ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে পর্ব-১১

0
311

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ১১
#_আরজু_আরমানী

একটা নিস্তব্ধ রাতে মে’রে ফেলা হয় রোমিও-
জুলিয়েটকে। মৃ’ত্যু’র কয়েক সেকেন্ড আগে জুলিয়েট বলেছিলেন,

” এই পৃথিবীর সবাই রাতের নিস্তব্ধতাকে ভালোবাসবে। সূর্যের উজ্জ্বলতাকে কেউ ভালোবাসবেনা।”

সত্যি তার কথা। রাতের নিস্তব্ধতাকে ভালোবাসেনা এমন মানুষ বোধহয় খুজে পাওয়া যাবেনা। একজন লোক সারাদিন হারভাঙা পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় তার বাসায় ফেরে। রাতে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়। একজন স্বামী পূর্নিমার আলোর নিস্তব্ধতায় তার সহধর্মিণীর হাত ধরে বসে চাঁদ দেখে। জীবনের কত গল্প করে। একজন স্টুডেন্ট রাতের নিস্তব্ধতায় নিজের পড়াশোনায় গভীর মনোযোগী হয়। পৃথিবীও তার কাজ হতে একটু অবসর নেয় এই রাতে। আজ আমিও বসে আছে ছাদে। একা একা। কোথাও কেউ নেই। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে পৃথিবী। মোবাইলে একটা গান ছেড়ে দিলাম,

“আলোয় আমার আলোয় ওগো
আলোয় ভুবন ভরা।

চোখ বন্ধ করে গানটা শুনছি। পাশে এসে বাবা বসেছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। প্রতিউত্তরে তিনিও হাসলেন। বাবা বললেন,

” তোমার মায়েরও গান খুব প্রিয়।”

আমি জানি আমার বাবা – মা দুজন দুজনকেই খুব ভালোবাসে। যদি সেটা না হতো, তবে আমার বাবার কিছু ভুল কাজের পরও তার সাথে থাকতেন না। আমার হাসিটা গাঢ় হলো। হেসে হেসেই বললাম বাবাকে,

” মাকে অনেক বেশী ভালোবাসেন? ”

” হ্যাঁ। খুব। ”

বাবা আবার তাকালেন আকাশ পানে। সেদিকে তাকিয়েই বললেন,

” তোমার মা কিন্তু একজন নরম মনের মানুষ। আমি তাকে কাছ থেকে দেখেছি, চিনেছি। ”

” তবে সে কেন আমায় ভালোবাসতে পারলো না?”

বিরস মুখে কথাটা বললাম। বাবা আমার দিকে তাকালেন। তার মুখের হাসিটা এবার মলিন হলো। মলিন মুখেই সে বললো,

” প্রত্যেকটা কাজের পিছনে একটা শক্ত ইতিহাস আছে। কোনো কারন ছাড়া কোনো কার্যসিদ্ধি হয়না। তোমার মায়ের তোমাকে ভালো না বাসার একটা কঠিন ইতিহাস আছে। ”

” সেটা কি?”

বাবা মলিন মুখে হাসলেন। এই হাসিতে কোনো প্রান নেই। আমার বুকের মাঝে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো বিচ্ছেদ ব্যাথার আগুন। কেন মা আমাকে ভালোবাসতে পারলেন না?

” সেটা না হয় তুমি অন্য কোনো একদিন জানবে। আজ এখানে কেন ডাকলে সেটা বলো।”

” বাবা আমি কি আপনার কোলে মাথা রেখে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি? ”

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন বাবা। মনে হচ্ছে বহু বছর তিনি আমায় দেখেন নি। আমার মুখে এমন কথা শুনে তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরলো। তার মধ্যে জেগে উঠেছে পিতৃত্ববোধ। তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করছেন। তার মুখের আদল দেখে আমি এটাই বুঝতে পারছি। বাবা আমাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। আমি দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

” তোমার জীবনেও ভালোবাসা আসবে। তুমিও অনেক সুখী হবে। দেখো সেইদিনটা খুব সুন্দর হবে। আমি বিশ্বাস করি। তুমি অপেক্ষা করো। ”

বাবার কথায় আমার কান্নার তোড় বাড়লো। তিনি আমার মাথায় চুমু খেলেন। এই প্রথম বাবা আমাকে এতোটা আদর করলো। এর আগে আমি কখনো কারো এতো ভালোবাসা পাইনি। আমি বড় ভালোবাসার কাঙাল। একটু ভালোবাসা পেলে আমি হয়তো পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ হতাম। বাবা আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে অপেক্ষা করবো। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করবো।

___________________________

তামিম ভাইয়া এনে দিলেন সমরেশ মজুমদারের লেখা সাতকাহন ১ম খন্ড বই। এই বইটা পড়ার অনেক ইচ্ছে ছিলো অনেকদিন থেকেই। কিন্তু কারনে- অকারনে হয়ে উঠেনি। আজ মনটা ফুরফুরা লাগলো সকাল সকাল বইটা পেয়ে। কিন্তু তামিম ভাইয়ার শর্ত শুনে মাথার কলকব্জা সব নড়ে গেলো। তার শর্তটা এরকম,

” তিনি কাল আমাদের পঞ্চবটী নিয়ে যাবেন। ওখানে নদীর পাড়ে তিনি তিশাকে প্রোপজ করবেন। কিন্তু তিশা একা যাবেনা। তাই ওকে ওখানে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে হবে।”

কিন্তু আমি তাকে বলেছি, এরকম বিট্রে করার জন্য আমি এখন আর নিরব ভাইয়াকে বিশ্বাস করিনা। তিশা যদি আমাকে অবিশ্বাস করে। তিনি আমাকে কথা দিয়েছেন এরকম কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবেনা। বাসার সবাই যাবে। আমি তার কথায় পুরোপুরি আস্থা করতে পারলাম না। কোথাও একটা অবিশ্বাস যেনো থেকেই যায়। আমি তিশার বাসার কলিংবেল টিপে দাড়িয়ে আছি। সেজ ফুপি এসে দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে বললেন,

” তিশা বাসায় নেই। ”

তার কথা বলার ধরনটা আমার কাছে খুবই অপরিচিত অপরিচিত ঠেকলো। কাল অবধি তিনি আমার সাথে নরম সুরে কথা বলেছিলেন। একটা রাত যেতে না যেতেই তার কন্ঠেরও পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ কত দ্রুত বদলে যায়, তা বোধহয় আমার ফ্যামিলির মানুষদের না দেখলে জানতে পরতাম না। আমি ফুপিকে বললাম ,

” কিন্তু একটু আগেই তো ও বললো বাসায় আছে। তাইতো এলাম।”

” না, নেই। তুই এখন যা তিশা যখন আসবে তখন আসবি।”

” আর বোধহয় আসা হবেনা ফুপি।”

আমি সিড়ির একেকটা ধাপ ভেঙে ছোট ফুপির বাসার সামনে এসে দাড়ালাম। তিনি এবং মেজো ফুপি দুজনে আমার সাথে এখনো ভালোভাবে কথা বলে। কিন্তু তারা যে বদলে যাবেনা তার নিশ্চয়তা দিতে পারছিনা। এশা আপুই যেখানে বদলে গেলো। আর কাউকে তেমন ভরসা করা যায় না। কলিংবেল টিপতেই মেহেরিমা এসে দরজা খুলে দিলো। বেড়াল ছানার মতো তুলতুলে নরম বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ফুপির কাছে গেলাম। ফুফা বেরিয়েছে অফিসের উদ্দেশ্যে। ফুপি দুপুরের রান্নার আয়োজন করছেন। আমাকে দেখে হাসলেন। তার হাসিতে সেই আগের মমতাময়ীতা দেখতে পেয়েছি। তিনি আমাকে বললেন,

” মেয়েরা আসলেই টাকা-পয়সা আর দামী কিছু গহনা পেলে নিজের সুখ, স্বপ্ন, আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেনা। ”

আমি তার কথা বুঝতে না পেরে বললাম,

” এরকম কেনো বলছো?”

” এশার স্বপ্ন ছিলো পড়াশোনা করে একটা চাকরি করবে। কিন্তু বিয়ে তার সেই স্বপ্ন শেষ করে দিলো।”

” তাহমিদ ভাইয়া তো তাকে পড়াবে।”

ফুপি চেয়ার টেনে ডাইনিং টেবিলের পাশে বসলেন। আমিও বসলাম। মেহেরিমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম। ও চরে গেলো টিভির রুমে। ফুপি এক ঢোক পানি খেয়ে বললেন,

” তুই কি জানিস তাহমিদ কেন এশাকে বিয়ে করছে?”

আমি মাথা ডানে -বামে নেড়ে বললাম,

” স্পেসিফিক কারন তো জানিনা। তবে তিনি তো আমাকে বিয়ে করার কথাও বলেছিলেন। আমি না করে দেওয়ার পর তিনি কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে গেলেন। ”

” ঠিক ধরেছিস। ঝামেলাটা ওখান থেকেই হয়েছে। অনেক আগে থেকেই তাহমিদ তোকে পছন্দ করতো। বড় আপা এবং দুলাভাইকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছিলো, যাতে তারা তোকে তাদের ঘরে বউ করে নেয়। তারা সবটা মেনেও নিয়েছিলো। কিন্তু তুই না করে দেয়ার পর ও তোকে কয়েকবার বোঝাতেও নাকি গিয়েছে। কিন্তু তুই ওকে পাত্তা দিসনি। এরপর ও দুদিন বাসায় বসে মদ গিলেছে। এটা দেখে বড় আপা বললো, ও যেন এশাকে বিয়ে করে তোর উপর প্রতিশোধ নেয়। এশাকে সোনা-গহনায় স্বনার্লি বানিয়ে তোকে জ্বালাবে। আর তুই তাতে জ্বলবি। কিন্তু আমার মনেহয় না, তোর এতে কিছু আসবে-যাবে।”

” কয়লা জ্বালানোর আর কোনো প্রয়োজন নেই। সে জন্ম থেকেই পুড়েছে। ”

” আমি তোকে এমন ইস্পাত কঠিন দৃঢ়ই দেখতে চেয়েছি। মন যাকে সায় দিবে তাকে বিয়ে করবি। আমাদের চোখ ভুল করলেও মন কিন্তু কখনোই ভুল করেনা। ”

ছোট ফুপির সাথে কথা বলে মনটা হালকা লাগলো। তার সাথে দাড়িয়ে আজ বিরিয়ানি রান্না দেখলাম। তৃপ্তি করে খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে বাসায় ফিরে এলাম। নিজের রুমে এসে অবাক হলাম। মা বসে আছে আমার টেবিলের পাশে। টেবিলের উপর একটা হলুদ রংয়ের খাম। এই যুগে কেউ কাউকে চিঠি দেয়? আমার জানা নেই। কিন্তু কে দিবে আমায় চিঠি? কাউকে তেমন খুজে পেলাম না। মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

” আজকাল বাসা ছেড়ে কোথায় থাকিস? একটা মেয়ে চিঠি দিয়ে গেছে। আমি নিয়ে এসেছি। এটা খুলে আমার সামনে পড়।”

চিঠিটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষন। কোন মেয়ে চিঠি দেবে আমাকে? তেমন কোনো মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক নেই। কোনো ফ্রেন্ড সার্কেলও নেই। তবে কে দিলো চিঠিটা? মাথা ধরে গেলো এতটুকু চিন্তা করতেই। মা আমাকে চিঠিটা পড়ার জন্য আবার তাড়া দিলো। মাথা ধরার সাথে সাথে এবার মেজাজটাও বিগড়ে গেলো। আমি কেন তার সামনে দাড়িয়ে চিঠি পড়বো? না পড়বো না। আমি চিঠিটা ওয়াডড্রবে রেখে দিয়ে লক করে দিলাম। বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পরলাম। মা আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রইলেন। ধমকে উঠলেন,

” কথা কানে যাচ্ছে না।”

চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তার কথার কোনো রেসপন্স করলাম না। আচমকা মা আমাকে কয়েকটা থাপ্পড় মারলেন। আমি দড়ফড়িয়ে বসে পরলাম। চুল ধরে ঝাকুনি দিয়ে বললেন,

” চিঠি বের করে আমার সামনে পড়।”

রাগ হলো ভীষন। যে ভালোবাসতে জানেনা তার আঘাত করার অধিকার নেই। আমি কারো অধিকার মানবো না। আমি রাগে হাতের পাশে থাকা কাচের ফুলদানিটা বাড়ি মেরে ভেঙে ফেললাম। মা আমার চুল ছেড়ে দিলেন। আমার দিকে অগ্নি চোখে তাকালেন। আমিও দৃঢ়চোখে তার তাকিয়ে রইলাম। তিনি চলে গেলেন। আমি চোখ বন্ধ করে বসলাম। মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা ফুল স্পিডে চলছে। তবুও আমি ঘেমে গেছি। ছোট ফুপির জামা কাপড় আমার পরনে। মুখের ঘাম মুছে শুয়ে পরতেই বড় ফুপির কন্ঠ শুনতে পেলাম।

চলবে……….