#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ২০ ও ২১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
রাত্রির মধ্যভাগ! মেয়েকে বুকে নিয়ে গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত তূবা। এতোরাতে দরজার ঠকঠক শব্দে ঘুম হালকা হয়ে এলো তার। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। অন্ধকারে হাতরে মোবাইল খুঁজে বের করলো সে। রাত একটা সাত বাজে। আবারও ঠকঠক শব্দের সাথে ভেসে এলো তাহমিদের কণ্ঠস্বর।
‘তূবা, একটু দরজা খোল না। আমার প্রচুর মাথা ব্য’থা করছে।’
ভাইয়ের আওয়াজ পেয়ে মোবাইল হাতে তড়িঘড়ি করে উঠে বসল তূবা। দ্রুত পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। অন্ধকারে তাহমিদ কে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তূবা ঘুমঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে?’
তাহমিদ কপালে হাত রাখল। যদিও অন্ধকারে তা বোঝা গেল না।
‘মাথা ব্য’থার জন্য ঘুম আসছে না। তোর কাছে কি ঔষধ আছে?’
ফ্ল্যাশলাইট তাহমিদের মুখ বরাবর ধরে তূবা সূঁচালো দৃষ্টিতে একবার তাকে পরখ করল। ভাইয়ের মতিগতি তার সুবিধার ঠেকছে না।
তাহমিদ চোখেমুখে হাত রেখে বলল,
‘এটা নামা। চোখে লাগে তো। কি দেখছিস এভাবে?’
তূবা সন্ধিহান গলায় বলল,
‘ফার্স্ট এইডের বক্স তো সবসময় তোর রুমেই থাকে। তাহলে কোন দুঃখে তুই এই মাঝরাতে আমার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে ঔষধের কথা জিজ্ঞেস করছিস? আমি তো রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।’
তাহমিদ কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
‘তোর কাকের কন্ঠ শুনতে এলাম। যদি মাথা ব্য’থা একটু কমে। তোর বেসুরা কাকের কন্ঠ ম্যাজিকের মতো কাজ করে। কোথায় হন্তদন্ত হয়ে ঔষধ খুঁজে বের করবি। তা না করে গোয়েন্দাগিরি করছিস।’
বলেই দাঁড়াল না। হনহন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। তাহমিদের উত্তরে আহাম্মক হয়ে গেল তূবা। তাহমিদের মাথা ব্য’থা করছে কথাটা মাথায় আসতে তাহমিদের পিছু পিছু গেলো।
তাহমিদের রুমে গিয়ে বক্স হাতরে ঔষধ পেয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তূবা। রাগে দাঁত কটমট করছে সে। তাহমিদ কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
‘যা এবার তুই। আমি ঔষধ খেয়ে ঘুমাবো।’
‘হাতের কাছে ঔষধ রেখে আমার কাঁচা ঘুম ভাঙালি?’
পাল্টা রাগ দেখিয়ে বিড়বিড় করে তাহমিদের রুম থেকে প্রস্থান করলো ।
উষ্ণ শ্বাস ফেলে নিজের রুমের দরজা আটকালো তূবা। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় নিজের শায়িত স্থানে কালো অবয়ব দেখে কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো তার। পুনরায় মোবাইলে আলো জ্বালালো। তার দৃষ্টি গোচর হলো ফয়সালের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে। অপ্রত্যাশিতভাবে ফয়সালকে দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগল সে। ফয়সাল তূবার হাল বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎ উঠে এসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। তখনও কাঁপছে তূবা। ফয়সাল পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ভয় পাচ্ছো কেন? আমিও তো। এই দেখো জলজ্যান্ত আমি।’
ভয়ের চো’টে ফয়সালের শার্ট খাঁমচে ধরে কেঁদে দিলো তূবা। ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে উঠলো,
‘ তুমি আমার অবস্থা জানার পরও এভাবে ভয় দেখাবে? তুমি জানো এগুলো আমার জন্য ক্ষ’তি’ক’র। তাহমিদের সাথে মিলে এমনটা করলে তাই তো?’
নিজের বক্ষঃস্থল থেকে তূবার মাথা তুলে কপালে একটা দীর্ঘ চুম্বন করলো।
‘কি করবো বলো? বউ যে বলে দিয়েছিল কাছে ঘেঁষতে দেবে না। এইদিকে নিরীহ আমার যে বউয়ের সান্নিধ্যে পেতে বড্ড ইচ্ছে করছিলো। বউ আর মেয়ের বিরহে আমি অধম এমনিতেই আ’ধ’ম’রা। তার উপর বউ আবার ছ’ল চা’তু’রী তার শ্বাশুড়িকেও নিজের দলে দ’খ’লে নিয়ে গেলো। উফ! তার মধ্যে নতুন কেউ আগমনের বার্তা। মনটা কেমন বউ বউ করছিল। আর ওই ভুতুড়ে বাসায় একা একা থাকা যায় বলো? তাই কায়দা করে চলে এলাম।’
‘তুমি প্রচন্ড খা’রা’প একটা মানুষ। আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসি না।’
শব্দহীন হেসে তূবাকে বুকের সাথে মিশিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ফয়সাল। চারপাশে সুনশান-নিস্তব্ধতা। মাথার উপর ঘূর্ণায়মান পাখার সাঁইসাঁই আধ্বান কেবল কর্ণগোচর হচ্ছে।
‘শা’স্তি কমানো যায় না? মানছি তো আমি ভুল করেছি। আদালতে দো’ষী তার দোষ স্বীকার করলেও তার শা’স্তি কমিয়ে দেয়। আর তুমি আমার বউ হয়ে আমার সাথে এমন অ’বি’চার করছো?’
কোনো প্রকার বাক্যব্যয় না করে মিটিমিটি
হাসতে লাগলো তূবা। ঠিক এইভাবেই ফয়সাল কে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর ফন্দি আঁটলো। প্রতিনিয়ত আতংকের মধ্যে রাখবে।
অকস্মাৎ ফয়সাল তূবাকে ছেড়ে নিচে বসে পড়লো। অনুজ্জ্বল, অপরিস্ফুট, ক্ষীণদৃষ্টিতে ফয়সালের মুখের অবয়ব কিছু বুঝতে পারলো না তূবা।
‘নতুন প্রাণ এখানে আছে তাই না, তূবা?’
ক্ষীণালোকে বাঁকা হাসলো তূবা। ফয়সালকে আতঙ্কগ্রস্ত করতে গম্ভীর স্বরে বলে,
‘তুমি যদি ভেবে থাকো এমন আদিক্ষেতা করলে বা একটু ভালোবাসা দেখিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললে আমি মত পাল্টে নেবো। তবে তুমি ভুল করছো। আমি তোমাকে শাস্তি দিয়েই ছাড়বো।’
ফয়সাল তূবার কোমর প্যাঁচিয়ে ধরে বলে,
‘ইশ! বললেই হলো নাকি? এখানে আর কয়েকদিন থাকার পর আমি তোমায় ওই বাসায় নিয়ে যাবো। তুমি এখানে থাকলে আমি চো’রের মতো রাত বিরাতে আসবো। মানুষ তার প্রেমিকার সাথে রাত বিরাতে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করতে আসে।আর আমি বউয়ের সাথে। শুধু বউ আমার দুই সন্তানের মা সে। কি ফা’টা কপাল আমার।’
______________________
আরো কিছু সময় বসে থাকার স্থান পরিত্যাগ করে নাযীফাহ। পুকুর পাড়ের শীতল বাতাসে তার শরীর হিমশীতল হয়ে যায়। নাযীফাহ চলে যেতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো কালো অবয়বটি। মৃদু আলোয় অনিমেষ চেয়ে রইলো নাযীফাহ’র যাওয়ার পানে।
তার সেই চাহনিতে আছে আক্ষেপ, অনুশোচনা, অনুতাপ আর অনুভূতি প্রকাশ করার চাপা কষ্ট। আপাদমস্তক দুঃখে মোড়ানো মেয়েটাকে দেখলে তার বুকে বড্ড য’ন্ত্র’ণা হয়। সে কেন পারে না মেয়েটার সকল দুঃখ ঘুঁ’চি’য়ে দিতে? একটু আদর করে ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে? কেন একটু মায়াভরা স্বরে বলতে পারে না ভালোবাসি তোকে?
সহানুভূতি দেখে নিজের উপরই হাসলো সে। মেয়েটার দুঃখের কারন তো সে। মাঝে মাঝে তার নিজেকে ব্যর্থ আর কাপুরুষ মনে হয়। তাগড়া যুবক, সাবলম্বী হওয়ার পরও সে নিজের মনের কথাটা ভালোবাসার মানুষকে বলতে পারছে না।একটা সুখের সংসার সাজাতে পারছে না। বরং এমন ভাব করতে হয় যেন সেই তার বিরক্তির কারন। চোখেরবালি সে।
অভিনয় করতে করতে হাঁপিয়ে গিয়েছে সে, বড্ড ক্লান্ত। একটুখানি নিশ্রাম দরকার। তার আর এসব ভালো লাগে না। সে একটু শান্তি চায়। চিন্তামুক্ত একটা শান্তির ঘুম দরকার। একটুখানি শান্তির নে’শা’য় সে কয়েকবার আত্ম’হ’ন’ন চেষ্টা চালিয়েছে। বরাবরই ব্যর্থ। বার বার মায়ের সেই বেদনার্ত মুখ চোখে ভাসতো। তার কিছু হলে মায়ের কি হবে? মুখোশের আড়ালের মানুষগুলোর জন্য যে তার মা আজও সুখের মুখ দেখল না। সে যে তার মাকে একটু সুখের মুখ দেখাতে চায়। ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। বিশাল আকাশের দিকে চেয়ে রইল অপলক।
কাক ডাকা ভোর! চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস শরীর আর মন একেবারে জুড়িয়ে যায়।
ফাহমিদা বেগম নামাজ পড়েই নাস্তা তৈরির কাজে লেগে পড়েন। আটার ডো করার জন্য পানি চুলোতে বসিয়ে ঘাড় কাত করে দেখল নাযীফাহ রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মলিন, ফ্যাকাশে, ম্লান চেহেরা নাযীফাহ’র। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন নিষ্পলক।
‘আমি কা’টা’কু’টি করে দেই?’
ম্লান হেসে ফাহমিদা বেগম বলেন,
‘দিবি? আচ্ছা দে। তাহলে আমার কাজও তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে।’
______________________
রাশেদা খাতুনের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হয় তূবা। এখনো নাস্তার বন্দোবস্ত করা বাকি। মনোয়ারা বেগম বেয়াইনের পাশে বসে আছেন। সাঝ সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস উনার নেই।
তূবার রুম থেকে ফয়সালকে বের হতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে রাশেদা খাতুন। গরম চায়ে জিভ পুড়িয়ে ফেললেন তিনি। চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন। ফয়সাল তড়িঘড়ি করে মায়ের কাছে যেতেই আরেক দফা চমকান মনোয়ারা বেগম। দু’বেয়ানের চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হাসলেন তারা। বসার ঘরে তূবা এসেও অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ফয়সালের আসার খবর বলা হয়নি কাউকে। গলা ঝেড়ে বলল,
‘আজকে ব্রেড আর জেলি দিয়ে নাস্তা সেরে নাও। গ্যাসলাইনে সমস্যা হচ্ছে।’
জেলি মাখা পাউরুটিতে ফয়সাল কামড় দিয়ে রাশেদা খাতুন কে বলে,
‘সন্ধ্যার দিকে সবাই রেডি হয়ে থেকো। একেবারে তোমাদের নিয়ে যাবো।’
রাশেদা খাতুন রগড় গলায় বললেন,
‘আমি যে পরিকল্পনা করলাম ছেলের বউ আর নাতনিকে নিয়ে এই বাসায় সারাজীবন থাকবো।’
ফয়সাল গম্ভীর স্বরে বলে,
ঘর জামাই থাকলে মানুষ আমাকে খারাপ বলবে না?’
ফয়সালের কথা শুনে তূবা খুকখুক করে কাশতে লাগল।
রাশেদা খাতুন পুনশ্চ ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,
‘তোকে কে থাকতে বলেছে? তুই ওই বাসায় থাকবি।’
এর মাঝে টিপ্পনী কা’টে তাহমিদ।
‘আমাদের কিন্তু আপত্তি নেই ফয়সাল ভাই। ঘর জামাই থাকলেও থাকতে পারেন।’
অফিস যাওয়ার উদ্দেশ্যে জুতা পড়ছে ফয়সাল। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তূবা। জুতো পড়ে উঠে দাঁড়ায় সে।
‘ব্যাগপত্তর গুছিয়ে তৈরি হয়ে থাকবে কিন্তু বলে দিলাম। না হলে আমিও এখানে থেকে যাবো।’
‘তাহলে রাতটা না হয় তাহমিদের সাথে কাটিয়ে দিও।’
‘সে সময় বলে দিবে।’ বলেই তূবার কপালে সুদীর্ঘ চুমু আঁকল।
বরের মায়াভরা স্পর্শ কপাল ছুঁতেই পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো তূবা। কিছু কিছু অনুভূতি কখনো পুরোনো হয় না। অনুভূতির কারনে শিহরিত হয় সমস্ত কায়া।
‘এমন একটা দৃশ্যের অপেক্ষায় আমি গত পাঁচটা বছর ধরে ছিলাম। আমি অফিস যাওয়ার সময় আমার অর্ধাঙ্গী দরজায় দাঁড়িয়ে আমার বিদায় দিবে। আর শেষ মুহুর্তে আমি তার কপালে আমার ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া দিবো। সারাদিন অফিস শেষে আমার বাড়ি আসার তাড়া থাকবে।কেননা একজোড়া অপেক্ষারত আঁখি যুগল আমি পৌঁছানোর অপেক্ষায় থাকবে। ওই যে আমি তার কপালে চুমু এঁকেছি। জানো আমার না বড্ড আফসোস হয়। আমার কিছু ভুলের কারণে আমি আমার জীবনে অনেক সুখকর মুহূর্ত অনুভব করতে পারিনি। আমি এই কয়দিনে যা বুঝেছি বাহিরের মানুষের সাথে যেভাবে গাম্ভীর্যতা আর ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে কথা বলি বউয়ের সাথে সেই গাম্ভীর্যতা বজায় রাখতে নেই। এই গাম্ভীর্যতা স্বামী স্ত্রীর মাঝে অদৃশ্য দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। বউয়ের বাচ্চামি সহ্য করতে হয়।তার সাথে বাচ্চামিও করতে হয়। তার সাথে পা’গ’লা’মী করতে হয়। তার পা’গ’লা’মী সহ্য করতে হয়। তাকে ভালোবাসতে হয়। তার থেকে ভালোবাসা আদায় করে নিতে হয়। ফেলে আসা দিনগুলো তো আর ফিরে পাবো না। আফসোসের মাত্রা কেবল বাড়বে। তবে আমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখকর, আবেগপ্রবণ কিছু স্মৃতি নতুন করে তৈরি করতে চাই। যা তোমাকে আমার অনুপস্থিতিতে কল্পনায় শান্তি দিবে । ঘটনাগুলো কথা মনে করে তোমার ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি ফুটবে।’
চোখ মেলে অপলক, অনিমেষ তাকিয়ে রইলো তূবা ফয়সালের দিকে। তার চোখেমুখে হাসি প্রতীয়মান। ভেতরের অনুভূতি গুলো এলোমেলো ভাবে দৌড়াচ্ছে প্রবল আনন্দে। তূবার মুখের উদ্দীপ্ততা দেখে ফয়সালও হাসলো।
পুনর্বার ফয়সালের ঠোঁট তূবার গাল ছুঁয়ে দিলো। অক্ষি যুগল বড় বড় করে তাকালো ফয়সালের অভিমুখে।
‘এটা আমাকে প্রথমবার বাবা হওয়ার অনুভূতির সাথে পরিচয় করানোর জন্য।’
আবারও চুমু আঁকল তূবার আরেকটা গালে। তূবা স্তম্ভিত স্বরে বলে,
‘খাড়ুস, আনরোমান্টিক মানুষটা হঠাৎ করে রোমান্টিক আর সাচ্চা প্রেমিক হয়ে গেলো। একটু বেশি বেশি হয়ে গেলোনা? যে রাস্তা পাড় হাওয়া সময়ও বউয়ের হাত ধরতো না আর এখন দরজায় দাঁড়িয়ে বউকে একের পর এক চুমু দিয়ে চলেছে। ব্যপার ঠিক হজম করতে পারছি না।’
উৎফুল্ল আর প্রসন্ন হাসলো ফয়সাল।
‘শেষের চুমুটা হলো একই রকম অনুভূতির সাথে আমাকে আরেকবার পরিচয় করানোর জন্য। তোমার আরো একটা চুমু পাওনা। তবে সেটা গালে না ঠোঁটে। সেটা এখন না রাতে পুষিয়ে দিবো।’
তূবা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
‘অ’স’ভ্য লোক কোথাকার। যাও তো এখান থেকে।’
হাসতে হাসতে প্রস্থান করে ফয়সাল। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো তূবা।
যখন ফয়সাল দ্বিতীয়বার তূবার গাল ছুঁয়ে দিচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ড্রয়িং রুমে এসেছিলেন রাশেদা খাতুন। অকস্মাৎ সেই দৃশ্য গোচরীভূত হয় উনার। তাড়াতাড়ি সরে পড়েন উনি। ছেলে বা বউ যেকেউ দেখলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বেন। তবে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে ভুললেন না।
_______________________
মায়ের হাতে হাতে সাহায্য করে সবেমাত্র সবকিছু গুছিয়ে টেবিলে রাখলো নাযীফাহ।এর মাঝে খালেদ মোশাররফ হাঁক ছেড়ে ডাকলেন ফাহমিদা বেগমকে।
‘ফাহিমের মা, নাস্তা বানানো শেষ হলো? রোদ উঠতে শুরু করেছে। একবার জমিতে গিয়ে এরপর দোকান খুলবো।’
‘বাবা, বানানো শেষ। তুমি বসে পড়।’ বলেই নাযীফাহ একটা চেয়ার টেনে বসলো।
বা পাশের চেয়ারটা টেনে খালেদ মোশাররফও বসলেন। ফাহমিদা বেগমের আসার অপেক্ষা করছে তারা। উনি ফাহিমকে ডাকতে গিয়েছে।
ফাহমিদা বেগম ডেকেই চলে এসেছেন। উনি সবার প্লেটে রুটি আর ভাজি দেওয়ার পর সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই উনার ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো। তীক্ষ্ণ আর সূঁচালো চাহনিতে চেয়ে রইলেন।
ফাহিমের চক্ষুদ্বয় ফোলা ফোলা। লালাভ চক্ষু জোড়া দেখলে যে কেউ চমকে উঠবে। আর এই ভাপসা গরমেও ফুলহাতা শার্ট পরিধান করে আছে সে।
‘এই গরমে ফুলহাতা শার্ট পড়েছিস কেন? আর চোখ দুইটা লাল। রাতে ঘুমোসনি?’
ফাহমিদা বেগমের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকায় নাযীফাহ আর খালেদ মোশাররফ। দুজনই ফাহিম কে জহুরীর দৃষ্টিতে পরখ করে খাবারে মনযোগ দিল।
মায়ের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সোজা চেয়ার টেনে বসে পড়লো ফাহিম। কারো দিকে নজর না দিয়ে খাওয়া শুরু করলো।একমনে খেয়েই চলেছে সে।
ফাহমিদা বেগমও আর কথা বাড়ালেন না। তিনিও খাওয়ায় মনযোগ দিলেন। ছেলে যে নাগালের বাইরে চলে উনার আর বুঝতে বাকি নেই।
নিঃশব্দে খেয়ে চলেছে সবাই। খালেদ মোশাররফ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন।খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। উঠে দাঁড়ায় নাযীফাহ।
‘তোর খাওয়া শেষ?’
বাবার করা প্রশ্নে মাথা দুলায় নাযীফাহ।
‘তোমাদের আমার কিছু বলার আছে।’
জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকায় সবাই। তবে ফাহিম মাথা নুইয়ে খেয়েই চলেছে।
‘আমি কাল সারারাত ভেবে দেখলাম, হয়তো তোমরা সবাই আমার প্রতি বিরক্ত। কেউ প্রকাশ করছো আর কেউ করছো না। তাই তোমাদের সবার টেনশন আর চাপ কমাতে আমি বিয়ে করবো। তুহিন ভাই না তোমার কাছে একটা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল? তুহিন ভাইকে বলো তাদের নিয়ে আসতে। ছেলে যেমনই হউক আমার আপত্তি নেই। তারা যদি বলে আমাকে তাদের পছন্দ তৎক্ষনাৎ বিয়ের আয়োজন শুরু করে দাও। এরপরে যদি সংসারে কোনো অশান্তি বা ঝামেলা হয় আমি বুঝে নেবো। সারাজীবন তো সহ্য করে এলাম তখনও না হয় সহ্য করবো। তোমরা তো এই সম্বন্ধের কারনে আমাকে বকুল ফুফুর মিথ্যা অসুস্থতার কথা বলেছো। কারন তোমরা জানো বকুল ফুফুর শরীর খারাপের কথা শুনলে আমি না এসে থাকতে পারবো না। তোমাদেরও শান্তি দিতে চাই আর নিজেও একটু শান্তি চাই। শেষ বারের মতো না হয় ভাগ্যকে আরেকটা সুযোগ দিলাম।’
ফাহমিদা বেগম ছলছল চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন। খালেদ মোশাররফ থম মে’রে প্লেটের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলেন। কষ্ট হচ্ছে উনার। অসহনীয় কষ্ট।
ফাহিম খেয়েই চলেছে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে।ভাইয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের কান্না লুকাতে রুমের দিকে পা বাড়ায় নাযীফাহ। কয়েক পা এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে।
‘ফাহিম? ভয় পাস না আমি কোনোদিনও সম্পদের ভাগের জন্য আসবো না। আমি যা পাওয়ার কথা সেগুলোও তোর। আমার দুর্দিনেও তোর সম্পদ আমার প্রয়োজন না হয় সেই ব্যবস্থা করবো।সম্পদের জন্য মধুর সম্পর্ক নষ্ট হউক আমি চাই না।’
মুখের সামনে খাবার নিয়ে থেমে যায় ফাহিম। স্তম্ভিত, নিশ্চল, নিষ্ক্রিয় আর অনুভুতিহীন হয়ে বসে রইল কিয়ৎকাল। বোনের চোখের দিকে তাকাতে সংকোচ, সংশয় আর কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে। শুকনো ঢুক গিলে নাযীফাহ।
‘তিক্ত বাণীর তীর দ্বারা বাহিরের মানুষ আ’ঘা’ত করলে তা সহনীয় হয়। কিন্তু সেই আ’ঘা’ত টা আপন মানুষ করে তা আর সহ্য করা যায় না। কয়েকগুণ বেশি থাকে সেই নিদারুণ য’ন্ত্র’ণা।’
বিলম্ব না করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। গলা দিয়ে আর খাবার নামল না খালেদ মোশাররফের। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
‘যেখানে আমি বেঁচে থাকা কালীন আমার মেয়েকে তার ছোট ভাই সম্পদ নিয়ে কথা শুনায়। না জানি আমি মা-রা গেলে কি হবে। ঠিক কতটা আ’ঘা’ত সহ্য করতে পারে আমি এখনই আন্দাজ করতে পারছি। আমি তুহিনের সাথে কথা বলবো। বিয়ে দিয়ে দিলে আমিও শান্তি পাবো।’
_______________________
বাড়ির ভেতরের সরু গলি দিয়ে যাচ্ছে নাযীফাহ। কয়েকজন মহিলার ফিসফিসানি শুনে পা থেমে যায় তার।
‘আরে ওইডা খালেদ ভাইয়ের মাইয়া না? আহারে এই মাইয়া খালেদ ভাইয়ের মান সম্মান এক্কেবারে শেষ কইরা দিলো। মাইয়ার বাপটা কি ভালা মানুষ। আর মাইয়ার চ’রি’ত্রে সমস্যা।’
‘আরে মাইয়া মানুষরে শহরে পড়ালেহার লিগা পাডাইলে পোলাপান নিয়া ফষ্টিনষ্টি করবো। আমার নামে এত বড় কথা র’ট’লে গ’লা’য় দ’ড়ি দিতাম।’
‘আরে এরা ম’রে না। অ’স’তে’র আবার ক”ল”ঙ্কের ভয় আছে নাকি।’
দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল নাযীফাহ’র।
#চলবে
বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।