ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-০১

0
328

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_সূচনা_পর্ব
#_আরজু_আরমানী

পরিবারের বড় সন্তানরা প্রচুর ভালোবাসা পায়। সেক্ষেত্রে আমি পেয়েছি ডালা সাজানো তিরস্কার। কারো কাছ থেকে এক টুকরো সান্ত্বনার বানী শুনতে পাইনি। মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ি আমি, তখন থেকেই কঠোরভাবে আমার মা চাইতো আমাকে বিয়ে দেয়া হোক। সমাজের আর পাঁচটা মেয়ের মতো বিয়ে করে সংসার, স্বামী, ছেলেমেয়ে সামলাই। শ্বাশুড়ির অকথ্য গালিগালাজ আর নির্যাতন সহ্য করি। কেউ কোনো প্রতিবাদ করতো না তার কথার। আমার নানু ছিলেন যে, এতো প্রতিকূলতার মাঝেও আমার হাতটা ধরে থাকতেন। তিনি আমাকে বুঝাতেন,

” তোর মা আমার মেয়ে, আমি তার দূর্বলতা জানি। তুই চিন্তা করিস না। এতো তাড়াতাড়ি আমি তোর বিয়ে দিতে দিবোনা।”

আমি নানুর মুখপানে চেয়ে থাকতাম। এতো মানুষের ভীড়ে আমার তাকে ভরসা যোগ্য মনে হতো। তার হাত ধরলে সবটা অন্ধকার একটু একটু করে আলোয় পরিনত হতো। আমার ভাই আমার পাঁচ বছরের ছোট। তাকে নিয়ে সবার মাঝে উচ্ছ্বাস। তাকে আমার মা ও বেশি ভালোবাসতো। আমি তখন মনে মনে ভাবতাম,

” আমি যদি ভাই হতাম তবে মা আমাকেও বেশি ভালোবাসতেন।”

কিন্তু আমিতো মেয়ে ছিলাম। আমার কোনো মূল্য ছিলোনা। এই পরিবারে ছেলেদের মূল্য আকাশ সমান ছিলো। তাদের জন্য সাত খুন মাফ। আমাদের বিশাল পরিবার। আমার বাবার পাঁচ বোন এবং দুই ভাই। সবাই একসাথে থাকতো। বড় দুই ফুপি মমতা এবং কুলকুলের চার ছেলে। তাহমিদ, তামিম, নিলয় এবং নিরব। মেজো ফুপি এনার এক মেয়ে এশা এবং ছেলে আয়মান। সেজো ফুপি তিথির দুই মেয়ে তিশা এবং তিহা। ছোট ফুপি ইসরাতের এক মেয়ে মেহেরিমা। আমার চাচা আশফিক বিয়ে করেনি। আমার বাবা রায়হান রেদোয়ান ভাই বোনের মধ্যে তৃতীয়। তার এক মেয়ে আমি রাত্রি এবং ছেলে তাসকিন। আমার মা তাহিরা বেগম। রৌদ্রউজ্জল শুক্রবার। বাড়ির সব পুরুষ সদস্যরা নামাজ পড়ে এসেছে। তখন আমার মা আমার হাতে একটা লাল শাড়ি দিয়ে আমাকে বললো,

” রাত্রি এটা পরে একটু সেজে আয়। আর কিছুক্ষন পরে ছেলেপক্ষ তোকে দেখতে আসবে। তারা এখানে দুপুরে খাবে। সেই সাথে তোকে দেখে যাবে।”

সে চলে গেলো মেহমানদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে। আমি করুন দৃষ্টিতে আমার বাবার দিকে
তাকিয়ে রইলাম। সে মাথা নিচু করে আছে। তার কিছুই করার নেই। মায়ের উপর কথা বলতে পারেনা সে। কারনটা আমি জানিনা। হাতের শাড়িটা নিয়ে আমার রুমের দিকে ছুটলাম। রুমে ডুকে দরজাটা বন্ধ করে কিছুক্ষন কাঁদলাম। তখন এশা আপু আমার দরজায় কড়া নাড়লো। দরজা না খুলেই ছুটলাম ওয়াশরুমের দিকে। মুখটা ভালোভাবে ধুয়ে ফেললাম। কাউকে আমার কষ্টগুলো দেখাতে চাইনা। একটু পরে দরজা খুলে দেখি এশা আপুসহ তিশা, তিহা, এবং ছোট্ট মেহেরিমাও এসে হাজির আমার রুমে। হুড়মুড়িয়ে সবাই ঢুকলো । দরজাটা বন্ধ করে দিলো। এশা আপু বললো,

” মামি কারো কথা শুনবে না রে রাত্রি। তুই রেডি হয়ে নে। আমার মনে হয় এটাই ভালো হবে।”

আমি আর কোনো কথা বললাম না সেদিন। চুপ করে সবার রায়টাকে মেনে নিয়েছে। এশা আপু আমাকে শাড়ি পরালেন। ওরা সবাই মিলে আমাকে সাজালো। খুব মাধুর্যতার সাথে তারা আমার রুপের বর্ননা করলো। এতে আমার কোনো ভাবান্তর ঘটলো না। অতঃপর ছেলেপক্ষের লোকের সামনে নেয়া হলো আমাকে। দেড় হাত গোমটা টেনে বসে রইলাম তাদের সামনে। তারা পাঁচ জন পুরুষ এসেছে। এর মধ্যে আমার বর যে কে হবে সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। তাদের সাথে কাজী এসেছে। তাদের কথার ধরনে বুঝতে পারলাম, বিয়েটা আমার আজি হচ্ছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরলো কতটুকু নোনা জল। ঘৃনা হলো মায়ের প্রতি। সন্দেহ হলো, সেকি আমার আসল মা নাকি সৎ মা। তখন এশা আপু আমার মুখের ঘোমটা সরিয়ে দিলেন। কাপড়ের কোনা দিয়ে চোখটা মুছে ফেলেছি। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। বাজখাই কন্ঠে এক লোক বলে উঠলো,

” তাহিরা তোর মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছে। আজই তুই আমার শ্বাশুড়ি হয়ে যা।”

আবার ক্ষত – বিক্ষত হলো আমার ছোট্ট হৃদয়। শেষে কিনা মায়ের বয়সী এক লোককে বিয়ে করতে হবে। তার চেয়ে আমার মরন ভালো। চোখে টলমল করছে জল। সবার গোপনে গড়িয়ে পরলো। কেউ হয়তো তা দেখতে পায়নি। আমার মা বললো,

” তবে তাই হোক।”

কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করে করে দিয়েছেে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কাঁদছি আমি। এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে, ” আমার মতো কেউ এতোটা অসহয় না।” আমার এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার পুরো পরিবার দাড়িয়ে আছে। কেউ কোনো টু – টা শব্দ করছে না। সবাই দাড়িয়ে তামাশা দেখছে। কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না। নানুকে আজ আমি কিছুই জানাতে পারিনি। সে জানলে আজ আমার কাঁদতে হতো না। তাকেও মনে- প্রানে খুঁজছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চাইছি। কিছুতেই কিছু লাভ হচ্ছে না। বাবার দিকে তাকালাম, তিনি চুপ আছেন। তার কি আমার জন্য কষ্ট হচ্ছে না। শুনেছি বাবারা নাকি তার মেয়েকে ভীষন ভালোবাসে। আমার বাবা কি আমায় ভালোবাসে না? যদি ভালোবাসে তবে কেন সে এই বিয়েটা আটকাচ্ছে না? কেন কেন কেন?

” কবুল বলো মা”

কাজীর ডাকে ছেদ ঘটলো। আমাকে কবুল বলতে বলা হচ্ছে। তখন মাথায় একটা চিন্তার উদয় হলো, আচ্ছা কবুল মানে কি? কেন প্রত্যেক বিয়েতে কবুল বলতে হয়? কবুল ছাড়া কি বিয়ে হয়না? আমি সঠিক জানিনা। যদি কবুল না বললে বিয়ে হয়না, তবে আমি কবুলই বলবো না। মরে যাবো তবুও কবুল বলবো না। চুপ করে আছি। অনেকক্ষণ হলো। তবুও আমি চুপ। হঠাৎ হাতে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলাম। পাশ ফিরে দেখলাম মা আমার দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছে। রাগে গজ গজ করতে করতে তিনি আমায় বললেন,

” দ্রুত কবুল বল। নয়তো আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। ”

চোখ থেকে গড়ালো অশ্রু। হাতে ব্যাথা হচ্ছে। মায়ের ছোয়া তো আনন্দের হয়। ব্যাথা নিরাময় হয়। তবে আমার কেন জ্বালা বাড়ছে? এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? হাতে তার ধারালো নখগুলো বসে গেছে। চিরচিড়য়ে রক্ত বেরচ্ছে। আর সহ্য হচ্ছে না। এবার কবুল বলতেই হবে। সামনে দিকে তাকালাম। বাবার দিকে একবার তাকালাম। একটু বিদ্রুপের হাসি হাসলাম। মনে মনে বাবাকে বললাম, ” রায়হান রেদোয়ান আপনার বড় মেয়ে আজ মারা যাচ্ছে। কিন্তু আপনি সেটা বুঝতে পারছেন না। লাশ দেখে তবেই বুঝবেন।”
বাবার থেক চোখ ঘুরিয়ে কাজীর দিকে তাকিয়ে বললাম,

” কি বলতে হবে?

” কবুল।”

আমি কবুল বলার জন্য দুই ঠোঁট ফাঁক করতেই হঠাৎ কেউ বললো,

” বাল্যবিবাহ আইনগত অপরাধ। এদের প্রত্যেকটাকে গ্রেফতার করে কোর্টে চালান দিবো।”

দরজার দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হলাম। পাঁচ – ছয়জন পুলিশ দাঁড়ানো। এদের কে ইনফর্ম করলো? শুকনো মরুভূমিতে পানি পেলে যেরকম হয় ঠিক সেই অনূভুতিটা হলো আমার। চোখমুখ থেকে সরে গেলো বিষন্ন ভাব। তারা বাসার ভিতরে প্রবেশ করলেন। আমার মা এবং তার বন্ধুরা ভয় পেলো প্রচন্ড। তাদের মধ্যের একজন উঠে পুলিশের পা ধরে বললো,

” স্যার এরকম আর কখনো হবেনা। এবারের মতো যেতে দিন। ”

পুলিশ কারো কোনো কথা শুনলেন না। সবাইকে নিয়ে গেলেন। তবে আমার মা তাহিরা বেগমকে নিলেন না। খুবই মনে কষ্ট পেলাম আমি। সেও তো দোষী। তাকে কেন ছেড়ে দেয়া হলো? এটা পুলিশ কাকু ঠিক করলো না। তারা চলে যেতেই থমথমে হলো পরিবেশটা। মা কোনো কথা বললেন না। চুপ করেই আছে। হয়তো তাকে খুঁজছে যে পুলিশ খবর দিয়েছে। আমি আমার রুমে চলে এলাম। এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দুপুরে কিছুই খাইনি। ভীষন ক্ষুধা লেগেছে। কিছু খাওয়া দরকার। তবে আগে ড্রেসটা পাল্টাতে হবে। ড্রেস পাল্টে সাদা সুতির সেলোয়ার-কামিজ পরলাম। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলতেই সপাটে এক চড় পরলো আমার গালে। হঠাৎ এমন আক্রমণে তাল সামলাতে না পেরে পাশে থাকা টেবিলের উপর পরলাম। টেবিলের কোনার সাথে বাড়ি খেয়ে ঠোঁট ফেটে গেছে। জিহ্বায় নোনা স্বাদ অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখলাম মা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা খুন্তি। তা দিয়েই পিটানো শুরু করলো। দরজাটা বন্ধ। ওপাশ থেকে কেউ আসতে পারছেনা। আমার সাদা জামা ক্রমশই রং পরিবর্তন করে লাল রঙে পরিনত হলো। আচমকা একটা বাড়ি এসে আমার কপালে পড়তেই আমি সেন্সলেস হলাম। কত সময় এভাবে কেটে গেছে জানিনা। যখন হুঁশ ফিরলো তখন আমি হাসপাতালের বেডে। মাথায় ব্যান্ডিজ করা। হাতে ক্যানোলা লাগানো। এখন মনে হয় মধ্যে রাত। চারপাশে শুধু ঝি ঝি পোকার আওয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম তিশা বসে বসে ঘুমাচ্ছে। ওকে ডাক দিলাম। ও জেগে গেলে ওকে বললাম,

” একটু পানি নিয়ে আয়। খুব তেষ্টা পেয়েছে।”

তিশা দ্রুত পায়ে ছুটলো পানির জন্য। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। পানি খেয়ে তৃষ্ণা নিবারন করলাম। ওকে বললাম,

” এখানে কে নিয়ে এসেছে?”
” তাহমিদ ভাইয়া।” দ্রুত জবাব দিলো তিশা

চমকে গেলাম। তিনি তো আজ বাড়িতে ছিলেন না। তার কোনো বন্ধুর বোনের বিয়েতে ছিলেন। তবে তিনি কখন এলেন। কি হয়েছিলো আমার? তখন মনে পরলো সব কিছু। মনটা বিষিয়ে উঠলো। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়ালো। তিশাকে জিজ্ঞেস করলাম,

” এখানে কতদিন থাকতে হবে?”
” কাল সকালেই বাড়ি চলে যাবো আমরা। তুই চিন্তা করিস না। কিছুদিনের জন্য রেস্ট নিবি। সব ঠিক হয়ে যাবে। স্কুলের স্যারের কাছ থেকে তোর জন্য একসপ্তাহের ছুটি চেয়েছি। তিনি রাজীও হয়ে গেছেন। আমিও যাবোনা এ কদিন বুঝলি।”

তিশা থামলো। এই বাড়িতে থাকার ব্যাপারটা ভালো লাগলো না। বাড়িতে থাকলেই মায়ের কথা শুনতে হবে। তার চেয়ে গনিত স্যারের বেতের বাড়ি খাওয়া ভালো। ঠিক করলাম পরশু থেকেই স্কুলে যাবো।

চলবে……….