না চাহিলে যারে পাওয়া যায় পর্ব-৩৫+৩৬

0
370

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-৩৫

ঝিনুক ম্যাসেন্জারে আসা ছবিটার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সৌরভের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় একটা মেয়ের ছবি। সৌরভ যেমনই হোক এতোটা নিচ তাকে কখনো ভাবেনি। মিসক্যারেজের ঘটনার পর থেকে সৌরভের সাথে তার একরকম দেখানো সম্পর্ক। চারদেয়ালের মধ্যে একে অপরের সাথে কথা বলে না। মাঝে একবার ঝিলিক কথা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু সৌরভের অনাগ্রহে সেকথা বলা আর আগায়নি। এরপর ঝিলিক আর চেষ্টা করেনি। ইদানীং সৌরভ মাতাল হয়ে ফিরে বলে কথা বলার চেষ্টা করে লাভ হয়নি। কিন্তু আজ মনেহচ্ছে যেভাবেই হোক কথা বলা দরকার ছিলো। কথা বললে হয়তো এই দিন দেখতে হতোনা এতো অসম্মান হতে হতোনা। ঝিলিক মোবাইল হাতে নিয়ে ভুতগ্রস্থের মতো বসে রইলো।

“কি ব্যাপার এভাবে বসে আছো কেন?”
সৌরভের জড়ানো কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। হঠাৎ করে যেন ঝিলিকের মাথায় আগুন ধরে, সে মোবাইলের ছবিটা মেলে ধরে সৌরভের সামনে-
“এটা কি? এটাই বুঝি দেখা বাকি ছিলো?”
“কি এমন ব্যাপার যে এতো আপসেট হতে হবে? বিজনেস করলে এরকম একটু আধটু থাকেই।”
ঝিলিক সজোরে চেচিয়ে উঠলো-
“এটা ছোট ব্যাপার? তুমি আরেক মেয়েকে নিয়ে বেডে যাচ্ছ আর আমি এসব নিয়ে কিছু বলবো না? আমি হলে সহ্য হতো?”
সৌরভ কানে দু’হাত চাপে-
“ওহহ প্লিজ চেচিয়না তো। নেশার ঘোর কেটে যাচ্ছে তোমার চিৎকারে।”
ঝিলিকের হঠাৎ কি হলো কে জানে। সে দৌড়ে এসে সর্বশক্তি দিয়ে সৌরভের চুল টেনে ধরলো-
“তুমি বলে আমাকে ভালোবাসো? এই তোমার ভালোবাসার নমুনা? আমাকে কেন বিয়ে করলে তুমি? কেন আমার জীবনটা নষ্ট করলে? বলো জবাব দাও আমাকে। আজ জবাব না দিলে তোমাকে খুন করবো আমি।”
সৌরভ তাল সামলাতে না পেরে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো সাথে ঝিলিকও। ঝিলিকের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইছে। কিন্তু ঝিলিক আজ মরিয়া হয়ে সৌরভের গায়ে সমানে কিল ঘুষি মেরে চলেছে। গায়ের কাপড় টেনেহিঁচড়ে ছিড়ছে-
“বলো শিগগিরই বলো। কেন আমাকে জোর করে বিয়ে করলে? কেন? তুমি জানতে না আমি রাজকে ভালোবাসতাম?”
রাযীনের নাম শুনেই হয়তো টনক নড়ে সৌরভের-
“বেশ করেছি জোর করে বিয়ে করে। কেন করেছি শুনবে? শোনো তবে… ”
সৌরভের কথা শুনে ঝিলিক স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।

★★★

“তোমার কি কখনো মনে হয়েছে আমাকে কিছু বলা দরকার?”
রাযীনের কথায় রুহি বেশ অবাক হলো। ঘুমন্ত ছেলেকে আলতো করে কটে শুইয়ে দিয়ে রাযীনের দিকে ফিরলো-
“হঠাৎ এমন কথা বলার কারন?”
রাযীন একটু শুকনো হাসলো-
“স্পেশাল কোন কারন নেই। অনেকদিন যেহেতু তোমার জীবনে ছিলাম না তাই বললাম আরকি।”
রুহি বিস্মিত হয়ে রাযীনকে দেখলো কিছুক্ষণ তারপর শান্ত গলায় বললো-
“আমার জীবনে আপনি ফিরে এসেছেন তাও তো দু’বছর হতে চললো। এতোদিন পরে আবার পেছনে ফিরে যেতে চাওয়ার কোন কারন খুঁজে পাচ্ছি না। তাছাড়া আমার যা বলা দরকার মনে হয়েছে তা কখনোই লুকিয়ে রাখিনি আপনার থেকে। তাই না?”
রাযীন কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেলো৷ ম্লানমুখে বিছানার উল্টো দিকে যেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। রুহি বেশ অবাকই হলো। আজ রাযীন এমন করছে কেন সে ভেবে পাচ্ছে না। কিছু হয়েছে কি? রুহি এগিয়ে এসে রাযীনের গায়ে হাত দিয়ে কোমল গলায় ডাকলো-
“কি হয়েছে আপনার? মন খারাপ নাকি কোন কারনে? হঠাৎ শুয়ে পড়লেন যে?”
রাযীন রুহির দিকে না ফিরেই উত্তর দিলো-
“তেমন কিছু না। আজ একটু বেশি ক্লান্ত তাই ঘুম পাচ্ছে।”
রুহি আর কিছু না বলে নিজেও শুয়ে পড়লো। তার মনটা খচখচ করছে কেন জানি। রাযীন আজ ফিরেছে বেশ দেরী করে। আসার পর থেকে গম্ভীর হয়ে ছিলো সারাটা সময়। আজ ছেলের সাথে খুব একটা খেলেওনি। রাতে কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করতেই বললো খেয়ে এসেছে। রুহি বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে রাযীনের। কিন্তু কি হতে পারে? বিজনেসে কোন ঝামেলা কি? রুহি বেশিক্ষণ ভাববার সুযোগ পায় না। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে আপনাতেই।

সকালে রুহির ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। রাতে বার তিনেক উঠে রাহিকে খাওয়াতে হয়েছে। এই সকালের সময়টুকুতে তাই খুব গাড়ো ঘুমে থাকে রুহি। চোখ কচলে উঠে দেখলো রাহি কটে নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল দশটা। তারমানে রাযীন অফিসে চলে গেছে। ছেলেকে নিশ্চয়ই শশুরের ঘরে দিয়ে গেছে? রুহি হাসলো, রাগী লোকটা যে তার এমন কেয়ার করবে সেটা ভাবেনি কখনো। সকালে যাতে সে আরামে ঘুমাতে পারে সেজন্য নিজে ছেলেকে রাখে তারপর অফিস যাওয়ার সময় শাশুড়ীর কাছে দেয়। এই সময়ে একটু ফিডার খাওয়ায় রাহিকে। রুহি আরমোড়া ভেঙে ওয়াশরুমে ঢুকলো। হাতমুখ ধুয়ে ঝটপট বেরিয়ে এসে কাপড় পাল্টে চুল আঁচড়ে নিয়ে শাশুরীর রুমের দিকে পা বাড়ালো।
“মা আসবো?”
“কে রুহি? হ্যা এসোনা।”
রোজীর গলা শুনে রুহি দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো-
“মা রাহিকে নিতে এলাম।”
রোজী আলমারি খুলে কিছু একটা করছিলো। এমন কথা শুনে অবাক হয়ে রুহির দিকে ফিরে বললো-
“রাহিকে তো আজ আনিনি। আনতে গেছিলাম, তোমাদের ঘরের দরজা বন্ধ পেয়ে ফিরে এসেছি।”
রুহির বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠলো-
“কি বলছেন মা? রাজ আর রাহি কেউ রুমে নেই দেখে ভাবলাম রাজ মনেহয় অফিস যাওয়ার আগে রাহিকে আপনার কাছে দিয়ে গেছে।”
রাযীন নেই শুনে একটু স্বস্তিবোধ করলো রোজী-
“হতে পারে রাজ নিয়ে গেছে কোথাও। ও যেহেতু নেই বললে। ছাদে টাদে আছে কিনা দেখো।”
রুহি প্রায় ছুটে বেড়িয়ে গেলো। পুরো বাড়ি খুঁজেও রাযীন আর ছেলেকে পেলো না। বাড়ির দুই দারোয়ান কে প্রশ্ন করেও কোন সদুত্তর পাওয়া গেলোনা। হন্যে হয়ে ফোন করতে শুরু করলো কিন্তু রাযীনের ফোনও বন্ধ। রুহির হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। এসব কি হচ্ছে ওর সাথে? কোথায় গেলো ওরা দু’জন? মাত্র দু’মাসের বাচ্চা তার। রাযীন কি কোন কারণে রেগে আছে তার উপর? গতরাতে ঠিক মতো কথা বলেনি। আচ্ছা শুভ কিছু বলেনিতো? অজানা আশঙ্কায় আর ছেলের চিন্তায় রুহির বুকটা হুহু করে উঠলো। সে বাচ্চার জন্য চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো।

রোজীও বুঝতে পারছে না কি হলো? এই সাতসকলে রাজ কোথায় গেলো ছেলে নিয়ে? অফিসে ফোন দেওয়া হলো। নাহ, আজ নাকি অফিসে যায়নি রাযীন। একে একে পুরো বাড়ির মানুষ জেনে গেলো ঘটনা। সবাই চিন্তিত হয়ে ড্রইংরুমে বসে আছে। আফজাল, সৌরভ সবাই নানা জায়গায় ফোন দিয়ে খবর নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারলোনা। রাযীন যেন গায়েব হয়ে গেছে একেবারে। রোজীর এবার সত্যি চিন্তা হচ্ছে। শিখার বলা কথাগুলো কি সত্যি হয়ে গেলো তবে? রাজ কি সব জেনে গেছে? ও কি ছেলে নিয়ে পালিয়ে গেলো? এমন কিছু হলে রোজী সইতে পারবেনা। এক ছেলে মারা গেছে আরেক ছেলে যদি এভাবে দূরে সরে যায় তবে বেঁচে থাকবেন কিভাবে? আর আশরাফই বা এ খবর শুনলে কি করবে? রুহি যদি সব সত্য জানে তাহলেই বা কি করবে? এসব ভেবে রোজীর অসুস্থ অনুভব হলো। হঠাৎ করে মাথা ঘুরতে লাগলো। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই সে চোখে অন্ধকার দেখে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

★★★

শুভ নিজের ঘরে বসেই সব টের পাচ্ছে। গতকাল থেকে তার হৃৎপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালন বেড়ে গেছিলো। নিজের মধ্যে স্হিরতা আনার বহু চেষ্টা করেও পারেনি, সারারাত পায়চারি করে কাটিয়েছে। সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রাজ ভাই এসেছিলো তার কামরায়। শুভ কম্পমান কন্ঠে কিছু বলতে চাইলে রাজ হাত দেখিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। চোখ ভরা জল নিয়ে শুধু একটা কথাই বলেছিলো-
“আমার সাথেই কেন বারবার এমন হয় বলতে পারবি শুভ?”
শুভ মাথা নিচু করে বসে ছিলো। এইপ্রথম নিজেকে অপরাধী মনেহচ্ছিলো তার। বড় ভুল করে ফেলেছে সে। সম্পর্কের লেহাজ ভুলে রুহির পেছনে পড়ে থাকা তার উচিত হয়নি। কেমন করে পারলো এমন করতে? রুহির জন্য কষ্ট হচ্ছিল। তার কারনে মেয়েটা কষ্ট না পায়। এমন হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না কিছুতেই। ঘুম ভাঙার পর যখন রাজের কথা জানলো তখন থেকেই বুকের ভেতরটা খালি লাগছে। সত্যি সত্যি কি ভাইয়া রাহিকে নিয়ে চলে গেছে? শুভর সাহস হলোনা রুম থেকে বেরুনোর, রুহির মুখোমুখি হওয়ার। রুহি যদি ভাবে তার কারনে রাযীন বাড়ি ছেড়েছে? যদি তাকে দোষারোপ করে সবার সামনে? এতোগুলো অভিযোগের দৃষ্টি সইতে পারবেনা শুভ কিছুতেই পারবে না, এতো সাহস তার নেই।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-৩৬

সারাদিন পার হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে তবুও রাযীনের দেখা নেই। রোজীর প্রেশার উঠে অবস্থা এতোই খারাপ যে তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হচ্ছে। এসব দেখে আশরাফ নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। তারউপর ছেলে আর নাতিকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে আশরাফের মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। সে ভুলে গেলো সে অসুস্থতার নাটক করছিলো। সব ভুলে উত্তেজনায় নিচতলায় চলে এলো। বাড়ির মানুষগুলো বিস্ময় নিয়ে আশরাফকে দেখতে লাগলো। আশরাফ বিরক্তি নিয়ে জানতে চাইলো-
“কি? কি দেখছিস এমন করে?”
“ভাইজান! আপনি হাঁটতে পারছেন? সুস্থ হয়ে গেলেন নাকি?”
আফজাল বিস্মিত কন্ঠে জানতে চাইলো। আশরাফ মুখ কুঁচকে বললো-
“অসুস্থ হইনি কখনো। ছেলেকে কাছে আনার জন্য এতো নাটক করলাম আর সেই ছেলেই আজ আমার সবকিছু নিয়ে পালালো।”
আফজাল এখনো হজম করতে পারছে না আশরাফের মিথ্যাচার। তার আর কিছু বলার রুচি হয়না। সে চুপচাপ চোখ বুজে বসে থাকে।
“এসব কিছুর জন্য তোর বউ দায়ী। সেই পুরনো কাসুন্দি ঘাটছে এখনো। বারবার বলছি আমার ভুল হয়েছিলো তখন তবুও আমার ছেলেটাকে রেহাই দিলো না। পাঁচ বছর ছেলেটা দেশেই এলোনা। এবার এতো কষ্ট করে দেশে আনলাম কিন্তু তোর বউয়ের হিংসা থেকে বাঁচাতে পারলাম না।”
আফজাল আড়চোখে শিখাকে দেখলো। ওর মধ্যে কোন হেলদোল নেই। শিখা ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে চুপচাপ বসে মজা দেখছে। ঝিনুককে কোথাও দেখা গেলোনা। রুহি চমকে একবার শশুরকে আরেকবার শিখাকে দেখলো। ছেলের কথা মনে এলেই তার চোখ থেকে আপনাতেই জল গড়াচ্ছে। আশরাফ এগিয়ে এলো রুহির দিকে, ওর মাথায় হাত রেখে বললো-
“মারে, আমাকে মাফ করে দিস। আমি তোর জীবনটা বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছি। অথচ আমি মন থেকে চাই তুই আর রাজ একটা সুখী জীবন কাটা। আমাকে মাফ করিস রে মা, মাফ করিস।”
রুহি কিছু বলতে পারলোনা কেবল গুমরে কেঁদে উঠলো।
আশরাফ পূনরায় শিখার কাছে এগিয়ে এলো-
“তুমি কি চাও বলোতো? অতীতে যা ঘটেছিলো তাতে কি তুমি একাই কষ্ট পেয়েছিলে আমরা পাইনি? কেন এমন করছো? তুমি একাই মা? কষ্ট শুধু তোমারই হয়? রোজীর কষ্টের কথা একবারও ভাবলে না? ও বেচারি কতোগুলো বছর ধরে তোমার এসব অত্যাচার সইছে বিনাবাক্যে কখনো ভেবেছো এসব?”
শিখা কোন জবাব দিলো না। আশরাফ আবার বলতে শুরু করলো-
“বাবার ইচ্ছে ছিলো আমরা যেন সবাই একসাথে থাকি। একই পরিবারে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে বাবার মত ছিলোনা কখনোই। আমি তার বড় সন্তান হয়ে চেষ্টা করেছিলাম তার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার। আলিফ আর নুূরীর ব্যাপারে এটাই আমার ভুল ছিলো। আমি আলিফকে মানা করি, বলি এরকম বিয়ে সম্ভব হবে না। আমার ছেলে যে সে কথা মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যা করবে সেটা তো আমি বুঝিনি। বুঝলে কি ওকে এ কাজ করতে দিতাম? আর নুরীও তো আমার মেয়ে। নুরী আলিফের শোকে পাগল হবে এটা কি জানতাম কখনো? কতো আদরে সোহাগে ছেলে বড় করেছিলাম সেই ছেলে অকালে চলে গেলো তোমার কি মনেহয় বাবা হিসেবে আমার কষ্ট লাগেনি? হ্যা আমার ভুল হয়েছিলো, ভেবেছি বাচ্চা মানুষ হয়তো আবেগে এমন করছে। বুঝিয়ে বললে বুঝবে ব্যাপারটা। ওরা যে এমন বুঝবে সেটা তো আমার ধারণায় ছিলোনা। যদি বুঝতাম তবে কখনোই এমন কিছু করতাম না। কিন্তু তুমি কি করেছো বলতো? এই ঘটনার পরে কতোবার নিজের ভুল স্বীকার করেছি তবুও তোমার মন গলেনি। ছোট বেলার থেকে ঝিলিক আর রাজ একসাথে, ওরা দু’জন দু’জনকে পচ্ছন্দ করে। সেই ঝিলিককে তুমি সৌরভের সাথে বিয়ে দিয়েছো আমি কিন্তু কিছু বলিনি। আমার ছেলে কষ্ট পাবে তবুও আমি চুপ থেকেছি যাতে তুমি শান্তি পাও। কিন্তু তুমি শান্তি পাওনি। তুমি রেনুর জীবনে অশান্তি করতে চেয়েছো তবুও আমি চুপ থেকেছি। ভাবলাম আফজালকে অফিস চালানোর দায়িত্ব দিলে হয়তো তোমার ক্ষোভ করবে। আমার দু’টো উদ্দেশ্য ছিলো। এক. ছেলেকে দেশে আনা দুই. ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া যাতে আফজাল সৌরভ সবকিছু দেখভাল করতে পারে। ওরা যেন মনে না করে আমি ওদের চাকর খাটাচ্ছি। রোজীকেও বললাম সংসারের চাবি তোমার হাতে দিতে। এসব কিছুই কিন্তু তোমাদের খুশি করতে। অথচ তোমরা এসব পেয়ে ভেবেছো আমরা মনেহয় দোষ লুকানোর জন্য এমন করছি। তোমরা আমাদের অপরাধী ভাবতে শুরু করো অথচ আমরা কোন অপরাধ করিনি। যাইহোক, এসবে আমার অভিযোগ নেই কোন। তুমি নিজের হিংসা চরিতার্থ করার জন্য এই নিরপরাধ মেয়েটাকে সাজা দিচ্ছ আমার ছেলেটার মন দ্বিতীয়বারের মতো ভেঙে দিয়েছো। এটা কি ঠিক কাজ করেছো বলে মনেহয় তোমার? আর এতোকিছু করার পর তোমার কি মনেহয় এবার আমি চুপচাপ তোমার এসব কীর্তি মেনে নেবো?”
শিখা একটু নড়েচড়ে বসলো। আফজাল বউয়ের দিকে বিরক্তিভরে তাকালো। ভাইজান রেগে গেছে মানে এবার আসলেই খবর আছে শিখার। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভাবলো এই বয়সে এসে পৈতৃক নিবাস থেকে বিতাড়িত হওয়াটা মোটেও সুখকর হবে না। আশরাফ আবার মুখ খুললো-
“তুমি তোমার হিংসা তোমার সন্তানের মধ্যে সংক্রামিত করেছো। নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা ভেঙে নিজের মতো কিছু করার বুদ্ধি সৌরভকে তুমি দিয়েছো জানি। কিন্তু আমার কষ্ট লাগলো সৌরভের ব্যবহারে। ওকে আমি বিবেচক ভাবতাম কিন্তু ও তোমার সাথে ভেসে গেলো।”
সৌরভ অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের মুখ লুকালো।
কথাগুলো বলে আশরাফ খানিকক্ষণ থামলো। আলগোছে চোখে আসা জল মুছলো। তারপর ঠান্ডা গলায় বললো-
“আফজাল, শিখাকে নিয়ে তোরা নাসিরাবাদের বাড়িতে শিফট হয়ে যা। একসাথে থাকার জন্য যখন এতোকিছু তখন আর একসাথে না থাকাই ভালো। বাবার ইচ্ছে পূরণে আমি ব্যর্থ এটা মেনে নেবো আমি। আমি চেয়েছিলাম দু’ভাই একসাথে থাকবো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কিন্তু তা আর হলোনা। আমি মেনে…”
“বাবা!”
আশরাফ চমকে পিছু ফিরে খুশিতে চিৎকার করলো-
“রাজ! বাবা, তুই ফিরে এসেছিস?”
রুহি চিৎকার করে দৌড়ে এসে রাযীনের কাছ থেকে নিজের ছেলেকে কেড়ে নিলো। ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের গোটা শরীরে চুমু দিতে লাগলো। বুকে জড়িয়ে ধরে দৌড়ে দোতলায় নিজের কামরায় চলে গেলো। রাযীনের সাথে একটা কথাও বললো না এমনকি একবারও ফিরে তাকালো না। জানার আগ্রহও দেখালো না যে রাযীন কেন বাড়ি ছেড়ে গেলো। রাযীন চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটা দেখলেও একটা আওয়াজও করলোনা। রুহি চলে যেতেই আশরাফ ছেলের হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন-
“রাজ, তুই যদি আজ সত্যিই চলে যেতিস তবে আমার মৃত্যু ছাড়া গতি ছিলোনা। একটা মেয়েকে কয়বার কষ্ট দেওয়া যায় তুইই বল? আর যা কিছু হয়েছে বা হচ্ছে তাতে রুহির কোন দোষ নেই বাবা। তুই অনেক বড় পাপ থেকে বেঁচে গেলি আব্বু সেই সাথে আমাকেও বাঁচিয়ে দিলি।”
রাযীন শক্ত গলায় জবাব দিলো-
“অল থ্যাংস টু ঝিলিক। ও আমাকে বোঝালো এভাবে পালিয়ে গেলে আমি কি কি হারাবো। তা না হলে এতোক্ষণ আমি হয়তো আকাশে থাকতাম।”
আশরাফ ঝিলিকের দিকে তাকালো-
“মারে, তুই আমাকে ঋণী করে ফেললি। আমি আজন্ম তোর এই ঋনের বোঝা নিয়ে থাকতে চাই তোর কোন সমস্যা নেই তো?”
ঝিলিক আশরাফের পানে চেয়ে আস্বস্ত হাসি হাসলো। সৌরভের মেজাজ ততোক্ষণে খারাপ হয়ে গেলো। ঝিলিকের পরোপকারীতা দেখে সে যারপরনাই বিরক্ত। মেজাজ নাকের ডগায় এসে বসে রইলো। মনেমনে বললো, রুমে যেয়ে নেই খালি তারপর তোর খবর নিচ্ছি। পুরনো প্রেমিকের প্রতি টান এখনো কমেনি দেখছি? ঝিলিক যেন সৌরভের মনের খবর বেশ ভালো ভাবেই টের পেলো। সে সৌরভের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো একটু। সৌরভ সে হাসির মানে না বুঝে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো ঝিলিকের দিকে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin