মা? তুমি তোমার ছেলেকে ভুলে গেলে? ছেলেকে বিয়ে করানোর জন্য তো মরিয়া হয়ে ছিলে। যখন বিয়ে করলাম আসলে না তো। আমাকে দোয়াও করলে না।’

দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল হালিমার গাল বেয়ে। নাযীফাহ হালিমার হাত ধরে সালাম সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়ালেন।

‘বলেছিলাম না তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। না গেলে মিস করবা।’

হালিমার হাতটা সালাম সাহেবের হাতে দিয়ে বলল,

‘এই নাও তোমার সারপ্রাইজ।’

হাতটা চট করে সরিয়ে নেন হালিমা। আচমকা কেউ এসে উনার পায়ে ছুঁয়ে সালাম করল। স্পর্শে ভয়ে পেয়ে যান।

‘তোমার ছেলের বউ। তাকে কেন শ্বাশুড়ির মায়া মমতা থেকে বঞ্চিত করছো? মেয়েটার মা নেই চাচি। তাকে একটু নিজের ছায়াতলে রাখো। যা হয়েছে ভুলে যাও। এতো রাগ ভালো না তো। রাগ হল এক প্রকার অভি/শা/প। রাগ হলেই দেখবে প্রাপ্তির খাতা শূন্য। তোমাদের বয়স হয়েছে। এই বয়সে এখন তোমাদের একজন আরেকজনের সঙ্গ প্রয়োজন। মানছি চাচা ভুল করেছে। তার উচিত ছিল সবকিছু যাচাই করা। ওগুলো তো অতীত। আগের কথা ভেবে কেন বর্তমান আর ভবিষ্যতের সুখকর স্মৃতি থেকে দূরে আছো? তুমি চলে যাওয়ার পর চাচা হাসেনি। বার বার আমি তার অনুতপ্ত চেহেরা দেখেছি। আজ যদি তুমি চাচাকে ফিরিয়ে দাও তাহলে সারাজীবন আমি আর তোমাদের জামাই দোষী হয়ে থাকবো। ও সেদিন সকল সত্য সামনে এনেছিল বলেই আজ পরিনতি। বাচ্চাদের মতো রাগ না করে মিলে যাও তো।’

‘ভাবি বাদ দেন বেডা মানুষ। সুযোগ আসছে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোর। সুযোগ কে কেন পায়ে ঠেলে দিচ্ছেন? যতদিন বেঁচে আছেন সুযোগ কাজে লাগান।’

ফাহমিদা বেগমের কথায় উচ্চ শব্দে হাসতে লাগল সবাই।

‘তাদের কে বলেন কাল সকালে যেন আমার সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে।’

কথাটা শুনার পর যেন বহুদিন পরে সালাম সাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। হালিমা দু’কদম এগিয়ে ছেলের বউয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লম্বা ঘোমটা টেনে সে শিহাবের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হালিমা তার মাথায় হাত রেখে নম্র আর মায়া মাখা স্বরে বলে,

‘শুধু তোমার জন্য আমি সংসারে ফিরবো। যার মা থাকে না শুধু সে জানে এই দুনিয়ায় সে কতটা অসহায়। তোমার মায়ের স্থানটা আমাকে দিবে তো?’

অশ্রুসিক্ত আঁখিতে সে হালিমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

‘বকুল ফুফু যদি তার ভুল,,,,,,’

নাযীফাহ কথা শেষ করতে পারলো না এর আগেই গর্জে উঠেন সালাম সাহেব।

‘ ওই জা/নো/য়া/রের নাম নিবি না। ওর জন্যই আজ আমাদের সবার জীবনটা এমন।সুখের মুখ দেখিনি কেউ বহু বছর। ও নেই সবাই একটু হলেও সুখী।’

__________________

সন্ধ্যা হতে চলল। অনুষ্ঠান প্রায় শেষের পথে। তূবার ছেলের খাওয়ার সময় হয়েছে। সে ফয়সালের কাছে। ফয়সাল খুঁজতে গেলেই তামান্না তূবাকে টেনে আড়ালে নিয়ে যায়।

‘এভাবে টেনে আনলি কেন? তিহানের খাওয়ার সময়। খাওয়াবো এখন।’

‘তোর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।’

তূবা কপাল কুঁচকে বলে,

‘কে?’

‘আমি।’

পিছনের মানুষটাকে দেখে চমকে উঠে তূবা। তবে কোনো কথা বলল না।মুখ ফিরিয়ে নিল।

‘কথা বলবি না আমার সাথে? মানুষ মাত্রই তো ভুল করে। আমিও ভুল করেছি।’

‘হুম মানুষ বহুবছর ধরে ভুল করে।’

‘ক্ষমা করে দিননা হুমায়রা কে। তার ধারণা আপনি ক্ষমা না করলে আমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হবে না।’

আরেক দফা চমকায় তূবা। সাথে তামান্নাও। তামান্না চমকিত স্বরে বলল,

‘বিয়ে করে ফেললি বললিও না?’

‘তোরা তো আমার উপর রেগে আছিস। তাছাড়া আমিও জানতাম না আমার বিয়ে। মুয়ায বলল আমায় ভালোবাসে। আমিও মজা করে বলেছিলাম ভালোবাসলে এখনই বিয়ে করতে হবে। আল্লাহর বান্দা টেনে হিঁচড়ে তখনই কাজী অফিস নিয়ে যায়। ওই সময়টায় কেন জানি একজন সঙ্গীর অভাব বোধ করেছিলাম। যার কাঁধে মাথা রেখে সূর্য উদয় দেখা যাবে। যার সাথে একটু অভিমান করা যাবে। যার কাছে একটু আধটু অ’ন্যায় আবদার করা যাবে। ব্যস বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর বুঝেছি একজন স্ত্রীর তার স্বামীর সঙ্গ ঠিক কতটা প্রয়োজন। তখনই মনে আমি কত বড় ভুল করেছি। আমাকে মাফ করে দে তূবা।’

‘আমাদের বিয়ের প্রথম প্রথম ও ঠিক থাকলেও পরে হাসফাস করতে থাকে। একটা সময় পরে সব খুলে বলে আমাকে। আমি বলেছিলাম ক্ষমা চাইতে। ক্ষমার চেয়ে মহৎ আর কিছুই নেই। ও আপনাদের সামনে আসতে চাইছিল না। ভুল তো মানুষই করে তাই না? হয়তো ও জেনে-বুঝে করেছে।’

হুমায়রা ও মুয়াযের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তূবা।

‘ তামান্না কেউ যদি ভেবে থাকে এভাবে বিয়ে করলে সে পার পেয়ে যাবে তাহলে সে ভুল করছে। সুলতান’স ডাইনে পুরো এক সপ্তাহ কাচ্চি খাওয়াতে হবে। বলে দে তাকে।’

তূবার কথায় যেন হুমায়রা আকাশের চাঁদ পেয়ে গেল। একছুটে এসে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তূবাকে।

‘যতদিন ইচ্ছে ততদিন খাওয়াবো। তারপরও ক্ষমা কর আমাকে।’

‘তামান্না বলে দে, তূবার দয়ার শরীর।’

‘তুই বলে দে। আমার এতো ঠেকা পড়েনি।’ এটা বলে তামান্নাও এসে তূবাকে জড়িয়ে ধরলো।

______________________

আজ মোটামুটি অনেক ধকল গিয়েছে। তূবা চুলগুলো বেনি করে উঠে দাঁড়াল। দরজা লক করে তূবার পিছনে এসে দাঁড়ায় ফয়সাল। কোমর ধরে তূবাকে নিজের আরো একটু কাছে নিয়ে আসে। তূবা মুচকি হেসে ফয়সালের বুকে নিজের পিঠ ঠেকালো। বিছানার দিকে ইশারা করে বলল,

‘আজ ফারিয়া এখানে থাকবে?’

‘ভাই হওয়ার পর নাকি তার আদর কমে গিয়েছে। ভাইকে বেশি বেশি আদর করার জন্যই নাকি তাকে তার দাদির সাথে ঘুমোতে বলি। তাই বান্দা আজ আমাদের সাথে ঘুমোবে।’

‘মেয়ে আমার তো ঠিকই বলেছে। মেয়ের মা এখন মেয়েকেও আদর করে না মেয়ের বাবাকেও আদর করে না।’

ফয়সালের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কোমরে হাত রাখে তূবা।

‘ছেলে মেয়ে দুইটা আসমান থেকে টপকাইছে তাই না?’

ফয়সাল আবারও তূবার কোমর টেনে আরো কাছে আনে তূবাকে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আবৃত গাল দিয়ে তূবার গাল ঘষে বলে,

‘আসমান থেকেই তো টপকাইছে। ফারিয়াকে জিজ্ঞেস করলে ও এটাই বলবে।’

তীক্ষ্ণ আর সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকাল তূবা।

‘ধন্যবাদ।’

তূবা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় ফয়সালের দিকে।

‘কেন?’

‘কেন দিচ্ছি তা জানি না তবে ধন্যবাদ।’

‘হুমায়রা এসেছিল।’

‘জানি।’

‘আচ্ছা মানুষ এমন কেন করে বলো তো। শুধু শুধু নিজের কাছে নিজেই দোষী হয়।’

‘এটাই দুনিয়ার নীতি। ভুল করবে। অনুতপ্ত হবে। খারাপ আছে বলেই ভালোর এতো দাম।’

তূবা ফয়সালের বুকে মাথা রাখল।মনযোগ দিয়ে শুনতে লাগল ফয়সালের বুকের ধুকপুকানির নিনাদ।

‘এখানটায় মাথা রাখলে এতো সুখ লাগে কেন বলো তো।’

ফয়সাল তূবার দু গালে হাত রেখে কপালে চুমু দিয়ে বলে,

‘তার আগে বলো এই মাথাটাই এখানে রাখলে আমার এতো শান্তি লাগে কেন? নিজেকে পূর্ণ কেন লাগে?’

তূবার ফয়সালের একটা হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিল।

‘কারন এই মানুষটাকে আমি ভালোবাসি।’

ফয়সাল যেন এবারে তূবাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

‘এই মানুষটাও যে তাকে খুব ভালোবাসে। ধন্যবাদ শত অবহেলা করার পরও আমাকে ভালোবাসার জন্য। ধন্যবাদ আমাকে ছেড়ে না যাওয়ার জন্য। ধন্যবাদ দুটো চাঁদের টুকরো আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য। ধন্যবাদ আমার মাকে আগলে রাখার জন্য। সর্বোপরি ধন্যবাদ এই রগচটা, গম্ভীর মানুষটাকে ভালোবেসে তার পা’গলামি সহ্য করার জন্য।’

তূবার ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা হাসিটা যেন আরো বিস্তৃত হলো।

____________________

সুতি মেক্সি পড়ে ফুল স্পিডে ফ্যান চালু দিয়ে বসে আছে নাযীফাহ। প্রেগন্যান্সির পর যেন তার গরম আরও বেড়ে। দু’চারটা ফ্যান চালু করলেও যেন গরম যাবে না। চোখ জোড়া লেগে আসতেই দরজার খট শব্দে চোখ মেলে তাকায় সে। তাহমিদ এসেছে। হাতে ঔষধ আর এক গ্লাস পানি। তাহমিদ মুখ কালো করে নাযীফাহ’র সামনে ঔষধগুলো ধরলো। নাযীফাহ দেখেও না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। তাহমিদ সেই দুপুর থেকে তার গাল ফুলিয়ে রেখেছে। পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরও নাযীফাহ’র কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে চোখ কুঁচকে তাকাল।

‘কি হলো নিচ্ছো না কেন?’

‘আপনি আমাকে বলেন নি নেওয়ার কথা বা খাওয়ার কথা। তাহলে বুঝবো কেমনে?’

দাঁত কটমট করে তাকাল তাহমিদ।

‘কেউ তো আমাকে ভালোই বাসে না। তাহলে কথা বলবো কেন?’

‘মহাশয়ের বুঝি রাগ হয়েছে?’

অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ।

‘দেখি ঔষধ গুলো আমার হাতে দিয়ে পাশে একটু বসুন তো।’

‘পাশে বসবো কেন?’

‘আহা! এতো কথা কেন বলেন?’

নাযীফাহ ঔষধগুলো খেয়ে হাত ধরে টান দিয়ে পাশে বসাল। তাহমিদ তখনও অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিদের হাতটা নাযীফাহ তার উঁচু পেটের উপর রাখল।

‘কিছু ফিল হয় মিস্টার তাহমিদ?’

তাহমিদ বিস্মিত চোখে নাযীফাহ’র দিকে তাকাল। হাতের তালুতে কিঞ্চিৎ এক অদ্ভুত স্পর্শ লাগল। তাহমিদ একবার নাযীফাহ’র দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার পেটের দিকে। বার বার শুকনো ঢুক গিলছে সে। তার নিঃশ্বাস পড়ছে খুব দ্রুত গতিতে। নাযীফাহ তাহমিদের বুকের ঠিক বা পাশে মাথা ঠেকাল।

‘আপনি বলেছিলেন বাবু কিক দিলে যেন আপনাকে বলি। কেমন অনুভব হয় মিস্টার? সন্তান এক অন্যরকম সুখ। এই সুখের ব্যাখ্যা কখনো করা যায়। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। উহ্ একটুও না। তবে যার অস্তিত্ব নিজের শরীরে বহন করে চলছি তাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। সে মানুষ আমার কাছে কি কখনো ব্যক্ত করতে পারবো না।’

তাহমিদ নাযীফাহকে আগলে নিলো দু’হাতে।

‘তোমার নামের একটা পার্সেল এসেছে। দারোয়ান চাচা দিলো। কেউ নাকি তোমার নাম করে দিয়ে গেছে।’

তাহমিদ ওয়ারড্রব থেকে রেপিং পেপারে মোড়ানো ছোট্ট একটা বক্স নাযীফাহ’র হাতে দিল। নাযীফাহ বক্স খোলে দেখল বেশ মোটা দুইটা স্বর্ণের চেইন আর আর একটা চিঠি। চিঠি ভাঁজ খোলে পড়া শুরু করলো সে।

প্রিয় নাযীফাহ,

নিশ্চয়ই এই খারাপ মানুষটাকে ভুলে গিয়েছিস? যাবারই কথা। তোদের সবার সাথেই অন্যায় করেছি। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। আমার ভাই যদি আমাকে পুলিশে দিয়ে সেই ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। আমাকে মাফ করে দিস মা। সবাইকে বলিস আমাকে মাফ করে দিতে। আমি তোদের খবর রাখি। আমার সেই ছোট্ট নাযীফাহ ক’দিন বাদে মা হবে। সেই ছোট্ট নাযীফাহ কত বড় হয়ে গেল। হয়তো বা তোর বাবার সাথে রাগ আর জেদ থেকে তোর সাথে এতোকিছু করেছি। তবে তুই আমার সন্তানের মতোই ছিলি। এখানে দু’টো চেইনের একটা চেইন তোর সন্তানের জন্য আর একটা চেইন আমার শিহাবকে দিবি। যখন সে বাবা হবে তখন। তাকে বলিস আমাকে ক্ষমা করে দিতে। তার ফুফু তাকে তার ভালোবাসা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আমার জন্যই নিজের ভালোবাসাকে ,,,,,,। যাইহোক কখনো আমার খোঁজ করিস না। আমি যেখানেই আছি ভালো আছি। তোদের আশেপাশেই আছি। আমি মা-রা গেলে হয়তো আমার লা/শ তোদের ঠিকানায় যাবে নয়তো আমার মৃ/ত্যু/র খবর। প্রাণ/হী/ন দেহটাকে অবহেলা করিস না। নিজের যত্ন নিস। নতুন অতিথির জন্য এই খারাপ মানুষটার পক্ষ থেকে অনেক দোয়া এবং ভালোবাসা। শিহাব কে বলিস বউকে যেন কখনো অবহেলা না করে।

ইতি তোদের সবার অপরাধী,

বকুল।

চিঠি পড়ে থমথমে মুখে বসে রইলো নাযীফাহ। তাহমিদ নাযীফাহ’র এমন থমথমে মুখ দেখে কাঁধে হাত রাখল।

‘চিঠি পড়ে মন খারাপ হয়ে গেলো?’

শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নেয় নাযীফাহ।

‘মানুষ এমন কাজ কেন করে বলুন তো? যে কাজের জন্য তাকে তার আপনজন দেখে দূরে থাকতে হয়। উনি উনার ভুল আরো আগে বুঝলে তো আজকের চিত্র অন্যরকম হতো। মানুষের কর্ম তাকে তার আপনজন থেকে একটু একটু করে সরিয়ে দেয়। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে তবে সময় খুইয়ে।’

‘চিত্র ভিন্ন তো অবশ্যই হতো। তুমি শিহাব সাহেবের বউ থাকতে।’

তাহমিদের কথায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নাযীফাহ। নাকের বাঁশি ফুলিয়ে রাগে ফুঁসছে সে।

‘আচ্ছা ঠিক আছে রাগতে হবে না। চাঁদের আলোয় চারপাশ কেমন ঝলমল করছে। চলো না ছাদে যাই।’

‘হুম খেয়ে দেয়ে আর কাজ নাই। আমি এই শরীর নিয়ে ছাদে যাই আর কিছু একটা হয়ে যাক। আপনার ইচ্ছে হলে আপনি ছাদে গিয়ে চন্দ্র বিলাস করেন।’

তাহমিদ আয়াতুল কুরসী, আর তিন কূল পড়ে নাযীফাহ শরীরে ফুঁ দিলো।

‘নাও আর কিছু হবে না। আল্লাহ আছে তো সাথে।’

ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দু’জন বের হলো। কয়েকটা সিঁড়ি অতিক্রম করে নাযীফাহ বলে উঠলো,

‘আমি যাবো না। আমার বেশ ক্লান্ত লাগছে। সিঁড়ি ভেঙে আর উঠতে পারছি না।’

তাহমিদ কোনো বাক্য ব্যয় করলো না। সোজা পাঁজা কোলে তুলে নিলো নাযীফাহকে। নাযীফাহ টাল সামলাতে না পেরে তড়িঘড়ি করে তাহমিদের গলা জড়িয়ে ধরলো।

‘এবার ঠিক আছে?’

মুচকি হেসে মাথা দুলায় নাযীফাহ। তাহমিদ একটা একটা করে সিঁড়ি অতিক্রম করছে আর গুনগুন করছে। আচমকা সুর থামিয়ে বলে,

‘বেশ মোটা হয়ে গিয়েছো তুমি।’

‘আপনার বংশধরকেই পেটে নিয়ে ঘুরছি। তাই একটু মোটা না হলে চলে?’

চাঁদের দিকে মুখ করে বসল দু’জন। তাহমিদ নাযীফাহ কোমর প্যাচিয়ে ধরলো। আর নাযীফাহ আদুরে বিড়াল ছানার ন্যায় তাহমিদের আধখোলা বুকে মাথা রাখে। হুট করে নাযীফাহ তাহমিদের চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দেয়। নাকে নাক ঘষে বলে,

‘এই শরীরের স্পর্শ আমাকে প্রশান্তি দেয়। এই শরীরে যেন মা/তা/ল করা এক গন্ধ আছে। আমাকে মা/তা/ল করে দেয়। এই মানুষটা সাথে থাকলে নিজেকে নিরাপদ অনুভব করি।মানুষটাকে ভালোবেসে ফেললাম না তো? এমনটা তো মোটেই কাম্য না। আমার বাবুর বাবা যে রাগ করবে।’

নাযীফাহ’র এমন ছেলেমানুষি কথায় ফিক করে হেসে উঠলো তাহমিদ। নাযীফাহ’র মুখটা হাতের আঁজলায় নিয়ে নাযীফাহ’র ওষ্ঠে সুদীর্ঘ এক চুমু দিল।

‘ভালোবাসি! ভীষণ ভালোবাসি! ঠিক যতটা ভালোবাসলে মায়া কাটানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।ঠিক যতটা ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষটার সাথে হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে। আমি ঠিক ততটাই ভালোবাসি।’

নাযীফাহ আবারও তাহমিদের বুকে মাথা রেখে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো।

‘জানেন প্রথমদিন আপনাকে দেখে ভেবেছিলাম, আপনি বিয়ে করে ফেলেছেন। হয়তো বাচ্চাও আছে।’

তাহমিদ রগড় গলায় বলল,

‘আর এখন?’

নাযীফাহ বিস্তৃত হেসে বলে,

‘তার বাচ্চা পেটে নিয়ে তার বুকে মাথা রেখে বসে আছি।’

শব্দযোগে হাসতে লাগল তাহমিদ। নাযীফাহ আরো একটু মিশিয়ে নিল বুকের সাথে। নাযীফাহ পূর্ণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে গাইতে লাগল,

‘এই মোম জোছনায়,
অঙ্গ ভিজিয়ে,
এসো না গল্প করি।’

___________________সমাপ্ত___________________