#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-২৫
“শিখা কি করছো?”
শিখা চমকে পিছু ফিরলো। তার হাত থেকে মোবাইল আছড়ে পড়লো মেঝেতে। ভীত চোখে সামনে দাঁড়ানো রোজীকে দেখছে। এতোক্ষণ তার বলা কথাগুলো কি রোজী শুনে ফেলেছে? উফফ এমন ভুল হলো কি করে? দুপুরের এই সময়টা ভাবি একটু ঘুমায় ভেবে ড্রইং রুমে বসেই ফোনে কথা শুরু করেছিলো সৌরভের সাথে। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেকেই মারতে মন চাইলো শিখার। রোজী অবশ্য শিখার চেহারার দিকে মনোযোগ দেয়নি। স্বাভাবিক ভাবে এসে শিখার পাশে বসলো, তার মোবাইল তুলে হাতে দিলো-
“তোমার সাথে একটু পরামর্শ করতে এলাম।”
এতোক্ষণে নিজেকে একটু সামলে নিলো শিখা। কন্ঠ স্বাভাবিক করে রোজীর দিকে তাকালো-
“হ্যা ভাবি, কি পরামর্শ? সিরিয়াস কিছু?”
“আরে না। তেমন সিরিয়াস কিছু না। রাজ আর বউমার ব্যাপারে। ওদের কি কোথাও বেড়াতে পাঠাবো? ওদের নিজেদের মধ্যে একটু সময় কাটানো জরুরি। এদিকে তোমাদের ভাইয়ের শরীরটা ক’দিন ধরে একটু বেশি খারাপ মনে হচ্ছে তাই সাহস করতে পারছি না।”
“সময় তো ওরা বাসাতেও কাটাতে পারে ভাবি। এই মুহূর্তে কোথাও পাঠানো ঠিক হবে না।”
“তা পারে কিন্তু তাতে ওরা নিজেদের মধ্যে সহজ হচ্ছে না। এতোদিন পর হঠাৎ করে জীবন শুরু করলো এমনটা হওয়ারই কথা। তাই ভাবছিলাম ওদেরকে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসতে বলবো।”
“আপনার বউমার মন উড়ুউড়ু থাকে। এসেছে তাও তো চার পাঁচ মাস হয়ে গেলো। ওদের বরং ঢাকায় পাঠান। মেয়েটা ওর বাবা মায়ের কাছে থেকে আসুক কিছুদিন। এরপর হয়তো মন বসবে।”
রোজীর চেহারা উজ্জ্বল হলো-
“ঠিকই বলেছো। আচ্ছা দেখি রাজের সাথে কথা বলে ও রাজি হয় কিনা।”
রোজী সন্তুষ্ট চিত্তে উঠে গেলো। শিখা হাসলো মনে মনে। ভাগ্যদেবী এবার একটু বেশিই সহায় তার উপর। যদি রাজ ঢাকায় যেতে রাজি হয় তাহলে অনেক মুশকিল আসান হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে রাজের ঢাকায় যাওয়া জরুরি। দুদিন সময় পেলেই সৌরভ নিজের কাজ গুছিয়ে নিতে পারবে। নিজের ছেলের জন্য এইটুকু সাহায্য মা হয়ে না করতে পারলে হবে কি করে?
“তুমি কি মাকে কিছু বলেছো?”
রাযীন কাপড় পরতে পরতে জানতে চাইলো। রুহি অবাক হয়ে রাযীনকে দেখলো-
“কোন বিষয়ে?”
“এখানে ভালো লাগছে না বা এমন কিছু?”
“নাতো?”
“ওহহ। তাহলে মা হঠাৎ ঢাকায় যাওয়ার কথা বললেন কেন?”
“তার আমি কি করে বলবো?”
রুহি কাঁধ ঝাকিয়ে উত্তর দিলো। রাযীন রুহির দিকে এগিয়ে এসে ওর দু’কাধে হাত রাখলো-
“কি হয়েছে? এমন কাটা কাটা উত্তর দিচ্ছ কেন?”
রুহি রাযীনের হাত সরিয়ে দিলো-
“এমনিতেই। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আগে।”
রাযীন গেলো না দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। সে রুহির এমন আচরণের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না কোন। সকালেই তো বেশ ভালো মুডে ছিলো। রুহিও সব বুঝে না বোঝার ভান করে মোবাইল দেখতে লাগলো। রাযীন ওর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিলো-
“কি হয়েছে বলবে? এমন করছো কেন?”
“কেমন করছি?”
“এই যে আমাকে ইগনোর করছো।”
রুহি রাযীনের প্রশ্ন উপেক্ষা করে সরাসরি তার চোখে চোখ রাখলো-
“শুনুন আমি কিছু জানতে চাই। সরাসরি উত্তর দেবেন তো?”
রাযীন সরু চোখে রুহিকে জরিপ করলো-
“কি জানতে চাও?”
“আপনি এতোদিন দেশের বাইরে ছিলেন কারো সাথে সম্পর্ক নেই? ওই যে স্প্যানীশ গার্লফ্রেন্ডের কথা বলতেন সে কি সত্যি আছে?”
রাযীন নিষ্পলক চোখে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে-
“কোনটা শুনলে তুমি খুশি হবে?”
“প্লিজ কথা প্যাচাবেন না। আমার সত্যি উত্তরটা চাই, প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন না।”
রাযীন বুঝে পেলোনা কি বলবে। সত্যি বললে মেয়েটা কষ্ট পাবে মিথ্যে সে বলতে চায় না। রাযীন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-
“স্প্যানীশ গার্লফ্রেন্ডের কথা মিথ্যে নয়। ছিলো একটা মেয়ে যার সাথে একই এ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। ও আমার প্রজেক্ট পার্টনার ছিলো।
তুমি তো জানোই ঝিলিকের সাথে আমার একটা মেন্টাল এ্যাটাচমেন্ট ছিলো। ওকে ভুলতেই আমি দেশ ছেড়েছিলাম। হ্যা আরেকটা কারণ ছিলে তুমি। সেই সময় বাবা জোর করে বিয়ে দেন সেটাও মেনে নিতে পারিনি। সব মিলিয়ে খুব ফ্রাসটেশনে ছিলাম। এই মেয়েটা আমার সাথেই পড়তো, খুব ভালো ফ্রেন্ড আমার। আমাকে ভালো বুঝতো। দেশে আসার পর কিছুদিন ওর সাথে কথা হয়েছে। এখন আর হচ্ছে না। আমিও ফোন দেই না ও ওর কাজ নিয়ে বিজি।
এখন এটাকে ভালোবাসা বলে কিনা জানিনা।”
রাযীনের শেষ কথা যেন রুহির কানেই গেলোনা। সে রাযীনের দিকে নজর রেখে বলে-
“ওর সাথে ফিজিক্যাল হয়েছিলেন? ওসব দেশে তো ভালোবাসার প্রয়োজন হয়না ফিলিক্যাল হতে।”
রাযীন হাসলো রুহির দিকে তাকিয়ে-
“তা জেনে কি হবে বলোতো? আমার সাথে আর থাকবেনা? ছেড়ে দেবে আমাকে? তোমরা মেয়েরা এতো পজেসিভ হও কেন?”
“আমাকে ভালোবাসেন?”
আচমকা রুহির এমন প্রশ্নে রাযীন কিছুটা চমকে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বললো-
“নাহ। ভালোবাসা ব্যাপারটা আমার দ্বারা আর হবে না। আর কোন মেয়েকেই হয়তো ভালোবাসতে পারবো না আমি।”
জবাব শুনে রুহি অবাক হলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো-
“তবে আমার কাছাকাছি আসছেন কোন অধিকারে?”
রাযীন উঠে দাঁড়ালো। ঘরের মধ্যে কিছুটা সময় পায়চারি করে কাটালো তারপর আবার রুহির সামনে এসে বসলো-
“তুমি আমাকে ভালোবাসো? আমি জানি উত্তর নাই হবে। বিয়ের সম্পর্কটা কি ভালোবাসাবাসির ধার ধারে? কয়টা বিয়েতে ভালোবেসে শারীরিক সম্পর্ক হয়? বিয়ে ব্যাপারটা আসলে কি? আমার কাছে মনেহয়, বিয়ে করে দু’জন মানুষ পাশাপাশি থাকতে থাকতে অভ্যাস মতোন হয়ে যায়। তখন তাকে ছেড়েও থাকা যায় না আবার ধরেও থাকা যায় না। এই দুয়ের মাঝে থাকতে থাকতে সম্পর্কে এক ধরনের নির্রভশীতা তৈরি হয় হয়তো ভালোবাসাও।”
একটু থেমে দম নিলো রাযীন-
“তাছাড়া জৈবিক চাহিদার কথা অস্বীকার করি কি করে। আমি তো মহামানব না। একজন সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ আমি, কাছে বউ আছে তাকে একান্ত নিজের করে পেতে চাইবো না?”
রুহি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। রাযীনের কথাগুলো মানতে পারছেনা। সম্পর্কের এমন অদ্ভুত অবস্থায় এ সম্পর্ককে ভবিষ্যতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা ভাবাটা অযৌক্তিক লাগছে তার কাছে। কিন্তু কি বলবে ভেবে পেলো না। রাযীন কি যেন ভাবলো খানিকক্ষণ তারপর বললো-
“দেখো রুহি, আমার মনেহয় না যা হয়েছে যা হচ্ছে তা নিয়ে এতো ভাবনার প্রয়োজন আছে। আমি অতীতে কি করেছি তুমি কি করেছো তা নিয়ে না ভেবে বর্তমানে কি হচ্ছে সেটা ভাবাই বুদ্ধিমানের কাজ। যে কারনেই হোক না কেন আপাতত আমরা দু’জনে একসাথে আছি এটাই বড় কথা। এই একসাথে থাকার সময়কাল বৃদ্ধি পাবে কিনা এটা আমাদের আচরণের উপর নির্ভর করছে। আমি আমার দিক থেকে চেষ্টা করছি তুমি ও করছো তাহলে এতো টেনশনের কি আছে?”
“সবকিছু কতো সহজে বলে দিলেন। আপনার জন্য এতোটা সহজ সব? আমি গত পাঁচ বছর কি সয়েছি সে সম্পর্কে বিন্দু মাত্র আইডিয়া ছিলোনা আপনার এখনো নেই তাই কথাগুলো সহজে বলতে পারলেন।”
রুহি মেজাজ খারাপ করে রুক্ষ স্বরে কথাগুলো বলতেই রাযীনের চেহারায় বিরক্তির ছাপ পড়লো-
“সবাই আসলে সবসময় নিজের কথাই ভাবে।
দেখো আমিও কিন্তু মানসিক অশান্তিতে ছিলাম। কিন্তু সেটা আমি তোমায় বলছি না। তুমি হয়তো আমার কারণে ছিলে আমি অন্য কারো কারণে। আগেই বলেছি এসব নিয়ে কথা না বলে আমরা বর্তমান নিয়ে ভাবি।”
“আর ভবিষ্যৎ? সেটা নিয়ে কে ভাববে?”
রুহি খর কন্ঠে জানতে চাইলো।
“এতো ভাবতে হবে কেন? জীবনকে জীবনের নিয়মে চলতে দাও। টেক ইট ইজি।”
“আপনি কি আবার ফিরে যাবেন আমেরিকায়?”
“আমি কিন্তু তা বলিনি এমনকি এমনটা ভাবিওনি। আচ্ছা চলো আমরা ঢাকায় যাই। নিজেদেরকে একটু সময় দেই। তাছাড়া পরিবেশ পরিবর্তন হলে হয়তো মনের কিছুটা পরিবর্তন হবে। নিজেরা একটু নিরিবিলি থাকতে পারবো নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে ভালোভাবে ভাবতে পারবো। চাইলে তুমি তোমার বাবা মায়ের সাথেও থাকতে পারো আমি কিছু বলবো না। ঢাকায় আমার কিছু কাজ আছে সেগুলো সেরে নেবো এর মধ্যে।”
রাযীনের কন্ঠে স্পষ্ট হার মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত। রুহির ভালো লাগলোনা পুরো বিষয়টা। এতো ভাসা ভাসা ভাবনা তার ভালো লাগে না। জীবন নিয়ে স্পষ্ট চিন্তা না থাকলে এগুনো মুশকিল। সে নিজেই বা কি করবে? এ পরিবারকে আপন করতে চাইলে পদে পদে বাঁধা। এক শুভ তারপর… কিছু মনে পড়তেই রুহি রাযীনকে ডাকলো-
“শুনুন, একটা সত্যি কথা বলবেন?”
রাযীন মাথা ঝাকায়-
“আমাকে নিয়ে আপনি সিরিয়াস তো? মানে গতবারের মতো আবার ফেলে চলে যাবেন নাতো?”
রাযীন রুহির সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলো, চোখে চোখ রেখে গাঢ় স্বরে বললো-
“যা করেছি সেজন্য আমার উপর বিশ্বাস করাটা হয়তো কঠিন তোমার জন্য। আমি বলবো না যে বিশ্বাস করো। ওটা সময়ের সাথে সাথে এসে যাবে। শুধু এতটুকু বলবো, অবিশ্বাস করোনা। আমি মনেহয় এতোটাও খারাপ মানুষ না।”
তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুহির চোখে জল আসে। বুকের গহীনে এখনো শুভর কথা ভেবে চিনচিনে ব্যথা বোধহয়। রাযীনকে কি শুভর কথা বলে দেবে? যেখানে দুজনের দু’জনার প্রতি বিশ্বাস এখনো পাকাপোক্ত হয়নি সেখানে শুভর কথা জানানো কতখানি ঠিক কাজ হবে? যদি আবার দূরত্ব আসে?
অভিমানে যদি আবার রাযীন হারিয়ে যায়? অজানা আশঙ্কায় রুহির বুক দুরুদুরু কাঁপে।
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
শিখা অবাক হয়ে শুভকে দেখলো। উত্তর না দিয়ে ব্যাগে নিজের প্রয়োজনীয় কাপড় ঢুকাচ্ছে শুভ। শিখা ওর হাত থেকে কাপড় কেড়ে নিলো-
“তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি?”
শুভ নির্বাক হয়ে মাকে দেখলো-
“ঢাকায় যাবো।”
“কেন?”
“এমনিতেই।”
শুভ মায়ের হাত থেকে কাপড় কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো শিখা দিলো না। উল্টো দিকে ফেলে শুভর দিকে রাগী দৃষ্টি হেনে বললো-
“কোন ধরনের পাগলামি করবেনা শুভ। আমি বলেছি তুমি যাতে ওকে পাও সে ব্যবস্থা আমি করবো। আমার উপর ভরসা করতে হবে তোমার। এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওয়া চলবে না তোমার।”
শুভ দাঁতে দাঁত চেপে বললো-
“তোমাকে আর বিশ্বাস করি না আমি। ওদের ঢাকায় পাঠানোর বুদ্ধিটা তোমার। তুমি চাইছো ও যেন আমার কাছ থেকে আরো সরে যায়।”
শিখা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ছেলের হাত ধরতে চাইলে শুভ ঝটকায় সে হাত ছাড়িয়ে নিলো। শিখা বিছানায় বসে দূর্বল গলায় বললো-
“বোকার মতো কথা বলোনা শুভ। আমি তোমার মা, তোমার খারাপ কেন চাইবো? তোমাকে বলেছি যখন ও তোমারই হবে আজ অথবা আগামীকাল। যদি অস্থির হয়ে উল্টো পাল্টা কাজ কর তাহলে আমাকে কিছু বলতে পারবে না। মেয়েটা তোমাকে অবিশ্বাস করে। পুনরায় ওর বিশ্বাস অর্জন করতে তোমাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে। অধৈর্য্য হওয়ার ফল ভালো হবে না জেনে রেখো।”
শিখার কথা শুনে শুভ কিছুটা শান্ত হলো। মায়ের পাশে বসে ক্লান্ত গলায় বললো-
“তাহলে কি করবো এখন? ভাইয়ের সাথে ওকে দেখলে সহ্য হয় না।”
“সহ্য করতে হবে বাবা। তুমি তো জেনে-বুঝেই এ পথে পা বাড়িয়েছো তাহলে এখন কষ্ট সইতে ভয় কি?”
শুভ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো-
“ওকে প্রথম দেখায় ভালো লেগেছিল মা। জীবনে প্রথমবারের মতো কাউকে আপন আপন লেগেছিল। তাছাড়া তখন মনের কথা শোনার মতো তুমি ছিলো নাতো পাশে এখন যেমন আছো।”
“তখন ভুল করেছিলাম বাবা। কিন্তু এখন আমি আছি, সবসময় তোমার পাশে আছি। মাকে বিশ্বাস করে দেখো বাবা। এই কষ্টটুকু সয়ে নে। দেখবি মা সব ঠিক করে দেবে।”
শুভ ছলছল চোখে মায়ের কোলে মুখ লুকায়-
“রুহিকে না পেলে বাঁচবো না মা। ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি মা।”
শিখা কথা না বলে চুপচাপ ছেলের মাথার চুল বিলি করে দিচ্ছে। কি করে ছেলের জন্য কিছু করবে তা ভেবে চলছে মন। রাযীন এবার আগের মতো আবেগি নেই। বয়স বেড়েছে, পরিপক্বতা এসেছে ভাবনা চিন্তায়। এবার ওর সাথে কিছু করলে অনেক ভেবে চিন্তে করতে হবে।
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-২৬
বাসায় ফিরে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতের কাছে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে গেলো সৌরভের। ঝিলিককে ডাকলো কয়েকবার কিন্তু কোন সারা পাওয়া গেলোনা। বাথরুম আর বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো সেখানেও নেই। বাধ্য হয়ে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে ঝিলিকের গলা শোনা গেলো-
“আমি মায়ের কাছে এসেছি থাকবো কয়েকদিন।”
“আমাকে না জানিয়ে গেলে কোন সাহসে?”
সৌরভ দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলো। ঝিলিক অবশ্য সৌরভের রাগকে গা করলোনা। সে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো-
“মাকে বলে এসেছি কাজেই তোমার রাগ হওয়ার কোন কারণ দেখি না। তুমি তো মায়ের বাধ্য ছেলে। মা অনুমতি দিয়েছে মানেই তো তোমার কোন সমস্যা নেই।”
সৌরভের রাগ আরেকপ্রস্ত বাড়লো, সে চিৎকার করে উঠলো-
“আমি তোমার স্বামী আমার অনুমতি না নিয়ে তুমি বাড়ির বাইরে গেলে কেন?”
“স্বামী! স্বামী মানে কি শুধু শাসন করার মানুষ? নিজে বাইরে অন্য মেয়েদের সাথে সময় কাটিয়ে আসবে আর বউকে অযাচিতভাবে সন্দেহ করবে, মারবে যা খুশি করবে? স্বামী মানে বোঝো তুমি?”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো ঝিলিক। লম্বা দম নিলো। এপাশে সৌরভ ফুঁসে উঠলো-
“তোমার খুব পা গজিয়েছে ঝিলিক। বড় বাড় বেড়েছো তুমি।”
“শোন সৌরভ, তুমি যদি আমার উপর অমুলক সন্দেহ করা না বন্ধ করো তবে আমি আর ফিরছি না। অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার যথেষ্ট অন্যায় সয়েছি এতোদিন। এমন না যে আমি গরীব, যাওয়ার কোন জায়গা নেই। শুধু ভেবেছি বিয়েটা যেভাবেই হোক হয়েছে সংসার করি। তোমাকেও যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছি নিজেকে শোধরানোর। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল ছিলো। তুমি তো শোধরাবার মতো মানুষই না। তাহলে আমি নিজেকে শুধরে নেই। শুধু শুধু তোমার সাথে থেকে জীবন নষ্ট করবো কেন? এখন আবার ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয় না প্লিজ। নিজের বউয়ের ভিডিও নিয়ে যদি তাকে অপদস্ত করতে চাও তাহলে করতে পারো। নিজেকে এতোটা নিচে নামাতে চাইলে নামাতে পারো। আমার কিছু বলার নেই।”
সৌরভকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝিলিক ফোন কেটে দিতেই সৌরভ ফোন আছড়ে ভাঙলো। এবার রাযীন ফিরে আসার পর থেকেই ঝিলিক বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে। ওর এই সাহসের উৎস কি? রাযীন তো ওর সাথে কথাও বলেনা। তবে? সৌরভ কাপড় না পাল্টেই মায়ের ঘরে উঁকি দিলো-
“মা।”
শিখা মন দিয়ে কিছু কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলো।সৌরভকে দেখে একগাল হাসলো-
“আয়। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরলি মনেহয়?”
সৌরভ মায়ের কাছে এসে বসলো-
“একটা পার্টি আছে রাতে তাই এলাম।”
“আচ্ছা! তোর কাজ কতোদূর এগুলো?”
শিখা চশমা খুলে রাখলো। সৌরভের মন খারাপ ভাব চোখ এড়ালোনা তার।
“অফিসে রেনুর বর নকিব খুব সতর্ক। প্রায়ই অফিসে এসে বসে থাকছে আর এদিক সেদিক গল্প ফেদে বসছে। একাউন্টসে গিয়েও খোঁজখবর করছে।”
শিখা বিরক্ত হলো-
“ভাইজানের এই মেয়ে জামাইদের অফিসে বসানোর ব্যাপারটা আমার একদম ভালো লাগে না। ওদেরকে আলাদা বিজনেস বুঝিয়ে দিলেই হতো।”
সৌরভ হাসলো-
“আমাদের বেনুর বরও কম না। গতদিন আমাকে বলছিলো ওর নাকি লাখ বিশেক টাকা দরকার। কি একটা বিজনেস নাকি করবে বেনু।”
“কই বেনুতো আমাকে কিছু বলেনি? আচ্ছা আমি শুনবো ওর কাছে থেকে। রাজ ফিরতে ফিরতে তোর কাজ এগিয়ে নে। এসব তোর বাবাকে বলে লাভ নেই কারণ তাকে দিয়ে এসব করানো যাবে না।”
সৌরভ মাথা নেড়ে সায় দিলো। ঝিলিকের ব্যাপারটা মাকে বলবে কিনা ভাবছে। শিখা ছেলের ভাব বুঝে নিজে থেকে জানতে চাইলো-
“কিছু বলবি নাকি?”
সৌরভ উসখুস করে-
“ঝিলিক তোমাকে বলে বাড়ি গেছে?”
শিখা মাথা ঝাকালো-
“হ্যা। তোদের মধ্যে কিছু হয়েছে? ওকে ক’দিন ধরে খুব আপসেট দেখাচ্ছিলো।”
সৌরভ বলতে যেয়েও পারে না। মায়ের কাছে বলতে বাঁধো বাঁধো ঠেকে।
“কিছু না হলেই ভালো। মেয়েটা বেশ ভালো। পুরনো সব ভুলে সামনে এগিয়েছে এটাই সবচেয়ে ভালো ব্যাপার। তুই কখনো ওকে এসব নিয়ে কিছু বলে দুঃখ দিস না।”
সৌরভ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারে না। সত্য জানলে মা কি বলবে তাকে?
★★★
বারিধারা খ ব্লকের এই এ্যাপার্টমেন্টটাও রাযীনের বাবার তৈরী। ঢাকায় মাঝে মাঝে এসে থাকতে হতো বলে দুটো ফ্ল্যাট ফাঁকা রেখে বাকীগুলো ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। আত্মীয় স্বজন যে যখন প্রয়োজন হয় ঢাকায় আসে এখানেই থাকে। রুহির ভালোই লাগছে এখানে। গতকাল ঢাকায় এসেই বাবা মায়ের সাথে দেখা করে এসেছে। রাযীনও গেছিলো সাথে। রাতের খাবার খেয়ে ফিরেছে তারা। আজ বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো রুহির। উঠে শাওয়ার নিয়ে রান্নাঘরে এলো চা করবে বলে। সকালে খাবেই বা কি? থরে থরে জিনিস সাজানো আছে। কি বানাবে ভেবে পেলোনা রুহি। আসলে কখনো রান্নাঘরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি তার। গেলেও চা বানানো কিংবা ভাত ফুটানো ছাড়া কখনো কিছু করা হয়নি। রুটি সে বানাতে পারে না। ভাত কি রাযীন খাবে সকালে? রুহি একটা একটা করে বক্স নামিয়ে দেখছিলো কি আছে তাতে। কিছুক্ষন পরেই রাযীনকে দেখা গেলো চোখ ডলতে ডলতে রান্না ঘরে এসে দাঁড়ালো-
“এতো সকালে কি করছো রান্না ঘরে?”
“সকাল! সকাল কোথায় দেখলেন? সাড়ে এগারোটা বাজে। খিদেয় পেট চো চো করছে আমার।”
রুহির কথা শেষ হওয়ার আগেই চুলায় কিছু পুড়ে যাওয়ার গন্ধ পাওয়া গেলো। নিমিষেই রান্নাঘর ধুঁয়ায় ভরে গেলো। রাযীন দৌড়ে এসে রুহিকে হ্যাচকা টানে দূরে সরিয়ে দিয়ে চুলা বন্ধ করলো-
“আজব মেয়ে তুমি? চায়ের পানি চড়িয়ে ভুলে গেলে কেন? এখনই একটা দূর্ঘটনা ঘটলে কি হতো?”
রুহি অপরাধী চোখে নীরবে চেয়ে রইলো। আসলেও সে ভুলে গেছিলো। রাযীন নিজেকে শান্ত করে রুহির দিকে তাকালো-
“তুমি যাও বসে টিভি দেখো আমি হাতমুখ ধুয়ে এসে কিছু বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
রুহি চোখ বড় বড় করে তাকালো-
“আপনি রান্না করবেন?”
“হ্যা। এতে অবাক হওয়ায় কি আছে? গত সাত আট বছর ধরে আমেরিকায় ছিলাম একা। নিজের কাজ নিজেকেই করতে হতো ওখানে। বাইরে খেয়ে তো আর বছর পার করা যাবে না।”
রুহি অবাক চোখে রাযীনকে দেখছে। এই লোক তার অচেনা একেবারেই। চিটাগং এর বাড়িতে কোনোদিন কিছু করতে দেখেনি তাকে। রুহি ইন্টারেস্ট নিয়ে রাযীনের দিকে তাকালো-
“আমি প্লিজ থাকি এখানে? চুপচাপ দাঁড়িয়ে আপনার কাজ দেখবো শুধু। আমি না আসলে তেমন একটা রান্না টান্না পারিনা। মা কখনো রান্না ঘরে যেতে দেয়নি কিংবা প্রয়োজনও হয়নি। এখন দেখি আপনার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারি কিনা।”
রাযীন হো হো করে হাসলো-
“আমার কাছ থেকে রান্না শিখবে তবেই হয়েছে। আমি নিজে কি খুব ভালো রান্না পারি? তবে কাজ চালানোর মতো রান্না পারি অবশ্য। আচ্ছা একটু হেল্প করো। দেখো ফ্রিজে টমেটো ধনেপাতা আর ক্যাপসিকাম পাও কিনা। নিয়ে এসোতো। আমি ততক্ষণে হাতমুখ ধুয়ে আসি।”
রাযীন ঘরে ফিরে গেলো। ফ্রিজ খুলে অবাক হলো। থরে জিনিস সাজানো আছে। এতো জিনিস কে কিনে আনলো? ভাবতে ভাবতে ভেজিটেবল জোনের ডালা খুললো। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বেশি খুজতে হলোনা রুহির। হাতের কাছেই সব পেয়ে গেলো। সেগুলো নিয়ে ফিরে এসে দেখলো রাযীন এরমধ্যেই পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ কুচি করছে। চুলোয় ফুটে ওঠা চায়ের পানি থেকে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়েছে। রুহির হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে রাযীন একে একে সব কুঁচি করে তাতে লবন গোলমরিচ ডিম আর আটা মিশিয়ে গোলা বানিয়ে ননস্টিকি ফ্রাইপেনে রুটির মতো গোল গোল করে ভেজে নিচ্ছে। প্রথমটা প্লেটে তুলে রুহির দিকে বাড়িয়ে দিলো-
“নাও খেয়ে বলো কেমন হয়েছে। লবন ঝাল সব ঠিক আছে তো?”
রুহি হাসি মুখে রাযীনের বাড়িয়ে দেওয়া প্লেট থেকে ভেজে রাখা রুটির এককোনা ছিড়ে মুখে দিতেই চমকে উঠলো। নিঃশব্দে পর পর কয়েকবার মুখে দিয়ে খেতে লাগলো। স্বীকার করতেই হবে জিনিসটা খেতে খুবই সুস্বাদু হয়েছে। কয়েকরকম স্বাদের কারনে রুহি চোখ বুঁজে খাচ্ছে। চোখ খুলতেই দেখলো রাযীন তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে-
“তোমার আসলেই খিদে পেয়েছিল দেখছি।”
রুহি লাজুক হাসলো-
“না আসলে আপনার বানানো জিনিসটা খেতে খুবই মজা লাগলো। আমার মা বানাতো শুধু পেয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে। আমরা এটাকে ঝাল পিঠা বলি।
সেটা অন্যরকম মজা আর এটা একেবারেই আলাদা।”
“আচ্ছা? এতে যত জিনিস দেবে এর স্বাদ তত বাড়বে। আমি আস্তে আস্তে এটা শিখেছি। সহজে বানানো যায় বলে খেতেও ভালো লাগে।”
গল্প করতে করতে আরো কয়েকটা পিঠা বানিয়ে ফেললো রাযীন। দুটো ডিম পোচ করলো। তারপর দু’মগে চা ঢেলে রুহিকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো। রুহি অলরেডি তিনটে খেয়েছিলো, রাযীনের সাথে বসে আরো একটা খেলো। পেট একেবারে ফুল হয়ে গেছে। পানি খেয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো-
“আহ, অনেকদিন পরে শান্তি করে খেলাম।”
“চা টা খাও আরো ভালো লাগবে। এটা শ্রীলংকান চা, ফ্লেভারটা একদমই আলাদা।”
রুহি সোজা হয়ে বসলো-
“এখানে তো কেউ থাকে না তবে এতো বাজার কে করলো?”
“দারোয়ান আছে। ওর কাছে একট্রা চাবি দেওয়া আছে। কেউ আসার কথা থাকলে বউকে দিয়ে বাড়ি পরিস্কার করে, বাজার করে গুছিয়ে রাখে। চাইলে এখন এসে কাজও করে দেবে। ডাকবো?”
“তাহলে তো ভালোই হয়। দুপুরের রান্না করে দিয়ে যাক।”
রাযীন চুপ করে কি যেন ভাবলো তারপর গভীর গলায় বললো-
“আসলে আমি ভাবছিলাম কি যে ক’দিন এখানে আছি নিজেরাই নিজেদের মতো রেদেটেধে খেলাম না হয়। এই যে আজকের মতো। দু’জন গল্প করতে করতে রান্না হয়ে যাবে।”
রুহি ভাবলো ব্যাপারটা মন্দ না। এতে দু’জন দু’জনার সাথে আরো সহজভাবে মিশতে পারবে। নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাড়বে। রুহি নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিলো। মাঝে মাঝে আড়চোখে রাযীনকে দেখছে। আজ রাযীনকে অনেকটা সহজ লাগছে। রাযীন হঠাৎ তাকাতেই চোখাচোখি হলো, রুহি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। রাযীন হেসে দিলো-
“এবার আমার পুরস্কার দাও।”
“কিসের পুরস্কার?”
রুহির কন্ঠে বিস্ময়।
“ওমা! এই যে এতো মজার নাস্তা খাওয়ালাম, কিছু দেবে না আমাকে?”
“ওহহহ, কি চাই আপনার বলুন।”
“আমি বলবো কেন? গিফট দেবে তুমি, তুমি কি দিতে চাও দেবে।”
রুহি ঠোঁট উল্টে বলে-
“আপনার কি চাই তা আমি কি করে বলবো?”
“উহু, আমি বলবো না। তুমি বুঝে নাও আমার কি চাই। আমি অপেক্ষা করবো তোমার উপহারের।”
নাস্তার প্লেট তুলে নিয়ে রাযীন চলে গেলো। রুহি দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবছে রাযীন কি চায় তার কাছে? রাযীনকে তার কি দেওয়ার ক্ষমতা আছে?
চলবে—
©Farhana_Yesmin